শীতকালটা বড় কষ্টের। আবার বেশ আরামেরও। কষ্টের এ কারণে যে গরম কাপড় ছাড়া শরীর প্রায় অবশ হয়ে যায়। আর আরাম লাগে যখন লেপ কিংবা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা যায়। এ ছাড়া কষ্টের আরও কিছু কারণ আছে। যেমন- শীতে ঠোঁট, মুখ-হাত শুকিয়ে যায়। ফেটে যায় কখনো কখনো। হেমন্তের আঁচল ধরেই নেমে আসে শীতের ঋতু। নেমে আসে বাংলাদেশের সর্বত্র। শীত সবুজ প্রান্তরে জাগিয়ে তোলে ধূসর ছবি। অনেক সময় পায়ের পাতাও ফাটে। কুয়াশার সাথে ধূলি মিশে লাগে ঠাণ্ডা। শ্বাসকষ্ট যাদের রোগ তাদের আরো বেড়ে যায় কষ্ট। অ্যাজমা রোগীদের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। হাত-মুখ ধুতে, ওজু কিংবা গোসল করতেও দারুণ কষ্ট লাগে।
ঠিক পাশাপাশি আরামের দিকও কম নয়। গরম পোশাক পরে নিলে বেশ মজা লাগে। রাস্তাঘাট শুকনো থাকে বলে চলাফেরায় খুব সুবিধা হয়। শীতকালে খাওয়া দাওয়ায়ও বেশ আরাম। নানা ধরনের শীতের সবজি, ফলমূল পাওয়া যায় বলে খাবারে অন্য ধরনের একটা মজা থাকে। রান্নাবান্নায়ও কম মজা পাওয়া যায় না। একবার রান্না করলে অনেক সময় ধরে রাখা যায়। সহজে নষ্ট হয় না। তেমনি তরিতরকারিও অনেক সময় পর্যন্ত সতেজ থাকে।
আমাদের বাংলাদেশে যে ছয় ঋতু বিরাজমান এর অন্যতম শীত ঋতু। যদিও পৌষ-মাঘ দু’মাসকে শীতকাল ধরা হয়। কিন্তু এটা মূলত তিন থেকে সাড়ে তিন মাস পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। বিশেষ করে আমাদের গ্রামে কার্তিক মাসের শেষের দিক থেকে শীত শুরু হয়ে যায়। আর ওদিকে ফাগুন মাসের কিছু অংশও কিন্তু শীত দখল করে নেয়। কুয়াশাতো আরও আগ থেকেই পড়ে। এ কারণে গ্রামের মানুষেরা বরাবর শীতের প্রস্তুতি নেয় অনেক আগ থেকে। লেপ কম্বল প্রস্তুত করে। গ্রামে শীতকালটা বেশ মজার। মজার কেন? হ্যাঁ বলছি। মজার হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন- গ্রামে শীত আসতে না আসতে শুরু হয় শীতের পিঠা তৈরির ধুম। নানা ধরনের নানান জাতের শীতের পিঠায় কেমন খুশবুদার হয়ে ওঠে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। ধনী-গরিব সকলের ঘরেই কম বেশি শীতের পিঠা প্রস্তুত হয়। সকালবেলা ভাপা পিঠার ধোঁয়া আহা কি মজার!
