বর্ষায় আকাশ ফেটে অনবরত বৃষ্টি নামছিল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ অত্যন্ত কঠিন, চারিদিকে বাতাসে গাছের আগা ওঠানামা করছিল। বেশ কয়েকটা গাছ মড়মড়ে ভাঙার শব্দও বৃষ্টি শব্দের সাথে মিশে আওয়াজ আরো তীক্ষ্ণ বানিয়ে দিলো। প্রতিবার বৃষ্টি হলে আমরা মোটা কাঁথা গায় জড়িয়ে ইচ্ছেমত ঘুমোতাম। এখন আর ওভাবে বৃষ্টিপাত হলে ঘুম আসে না। এক বছরে বাড়িটা টিনের চাল থেকে পাকা ছাদে রূপ পরিবর্তন করেছে তাই বৃষ্টির ওই গুণগুণ গান আর শুনতে পাই না। কিন্তু আগের মতো তুমুল ঝড় ঠিকই আছে আকাশ ফেটে ঠিকই বৃষ্টি নামে কিন্তু এই ইটের দেয়ালে তার কিছুই উপভোগ করতে পারি না। এমতাবস্থায় একদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, ইচ্ছে করে নিজে ও বইখাতা ভিজিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।
মায়ের বকুনিঝকুনির কথা বাদই দিলাম। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাড়ির বাইরে জানালার ওপরের ছোট্ট শিটে অদ্ভুত বৃষ্টিতে ভেজা কালো টাইপের কিছু। পেছন থেকে গিয়ে কালো কবুতর মনে করে ধরে নিয়ে এলাম। দেখলাম একটি কালো কাক, কিন্তু মোটেও আমার হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করেনি। কাকটি মাথাটা নিচে নামিয়ে লাগাতার শীতে কাঁপছে। নরম লোমগুলো মানুষের ভেজা চুলের মতো দেখাচ্ছে। মায়ায় পড়ে চুলার আগুনের থেরাপি দিয়ে কিছুটা শীত কমিয়ে হাতে খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম। প্রথমত, খাবার খায়নি। বোধহয় পরিবারের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আমিও জানি না কাকটি কোথায় ছিলো বা কোত্থেকে এলো। পরে খিদের যন্ত্রণায় খেয়ে নিলো। আমার মা হুট করে এসে বলতে লাগলেন। কিরে আগে তো আমার কথায় কর্ণপাত না করে নানান জাতের পাখি গাছ থেকে ধরে নিয়ে এসে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুড়ির মতো পায়ে চিকন রশি বেঁধে উড়াইতিস। আজকে একটি কাকের সমাদর বেশি করছিস লক্ষ করলাম।
লজ্জায় পড়ে গেলাম আগের পাখি হত্যার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাওয়ায়। আমার বাংলা বইয়ে স্যার গত কয়েকদিন আগে পড়িয়েছেন। পাখিরা সৌন্দর্যময়, এরা পরিবেশকে এ অবস্থায় টিকিয়ে রেখেছে নইলে আমরা যে হারে বর্জ্য উচ্ছিষ্ট যেখানে সেখানে ফেলি তা যদি কাকেরা নিজে হজম না করতো তাহলে আমাদের চারপাশের এই পরিবেশ মানুষ বসবাস করার অনুপযোগী হয়ে পড়তো। যেখানে আমরা এতো ভালো অবস্থায় নাক সিটকাই যদি কাকেরা না হজম করতো মাস্ক পরেও থাকা যেত না। অতিরিক্ত ঝড় বাতাস এসব মানুষের গাছ কেটে ফেলার ফল। যার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। স্যার আমাদের পরিবেশ ও পাখির উপকারিতা নিয়ে পাঠ দিয়েছিলেন। সে থেকে বুঝে গেছি আমাদের পরিবেশের জন্য পাখি কতটা দরকারি তাদের সেবার পরিসীমা অনির্ধারিত। তাই আজ এই কালো কাকটি দেখতে কালো হলেও মন কী রকম তা বুঝা হয়ে গেছে। আবার বিরতিহীন ঝড় ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানোর ঠ্যাং ঠ্যাং শব্দে দুনিয়াদারি অসহায়। কত কিছু বাতাসের সাথে জোট বেঁধে উড়ে যায়। রাত হয়ে গেছে বৃষ্টিও থেমে গেছে। সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখছি কাকটা এখনো আমার রুমে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নিচে করে গলা ফুলিয়ে একাকার হয়ে বসে আছে। গতকালের লণ্ডভণ্ড ঝড়ে বোধ হয় ওর পরিবার থেকে একা খোঁজখবরহীন। তারপর কাকটিকে বাড়ির বাইরে ছেড়ে দিয়ে এলাম। উড়ে চলে গেলো আমিও তাকে লক্ষ করে কিছুদূর দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একটি আধ ভাঙা গাছের নিচে ডালে চাপা পড়া আরেকটি কালো কাকের নিথর লাশ পাশে দুটো ভাঙা ডিম। এই অবস্থা দেখে ছোট্ট এ বয়সে খুব বেশি মর্মাহত হয়েছি। লাশটিকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। সেদিনের স্বজনহারা পরিবারহীন কাকটি নতুন বাসা পাতে আমাদের পুকুরপাড়ের গাছে। এখন সে আবারো বংশ বিস্তার করেছে নতুন করে আগের দুঃখ বেদনার দিনগুলো ভুলে গিয়ে।

Share.

মন্তব্য করুন