কক্সবাজার এমন একটা ট্র্যাভেল স্পট বা ডেস্টিনেশন যা আমার খুব ভালো লাগে। দেশে, দেশের বাইরে যতগুলো জায়গায় গিয়েছি কক্সবাজারের আকর্ষণ তার মধ্যে সেরা। বান্দরবান, সেন্টমার্টিন, সিলেট টি গার্ডেন, রাঙ্গামাটি এমনকি সুন্দরবনের চেয়েও আমাকে বেশি টানে কক্সবাজার। কেন তা ঠিক আমি জানি না। এটুকু জানি, কক্সবাজার ভ্রমণের কোন সুযোগ এলে কার্যত আমি আর ছাড়ি না। একই কথা আমার পরিবারের সদস্যদের বেলায়ও। তারাও পছন্দ করে কক্সবাজার আর তার সাথে হিমছড়ি আর ইনানি বিচ। আমার স্ত্রীর অবশ্য আরো একটা পছন্দের স্থান আছে আর সেটা হলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, পতেঙ্গা সি বিচ। অবশ্য পতেঙ্গা আমারও ভালো লাগে। পারিবারিক ট্যুরে চট্টগ্রাম গেলে একবার পতেঙ্গায় যেতে হবেই।
কক্সবাজার যতবারই গিয়েছি গিয়েছি দল বেঁধে। দল বেঁধে ভ্রমণ মানেই টাইট শিডিউল। অতটায় উঠতে হবে নাস্তা খেতে, অতটায় যেতে হবে ওখানে তাই প্রস্তুত থাকতে হবে, অতটায় দুপুরের খাবার ইত্যাদি ইত্যাদি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে গিয়েছি একবা মে মাসে। পেয়েছি বৃষ্টিসড়বাত সৈকত, সে এক ভিন্ন অনুভূতি।
আরেকবার গেলাম বান্দরবান ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে। এবারও দল বেঁধে। বান্দরবান থেকে কেরানিরহাট পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় পার হয়ে এলাম। আগের বারে যা দেখা হয়নি- পথের দুই ধারের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছি। একটু জ্বর জ্বর লাগছিল- ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে খেয়ে নিলাম। চট্টগ্রাম কক্সবাজার পথে সুন্দর সুন্দর পেয়ারা পাওয়া যায়- গাড়ি থামিয়ে কেনা যায়। ভাবলাম এ রকম পেলে ভালোই হয়- মুখটা বিস্বাদ লাগছিল- পেয়ারা চিবুলে ভালো লাগত। বাস এগিয়ে চলেছে কেরানিরহাটের উদ্দেশে।রাজশাহীতে আছে সাহেববাজার। ঢাকায় আছে কেরানীগঞ্জ- এখানে কেরানিরহাট। সাহেবেরহাট না হয়ে কেন কেরানিরহাট হলো সে কথা কাউকে জিজ্ঞেস করবো কি না ভেবে পেলাম না।
রাজশাহীতে আছে সাহেববাজার। ঢাকায় আছে কেরানীগঞ্জ- এখানে কেরানিরহাট। সাহেবেরহাট না হয়ে কেন কেরানিরহাট হলো সে কথা কাউকে জিজ্ঞেস করবো কি না ভেবে পেলাম না। রাস্তায় বাম দিকে দূরে দূরে পাহাড় শ্রেণী, মাঝে মধ্যে জমি, ধানক্ষেত, তরকারির ক্ষেত ইত্যাদি। কক্সবাজার যাচ্ছি বলে মনটা ফুরফুরে লাগছে। ইপসিরা ওখানে আছে। দেখা হয়ে গেলে ভালোই হবে। অবাক হবে ইপসি আর ঈশান। ওর মা-বাবাও কম হবে না। ভাবলাম ওদের সাথে যোগাযোগ করি না কেন? না- মোবাইলে কামরুজ্জামানের নম্বর সেভ করা নেই। সে এত মোবাইল হারায় আর নম্বর পরিবর্তন করে যে তার নম্বর সেভ করে কূল পাওয়া যায় না। মুনা জামানের নম্বরে কল দিলাম, যথারীতি রিং হচ্ছে। কিন্তু ধরছে না, নিশ্চয়ই ব্যাগে মোবাইল। বাসায় ফোন করে জামানের নম্বর নিলাম। এতে কেটে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। বাস