শীতের শুরুতে থাকে নতুন ধানের মেলা। নতুন ধান থেকে পিঠার চাল সংগ্রহ করা হয়। সেই নতুন চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় শীতের পিঠা। এই সময় গ্রামের বউ-ঝিরা অন্যান্য কাজের সাথে পিঠা তৈরির ব্যস্ততাকে এক করে নেয়। শুধু নিজেদের জন্য পিঠা তৈরি করবে এমন নয়। বরং আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও পিঠা পাঠাতে হয়। কেউ কেউ আবার পিঠা তৈরির সরঞ্জামাদি পাঠিয়ে দেয়। কেউ পিঠা বানিয়ে পাঠায়। এসব পিঠা দিয়ে কোথাও কোথাও বসে পিঠামেলা।
শীতের পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভাপা পিঠা। এ পিঠার সাথে পরিচয় নেই এমন কোনো মানুষ বোধ হয় বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। প্রায় গোটা দেশেই ভাপা পিঠার প্রচলন রয়েছে। পানির ভাপ দিয়ে এ পিঠা তৈরি হয় বলে একে ভাপা পিঠা বলে। কেউ গুড় মিশিয়ে এ পিঠা তৈরি করে। কেউ আবার পিঠা তৈরির শেষে গুড় মিশিয়ে খায়। সে যাই হোক ভাপা পিঠার স্বাদ নেয়ার উপযুক্ত সময় কিন্তু এ শীতকাল। শহর-নগর-গ্রামে সর্বত্রই ভাপা পিঠা পাওয়া যায়। খেজুর রসে ভিজিয়ে খেতে সব থেকে মজা এ পিঠা।
শীতের ভোরে যখন চারিদিকে কুয়াশার আঁচল বিছিয়ে থাকে। যখন মুখ খুলে হা.. শব্দ করলে মুখ থেকে স্রোতের মতো ধোঁয়া বের হয়। ঠিক তখন পানির ভাপে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠার মজাই আলাদা। ঝুনা নারিকেল দিয়ে গুড় মিশিয়ে নেয়া ভাপা পিঠা বাংলাদেশের আবহমান কালের একটি বিরাট ঐতিহ্যের প্রতীক। যারা এ ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেনি তারা বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখেনি। যারা গ্রামের নিসর্গ প্রকৃতির মায়াবী ভোরে একবারও ভাপা পিঠা খায়নি তারা কিইবা দেখেছে জীবনের মজা। যারা শীতের ভোরে দোয়েলের গান শোনেনি তারা অনেক মজা থেকে বঞ্চিত। এ কারণে বলা যায় যারা আমাদের গ্রাম দেখেনি, গ্রামে থাকেনি এবং গ্রামীণ পরিবেশে ঘুরে বেড়ায়নি তাদের জীবন অনেকাংশে অপূর্ণই থেকে যায়। শীতে আরও দু’টি পিঠাও খুব জনপ্রিয় কিন্তু। একটা হলো চিতৈ পিঠা। আরেকটি হলো পাটি সাপটা। এ দুটো পিঠাও প্রায় গোটা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও নানা ধরনের পিঠা শীত ঋতুতে দেখা যায়। একেক এলাকায় একেক ধরনের পিঠা প্রস্তুত হয়। মানুষের পছন্দ অপছন্দ এ ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ এক এলাকার লোকদের খাওয়ার রুচি এক রকম। অন্য এলাকার লোকদের আবার আরেক রকম। এই রকমফেরের কারণে খাওয়া দাওয়া এমনকি চলাফেরায়ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
শীতে খেজুরের রসের কথা কে না জানে! কে দেখেনি খেজুর রস। কিংবা খেজুর রসের স্বাদ নেয়নি এমন লোকও কী খুব বেশি আছে? যদি থেকে থাকে তবে পূর্বের সে কথা আবার বলতে হয় যে জীবনে তারা অনেক মজা থেকে বঞ্চিত। আমরা মনে করি বঞ্চিত জনতা বেশি নেই। নেই কেননা এই বিষয়টি এতো বেশি মানুষের জীবনের সাথে জড়িত যে মানুষ ইচ্ছে করলেই এটাকে কিন্তু দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। পারে না বলেই খেজুর রস আমাদের মজার ব্যাপার হয়ে জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে।
