জাহিনদের গ্রামের নাম ফুলপুর। সবুজ ছায়ানিবিড় একটি গ্রাম। গ্রামের উত্তর দিকে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। দক্ষিণে বয়ে চলেছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা। উত্তরে পাহাড় আর দক্ষিণে নদী। কী মনোরম দৃশ্য! যেনো কোনো শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা। গ্রামের পূর্বদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও। নাম ফুলপুর বিদ্যানিকেতন। ওই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র জাহিন। বেশ ভাবুক আর বুদ্ধিমান। ওর বয়সী আরো দশটা ছেলে থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বয়সেও নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যেস আছে। দাদু নিয়মিত বাজার থেকে পত্রিকা আনেন। সময় করে সেটা মনোযোগ দিয়েই পড়ে জাহিন।
হেমন্ত প্রায় শেষ। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। শেষ রাতে টিনের চালে হালকা বৃষ্টির ফোঁটার মতো কুয়াশা ঝরে। ভোরে গাঁয়ের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে সবুজ দূর্বার শিশিরবিন্দু খুব আদরে চুমোয় ভরিয়ে দেয় পা যুগল। ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। শীতকালে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে দূরের সাইবেরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে ছোটে আসে পাখিরা। আমরা এদের বলি অতিথি পাখি। হ্যাঁ অতিথিই তো। শীত শেষ হতেই যে ওরা আবার ডানা মেলে উড়ে যায় দূর অজানা। বিভিন্ন রঙ আর বর্ণের পাখি। বাংলাদেশের প্রকৃতিও সাদরে বরণ করে তাদের।সুন্দরবন, হাকালুকি হাওর, চলনবিলসহ ছোটোবড় হাওর-বিল ইত্যাদি যেনো পরিণত হয় পাখির অভয়ারণ্যে। মিষ্টি গান আর
কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি। সেদিন পত্রিকায় পাখি শিকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়ে মনটা খুব খারাপ হয় জাহিনের। দিন দিন মানুষ কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ইদানীং যে হারে মানুষ পাখি শিকার শুরু করছে, এমন চললে ভবিষ্যতে আর অতিথি পাখিরা আসবে না বাংলাদেশে। এমনিতেই দিন দিন প্রকৃতি হারাতে বসেছে তার ভারসাম্য। মানুষ কেটে ফেলছে গাছগাছালি। নির্বিচারে উজাড় করছে বন। ফসলি জমিতে গড়ে তুলছে উঁচু উঁচু দালান।
ফলস্বরূপ দেখা দিচ্ছে বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরার সময় হয়ে যাচ্ছে বন্যা, যখন নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠার কথা, সে সময় চলে আসছে বন্যা। তলিয়ে যাচ্ছ সোনালি ফসলের ভূমি। ম্লান হয়ে যাচ্ছে কৃষকের মুখের হাসি। আবার যখন মাঠে পর্যাপ্ত পানি থাকার কথা তখন খরায় কাঠ হয়ে ফেটে যাচ্ছে মাঠ!
কেমনে এই অতিথি পাখিদের শিকারির হাত থেকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে জাহিন। সরকারি আইন থাকলেও তোয়াক্কা না করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করছে অনেকেই। ছোটো মানুষ ও। নিষেধ করা বা বাধা দেয়ার মতো সামর্থ্যও হয়নি এখনও। খোদ ওর চাচ্চুও এই নির্মমতার সাথে জড়িত। সেই ছোটোকাল থেকেই দেখে আসছে, শীতকাল এলেই ছোটো চাচ্চু সন্ধ্যার পরই জাল আর টর্চ নিয়ে রওয়ানা দেন হাওরের দিকে। অনেক পাখি নিয়ে ফেরেন রাত করে। কী করে এই নির্মমতা বন্ধ করা যায়? অনেক ভেবে একটি পথ আবিষ্কার করে জাহিন। এই নির্মমতা বন্ধে সর্বপ্রম প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। চিন্তা করে ওর স্কুলে বন্ধুদের নিয়ে কোনো একটা কিছু করার। জাহিন ওর ক্লাসের ক্যাপ্টেন। চাইলে বন্ধুদের নিয়ে কোনো সেমিনার বা অমন কিছু করা সম্ভব। ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় আগামী বৃহস্পতিবার ক্লাসে সবার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে। সেদিন ক্লাসে সবাই সম্মত হয়। ঠিক হয় স্যারের সাথে কথা বলে ২টি ইভেন্টে কাজ নিয়ে এগুনোর।
১. ‘অতিথি পাখি নিধন : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক নির্মম আঘাত’ এই শিরোনামে স্কুলজুড়ে একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
২. রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের কে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা। পাশাপাশি সব অভিভাবকদেরও স্কুলে দাওয়াত করা। এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের পাশাপাশি প্রত্যেক ক্লাস থেকে একজন করে শিক্ষার্থীকে অতিথি পাখি নিধনের কুফল সম্পর্কে বক্তব্য দানের সুযোগ দেয়া।
যেই ভাবা সেই কাজ। জাহিনরা মিলে এ নিয়ে কথা বলতে যায় হেডস্যারের রুমে। স্যার তো শোনে মহাখুশি এবং স্যার সাথে সাথে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। এতে বেশ উল্লসিত জাহিনরা এবার বাস্তবায়নের পালা। পরদিনই স্কুলের নোটিশবোর্ডে সাঁটানো হলো প্রতিযোগিতার বিজ্ঞপ্তি। ব্যাপক সাড়া পড়ে স্কুলজুড়ে। রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেয় প্রতিযোগিতায়। শিক্ষক প্যানেল বসে ক,খ ও গ এই তিন বিভাগে ভাগ করে বিজয়ী নির্বাচিত করেন। এবার ঠিক হয় অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ। সাথে সাথে হ্যাড স্যার অভিভাবক সমাবেশ ডেকে সবাইকে অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেন এবং সবাইকে উপস্থিত থাকার জোর তাগিদ দেন। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি দাওয়াত দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ‘বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’র উপজেলা সভাপতি কে। আসে সেই দিন। জাহিনরা জনসচেতনতামূলক বিভিন্স্লো গান সংবলিত হস্তলিখিত প্ল্যাকার্ডে রাঙিয়ে তুলে পুরো অনুষ্ঠানস্থল। শুরু হয় অনুষ্ঠান। বাংলা স্যারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সভাপতি হেডস্যার। একে একে সবাই বক্তব্য দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর বক্তব্যে নির্বিচারে অতিথি পাখি নিধন আইনটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত দেন। রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিবৃন্দ। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সভাপতির বক্তব্য দিতে ডায়াসে দাঁড়ান হেডস্যার। বক্তব্যের শেষ দিকে স্যার জাহিনকে ডেকে নেন স্টেজে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, এই ছেলের কারণে আজকের এই চমৎকার আয়োজন। আনন্দে চোখজোড়া অশ্রুসজল হয়ে ওঠে জাহিনের। হাততালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানস্থল।

Share.

মন্তব্য করুন