‘তোমার উজ্জ্বল জলরাশিতে মুগ্ধ করেছ আমায়, তাই তো অবচেতন মনে ছুটে চলি তোমার ঐ দূর নীলিমায়।’
মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালির কথায় ‘যার মাঝে স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কৌতূহল নেই, সেই হয়ত নপুংসক নয়ত জন্তু-জানোয়ার।’
তবে, আমি নই নপুংসক কিংবা জন্তু-জানোয়ার। আমি একজন পরিপূর্ণ আবেগ আর বিবেকের সংমিশ্রণ হৃদয়ের গড়া স্রষ্টার সৃষ্টি দেখার পাগলপারা এক সাধারণ মানুষ। অবচেতন মনে সুযোগ খুঁজি নতুন নতুন জায়গা গিয়ে ঘুরে আসার আর নতুন নতুন সৃষ্টির রহস্যের সাথে পরিচিত হওয়ার।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে স্বনামধন্য একটা কোচিং সেন্টারের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম। সেই কোচিং হতে প্রতি বছর কোচিং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মানসিক প্রশান্তির অজুহাতে কোথায় না কোথায়ও ঘুরে আসতে হয়। তাদের গত বছরের সিলেট ভ্রমণে তাদের কোচিংয়ের সদস্য না হয়েও আমার ঘুরে আসার সুযোগ হয়। সেটা আরেকদিন সিলেট ভ্রমণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রবালের দেশেসেই কোচিংয়ের বর্তমান সহকারী পরিচালক হিসেবে অনেকে আমাকে অনুরোধ করছে আমি যেন পরিচালককে দূরে কোথায়ও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করাই। তখন তারা বলল হয়ত সেন্টমার্টিন নয়ত সুন্দরবন ঘুরতে যেতে। তাদের অনুরোধ রক্ষার্থে আর আমারও নতুন কোথায়ও ঘুরতে যাওয়ার খায়েশ পূরণ করতে পরিচালক এবং প্রধান পরিচালককে রাজি করিয়ে জানুয়ারির ২১ তারিখ দিনক্ষণ ধার্য করলাম।
শুরু হলো সেন্টমার্টিন যাওয়ার প্রস্তুতি আর দিবাস্বপ্নে বিভোর হচ্ছি সেন্টমার্টিনের নীলাভ পানির বুকে ভেসে যাওয়া লঞ্চের দৃশ্য ভেবে। সেন্টমার্টিনের ভ্রমণকে স্মৃতিময় রাখার জন্য কোচিং-এর সদস্যসহ অন্যান্য মেহমানদের জন্য ২০টা টি-শার্ট এবং ব্যানার অর্ডার করলাম। আর টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য লঞ্চের টিকেট খরচ, থাকা-খাওয়া বাবদ সব দায়িত্ব কেয়ারি লঞ্চের একজন সমন্বয়ককে অফার সিস্টেমে অর্ডার দিয়ে দিলাম।
প্রবালের দেশেআমার কলেজের প্রভাষক শফিউল স্যারকে যখন বললাম সেন্টমার্টিন কেমন তখন তিনি বললেন অনেক সুন্দর তবে তার সৌন্দর্য পুরোটাই উপভোগ করার জন্য একদিন কখনো যথেষ্ট নয়। তাই আমরা সেখানে একরাত থাকার সিদ্ধান্তে ২১০০ টাকার অফারটা নিয়ে ২১ তারিখ রাত ১টায় এস আলম গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করি।
আমি, আমার বন্ধু ফরিদ, কোচিং এর প্রধান পরিচালক আমজাদ ইলাহী ভাই এবং সাবেক পরিচালক রমিজ ভাইসহ চট্টগ্রাম শহরের সিনেমার প্লেসের এস আলম বাস কাউন্টার হতে গাড়িতে উঠি। বাকি ১৬ জন সদস্য পটিয়া বাস স্টেশনে ফুলকলির সামনে থেকে ওঠে। সাথে সেন্টমার্টিন গিয়ে ফুটবল খেলার জন্য একটা ফুটবল এবং পথিমধ্যে গাড়িতে ক্ষিদে লাগলে ক্ষিদে নিবারণ করার জন্য কেক, বিস্কুট আর পানি ক্রয় করা হলো। শীতের দখলদারিত্ব সেখানে বিদ্যমান থাকায় প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় সঙ্গে না রাখার মতো ভুল আমরা কেউ করিনি। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে সাথে আমরা ঘুমিয়ে আবার কেউ প্রবালের দেশ দেখার উত্তেজনা নিয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকারত আছে।
