(গত সংখ্যার পর)
রিকশা-টিকশা একটা পেলে ভালো হতো। কিন্তু অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো রিকশা পায়নি ওরা। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলো অঞ্জুদের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটেই যাবে। অবশ্য এ নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে একদফা তর্ক হয়ে গেছে। অয়ন প্রস্তাব দিলো- ‘চল, আমরা যখন রিকশা পাচ্ছি না তখন হেঁটেই যাই। অঞ্জু বলেছিলো- মইজ্যার ট্যাক থেকে ওদের বাড়ি নাকি মাত্র তিন কিলোমিটার পুবে।’ ‘তিইইই…ন কিলোমিটার! আমি পারবো না ভাই। তোরা দু’জন বরং হেঁটে যা।’ বললো সিফাত।
‘এইটুকু পথ হেঁটে যেতে পারবি না- আর তুই করবি অ্যাডভেঞ্চার! ঠিক আছে আমরা দু’জন অঞ্জুদের বাসায় যাই, আর তুই এখানে বসে থাক।’
‘আমি একা একা বসে থাকবো?’
‘তো কী করবি?’
‘আমরা বরং আরো কিছুক্ষণ রিকশা দেখি।’
‘না, তা আর হবে না। চল আমরা হেঁটেই যাবো। বেশি রাত করা যাবে না। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। নইলে বকাঝকা করবেন আম্মু। চল চল…।’ বললো ইভান।
সিফাত একটু মন খারাপ করলো বটে। কিন্তু তিনজনই অঞ্জুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো।
এদিকটাতে শহুরে আবহ নেই বললেই চলে। অনেকটা গ্রাম ধরনের। দূরে দূরে অবশ্য বিল্ডিং বাড়ি আছে, সরকারি স্থাপনা আছে। মানুষের বাড়িঘর থেকে বৈদ্যুতিক আলো এসে পড়ছে রাস্তায়। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে মোটরসাইকেল, সিএনজি,
বাইসাইকেল এইসব আসছে। ওরা হাঁটছে। বাতাসে একটা বুনো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে- ওদের নাকে লাগছে। এই রাস্তার দু’পাশে ফসলি জমিন। সদ্য চষা বিস্তীর্ণ ক্ষেত। ইভান, সিফাত আর অয়ন- ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে হাঁটছে অঞ্জুদের বাড়ির দিকে। কিছুদূর পর্যন্ত মোড় ঘুরতেই পেছন থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল বাজার শব্দ শুনে রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে হাঁটতে থাকলো ওরা। কিন্তু পেছনের সাইকেলটি ওদের প্রায় পায়ের কাছে এসে গেলো। ওরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা ওদের তিনজনকে জাপটে ধরে অদ্ভুত ও বিকৃত স্বরে কিছু একটা বলে উঠলো পেছনের লোকটি। সিফাত মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠলো- ‘ইভান-অয়ন, আয় ভাগ। ওরে মারে… কে আছো, বাঁচাও…!’ বলতে বলতে সামনে দিকে দৌড়াতে থাকলো সে। আর অয়ন গিয়ে পড়লো পাশের ধানক্ষেতে। ভয় পেলো তিনজনই। তবু ঝট করে পেছনের লোকটিকে ধরে ফেললো ইভান। তারপরই গোটা কয়েক কিল-ঘুষি লাগিয়ে দিলো। আবছা আলো-অন্ধকারে ইভানের কিল-ঘুষি খেতে খেতে এবং নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে লোকটি বলতে থাকলো- ‘কিরে আমাকে মেরে ফেলবি দেখছি! ছাড় ছাড়! আমি অঞ্জু। এতো সহজে ভয় পেয়ে গেলি তোরা?’ হো হো করে হেসে উঠলো সে।
‘তোকে মেরে ফেলাই তো দরকার। এমন বেকুবের মতো কাণ্ড করলি কেন বলতো? ওই দ্যাখ, অয়ন কেমন ভয় পেয়েছে।’
অয়ন ক্ষেত থেকে উঠে আসলো। কাদা-পানিতে মাখামাখি অবস্থা তার। তবু নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। ইভান বললো-
‘অয়ন, ওই ড্রেন থেকে কাদাগুলো ধুয়ে আয়। কাপড়-চোপড় আরো ভিজে যাবে যদিও- তবু অতো সমস্যা হবে না। কিছুক্ষণ
গায়ে থাকলে শুকিয়ে যাবে।’
এদিকে সিফাতও ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অঞ্জু ওদের তিনজনকে সাথে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। ইভান বললো-
‘শোন অঞ্জু, আমরা কেউই বাসা থেকে বলে আসিনি। দ্রুতই বাসায় ফিরতে হবে আমাদের। এসেছি তোর কাছ থেকে একটা বিষয় জানার জন্য।’
‘কী বিষয়ে জানার জন্য তোরা এসেছিস তা আমি জানি। বলবো?’
‘দেখি বল তো।’ বললো সিফাত।
ইভান বললো- ‘না না, এখন আর বলতে হবে না। আমি বলি শোন অঞ্জু।’
‘বল।’
‘জয়দেব স্যারকে কারা কিভাবে তুলে নিয়ে গেছে- বলতে পারবি?’
‘কারা নিয়ে গেছে এবং কিভাবে নিয়ে গেছে- তা তো আমি জানি না!’
‘কী জানিস, বল তো!’
‘কেন, তোদের কাজ কী? আমি যেটুকু জানি তা তো অয়নও জানে। ওকে তো আমি বলেছি।’
‘হ্যাঁ-রে, অয়নের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু এই পুরো বিষটি নিয়ে তোর কী মনে হয়? কারা তুলে নিতে পারে স্যারকে? আর
কেনই বা নেবে তারা? তাছাড়া এখন উদ্ধারের চেষ্টাও তো করতে হবে- তাই না?’
‘তোরা দেখছি জয়দেব স্যারের কথাই শুধু জানিস! নয়নের কথা কিছু জানিস না তোরা?’
‘নয়নের কী হয়েছে আবার?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ইভান।
সেই সাথে অয়ন এবং সিফাতও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অঞ্জুর দিকে তাকালো।
‘তোরা দেখছি কিছুই জানিস না! নয়নকেও হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, ওইদিনের অ্যাক্সিডেন্ট- সেটাও ছিলো পরিকল্পিত।’
‘কেমন করে জানলি?’
‘পুলিশকে জয়দেব স্যারই নাকি ওই রাতে ফোন করে বলেছিলেন।’
‘কিন্তু ওরা কারা?’
‘তা এখনো কিছুই জানা যায়নি। তবে থানায় জানানো হয়েছে এবং সেখানে দু’টি আলাদা মামলা হয়েছে বলে শুনেছি।’
‘থানায় কে জানালেন- হেডস্যার?’
‘হ্যাঁ, হেডস্যার এবং আমি। স্যার আমাকেও যেতে বললেন- তাই গেলাম।’
‘আচ্ছা শোন, এখন আমরা কী করতে পারি- কিছু ভেবেছিস?’
‘আমি যেটা ভাবছি, তা হলো- হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ভিডিও এবং রেকর্ড চেক করতে হবে। তাহলে যদি কিছু পাওয়া যায়…। তবে সেটাও করতে হবে পুলিশের মাধ্যমে।’
‘আমাদের এখন কী করা উচিৎ বলে তুই ভাবছিস?’
‘আপাতত আমাদের কিছুই করার মতো দেখছি না। তবে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের এবং কারো সাথেই এইসব বিষয় নিয়ে বলাবলি করা যাবে না।’
‘করার মতো কিছু থাকলে এবং কোনো তথ্য থাকলে আমাদের জানাস তাহলে। আমরা বাসায় চলে যাই- কি বলিস?’
‘হ্যাঁ, তোরা বাসায় চলে যা। দেখেশুনে যাস কিন্তু। সাবধানে। পুলিশ বলেছে ওরা খুবই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে। তাদের সোর্স নাকি অনেক সমৃদ্ধ।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা চললাম তাহলে।’
‘গুডবাই!’
