পুরো দলের মেজাজ সাড়ে ঊনপঞ্চাশ ডিগ্রিতে পৌঁছে ছটফট করতে থাকল। এক রানে দল হেরে যাওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। দরকার ছিল দুই রান। হাতে ছিল চার বল, দুই উইকেট। এই অবস্থায়ও কি টিম হারতে পারে? দুই বলে দুইজনই আউট! সব দোষই শেষ দুই ব্যাটসম্যানের ওপর গিয়ে পড়ল। তারা কি ম্যাচ খেলার যোগ্যতা রাখে? নির্বাচকমণ্ডলী কি বাদাম চিবিয়ে চিবিয়ে আটজন খেলোয়াড় নির্বাচিত করেছিল? কারোর মাথায় যেন কিছুই প্রবেশ করছে না।
সব খেলোয়াড়ই পাগুলোকে লম্বালম্বি করে এদিক ওদিক পড়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে এইমাত্র পরাজিত হয়ে সবাই যেন আফসোসের সমুদ্রে ভেসে আছে। কিছুক্ষণ আগেও শতাধিক ক্ষেপাটে সমর্থক হই-হুল্লোড়ে লাফালাফি করছিল। একজন সমর্থককেও এখন আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছে: ছে: করে তিন মিনিটেই সবাই মাঠ ছেড়ে চলে গেল।
সামি দলের ক্যাপ্টেন। বর্ষার কালো মেঘ এখনো তার চেহারায় লেপ্টে আছে। ও আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সব খেলোয়াড়ের চেহারায় একবার চোখ বুলাল। ও সবাইকে সান্ত¡নার সুরে বলল- আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। ভাগ্য আমাদের পেছনে কাজ করে নাই। আঁধার নেমে আসছে। আমাদের দুই কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। মিঠু তড়াক করে উঠে বসে বলল- আমরা হেঁটে যাবো?
সামি বলল- হ্যাঁ, হেঁটে যেতে হবে। আমরা পরাজিত সৈনিক। পরাজিত সৈনিকের কোন দাম নেই।
মিঠুর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আজকের খেলায় মিঠু যে দুই দুইটা ছক্কা হাঁকিয়েছে সেই আনন্দটাও এখন আর বুকের কোথাও রইল না।
অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। একটা খুঁটিতেও কোথাও বিদ্যুতের আলো দেখা যাচ্ছে না। সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত। শরীরের অণু পরমাণুগুলোও বোধ হয় তাদের ওপর নাখোশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সবাই রাস্তার পাশ দিয়ে এলেবেলে হাঁটছে। কারোর কারোর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। এই খিদের কথাটিও কেউ কাউকে বলতে পারছে না। সীরু এবং মীরু শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিল। এরাই বেশি বেশি মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটছে। বিদ্যুৎ নেই বলে পুরো দলটাই আজ বেঁচে গিয়েছে। নাহলে কত্তো ছে: ছে: আওয়াজ উঠতো!
সবাই ক্লাবের কাছাকাছি এসে গিয়েছে। কিন্তু ক্লাবে তালা লাগানো দেখে সবাই বিস্মিত হলো। এই ক্লাবের কপালে অনেক জয় চিহ্ন আছে। গত বছর দুই দুইটা টুর্নামেন্ট জিতেছে এই ক্লাব। পত্রিকায়ও উঠেছিল এই জয়ের খবরটা। সেদিন কী রসগোল্লা খাওয়া-খাওয়ি! এর কিছুই মনে রাখলো না ক্লাব কর্তৃপক্ষ? বিষয়গুলো ক্যাপ্টেন সামির মাথায় বারবারই ধাক্কা খেতে থাকল।
মনের কষ্টগুলো মাথায় নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো সবাই। এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। অন্ধকারটা ভালোভাবে চেপে বসেছে চারদিক। হাসান শাহ মাজারের বিশাল বটবৃক্ষটা ভয়ঙ্কর কালো রূপ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় এই দৃশটা চোখে পড়লে কারো কারো বুকে ধুকপুকানি নামতো। আজকে কারোর ওদিকে নজরই গেলো না।
সামি কেতুরা মসজিদের মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ালো। এই মোড়ের চারপাশে চারটা কবরস্থান। এরকম চারটে কবরস্থানঅলা মোড় বাংলাদেশের আর কোথাও আছে কি না কারোর জানা নেই।
সীরু বলল, কী হলো, অমন করে কী দেখছিস?
মানিক, সাপের মানিক। ওই ঝোপের ভেতর। মানিকটা নিশ্চয় বড় হবে। আলোর বৃত্তটা অনেক বড়।
এবার দেখাদেখি শুরু হয়ে গেল। কবরস্থানের মাঝ বরাবর আলো জাতীয় কী যেন জ্বলছে। সাপের মানিকও ওভাবে আলো ছড়ায়। সবাই জুল জুল চোখে অবাক দৃষ্টি ফেলে তাকাচ্ছে। আবার এক আধটু ভয়ও কাজ করছে সবার বুকে।
মীরু বলল, ছক্কা মারবো।
সীরু বলল, কিছুক্ষণ আগে তুই না শূন্য রানে আউট হয়ে গেলি?
এটা পুষিয়ে দেবো।
মানে?
আমি মানিকটা মুঠোয় নেবো।
মুঠোয় নিবি? কিভাবে নিবি?
