পোষা প্রাণী বাড়িতে রাখা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অনেকেই পাখি, খরগোশ, বিড়াল কিংবা কুকুর পোষে। আমি পাখি পুষতাম। কিন্তু মজার বিষয় হলো, পাখি পোষ মানে না তাই আর পুষি না। তবে আমাদের বাসায় বিড়াল এসে থাকতো আবার কিছুদিন পর চলেও যেত। আম্মু বিড়াল দেখতে পারতেন না। তার ধারণা বিড়াল চুরি করে খাবার খাবে। আর আমি যেন বিড়াল না ধরি। কারণ
বিড়াল কামর বা আঁচড় দিলে রোগ হতে পারে। সেদিন আম্মু রান্না করছিলেন। দেখি একটা বিড়াল আম্মুর গা ঘেঁষে অযথাই মিউ মিউ করছিল।আম্মু একটা ঝাঁটা দিয়ে বিড়ালটাকে তাড়াচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘যা দূর হও, মাছ চুরির মতলব।’ আমি আম্মুকে বললাম, ‘আম্মু, বিড়ালটার ক্ষুধা পেয়েছে মনে হয়। একটু ভাত আর মাছের কাঁটা দাও না।’ আম্মু হেসে বললেন, ‘তুই তো জানিস, আমি বিড়াল দেখতে পারি না। তবে তোর বাপের আবার বিড়াল দেখলে দরদ উথলে ওঠে; তুই যেহেতু বললি, আচ্ছা দিচ্ছি।’ আম্মু একটা মাটির পাত্রে একটু ভাত আর
মাছের কাঁটা ও তরকারি দিলেন। বিড়ালটা নিমিষেই সাবাড় করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ করতে লাগলো। আমি আম্মুকে বললাম, ‘আম্মু দেখেছ বিড়ালটা কত্তো ভালো! কি মিষ্টি দেখতে!! মনে হয় সারাদিন খেতে পায়নি। দেখলে তো সব একেবারে সাবাড় করে দিলো।’ আম্মু বললেন, ‘ঠিক বলেছিস খোকা। তোদের ধারণা আমি বিড়াল দেখতে পারি না। বিষয়টা সে রকম না। আসলে প্রাণী জিনিস কখন কী করে তাই সাবধান থাকি। একবার কি হয়েছিল শুনবি? আমি হেসে বললাম, ‘মা সেকি? বিড়াল নিয়েও দেখি তোমার কাহিনী আছে? আচ্ছা বলতো শুনি।’ আম্মু বলতে শুরু করলেন, ‘তখন তোর জন্ম হয়নি। তোর বড় ভাইয়া তখন তোর থেকেও ছোট, আমি সারাদিন রাজ্যের কাজ নিয়ে
ব্যস্ত বাড়িতে। এটা করি তো ওটা। সেদিন হাটবার ছিল। তোর বাপ করলো কী জানিস? দুই কেজি গরুর গোশত নিয়ে হাজির। বললো, এগুলো ধুয়ে রান্না করতে। রাতে খাওয়া যাবে। আমি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। সওদাগুলো গুছিয়ে গোশতগুলো একটা মাটির কুঁড়া মানে পাত্রে রেখে ঢাকা দিয়ে ভারি একটা পাথর চাপা দিলাম।
তারপর কলপাড়ে গেলাম কাপড়গুলো ধুতে, কাজের ব্যস্ততার কারণে মনে হয় দরজা লাগিয়ে দেইনি। হঠাৎ তোর দাদীর চিৎকার, কী হলো
পোষা প্রাণী বাড়িতে রাখা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অনেকেই পাখি, খরগোশ, বিড়াল কিংবা কুকুর পোষে। আমি পাখি পুষতাম। বলতেই শুনলাম বিড়াল সব গোশত সাবাড় করেছে। শুনে তো মাথা আমার খারাপ। তোর বাপ যদি জানে তাহলে রক্ষে নেই। তোর দাদী
বললো, আচ্ছা চুপ থাকো। যা হওয়ার তাই হয়েছে। একটা কাজ করো, বাজার থেকে গোশত এনে রাখলে তো আর বুঝতে পারবে না। কী করা। আমি টাকা বের করলাম। কিন্তু কিছু কম আছে। তোর দাদী কিছু দিলো, চুপ করে তোর চাচ্চুকে বাজারের পাঠালাম। সে গোশত কিনে আনলে সেটা রেঁধে রাখলাম। তোর বাবা আর বুঝতে পারেনি।