‘সী ইউ আগেইন।’ বললো ইভান। সেই সাথে ওরা তিনজনই অঞ্জুকে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো।
পরের সপ্তাহর সোমবার। রাত তখনও খুব একটা গভীর হয়নি। এগারটার মতো বেজেছে মাত্র। ইভান রাতের খাবার খেয়ে ছাদে উঠলো আবারও। সাথে জিদানও এলো। এলেন জাহানারা খানমও। আকাশে মেঘের কোনো ছিটেফোটাও নেই। চাঁদটাকে দারুণ লাগছে এমুহূর্তে। আকাশ জুড়ে তারাদেরও মিছিল যেন। রূপালী জোছনায় ঝলমল করছে সমস্ত পৃথিবী। তিন মা-ছেলে একসাথে বসে আছে ছাদে। জিদান বললো- ‘ভাইয়া, আমি যা দেখি তুমি কি তা দ্যাখো?’
‘না। কী দেখছো তুমি?’
‘আমি দেখি একসাথে সাতটি তারা!’
ইভান হেসে ফেললো। তারপর খুঁজে খুঁজে আকাশের একপ্রান্তে একসাথে থাকা অনেকগুলো তারার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো- ‘হ্যাঁ পেয়েছি। ওই যে দ্যাখো তোমার সাতটি তারা।’
‘ধুর, ওখানে তো অনেকগুলো তারা। সাতটি কোথায়?’
‘তাহলে তুমি দেখাও।’
‘দেখাচ্ছি। ওই দ্যাখো চাঁদের কতো কাছাকাছি সাতটি তারা। দেখেছো?’
‘হুঁ, দেখেছি।’
এবার জাহানারা দুই ছেলের দিকে ফিরে বললেন- ‘আমি যা দেখি তোমরা কি তা দ্যাখো?’
‘বলো, কী দেখছো তুমি?’ বললো জিদান।
‘আমি দেখি এক জায়গায় এক বুড়ি বসে আছেন। তিনি…।’
‘থাক থাক আর বলতে হবে না। তুমি ওই
চাঁদের মা বুড়ির কথাই বলতে চাইছো! কি, ঠিক বললাম?’
‘হা হা হা। একদম ঠিক বলেছিস।’
‘আচ্ছা আম্মু, ওখানে কি ঠিক ঠিকই একজন বুড়ি বসে আছেন?’
‘শোনো পাজি ছেলের কথা! তা হয় নাকি?’
‘তাহলে?’
‘ঘটনা হলো- রাসূল মুহাম্মদ সা. যখন সত্য ও সুন্দরের দিকে মানুষকে ডাকছিলেন, তখন একশ্রেণির খারাপ লোকেরা তাঁকে উপহাস, উপেক্ষা ও জুলুম-অত্যাচার করতে শুরু করে। তবু তিনি মানুষকে অসুন্দর ও অন্ধকার জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার কাজ করে যাচ্ছিলেন। তো একদিন হলো কী…!’
‘কী হলো একদিন?’
‘ঐ খারাপ লোকেরা তাদের গোত্রপতিদের নিয়ে নবী মুহাম্মদ সা. এর কাছে আসেন। এবং তাঁর কাছে প্রস্তাব পাড়েন যে, তিনি যদি আকাশের ঐ চাঁদটাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখাতে পারেন- কেবল তাহলেই তারা তাঁর কথা শুনবে এবং ইসলাম গ্রহণ করবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর রাসূল মুহাম্মদও তাদের কথা মেনে নিলেন এবং আল্লাহর দেয়া মু’যেজা বা বিশেষ ক্ষমতা বলে তিনি চাঁদের দিকে তর্জনী আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন।’
‘কী হলো তারপর?’ জিদানের চোখে মুখে বিস্ময়। ইভানও মনোযোগ দিয়ে শুনছে মায়ের কথা।
‘রাসূলের ইশারায় চাঁদটা ঠিক ঠিকই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো।’
‘তাহলে চাঁদের বুড়ি?’
‘ঐতো, সেই ফাটলেরই এটি একটি চিহ্ন মাত্র। আল্লাহ বিশ্ববাসীর জন্য একটি নিদর্শন স্বরূপ রেখে দিয়েছেন।’
‘কিন্তু বিজ্ঞান কি এই কথার সমর্থন করে?’ জিদান বললো।
এতোক্ষণ সে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আম্মুর কথা।
‘হ্যাঁ, বিজ্ঞানও এর সমর্থনে প্রমাণ ও যুক্তি পেয়েছে। তারা চাঁদে গিয়ে সেখানে চাঁদেও গায়ে অবিশ্বাস্য রকমের ফাটল দেখতে পেয়েছে। তবে সবচে বড়ো কথা হলো- চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার বিষয়টি খোদ কুরআনেই আছে।’
‘তুমি এতো কিছু জানো আম্মু?’ জিদান বললো।
‘শোনো ছেলের কথা। তোমরাও বড়ো হয়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। এজন্য ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। বুঝেছো?’
‘জ্বি আম্মু।’ জিদান মাথা নেড়ে বললো।
এবার ইভান বললো- আচ্ছা আম্মু, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো আমার। বলবো?’
‘বল, তোকে মানা করলাম নাকি?’
‘না, তা নয়। কিন্তু কেমন যেন লাগছে।’
‘কেন, কেমন যেনটা আবার কেন লাগছে রে? বিয়েটিয়ের কথা বলবি নাকি আবার?’
‘আম্মু…!’ শরম পেলো ইভান। আর অমনি হো হো করে হেসে উঠলো জিদান, সাথে জাহানারা খানম নিজেও।
‘আচ্ছা বল- কী বলবি।’
‘আম্মু, রেলস্টেশনে একজন মহিলা ভিক্ষা করেন।’
‘তো!’
‘দেখতে কেমন যেন লাগে। অনেকটা
তোমার মতো।’
‘ওই মহিলাকে মা ডাকতে ইচ্ছে করে নাকি তোর?’
‘যাও! শুধু শুধু…।’
‘হা হা হা। আচ্ছা বলনা- কী বলবি!’
‘তুমিই তো আমাকে বলতে দিচ্ছো না। শোনো, ওই মহিলাটা অনেকটা তোমার বয়েসি। অনেক কষ্ট হয় তার। আমার মনে হয়েছে উনি খুবই সম্ভ্রান্ত মহিলা। কিন্তু কেমন করে যেন এই দুর্দশার শিকার হতে হলো তাকে। আম্মু, বলছিলাম কী…।’
‘কী, বল!’
‘উনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা যায় না?’
‘ও এই কথা? না বাবা, তোর আব্বু বাড়িতে নেই। এমতাবস্থায় বাইরের কোনো মহিলাকে বা যে কাউকেই এভাবে নিয়ে আসা
একদম ঠিক হবে না। ওসব মাথা থেকে মুছে ফেল। আর হ্যাঁ, আবার কখনো সামনে পড়লে পারিস তো দু-দশ টাকা দিস। কিন্তু কোনো ঝামেলা করা যাবে না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে আম্মু।’
‘এবার চল, রাত অনেক হয়েছে- খাবার খেয়ে ঘুমাবি। আজ তো আর পড়াশোনা করলি না। অথচ ক’দিন পরই তোর ফাইনাল পরীক্ষা। রাতের বেলা একদম বাসা থেকে বেরোবি না, ঠিক আছে?’
