(গত সংখ্যার পর)

জয়দেব বাবুর ধারণাই সত্য। তারা নতুন করে বিপদে পড়লো। তাদেরকে যেখানে আনা হয়েছে- তা রীতিমতোই একটা ব্যারাক! এখানে প্রায় পনেরো দিন কেটে যাওয়ার পরও তাদের যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এমনকি এখান থেকে বেরুতে পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না। চতুর্দিকে কড়া পাহাড়া। অস্ত্রপাতি, বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিফর্ম, বুট-এইসবের ছড়াছড়ি জায়গাটিতে। একটিমাত্র ঘরের চারপাশে বেশ ক’জন লোক পাহারা দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, তাদের ইউনিফর্মের কোনো ম্যাচিং নেই। এই যেমন- একজনের গায়ে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক অথচ পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট! আবার একজনের পায়ে বুট, গায়ে পুরনো ও ময়লা টি-শার্ট এবং মাথায় কমান্ডোদের মতো হেলমেট! আরেকজন পরে আছে এমন একটা পোশাক- যেটাকে বাংলাদেশী কোনো বাহিনীর পোশাক বলেই মনে হয় না। জয়দেব বাবু নিশ্চিত হলেন যে, এরা পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। কী উদ্দেশ্য এদের? এরা কেন আটকে রাখছে তাদের? নয়ন বললো- ‘স্যার, আমি শুনেছি- এরা নাকি খুব দুর্ধর্ষ। তবে কোনো বিপদগ্রস্ত লোকের ক্ষতি এরা করে না। এদের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এদের কাছে নালিশ করলে এরা নাকি সঠিক বিচার করে দেয়।’
‘তুমি সত্য শুনেছো। কিন্তু এরা সাধারণ সদস্য, কোনো অথরিটি না। কে জানে- আমাদেরকে যারা তুলে এনেছে তাদের সাথে এদের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা! আমার ধারণা, অবশ্যই থাকবে।’
‘তাহলে তো খুব বিপদ স্যার।’
‘আস্তে। আস্তে কথা বলো। দেয়ালেরও কান আছে।’
‘কোনো একটা পথ বের করতে হবে স্যার। আমাদেরকে বাঁচতে হবে।’
‘সাহস রাখো। আমরা যেহেতু এখনো দু’জন একসাথেই আছি- ভগবান কোনো একটা পথ বের করে দেবেন।’
‘স্যার, একটা কথা…।’ নয়ন চাপা আওয়াজে ফিসফিস করে বললো।
জয়দেব বাবু নয়নের একদম কাছে এগিয়ে এসে বললো- ‘কী কথা, বলো।’
‘স্যার, টয়লেটের পেছনের দেয়ালে উপরের দিকে একটা খুপড়ি আছে।’
‘হুম, তুমি চাইলে বেরোতে পারবে। আমার শরীর যাবে না। তাছাড়া ওভাবে বের হলে ধরা পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা আগে যেহেতু একবার পালিয়ে এসেছি- তাই ওরাও আমাদের ব্যাপারে সতর্ক।’
‘কিন্তু ওরা যদি আমাদেরকে আবার তাদের হাতে তুলে দেয়।’
‘চুপ…! বাইরে কেউ একজন আসছে।’ মুখের কাছে তর্জনী আঙুল তুলে জয়দেব বাবু নয়নকে সতর্ক করলেন। তারা দু’জনই চুপচাপ বসে আছেন। এরমধ্যে বাইরের পায়ের আওয়াজ দরজার কাছে এসে থেমে গেছে। তারপরই ঠকঠক আওয়াজ হলো কপাটে। নয়ন উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দ্রতপায়ে একজন ভেতরে প্রবেশ করলো। নয়ন এবং জয়দেব বাবু নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। তারা দু’জনই আশ্চর্য হয়েছে লোকটির চেহারা আর পোশাক দেখে।
লোকটি বাঙালী- কিন্তু এদের গ্রুপে আসলো কী করে তাই ভেবে অবাক হলো তারা। কথা শুরু করলো লোকটি-
‘আমার নাম আলফু মিয়া। ভিতর পার্টির বাইট্টা গ্রুপে আছি। আমার বাড়ি গোমতি। তো, এখন সব কথা বলা যাবে না। আপনারা দ্রুত রেডি হন।’
‘কেন কোথায় যেতে হবে আমাদের?’ আশ্চর্য চোখে একবার লোকটির দিকে আরেকবার জয়দেব স্যারের দিকে তাকাচ্ছে নয়ন।
‘যা বলছি- দ্রুত করেন।’ আবার তাড়া দিলো লোকটি।
‘আমরা রেডি। কিন্তু কোথায় নেয়া হবে আমাদের? আমরা এখন মৃত্যুকেও ভয় করি না। আমাদেরকে বলুন- আজ রাতেই মেরে ফেলবেন কিনা আমাদের। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চট্টগ্রামে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন বলে আপনারা আমাদের এখানে এনেছিলেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো- আপনারা আমাদের বন্দী করে রেখেছেন। এখন এতো রাতে কোথায় নেবেন আমাদের?’ জয়দেব বাবুর কণ্ঠস্বর এসময় অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনালো। জয়দেব বাবুর কথা শুনে লোকটির চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এবার সে বললো-‘আপনারা আমাকে নিজেদের সমগোত্রীয় ভাববেন- কেবল এজন্যই সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনারা আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবশ্য বিশ্বাস না করারই কথা। এখন আমি শুধু বলতে চাই আপনাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেটা কোনো বন্দিখানা নয়। আপনারা নিজেদের কথা ভাবতে পারবেন। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।’
নয়ন বললো-‘স্যার, আল্লাহ ভরসা। চলেন আমরা উনার সাথে বেরিয়ে পড়ি।’
‘কিন্তু…!’
‘যা হবার হোক। নতুন জায়গায় যাচ্ছি তো। এরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কী করে তাই দেখা যাক।’
‘চলো তাহলে।’
‘চলুন। আমরা রেডি।’ বললো নয়ন।
তারা তিনজনই আলফু মিয়ার সাথে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে আসলো। আলফু মিয়ার কাঁধে একটা শক্তিশালী রাইফেল। হাতে একটা টর্চ। খুব দ্রুত গতিতে হাঁটছে সে। পেছনে পেছনে অনেকটা দৌড়ের মতো করে হাঁটছে নয়ন আর জয়দেব বাবু। অন্ধকার রাত। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আলফু মিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেক দূর পর্যন্ত চলে আসলো। এবার থামলেন আলফু মিয়া। জয়দেব বাবুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে সে যা বললো তাতে বোঝা গেলো- আলফু মিয়া তাদের দু’জনকে বাঁচাতেই চান। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তারা একদম নিচে নেমে এলো। একটু দূরেই পাহাড়ি নদী। আলফু মিয়া খুব সংক্ষেপে বললেন- ‘আমি একজন বাঙালী। দীর্ঘদিন যাবৎ বিভ্রান্ত হয়ে এবং আর্থিক সুবিধা পেয়ে আমি ওদের সাথে কাজ করছি। অনেক অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছি। স্বজাতির বিরুদ্ধে অনেক অপরাধ-অপকর্ম করেছি। কিন্তু আর নয়। ওদের ওখানে থাকলে ওরা আপনাদের দু’জনকে মিশনারীদের হাতে তুলে দিতো। তারা আপনাদের নিয়ে যেতো আমেরিকায়। সেখানে নিয়ে কী করতো তা আমার জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে, আপনারা আর কখনোই এদেশে ফিরে আসতে পারতেন না। সামনের নদীতে আপনাদের জন্য একটা নৌকা রাখা আছে। একজন লোক আছে নৌকায়- চালক। চালকের সাথে কোনো কথা বলবেন না আপনারা। এখন খুব দ্রুত গিয়ে ওই নৌকায় উঠে পড়ুন। নদীটা গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। নদীর আশেপাশে খুব সম্ভবত ওদের কেউ থাকবে না। সুতরাং আপনাদের তেমন কোনো বিপদও দেখছি না। সকাল নাগাদ আপনারা কোনো না কোনো লোকালয়ে পৌঁছে যেতে পারবেন। তারপরের দায়-দায়িত্ব আপনাদের। যান, খুব দ্রুত গিয়ে নৌকায় উঠে পড়ুন।’ থামলো আলফু মিয়া।
জয়দেব বাবু বললেন- ‘কিন্তু আপনি যেহেতু ওদের সাথে আর থাকতে চাচ্ছেন না এবং ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই আমাদের ওখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সুতরাং আপনিও নাহয় চলুন আমাদের সাথে।’
‘না। যা বলছি তাই করুন। কুইক! পরে বেঁচে থাকলে দেখা হবে। আল্লাহ হাফিজ।’
‘আল্লাহ হাফিজ।’ বললো নয়ন।
তারা দু’জনই নৌকার উদ্দেশ্যে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকলো। আর পেছনের অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর মুহূর্তেই মিশে গেলেন আলফু মিয়া।দূর-পাহাড়ের-দানো

সাত.

মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ। এরই মধ্যে এসএসসি বোর্ড পরীক্ষাও শেষ হয় ইভান, অয়ন, সিফাত, ইরিনা ও অঞ্জুদের। ইভানের বাবা-মা দু’জনেরই ইচ্ছে- ইভানকে ঢাকায় পাঠানোর। সে হিসেবে তার মেজো মামার সাথে কথা বলা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে তিনি এসে ইভানকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। এদিকে এতো দিনেও জয়দেব স্যার ও নয়নের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় স্কুলের সর্বস্তরের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। কর্মসূচি থেকে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে নিখোঁজ ছাত্র-শিক্ষকের সন্ধান দাবী করা হয়। এরমধ্যে প্রশাসন থেকে কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তারপরও কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষকরা কর্মবিরতির দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
বুধবার রাতে ইভানদের বাসায় আসে অঞ্জু। সে ওদের বাসায় এর আগে খুব কমই এসেছে। আজ যখন রাত ন’টার দিকে এসে কলিংবেল টিপলো তখন জাহানারা খানম ইশার নামাজ পড়ছিলেন; ফরজ আদায় করে সবেমাত্র সালাম ফিরিয়েছেন। জায়নামাজে বসেই তিনি ইভানকে ডাকলেন-‘ইভান, দেখ তো বাবা- বাইরে কে আসলো।’
ইভানের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় সে বসে বসে জিদানকে অঙ্ক করাচ্ছিলো।
‘আচ্ছা আম্মু দেখছি।’ জবাব দিলো ইভান। তার জবাব শেষ হওয়ার আগেই বই বন্ধ করে দরজা খুলতে চলে গেলো জিদান।
দরজার সামনে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জু। সে নতুন কারো সামনে গেলে কিংবা কারো বাসায় গেলে বিব্রতবোধ করে এবং শরম লাগে তার। জিদান এসে দরজা খুলতেই দেখলো অঞ্জুকে। সে আগেও দু’য়েকবার তাকে দেখেছে।
অঞ্জু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে ইভানকে ডাকলো-
‘ভাইয়া দেখে যা তো, কে এসেছেন।’
‘কে আসলো?’
‘তোর বন্ধু। অঞ্জু ভাইয়া।’
‘আচ্ছা, আসছি।’
ইভান এসে অঞ্জুকে ঘরের ভেতরে যেতে বললে, সে বললো- ‘না, ভেতরে যাবো না। তুই একটু বাইরে আয় সামান্য একটু কথা বলে চলে যাবো।’
‘আচ্ছা আসছি।’
ইভান অঞ্জুর সাথে বাইরে চলে আসলো। উঠোনের এক কোণে দাঁড়ালো তারা দু’জন। অঞ্জুই বলতে শুরু করলো-‘ইভান, একটা বিষয়ে তোর সাথে কথা বলতে চাই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘কী বিষয়, বলতো!’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো ইভান।
‘এখন থেকে তিন-চার মাস আগে লোকটিকে দেখেছিলাম। তার চেহারাটা আমার চোখে ভাসছে এখনো। আমার মনে হয় লোকটি এখন এই
শহরেই আছে।’
‘কোন লোক? কার কথা বলছিস তুই?’
‘জয়দেব স্যারকে কিডন্যাপ করতে যে লোকটি এসেছিলো- তার কথা বলছি।’
‘বুঝলাম না। তুই দেখেছিলি লোকটিকে? তা কখনো তো বলিসনি!’
‘আরে, ওরা একা ছিলো নাকি! ওরা একটা কালো মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছিলো। ভেতরে ঠিক ক’জন ছিলো এবং কার কী চেহারা এসব আমি
কিছুই দেখিনি। সম্ভবত চার-পাঁচজন ছিলো। শুধু একজনকে দেখেছি। লোকটি একবার মাত্র গাড়ির কাচ ফাঁক করে আমার দিকে চেয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিলো। নাকি আমাকেও তুলে নিতে চেয়েছিলো- কে জানে! তারপরই আবার গাড়ির কাচ নামিয়ে দেয়। আমি তখন ইশকুলের গেইট দিয়ে ঢুকে কলেজ ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। তারপর স্যারের রুমে গিয়ে দেখলাম ওই অবস্থা।’
‘তা ওই লোকটিকে শহরের কোথায় দেখলি? আমার মনে হয়, তুই ভুল করছিস। লোকটি তো অন্য কেউও হতে পারে।’
‘তা পারে। কিন্তু এখন এ অবস্থায় সন্দেহেরও গুরুত্ব আছে। লোকটিকে আমি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করার চিন্তা করেছিলাম। এতে যেটা হতো, তা হলো- আশেপাশের লোকেরা এসে জড়ো হতো এবং তারপরই তাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয়া যেতো। এ ঘটনার পর পুলিশ চাইলেই কিন্তু তাকে ছেড়ে দিতে পারতো না। তারপর আবার ভাবলাম- লোকটির পিছে পিছে যাওয়া যাক।’
এটুকু বলে একটু থামলো অঞ্জু। তারপর আবার বলতে শুরু করলো-
‘লোকটি এই শহরেই থাকে। আমার মনে হয় কী জানিস?’
‘কী?’
‘লোকটির ব্যাপারে এক্ষুণি পুলিশকে ইনফর্ম করা ঠিক হবে না। কারণ এরা যখন নয়নকে ইচ্ছেকৃত গাড়ি মেরে দিয়েছিলো, তখন এদের ড্রাইভারকে ধরিয়ে দেবার পরও একঘণ্টার মধ্যেই আবার ছেড়ে দিয়েছিলো পুলিশ। সে নাকি পুলিশকে কী একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্ডও দেখিয়েছিলো!’
‘তো কী করবি এখন? আমার তো প্রথম থেকেই মনে হয়েছে এরা খুবই শক্তিশালী কোনো আন্তর্জাতিক গ্রুপ।’
‘অফকোর্স! কিন্তু এখন আমাদের যেটা করতে হবে, তা হলো- লোকটির গতিবিধি লক্ষ রাখতে হবে। এই দায়িত্ব আমার। তোকে শুধু জানিয়ে রাখলাম।’
‘কিন্তু আমার যেটা মনে হয়- আমরা নিজেরা কিছুই করতে পারবো না। লোকটিকে সন্দেহজনক আসামি হিসেবে পুলিশে দেয়াই ঠিক।’
‘খারাপ বলিসনি। কিন্তু একটা অবস্থা তৈরি হওয়ার আগে একে পুলিশে দেয়া যাবে না।’
‘কী অবস্থা তৈরি করতে চাস তুই?’
‘শুধু তুই তুই করছিস কেন? আমি একা তো নই- আমরা! আমরা সবাই। তুই, আমি, অয়ন, হেডস্যার…।’
‘রেগে যাচ্ছিস কেন খামোখা? বল- আমরা কী করতে পারি?’
‘আমাদের উচিৎ জয়দেব স্যার এবং নয়নের সন্ধান চেয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখা। এজন্য আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। আমরা নয়নের মাকে দিয়ে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করি। কী বলিস?’
‘আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু হেডস্যারকে তো বলতে হবে।’
‘হুঁ, তা তো বলবো! হেডস্যার বরং খুশিই হবে, এটা আমার বিশ্বাস।’
‘তার পরের স্টেপ কী করবি?’
‘এখনই নয়। আমি আজ রাতটা ভাবি। কাল তোর সাথে শেয়ার করবো। এখন আমি বাড়ি যাই। কী বলিস?’
‘আচ্ছা যা। সাবধানে থাকিস কিন্তু!’
অঞ্জু কিছুদূর গিয়েই আবার ফিরে আসলো। ইভান তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে অঞ্জুকে বললো- ‘কিরে, কী ব্যাপার?’
‘আচ্ছা ইভান, তুই ঢাকা যাচ্ছিস কবে?’
‘পরশু দিন, শুক্রবার। বিকেলের ট্রেনে।’
‘হুম, তাহলে তোকে নিয়ে আর কীভাবে কাজ করবো?’
‘আমাকে সবকিছু জানাবি। তোর সাথে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আব্বু নাকি মামাকে বলে দিয়েছেন, আমাকে এসে নিয়ে যেতে। মামা কালই আসবে। এখন আমি কী করবো বল। তবু আমি তোর কাজের সাথে থাকতে চাই। আর ফোনে তো যোগাযোগ হবেই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
‘আমাকে জানাবি কিন্তু সব।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে বললাম তো!’
