‘শান্তির এই শহরটা আজ অশান্তিতে ভরে গেছে। মানুষ দিকণ্ডবিদিকে দিশেহারা হয়ে ছুটে যাচ্ছে। কেউবা শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হচ্ছে। আবার শহরের অনেক বিত্তবানরা রাতারাতি বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানুষ এখন পিপিলিকার মত যে যেভাবে পারছে লুকিয়ে পড়ছে পৃথিবীর গহ্বরে।’ সন্ধ্যা সাতটায় সরাসরি টিভির খবরে দেখাচ্ছে এসব কাণ্ডলীলা।

কিন্তু কিসের জন্য এই অশান্তি? কেন এমনটা ঘটছে শান্তিনগর নামে এ শহরটায়? কারণটা খুব স্পষ্ট। একটা আরশোলা। যেটা রাতের অন্ধকার পেলেই মস্ত বড় দৈত্যর মত হয়ে আকাশটাকে মাথায় নিয়ে নাচে। প্রথম প্রথম অধিকাংশ মানুষই এই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়েছিল কুসংস্কার বলে। কিন্তু দিনের দিন এই কুসংস্কার চিন্তাটাই বাস্তবে আবিষ্কার হয়ে জনসম্মুখে ধরা দিয়েছে। ঐ আরশোলাটা দিনের আলোতে কোথায় থাকে তা কেউই বলতে পারেনা। কিন্তু রাত নামলেই আকাশে ভয়ংকর রকমের বিজলি চমকাতে থাকে। মেঘের প্রচণ্ড বোমাফাটা শব্দ শুনলে মনে হবে এই বুঝি আকাশটা দু’খণ্ড হয়ে ভুমিতে পতিত হবে। আর ভুমিতে সেটা পতিত হলে আস্ত পৃথিবীর ভুখণ্ডটাই তলিয়ে যাবে চিরকালের মত। শহরের ক্রন্দনরত চমকানো পরিবেশের একেকটি কাণ্ডলীলা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। মানুষ সেই আরশোলাটাকে দেখতে একসময় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যার চোখে একবার সেই আরশোলার ছবি ধরা দিয়েছে সে আর কোনদিন চোখে দেখতে পায়নি। তাই রাত্রি নামার সাথে সাথেই মানুষ দরজা জানালা সব বন্ধ করে লুকিয়ে পড়ত ঘরের ভিতর।

বিজ্ঞানী নাসিম। এই শহরের একজন নামকরা ব্যক্তি। নিজের শহরকে অত্যাধুনিক রূপে গড়ে তোলার পিছনে তার অবদানই সবথেকে বেশি। সেজন্য বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মেহেদী হাসান রায়হান তাকে নিয়ে একটা চিত্রকল্প এঁকেছিল। এবং বর্তমানে তার আঁকা চিত্রটাই শহরের মাঝখানে বিশালাকার একটা মুর্তির মত দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মূর্তির সামনে সমস্ত বর্ণনা মাটি খোদাই করে লেখা হয়েছে। যেকেউ এই শহরে আসলে সবার আগে সেই জায়গাটা পরিদর্শন করে।বিজ্ঞানী-নাসিম-ও-তার-স্বপেড়বর-শহর-1

