কবি গোলাম মোস্তফার নামটি পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলিম ঘরেই। কিভাবে? ঐ যে তার লেখা- “তুমি যে নূরের রবি/ নিখিলের ধ্যানের ছবি/ তুমি না এলে দুনিয়ায়/ আঁধারে ডুবিত সবি।”…এই না’তটির মাধ্যমে। মূলত তাকে বেশি পরিচিত করে তুলেছে গ্রাম-বাংলায় ঐ না’তটিই। কারণ এটা প্রতিটি মিলাদেই পাঠ করা হতো। এখনো হয়।
আমরা তো সেই ছোট্ট, ছেলেবেলাতেই কবি গোলাম মোস্তফার নামটির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, ঠিক ঐভাবেই। তারপর একটু বড় হয়ে স্কুল পাঠ্যে পড়লাম :

“একটা লতা ছিঁড়তে পারো তোমরা সহজেই
কিন্তু যদি দশটা লতা পাকিয়ে এনে দেই,
তখন তারে ছিঁড়ে ফেলা নয়তো সহজ কাজ
ছিঁড়তে তারে পাগলা হাতিও হয়তো পাবে লাজ।”

এই কবিতাটির শেষ লাইন দুটো হলো :

“এক সাথে সব থাকো যদি এমনি হবে ফল
বাড়বে মনের সাহস এবং বাড়বে বুকের বল।”

কবিতাটি যে শুধু স্কুলের সীমাতেই পড়তাম, তা নয়। বরং বাড়িতে, রাস্তা-ঘাটে, যখন-তখন পড়তাম। বাড়ির মুরব্বিরাও মাঝে মাঝে কবিতাটির মর্মার্থ মনে রাখার জন্য উপদেশ দিতেন। ঝগড়া-বিবাদ নয়, বরং মিলে মিশে থাকলেই বুকে সাহস বাড়ে যেমন, তেমনি অনেক বড় বড় কাজও সহজেই করা সম্ভব হয়। কবিতাটি আমাদের কাছে ঐ সময় ছিল প্রতিদিনকার শিক্ষা ও

আদর্শ গ্রহণের একটি মাধ্যম। কিশোরদের কাছে এখনও এই কবিতাটির গুরুত্ব অনেক বেশি। শুধু কিশোরই বা বলি কেন, সকল বয়সের মানুষের জন্যইতো এই শিক্ষাটি গ্রহণ করা উচিত। তাহলে সমাজে হানাহানি, মারামারি আর রক্তপাতত্ত থাকবে না। বরং সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমাজ ও দেশটাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারবে। এইভাবে কিন্তু গোলাম মোস্তফা শিশু-কিশোরদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তন্ময় হয়ে পড়তে হতো :

“প্রভাত কাননে আজি ফুটিয়াছে ফুল
গোলাপ, চামেলি-বেলী-চাঁপা ও বকুল।
মধুর পবিত্র অতি ওদের জীবন
ক্ষতি ওরা কারো কভু করে না কখন।
বিলায়ে আপন প্রাণ
করে শুধু প্রীতি দান
পর-সুখ তরে করে মরণ বরণ।”

এই পবিত্র ফুলের সাথে আমাদেরকে তুলনা করে তারপর তিনি বলেন :

“আমরাও হবো ভাই কুসুমের মত
সংসার কাননে মোরা শিশু আছি যত।
দিব নাকো কোন দিন ব্যথা কারো মনে
হাসি আর খুশি দিব সবার জীবনে।
যতদিন রব ভবে
ভাল যেন বাসে সবে
সুখী যেন হয় মিশে আমাদের মনে।”

হ্যাঁ। এমনি ছিল তার উচ্চারণ। এমনি ছিল তার শিশু-কিশোরদের প্রতি প্রেম, দরদ, ভালোবাসা আর প্রাণঢালা শুভাশিস। তিনি চাইতেন শিশুরা মানুষের মত মানুষ হোক। ফুলের মত সুন্দর ও পবিত্র হোক। যোগ্য ও কর্মঠ হোক। তারা এই পৃথিবীকে নতুন ভাবে, সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার মতো যোগ্যতা অর্জন করুক। এই জন্য ছোটদের নিয়ে তার স্বপ্নের কোনো শেষ ছিল না। ছিল না তার সীমা-পরিসীমা। কী দরদভরা কণ্ঠ! কী তার আবেগভরা অথচ দৃঢ়তায় অঙ্গীকার :

“এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতন মধুর করে গড়বো এ জীবন।
হাসি রবে মোদের মুখে
সুবাস রবে লুকিয়ে বুকে
দেখলে পরে জুড়িয়ে যাবে সবার দু’নয়ন।
সূর্য যেমন রোজ আকাশে করে কিরণ দান
আঁধার দূরে যায় পালিয়ে জাগে পাখির গান।
তেমনি মোদের জ্ঞানের আলো
দূর করিবে আঁধার কালো
মোদের ছোঁয়ায় উজল হয়ে উঠবে সবার প্রাণ।”

কবি গোলাম মোস্তফা এভাবেই কিশোরদেরকে সকল সময় উজ্জীবিত করে তুলতেন তার শিশুতোষ কবিতায়। তার এ ধরনের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা, জ্ঞান, আদর্শ, সাহস আর জীবন গঠনের হাজারো উপাদান। কী অর্থবহ উচ্চারণ!

“আঁধার দূরে পালিয়ে গেল,
রাত হলো ওই ভোর
ওমা এখন বাইরে যাবো,
দাও খুলে মোর দোর।
পূব আকাশে অরুণ রবি
উঠছে হেসে ওই
এমন সময় আমরা কেন
ঘরের কোণে রই?”

সত্যিই তো, পূব আকাশে সূর্য উঠলে আর ঘরের কোণে বসে থাকা কেন? বরং তখন বাইরে বেরিয়ে এসে জগৎটাকেই ভালো করে দেখে নিতে হবে আর সেই সাথে গড়ে তুলতে হবে নিজেকে ও সমাজকে। নতুন ভাবে। কবি সাহসও দিচ্ছেন এইভাবে :

“চিরদিনের ছন্দ পাগল
ওঠ জেগে তুই, ভাঙরে আগল।
উড়িয়ে দে তোর সবুজ নিশান
চল এগিয়ে বাজিয়ে মাদল।
বিজলী সম ওঠরে জেগে
আগুন জ্বালা ঝঞ্ঝা মেঘে
নতুন যুগের দে খুলে দোর
দেখুক জগৎ শক্তি যে তোর।”

কবি গোলাম মোস্তফার এ ধরনের কবিতা মানেই উৎসাহ আর প্রেরণার এক সাগর। যে কবিতা পড়লে সাহস পাওয়া যায়। স্বপ্নের বৃষ্টিতে ভেজা যায়। আবার বাতাসের মত পার হওয়া যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে। বিশ্বব্যাপী। তার আহবানে জেগে ওঠে অলস মনটিও। কেন উঠবে না? তার আহবানটি যে অকৃত্রিম ভালোবাসা আর হৃদয় নিংড়ানো স্বপ্নের সোনালি শিস। কী ব্যাকুল ও সাহসী কণ্ঠ তার!

“ঘরের কোণে বসে বসে রইবো নাকো আর
ছুটবো মোরা দিকে দিকে ধরার চারিধার।
হাজার ভাবে হাজার কাজে
ছড়িয়ে যাতো জগৎ মাঝে
ঘরে ফিরে আসবো আবার নিয়ে রতন ভার।
ছাত্র হয়ে লাগবো মোরা জ্ঞানের সাধনায়
শীর্ষ দেশে থাকবো সবার প্রতিযোগিতায়।
যাবো জাপান, আমেরিকা
জ্বালবো নতুন নূরের শিখা
মুগ্ধ হবে বিশ্ব জগৎ মোদের প্রতিভায়।”

সুতরাং নিজেকে মহৎ ও আলোকিত করার এমন আন্তরিক আহবান উপেক্ষা করতে পারে কে? কবি গোলাম মোস্তফা কিশোরদেরকে ভালোবেসে গেছেন আজীবন। তাদেরকে ভালোবেসেই তিনি লিখেছেন অজস্র কবিতা। আগেই বলেছি, তার প্রতিটি কবিতাতেই রয়েছে শিক্ষা, সাহস, আদর্শ-ঐতিহ্য এবং প্রকৃত মানুষ হওয়ার এক মহান আলো। অনেকেই ছোটদের জন্য অর্থহীন কবিতা বা গল্প লেখেন কেবল তাদেরকে মজা দেয়ার জন্য। কিন্তু গোলাম মোস্তফা এখানে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক কবি। তিনি তার প্রতিটি কবিতাকেই শিশু-কিশোরদের জ্ঞান-গরিমা ও চরিত্র-মাধুর্যের পাঠশালায় পরিণত করেছেন। যা পড়তে ভালোও লাগবে, আবার তার মধ্য দিয়েই তারা তাদের জীবন গড়ার প্রয়োজনীয় উপাদানও পাবে।