‘ওকে।’
ইভানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অঞ্জু বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। প্রতিদিন গাড়িতে-টেম্পুতে চড়ে নদীর ওপার থেকে এতো পথ পাড়ি দিয়ে তাকে শহরে আসতে হয়। তবে আসতে আসতে তার কাছেও ব্যাপারটা অনেক ইজি হয়ে গেছে। তাছাড়া মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ায় এখন অনেক ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াতে পারে সে। সকালেই আবার ইভানদের বাসায় আসলো অঞ্জু। সাথে অয়ন,সিফাত এবং ইরিনাও। ওরা ইভানকে ডেকে নিয়ে রাস্তার পাশের খোলা জায়গাটিতে চলে গেলো। কথা শুরু করলো অঞ্জু- ‘লোকটিকে আজই পুলিশে ধরিয়ে দেবার চিন্তা করেছি। তোরা কী বলিস?’
ইরিনা এবং সিফাত লোকটি সম্পর্কে কিছুই জানে না এখনো। অঞ্জু বলেনি। তবে গত রাতেই সে অয়নকেও বলেছিলো পুরো ব্যাপারটা। ফলে ইরিনা একবার জিজ্ঞেস কওে বসরো- ‘কোন লোকটির কথা বলছিস অঞ্জু?’
অঞ্জু তার কথার কোনো জবাব না দিয়েই বলতে থাকলো- ‘কারণ আমি খোঁজখবর নিয়ে যতোটা জেনেছি- এই লোকটি শহরে খুব কম আসে। আর আসলেই দু’তিনদিনের মধ্যে আবার চলে যায়। নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলবে আসে!’ লোকটির ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য সে জোগাড় করেছে ঐ লোকটি শহরের যে বাসায় থাকে তার পাশের বাসার লোকজনের কাছ থেকেই। অঞ্জু পুরো বিষয়টি ওদেরকে বুঝিয়ে বললো। ওরা সবাই একমত হলো যে, লোকটিকে পুলিশে দিতে হবে। আর এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে- যেন সে আগের ড্রাইভারটির মতো কোনো কার্ডফার্ড দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। তারপর বাকি ব্যবস্থা করা যাবে। আর পুরো বিষয়টি এক্ষুণি গিয়ে জানাতে হবে হেডস্যারকে। এরই মধ্যে অঞ্জু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলো, তা হলো- লোকটি যে ভবনে থাকছে সেখানে সিসি ক্যামেরা আছে। ওখান থেকেও অনেক তথ্য ও ছবি পাওয়া যেতে পারে। সবাই একমত হলো তার সাথে। ইরিনা বললো- ‘আমাদের সবকিছু করতে হবে সাবধানে। খুব সাবধানে।’
পুলিশ লোকটিকে গ্রেফতার করলো এবং আদালতে তুললো। এবারও সে আদালতে সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্ড দেখালো। আর ঠিক সাথে সাথেই আইনজীবী দাঁড়িয়ে আদালতের উদ্দেশ্যে বললেন- ‘মাননীয় আদালত, আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি- এদের ড্রাইভার যখন ইশকুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র নয়নকে গাড়ি মেরে দিয়ে ইচ্ছেকৃত হত্যা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলো- তখনও পুলিশকে এরকম একটি সংস্থার কার্ড দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলো। আর সেদিন রাতেই এরা নয়ন এবং জয়দেব বাবুকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে আজও অবধি তাদের দু’জনের কোনো খোঁজখবর পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই লোকটি এখন যে কার্ডটি আদালতে প্রদর্শন করলো, এটিও জব্দ করা হোক এবং অধিকতর তদন্তের স্বার্থে তাকে রিমান্ডে নেয়া হোক।’
আদালত কার্ডটি জব্দ করার নির্দেশ দিলেন এবং পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। পরদিন শুক্রবার, বিকেলের ট্রেনে মেজো মামার সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো ইভান। মামা-ভাগ্নে পাশাপাশি দুই সিটে বসেছে। জানালার পাশে বসেছে ইভান। কি সুন্দর শব্দ তুলে হেলেদুলে দ্রুত গতিতে যাচ্ছে ট্রেন। কখনো লাইনের দু’পাশের বিস্তীর্ণ ফসলী ভূমির মাঝ দিয়ে আবার কখনো সুদীর্ঘ সাঁকো পার হয়ে চলছে ট্রেনটি। আজব এক জন্তু! এতোগুলো মানুষ নিয়ে, লোহার তৈরি এক মস্ত অজগর যেন বাতাস কেটে কেটে দ্রুতগতিতে ছুটছে। মাঝে মাঝে বিকট আওয়াজে হুঁইসেল দিচ্ছে। তারপর গতি শ্লথ হতে হতে একটা ধাক্কা মেরে থেমে যাচ্ছে একেকটা জংশনে। কুমিল্লা পার হয়ে তাদের ট্রেন এসে গেছে আরো অনেক দূর। বাহির থেকে বাতাস আসছে শো শো করে। ইভান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। মামা আশিক ইমরোজ মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ভাগ্নের দিকে। হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন তাকে। তারপর মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েনেড়ে আদর করতে লাগলেন এবং মোলায়েম স্বরে ডাকলেন- ‘ইভান।’
‘জ্বি। বলো, মামা।’
‘তুমি কেমন আছো?’
‘হা হা হা। তুমি একটা পাগল তো দেখছি!’
‘কেন, বাবা?’
‘নয়তো কী? আমি তো তোমার সাথেই আছি।এরকমভাবে কেউ কি ভালো থাকার কথা জানতে চায়?’
‘কি জানি! আমি চাইলাম আরকি। বলো তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো আছি। হা হা হা, তুমি ভালো আছো মামা?’
‘হ্যাঁ রে সোনা। আমিও ভালো আছি। তোমার আম্মুর জন্য খারাপ লাগছে না?’
‘হুঁ, লাগছে তো।’
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
‘আম্মুকে মিস করছি।’
‘পাগল ছেলে। এই ক’ঘণ্টা আগেই বাসা থেকে এলে। তাছাড়া এখন মোবাইলের যুগ। ফোনেই তো প্রতিদিন, এমনকি যখনতখন কথা বলতে পারবে। তাই না?’
‘হুঁ।’
‘ভালো পড়াশোনা করতে হলে, একটু সেক্রিফাইস তো করতেই হয়। তাই না?’
‘হুঁ।’
‘যখনই মন চাইবে, আম্মুর সাথে ফোনে কথা বলবে। আমার মোবাইল আছে, তোমার মামীর আছে; আর দেখি, তোমাকেও একটা ভালো সেট
কিনে দেবো। তবে ভালো পড়াশোনা করতে হবে, বুঝেছো?’
‘জ্বি, মামা।’
‘প্রতি মাসে বা যখনই ইশকুল দু’চারদিনের জন্য ছুটি হবে, তোমার আম্মুর কাছে এসে থেকে যাবে। বুঝেছো?’
‘জ্বি, মামা।’
‘তোমার কখন কী লাগে, আমাকে তা বলবে। আর আজকে বাসায় যখন যাবে, দেখবে তোমার ছোট্ট বোনটি- মানে মৌটুসী তোমাকে দেখে ভীষণ খুশি হবে। তোমার মামীটা তো কেঁদেই ফেলে কিনা, কে জানে। ওনার আবার আবেগ বেশি। সবসময়ই তোমার কথা বলে।’
‘হা হা হা।’
‘হাসছো কেন?’
‘মামীর কথা শুনে। তুমিও না অনেক মজা করে কথা বলতে পারো। মামীর সাথে ঝগড়াটগড়া হয় না তোমার?’
‘তা হয় বৈকি! আবার আমরা দু’জনই হাসাহাসি করে এক হয়ে যাই।’
‘হা হা হা।’ ইভান হাসলো। মামার কথা শুনে দারুণ মজা পেয়েছে সে। এতোক্ষণ ধরে যে মনমরা ভাবটা ছিলো, তা কেটে গেছে মুহূর্তেই। তার হাসি দেখে মুগ্ধ হন আশিকও। তিনি আবার বলেন- ‘ইভান।’
‘জ্বি, মামা।’
‘তোর হাসিটা আমার এতো ভালো লাগে জানিস!’
‘হা হা হা। কী যে বলো মামা! তা, মামী আমার কথা কী বলেন?’
‘এইসব বলে আরকি- ইভান জানি এখন কতো বড়ো হয়েছে। ছেলেটা কি পাজিই না ছিলো- ও এখন কেমন করে হাসে, কী করে বেড়ায়…। এইসব বলে প্যাঁচাল পাড়ে। হা হা হা।’
‘হা হা হা।’ মামা-ভাগ্নে দু’জনই হেসে ওঠে একসাথে।

আট.

