আর দশটা নিম্নবিত্ত পরিবারের মতোই গল্পটা। স্বল্প আয়ের টানাটানির
সংসার, বাবা-মায়ের স্বপ্ন সব সম্বল দিয়ে হলেও সন্তানকে শিক্ষিত করা
যাতে তারা বড় হয়ে একটু উন্নত জীবন যাপন করতে পারে; কিন্তু মানুষের
জীবন সব সময় ধরাবাঁধা নিয়মে চলে না। কেউ কেউ ভিন্ন পথেই লেখেন
নিজের গল্প, ক্যারিয়ার সাজান অন্যরকমভাবে যা কেউ ভাবেনি। জাতীয়
ক্রিকেট দলের তরুণ সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজের
গল্পটা ঠিক এমনই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে পা রেখেই যিনি জায়গা
করে নিয়েছেন সম্ভাবনাময়ীদের কাতারে। জাতীয় দলে এখন অটোমেটিক
চয়েজ হয়ে দাঁড়িয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

সাকিব আল হাসানের যোগ্য স্পিন বোলিং পার্টনার খুঁজে পাওয়ার জন্য গত ৮ বছরে কম চেষ্টা হয়নি বাংলাদেশে। এই সময় অন্তত ছয়জন স্পিনারের অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে (সোহাগ গাজী, আরাফাত সানী, ইলিয়াস সানী, তাইজুল ইসলাম, জুবায়ের হোসেন প্রমুখ)। কিন্তু তাদের কেউই দলে স্থায়ী হতে পারেননি। এদের সবার শেষে দলে এসেছেন তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও ভালোই পারেন, তাই দলে তার পরিচয় অলরাউন্ডার। যদিও বোলিংটাই মিরাজের মূল কাজ। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে টেস্ট সিরিজে অভিষিক্ত হয়েই প্রতিভার জানান দেয়া শুধু নয়, রীতিমতো তারকা হয়ে যান মিরাজ। দুই ম্যাচের সিরিজে অভিষিক্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেয়ার রেকর্ড দখলে নেন। টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন আর অভিজাত আঙিনায় অভিষেকে এত সুন্দর নৈপুণ্য দেখানো সহজ কথা নয়।
চট্টগ্রামে অভিষেক টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেটসহ মোট ৭ উইকেট আর ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে তো বলতে গেলেই একাই হারিয়ে দিয়েছেন ইংলিশদের। দুই ইনিংসে ৬টি করে মোট ১২ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন ম্যাচ ও সিরিজ। নিজে হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ ও ম্যান অব দ্য সিরিজ।
শুরু থেকেই নতুন বলে বোলিং করার বিষয়ে তিনি অধিনায়কদের আস্থার পাত্র হয়ে উঠেছেন। বয়সভিত্তিক দল থেকেই নতুন বলে বোলিং করতে অভ্যস্ত ছিলেন বিধায় দ্রুতই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন এই ভূমিকায়। ফলে মিরাজ দ্রুতই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে চলছেন জাতীয় দলের নিয়মিত অলরাউন্ডার হিসেবে। যেভাবে উঠে আসা মেহেদী হাসান মিরাজের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায়; কিন্তু বাবার কর্মস্থলের সুবাদে শৈশব থেকেই বেড়ে ওঠা খুলনায়। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই ব্যাট-বল ছাড়া কিছু বুঝতেন না মিরাজ। বাবা জালাল হোসেন পেশায় গাড়ি চালক। বাবা-মা মিরাজের ক্রিকেট খেলার বিষয়টি সমর্থন করতেন না। বাধাও দিতেন। তারা চাইতেন ছেলে বড় হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হোক। এমনকি ক্রিকেট খেলার জন্য বাবার হাতে মারও খেতে হয়েছে তাকে। তবে ভাগ্য যার ক্রিকেটে লেখা তাকে কি আর ফেরানো যায়! স্কুলে পড়া অবস্থাতেই মিরাজ নজরে আসেন স্থানীয় কাশিপুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ আল মাহমুদের। পরিবারের সম্মতি ছিলো না বিধায় টাকা খরচ করে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিলো না তার। তবে এক প্রতিবেশীর সহযোগিতা আর কোচের আগ্রহে অ্যাকাডেমিতে প্র্যাকটিস শুরু করেন মিরাজ। প্রতিভা দেখে কোচ মিরাজকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এমন ঘটনাও আছে যে, মিরাজের বাবা প্র্যাকটিসের সময় মাঠ থেকে ধরে নিয়ে গেছেন ছেলেকে।
ওই অ্যাকাডেমি থেকেই বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ হয় মিরাজের। সেই দলের হয়ে একটি টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়ে জেতেন জীবনের প্রথম পুরস্কার ২৫ হাজার টাকা। এরপর অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলার পর সুযোগ হয় অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। ব্যাস! ঘুরে যায় জীবনের মোড়। ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্বও দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সেই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স আর সাথে ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করার পুরস্কার হিসেবে সে বছরই ডাক পান ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথ চলা। বয়স তখন ১৯ বছর।
অভিষেকের পর মিরাজও কিছুদিন হাঁটতে শুরু করেছিলেন অচেনা রাস্তায়। নিউজিল্যান্ড ও ভারত সফরে পরবর্তী তিন টেস্টে মাত্র ৬ উইকেট, তবে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে আবার ফিরে আসেন তিনি। ১০ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে টেস্ট সিরিজ ড্র করতে সাহায্য করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজেও ২৯ গড়ে নিয়েছেন ৮ উইকেট।
তবে টেস্টে এমন পারফরম্যান্স সত্ত্বেও মিরাজ সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না প্রথম দিকে। যার ফলে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে সাকিব আল হাসানের বোলিং পার্টনার নিয়ে সেই অভাব থেকেই যাচ্ছিল। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফি ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভারতে অনুষ্ঠিত সিরিজ মিলিয়ে ছয় টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ১টি উইকেট নেন এই ডানহাতি অফস্পিনার। ওয়ানডেতেও ছিলেন ম্লান। ফলে নাসির হোসেন, সোহাগ গাজীদের হারিয়ে যাওয়া দলে আরো একটি নাম যোগ হবে কি না সেই সংশয় দেখা দিয়েছিলো।
তবে মিরাজ ঠিকই নিজেকে ফিরে পেয়েছেন ২০১৮ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। দুই টেস্টে ১০ উইকেট নেয়ার পুরস্কার হিসেবে জায়গা হয় ওয়ানডে দলে। সেই সিরিজে মাত্র ৪ উইকেট পেলেও দারুণ কিপটে বোলিং করেন মিরাজ। ক্রিস গেইল আর এভিন লুইসের মতো আক্রমণাত্মক দুই ওপেনারের সামনে যা সত্যি বিস্ময়কর। ফলে গত এশিয়া কাপের দলে নিয়মিত মুখ ছিলেন মিরাজ। দলের প্রয়োজনে বোলিং-ব্যাটিং দুই ভূমিকাতেই সফল তিনি। তামিম ইনজুরির কারণে দল যখন ওপেনার সঙ্কটে ভুগছিলো সে সময় ফাইনালে লিটন দাসের সাথে ইনিংস ওপেন করতে নেমে গড়েছেন ১২০ রানের উদ্বোধনী জুটি।

Share.

মন্তব্য করুন