প্রবালের দেশেরাত ৩টা ৩০ মিনিটের দিকে গাড়ি কক্সবাজার লিংক রোডের মোড়ে যাত্রাবিরত করে ১০ মিনিটের জন্য।সেখান থেকে অন্য সদস্যদের জন্য কলা আর যারা বুমি করতে পারে তাদের জন্য ৫৫৫ আচার নিই। বাসে উঠে সবাইকে কলা আর কেক-পাউরুটি দিই। কিছু নাস্তা পেছনের সিটের ছোট যাত্রীদের দিই।
অসংখ্যবার কক্সবাজার আসার সুবাদে লিংক রোড ক্রস করে যাওয়া হয় তবে এই রোডের ভেতরে তেমন যাওয়া হয়নি। তাই লিংকরোড হতে নতুন জায়গা দেখার লোভে আর ঘুমাইনি। রোডটা তেমন প্রশস্ত নয় তার সাথে রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট টিলা আর গাছ দ্বারা আবৃত। রাতের সাদা কুয়াশায় রাস্তা দেখা যাচ্ছে না বললে চলে কিন্তু গাড়ির লাইটের তীব্রতায় কুয়াশাগুলো পরাজিত হয়ে আমাদের আগমনকে সহজ করে দেয়। নীরব নিস্তব্ধ সারা পথ আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশনে দুই একটা চা-পানের দোকান খোলা আছে। সম্পূর্ণ রাস্তায় আমাদের গাড়ির মতো কিছু নৈশবাস ছাড়া আর কোনো কৃত্রিম অস্তিত্ব অবলোকন করা যাচ্ছিল না। ঠিক ৫টার একটু আগে টেকনাফ স্টেশনের আগে সেন্টমার্টিনগামী লঞ্চঘাটে গাড়ি হতে নেমে যাই। সেখানে থাকা মসজিদে সবাই ফজরের নামাজ আদায় করে পাশের দোকানগুলোতে যাই নাস্তা করার জন্য। দোকানের নাস্তাগুলোর নাম শুনতে ভালো দেখালেও খেতে গেলে বিশ্রী স্বাদে খাওয়া যায় না। আমি দোকানদারকে বললাম সবাইকে ভুনা খিচুড়ি দেয়ার জন্য। প্রতি প্লেট খিচুড়ির দাম ৬০ টাকা করে। ভাবলাম মাংস বা ডিম দিয়ে হবে। দেয়ার পর দেখি চালগুলোকে তেল, পেঁয়াজ, মরিচ আর হলুদ দিয়ে খিচুড়ি বলে সামনে আপ্যায়ন করল। কি আর করা ‘ক্ষিদের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় আর পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো এক রুটি।’ অনেক কষ্ট করে খাওয়া শেষ করতে ৬টা পার হয়ে গেল তবে লঞ্চ ছাড়বে ৮টার পর। মধ্যবর্তী দুই ঘণ্টা সবাইকে নিজের মতো করে ঘুরাফেরা করতে বলে আমি যাই সকালের ফ্রেশনেসের জন্য।
প্রবালের দেশেবলা বাহুল্য সেখানকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা তুলনামূলক অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সবাই নিজের মতো করে ঘুরাফেরা করেছে আমিও টুপির দোকান দেখতে পেয়ে ট্যুরিস্টেও বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্য হাজির করার জন্য একটা ২৫০ টাকা দিয়ে টুপি ক্রয় করলাম। সাথে সাথে মাথায় দিয়ে নিজের মাঝে একটু ট্যুরিস্টের ভাব নিতে শুরু করলাম। পরে ৮টার আগে সবাই কেয়ারি লঞ্চ ঘাটে চলে আসি কিন্তু লঞ্চের অন্যান্য যাত্রীরা লঞ্চের ওঠার পথে প্রবেশ করতে পারলেও আমরা প্রবেশপথে আটকে যাই। লঞ্চের টিকেট আমাদের হাতে না থাকার জন্য প্রবেশাধিকার পত্রটা আমরা পাইনি। সবার মাঝে উৎকণ্ঠা আর এদিকে লঞ্চ ছাড়ার সময় বাকি আছে মাত্র ২০ মিনিট। সবাই মনে করেছে আমি কি ভুল মানুষের সাথে চুক্তি করছি। টাকার বড় কথা নয়, ভ্রমণটা মাটি হবে সেটা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায়। আমি সেই সমন্বয়কসাজ্জাদ ভাইকে কলের ওপর কল দিচ্ছি। কিন্তু উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন উনাকে ছাড়া লঞ্চ ছাড়বে না।