‘মামা, যাইবা?’
‘কই যাইবেন স্যার?’
‘টিটিপাড়া।’
‘কতো?’
‘ভাড়া যা তাই দিয়েন স্যার।’
‘আচ্ছা, চলেন।’
দৈনিক ইত্তেফাক মোড় থেকে টিটিপাড়ার উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলো এক তরুণ। আর. কে মিশন রোড দিয়ে যাচ্ছে রিকশাটা। হালকা জ্যামের কারণে প্রথমে আস্তে এবং একটু পরেই দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। তারপর আর দেখা যায় না; মিলিয়ে যায় অপরাপর রিকশা ও যানবাহনের ভিড়ে। প্রথম থেকেই ছেলেটির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ইভান। কতো সহজ এবং সাবলীল ছেলেটির ভাষা। এই প্রথমবারের মতো যেন তার মনে হলো, প্রত্যেক ভাষারই একটা নিজস্ব ঢঙ ও সম্মোহনী শক্তি আছে। নইলে নিজের আঞ্চলিক ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটির কথাগুলো অমন ভালো লেগে যাবে কেন? এতোদিন সে মনে করতো, সবচে সুন্দর করে আঞ্চলিক এবং শুদ্ধ কথা বুঝি চট্টগ্রামের লোকেরাই বলে। যদিও তার বন্ধুরা অনেকেই তার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার দুর্বোধ্যতার কথা বলে নিন্দা করতে চাইতো। কিন্তু সে ওসব গায়ে মাখতো না। বলতো- ‘ভাষা আল্লাহর দান আল্লাহই মানুষকে বিভিন্ন ভাষা ও অঞ্চলে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেন তারা পরস্পর পরিচিত হতে পারে। একথা তো কুরআনেই আছে।’
‘হুঁ, বুঝলাম কুরআনে আছে। তা তুই জানলি কেমন করে?’ পাশ থেকে রাগ রাগ চেহারা নিয়ে চোখ পিটপিট করে প্রশ্ন করতো অয়ন।
‘কেন, কুরআন পড়ে জেনেছি!’
‘তুই কুরআন পড়তে পারিস? বাংলাসহ পড়িস বুঝি?’ অয়নের হিংসে হয় খুব। চোখ ছোটো ছোটো করে সে তাকিয়ে থাকে ইভানের দিকে।
‘হুঁ, বাংলাসহ পড়ি। আমাদের বাসায় যে কুরআনটা আছে, সেখানে আরবির পাশাপাশি বাংলা অনুবাদও দেয়া আছে। আব্বু কিনেছিলেন আন্দরকিল্লা থেকে।’ এটুকু বলে কেমন চুপ হয়ে যায় ইভান। আব্বুর কথা মনে হতেই আজকাল এমনটা হয় তার। ছ’বছর আগে একটি কোম্পানিতে চাকুরির সুবাদে সৌদি আারব গিয়েছিলো তার আব্বু। তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়তো। বার্ষিক পরীক্ষার সময়। আব্বু তাকে অনেক আদর করতেন। যখনতখন সেসব কথা মনে পড়ে তার।
এখন প্রায় প্রতিদিনই আব্বুর সাথে ফোনে কথা হয়। কিন্তু আব্বুকে সবসময়ই ভীষণ রকম মিস করে সে। তাকে এমন চুপ করে থাকতে দেখে অয়ন বলে উঠতো- ‘কিরে, তুই অমন কী ভাবছিস হঠাৎ?’
‘নাহ, এমনি। চল ক্লাসে যাই।’
‘চল।’
এভাবে শুধু ভাষাই নয়, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে তারা। তবে মেধাবী ছাত্রদের একটা সুবিধা হলো, তারা কিছু বললে অন্যরা সহজেই তা মেনে নেয়। ভাষার এই বিবিধ বৈচিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে দৈনিক ইত্তেফাক মোড় থেকে হেঁটে আরেকটু সামনে চলে আসলো ইভান। উদ্দেশ্য বাসায় যাওয়া। রামকৃষ্ণ মিশনের উল্টোদিকে একটা ছ’তলা ভবনের চতুর্থ তলায় মামার বাসায় থাকে সে। চতুর্থ তলায় ডানদিকের এই ফ্ল্যাটটিতে তার মামা আশিক ইমরোজ অনেক বছর ধরে থাকছেন। মামা, মামী এবং ছোটো এক মামাতো বোনসহ তিনজনের এই ছোট্ট ফ্যামেলিতে ইভান এখন নতুন সদস্য। মামার প্রচণ্ড আগ্রহের কারণেই তার ঢাকায় আসা। তিনি চান ভাগ্নেকে তার নিজের কাছে রাখতে। অনেক আগেই তাকে আনতে চেয়েছিলেন। তখনো তার মামাতো বোনটির জন্ম হয়নি। কিন্তু ইভানের আম্মু তাকে দেননি। তার এক কথা- ‘ওকে রেখে আমি থাকবো কী করে!’ জবাবে মামা বলেছিলেন-‘কেন, সমস্যা কী? তোমার তো আরো এক ছেলে আছে। একজন আমার কাছে থাক না!’
‘দ্যাখ আশিক, ও এখনো অনেক ছোটো। সবে নাইনে উঠলো। অন্তত মেট্রিকটা পাশ দিক, তারপর নাহয় ভাগ্নে তার মামার কাছে
চলে যাবে।’
‘হুঁ, মনে থাকে যেন। তখন আবার বলো না যে, ছেলেটা এখনো ছোটো, ইন্টার পাশ করুক।’
‘না, বলবো না। তখন ঢাকা নিয়ে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করে দিস।’
‘আমার ভাগ্নেকে আমি দেশের সেরা কলেজটিতে পড়াবো, হুঁ।’
ইত্তেফাক মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় এসে গেলো ইভান। মৌটুসী ইশকুলে যায়নি আজ। না যাওয়ার একটা কারণ হলো- গতরাতের ভারী বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি উঠে নাকি থইথই করছে। রিকশায় চড়ে পানি পার হতে হয়। তারপর বিশ্বরোড মোড় থেকে তুরাগ বাসে উঠে মালিবাগ রেলগেইট পর্যন্ত যেতে হয়। সেখান থেকে আবার রিকশা নিয়ে সোজা ভিকারুন্নেছা নুন ইশকুল! অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। তবু প্রতিদিন তার ইশকুলে যেতেই হয়। ইভান বাসায় ঢুকে সোফায় বসে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে লাগলো। পত্রিকা হাতে নিয়ে সে মূলত যেটা করে তা হলো- পুরো পত্রিকাটায় একবার চোখ বুলায়। তারপর মনোযোগ দিয়ে শুধুমাত্র খেলার পাতাটা পড়ে। ঢাকায় মামার কাছে আসার পর ইদানীং সে পত্রিকা পড়ছে। প্রতিদিন যে কোনো সময় আধাঘণ্টা করে পত্রিকা দেখে সে। আজও খেলার পাতাটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে তার রুমে চলে গেলো সে। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের মামী কিচেনে আছেন। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত আছেন তিনি। দু’মাস ধরে ঢাকায় আছে ইভান। এ দু’মাসে বেশ
ক’জন বন্ধু হয়েছে ইভানের। তারাও বেশির ভাগই তার মতো এসএসসি ফলপ্রার্থী। আর ক’জন আছে তার চেয়ে এক-দু’বছরের সিনিয়র। সবার সাথেই ইভানের একটা ভালো সম্পর্ক। প্রতিদিন খেলাধুলা আর আড্ডা হয় তাদের সাথে। প্রথম প্রথম ঢাকায় এসে যেমন নিজেকে একা একা লাগতো তার; এখন আর তেমনটা লাগে না। সবার সাথে মিলেমিশে দারুণ সময় কাটে তার। প্রায় প্রতিদিনই বাড়িতে ফোন করে আম্মু এবং ছোটো ভাই জিদানের খোঁজখবর নেয় সে। নিয়মিত যোগাযোগ হয় অয়ন-অঞ্জুদের সাথেও। গতকালই সিফাত ফোন করে জানিয়েছে- নয়ন এবং জয়দেব স্যারকে তুলে নেয়ার জন্য সন্দেহজনক হিসেবে যে লোকটিকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলো অঞ্জুরা, সেই লোকটি অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। লোকটি নাকি স্বীকার করেছে যে, তারাই জয়দেব স্যার এবং নয়নকে তুলে নিয়েছে। তবে তারা নাকি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। বর্তমানে কোথায় আছে তা নাকি লোকটি জানে না। পুলিশ তাকে আবারও রিমান্ডে নিয়েছে। আজ আবার ফোন করেছে ইরিনা। তার কাছেও ঐ একই কথা শোনা গেলো। এখন পর্যন্ত জয়দেব স্যার এবং নয়নের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর ক’দিন পরই এসএসসি’র ফল বেরোবে। ঢাকার বন্ধুরা ঠিক করেছে এসএসসি’র ফল বেরুবার পর তারা সবাই মিলে একটা ট্যুর করবে পাহাড়ে। একদম পার্বত্য চট্টগ্রামে! কাপ্তাই লেক, সাজেক ভ্যালি, খাগড়াছড়ির রহস্যময় সুড়ঙ্গ, পাহাড়ি নদী এবং পাহাড়ি বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা দেখবে তারা। তাদের প্ল্যান দেখেই মনে হচ্ছে অসাধারণ একটি ট্যুরের আয়োজন করতে যাচ্ছে তারা। ইভান চট্টগ্রামের ছেলে হওয়ায় অনেক পাহাড় দেখার সুযোগ তার হয়েছে। তবু সেও রাজি হলো ওদের সাথে ট্যুরে যেতে। কারণ পার্বত্য এলাকার পাহাড় তার কাছেও একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। পাহাড়ের পর পাহাড়।
পাহাড়ের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তা। অদ্ভুত ব্যাপার! আর সাজেক ভ্যালির নাম সে অনেক শুনেছে। সবমিলে অসাধারণ একটা ট্যুর হবে বলেই মনে হচ্ছে। মামাকে ট্যুরের কথা বললে- একটু আমতা আমতা করে তিনিও রাজি হলেন। তবে তার শর্ত হলো- তিনি নিজেও ইভানের সাথে যাবেন। এখানকার নতুন বন্ধুদের সাথে তিনি ইভানকে একা যেতে দিতে পারেন না। বন্ধুরাও এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি করলো না। তারা বললো- তাদেরও অনেকের অভিভাবকরা যাবেন তাদের সাথে। এমনকি তাদের একজন স্যারও নাকি যাবেন। রায়হান সার।

নয়.

