সমুদ্র মানে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য। পৃথিবীতে এমন কেউই হয়ত নেই যে সমুদ্র পছন্দ করে না। সবাই পছন্দ করে সমুদ্র। সবাই চায় সমুদ্রের গর্জন শুনতে। সমুদ্রের গর্জন শুনার মাঝে রয়েছে অন্যরকম অনুভূতি। প্রতিটি সমুদ্রসৈকতের পাড়ে চিকচিক করে বালি। কিন্তু সুন্দর সমুদ্রপাড় যদি হয় কাচের! ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট ব্র্যাগের কাছে ম্যাক্যারিচার স্টেট পার্কে রয়েছে এক অদ্ভুত সমুদ্রসৈকত। এটি অন্যসব সমুদ্রসৈকত থেক ভিন্ন। এখানে বালি নয় চিকচিক করে কাচের টুকরো। এ সৈকতের নাম গ্লাস বিচ। সমুদ্র বিলাস তো সব সৈকতেই করা যায়। কিন্তু গ্লাস বিচ নামে পরিচিত এ সমুদ্রসৈকতে গেলে পর্যটকদের নানা রঙের স্বচ্ছ পাথর দেখে মন ভরে যাবে। এখানে রঙিন পাথরগুলোর ওপর সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে। যা অন্যরকম প্রতিফলন তৈরি করে। রাশি রাশি কাচের টুকরোয় ভরপুর এ সমুদ্রসৈকতকে কাচের সৈকত বললে খুব একটা ভুল হবে না।
চোখ জুড়ানো কাচের সমুদ্রস্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে এত সব বর্ণিল কাচের টুকরোগুলো সমুদ্রের নীল পানির মাঝে তৈরি হল কেমন করে! আসলে এসব কাচ প্রমত প্রাকৃতিকভাবে তৈরি নয়। সবই কৃত্রিম। তবে এ কৃত্রিমতার সঙ্গে যোগ হয়েছেত প্রকৃতি। প্রথম দিকে এ গ্লাস বিচ অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের মতোই ছিল। ১৯০৬ সালে ফোর্ট ব্র্যাগের বাসিন্দারা তাদের গৃহস্থালির আবর্জনা ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ফেলার জন্য এ সমুদ্রসৈকতকে বেছে নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন লুম্বার কোম্পানি। শহরবাসী সরকারিভাবে তাদের পরিত্যক্ত বস্তুসামগ্রী ও লুম্বার কোম্পানির বর্জ্য এ সৈকতের ধারে ফেলতে থাকে। এই কাজটি চলতে থাকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত যতক্ষণ না সৈকতটি বর্জ্যে ঢেকে যায়। এরপর তারা পাশের সৈকতটিকেও বর্জ্য ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। শহরবাসীরা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এভাবে এ সৈকতকে ব্যবহার করতে থাকে। তাদের এসব বর্জ্যরে মধ্যে ছিল কাচের সামগ্রী, গৃহসরঞ্জাম আর পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতিসহ নানা কিছু। এরপর তারা বর্জ্যরে পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে এগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বর্জ্যগুলো পুড়ে সংকুচিত হয়ে নানা রকম পাথরের মতো হয়ে যায়।
এসব ময়লা আবর্জনা সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে বলে ১৯৬৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া পানিসম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং শহরের নেতারা এ অঞ্চলে মানুষের প্রবেশ ও ময়লা ফেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শহর কর্তৃপক্ষ পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি সরিয়ে নিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই বর্জ্য হতে প্রাপ্ত অনেক ধাতব বস্তু তারা বিক্রি করে ফেলে। অনেক রাসায়নিক দ্রব্য ও হালকা বর্জ্যগুলো দীর্ঘদিনে সমুদ্রের ঢেউয়ে হারিয়ে যায়। আর সৈকত পরিষ্কার হয়ে রয়ে যায় রাশি রাশি কাচের টুকরো। ঢেউয়ের আঘাতে সেগুলোও মসৃণ হয়ে যায়। কাচের পাথরে পরিণত হয় সেগুলো। মনে হয় সমুদ্রতটে পড়ে আছে ছোট ছোট রঙিন, উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ সব পাথর। যে কেউ দেখে মনে করবে ঢেউয়ের সঙ্গে বেলাভূমিতে সমুদ্রগর্ভ হতে রত্ন, মণি-মাণিক্য, মুক্তো ভেসে উঠে এসেছে। সকালের সূর্য এসব রত্নসদৃশ কাচের টুকরোয় পড়লে চারিদিকে দ্যুতি ছড়ায়। চমৎকার এক অনাবিল সৌন্দর্যে সমুদ্রসৈকতে পরিণত হয় গ্লাস বিচটি।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ১৯৯৮ সালে এ সমুদ্রসৈকত ব্যক্তিমালিকানায় না রেখে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয় তবে তার আগে পাঁচ বছর ধরে এর উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করা হয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে এ সৈকতকে ম্যাক্যারিচার স্টেট পার্কের আওতাভুক্ত করা হয়। বর্তমানে অসংখ্য পর্যটক এ সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যান। খোলা সমুদ্রের উজ্জ্বল রোদে কাচের টুকরোর চিকিচিক বর্ণিল রঙ দেখাই মূলত প্রম আকর্ষণ। এ সৈকত থেকে কোনো পাথর বা কাচের টুকরা নেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। গ্রীষ্মে প্রতিদিন সহস্রাধিক পর্যটকের ভিড় জমে এ গ্লাস বিচে। এখানে প্রতি বছর গ্লাস ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হয়। কাচের তৈরি নানা রকম আকর্ষণীয় পণ্যের মেলা বসে এখানে। তবে আশঙ্কার বিষয় হল গ্লাস বিচের মূল আকর্ষণ এ বর্ণিল কাচের মুক্তো দিন দিন কমে আসছে।

Share.

মন্তব্য করুন