এখন কেরানিরহাট পার হয়ে কক্সবাজার হাইওয়ের মূল রাস্তায় উঠে গেছে। কয়েকবার কল দেয়ার পর জামানকে পাওয়া গেল। তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। জামান তো বিশ্বাসই করতে চায় না আমরা কক্সবাজার আসছি। কিন্তু বিধি বাম। তারা গোছগাছ করছে, রাত ৯টায় তাদের বাস ছাড়বে। আমি বললাম আমাদেরও পৌঁছতে পৌঁছতে ৮টা বেজে যাবে। হোটেলের নাম লামিট হোটেল বলে ফোন ছেড়ে দিলো জামান। ওদের শুনেছিলাম পাঁচ-ছয় দিন থাকার কথা, কক্সবাজারে তাহলে আজই চলে যাচ্ছে। কী জানি কী কারণ। ধরে নিলাম দেখা হবে না। কারণ তখন ওরা রাতের খাবার আর ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত থাকবে।
আবার পেয়ারার দিকে মন দিলাম। জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা হয়ে গেল। পেয়ারা ওয়ালাদের দেখা নেই। গত বছরের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে- কী ডাসা ডাসা পেয়ারা- আমাদের মাইক্রোর সামনে ধরত। সে সময় সাথে ছিল সাংবাদিক নেতা মনির ভাই, আজিজ ভাই, হারুন জামিল। কিন্তু কী হলো এবার! যাত্রীবাহী বাস বলে বিক্রেতারা কাছে আসছে না। না কি পেয়ারার মওসুম নয় এখন। জ্বরটা একটু কমে আসছে। বাস দ্রুত এগিয়ে চলেছে কক্সবাজারের পথে। অনেকক্ষণ পর এক হকার বাসে উঠল পিয়াজুর একটি ডালা নিয়ে। আমাদের কাছাকাছি আসতে ছেলেটির ডালা অর্ধেক শেষ। আমি মাদ্রাজি পরিবারসহ কয়েকজনের জন্য নিলাম। গরম পিয়াজুর সঙ্গে পাওয়া গেল ফাও বড় বড় ভাজা পোড়া মরিচ। পিয়াজু খেতে মুড়ি, চানাচুর ধনেপাতা, কাঁচামরিচ ও পিয়াজকুচি লাগে। পুদিনা পাতা তেল হলে আরো জমে। তবে শুধুমাত্র পোড়া মরিচ দিয়ে পিয়াজু খাওয়া এই প্রথম। পিয়াজুগুলো শক্ত শক্ত। পেঁয়াজ তেমন নেই- তবু কুড়মুড় করে খেলো সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডালা শেষ হয়ে গেল। এবার হকার ছেলেটার দিকে দৃষ্টি দিলাম। রোগা লিকলিকে ১০-১২ বছরের একটি ছেলে। নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম তবে, এখন আর মনে নেই। মা হয়তো পিয়াজু বানিয়ে বিক্রির জন্য পথে বের করে দিয়েছে। এই বয়সেই রোজগারে নামতে হয়েছে তাকে। পরবর্তী স্টপেজে নেমে পড়ল ছেলেটি। তবে দ্রুতগামী বাস হওয়ায় অনেকখানি দূরে চলে এসেছে ছেলেটা। আমি মাদ্রাজিকে বললাম- আহা বেচারা, এতদূর যাবে কিভাবে। ১০ টাকা রিকশা ভাড়া দেয়া উচিত ছিল। মিসেস মাদ্রাজিসহ সবাই হেসে উঠল আমার কথায়। তাই তো, তাই তো! ছেলেটা হেঁটে এত পথ যাবে কী করে? মাদ্রাজিই বলল- আরে ভাবেন কেন ফিরতি বাসে চলে যাবে, ওদের ভাড়া লাগে না। রাত সাড়ে ৭টা। কক্সবাজারে এসেছে বলে বাস যেখানে থামল সে এলাকার সাথে আমরা পরিচিত নই। জানা গেল শহরের বাইরে এটা আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল। যেখান থেকে ইজিবাইক, রিকশা বা সিএনজিতে যেতে হবে কলাতলী হোটেল মোটেল জোন, যা আমাদের চেনা কক্সবাজার। বাস থেকে মালপত্রসহ নামলাম। তাহলে দুর্ভোগেই পড়া গেল। এত পথ যাবো কী করে? মুহূর্তেই মুশকিল আসান হিসেবে আবির্ভূত তারেক মোরতাজা। সাথে একটি যাত্রী পরিবহন বাস। এটা করে যেতে হবে হোটেলে। যাক বাবা বাঁচা গেল।