চার-পাঁচজন ছেলে একসাথে মসজিদে বসে আছে। একটু আগেই এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট জেনেছে ওরা। ওদের মধ্য থেকে কেউ একজন বললো-‘চল, আমাদের রেজাল্ট তো পেলাম। এখন মসজিদে গিয়ে জোহরের নামাজটা পড়ে ফেলি।’
জুমার নামাজ বাদে আর কোনো ওয়াক্তের নামাজ না পড়লেও, এ বেলায় মসজিদে যেতে রাজি হয়ে গেলো সবাই। কেবল টুটুল আর আনান বাদে। টুটুলের নাকি প্যান্টে সমস্যা। প্যান্টে সমস্যার কথা বলতেই আফিফ বলে উঠলো- ‘ক্যানো রে, মুতে পানি নিতে পারিস না? তাহলেই তো হয়!’ এতে টুটুল একটু শরম পেলো বটে। কিন্তু কোনো জবাব না দিয়ে শুধু এটুকু বললো- ‘আমি এখানে আছি। তোরা নামাজ পড়ে আস।’ আর আনান বললো-‘আমার টুপি নেই।’ ওর কথা শুনে শাওন বললো- ‘তুই কেমন বোকাই থেকে গেলি। টুপি ছাড়া নামাজ হয় না বুঝি! আয়, নামাজে আয়।’ আনান গেলো না। তারও আসলে প্যান্টেই সমস্যা। শাওন তাকে বোকা বললেও, আসলে সে চালাকিই করেছে। টুটুল আর আনান বাইরের চা দোকানের টুলে গিয়ে বসলো। আর ওরা সবাই অজু করে মসজিদে ঢুকে পড়লো।
এদের মধ্যে লাল টি-শার্ট পরা যে ছেলেটি, সে অন্যদের চেয়ে অনেক মোটা। ঠিকমতো বসতেও পারছে না। তবে তার শরীরের এই অতিরিক্ত মেদের বিষয়টি বাদ দিলে, যে কোনো বিবেচনায়ই তাকে সুন্দর বলতে হয়। এর নাম রবিন। ভালো নাম আবরার সাইফ। মসজিদের ফ্লোরে বসে জুত করতে পারছে না সে। একটু পরপরই নড়াচড়া করছে এবং এপাশওপাশ করে বসছে। এরমধ্যে একবার দাঁড়িয়ে দু’পাশের বেল্ট ধরে টান দিয়ে প্যান্ট উপরে তুললো। তারপর বসলো। বসতেই তার পেটের উপর মৃদুভাবে ঘুষি মারলো অনিক। আর প্রায় সাথে সাথেই মুখে হাত দিয়ে চাপা আওয়াজে হেসে উঠলো সবাই। এতে রবিন কিছু মনে করেনি। কারণ এসব তার গা-সওয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। সে একটু মোটা, আর তাই বন্ধুরাও যে দুষ্টুমি করেই ছোটোখাটো কিল-ঘুঁষা মারে, তা সে বুঝতে পারে।
মসজিদের অপরাপর মুসল্লিরা তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। কিন্তু ওদের কথাবার্তায় কারো ডিস্টার্ব হচ্ছে না বলে কেউই কিছু বলছেন না ওদের। ওদের চেহারার ঔজ্জ্বল্য ও গুনগুণ করে কথা বলার দৃশ্য দেখলে যে কেউই বুঝবে যে, এরা অনেক ফুরফুরে মেজাজে আছে। আসলেও তাই। একটু আগেই তাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আর এদের মধ্যে মাত্র একজন বাদে বাকি সবাই এ-প্লাস পেয়েছে। যে একজনটি পায়নি, তার নাম সুহৃদ। পুরো নাম ইউসুফ তাশফীন সুহৃদ। আজ একটা বিশেষ দিন, যেহেতু রেজাল্ট জানা যাবে। সে হিসেবে একটা গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে সে। সাথে শাদা পাজামা। সুন্দর শারীরিক গঠনের সাথে এই বিশেষ পোশাক মিলে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে, তা বলাই যায়। এই ছেলেটি এ-প্লাস পায়নি। পেয়েছে এ-মাইনাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- তার মধ্যে এ নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা কাজ করছে না। বরং সে অন্যদের মতোই হাসছে, কথা বলছে এবং শুনছে। দারুণ প্রাণবন্ত সে। এ নিয়ে তাকেও কেউ ঘাঁটায় না। কারণ এদের সবারই তার সম্পর্কে জানা ছিলো। স্যাররাও বলতেন- এই ছেলেটা পরীক্ষায় পাশ করবে নিশ্চিত, কিন্তু এ-প্লাস পাবে না। পায়ওনি। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপও নেই। আরো মজার ব্যাপার হলো- সে আজ উদ্যোগ নিয়ে এসেছে, এ-প্লাস পাওয়া সব ক’জন বন্ধুকে মিষ্টি খাওয়াবে। দুপুর সাড়ে বারোটায়ই এসএমএস-এর মাধ্যমে রেজাল্ট জানতে পেরেছে ওরা। এদের প্রত্যেকেরই বাসা এলাকায়। জানাই ছিলো যে, রেজাল্ট বারোটার আগে হবে না। তবু সকাল দশটা বাজার আগেই সবাই মিলে তাদের ইশকুলের সামনে চলে এসেছে। দুপুর বারোটার মধ্যে আরো অনেকে এসেছে। পুরো ইশকুল জুড়ে এখন আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। নামাজ শেষ করে ইশকুলে আসলো ওরাও। ইশকুলের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ওদের সামনে পড়লো রায়হান স্যার। স্যারের মুখ কেমন হাসি হাসি। পুরো ইশকুলে মোটিভিশনাল লেকচারার হিসেবে খুব নাম করেছেন তিনি। স্যারকে দেখে ওরা সবাই একযোগে সালাম দিলো- ‘আস-সালামু আলাইকুম…।’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম…। কেমন আছো তোমরা?’
‘ভালো। আপনি ভালো আছেন স্যার?’
‘হুঁ। আমিও ভালো আছি। তোমরা সবাই তো এ-প্লাস পেয়েছো, তাই না?’
‘জ্বি-স্যার।’
‘ওই গাধাটার কী হয়েছে? এই, কী এসেছে তোর?’
