নরওয়েকে পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ বলা হয়। একটি দেশ অন্য দেশের চেয়ে কেন বেশি সুখী, এই বিশ্লেষণে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি (দেশজ সম্পদ), সামাজিক নিরাপত্তা, গড় আয়ু, ব্যক্তিস্বাধীনতা, দুর্নীতি প্রতিটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে নরওয়ে পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ।
এ ছাড়াও নরওয়ের জিডিপি, যোগাযোগব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও দেশটিকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। সাধারণত দেশটি উত্তর মেরুতে হওয়াতে এখানকার আবহাওয়াও শীতল, তাই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও তুলনামূলক বেশি। সেই সাথে দেশটির মানুষের মেজাজও ঠাণ্ডা। তাই দেশটি সবচেয়ে সুখী।সুখী হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করার সময় জানা যায় নরওয়ে অপার সৌন্দর্যের দেশ। তেমন বিস্ময়কর কিছু সৌন্দর্যের কথা আজ বলবো। আমাদের জীবনের প্রতিদিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। যদি এমনটা হয় যেখানে সূর্য অস্তই যায় না তাহলে কেমন হবে! সূর্য অস্ত যাবে না এ রকম চিস্তাও তো কখনও আমাদের ধারণায় আসেনি। তবে অবিশ্বাস্য মনে হলেও নরওয়ে তেমন একটি দেশ। নরওয়েকে নিশীথ সূর্যের দেশ বলা হয়। বিশ্বব্যাপী নরওয়ে দেশটি পরিচিতি মধ্যরাতের সূর্যের দেশ বা নিশীথ সূর্যের দেশ হিসেবে। অর্থাৎ মধ্যরাতেও এই দেশটিতে সূর্যের দেখা মেলে। মধ্যরাতের সূর্য হচ্ছে এমন একটা ঘটনা যখন টানা ২৪ ঘণ্টাই সূর্য দিগন্ত রেখার ওপরে থাকে এবং ঐ সকল অঞ্চল ২৪ ঘণ্টাই সূর্যের আলো পেয়ে থাকে। আবার একইভাবে সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নিচে অবস্থান করে তখন ঐ অঞ্চলসমূহে ২৪ ঘণ্টাই রাতের অন্ধকার থাকে।পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত নরওয়ের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকা। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে নরওয়ের কিছু অঞ্চলে ২ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত একটানা সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকে এবং রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে আকাশে গোধূলির আলো ফুটে থাকে। নরওয়ে ছাড়াও উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত কয়েকটি দেশ যেমন- সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নরওয়েরই বেশির ভাগ অঞ্চল উত্তর গোলার্ধের মধ্যে অবস্থিত এবং সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। আর এই কারণেই নরওয়ে মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত। ২৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো থাকার কারণ হচ্ছে নরওয়ের ভৌগোলিক অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল তখন সুমেরু বৃত্ত থেকে যত উত্তরে বা উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই সূর্যের আলো বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। উত্তর গোলার্ধের সর্বোচ্চ স্থান বা সর্ব উত্তরে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস সূর্য আলো দেয় এবং তার পর ৬ মাস অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। অর্থাৎ এই ৬ মাস উত্তর গোলার্ধে শীতকাল থাকে। নরওয়ের সালবার্ড দ্বীপপুঞ্জ উত্তর গোলার্ধের জনসংখ্যা অধ্যুষিত সর্ব উত্তরের স্থান। এই অঞ্চলে ১৯ শে এপ্রিল থেকে ২৩ শে আগস্ট পর্যন্ত একটানা প্রায় ৪ মাস সূর্য আলো দেয়। এ ছাড়াও অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন স্থানে ২-৩ মাস পর্যন্ত একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে মধ্যরাতের সূর্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায় ২১ জুন। প্রাকৃতিক এই ঘটনাটিকে হোয়াইট নাইট বা শ্বেতরাত্রি
