শুককীটের ভেতর থেকে প্রজাপতিটি বেরিয়ে দেখলো গাছে গাছে ফুল ফুটেছে আর আলোয় আলোয় সারা পৃথিবী ঝলমল করছে!
প্রজাপতির এই প্রথম ফুল আর আলো দেখা। তাই তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক বিস্ময়ধ্বনি- অপূর্ব! এই ফুল, পাখি আর নীল আকাশ- কে বানিয়েছে এসব? এই যে আমি দু’চোখে এদের দেখছি, বাতাসের ছোঁয়া গায়ে মাখছি, এইই কি সব? নাকি এমন হাজার বিস্ময় সাজানো রয়েছে পৃথিবী জুড়ে? আমি তা দেখবো।
এ কথা ভেবে প্রজাপতি হালকা দুটো পাখা মেলে উড়ে চললো। তারপর উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে একটা শুকিয়ে যাওয়া ডালিয়া ফুলের ওপর বসলো। যে ডালিয়ার ওপর প্রজাপতি বসেছিলো তার চারপাশে কতো যে ফুলের গাছ ছিলো, প্রজাপতি তা গুনে শেষ করতে পারলো না। সে দেখলো, ফুলেরা বাতাসের ছোঁয়ায় দোল খাচ্ছে আর এক ফুল অন্য ফুলের গায়ে ঢলে পড়ছে। মৌমাছিরা ফুলে ফুলে নেচে বেড়াচ্ছে আর কিচিরমিচির করে পাখিরা গান গাইছে। আহ্ কি সুন্দর! প্রজাপতি ভেবেছিলো এই সৌন্দর্য সে প্রাণভরে উপভোগ করবে। কিন্তু ঠিক সে সময় ডালিম গাছে বসে থাকা একটা ফিঙেপাখি জিজ্ঞেস করলো, কে গো তুমি? আগে তো কখনো তোমাকে দেখিনি! তুমি কি আজ নতুন এসেছো?
প্রজাপতি বললো, হ্যাঁ, একেবারেই নতুন। আজই আমার জন্ম হয়েছে। চোখ মেলে তাকাতেই সবকিছু ভালো লেগে গেলো। তাই বেড়াতে বের হয়েছি। ফিঙে বললো, প্রজাপতি তো কতোই দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো সুন্দর আর একটিও দেখিনি। কতো রঙ ছড়িয়ে রয়েছে তোমার পাখা দুটোয়। যেনো পাখা নয়, রঙের সমুদ্র!
ডালিয়ার পাশেই ছিলো জবাগাছ। সে গাছের হলুদ জবা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, পাখা দুটো সুন্দর হলে কি হবে? প্রজাপতিটার কোনো রুচিজ্ঞান নেই। নইলে আমার মতো হলুদ জবা আর ওর মতো লাল গোলাপ রেখে কেউ শুকিয়ে যাওয়া ফুলের ওপর বসে?
প্রজাপতি বললো, যাদের মনে ভালোবাসা আছে, তারা শুকিয়ে যাওয়া ফুলদের ওপরও বসে। তাছাড়া এই ডালিয়াটাও তো একদিন তোমার মতোই ঝলমলে ছিলো, তাই না?
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ডালিয়া বললো, যেদিন আমি প্রথম ফুল হয়ে ফুটেছিলাম- সেদিন সবাই আমার প্রশংসা করেছে। আমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একটি মেয়ে আমাকে ছিঁড়ে নিয়ে ফুলদানিতে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু অন্য একটি মেয়ে বলেছে, ফুল ছেঁড়া ভালো নয়। ফুলেরা গাছে থেকে সবাইকে সৌন্দর্য বিলোবে, সেটাই নিয়ম। এরপর মেয়েটি আর আমাকে ছিঁড়ে নেয়নি। তাই এখনো আমি গাছে রয়েছি। কিন্তু জানো প্রজাপতি, সেই মেয়ে দুটো আজও বাগানে এসেছিলো। কিন্তু ওরা আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। কি দুঃখের জীবন আমাদের- একটু শুকিয়ে গেলে কেউ ফিরেও তাকায় না।
ডালিয়ার কথা শুনে ফিঙে বললো, তোমাদের সমস্যার কথাটা কোনোদিন এমন করে ভাবিনি। থাক ডালিয়া, মন খারাপ কোরো না। একদিন সবাইকেই বুড়িয়ে যেতে হবে। আমিও বুড়ো হবো। ফিঙে আর ডালিয়ার কথা শুনে প্রজাপতির চোখ ছলছল করে উঠলো। সে উড়ে উড়ে পাঁপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডালিয়াকে আদর করলো। তারপর বললো, আমরা তো আল্লাহর এক সামান্য সৃষ্টি। আমাদের ভুল হতেই পারে। কিন্তু মানুষরা কেনো ভুলে যায়, বয়সের কাছে একদিন তাদেরকেও হার মানতে হবে? তারাও একদিন সৌন্দর্য হারিয়ে ফুলদের মতো মলিন হয়ে যাবে। মন খারাপ কোরো না, মানুষরা একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবে। সেদিন তারা তাজা ফুলের মতো শুকিয়ে যাওয়া ফুলকেও ভালোবাসবে। এ কথা বলে ছোট্ট প্রজাপতি পাখা মেললো। আর ওর প্রতি অপার ভালোবাসা নিয়ে হলুদ জবা, ফিঙেপাখি আর শুকিয়ে যাওয়া ডালিয়া তাকিয়ে রইলো।

Share.

মন্তব্য করুন