হঠাৎ করে কক্সবাজার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রথমে ছিল গাড়ির বিপত্তি। এরপর দেখা দিলো হোটেল বিপত্তি। এখন পর্যটনের ভরা মওসুম। কক্সবাজার এখন মালিবাগ মোড়ের মতো লোকে লোকারণ্য। এ কক্সবাজার আমাদের অচেনা। গত বছর এসেছিলাম এপ্রিলের শেষে। দুই বছর আগে এসেছিলাম তাও মার্চ মাসে। ভিড় ততটা ছিল না। আর গত বছর ছিল অনেকটা ফাঁকা।হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামার পর বোঝা গেল বিপত্তির আসল চিত্র। এক হোটেলে সবার জায়গা হবে না-দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকতে হবে। প্রথমে শুনেছিলাম দুই পরিবার এক রুমে থাকতে হবে।
হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামার পর বোঝা গেল বিপত্তির আসল চিত্র। এক হোটেলে সবার জায়গা হবে না-দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকতে হবে। প্রথমে শুনেছিলাম দুই পরিবার এক রুমে থাকতে হবে। যাক শেষ পর্যন্ত তা হলো না-ত পরিবারভিত্তিকই বণ্টন হলো। ভালো মানের হোটেলে বড় পরিবারের স্থান হলো। আমরা গেলাম জিয়া গেস্ট হাউজে। মাদ্রাজি পরিবার ও হামিদ ভাই পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ওদের হোটেলে গরম পানির ব্যবস্থা আছে- আমাদেরটার নেই। মনটা দমে গেল। অথচ আমার গরম পানি দরকার ছিল। এ আল্লাহর এক অমোঘ বিধান কে কী চায় কার কী দাবি আর কে কী পায়। জিয়া গেস্ট হাউজে দুই বেডের বিশাল রুম বরাদ্দ পেয়ে রেস্ট নেয়ার পালা। তখন রাত ৮টা বেজে গেছে। কিছু দূরেই আগের দুইবার থাকা ডায়মন্ড গেস্ট হাউজ- তার পেছনেই লামিট হোটেল। ইপসিরা বোধ হয় এখন গোছগাছ করছে। যেতে ইচ্ছে করছিল- কিন্তু শরীর কুলাচ্ছে না। ওদের দিক থেকে সঙ্গতকারণেই সাড়া নেই। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। তারেকের ডাকে ঘুম ভাঙলো। রাতের খাবারের ডাক।
ডায়মন্ড প্যালেস পার হয়ে এই হোটেল। খাবার দাবারের মান ভালো। কিন্তু দূর বলে ততটা ভালো লাগল না। সবাই বলল আরো কাছে খাবার ব্যবস্থা করার জন্য। সকালে নাশতার সময়ে তা বাস্তবায়ন হয়ে গেল। বৈশাখী রেস্তোরাঁ আমাদের হোটেল থেকে ২ মিনিটের পথ। যাক বাঁচা গেল। রাত কিভাবে কেটে গেল টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। কক্সবাজার এই বোধ হয় তৃতীয় কী চর্তু প্রভাত। মুড়ি রাখা ছিল প্যাকেটে, মুড়ি খেয়ে আবার জ্বরের ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম।