বলেও উলেখ করা হয়। কারণ এই সময় স্বাভাবিক নিয়মে সূর্য উঠলেও তা অস্ত না গিয়ে দিগন্ত রেখার ওপরে অবস্থান করে এবং রাতের বেলাও আকাশকে মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত রাখে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই পরাবাস্তব দৃশ্য অবলোকন করতে নরওয়েতে আসেন। বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটির পরিচিতি মূলত মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে থাকলেও এটি ছাড়াও এই দেশটির বিশেষত্ব হিসেবে রয়েছে এর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন- রূপকথার গল্পের মত সুন্দর সব সমুদ্র খাত, অরোরা বোরিয়ালিস বা উত্তরের আলো, তুষার ঢাকা বিস্তৃত মালভূমি আর অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা।
মধ্যরাতের সূর্যের মত আরও একটি মনোমুগ্ধকর ঘটনা হচ্ছে রাতের আকাশ জুড়ে বর্ণিল আলোর খেলা যা অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন লাইটস নামে পরিচিত। নরওয়েতে গ্রীষ্মকালে ৬ মাস যেমন সূর্যের আলো থাকে তেমনি শীতকালে এই অঞ্চলটি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। আর এই সময়েই দেখা মেলে অরোরা বোরিয়ালিস বা সুমেরুপ্রভা। এই মহাজাগতিক আলোর খেলা সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত অন্ধকার রাত্রিতে দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশ অঞ্চলসমূহে এই ঘটনা দেখা যায় এবং নরওয়ে ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য মেরু অঞ্চলেও অরোরা দেখতে পাওয়া যায়।
সুমেরুপ্রভা সৃষ্টি হয় বায়ুম-লের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ওনাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত ইলেকট্রন এবং প্রোটন কণার সংঘর্ষের ফলে। এই সংঘর্ষের ফলে চার্জিত কণাসমূহ থেকে পরমাণুকণাগুলো কিছু শক্তি লাভ করে এবং তা ঐসকল পরমাণু কণায় সঞ্চিত থাকে। এই অভ্যন্তরীণ সঞ্চিত শক্তি যখন আলোক শক্তি হিসেবে বিকিরিত হয়, তখনই অরোরা দেখা যায়। নরওয়ে ছাড়াও আলাস্কা, কানাডা, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও অরোরা দেখা যায়।
নরওয়ের অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি উৎস হচ্ছে এর সমুদ্রখাড়িগুলো যা ফিয়র্ডনামে পরিচিত। বরফ যুগের শেষে এর গভীর উপত্যকা এবং সঙ্কীর্ণ খাড়িগুলো সমুদ্রের পানিতে ডুবে যায় এবং মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। যদিও বিশ্বজুড়ে এরকম অসংখ্য সমুদ্রখাড়ি রয়েছে, কিন্তু নরওয়ের সমুদ্রখাড়িগুলো পর্যটকদের নিকট অত্যধিক জনপ্রিয় এগুলোর নজরকাড়া সৌন্দর্যের জন্য।
নরওয়েতে রয়েছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের পাশাপাশি এ সকল হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ। নরওয়ে এই সুস্বাদু স্যামন বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে রফতানি করে থাকে। হ্রদের কিনার ধরে রয়েছে জেলেদের সারি সারি কেবিন। এ ছাড়াও ইউরোপের সবচেয়ে গভীর হ্রদ Hornindalsvatnet নরওয়েতে অবস্থিত। এই হ্রদের আয়তন ৫১ বর্গ কিলোমিটার, গভীরতা ৫১৪ মিটার। এর উপরিভাগ সমুদ্রপ্রষ্ঠ থেকে ৫৩ মিটার উঁচুতে এবং তলদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৬১ মিটার গভীরে।
সার্বিক দিক থেকে নরওয়েতে রয়েছে প্রাচুর্যের সমাহার। যার কারণে দেশটি হয়েছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। সুখী দেশ হওয়ার অন্যতম কারণ ভৌগোলিক সৌন্দর্য। যার প্রভাব পড়ে এখানকার বসবাসরত মানুষের আচরণের ওপর। তাই নরওয়েকে সুখী দেশ বলা হয়।