‘জ্বি আম্মু।’
‘চল, বাসায় চল।’
তিন মা-ছেলে একসাথে ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে আসলো। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে আসলো ইভান-জিদান। জিদান শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। ইভানের ঘুম আসছে না। অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি সে ঘুমায়ও না। তার মাথায় এ মুহূর্তে একটা চিন্তাই খেলছে। আর তা হলো- রেল স্টেশনের সেই মহিলা। যে কিনা তার মায়ের বয়সী এবং সম্ভ্রান্ত ধরনের। আল্লাহ মানুষকে গরীব করে সৃষ্টি করলেন কেন? কেন মানুষে মানুষে এতো বৈষম্য, এতো অনাচার? বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করে উঠলো তার। বিছানা থেকে উঠে বসলো সে। তার ভাবনায় বারংবার উঠে আসছে অসংস্য মানুষের ক্ষুধাক্লিষ্ট চেহারা আর অসুস্থ-রোগাক্রান্তের সারি। সে যতই অন্য কিছুতে মনোযোগ দিতে চাইছে ততোই বারবার ফিরে আসছে ওই একই দৃশ্য। ফিরে আসছে ভাগ্যবিড়ম্বিত অসংখ্য মানুষের রক্তে ঢেউ তোলা দুঃখের কাহিনী। ইভানের মনে হলো- এমুহূর্তে একটা বই পড়া যায়। বই পড়লে মনে আর এইসব চিন্তা আসবে না। আর পড়তে পড়তে চোখে ঘুমও চলে আসতে পারে। সে টেবিলের ওপর থেকে একটি গল্পের বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো এবং একসময় ডুবে গেলো গল্পের ভেতর।
পড়তে পড়তে কোমর ধরে এলে বইটা বন্ধ করে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ইভান। বাইরের দৃশ্যটা দারুণ। আকাশের কোথাও কোথাও কিছু কিছু শাদা মেঘ ভাসতে থাকলেও পুঞ্জ পুঞ্জ মোলায়েম জোছনায় থইথই করছে চারদিক। হঠাৎ টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নীল হয়ে গেলে সেদিকে তাকালো ইভান। একই সাথে সে দেখতে পেলো পুরো ঘরটাই নীল হয়ে গেছে। ইভান প্রথমে একটু অবাক হলেও পরক্ষণেই তারানার উপস্থিতি বুঝতে পেরে হেসে ফেললো। আর সেই সাথে কলকল করে হেসে উঠলো তারানাও। তার হাসির শব্দটা যেন পাথরের উপর দিয়ে কলকল করে নেমে যাওয়া স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ ঝরণার শব্দ! ডাকলো- ‘তারানাপু তারানাপু!’
‘এই তো আমি। কেমন আছো ইভান?
‘ভালো। তুমি কেমন আছো?’
‘হুঁ, আমিও ভালো আছি।’
‘আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো?’
‘আজ শুরুতেই একটা প্রশ্ন করে বসবে? আচ্ছা করো।’
‘বলছি- তুমি এখনো ইরিনার বেশ ধরে আসো কেন? তুমি তোমার নিজের বেশেই তো আসতে পারো।’
‘হুঁ, তা পারি। কিন্তু কেন বলো তো। তোমার কাছে খারাপ লাগে?’
‘হুঁ। তোমাকে ইরিনা ভাবতে ভালো লাগে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। পরের বার আর ইরিনার বেশে আসবো না। ঠিক আছে?’
‘ওকে।’
‘আচ্ছা, আমাকে কি পুরোপুরি ইরিনার মতোই লাগে?’ এবার ভালো করে খেয়াল করলো ইভান। নাহ, তাকে তো ইরিনার মতো লাগছে না আসলে! অদ্ভুত সুন্দর তার চোখ- চেহারায় কিছুটা দ্বিধাজড়িত অর্ধস্ফূট হাসির কুঞ্চিত রেখা। তার দিকে চেয়ে আছে সে। ইভান কিছু বলতে যাবে- ঠিক তখনই বাঁধা ডিঙানো ঝরণার মতো কলস্বরে আবারো হেসে উঠলো
তারানা। এসময় বাইরে থেকে জাহানারা খানমের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো- ‘ইভান, এই ইভান! এতো রাতেও কথা বলছিস? তোরা দু’ভাই ঘুমোসনি এখনো?’
‘জ্বি আম্মু, এই তো…।’
‘দেখি দরজা খোল।’
‘এই সেরেছে, তারানাপু…!’
ইভান ভয়ে ভয়ে চাপা গলায় বললো। কিন্তু এরই মধ্যে সে লক্ষ করলো তারানা কোথাও উধাও হয়ে গেছে, আর সেই সাথে ঘরের নীল আলোও! একটা বুদ্ধি বার করলো সে। দরজা খোলার আগে জিদানকে ঠেলে জাগিয়ে দিতে হবে। আর তাকে একটু একপাশে সরে ঘুমানোর জন্য বলতে থাকবে। এদিকে দরজায় নক করছেন আম্মু। ইভান দ্রুত গিয়ে জিদানকে ঠেলে জাগিয়ে দিলো এবং বলতে লাগলো- ‘কিরে পুরো খাটজুড়ে তুইই ঘুমাবি নাকি? ওইপাশে সর একটু।’ বলতে বলতে গিয়ে দরজার সিটকিনি খুলে দিলো ইভান। জাহানারা খানম রুমে ঢুকে একটা চেয়ারে বসলেন। তারপর ইভানকে বললেন- ‘এতো রাত হলো, কিন্তু এখনো ঘুমোচ্ছিস না কেন তুই? পড়াশোনাও তো ঠিকঠাক মতো করিস বলে মনে হয় না। আমি বুঝি না তোর অবস্থাটা কী! আর তো ক’দিন পরই তোর পরীক্ষা।’
‘কে বললো তোমাকে যে, আমি ঠিকঠাক মতো পড়াশোনা করি না? ক্লাস এগজাম সবগুলোতেই তো ভালো করলাম!’
‘তা করেছিস। কিন্তু ক’দিন পরই যে বোর্ড এগজাম, সেজন্য পড়ছিস কই? পরীক্ষার আগে ঘুম হারাম হয়ে যায় ছেলেদেও, আর তুই কিনা…।’
‘তোমার ধারণা- আমার প্রস্তুতি নেই? তুমি শুধু দোয়া করো আম্মু। দেখবে আমি ভালোই পরীক্ষা দেবো- ইনশাআল্লাহ।’
‘দোয়াই তো করি তোদের জন্য! পরীক্ষা দিয়ে একটা ভালো রেজাল্ট কর। তোর মামা চাইছে তোকে ঢাকা নিয়ে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করে দিতে।’
‘আম্মু, আমার ঢাকা যেতে ইচ্ছে করছে না। চট্টগ্রামেও তো কতোগুলো ভালো কলেজ আছে- চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, সিটি কলেজ…।’
‘তোর মামা যখন চাইছে এবং এতো করে বলছে- তখন যা, যেতে এতো সমস্যা কী? তাছাড়া ঢাকায় থাকওে অনেক কিছু জানতে পারবি, শিখতে পারবি। এখন থেকে যে ক’দিন আছে ভালো করে পড়, পরীক্ষার প্রস্তুতি নে। আর এখন রাত অনেক হয়ে গেছে- ঘুমা।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে আম্মু।’
বিছানা ঠিকঠাক করে জিদানকে তার বালিশসহ একপাশে সরিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন জাহানারা খানম। সেই সাথে ইভানকে দ্রুত ঘুমানোর তাগাদা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ইভান যে রুমে বসে তারানার সাথে কথা বলছিলো, তা ধরতে পারেননি আম্মু। দোয়ায়ে ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিলো ইভান। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! টেবিলের বইপত্র ঘুছিয়ে রেখে কিছুক্ষণ তারানার কথা ভাবলো সে। এমুহূর্তে তার কাছে মনে হচ্ছে- তারানা যতোই বোনের মতো ভান করুক না কেন, সে আসলে তার কেউই নয়। অবশ্য সে চাইলে তাকে দিয়ে অনেক ভালো ভালো এবং পরিস্তানের দুর্লভ জিনিস আদায় করে নিতে পারে- যার অনেক কিছু প্রমদিন তারানাই তাকে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তক্ষুণি আবার তার কাছে মনে হলো- এটা ঠিক হবে না। যা তার নয়, তা সে নিজের করে পেতে চাইবে কেন? একটা আপন বোনের তীব্র অভাব বোধ যেন সহসাই তাকে পেয়ে বসলো।
যাকে সে কিছু উপহার দিতে পারবে, যখন-তখন গল্প করতে পারবে, অয়নদের মতো ভাইবোন মিলে উঠোনে খেলতে পারবে, ঝগড়া করতে পারবে- এমন একটা বোন যদি তার থাকতো! তারানা যে আসে- তাও সত্য। কিন্তু অমন নীলপরি বা ঠিক ওরকম কিছু তার বোন হোক- তা যেন এমুহূর্তে তার মানতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্য ওরকম রহস্যময়ী তারানা একেবারেই না আসুক- সেটাও চায় না সে। কারণ পরীদের সম্পর্কে এখনো যে তার কিছুই জানা হলো না! অবশ্য এমুহূর্তে তারানাকে নিয়ে তার কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না। তার ইচ্ছে করছে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে লম্বা একটা ঘুম দিতে। অবশ্য আরো আগেই ঘুমানো দরকার ছিলো তার।
নতুন ভাবনা মাথায় এলো ইভানের। সে ভাবছে- নয়ন এবং জয়দেব স্যারের কিডন্যাপ হওয়া নিয়ে। কী রহস্যময় একটা ব্যাপার! একটা ছেলেকে ইচ্ছে করেই মেরে ফেলতে চেয়েছে কারা যেন। আবার ঠিক তারাই তাকে চিকিৎসা পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। জয়দেব স্যার চেষ্টা করলো, কিন্তু তাকেও তুলে নিয়ে গুম করে ফেললো তারা। আন্তর্জাতিক কী একটা সংস্থারও নাকি পরিচয় দিয়েছে তারা। ব্যাপারটি দারুণ উদ্বেগের। ইভান ব্যাপারটি নিয়ে নানাভাবে ভাবতে থাকলেও কিছুই কূলিয়ে উঠতে পারছে না। একসময় দরজা ভেজিয়ে এসে জিদানের পাশে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
ছয়.