সে দিনের মতো বেঁচে গেলাম। তখন থেকেই আমি বিড়াল, কুকুর এগুলো এড়িয়ে চলি।’ আম্মুর কথা শুনে আমি হো হো করে হেসে পরে যাচ্ছি। বললাম, ‘আম্মু তুমি এতো বোকা?’ আম্মু বললেন, ‘কেনরে খোকা? এখানে বোকামির কী দেখলি। বুঝলাম না।’ আমি বললাম, মনে হয় ওটা বাইরের বিড়াল ছিল, পোষা না। পোষা বিড়াল খাবার চুরি করে না বুঝলে? বরং ক্ষুধা পেলে মিউ মিউ করে খাবার চায়। আম্মু, আমি এই বিড়ালটা পুষবো। আম্মু বললেন, ‘আচ্ছা। তুই যখন বললি ঠিক আছে ও আজ থেকে আমাদের বাসায় থাকবে।’ আমি তো মহা খুশি। বললাম, ‘সত্যিই মা। তুমি খুব ভালো।’ আম্মু হেসে দিয়ে বললেন, ‘হয়েছে, নে এবার ভাত খা, বোয়াল মাছের ঝোল রেঁধেছি। তোর প্রিয় খাবার।’ আম্মু আমায় ভাত দিয়ে কলপাড়ে চলে গেলেন। বিকালে আব্বু বাসায় এসে আম্মুকে ডাকলেন। আম্মু আর আব্বু গল্প করছিলেন। আব্বু বলছিলেন, ‘মাঝে মাঝে এসব অবলা প্রাণীকে দেখলে খুব কষ্ট হয় বুঝলে। যাক, খোকা বিড়ালটা পুষতে চায় পুষুক, না করো না। ছোট মানুষ। আম্মু বললেন, ‘না আর করে কি রক্ষা পাবো। তোমরা বাপ-বেটা যা ইচ্ছা তাই করো। আর হ্যাঁ শোনো। বড় খোকা ফোন করেছিল, ওর পরীক্ষা সামনের মাসে। বই, কাপড় ও মেস ভাড়াসহ ওর কিছু টাকা লাগবে। খালি বিড়াল নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? এ দিকটাও তো দেখতে হবে।’
আব্বু বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ওকে ফোন করে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। ছোট খোকা কই?’
আম্মু বললেন, ‘কোথায় আর যাবে? ওই বিড়ালটা নিয়ে মনে হয় পুকুরপাড়ে বসে আছে। এই ছেলে শেষমেশ পড়ালেখাটা নষ্ট করবে নাকি কে জানে?’ পুকুরের পাশে রান্নাঘর হওয়ায় আমি সব কথা শুনতে পেলাম। আমি সেখান থেকে উত্তর দিয়ে বললাম, ‘আম্মু তুমি যে কী?
বিড়ালের সাথে পড়ালেখার কী? বলতো? আমি পড়াশোনা করি না নাকি? শোনো, তোমার ছোট খোকা ক্লাসের ফার্স্ট বয়।’ আমার কথা শুনে বাবা হো হো করে হেসে বললেন, ‘সত্যিই তো, আমাদের ছোট খোকা অনেক বড় হয়েছে।’
বাড়িতে বিড়ালটাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। আমিসারাদিন ব্যস্ত থাকি তাই ওকে খাবার দিতে পারি না। শুনলাম আব্বুই নাকি বিড়ালটাকে খাবার দেন। মা বললেন, আজকে বড় একটা ইঁদুর ধরেছে ও। তারপর ওটা নিয়ে খাটের নিচে খেয়েছে। মার সেকি বকাঝকা। ঘর নোংরা করে দিলো। সব তোদের বাপ-বেটার জন্য। আম্মুর এই এক সমস্যা। একটুতে চেঁচিয়ে একেবারে বাড়ি মাথায় তোলেন। ‘এইরে, বিড়ালটার আবার কী হলো?’ সত্যিই তো বিড়ালটাকে আমাদের বাচ্চাওয়ালি লাল মুরগিটা তাড়া করেছে। আমি ছুটে গেলাম। মুরগিটাকে পিটিয়ে দিয়ে বিড়ালটার কাছে গেলাম।
বিড়ালটা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে কাঁপছিল। আসলে বিড়ালটা একটু ভিতু টাইপের। আর দশটা বিড়ালের মতো না। আমাকে দেখে যেন বিড়ালটা রক্ষা পেল। ও আমার গা ঘেঁষে আশপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। আমি হেসে বললাম, ‘নে হয়েছে এবার। মুরগিটা পালিয়েছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? যা, এবার শুয়ে থাক। আমি গোসল করতে যাবো।’ বিড়ালটার কাছ থেকে বিদায় নিতেই আব্বু এসে হাজির। আব্বুকে দেখেই বিড়ালটা মিউ মিউ করতে লাগলো এবং ঘরে নিয়ে গেল। আব্বু হাতে মুড়ি নিয়ে বারান্দায় ওকে খেতে দিলেন। বিড়ালটা খাচ্ছে আর আব্বু পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন। মুড়ি খাওয়ার কড়মড় শব্দ। কী অদ্ভুত শব্দ! আমি গোসলের জন্য কলপাড়ে চলে গেলাম। এভাবে দিন যায়, মাস যায় নতুন বছর আসে। আর বিড়ালটাও আজ প্রায় ২ বছর যাবৎ আমাদের বাড়িতে আছে। আম্মু নামাজ পড়তে বসলে জায়নামাজের পাশে বসে থাকে। কখনও খাটে শুয়ে ঘুমায়। মজার ব্যাপার বিড়ালটা দিনের বেশি ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। সবাই বলে বোকা আর আলসে বিড়াল এটা।