‘এ-মাইনাস।’ বললো সুহৃদ।
‘এ-মাইনাস পেয়েছিস, তারপরও হাসি…!’ সুহৃদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে জবাব দেওয়ায় রায়হান স্যার বিস্ময় প্রকাশ করলেন। আর সাথে সাথেই টুটুল, আনান, অনিক, রবিন, পার্থ এবং আফিফসহ ওরা সবাই হেসে উঠলো। রায়হান স্যার হাসলেন না। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সুহৃদের দিকে। এদিকে রঞ্জু, পার্থ এবং টুটুল মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছে। রায়হান স্যার ওদের দিকে সবার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন- ‘তোমরা যারা হাসছো, তোমরা সব ক’টা বেকুব। এই ছেলে তুমি আমার সাথে এসো।’ রায়হান স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো সুহৃদ। ইশকুলের উত্তর দিকের ভবনের নিচতলায় যে শিক্ষক কমনরুম সেখানে প্রবেশ করলেন স্যার। আর তাঁর পেছন পেছন সুহৃদ। রায়হান স্যার এবং সুহৃদ কমনরুমের ভেতরে ঢুকে গেলে শাওন তার সামনে দাঁড়ানো রঞ্জু ও টুটুলদের দিকে তাকিয়ে রাগরাগ চেহারা করে বললো- ‘এই, তোরা স্যারের সামনে ওভাবে খ্যাক খ্যাক করে হাসলি ক্যান? বকা শোনার জন্য? সুহৃদ এ-মাইনাস পাওয়ায় তোরা বুঝি খুব খুশি হয়েছিস, না?’
‘এই, স্যার কি ওকে বানাবে?’ মুখটা কেমন একটু দুঃখী দুঃখী করে বললো পার্থ।
‘কী?’
‘মানে, ওকে কি পেটাবে বা বকাঝকা করবেন?’
‘না। আমার তা মনে হয় না। এ-মাইনাস পেয়েছে তাতে কী? ছেলে হিসেবে সুহৃদ তো আমাদের সবার চেয়েই ভালো। অন্তত আমার তাই মনে হয়।’
‘তাহলে ওকে ডেকে নিলেন কেন?’
‘কি জানি!’
রাজধানী ঢাকা শহরের খ্যাতনামা ইশকুল এটি। যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্ট হলেই হুড়মুড় করে অনেকগুলো মিডিয়ার সাংবাদিক এসে ঢুকে পড়েন ইশকুলে। রেজাল্ট সম্পর্কে ছাত্র ও শিক্ষকদের মন্তব্য রেকর্ড করেন, ছবি তোলেন এবং শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উল্লাস ধারণ করেন। যেগুলো লাইভও করতে থাকে কোনো কোনো মিডিয়া। ইতোমধ্যে আনান, টুটুল, পার্থ, রঞ্জু, আফিফ ও শাওনসহ ওদের গ্রুপটিও ফটো সেশনের মহড়ায় যোগ দিয়েছে। পুরো ইশকুল জুড়ে আনন্দের একটা জোয়ার এলো যেন। একজন ছাত্রকে চার-পাঁচজনে মিলে শূন্যে ভাসিয়ে রেখে চিৎকার করে উল্লাস করছে। একদল ছেলেরা বাদ্য বাজাচ্ছে, মেয়েরাও হইহুল্লোড় করছে এবং পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। একদম অন্যরকম দৃশ্য। অবশ্য এই অন্যরকম দৃশ্যটি এই ইশকুলে প্রতি বছরই দেখা যায়। ওদের গ্রুপটিও মেতে আছে আনন্দে। এমন সময় পেছন থেকে সুহৃদ এসে বললো- ‘এই টুটুল।’
‘হ্যাঁ, কী ব্যাপার। বল তো!’
‘কোনো ব্যাপার নয়। রায়হান স্যার ডাকছেন তোদেরকে।’
‘এ্যাঁ, আমাদেরকে? মানে, আমাকে, রঞ্জুকে, আনানকে- আমাদের সবাইকে?’
‘হুঁ।’
‘কেন, বলতে পারিস কিছু?’
‘না।’
‘তোকে কী বললো রে?’
‘এমনি খোঁজ-খবর নিলেন।’
‘এই? এজন্যই তোকে ডেকে নিলেন?’
‘হুঁ।’
টুটুল সবাইকে ডেকে নিয়ে রায়হান স্যারের কাছে গেলো। স্যার সবাইকে বসতে বললেল। ওরা সবাই কমনরুমে থাকা একটি বেঞ্চ টেনে বসে
পড়লো। এবার স্যার সবার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিলেন। সাথে সাথে রঞ্জুও হেসে ফেললো। হাস্যবাতিকগ্রস্থ একটা ছেলে! অযথাও হাসতে পারে। মুখে হাত চেপে হাসি থামাতে চেষ্ট করছে সে। ওর দিকে মনোযোগ দিলেন না রায়হান স্যার। বরং তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। শুরুতেই এ-প্লাস পাওয়ায় সবাইকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর সবার খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন এবং কলেজে কে কোথায় ভর্তি হতে চায় জানতে চাইলেন। তারপর বললেন- ‘তোমরা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছো। ব্যক্তিগতভাবে তোমরা একটা গোল অ্যাচিভ করেছো। এখন তোমাদের কাজ হবে, ভবিষ্যতেও ভালো পড়াশোনা করা এবং এই ফলাফলের ধারা অব্যাহত রাখা। কি, ঠিক বললাম?’
‘জ্বি, স্যার।’ একসাথে জবাব দিলো ওরা।
‘আচ্ছা শোনো- পরীক্ষায় এ-প্লাস পাওয়াটাই কিন্তু সাফল্যের অতলস্পর্শী কোনো ঘটনা নয়। বরং এটা তোমাদের ভবিষ্যতের পথে একধাপ এগিয়ে দিলো। ভবিষ্যতে তোমাদের সাধনার ওপরই ডিপেন্ড করবে আজকের ফলাফলের গুরুত্ব। বুঝতে পেরেছো।’
‘জ্বি স্যার।’
‘তোমাদের যেটা করতে হবে, তা হলো- তোমরা প্রত্যেকেই ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। আর পৃথিবীর সব মানুষকেই ভালোবাসবে, সম্মান
করবে।’
‘স্যার, খারাপ মানুষদেরকেও?’
‘হ্যাঁ, তাদেরকেও। শোনো, তোমাদের একটা ঘটনা বলি। একবার রসূল (সা.) সাহাবীদের বললেন- ‘তোমরা পৃথিরীর সব জালিম ও মজলুমকে সাহায্য করবে।’ একথা শুনে সাহাবীরা তো অবাক হয়ে গেলেন। তারা বললেন- ‘হে রাসূল (সা.), আমরা কেমন করে একজন জালিমক সাহায্য করতে পারি?’
রসূল (সা.) তখন বললেন- ‘তোমরা তাদেরকে মানুষের ওপর জুলুম করা থেকে বিরত রাখবে।’ এবার ব্যাপারটা তোমরা বুঝতে পেরেছো?’
‘জ্বি স্যার।’
‘পৃথিবীতে আমরা যাদেরকে খারাপ মানুষ বলি, তারা আসলে খারাপ কেন? খারাপ ভাবি এজন্য যে, তারা খারাপ কাজ করে- এই তো?’
‘জ্বি স্যার।’
‘তোমরা সবসময় মনে রাখবা, আসলে প্রকৃতিগতভাবে তারা নয়- তাদের কাজটাই খারাপ। মানুষ তো মানুষই। তাই না?’
‘জ্বি স্যার।’ ওরা একসাথে জবাব দিলো।
‘আর শোনো, সুহৃদের সাথে তোমরা ভালো আচরণ করবে। এ মাইনাস পেয়েছে বলে ওকে ঠাট্টা করবে না কখনো। আমার মনে হয়, ও একদিন খুব ভালো কিছু একটা করবে। আর একটা কথা- তোমাদের ট্যুরের কী অবস্থা? কোনো প্রস্তুতি কি নিয়েছো?’
‘জ্বি স্যার। আমরা ঢাকা থেকে বিশজন যাবো। এর মধ্যে আমাদের পাঁচজন অভিভাবকও যাবেন। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের সাথে যোগ দেবে আরো তিনজন। সবমিলে আমরা তেইশজন।’
‘চট্টগ্রাম থেকে কারা যাবে?’
‘ইভানের বন্ধু ওরা।’
‘ইভান কে?’
‘আমাদের বন্ধু ও। ওর বাসা চিটাগংয়ে।’
‘আচ্ছা। দেখো, আবার কোনো ঝামেলা যেন না হয়।’
‘হবে না স্যার।’ জবাব দিলো পার্থ।
‘তা কবে যাবে বলে ঠিক করেছো?’
‘আগামী রবিবার স্যার।’
‘রবিবার, রবিবার…। ওইদিন তো আমাদের শিক্ষদের একটা মিটিং আছে!’