মনোমুগ্ধকর করার জন্য জায়গাটার চর্তুদিকে ফুলের বাগান, কিছু জাদুঘরের মত দৃষ্টপটও তৈরি করা হয়েছে। সেই বিজ্ঞানী নাসিম কিন্তু এখনও বেঁচে আছেন। তিনি তার শহরের এমন সর্বনাশের ঘটনা শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। টিভি চ্যানেল সহ সকল সংবাদপত্রের মাধ্যমে তার নির্দেশনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের সব জায়গায়। যেকোন মুহূর্তে সেই ভয়ংকর আরশোলাটা অন্য আরেকটা শহরেও হামলা করতে পারে। কিন্তু তার আগে তাকে ঘায়েল করার জন্য দিনের আলোতে খুঁজে পেতে হবে তাকে। দিনের আলোতে সেটা কোথায় হারিয়ে যায় সেটাই লক্ষ রাখার এখন খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। তারপর তাকে বিনাশ করা যাবে এই পৃথিবীর বুক থেকে নচেৎ নয়। বিজ্ঞানী নাসিম এমন সব খবর চোখে কানে দেখে শুনে ঘরে আর বসে থাকতে পারলেন না। তার তৈরি কয়েকটা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের গুলতি বানিয়ে সেই অদ্ভুত প্রাণীটাকে ঘায়েল করার জন্য ছুটে গেলেন শহরের মাঝখানে। কিন্তু সবই বৃথা। পরিণাম আরও মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল। সেই ভয়ংকর আরশোলা প্রাণীটার দিকে বিজ্ঞানী যেই্ চোখ তুলে তাকিয়েছে অমনি প্রাণীটার চোখ থেকে এক ধরণের তীব্র ঝাঁজালো উত্তপ্ত আলোর রশ্মি উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চোখে এসে লাগল। অন্ধ হয়ে গেল বিজ্ঞানী। চারদিক দিক শুণ্য মানুষের হাহাকার ছাড়া এখন আর কোন পথ খোলা নেই। শহরের বড় বড় বিল্ডিং, বিশ্ববিখ্যাত এ শহরের নামকরা ভূতাত্মিক টাওয়ারটা নিমেষেই চুরমার করে দিল সেই আরোশালা আকৃতির মারাত্মক প্রাণীটা।

বিজ্ঞানী নাসিম অন্ধ হওয়ার পরও হাল ছাড়তে রাজি নয়। উনি খুব নিশ্চিতভাবে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ঐ প্রাণীটা আসলে ভীনগ্রহের। সম্ভবত বৃহস্পতি নামক গ্রহ থেকে এখানে এসেছে। তবে তাদের গ্রহে নিরাপত্তার প্রবল অভাব দেখা দেওয়ায় যে যার মত শান্তির খুঁজে ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। আর এই প্রাণীটা খুঁজতে খুঁজতে পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছে। তবে আর যেটাই হোক সেটার উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই আর তা হল পৃথিবী নামক সুন্দর এই গ্রহটাকে সে দখল করতে চায়।

মনুষ্যজাতিকে ধ্বংশ করাই এখন তার মূল উদ্দেশ্য এবং সেই প্রাণীটাকে ধ্বংশ করতে চাইলে রাসায়নিক বা মানুষের তৈরি যুদ্ধণ্ডঅস্ত্রের সাহায্যে সম্ভব নয়। ওটাকে দিনের আলোতে বিনাশ করতে হবে নচেৎ সম্ভব নয়। প্রায় দশ দিন পার হতে চলেছে। বিভিষিকাময় রাত পেরিয়ে এবার সকালের প্রথম সূর্য। আগের মত পাখিদের আর কোলাহল নেই। চিৎকার চেচামেচি নেই প্রভাতের শুভক্ষণে। সব চুপচাপ। নিরবে নির্জনে মানুষের কান্না হেমন্তের নদীর মত বয়। এই শহরের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা কুটিরে বাস করে সিফাত। বয়স প্রায় এগার পার হতে চলেছে। মাথাভর্তি বুদ্ধির ম্যাজিক। নিজের ঘরটাকে সে যেন বিজ্ঞান গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছে। স্কুলপ্রিয় সিফাতের মনটা একদমই ভালো নেই সেই আরশোলার তাণ্ডবে। সারাদিনরাত ঘরের ভিতর বন্ধী হয়ে বসে থাকতে হয়। তার প্রিয় দিশা প্রিপারেটরী স্কুলটা খণ্ড খণ্ড হয়ে ধসে গেছে রাস্তার সাথে। তার চিন্তায় শুধু সেই একটা বিষয়ই ধরা দেয়। আর তা হল কি করে এর থেকে রেহায় পাওয়া যাবে!!!!