অবশেষে লঞ্চ ছাড়ার ৩ মিনিট আগে উনি এলেন আর আমরা টিকেট নিয়ে নিজ নিজ আসন অলঙ্কৃত করেত সেন্টমার্টিন ভ্রমণটা নিশ্চিত করলাম। প্রথম লঞ্চ ভ্রমণ এবং নতুন জায়গা দেখতে কৌতূহলবশত লঞ্চ ছাড়ার পর থেকে আমি আর লঞ্চের নির্ধারিত আমার আসনে বসিনি। প্রধান পরিচালক আমজাদ ভাইসহ লঞ্চের চারপাশে ঘুরাফেরা করেছি। আর ইচ্ছে মতো ছবি তুলেছি। আমজাদ ভাই একবারে ১০-১৫টা ছবি তোলায় কিছু ছবি কাকতালীয়ভাবে অসাধারণ হয় আর সেন্টমার্টিন থেকে আসার সময় দেখি আমার মোবাইলের মেমোরিতে সেন্টমার্টিনের ১৫০০ ছবি জমা হয়ছে।
ঘুরাঘুরির সময় সমন্বয়ক সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি সেখানকার কর্মকর্তা হওয়ায় তার সুবাদে লঞ্চে বিভিন্ন ক্লাসে গিয়ে নিজের মত লঞ্চ ভ্রমণটা উপভোগ করলাম আর একটু পরপর কফি, চিপস বা অন্য কিছু খেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরপর লঞ্চের মাইক থেকে আমাদের পাশ দিয়ে থাকা বার্মার সীমান্ত, শাহপরীর দ্বীপসহ অনেক কিছু সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেন। নিজেদের ইচ্ছামত পুরা লঞ্চ ভ্রমণটা আমি আর আমজাদ ভাইয়ের সাথে চারপাশ ঘুরে ঘুরে উপভোগ করি এবং আকর্ষণীয় স্থানগুলো ছবির দ্বারা সংরক্ষণ করে রাখি। বেলা ১টার দিকে আমরা সেন্টমার্টিন লঞ্চ ঘাটে পৌঁছি। দেখি লঞ্চ ঘাটে প্রকৃতিপ্রেমী হাজারো মানুষের ঢল। সারা রাস্তায় মানুষের মিছিলের রূপ লাভ করে। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ ভ্রমণ করতে যায় তাদের অবাধ বিচরণের ফলে সেখানকার প্রকৃতি বিলীন হতে চলেছে তাই সরকার এখন অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ জন করে সেন্টমার্টিন যাওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়।
সমন্বয়ক সাজ্জাদ ভাইয়ের নির্দেশনায় আমাদের জন্য বুকিং দেয়া আবাসিক হোটেল ‘সি ইনন’-এ যাই। হোটেলটা দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে। চারপাশে সবুজ গ্লাসে আবদ্ধ মনোরম একটা পরিবেশ। প্রতি রুমে চারজন করে পাঁচ রুমে সবাইকে বুকিং দিয়ে নিজেদের মত ফ্রেশ হয়ে পাশের মসজিদে নামায আদায় করে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে যাই। অফারের মধ্যে খাবারের মেনু ছিল লাঞ্চে মাছ বা মুরগির মাংস, সবজি, আলুর ভর্তা, ডাল আর রাতে বার বি কিউর সাথে পরাটা। অফার ছাড়াও আসা যায় কিন্তু তাতে খরচ বেশি যায় তবে নিজের স্বাধীনতা থাকলেও অনেক কিছুই অনিশ্চিত থেকে যায়। তাই অফারে আসাটা তুলনামূলক ভালো কিন্তু বিশ্বস্ত না হলে অনেক সময় থাকা-খাওয়াতে সমস্যা হয়ে যায়।