‘তা থাকুক। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবেস্যার। আপনার কথা শুনে আমাদের অভিভাবকরা অনেক খুশি হয়েছেন।’ টুটুল বললো। সেই সাথে ওরা সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। এরই মধ্যে সুহৃদও এসে পাশে দাঁড়ালো। রায়হান স্যার ওদের সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে বিদায় দিলেন। রাস্তায় নেমে সুহৃদ বললো- ‘চল, আমরা ইভানের কাছে যাই। ওর রেজাল্ট কেমন হলো কে জানে।’
সুহৃদের কথা শেষ হতেই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লো রঞ্জু। সে বললো- নিজের রেজাল্টের ঠিক নাই, আবার সে যাবে অন্যের রেজাল্ট জানতে।’
তার কথার খুব একটা পাত্তা দিলো না কেউ। কারণ সবারই মনে আছে- কিছুক্ষণ আগেই রায়হান স্যার বলেছেন- রেজাল্টই সব কথা নয়। সুহৃদ একদিন অনেক বড়ো কিছু করবে। আসলেই তার দ্বারা অনেক কিছু করা সম্ভব। রঞ্জুর দেখাদেখি কেউ খুব একটা হাসলো না। পার্থ বললো- ‘হ্যাঁ। চল চল, আমরা বরং ইভানের খোঁজ নিয়ে আসি।’
ইভানও এ প্লাস পেয়েছে। ওর চট্টগ্রামের বন্ধুদেরও অনেকেই পেয়েছে এ প্লাস। ইরিনা, সিফাত, অয়ন, সাইফ, মুরাদ, তাওসিফ, অর্ণব- অনেকেই। তবে অঞ্জু পেয়েছে এ-মাইনাস। সে তার রেজাল্ট নিজে থেকেই ফোন করে জানিয়েছে ইভানকে। রেজাল্ট বলার সময় সে এমন ভান করলো, যেন তার এ-প্লাস পাওয়ার কথা ছিলো! সে অনেকটা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো- ‘যাহ, আর পড়াশোনাই করতে ইচ্ছে করছে না। এতো ভালো পরীক্ষা দিলাম, আর এমন একটা বাজে রেজাল্ট কী করে যে হলো!’ ইভান তার সাথে এ বিষয়ে কথা বাড়ায়নি। স্রেফ সান্ত্বনার সুরে বললো- ‘কী করবি দোস্ত, সবই ভাগ্য। তবে একবার বোর্ড চ্যালেঞ্জ করে দেখতে পারিস।’
‘দেখি, তাই বোধহয় করতে হবে।’
‘আচ্ছা, আমাদের ট্যুর কবে রে?’
‘রবিবার।’
‘ওকে, সমস্যা নাই। কিন্তু ওই শালা তো এখনো জয়দেব স্যার এবং নয়নের ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য দিলো না। এখন কী করা যায়, বলতো?’
‘হেডস্যারের সাথে পরামর্শ করে দেখতে পারিস তো।’
‘বোরিং লাগে বুঝলি, বোরিং লাগে।’
‘কেন? বোরিং কেন লাগবে?’
‘হেডস্যার সবসময় পাত্তা দিতে চান না। তার উপর এখন আবার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে…।’
‘আচ্ছা, ট্যুরের জন্য রেডি হ। সেখানে কথা হবে। দেখি, একটা কিছু তো ভাবতে হবে।’
‘সেটাই। তাহলে এখন রাখ, ইভান?
‘আচ্ছা, ওকে।’
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রেজাল্ট উপলক্ষে সারাদিনের ব্যস্ততার কথা ভাবছে ইভান। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ফোন করে করে রেজাল্ট জানিয়ে দোয়া চেয়েছে সে। তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, মিষ্টি খাওয়াসহ কতোরকম ব্যস্ততায় কেটেছে আজকের দিনটা
তার। চোখে ঘুম আসছে না তার। এমনসময় হঠাৎ তার চোখ পড়লো সামনের দেয়ালের ওপর। একটা মানুষের ছায়া সেখানে। যেখানে ছায়া পড়েছে তার বিপরীত দিকে তো কারো থাকার কথা নয়, সুযোগও তো নেই। তাহলে? ইভান দেখলো মুহূর্তেই সেই ছায়াটা নীল হতে হতে গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করছে। দ্রুত সে বিছানার উপর বসে পড়লো। ততক্ষণে একটি আস্ত মানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকলো। তারানা। ইভান
এতক্ষণে অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। আরো কয়েক মুহূর্ত সে চুপ থাকার পর বললো- ‘তারানাপু!’ তারানা হাসছে। কয়েক মুহূর্ত। তারপর হাসি থামিয়ে তারানা জিজ্ঞেস করলো- ‘কেমন আছো ইভান?’
‘ভালো। কিন্তু তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?’
‘ছিলাম, তোমার আশেপাশেই।’
‘কিন্তু দেখা দাওনি কেন?’
‘সে কথা পরেও বলা যাবে। এখন বলো- তোমার রেজাল্ট কেমন হলো?’
‘ভালো। এ-প্লাস পেয়েছি।’
‘তোমাকে অভিনন্দন ভাই। তবে আমাদের মধ্যে এরকম পরীক্ষার চল নেই।’
‘কেমন হয় তোমাদের পরীক্ষা?’
‘সে কথাও আরেকদিন শুনো, কেমন? এখন বলো- তোমাকে কী উপহার দেবো?’
‘তোমার ইচ্ছে।’
‘আচ্ছা। এক্ষুণি দেবো নাকি পরে নেবে?’
‘তোমার ইচ্ছে।’
‘আচ্ছা, পরেই নিও তাহলে। কিন্তু তুমি তো আমার কথা কখনোই মনে করো না!’
‘আমি করি, তুমিই বরং করো না।’
‘হা হা হা…।’ তারানা হাসছে।
হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে ইভান বললো- ‘আচ্ছা তারানাপু, তুমি আগেও আমাকে কিছু একটা দিতে চেয়েছিলে- আমি তখন বলেছিলাম, তুমি প্রয়োজনে ভাই হিসেবে আমার পাশে থেকো। তুমি রাজিও হয়েছিলে। আমাকে তোমার কিচ্ছু দিতে হবে না। তুমি বরং গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে পাশে থেকো, কেমন?’
তারানা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো- ‘ঠিক আছে। এখন তবে ভালো থেকো। আবার আসবো।’
মুহূর্তেই ঘর থেকে কোথাও যেন উধাও হয়ে গেলো সে। ইভান শুয়ে শুয়ে ভাবছে- এটা কী হলো? পরী বলে সত্যি কিছু কি আছে? পৃথিবীতে জ্বিন আছে সত্য, যাদেরকে মানুষ দেখতে পায় না। কিন্তু জ্বিনদের মধ্যেও কি পুরুষ-মহিলা আছে? নিশ্চয় থাকবে। পরী তাহলে কারা? মহিলা জ্বিনরা? হতেও পারে। কিন্তু তারানার ব্যাপারটি যদি সে কাউকে বলতে যায়- তাহলে কেউই তো তাকে বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে যে, ইভান তাদের সাথে গুল মারছে। সে মনে মনে ভাবলো- থাক, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই? তারানা তার ক্ষতি তো আর করছে না! বরং উপকার করতে চাইছে, যদিও সে নিতে চাচ্ছে না। তাছাড়া আরো তো অনেক কিছু জানতে হবে তাকে।

দশ.