বৃষ্টি হবে। আকাশের টুকরো টুকরো শাদা মেঘগুলো ক্রমেই কালো হয়ে আসছে। পরিবেশ কিছুটা থমথমে হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসও বইছে। এই বিকেল বেলাটাকেই এখন কেমন সন্ধ্যা মনে হচ্ছে! আকাশে মেঘ ডাকছে। নেমে পড়বে যখনতখন। কিছু একটা করার এটাই মোক্ষম সময়। নয়ন এতোদিন ধরে প্ল্যান করে রেখেছে- কেমন করে প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে বের হওয়া যায়। এখানকার মিশনারী গ্রুপের কেউই এখানে থাকেন না। তারা সবাই থাকে ভারতের সীমান্তবর্তী পাহাড়ের একটা গোপন জায়গায়। এসব খবর নয়ন খুবই সতর্কভাবে সংগ্রহ করেছে। যে দু’জন প্রহরী প্রতিদিন তার জন্য খাবার নিয়ে আসে তাদের সাথে দারুণ একটা খাতির হয়ে গেছে তার। এদের একজনের নাম সানজা মং- যিনি এই মিশনারী গ্রুপের মাধ্যমে সদ্য খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আর অন্যজনের নাম মনু সিং। নয়নের প্রমেই ধারণা হয়েছিলো- এই লোকটি ভারতী হবেন।
পরে একদিন কথাবার্তার ফাঁকে বিষয়টি সে নিশ্চিত হয়েছে যে, লোকটি সত্যি সত্যিই ভারতী। তৃতীয়জন প্রম একদিন ছাড়া আর কোনোদিনই এখানে আসেনি। সে-ই এই তিনজনের গ্রুপের কমান্ডার। সতর্কতাবশত এবং ইচ্ছে করেই তার নামটা কখনো জানতে চায়নি নয়ন। তবে সেটিও তার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। তবে ওই নামটি ছদ্মনাম নাকি আসল নাম- সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে তার। কারণ লোকটি কথা বলেছিলো ইংরেজিতে। অথচ তার নামটা এদেশীয় বাঙালিদের মতো! আবার চেহারা দেখে তাকে কেউই বাঙালি বলবে না। ইংরেজির যে উচ্চারণ- তা বাঙালিদের মতো তো নয়ই, বরং খাঁটি ইংরেজি বা অন্য কোনো দেশীদের মতো। এই লোকটির ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে নয়নের মনে। এই কমান্ডার লোকটিসহ সর্বসাকুল্যে তিনজন মাত্র প্রহরী রয়েছে এই গোপন চৌকির পাহাড়ায়।
নয়ন জানতে পেরেছে তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করতে চেয়েছিলো এই মিশনারী গ্রুপ। কিন্তু ইতোমধ্যেই ব্যাপারটি জানাজানি হওয়ায় এবং থানায় এ নিয়ে মামলা হওয়ায়- তারা তাকে তুলে এনেও ইচ্ছেকৃতই বাঁচিয়ে রেখেছে। মূলত পরিস্থিতি অবজারবেশন করছে তারা। তাছাড়া তুলেই যখন এনেছে তখন আর এতো তাড়াহুড়ো কী! নয়নকে মেরে ফেলতে চাওয়া এবং তারপর তাকে তুলে আনা- এসবের কারণও অনেকটাই জেনেছে সে। তবে পুরো বিষয়টি এখনো তার কাছে স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট যেটা তা হলো- তাকে এবং জয়দেব স্যারকে শীঘ্রই মেরে ফেলা হবে। এতোদিন তারা শুধু ওদের দু’জনের সুস্থতার জন্যই অপেক্ষা করেছে। এবার যে কোনো দিনই তাদের দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে- হতে পারে তা আজ রাতেও। আর তারপরই অনিশ্চিত কায়দায় মৃত্যু। অথবা এমন কিছু, যা তারা কেউই জানে না।
এই রুমের ভেতর তিনমাস ধরে বন্দি থাকতে থাকতে এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়েছে নয়ন। ঘরটিতে কোনো গোপন যন্ত্র নেই। কেন রাখেনি তারা? এতো গহীন বনের ভেতর এরকম সুরক্ষিত ঘরে রাখার পর আবার তিনজন সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে আটকে রাখার পর তারা হয়তো আর কোনো গোপন যন্ত্র দেবার প্রয়োজন মনে করেনি। অন্তত এই ঘরে যে, কোনো গোপন যন্ত্র নেই- এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে নয়ন। আর সে এও জানতে পেরেছে এই ঘরেরই অন্য একটি রুমে বন্দি আছেন জয়দেব স্যারও। জয়দেব স্যারের রুমটি ওর রুমের পাশে যে রুমটি রয়েছে- তার পরেরটি।
এমনটা করা হয়েছে এজন্য যে, তারা পাশাপাশি দুই রুমে থাকলে যে কোনোভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারে- এই আশঙ্কায়। কিন্তু যদি তাদের দুইজনকে ঘরের মাঝখানের রুমটি ফাঁকা রেখে দুইপাশের দুই রুমে রাখা যায়- তাহলে তারা কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারবে না। এমনকি খুব জোরে ডাকাডাকি করলেও তারা কেউ কারো ডাক শুনতে পারবে না। আসলে হয়েছেও তাই। এই দু’সপ্তাহ আগেও নয়ন জানতো না যে, জয়দেব স্যারকেও ওরা তুলে এনেছে এবং তিনি এই ঘরেরই অন্য একটি রুমে বন্দি হয়ে আছেন!