সকাল ছয়টা। ফুলবাগান থেকে ঘুরে এসে সোজা ‘বিশ্বকোষ’ বইটা খুঁজতে লাগল সিফাত। সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন না পাওয়া গেল তখন তার চিন্তায় নিরাশার কিছু চিত্র ধরা দিল। টুথব্রাশের মাথায় পেষ্ট লাগিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে সিফাত যখন বাথরুমের ভিতর গিয়ে ঢুকবে ঠিক সেই সময় তার স্কুলব্যাগে রাখা বিশ্বকোষ বইটার কথা মনে পড়ে। খুশিতে এক লাফে হাত মুখ ধৌত না করেই বাথরুম থেকে সোজা বের হয়ে রুমের এক কোণায় হুকের সাথে বেঁধে রাখা ব্যাগটার কাছে ছুটে গেল। ব্যাগের প্রথম পার্টের চেইনটা লাগানো ছিল না। দ্বিতীয় পার্টের চেইনটা টান দিয়ে খুলতেই সিফাতের মুখ থেকে পেষ্টের ফ্যানা ছিটকে গিয়ে পড়ল ব্যাগের ভিতর। কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল সঙ্গে সঙ্গে। ব্যাগের ভিতর থেকে বর্ণিল আলোর ছিটা বের হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সিফাত ভালভাবে লক্ষ করেই দেখতে পেল ব্যাগের ভিতর ছোট্ট একটা আরশোলা। তার মানে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেল সিফাতের সামনে। টেবিলের উপর থেকে পেষ্টের বোতলটা জলদি ব্যাগের সামনে এনে সবটুকুই ছিটিয়ে দিল ব্যাগের মধ্যে। ভয়ংকর চিৎকারে পুরু বাড়ি ছেয়ে গেল মুহূর্তেই। চারদিকের মানুষরা হৈ হৈ করে ঘরের ভিতর গিয়ে লুকাচ্ছে। কিন্তু সিফাত এখন উপায়হারা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তার আর কোন কাজ ছিল না। নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোনমতে খাটের তলায় গিয়ে লুকিয়েছিল। সেই আরশোলাটা ভয়ংকর রুপে ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসে জানালা ফুঁড়ে সোজা বেরিয়ে গেল বাইরে। কিন্তু বাইরে বের হবার সাথেই সাথেই তার প্রাণের ঝুঁকি বেড়ে গেল দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণে। আর ভয়ংকর রকমের চিৎকার করতে করতে পুরু আকাশটাকে রাতের মত অন্ধকার বানিয়ে ফেলল। ডানার ঝাপটানিতে ঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখা গেল। আকাশের মেঘগুলো ঘর্ষণে ঘষর্ণে শীলাবৃষ্টি হয়ে পড়তে লাগল বিল্ডিংয়ের গোড়ায়। কিন্তু সবকিছুই ছিল অদ্ভুত সেই ভিনগ্রহী প্রাণীটার জীবন নাশের পূর্বমুহূর্ত। একসময় সবকিছু শান্ত হতে শুরু করল। আরশোলা প্রাণীটা আগুনের কুণ্ডলীর মত দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে বিলিন হয়ে গেল বাতাসের চক্রে। পুরু শহরটা কিছুক্ষণের জন্য নিরবতার সঙ্গি হল।

সকাল পেরিয়ে গেছে। সবকিছু শান্ত হতে চলল। আরও সাত দিন পরের ঘটনা। বুদ্ধিমান সিফাত এখন বিজ্ঞানী নাসিমের সঙ্গেই থাকে। পৃথিবী থেকে যদিও ভয়ংকর এই আরশোলা আকৃতির প্রাণীটাকে ধ্বংশ করা গেল কিন্তু এটাকে কি সত্যিই বিনাশ করা সম্ভব হয়েছে? বিজ্ঞানীর মাথায় এই চিন্তাটা রীতিমত নতুন করে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু এখন আর আগের মত চিন্তা নেই। সব সমস্যার সমাধানও হাতের সামনে। যা সিফাত প্র্যাকটিক্যালই করে দেখিয়েছে।

বিজ্ঞানী নাসিমের দুইচোখ আছে কিন্তু চোখের আলো নেই। এই শহরের মানুষকে ভয়ানক এক বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নিজের চোখ দুটিকে সে বলি দিয়েছে। সেইজন্যই হয়ত তাকে এই শহরের মানুষরা এতটা ভালবাসে। ছোট্ট ছেলে সিফাত এখন উনার সবথেকে কাছের একজন বন্ধু। বিজ্ঞানীর চোখ দুটি হয়ত অন্ধ, আলো নেই কিন্তু তাতে কি! তার চোখে নতুন এক প্রদীপ এসে যোগ হয়েছে। আর সেই প্রদীপের নাম সিফাত।

Share.

মন্তব্য করুন