ট্যুরে তেইশজন যাবার কথা থাকলেও তারা মোট ছাব্বিশজন রওয়ানা হলো। চট্টগ্রাম থেকে উঠলো শুধু অঞ্জু আর অয়ন। পাহাড়ি আকাবাঁকা পথ দিয়ে তাদের গাড়িটি ছুটে চলছে রাঙামাটির দিকে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর তারা রাঙামাটি গিয়ে পৌঁছলো। তাদের সবার কাছেই অপার বিস্ময় যে এই পাহাড়ি জনপদ। পুরো রাঙামাটি জুড়েই যেন পানি আর পানি। ঝুলন্ত ব্রিজ,কাপ্তাই লেক এবং অন্যান্য সব দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার পর তারা সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। পথে পথে পাহাড়ি সৌন্দর্য, মানুষের জীবনপ্রণালী আর জীববৈচিত্র দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হচ্ছে তারা সবাই। একসময় তারা যখন সাজেক পৌঁছলো, তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠলো সবাই। সুহৃদ বললো- ‘হুর রে…। আমরা এখন দার্জিলিং এসে গেছি!’ তার সাথে সবাইই আনন্দধ্বনি করে উঠলো। সেদিন সারাটা বিকেল এবং রাত সাজেকে কাটানোর পর তারা সবাই দীঘিনালার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো।
দীঘিনালা পৌঁছে সবাই গ্রুপ গ্রুপ হয়ে এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। রায়হান স্যার এবং অভিভাবদের সবাই মিলে ঠিক করেছেন- প্রত্যেক গ্রুপে একজন করে মুরব্বি লোক থাকবে। সে হিসেবে- ইভান, অয়ন, আনান,আফিফ, অঞ্জু, সুহৃদ, টুটুল এবং রায়হান স্যার মিলে একটি গ্রুপ হলো। দুপুরের পরই তারা খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লো। এর আগে সবাইকে বলা হয়েছে ঠিক সন্ধ্যার সময় সবাই যেন আবার বাজারের নির্র্দিষ্ট বোর্ডিংয়ে চলে আসে। সেখানেই তারা একসাথে নাস্তা করবে এবং খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে। খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে সেখানকার আগে থেকে ঠিক করে রাখা বোর্ডিংয়ে গিয়ে রাতে সবাই আজকের এই গ্রুপিং করে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সবাই নিজেদের আলাদা আলাদা গ্রুপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
রায়হান স্যারও টুটুল, সুহৃদ, আনান, অঞ্জু, অয়ন এবং ইভানদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। হাঁটতে হাঁটতে তারা পাহাড়ি নদীর কাছে পৌঁছলো। নদীতে বেশ ক’টা নৌকা। অঞ্জু প্রস্তাব করলো- তারা নৌকায় চড়ে নদীটা দেখবে। তার সাথে আরো দু’য়েকজন একমত হলেও রায়হান স্যার অমত করলেন। বললেন- ‘এতো ছোটো নদীতে তোমরা কী এমন দেখবে? তাছাড়া পাহাড়ের অনেক কিছুই তো তোমরা দেখলে।’
স্যারের সাথে সবাই প্রায় একমত হয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর স্যারই আবার কী মনে করে যেন বললেন- ‘আচ্ছা চলো, আমরা বরং কিছুক্ষণ নদীতেই কাটাই!’একজন মাঝির সাথে কথা বলে একটা নৌকা নৌকা ঠিক করা হলো একঘণ্টার জন্য। এই একঘণ্টার মধ্যে মাঝে তাদেরকে ঘুরিয়ে এনে আবার এখানেই নামিয়ে দেবেন। নৌকায় ওঠার পর মাঝি তাদেরকে বললো- ‘আপনারা কনথনে আইছেন ছার?’
‘ঢাকা থেকে।’ জবাব দিলেন রায়হান স্যার।
‘আইচ্ছা।’
‘কোনো সমস্যা?’ বললো অঞ্জু।
‘নাহ, কিয়ের সমিস্যা, এমনি জিগাইলাম আরকি।’
‘ও।’ এসময় অঞ্জু খেয়াল করলো- নদীর ওই
পাড়ে একটা লোক গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাদেরকে দেখছে। অঞ্জুর খানিকটা সন্দেহ হলো লোকটিকে।
সে কাউকে কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।
এদিকে মাঝির সাথে কথা শুরু করেছে সুহৃদ। সে জিজ্ঞেস করলো- ‘আচ্ছা মাঝি ভাই, আপনার নামটা জানতে পারি?’
‘আমার নাম? আমার নাম ছাইদুল।’
‘আচ্ছা ছাইদুল ভাই, এই নদী দিয়ে ভাটির দিকে গেলে কোথায় যাওয়া যাবে?’
‘চিটাং যাইতারবেন। সাংগু হয়া কর্ণফুলী দিয়া…।’
‘ও।’
‘আর উজানে গেলে?’ জিজ্ঞেস করলো অঞ্জু।
‘উজানে গেলে বহুদ্দুর!’
‘বহুদ্দুর মানে? কোথায়?’
‘একদম ইন্ডিয়ার বর্ডার পার হয়া…।’
‘ও।’
‘গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়া…।’ মাঝি যখন জঙ্গলের কথা বলছে, ঠিক তখনো তাদের নৌকা এমন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে- যেখানে নদীর দু’কূলেই খাড়া পাহাড় এবং গভীর জঙ্গল। বলা যায়, তাদের নৌকাটি গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে! দু’পাশের জঙ্গলের কারণেই এখানকার নদীর পরিবেশ অনেকটা অন্ধকার ধরণের।
নদীতে তাদের প্রায় একঘণ্টার ভ্রমণ হয়ে গেলে নৌকা ঘোরাতে লাগলো মাঝি। তাদের নৌকা আবার চলতে থাকলো ঘাটের দিকে। যে ঘাট থেকে
তারা উঠেছিলো। কিছুদূর গিয়ে একটা বাঁক নিতেই সবাই শুনলো কেউ একজন চেঁচিয়ে মাঝিকে ডাকছে। মাঝি নৌকার গতি কমালো এবং সবাইকে সাবধান হতে বললো। মাঝি সবাইকে সাবধান করায় সবার চেহারায় একটা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রায়হান স্যার জিজ্ঞেস করলেন- ‘কী হলো মাঝি?’
‘কুনু সমিস্যা না ছার। তয় আল্লাবিল্লাহ করেন।’
‘কোনো পাহাড়ি সন্ত্রাসী?’
‘আগে দেখি ছার- ও কী কইবার চায়।’
মাঝি একপাশে নৌকা থামালে একটু পরই ওই লোকটি এসে হাজির হলো। এসেই মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমার যাত্রীরা কোত্থেকে এসেছে? ভাই আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?’
সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এমন সময় রায়হান স্যার বললো- ‘আমরা ঢাকার একটা ইশকুল থেকে ট্যুরে এসেছি।’
‘ইশকুল থেকে এসেছেন এই কয়জন মাত্র?’
‘না, আমাদের সাথে আরো অনেকে আছে।’
‘আচ্ছা, আপনি আসেন আমার সাথে। একটু কথা বলবো, প্লিজ আসেন।’
টুটুল বললো- ‘না স্যার, আপনি যাবেন না।’ আরো দু’য়েকজনও মাথা নেড়ে তার সাথে সায় দিলো।
রায়হান স্যার এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে বললেন- ‘কথাটা কি এখানে বলতে পারবেন না?’
‘আরে ভাই, এই এখানে দাঁড়িয়েই দু’কথা বলবো শুধু আপনার সাথে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।’
‘আচ্ছা আসছি।’ বলেই রায়হান স্যার মাঝিকে বললেন, তাকে ওপাড়ে নামাতে।
অঞ্জু বললো- ‘স্যার আমিও আসি আপনার সাথে।’
কিন্তু পাড়ে দাঁড়ানো লোকটি বললো- ‘না, তোমাকে আসতে হবে না। শুধু স্যার আসুক।’
রায়হান স্যার নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চিন্তিত মুখে রায়হান স্যার ফিরে আসলেন।
বোটে থাকা সবাই জিজ্ঞেস করলো- ‘কী হয়েছে স্যার?’
তিনি কিছু না বলে শুধু বললেন- ‘একটু অপেক্ষা করো।’ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে সবাই পরবর্তি অবস্থার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলো। এবার মাঝি জিজ্ঞেস করলো-‘ছার, টান দিমুনি, কন না কিছু? আপনাদের আইন্যা কোন কুফা যে লাগাইলাম- কে জানে আইজকা!’
‘আশা করছি, তেমন খারাপ কিছু না। একটু অপেক্ষা করুন।’
‘হ। আপনে জানেন তো! পাহাড়ি সন্ত্রাসী হইলে সব শ্যাষ। আইজকা কে কইছে…!’
মাঝি অস্থিরচিত্তে আপন মনে বিড়বিড় করে বকাঝকা করতে থাকলো।
অল্প কিছুক্ষণ পরই সেই লোকটি ফিরে আসলো। তার সাথে আরো তিনজন লোক। লোকগুলো নদীর একদম কাছাকাছি আসতেই অয়ন, ইভান এবং অঞ্জু পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার।
তারপরই প্রথমে ইভান এবং পরে অঞ্জু আর অয়ন- লাফিয়ে নৌকা থেকে নেমে পড়লো। তারা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো একজনকে এবং আরেকজনের পা ছুঁয়ে সালাম করলো তারা। এক মুহূর্ত, তারা পাঁচজনই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। অঞ্জু বারবার বলছে- ‘স্যার, এতোদিন কোথায় ছিলেন, স্যার…!’
একটু পর ইভান নৌকায় থাকা রায়হান স্যার, সুহৃদ, টুটুল, আনান এবং আফিফের দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠলো-‘আমরা আমাদের জয়দেব স্যার এবং নয়নকে পেয়ে গেছি…!’
এসময় তার কণ্ঠটা রোরুদ্যমান এবং আবেগকম্পিত শোনালো। উপজাতি লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে ওরা তিনজন নয়ন এবং জয়দেব স্যারকে সাথে নিয়ে নৌকায় উঠে পড়লো। সবাই জয়দেব বাবু এবং নয়নের সাথে আলিঙ্গন করতে থাকলো। আলিঙ্গন পর্ব শেষ হলে রায়হান স্যার বললেন- ‘মাঝি, এবার দ্রুত নৌকা টানো। খুব দ্রুত!’

(সমাপ্ত)

Share.

মন্তব্য করুন