শুধু তার জন্যই জয়দেব স্যারকে ওরা তুলে এনেছে- জানার পর তার ভীষণভাবে কান্না করতে ইচ্ছে হয়েছিলো এবং সেই রাতে খুব কান্নাও করেছিলো সে। তবে জয়দেব স্যারের কথা জানার পরই সে তার নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করতে থাকে। আর তখন থেকেই সে ভাবতে থাকে এভাবে এই রুমে পড়ে থেকে দিনকে দিন মৃত্যুর দিকে যাওয়ার চেয়ে বরং এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করাটাই দরকার। সে অনুযায়ী সুযোগের সন্ধান করতে থাকে নয়ন।
আজ দুপুরে সে খেয়াল করলো- তার রুমের যে বাঁশের সিলিংটি তা আলগাভাবে ঘরের আড়ার উপর শুধুমাত্র বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সিলিংয়ের উপর কী আছে তা দেখার এবং এখান থেকে বের হবার একটা চেষ্টা নেয়া যায়। বাড়িতে সে অনেকবার তাদের রান্নাঘরের সিলিংয়ে উঠেছে। সেটিও এরকম আড়ার উপর বিছিয়ে রাখা এবং উপরে ওঠার জন্য কোনো পথ তৈরি করা ছিলো না। তবু সে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে আড়া ধরে তারপর মাথা দিয়ে ঠেলে উপরে উঠে যেতো! এখানেও সেরকম একটা চেষ্টা নেয়া যায়। তবে খুবই সাবধানে।
যদিও রাত ছাড়া প্রহরীদের কেউই এ রুমে আসবে না। তবু বৃষ্টি নামলে বলা যায় না- সানজা মং নামের লোকটি তালা খুলে তার রুমে আসলেও আসতে পারে। সিলিংয়ে ওঠার চেষ্টা করলে দ্রুত এবং এক্ষুণি করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো- সিলিংটা ফ্লোর থেকে অনেক উপরে। এখানে কোনো টেবিল কিংবা আলমিরা বা সেলফ জাতীয় কিছুই নেই- যার উপর দাঁড়িয়ে সিলিংয়ে ওঠার চেষ্টা করা যায়।
হঠাৎ তার চোখ পড়লো দরজার কপাটের পাশে রাখা পানির কলসিটার দিকে। ভাবার সময় নেই- সে দ্রুত গিয়ে কলসিটা নিয়ে আসলো। তারপর আওয়াজ না হওয়ার মতো করে কলসির সবটুকু পানি টয়লেটের কমোডে ঢেলে দিয়ে খালি কলসিটা এনে ফ্লোরের উপর উল্টিয়ে রাখলো। খালি কলসিতে আওয়াজ হওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে। সেজন্য খুবই সতর্কভাবে উল্টানো কলসিটার উপর দু’পা রেখে দাঁড়ালো সে। কিন্তু এখনো আড়া অনেক উপরে। স্বাভাবিকভাবে হাত দিয়ে ধরা যায় না। পুরো ঘরের আড়াগুলো দেয়া হয়েছে ছালসহ আস্ত গাছ দিয়ে। এই বনের ভেতর এইসব করতে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিশ্চয়ই থেকে থাকবে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। নয়ন এক লাফ দিয়ে উপরের আড়া ধরে ফেললো। বুকটা ধক ধক করছে তার।
আগে এমনটা করেনি। এমুহূর্তে তার কেবলই মনে হচ্ছে- প্রহরীদের কেউ বুঝি এসে গেলো! তবু সে সাহস রাখলো- আল্লাহ ভরসা, যে করেই হোক উপরে ওঠা চাই তার। কোনো একটা ব্যবস্থা তো বের করতে হবে! মাথা দিয়ে উপরের সিলিংয়ে ঠেলা দিতেই সেটা ফাঁক হয়ে গেলো। তারপর ঠেলেঠুলে খুব সতর্কভাবে উপরে উঠে আসলো সে। শরীরের দু’য়েক জায়গায় ছিলে গেছে বলে মনে হলেও সিলিংয়ের উপরটা অন্ধকার হওয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাইরের আলো আবছাভাবে উপরে যেটুকু আসছে তাতে কোনোমতে সিলিংয়ের উপরটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা বলে তো আর বসে থাকলে চলবে না! নয়ন দেখলো- তার পাশের রুমের সিলিংয়ের পশ্চিম পাশে একটু ফাঁকা জায়গা আছে এবং সেখানে একটি আড়ার মাথা রয়েছে। সে খুবই সাবধানে আবছা অন্ধকারে একটু একটু করে হেঁটে সেখানে পৌঁছলো। মাথা নামিয়ে নিচের দিকটা দেখে নিলো একবার। তারপর আড়া ধরে খুব সাবধানে ঝুলে পড়লো ঠিক নিচে। তারপর আড়া থেকে হাত ছেড়ে নেমে পড়লো ফ্লোরে। সে চেয়েছে যেন কোনো শব্দ না হয়।
কিন্তু তারপরও ধপ করে কিছুটা শব্দ হলোই। এমুহূর্তে তার ভয় করছে খুব। যদি প্রহরীদের কেউ একজন তার রুমে ঢুকে পড়ে তাহলে! তাহলে আর নিস্তার নেই। এছাড়া বের হওয়ার যেটুকু ফন্দি-ফিকির করছে- তাও ভেস্তে যাবে। শুধু তাই নয়- এরপর ভাগ্যে যে কী জুটবে, তা কেবল আল্লাহই জানেন। মনে মনে সে একবার বললো- আল্লাহ, রক্ষা করো। এমুহূর্তে বাইরে একটা পাতা পড়ার শব্দ হলেও বুকটা কেমন ধুকপুক করে ওঠে! সে দ্রুত রুমটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। রুমটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে- বহুদিন এই রুমে কেউই আসেনি। কোনো কাজেও লাগেনি হয়তো। রুমের ভেতর মাকড়সার জাল ছাড়াও ধুলোবালিতে একাকার হয়ে আছে রুমটি।
নয়ন খুব সতর্কভাবে হেঁটে হেঁটে দরজার কাছে গেলো। সিটকিনি খোলা হলেও বাইরে থেকে তালা মারা। দরজা ফাঁক করে বাইরের দিকটা একবা দেখে নিলো নয়ন। বাইরে প্রচণ্ড বাতাস। একই সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেন এক্ষুণি ঝমঝম করে নেমে পড়বে বৃষ্টি। নয়ন ভেতর থেকে তালা লাগানোর জন্য যে দুটো হুক বা আংটা কপাটের সাথে লাগানো আছে- তা একবার পরীক্ষা করে দেখলো। ইস্ক্রু ঘুরিয়ে দেখলো। হ্যাঁ, ইস্ক্রুগুলো ঘুরছে। একটু চেষ্টা করলেই খুলে ফেলা সম্ভব।
কিন্তু এই বিকেল বেলা দরজা খোলার চেষ্টা করাটা নিতান্তই বোকামি হবে। সে শুধু পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো মাত্র। তারপর ভাবলো- নাহ, এখানে এ অবস্থায় আর এক মুহূর্তও নয়। দ্রুতই আবার ফিরে যেতে হবে রুমে। এক্ষুণি যদি কোনো প্রহরী রুমে ঢুকে তাকে দেখতে না পায় তাহলে আর উপায় থাকবে না। সে উপরে সিলিংয়ের ফাঁক দিয়ে মাথা তুলে উপরে উঠে গেলো আবার। তার রুমে তো কলস ছিলো, এ রুমে কিছুই নেই। কিন্তু এ রুমের সিলিংয়ের যে সামান্য খোপ বা ফাঁকা জায়গা- সেটি একদম দরজার পাশে হওয়ায়, দরজা বেয়ে বেয়ে সহজেই উপরে উঠে অঅসতে বেগ পেতে হয়নি খুব। তারপর আবার নিজের রুমে নামতে যাবে ঠিক এরকম সময় সে শুনতে পেলো- গররর গররর শব্দ করে কেউ একজন নাক ডাকছে পাশের রুমটিতে। তার মনে হলো- এটা নিশ্চয়ই জয়দেব স্যার! তিনি কি ঘুমোচ্ছেন? হতেও পারে। কী করবে সে এখন? সে কি এখন নিজের রুমে ফিরে যাবে, নাকি আরেকটা রিস্ক নেবে! মনে মনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়ে ফেললো সে। তারপর ভাবলো- আল্লাহ ভরসা, বাঁচি কী মরি একবার জয়দেব স্যারের কাছে যাবার চেষ্টা অন্তত করে দেখি! এটা যে সময়- তাতে এখন কেউই আসবে না রুমে। অবশ্য এমুহূর্তেই বৃষ্টি নামলে সানজা মংটা আসলেও আসতে পারে।
বসে থাকার সময় নেই। সে আগের চেয়েও দ্বিগুণ সতর্কতার সাথে পরের রুমের সিলিংয়ের উপর আসলো। তারপর সিলিংয়ের তরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরটা একবার দেখার চেষ্টা করলো। নাহ কিছুই ঠিকঠাক মতো দেখা যাচ্ছে না। সে জেনেছে এই রুমেই জয়দেব স্যারকে রাখা হয়েছে। কিন্তু জয়দেব স্যার যদি এ রুমে না থাকেন কিংবা নাক ডাকা লোকটি যদি মিশনারী গ্রুপেরই কেউ হয় তখন! হঠাৎ ভয়টা যেন আরোও বেড়ে গেলো তার। হৃদকম্পন দ্রুত হয়ে এলো। এখান থেকে একবার ভেতরটা দেখতে পারলে ভালো হতো। ব্যাপারটা শিওর হওয়া যেতো। সমস্যা হলো- এখানে একটা ভালো ফাঁকফোকরও নেই! হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়- যেহেতু নিচ থেকে ঘুমিয়ে নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে, সুতরাং সিলিংয়ের একমাথা একটু ফাঁক করেই তো দেখা যায়! তবে খুবই সতর্কভাবে করতে হবে। সে আস্তে আস্তে রুমের মাঝামাঝি একটা আড়া বরাবর সিলিংয়ের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আরোও আস্তে করে সিলিংয়ের এক মাথা ধরে একটু ফাঁক করে রুমের ভেতরটায় উঁকি মারলো। হ্যাঁ, ভেতরটা এখন একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জয়দেব স্যারই ঘুমোচ্ছেন!