আস্তে আস্তে আলো ফুটছে। নতুন একটি দিন শুরু হতে যাচ্ছে। তাও আবার কক্সবাজারে। শীতের ভোর বলে উঠি উঠি করেও আলসেমি লাগছে। পাশের বেডে ঘুমাচ্ছেন জবার আম্মা। বেচারার ওপর গতকাল বেশ ধকল গেছে। সফরে হাঁটাহাঁটি একবারে কম হয় না- তাও আবার নীলগিরি সফর। সে ঘুমাক। আমি আড়মোড়া ভেঙে ওঠে পড়লাম। জ্বর কিছুটা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গতকাল গোসল করা হয়নি- আজ গোসল করতেই হবে। গরম পানির সমাধান কী ভাবতে ভাবতে বারান্দায় দাঁড়ালাম। হালকা রোদের আভা। শীত ভোর বলে মিষ্টি লাগল। হোটেলের বেশ লম্বা বারান্দা। এখানে শীত বান্দরবানের চেয়ে বেশ কম। তাই বারান্দাতেও খারাপ লাগছে না। একজন দু’জন করে লোক চলাচল করছে। আশপাশে যতদূর যায় শুধু হোটেল আর গেস্টহাউজ। সবই লোকে লোকারণ্য। আজ সারা দিন কক্সবাজারে কাটিয়ে রাত ১১টায় বাসে ঢাকা ফিরতে হবে। প্রোগ্রাম আগেই বলে দেয়া হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়ে সবাই দলবেঁধে সি বিচে। ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে যার যার মতো ঘোরাঘুরি, শপিং করা, শুঁটকি কেনা। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখা। এই হলো কর্মসূচি। আরেকটু আলো ফুটতেই তারেকের ফোন। নাশতা রেডি, বৈশাখীতে। বললাম তথাস্ত। আমরা আসছি। অল্প সময়ের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে নামলাম। দেখলাম আমরাই দেরি করেছি- অনেকেই আগে ভাগে এসে পড়েছেন। তবে নাশতায় আবার আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। এক গ্রুপ খাবে তন্দুর রুটি। বাকিরা রুটি-পরোটা। নাশতা সেরে ঝটপট উঠে পড়লাম। হোটেলে ফিরে কাপড়-চেঞ্জ করে সি বিচের উদ্দেশে যেতে হবে। একদল তৈরি হয়েই এসেছে তারা হোটেলে না ফিরে সরাসরি বিচে চলে গেল। আমরা বললাম আসছি।
লাবণী পয়েন্টে একদিন হোটেল রুমে ফিরে সৈকতের উপযোগী পোশাক পরে দ্রুত বের হলাম। আমাদের চেনা সেই লাবণী পয়েন্ট। হাত বাড়ালেই সমুদ্রের লোনাপানি ছোঁয়া যায়- পা বাড়ালেই দেহ ডুবে যায় অবগাহনে। কান পাতলেই শোনা যায় সমুদ্রের গর্জন। হোটেল জোন থেকে কাছেই লাবণী পয়েন্ট-  আগে ছিল ঘুর পথ এখন সোজা পথ হয়ে গেছে ডায়মন্ড গেস্ট হাউজ পার হয়ে বামে মোড় নিয়ে নতুন রাস্তাটি চলে গেছে। আগে ছিল হাঁটাপথ এখন রিকশা ও ইজিবাইক চলে। গতবারই দেখেছি। আমাদের দেখে একটি ইজিবাইক থামল। আমার সাথে জবার আম্মা, হাশেম ভাই ও তার বেগম সাহেবা। ২০ টাকায় লাবণী পয়েন্ট যেতে রাজি হয়ে গেল। উঠে পড়লাম। ঘুর পথেই এলো ইজিবাইক। বালুর রাজ্য বালুর ডিবি পার হয়ে বেওয়াচ ধরনের মঞ্চ, তার পাশে লাল নিশান পার হয়ে পৌঁছলাম লাবণী পয়েন্টে।আমাদের দেখতে পেয়ে যেন হেসে উঠল সমুদ্র। পানীর ঢেউ আছড়ে পড়ে সে তার আনন্দ প্রকাশ করল।
আমাদের দেখতে পেয়ে যেন হেসে উঠল সমুদ্র। পানীর ঢেউ আছড়ে পড়ে সে তার আনন্দ প্রকাশ করল। লাবণী পয়েন্টেও লোক লোকারণ্য। রোদ উঠলেও এখনো বেশ ঠাণ্ডা পানি। বোঝা গেল বেশি নামা যাবে না। পুরো শরীর ভেজানো যাবে না। একটি ছেলে ছবি তুলে দিতে চাইল- তাকে বললাম ১০টি করে ছবি নিতে। মাদ্রাজি আর হাশেম ভাইও ছবির ব্যাপারে রাজি। নানান পোজে ছবি তোলা হচ্ছে। পেশাদার হলেও ওদের ছবি আদৌ ভালো হয় না- গতবারই দেখেছি- ক্যামেরা বাঁচাতে অগত্যা গেলাম সে পথে।