গোটা বাড়িতে একটাই কথা। বোকা বেড়ালটা খুব অলস। খালি মুড়ি খায় আর ঘুমায়। আম্মু সেদিন বললেন, ‘কই ইঁদুর তো ধরতে পারিস না? খালি সারাক্ষাণ মুড়ির ধান্দা।’ আমরা সবাই হাসি কারণ বিড়াল আবার মুড়ি খায় নাকি? এই বিড়ালই কি পৃথিবীর একমাত্র গাধা টাইপ বিড়াল যে কিনা শুধু মুড়ি খায়? কি জানি বাবা! এ রকমই হচ্ছে। এক দিনের কথা আমি কখনও সরাসরি বিড়াল টাচ করিনি। সেদিন কেন জানি মনে হলো একটু কোলে নিয়ে দেখি তো! যেই না বিড়ালটা কে টাচ করতে গেলাম ওমনি বিড়ালটা আমার হাত নখ দিয়ে দিলো। হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে লাগলো। মেজাজ গেল বিগড়ে। হাতটা ভালোভাবে ড্রেসিং করলাম এবং ঔষুধ খেলাম।
কয়েকদিন বিড়ালটাকে এড়িয়ে চললাম। কিন্তু বিড়ালটা আমার পেছনে ঘুর ঘুর করা কন্টিনিউ করতে লাগলো। আব্বুর বন্ধুরা বাসায় আসেন। বিড়ালকে আদর-যত্ন করতে দেখে মজা পান। আব্বু ওদেরকে বিড়ালের গল্প শুনান। আম্মুও আর বিড়ালটাকে অবহেলা করেন না। বরং মুড়ি খেতে দেন। কিন্তু একদিন এক ঘটনাই বিড়াল সংক্রান্ত মজার ব্যাপারটিকে শোকে পরিণত করে।
সেদিন সন্ধ্যা বেলা বিড়ালটা একটা ময়লা ডোবা টাইপ কিছু একটাতে পড়ে গিয়ে ওর গা ময়লা করে ঘরে ঢুকে। আমাদের এক ভাড়াটিয়া ছেলে রেগে বিড়ালটাকে রড দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। উল্লেখ্য, এর আগেও ও বিড়ালটাকে বিনা কারণে মেরেছিল। আমি কিছু বলিনি মানে বলে কী করবো? পৃথিবীতে কিছু অমানুষ আছে যারা অসহায় নারী, শিশু, বৃদ্ধা হোক সে নারী বা পুরুষ তাদের প্রতি মানবতা দেখায় না। তারা কী করে একটা সামান্য বিড়ালের প্রতি মানবতা দেখাবে? সারাটা জীবন আমি খালি মানবিক ইস্যুগুলোতে প্রতিবাদ করেছি বাট আমিও বারবার মানবতা থেকে বঞ্চিত হয়েছি কিছু মানুষরূপী জানোয়ারের কাছ থেকে। যাক সে কথা। বিষয়টা আমি কিন্তু পরে জেনেছি যখন দেখেছি বাড়িতে বিড়ালটা নেই কেন? আমি আব্বু ও আম্মু প্রতিদিন বিড়ালটার ফিরে আসার পানে চেয়ে থাকি। কিন্তু বিড়ালটা আর আসে না। শুনলাম বিড়ালটা নাকি অসুস্থ হয়ে মরে গেছে।
কিন্তু আমি কেন জানি বিশ্বাস করতে পারলাম না। একদিন সন্ধ্যাবেলা কিচেনে গেলাম খাবার গরম করতে। ওমনি দেখলাম, বিড়ালটা। আমাকে দেখে মিউ মিউ করছে। কাছে যেতেই বিড়ালটা উধাও। আমি চিৎকার করে সবাইকে ডাকলাম। কিন্তু বিড়ালটকে না দেখে সবাই বললো, আমি হেনুসিলেট করেছি। মৃত বিড়াল কি ফিরে আসে? হ্যাঁ আমার মতো মস্তিষ্কে মৃদু স্ট্রোক করা রোগীরা হেনুসিলেট করলেও করতে পারে। কিন্তু মানবতাকে অস্বীকার করতে পারে না। প্রাণীদের বেলাও কি মানবতা আছে? হয়ত নেই। তবে আমার ও আব্বুর কাছে আছে বোবা বিড়ালটার প্রতি মানবতা!

Share.

মন্তব্য করুন