শীতকালে নানান ধরনের ফল-ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে। বিশেষ করে মগ, মশুরি, খেশারি, আলু, তিল, তিষি, সূর্যমুখী ও শরিষার চাষ হয়। মাঠকে মাঠ শর্ষে ফুলের হলুদ রঙ যখন ছড়িয়ে থাকে। সেই দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে! শর্ষে ফুলের মাঠে দাঁড়ালে চোখ উজ্জ্বল হয়। দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়। চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়। হৃদয়-মন নেচে ওঠে আনন্দে। আর মানুষকে উদার করে তোলে এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
শীতের সকালে শর্ষে ফুলের গায়ে শিশির ঝুলে থাকে। সকালের সোনালি রোদ নিজেকে বিছিয়ে ধরে সেই ফুলের মাঠে। সোনালি রোদ আর শর্ষের হলুদ মিশে কেমন একাকার হয়ে যায়। তখন মনে হয় আমাদের গ্রাম সত্যিই ছবির মতো সুন্দর, মায়াবী ও আকর্ষণীয়।
শর্ষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি। দূর-দূরান্ত থেকে মৌমাছিরা ছুটে আসে মধু নিতে। আবার ভোমরও উড়ে এসে শর্ষে ফুলের মুখে পাখা দোলায়। হলুদ ফুলে কালো ভোমর আর মৌমাছি বেশ লাগে। এই দৃশ্য আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের এক পরিচিত দৃশ্য।
শহর জীবনে গ্রামীণ ঐ সমস্ত পরিবেশ নেই। নেই বলেই শহরের মানুষগুলো কেমন কঠিন। কেমন রুক্ষ-কর্কশভাষী। মায়া-মমতা নেই তাদের। শহরে ইট পাথরের ভেতর শীত সহজে প্রবেশ করতে পারে না। পারে না বলে শীতের যে মজা সেটাও তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য মাঝে মাঝে বেশ ঠাণ্ডা এসে যখন জেঁকে বসে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। তখন শহরেও সেই ঠাণ্ডার ঢেউ এসে লাগে। খানিকটা কাঁপানো শীত বয়ে যায় শহরবাসী মানুষের ওপর। তখন শহরের লোকেরা নানান ধরনের শীতের কাপড় পরে নিজেদের আরাম আয়েশকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করে তোলে। শুধু বিপদ হয় বস্তিবাসী বস্ত্রহীন মানুষগুলোর। যারা জীবনকে নিয়ে কোনো স্বপড়ব দেখে না। দেখতে পারে না। জীবনে আরাম আয়েশের কথা ভাবতে পারে না। শীত গ্রীষ্ম যাদের কাছে খানিকটা সমান তালেই কেটে যায়। তাদের বেশ কষ্ট বেড়ে যায় ঠা-া বেশি পড়লে। তবুও তারা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে হয় তাদের। এ ছাড়া আর কিছুই করার তো নেই তাদের। কি-ই বা করবে ওরা! জীবনের কাছে পরাভূত ওরা।
অবশ্য মানুষকে সংগ্রাম করে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠতে হয়। বড় হতে হয়। সংগ্রাম-পরিশ্রম ছাড়া কোন মানুষই বা কোন কালে বড় হয়েছে? হয়নি। নিশ্চয় হয়নি। একমাত্র পরিশ্রমই পারে জীবনের সফলতা এনে দিতে। তাই বলা যায় যারা পৃথিবীতে সফল হয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পরিশ্রমের ফলে সফল হয়েছে। এ কারণে আমাদের পরিশ্রম করেই বড় হতে হবে। সাধনা করেই এগুতে হবে।
শীতকাল অনেকের প্রিয় ঋতু। অনেকেই শীতের সময় বেশ স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করে। শীতকালটা উপভোগ করে দারুণভাবে। এদের অনেকেই আছেন যারা শীতের সময় গ্রামে বেড়াতে যান। নগরজীবন থেকে বেরিয়ে চলে যান গ্রামের নীরব সৌন্দর্যের কাছে। রাতভর কুয়াশার খেলা দেখেন। সকালে সবুজ ঘাসে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করা কুয়াশা বিন্দুর রূপ দেখেন। খালি পায়ে কুয়াশাভেজা ঘাসে হেঁটে নিজের শরীরকে শীতল করে তোলেন। এ ধরনের মানুষেরাই প্রকৃতিপ্রেমী। আর প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষই সত্যিকারের উদার মানুষ। এমন উদার মানুষদের আজ বড় প্রয়োজন। চলো ডুবে যাই শীতের কুয়াশায়।

Share.

মন্তব্য করুন