ভেতরটা একবার দেখে নিয়ে সিলিংয়ের আড়া ধরে আগের মতোই সতর্কভাবে রুমের ভেতর ঝুলে পড়লো নয়ন। এবারেও একটু শব্দ হলো। কিন্তু জয়দেব স্যারের ঘুম ভাঙলো না তাতে। বোঝা গেলো- বাইরেও প্রহরীদের কেউই শুনতে পায়নি। অবশ্য হালকাভাবে কথা শোনা যাচ্ছে তাদের। নয়ন আস্তে গিয়ে দাঁড়ালো স্যারের ঠিক মাথার কাছে। তারপর হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলো স্যারকে। জয়দেব স্যার অলসভাবে একটু মোড় দিয়ে আবারো ঘুমোচ্ছেন। বোধহয় রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার- সেজন্যই দিনের বেলায় এমন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আবারো ধাক্কা দিলো সে এবং একটু জোরেই দিলো। কাজ হলো এবার। জয়দেব স্যার ধড়মড় করে উঠে বসলেন এবং নয়নের দিকে একবার তাকিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর চাপা আওয়াজে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। নয়নের চোখ দিয়েও পানি এলো, কিন্তু চেপে রাখলো সে। সেই সাথে স্যারকেও ইশারায় সতর্ক করলো। জয়দেব স্যার কথা বলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে তার কথা। এক পর্যায়ে কানড়বাজড়িত গলায়ই বললেন- ‘নয়ন, বাবা কেমন আছিস তুই? কতোদিন পর…।’
নয়ন কোনো জবাব দিলো না। এবারও সে জয়দেব স্যারকে ইশারায় চুপ হতে বললো। তারপর স্যারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো ‘স্যার, আজ রাতে বৃষ্টি হবে। প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাইরে গর্জন শুনতে পাচ্ছেন?’
নয়ন কথাগুলো এমনভাবে বলছে- যেন সবকিছুই স্বাভাবিক আছে। স্যার একরাশ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছেন তার দিকে। হয়তো ভাবছেন- আমরা কতো কঠিন পরিস্থিতিতে আছি, আর এই ছেলে কেমন নির্বিকারভাবে কথা বলছে। কিংবা ভাবছেন- ছেলেটা ছিলো কোথায়, আর আসলোই বা কেমন করে? ওরা কি তাকে ছেড়ে দিয়েছে! কিন্তু এই বন্ধ ঘরে ঢুকলো কী করে? চোখ দু’টো ক্রমশ বড়ো হচ্ছে জয়দেব স্যারের। আচমকা নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটলেন তিনি। নাহ, সবকিছু ঠিকই তো আছে- তিনি তো কোনো স্বপ্ন দেখছেন না!
কথাটা এবার নয়নই বললো- ‘স্যার, গায়ে চিমটি কাটতে হবে না। আপনি কোনো স্বপড়ব দেখছেন না। এমুহূর্তে বিরাট বিপদ হয়ে যেতে পারে। কথা হলো- ওরা আমাদের মেরে ফেলবে নিশ্চিত। বলছিলাম…।
‘হ্যাঁ, বল বেটা। দ্রুত বল! তার আগে বল- তুই এই রুমে ঢুকলি কেমন করে?’
নয়ন ইশারায় সিলিংয়ের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো ‘স্যার, আজ রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়বে। প্রহরীরা বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকবে বলে মনে হয় না। দুপুর রাতের পর আমরা এখান থেকে পালাবো। একবার তো চেষ্টা করে দেখি। নইলে প্রাণে বাঁচার আশা নেই স্যার।’
‘কিন্তু কিভাবে?’ বললেন জয়দেব স্যার। এতোক্ষণে তিনিও খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছেন।
‘আপনার এবং আমার রুমের মাঝের রুমটাকে ওরা ফাঁকা রেখেছে। যেন কেউ কারো খোঁজখবর নিতে না পারি সেজন্য। একটু আগে আমি ওই রুমে গিয়ে সবকিছু দেখে এসেছি। সেখানে তালা মারা আছে, কিন্তু ভেতর থেকে তালা লাগানোর যে হুক- তা খুলে আমরা বের হয়ে যেতে পারবো।’
‘আচ্ছা!’
আবারও কিছুটা বিস্ময় এবং ভয় নিয়ে জয়দেব স্যার তাকিয়ে আছেন নয়নের দিকে।
‘রাত বারোটার পর আপনি পাশের রুমে থাকবেন। দেখেশুনে একসাথে বেরুবো।’
‘কিন্তু রাত বারোটা বাজলে বুঝবো কেমন করে? আমার এখানে তো ঘড়ি নেই! তাছাড়া আমরা যে বেরুবো- ওরা যদি বুঝতে পারে?’
‘সমস্যা নেই স্যার। আমার রুমে ওদের লাগানো একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। আর ওরাও বুঝতে পারবে না আশা করি। এখানে ওদের কোনো আড়ি পাতা যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না। এটা গভীর বন। প্রযুক্তি কতটুকু আছে কে জানে?’
‘আছে। ওদের কাছে সব প্রযুক্তিই আছে। ওরা তোমাকে টার্গেট করলো কেন- জানো? থাক, সেটা বেঁচে থাকলে কখনো শুনতে পারবে।’
‘ওরা আমার পেছনে লেগেছিলো? কী উদ্দেশ্য ওদের?’
‘থাক, সেটা পরেও কোনোদিন জানা যাবে। আমার নিজের জীবন আর কতটুকু! ভগবানকে বলেছি- তিনি যেন আমার বদলে হলেও তোমাকে বাঁচিয়ে রাখেন।’ এটুকু বলেই জয়দেব স্যার আবারও চাপা আওয়াজে কাঁদতে থাকলেন।
নয়ন বললো- ‘স্যার, আপনি শান্ত হোন। আর আমি এখন তাড়াতাড়ি আমার রুমে চলে যাই। কিছু একটা হয়ে গেলে…!’