প্রবালের দেশে২২ তারিখ দুপুরের খাবার খেয়ে পাশে রেস্টুরেন্টের রেস্ট স্পটের মাঝে সবার নিজের মতো করে রেস্ট নিয়ে ফুটবল খেলার জন্য প্রস্তুতি নিই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আশপাশে কিছু গ্রুপ ছবি তুলে সবাই সমুদ্রের বালুচরে চলে যাই ফুটবল খেলতে। দুই টিম করে ফুটবল খেলা আরম্ভ করলাম। সবাই খুশি মতো ফুটবল খেলেছে আর ইচ্ছে মতো ফাউল করে যাচ্ছে। আমাদের অফিস সহকারী রুকন অহেতুক আমাকে ফাউল করে পায়ে ইনজুরি করে দিল। ক্রিকেট মোটামুটি খেলতে ইচ্ছে করলেও ইনজুরি হওয়ার ভয়ে ফুটবল খেলার প্রতি আমার যতসব অনীহা।
ইনজুরি পায়ে আর না খেলে সমুদ্র স্নানে যোগ দিলাম। জোহরের সাথে আসরের নামাজ কসর পড়ার সুবাদে মাগরিবের আগে পর্যন্ত নীলাভ নুনতা পানিতে সাঁতার কেটে, ডুব দিয়ে আর ঢেউয়ের তালে লাফ দিয়ে নিঃসঙ্গ সমুদ্রকে সঙ্গ দিলাম। হোটেলে এসে মিঠা পানিতে গোসল করে মসজিদে গিয়ে মাগরিব আর এশার নামায কসরে আদায় করি। সবাই একসাথে নামায আদায় করে বাজারের একটা দোকানে নাস্তা করি। ৬ষ্ঠ-৭ম শ্রেণীর কোর্স পরিচালক মিজানকে কেরোসিন আর লাকড়ি জোগাড় করার দায়িত্ব দিয়ে সবাই রাতে আকাশে চাঁদের আলো ভরা সমুদ্রসৈকত দেখতে চলে এলাম। মিজান আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করলে আমাদের সাথে আনা সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে সেখানে ছোট্ট পরিসরে একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করি। সৈকতের শীতল বাতাস আর চাঁদনির রাতটা আমাদের আয়োজনের মাঝে একটা শৈল্পিকতা যুক্ত করল। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় সবাইকে কিছু না কিছুতে অংশগ্রহণ করার জন্য বাধ্য করা হলো। আমিও শব্দদূষণ করে একটা সঙ্গীত গাইলাম। তালি তেমন না পেলেও আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য পর্যটকরা অনেকে আমাদের সাথে যুক্ত হন। প্রশান্তির শীতল বাতাসের সাথে সাগরের গর্জন, প্রকৃতির মৃদু চাঁদের আলো আর কেরোসিন ও লাকড়ির সংমিশ্রণের জ্বলা আগুন তখনকার পরিবেশকে উপভোগ্য করে তুলে।
কিছুক্ষণ সঙ্গীত, কৌতুক আর হাসাহাসি করার পর চার-পাঁচজন মিলে সৈকত হয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সামনে গিয়ে দেখি এক লোক সৈকতের মাঝে এখন সাগর হতে ধরা মাছগুলো ফ্রাই করে বিক্রি করছে। হরেক রকমের বিভিন্ন সাইজের মাছগুলো তুলনামূল চড়া দামে বিক্রি করে। আমাদের সাথে থাকা সবাই বলল মাছ ফ্রাই খাবে, যার অর্ধেক টাকা আমার দিতে হবে বাকিটা অন্যরা দিবে। পরিশেষে ছোট একটা কোরাল মাছ ৪৫০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে তাজা সমুদ্রের মাছের স্বাদ নেয়ার জন্য সবাই একটু একটু খেলাম। যাওয়ার পর পাশের ডাবের দোকান থেকে পাঁচজন মিলে দুটো নারিকেলসহ ডাবের টানি পান করে রওনা দিলাম রাতের খাবার খেতে।