ফারিহা বায়না ধরল স্পিড বোটে চড়বে। মাদ্রাজি সাথে সাথে রাজি। উঠে বসল তারা সবাই। আমি আর জবার আম্মা যাবো না। ফারিহা গো ধরল আমাকে যেতেই হবে- অগত্যা উঠতেই হলো। দু’জনের এক শ’ টাকা। টাকা বড় কথা নয়- আমরা বড়রা উঠলে লোকে কী ভাববে? এটা ভাবছি বটে কিন্তু দেখলাম অনেকেই উঠছে। স্পিড বোট বিশেষ ধরনের। তাতে চড়তে হলে নিরাপত্তা জ্যাকেট পরতে হয়। এটা পরাতে সবাইকে কিম্ভূতকিমাকার লাগছে। ছেড়ে দিলো স্পিড বোট। প্রমে চলল উত্তরে ঝাউতলা অভিমুখে। সা করে খানিকটা গিয়ে বাম মোড় নিয়ে ফিরে এলো। খেল খতম। ৫০ টাকার মামলা। পোশাক পরা ছবিও তোলা হলো। ইপসির জন্য আর ওর ছোট ভাইটার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। সৈকতে ঝাপাঝাপির সময় আর স্পিড বোটে চড়ার সময় কি না মজা হতো ওরা থাকলে। অল্পের জন্য তা আর হলো না।
দুপুর হয়ে আসছে রোদ তেতে উঠছে। শীতের ভাবটা একটু কমেছে। এবার হোটেলে ফিরতে হয়। গোসল সেরে আবার বেরুতে হবে। শপিং করা শুঁটকি কেনা এখনো বাকি। শুঁটকির জন্য মুজিবর মিয়া আছেন। একবার তাকে খোঁজ করে পাইনি। আবার যেতে হবে। ভাবছি এর মধ্যে কেনাকাটা সেরে নিলে হয়। মাদ্রাজিকে বলতে সেও রাজি। ঠিক হলো অরিজিনাল বার্মিজ মার্কেটে যাবো। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন হাশেম মজুমদার ভাই ও ভাবি। মাদ্রাজি একটি ইজিবাইক নিয়ে চলে গেছেন। আমরা আরেকটি বাইক নিয়ে অনুগমন করলাম। বার্মিজ মার্কেট ইদ্রিস মাদ্রাজির চেনা আছে- চেনা আছে আমারও অতএব অসুবিধা নেই ওরা অনেক আগেও রওনা দিলেও উভয় বাইক পৌঁছল একই সময়ে। কক্সবাজার শহরের এ তল্লাটে আমি আর মাদ্রাজি এসেছিলাম। পরের বার আমি গিয়েছিলাম। ইজিবাইকে যেতে ভালোই লাগল। দুই পাশে নানা ফসলের ক্ষেত। আছে ঢেঁড়স, করলা, ধানক্ষেত। দূরে দেখা গেল সেই লাইট হাউজ। দিনে এখানে তেমন বোঝা যায় না এর সৌন্দর্য রাতে। রাতে ঘুরে ঘুরে আলো ছড়ায় লাইট হাউজ। পাহাড়ের ওপর স্থাপিত বলে দূর সমুদ্র থেকেও দেখা যায় এবং তা দেখে মাঝি মাল্লারা দিক ঠিক করেন।
কক্সবাজারেও দেখছি যে দিকে তাকাই সে দিকেই বার্মিজ মার্কেট। পাশাপাশি রাস্তার এপার ওপর সবই বার্মিজ মার্কেট। তবে আসল বার্মিজ মার্কেট এগুলো নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু বার্মিজ পণ্য আচার, শুঁটকি, স্যান্ডেল রেখে বার্মিজ মার্কেট বানিয়ে বিক্রি করছে। তবে খদ্দের কিন্তু কম নয়। সব মার্কেটই জমজমাট। আমাকে আসল বার্মিজ মার্কেটের মন্ত্রগুপ্তি বলে দিয়েছিলেন শিল্পী হামিদ ভাই। এ ধরনের মার্কেট আছে একটা কি দুটো। এগুলো চালায় রাখাইন মেয়েরা। কয়েকটি মার্কেট ঘুরে আসল বার্মিজ মার্কেট পেয়ে গেলাম। এতক্ষণ যেসব দোকানে কেনাকাটা করেছি সেগুলো রাখাইন পরিচালিত নয়, স্থানীয় লোকদের পরিচালিত। দরদাম করে কিছু কাপড় চোপড় ও আমার জন্য বার্মিজ লুঙ্গি কিনলাম। দাম মাত্র ১২০ টাকা। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। ক্ষিদে একটু একটু করে বাড়ছে হোটেলে ফিরতে হয়। আবার পৃক বাইকে করে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। মনটা মি সিংয়ের দুঃখ ভরা মুখটার জন্য ভার ভারই হয়ে থাকল। কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম ওদের জীবনযাত্রা আর শৈশবের কথা। বেশি দূর এগোনো গেল না। কেননা রাখাইন পরিবার সম্পর্কে আমার ধারণা মোটেই নেই। ওর সঙ্গেও আলাপ জমাবার আগে কষ্টে পড়ে গেল মেয়েটি। আহা বেচারা। বিয়ে থা করেছে কি না জানা হলো না। ওদের জীবনযাত্রা জানতে পারলে মন্দ হতো না। এ যাত্রা মি সিংয়ের কাহিনী এখানেই খতম।
আবার ইজিবাইক। আবার বৈশাখীতে ফেরা। দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বিশ্রামের খুব বেশি সময় পাওয়া গেল না। কারণ কেনাকাটা আছে। আর কিছু না হোক কিনতে হবে শুঁটকি আর আচার। মুজিবর মিয়ার দোকানে আমরা সদল বলে পৌঁছলাম। শুঁটকি কেনা হলো। সুন্দর করে প্যাকেট করে দিলো মুজিবর মিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আচার কিনতে হবে ফারজানা ভাবী আর হামিদ ভাইকে নিয়ে। ওনাদের চেনা দোকান আছে। আসল বার্মিজ আচার পাওয়া যাবে ওখানে। অচেনা দোকানে নকল আচার গছিয়ে দেয়ার ভয়। হামিদ ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আচার কেনা হলো। আমরা কিনলাম কিনলেন হাশেম দম্পতি আর মাদ্রাজি দম্পতি।
সবাই যার যার মতো সৈকতে ঘুরছেন বাজার করছেন। বিকেল নামতেই আমরা সবাই জড়ো হলাম সৈকতে। আবার লাবণী পয়েন্ট। সবার ইচ্ছে সূর্যাস্ত দেখা। এর আগে কক্সবাজার এসেছি বটে সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। আজ আর সে সুযোগ ছাড়ছি না। সৈকতেও বেশ ভিড়। পর্যটন মওসুম বলে কথা। শীতের এ সময়টাতে ভিড় লেগেই থাকে। আমরা কয়েকটি খাটিয়া ভাড়া করে শুয়ে বসে বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচ খাটিয়া সরানো হয়। কাজটা ওরাই করে যারা খাটিয়া ভাড়া দেয়, টাকা তোলে। আমাদের উঠতে হলো। খাটিয়া ও ছাতা সরিয়ে নেয়া হলো। আমরা আবার আরাম করে কেউ বসলাম, কেউ আধা শোয়া হলাম।
সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। দূরে লাল একটা গোলক ক্রমে সমুদ্রের অথৈ পানির মধ্যে ডুবে যাবে, এটা দেখতে খুবই ভালো লাগবে। এই আশায় সবাই বসে আছি।
সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ ছাতাসহ খাটিয়ার ছবি তুলছে। কেউ সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমাদের সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও একটা ছোট্ট মেঘের আড়ালে এক সময় লাল সূর্যটা সমুদ্রে হারিয়ে গেল। মনে হলো আরো কিছুক্ষণ এ রকম থাকলে ভালো হতো।

সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ ছাতাসহ খাটিয়ার ছবি তুলছে। কেউ সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমাদের সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও একটা ছোট্ট মেঘের আড়ালে এক সময় লাল সূর্যটা সমুদ্রে হারিয়ে গেল। মনে হলো আরো কিছুক্ষণ এ রকম থাকলে ভালো হতো।

Share.

মন্তব্য করুন