‘হ্যাঁ, বাবা। সাবধানে, সাবধানে…।’
জয়দেব স্যারের রুমে একটা চেয়ার ছিলো আগে থেকেই। নয়ন দ্রুত চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে উপরের সিলিং বেড়া ফাঁক করে উপরে উঠে গেলো। জয়দেব বাবু কান পেতে থাকলেন- যতক্ষণ নয়নের পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। নয়ন যখন তার রুম বরাবর সিলিংয়ের উপর এসে পৌঁছলো, তখনই বাইরে একজন প্রহরীর গলা খাকারির শব্দ শোনা গেলো।
তার হৃদকম্পন দ্বিগুণ হলো। সে দ্রুত সিলিং ফাঁক করে আড়া ধরে নিচে ঝুলে পড়লো। ধপাস করে আওয়াজ হলো- একটু ব্যথাও পেলো সে। এরই মধ্যে বাইরে থেকে প্রহরী ডেকে উঠলো- ‘কী হয়েছে, অ্যাঁ?’ নয়ন কোনো জবাব দিলো না। সে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলো এবং উপরের দিকে তাকালো। সর্বনাশ! সিলিংয়ের বেড়াটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে আছে। এবার? এরই মধ্যে দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়লো প্রহরী সানজা মং। হাসি হাসি মুখ করে নয়নের দিকে তাকিয়ে সে বললো- ‘কী খবর তোমার? আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে বুঝি?’
‘হুঁ, আছাড় খেলাম।’
এটুকু বলে সে মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করতে থাকলো- ‘আল্লাহ, ও যেন কিছু বুঝতে না পারে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো খোদা।’
‘ইশ, তোমার তো কপালের দিক থেকে অনেকটা কেটে গেছে। দেখি দেখি- ইশ, রক্ত বেরুচ্ছে।’ বলে প্রহরী সানজা মং তার কপালে হাত দিয়ে রক্তটা চেপে ধরলো। তারপর বললো- এখানে কোনো ওষুধ-পথ্যও নেই। কী যে করা…!’
‘ঠিক আছে। আমার জন্য তোমার অতো দরদ দেখাতে হবে না। রেখেছো তো নির্দোষভাবে বন্দি করে।’ প্রহরী সানজা মং নির্বিকারভাবে একটু হাসলো।
রাত বারোটা।
জয়দেব বাবু আগেই এসে মাঝের রুমটিতে অপেক্ষা করছে। তার হাত-পায়ের চামড়া বেশ কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। রক্ত বেরুচ্ছে সেসব জায়গা থেকে। এরকম যে সিলিং ফাঁক করে ওঠা যায়- সেটা এই প্রথম বুঝতে পারলেন তিনি। আজকালের ছেলেরা যে কতো বুদ্ধিমান- সেটা ভেবে ভালো লাগছে তার। নয়নের জায়গায় তিনি নিজে হলে এই বুদ্ধি তার কখনোই আসতো না যে, সিলিং ফাঁক করে, তারপর ভেতর থেকে দরজার ইস্ক্রু খুলে কেমন করে বের হওয়ার ফন্দি আঁটতে হয়! মনে মনে ইশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন তিনি। আর সেই সাথে আসন্ন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে থাকলেন- ইশ্বর, ছেলেটা যেন ঠিকমতো এখানে আসতে পারে। কে জানে এর আগে যখন এসে তার সাথে দেখা করে গেছে, তারপর কোনো সমস্যা হলো কিনা তার! তখন প্রহরীদের কেউ তাকে দেখে ফেললো কিনা- তাই বা কে জানে! মনে মনে আবারও তিনি ইশ্বরকে ডাকতে থাকলেন।
এরই মধ্যে হঠাৎ তিনি সিলিংয়ের উপর শব্দ শুনে সাবধান হলেন। তার রুমের উপর গিয়ে নয়ন চাপা আওয়াজে ডাকছে। এই ডাক প্রহরীদের কেউ শুনে ফেললে মহাবিপদ! তিনি দ্রুত হাতে উপরের সিলিংয়ে টোকা মেরে বললো- নয়ন আমি এখানে। ত্ইু এই রুমে নেমে আয়। নয়ন এক মিনিটের মতো চুপচাপ বসে থাকলো। হয়তো পুরো বিষটা বুঝে নিতে সময় নিলো। তারপর মাঝের রুমের সিলিংয়ের উপর এসে একপাশের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে আস্তে আস্তে পা নামিয়ে আড়া ধরে ঝুলে পড়লো। জয়দেব বাবু তাকে দুহাত দিয়ে পাজাকোলা করে শক্তভাবে ধরে বললেন- হ্যাঁ, হাত ছেড়ে দে- আমি ধরেছি। নয়ন হাত ছেড়ে দিলে জয়দেব বাবু ওকে ফ্লোরে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো।
এক মুহূর্ত, কেউ কোনো কথা বললো না।
তারপর জয়দেব বাবু প্রমে মুখ খুললেন- ‘কিরে, এখান থেকে বের হয়ে কিভাবে এবং ঠিক কোনদিকে যাবি- ঠিক করেছিস কিছু?’
‘হ্যাঁ স্যার, এদিকে নাকি শুধু বন। গহীন বন। আমরা এখান থেকে বের হয়েই বনে ঢুকে পড়বো।’
‘অনেক কিছু জানিস তাহলে! শোন, এদিকে শুধু বন নয়- একটা নদীও আছে। পাহাড়ি নদী।’
‘স্যার, এখন দ্রুত বের হতে হবে এখান থেকে-এক্ষুণি! ওরা টের পেলে সব শেষ!’
‘হ্যাঁ, দরজা খোলার ব্যবস্থা কর। ওর টের পাবার আগেই যেন আমরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারি। তবে সাবধান, বের হওয়ার সময় যেন কিছুতেই ওরা টের না পায়। ওদের কেউ যদি এদিকটায় থাকে…!’
‘থাকবে না স্যার। ওরা তিনজনই এখন তাস খেলছে। ওই শোনেন- ওদের কথাবার্তা।’
‘তবু সাবধান বেটা!’
পাহাড়ি নদী যে এতো ভয়ঙ্কর হতে পারে- তা ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করেনি নয়ন কিংবা জয়দেব বাবু। দু’আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে নদীতে যে স্রোতটা যেন ক্রমেই ফুলে ফুলে বাড়ছে। সেই সাথে ক্রুদ্ধ অজগরের মতো গর্জন করতে করতে লাফিয়ে নেমে যাচ্ছে ভাটির দিকে। ভয়াবহ এই বনের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের পায়ে পায়ে আকাবাঁকা হয়ে বইছে এই নদী। জয়দেব বাবু এই নদীটির কথা সানজা মংয়ের কাছে শুনেছিলেন। তারপর আজ যখন নয়ন পালাবার কথা বলেছে, ঠিক তখনই তার আবার মনে হয়েছে এই নদীর কথা। তার প্ল্যান ছিলো- বনে জঙ্গলে না হেঁটে নদীতে নদীতে চলে যাবেন নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু নদীর এখন যে হাল- তাতে কোনোভাবেই এরকম দুঃসাহস দেখানো যাবে না।
এই বনের ভেতর এ মুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি পড়লেও একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার নয় রাতটা। এখন পূর্ণিমার সময় কিনা কে জানে! হতেও পারে। নইলে- এমন বৃষ্টির রাতে বনের ভেতর নিজের শরীর নিজেও দেখতে পেতো না। জয়দেব বাবু নয়নকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন- ‘নয়ন, আমি ভেবেছিলাম নদীতে নদীতে আমরা সারা রাত ধরে হাঁটবো এবং এই এলাকা ছেড়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাবো। কিন্ত এ নদীর অবস্থা দেখেছিস!’