একটা কম্বল দরকার। কম্বলও আমার কাছে আছে। স্পেনের তৈরি কম্বল। মামা পাঠিয়েছে।
কম্বল দিয়ে কী করবি?
মানিককে মুড়িয়ে দেবো। মানিকের আশপাশেতো সাপও থাকতে পারে। যদি ফোঁস ঢোঁস করে বসে? ছক্কা মারতে গেলে একটু ঝুঁকি নিতেই হবে। তোরা পাঁচ মিনিট দাঁড়া। আমি একটুক্ষণ পর ফিরে আসছি।
সাত মিনিটের মাথায় একটা নতুন কম্বল নিয়ে মীরু ফিরে এলো। কবরস্থানে নামতে কারোর সাহস হলো না। একা মীরুই নেপোলিয়নের মতো কবরস্থানে ঢুকে পড়লো।
উপস্থিত সবার বুকের ধুকপুকানিটা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকলো। সামির মতো পরাক্রমশালী ক্যাপ্টেনের ভয়ে পায়ের তালু থেকে মাটি সরে যেতে থাকলো। কবরস্থান থেকে বের হয়ে মীরু বলল- ছক্কা। পুরোটাই ঢেকে দিয়েছি। এখন আর এখানে থাকা যাবে না। সাপটা চারপাশে এখন তোলপাড় করে ছাড়বে। কাল সকাল সকাল সবাইকে আসতে হবে। কেউ দেরি করতে পারবে না।
রাতের শেষ সময় থেকে অনেক বৃষ্টি। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। কালো মেঘে ছেয়ে আছে সারা আকাশ। বৃষ্টি থামাথামির কোন নাম নেই। বৃষ্টি না থামার জন্যই বোধ হয় আজ শপথ নিয়েছে। মীরু বৃষ্টির ভেতর বের হয়ে পড়লো। দুই মিনিটের মাথায় সে ভিজে চুপসে গেল।
কবরস্থানের মোড়ে গিয়ে মীরুর দু’চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। ক্লাবের সবাই এসে জটলা করে ফেলেছে। এই বৃষ্টিও কাউকে রুখতে পারেনি। সবাই যেন মীরুর জন্যই অপেক্ষা করে আছে।
এতো লোক দেখে মীরুর সাহস হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেল। ও এক মুহূর্তও চিন্তা না করে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল। জটলার চারপাশে একেবারে পিনপতন নীরবতা। কোথাও একটুও শব্দ উঠছে না। সবার চোখে মুখে চাপা ভয় কাজ করছে। এই মুহূর্তে গোটা এলাকায় একজনই বীর, ওর নাম মীরু।
মীরু কম্বলের দুইপাশটা শক্ত করে ধরল। গায়ের সমস্ত শক্তি দুই হাতে এনে একটা জোরে টান মেরে সরিয়ে ফেলল।
জটলার মাঝখান থেকে কেউ কেউ বলে উঠল, কই, মানিক কই?
একজনে বলল, সাদা সাদা ওগুলো কী? ওগুলো কি চিংড়ি মাছের খোসা?
সবাই বলল- তাইতো, তাইতো। খোসার মতোই তো লাগছে। এই খোসা এলো কোথা থেকে? মানিক গেলো কোথায়?
মীরুর মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকল। কাল রাত থেকে ও অনেক স্বপ্ন দেখে আসছিল। মানিকটা মিলে গেলে ছক্কা আর ছক্কা। পত্রিকা জগতের সব সাংবাদিক তাদের এলাকায় হামলে পড়ত। চারদিকে ক্যামরার ক্লিক আর ক্লিক। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় ছবি। সিডরের সর্বনাশের মতো সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে লোকজন পাতলা হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান স্যারকে এদিকে আসতে দেখে সবাই চোখ তুলে তাকাল। বিজ্ঞান স্যার মুখ খুলবে খুলবে এমন ভাব দেখাল।
বিজ্ঞান স্যার বললেন, কী হয়েছে, এতো লোকজন কেন?
মীরু বলল, মানিকটা ফসকে গেছে স্যার।
মানিক? কিসের মানিক?
সাপের স্যার।
সাপের আবার মানিক থাকে নাকি? কে বলে এ কথা?
সবাই এই কবরস্থানের মাঝখানে মানিকটা দেখেছিলাম। কিছু জায়গাজুড়ে আলো ফেলে রেখেছিল। মানিকটাকে নিয়ে সাপে যেন পালাতে না পারে রাতে স্পেনের কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে কম্বল সরিয়ে দেখি…।
কী?
চিংড়ির মাছের খোসার স্তূপ স্যার।
বিজ্ঞান স্যার হো হো করে হেসে উঠলেন। একটুক্ষণ পর তিনি হাসি থামিয়ে বললেন, চিংড়ি মাছের খোসাগুলো অন্ধকারে জ্বলে ওঠার ক্ষমতা রাখে। তোমরা বড় হয়ে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে। একটু একটু করে আবার বৃষ্টি নামা শুরু হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বড় হতে লাগল। দুই মিনিটেই চৌরাস্তার মোড়টা ফাঁকা হয়ে গেল। চোখের পলকেই সবাই যার যার বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
মীরু আবার কবরস্থানে নামল। কম্বলের গায়ে হাত রাখল। কম্বলটা কয়েকবার উঠাতে গিয়ে ও ব্যর্থ হলো। কারণ তার মামার পাঠানো স্পেনের কম্বলটা ভিজে অনেক ওজন হয়ে গিয়েছিল।
Share.