রাতের খাবার বার বি কিউ খেয়ে সবাই হোটেলে এসে নিজ নিজ কক্ষে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে প্রবেশ করি। তবে, এখানে এগারোটার পর আর বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সবার বিদ্যুৎনির্ভর মোবাইল ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি চার্জে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তবে আজ রাতের সৈকতের ক্যাম্প ফায়ারের সমুদ্র গর্জনের মিশানো শীতল বাতাসের মিশ্রিত আগুনের শিখাটা আমার মনে দাগ লেগে আছে। জীবনের অসম্ভব সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালাম তখন। তবে পরের দিনের সকালটা যে আমার জন্য স্মরণীয় কিছু থেকে থাকবে তা কল্পনা-ই করিনি।
পরের দিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সবাই নিজ নিজ রুমে ফজরের সালাত আদায় করে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত হয় সবাই নিজের মত করে বাইসাইকেল বা হেঁটে ঘুরাফেরা করে ৮টার দিকে রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা করতে আসবে।ত আমি আর প্রধান পরিচালক আমজাদ ভাই একসাথে ঘুরতে বের হই। প্রথমে লঞ্চঘাটে সূর্যোদয় দেখতে এসে সেখানে ডাবের পানি পান করে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুর করি। আমজাদ ভাই গতবার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার প্রতিনিধি হয়ে সবার আসার গল্প করছিল। তবে, সেই বার আমিও ডেলিগেট ছিলাম কিন্তু অনার্স ৩য় বর্ষের পরীক্ষা থাকায় আসতে পারিনি। আমজাদ ভাই বলছিল গতবার একদিনের জন্য আসায় তেমন ঘুরতে পারেনি কিন্তু এবার ভালো করে ঘুরতে পারছে।
দুইজনে কথা বলতে বলতে দক্ষিণের সৈকত হয়ে হাঁটতে থাকি। কিছু দূর যাওয়ার পর নৌবাহিনীর একটা ক্যাম্পে জালের তৈরি একটা দোলনা গাছে বাঁধানো ছিলো। কিছুক্ষণ সেখানে রেস্ট নিয়ে আবার দক্ষিণের সৈকতে হাঁটতে শুরু করি। আর পথিমধ্যে নজরকাড়া দৃশ্যগুলো দুইজনে একে অন্যের ক্যামেরাম্যান হয়ে মোবাইলে সংরক্ষণ করি। উনি আমাকে বলেছেন পাশের ছেঁড়াদ্বীপের কথা যা বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের স্থলাংশ। বলেছেন সেখানে যেতে লঞ্চ ঘাট হতে ৮০০-১০০০ টাকা দিয়ে বোট নিয়ে যেতে হবে। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ঝামেলা মনে করায় বোটে যাওয়ার জন্য ইচ্ছাপোষণ করলাম না। সামনে হাঁটতে হাঁটতে দেখি নারকেল জিনজিরার নারকেল গাছের সারিবদ্ধ নারকেল গাছের বাগান। মনে হচ্ছে যেন আমাদের বরণ করার জন্য পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আরো হাঁটার পর দুই চাকার স্রষ্টা প্রদত্ত গাড়িটার জ্বালানি শেষ হওয়াতে পাশের বাড়ির ভেতরের দোকানে গিয়ে আবার কচি ডাবের পানি পান করি। কিন্তু সেখানে ডাবে চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হওয়ার পরও ডাবের দাম তুলনামূলক বেশি। এখানে এসে বাজার অর্থনীতি অকার্যকর প্রমাণিত হলো। ডাব খেয়ে সামনে হেঁটে দেখি কিছু দূর পর আর স্থলভাগ নেই। ভাবলাম সেইটাই হয়ত ছেঁড়াদ্বীপ। কিন্তু তা শুধুই মরীচিকা ছিল। আরেকটু সামনে গিয়ে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করি সামনেরটা ছেঁড়াদ্বীপ কি না। কিন্তু উনার না সূচক জবাব আমাদের দুইজনকে হতাশ করে দিয়ে বলল, সেখান থেকে ছেঁড়াদ্বীপ আরো এক ঘন্টার পথ। এখন আরাফবাসীর মত মাঝখানে অবস্থান করায় ভাবলাম পেছনে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তখন আমজাদ ভাইকে বলছি কতজন কত কিছু করে। কেউ করে এভারেস্ট বিজয় আবার কেউ করে সাহারা বিজয়। আমি বলি, চলেন আজ আমরা ছেঁড়াদ্বীপ বিজয় করে আসি। উনার মুখে হ্যাঁ শব্দটা বের হওয়ার সাথে সাথে গায়ে জড়ানো শীতের কাপড়টা কোমড়ে বেঁধে ছেঁড়াদ্বীপ বিজয়ের জন্য পা বাড়াই।