‘স্যার, আমরা বরং বনের ভেতর দিয়েই হাঁটি। যে করেই হোক স্যার- আমাদের বাঁচতে হবে। আমার মা একা স্যার- আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে। কী জানি, কেমন আছেন তিনি।’ এটুকু বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো ওর।
জয়দেব বাবু একটু কড়া ভাষায় বরলেন- ‘বেঁচে থাকলে মায়ের কাছে যেতে পারবি। এখন চল এখানে এক মুহূর্তও আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। চল চল- কুইক!’
সকাল আনুমানিক আটটা নাগাদ তারা যেখানটাতে এসে পৌঁছলো- তা একটা অদ্ভুত জায়গা। আরেকটু হলেই গুলি খেয়ে মরছিলো আরকি! দু’তিনজন লোক দু’পাশের পাহাড় থেকে নেমে এসে বন্দুক তাক করে দূর থেকে ঘিরে ফেললো ওদের। জয়দেব স্যার বললেন- ‘শিগগির দু’হাত উপরে তোলো নয়ন!’
নয়ন এবং জয়দেব বাবু দু’হাত উপরে তুলতেই বন্দুক তাক করা অবস্থায় লোক তিনজন ওদের কাছে চলে আসলো।
একজন জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমরা কারা?’
‘আমি জয়দেব। আর ও আমার ছাত্র- নয়ন। আমরা দু’জনই বিপদগ্রস্থ।’
শেষের শব্দটি উচ্চারণ করে আসন্ন বিপদেও আশঙ্কা করে অনেকটা কেঁদে ফেললেন জয়দেব বাবু।
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বললেন- ‘আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি না। কিন্তু প্লিজ, আপনারা যারাই হোন- এই ছেলেটাকে ওর মায়ের কাছে যেতে দিন। ওরা মা-ছেলে ছাড়া ওদের আর কেউ নেই। ওর মা’টা এখন কেমন আছেন কে জানে? প্লিজ…!’
‘আপনাদের পুরো পরিচয় দিন।’
দু’জনের পুরো পরিচয় শোনার পর অনেকটা বিস্ময় নিয়ে সশস্ত্র তিনজনের একজন বললো- ‘তা আপনারা এখানে এলেন কী করে?’
তাদের আরেকজন বলে উঠলো- ‘কোনো কথা নয় এদের সাথে। গুলি করে দাও। এরা তথ্য লুকাচ্ছে।’
জয়দেব বাবুর প্রথমে ধারণা হয়েছিলো- এই সশস্ত্র তিনজন লোক বুঝি ওই মিশনারী চক্রেরই সদস্য। কিন্তু তাদের বর্তমান কথাবার্তায় তিনি নিশ্চিত হলেন- না, এরা ওদের কেউ নয়।
সুতরাং এদের কাছে পুরো বিষটা বলে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। যদি এদের ভেতর মনুষ্যত্বেও কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে হয়তো এ যাত্রায় ছেড়েও দিতে পারে। জয়দেব বাবু পুরো বিষয়টা বিস্তারিত বললেন।
পুরোটা শোনার পর কমান্ডার গোছের লোকটি বললো- ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাদের অবস্থাটা পুরোপুরি আমরা বুঝতে পেরেছি। আর আপনার পরিচয় থেকে তো বুঝলাম- আপনি আমারও শিক্ষক। যদিও আমি যখন আপনার স্কুলে পড়তাম তখন আপনি ওই স্কুলে আসেননি। আপনি নয়নকে যেমন ছেলের মতো স্নেহ করেন, ভালোবাসেন- তেমনি আমাকেও আপনার একজন ছাত্র মনে করে আমার উপর আস্থা রাখেন। আমি আপনাকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবো। তবে এমুহূর্তে আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না। পথে নির্ঘাত আপনারা দু’জন গুলি খেয়ে মরবেন। আমি ভাবছি- এতো পথ আপনারা এলেন কী করে? এখন চলেন, আপনাদেরকে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিই। সেখানে কমসে কম এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেবার পর চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। নইলে এখান থেকে এ অবস্থায় আপনারা কোনোভাবেই সামনে এগুতে পারবেন না। কারণ পথে পথে আমাদের বাহিনীর অনেক সদস্যরা ডিউটিরত আছেন।’
এবার জয়দেব বাবুর কাছে বিষয়টা আরো অনেকখানি স্পষ্ট হলো যে, এরা নিশ্চয়ই পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এ মুহূর্তে তাদের সাথে আর কথা বাড়ানো অর্থহীন।
জয়দেব বাবু নয়নকে ইশারা করলেন- ‘চল বাবা, আমরা বরং উনাদের সাথেই যাই। এই জঙ্গলে আমরা দু’জন মাত্র প্রাণী কোথায় যাবো? যাক, সবই ভগবানের ইচ্ছে। তিনি আমাদের দু’জনকে বাঁচাতে চেয়েছেন বলেই উনাদের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিলেন।’
তিনি নয়নের উদ্দেশ্যে শব্দ করে একথা বললেন বটে। কিন্তু মনে মনে এবং নিঃশব্দে তাকে বলতে হলো- হায় ইশ্বর, নতুন করে আমাদেরকে আবার কোন বিপদে ফেললে! শরীর, হাত-পা এবং কাপড়চোপড় কেটে-ছিঁড়ে একেবারে যা তা অবস্থা! ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় প্রাণ যায় যায়। সমস্ত শরীরই ব্যথায় টনটন করছে ওদের দু’জনের। সবচে নাজুক অবস্থা নয়নের। ঠিক মতো পা ফেলে হাঁটতেও পারছে না ও।
জয়দেব বাবু বললেন- ‘আপনাদের সাথে আমাদের আর কতোদূর যেতে হবে?’
‘আরো কিলো দু’য়েক।’
‘কিলো দু’য়েক! বলেন কি? এই ছেলেটা তো হাঁটতেই পারছে না। অতোদূর কিভাবে যে যাবে ও?’
‘এই তো আরেকটু মাত্র। দু’কিলো খুব বেশি
নয় স্যার। আরেকটু কষ্ট করতে হবে- এই যা!’ কমান্ডার গোছের লোকটি বললো।
এখনো পর্যন্ত এই তিনজনের কারো নামই জানেননি জয়দেব বাবু। জানেনি ইচ্ছে হয়নি বলে। এমুহূর্তে লোকটির সাথে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলেন ওদের সাথে।
এদিকে উঁচু একটি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেই ধপাস করে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালো নয়ন। এতোক্ষণ সে খুব একটা কথাবার্তাও বলেনি। জয়দেব বাবুসহ উপস্থিত সশস্ত্র তিনজন লোকের সবাই স্তম্ভিত হয়ে থাকলো এক মুহূর্ত। পাহাড়ের উপর পানিরও কোনো ব্যবস্থা নেই। এ মুহূর্তে নয়নের মাথায় পানি ঢালা দরকার। পানি ঢাললে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরবে। কিন্তু জয়দেব বাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নয়নের পাশে বসে রইলেন। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
এদিকে রাতের বৃষ্টিতে বন্য দাঁতাল শুকরদের খোঁড়া গর্তের ভেতর জমে থাকা পানি আজলা ভরে এনে নয়নের মাথায় এবং চোখে-মুখে দিতে থাকলো সশস্ত্র পাহাড়ি লোকগুলো। একসময় হুঁশ ফিরলো তার। জয়দেব বাবু তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন সশস্ত্র তিনজন লোকের পিছুপিছু। সারা রাতের দৌড়ঝাঁপে তিনিও ক্লান্ত- তবু অনেক সামর্থ তার এখনো আছে। যে তিনজন লোক তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের তিনজনের সাথেই তিনি একা ফাইট করার সাহস এবং শক্তি রাখেন। কিন্তু এ মুহূর্তে আর সেরকম সুযোগ নেই। তাছাড়া অস্ত্রের মোকাবেলায় পেশি শক্তি কতোটা আর কার্যকারী!
নয়নকে কাঁধে নিয়ে সশস্ত্র তিনজনের পেছনে পেছনে হাঁটছেন জয়দেব বাবু। নয়ন নির্বিকার। তার কাছে এ মুহূর্তে অন্ধকার।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)