প্রকৃত অর্থেই গোলাম মোস্তফা ছিলেন এক কিশোরপ্রেমিক অসামান্য কবি। তাদেরকে শুধু ভালোই বাসতেন না, গড়ে তুলতে চাইতেন যোগ্য ও মহৎ হিসেবে। তিনি সব সময় ছোটদের সাথে কথা বলেছেন তাদেরই ভাষায়। উপদেশের সুরে নয়। অথচ কী মজার ব্যাপার, তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অনেক উপদেশ। এ এক জাদুর খেলা যেন। বিষয়টি কেমন? একটু উদাহরণ দেয়া যাক তার সেই বিখ্যাত কবিতা থেকে :

“আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন-নন্দনে
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাপড়ি পাতার বন্ধনে।
সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবো মোরা ফুটবো গো
অরুণ রবির সোনার আলো দু’হাত দিয়ে লুটবো গো।
নিত্য নবীন গৌরবে
ছড়িয়ে দেব সৌরভে
আকাশ পানে তুলবো মাথা, সকল বাঁধন টুটবো গো।”

তারপর? তারপর তিনি তার ইচ্ছে ও স্বপ্নের পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে। অর্থাৎ কিশোরদের মাঝে। বলছেন :

“নীল দরিয়ার পাল তুলে আজ কেউবা হবো নিরুদ্দেশ
কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবো নতুন দেশ।
জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখতে মোরা কেউবা যাবো জার্মানি
সবার আগেই চলবো মোরা, আর কি কভু হার মানি?
ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।”

কী অবাক করা কণ্ঠ গোলাম মোস্তফার। শিশু-কিশোরদেরকে তিনি কিভাবে, কোন্ চোখে আর কী বিশাল হৃদয় দিয়ে দেখতেন ও ভালোবাসতেন, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়ে গেছে তার এই কবিতার প্রতিটি লাইনে। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’- এই লাইনটির মধ্যে যে কী মহান ও গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য লুকিয়ে আছে, তা ভাববার বিষয় বটে। ছোটদেরকে তিনি হেলা ফেলার দৃষ্টিতে দেখেননি, বরং তাদের মর্যাদাকে অনেক উচ্চে স্থান দিয়েছেন। এ

ধরনের উদার মানবিক ও আন্তরিক দূরদৃষ্টি সবার মধ্যে থাকে না। কিন্তু গোলাম মোস্তফার মধ্যে ছিল। এ এক মহান গুণ। এ এক মহৎ হৃদয়ের প্রকাশ। কবি গোলাম মোস্তফা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সালের ২১শে ডিসেম্বর। জন্মস্থান- তৎকালীন যশোর জেলার, শৈলকুপার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। ছোটদের জন্য ছাড়াও তিনি প্রচুর কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনী প্রভৃতি গ্রন্থ লিখেছেন। তার বহুল পঠিত সেই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’র কথা কে না জানে? এসবের বাইরেও তিনি প্রচুর ইসলামী গান লিখেছেন। সেইসব গানও খুব জনপ্রিয় হয়ে আছে। অনুবাদেও রয়েছে তার প্রচুর অবদান। মুসলিম সাহিত্য জাগরণ ও বিকাশে তার ভূমিকা রয়েছে সীমাহীন। ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার গভীর আস্থা ও দৃঢ়তা।

পেশায় শিক্ষক হলেও তার শিশুতোষ কবিতায় কিন্তু তার সেই গুরুগম্ভীর ‘মাস্টার সুলভ’ চরিত্র নেই। বরং তিনি এখানে মিশে গেছেন, একাত্ম হয়ে গেছেন নিবিড়ভাবে-তারই একান্ত আপন, প্রাণের স্পন্দন, স্বপ্নের পাখিদের সাথে। ছোটদের সাথে। তিনি ‘তোমরা’ না বলে বরং ‘আমরা’ বলেই শিশু-কিশোরদেরকে নিয়ে গেছেন সাহস, স্বপ্ন ও আলোকিত ভুবনে। এখানেই তার কৃতিত্ব, এখানেই তার বৈশিষ্ট্য।
এমন দরদি কবিকে কেউ কি কখনো ভুলতে পারে? না, সম্ভব নয়। আর তাইতো তার (১৩ই অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে) ইন্তেকালের পরও, এখনো আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

একজন বড় কবি যেভাবে সর্বকালে স্মরণীয় হয়ে থাকেন, কবি গোলাম মোস্তফাও ঠিক সেইভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জেগে থাকবেন তার পাঠকের মাঝে। একান্ত হৃদয়ে। কারণ, আমরা ছিলাম তার স্বপ্নের পাখি। আর তাই তিনি আমাদেরকে কখনো ভোলেননি, সুতরাং আমরা তাকে ভুলবো কেমন করে?

Share.

মন্তব্য করুন