শেষে সেন্টমার্টিন এবং ছেঁড়াদ্বীপের মাঝখানে গলাচিপা নামক স্থানে গিয়ে একজন মানুষকে জিজ্ঞাসা করি সামনের জায়গাটা কি ছেঁড়াদ্বীপ। তিনি হ্যাঁ সূচক শব্দ বলার সাথে আমাদের সতর্কতার জন্য বলেন, গেলে তাড়াতাড়ি যান কারণ একটু পর জোয়ারের পানি এসে এখানে পানিতে ভরে যাবে তখন আর আসতে পারবেন না। তখন আমাদের নাকি বোট নিয়ে আসতে হবে। তাড়াতাড়ি গলাচিপা অতিক্রম করে ছেঁড়াদ্বীপ পৌঁছলাম। সেখানে সম্পূর্ণ এলাকাজুড়ে একটা মাত্র পরিবারের বসবাস। ঐ পরিবারের কুঁড়েঘরের পাশে একটা ছোট্ট দোকান আছে। সেখানে যাওয়ার আগে কাঠের একটা স্তম্ভের মাঝে লেখা আছে ছেঁড়াদ্বীপে একটা পরিবার’ সাথে বাঁশ দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই এলাকাটা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের স্থলভাগ। সেটাকে সামনে নিয়ে ছেঁড়াদ্বীপ বিজয় করার সার্থকতাকে স্মরণীয় করার জন্য ছবি উঠিয়ে দোকান থেকে ডাব আর বিস্কুট খাই। আসার সময় তিনটা চিপস নিয়ে খেয়ে খেয়ে আসি। গলাচিপা এলাকার এসে আমজাদ ভাইকে বলছি, আসছি পূর্ব দিকে যাবো পশ্চিম দিকে। তাহলে ৮ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপের পুরোটায় আমরা দেখতে পারব। উনি রাজি হওয়াতে পশ্চিম দিকে আসার জন্য পথ ধরলাম। তবে গলাচিপার পশ্চিম পাশটা এত যে সুন্দর তা কল্পনাও করিনি। বিশাল বিশাল পাথর আর মৃত প্রবালের স্তূপগুলো এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা ভাঁজ করে আটকে আছে দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পী নিজের হাতে তা সাজিয়ে রাখছে। পাথরগুলোর ওপর ওঠে দুই হাত প্রসারিত করে সেই শিল্পীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আকাশের দিকে তাকাই সেটা আমজাদ ভাই ক্যামরায় ধারণ করে রাখেন। সেখানকার হরেক রঙের শামুকের চোয়াল নিই এবং একটি ছোট আর একটা বড় মৃত প্রবাল নিই। কিন্তু আমার মাথায় ছিল না এতবড় প্রবালটা নিয়ে আমার ৪ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তার সাথে পুব দিকের সৈকতটা ছিল বালুকাময় কিন্তু পশ্চিমের সৈকতটা পুরোটাই বড় বড় পাথর আর সাগরের ভেসে আসা উচ্ছিষ্টের স্তূপ। একটু কষ্ট হলেও হাঁটছি কিন্তু আমার সাথে থাকা বড় প্রবালটা গলার কাঁটা হয়ে গেছে। সুন্দরের লোভে রেখে আসতেও পারছি না আবার কষ্টের জন্য বহনও করতে পারছি না। কি আর করা, প্রবালটাকে কাপড় দিয়ে বেঁধে কিছুক্ষণ হাতে, কিছুক্ষণ কাঁধে আবার কিছুক্ষণ মাথায় নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোসকা পড়ে যায় তাই জুতা দুটো হাতে নিয়ে বালুময় সৈকত হয়ে জোয়ারের আসা পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কত রেস্ট হাউস ফেলে এলাম কিন্তু আমাদের রেস্ট হাউজের পথে পৌঁছতে পারলাম না। পথিমধ্যে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের ‘সমুদ্র বিলাস’ও অতিক্রম করে এলাম। অবশেষে আমাদের হোটেলের পথের সন্ধান পেলাম। কিন্তু পথ দিয়ে আসার সময় আমার বড় প্রবালটা দেখে সৈকতের একজন দোকানদার বলল, সমস্যা আছে নিয়ে যাওয়া যাবে না, পুলিশ দেখলে আপনার সমস্যা হবে। তার কথা শুনে মনের মাঝে ভয় ঢুকে গেল। বুঝতেছি না কী করব। প্রবালের মায়ার চেয়ে এত কষ্ট করে আনাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় ভয়ার্ত মনে সেটা নিয়ে রোডের দিকে হাঁটতে লাগলাম। রোডের দিকে চোখ পড়তে দেখি পুলিশ তিনটা রোডের মাথায়। সব কপাল, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। ভয়ে তাড়াতাড়ি প্রবালটা লুকিয়ে রাখলাম। পুলিশ যাওয়ার পর একটা ভ্যান পেলে সেটাতে করে আমাদের হোটেলে চলে আসি। সেই সকাল ৬টায় রওনা দিলাম আবার হোটেলে পৌঁছলাম সাড়ে ১১টায়। একটানা সাড়ে ৫ ঘন্টা হেঁটে দুইজন হোটেলে বিছানার সাথে একাকার হয়ে গেলাম। ১২টার আগে রুম চেকিং তাই কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে আসার জন্য গোছগাছ শুরু করে দিই। হোটেল থেকে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে রেস্টুরেন্ট এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নামায আদায় করে সবাই একসাথে লঞ্চে উঠে যাই। তবে লঞ্চে ওঠার সময় আসার টিকেটটা পুনরায় তাদের দেখাতে হয়। লঞ্চে ওঠার আগে অফিস সহকারী রুকনের ব্যাগে বড় প্রবালটা ঢুকিয়ে দিই। খুব ভয়ে ভয়ে সেটা লঞ্চের মাঝে তুলি। পরে শুনলাম মৃত প্রবাল আনতে পারে তাতে কোনো সমস্যা নেই।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে লঞ্চ হতে আর বের হতে ইচ্ছে করেনি, তাই লঞ্চে উঠে একঘুমে টেকনাফ লঞ্চ ঘাটে। সেখানে এসে আগে থেকে ফিরার টিকেট না করায় কোনো গাড়ির একসাথে বিশটা টিকেট পাচ্ছি না। অনেক কষ্টে টিকেট নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ে এর পাশের দোকানে নাস্তা করে গাড়িতে উঠে পড়ি। দোকানদার নষ্ট সবজি দেয়ায় গাড়িতে সবার শরীর খারাপ লাগছে আবার কিছুদূর পরপর বিজিবির চেকপোস্ট। চেকপোস্ট শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। আবার ঘুম ভাঙল লোহাগাড়ায় ‘মিডওয়ে’ রেস্টুরেন্টে। শরীর খারাপ লাগায় কেউ গাড়ি থেকে না নেমে পটিয়া এসে নেমে পড়ি। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার মত নিজে আবাসস্থলে চলে যাই। সব দায়িত্ব নিজের মাঝে থাকার কারণে মানসিক চাপে থাকার পরও সম্পূর্ণ ভ্রমণটা আমি ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলাম। কেমন জানি মনে হচ্ছে আমি পৃথিবী ছাড়া ভিন্ন কোনো অপরূপা গ্রহে ঘুরতে এলাম। জীবনের করা ভ্রমণের মাঝে এই ভ্রমণে সবটুকু উপযোগ নিঃশেষ করতে পারছি। মনের কোটরে এই ভ্রমণে রাতের ক্যাম্প ফায়ার আর পুরো সেন্টমার্টিন এলাকাটা ঘোরার অনুভূতি কখনো ভোলার মতো না!

Share.

মন্তব্য করুন