কান্না-জড়ানো-বিস্ময়কর-দ্বীপ-5হঠাৎ দেখলে মনে হবে এক অপরূপ মায়াবী নগর আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চারদিকে নীল জলরাশি দেখে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। মনে হবে কল্পনার কোনো এক দ্বীপে চলে এসেছেন। মনে হতেই পারে যেন সাগরের মাতাল হাওয়ায় কেউ হালকা ছুঁয়ে চলে যায়। কিন্তু আর দশটি সাধারণ দ্বীপের মতো নয় এটি। সারাক্ষণ পর্যটকদের ভিড়, বাচ্চাদের কোলাহল, সুখী দম্পতির হাসিমাখা মুখ- এই দ্বীপে এর কোনোটিরই দেখা মিলবে না। এ দ্বীপটি নিঝুম দ্বীপ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। দ্বীপ থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলেই দ্বীপের সৌন্দর্যের চেয়ে হাহাকার ধ্বনিই আপনাকে তাড়া করবে প্রতিনিয়ত। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে যেন এক অজানা আতঙ্ক আর ভয়। ভয়ে কেউ দ্বীপেই নামতে চায় না। বাতাসে হাজার বছরের পুরনো কান্না যেন জমে রয়েছে এই দ্বীপে। কিভাবেদ্বীপটি সকলের কাছে অভিশপ্ত আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে!কান্না-জড়ানো-বিস্ময়কর-দ্বীপ-1পোভেগ্লিয়া ভেনিস এবং লিডো এর মাঝে অবস্থিত উত্তর ইতালির ছোট এক দ্বীপ। লেগুন সেইন্ট মার্ক্স স্কয়ারে অবস্থিত এই দ্বীপ ‘পোভেগ্লিয়া ভেনিস’ বা ‘পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড’ হিসেবেও পরিচিত। দ্বীপটি ভেনিস হতে ৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। পোভেগ্লিয়া দ্বীপটি খাল দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত এবং তার ওপর একটি সংযোগ সেতু বিদ্যমান। ভেনিস এবং লিডো শহর দুটির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপ পোভেগ্লিয়া। ইতালির পোভেগ্লিয়া এমন একটি দ্বীপ, যেটি আইল্যান্ড অফ ডেথ নামে বহুল পরিচিত। এই দ্বীপটি সম্পর্কে কথিত রয়েছে, যে একবার এই দ্বীপে যায় সে আর জীবিত ফিরে আসে না। এর পেছনে রয়েছে একটি ভয়ানক কাহিনী। জানা যায়, কয়েকশো বছর আগে এখানে দেড় লক্ষ প্লেগ রোগীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। পরিত্যক্ত এই দ্বীপটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হলেও এর মূল ভবনগুলির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পর্যটকবান্ধব নয়।

কান্না-জড়ানো-বিস্ময়কর-দ্বীপ-3দ্বীপটিতে দাঁড়িয়ে থাকা ১১টি ভবনসহ মানসিক হাসপাতালটি ১৯২২ সালে উন্মুক্ত এবং ১৯৬৮ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সেটিই এর মূল আকর্ষণ। দ্বীপটির বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার প্রতিবেদনের কারণে পোভেগ্লিয়া দ্বীপটি ইতালির টিকে থাকা অন্যতম ভুতুড়ে স্থান হিসেবে চিহ্নিত। ১৩৪৮ সালটি পোভেগ্লিয়া দ্বীপের অধিবাসীদের জন্য এক আতঙ্কের বছর, এক বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাসের বছর। কারণ এ সময় দ্বীপের নোঙর ফেলা দু’টি জাহাজে বিউবোনিক প্লেগ দেখা দেয় এবং এই রোগে আক্রান্ত দুইজন মারা যায়। কিন্তু এখানে কাজ করা এবং অতিথিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়নি। ধীরে ধীরে প্লেগের মহামারী আশপাশ অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যেতে থাকে। চিকিৎসা করেও লাভ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বন্দরটি সিল করে দেয়া হয়।

শতাব্দীর অগণিত মানুষের জমে থাকা কান্না সর্বক্ষণ প্রতিধ্বনিত হয় নির্জন, নিঃশব্দ পোভেগ্লিয়া দ্বীপের চারপাশে। জঙ্গলে, রাস্তায়, এখানে সেখানে পড়ে রয়েছে মৃত মানুষের কঙ্কালের হাড়গোড়। রাতের অনেক দূর থেকে পোভেগ্লিয়া দ্বীপের দিকে তাকাতে বুক কেঁপে যায় পোড় খাওয়া জাহাজের ক্যাপ্টেনেরও। প্লেগ রোগীদের এখানে আনা হতো মেরে ফেলার জন্য। পরে ব্ল্যাক ডেথ (কালোজ্বর) এর সময়েও এই দ্বীপকে একই কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে যখন রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার অসুস্থ মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। ১৯২২ সালে এখানে মানসিক হাসপাতাল তৈরি করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর এটাকে বন্ধ করে দেয়া হয়। হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার কারণ ছিল ডাক্তার এবং নার্সরা অস্বাভাবিক জিনিস দেখতে পাওয়া। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি মানসিক রোগীরা মৃত প্লেগ রোগীদের আত্মা দেখতে পেতেন।

কান্না-জড়ানো-বিস্ময়কর-দ্বীপ-2১৮০০ শতকের শেষ দিকে পোভেগ্লিয়ায় রোগীদের নিয়ে এক ধরনের পাগলাটে এক্সপেরিমেন্ট চালান এক পাগল চিকিৎসক। হাসপাতাল নামক যে জায়গাটিতে রোগীদের রাখা হতো, তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সেখানেটিকে থাকা সম্ভব নয়। রোগীদের কথা তো অনেক দূরের ব্যাপার। সেই পাগল চিকিৎসক রোগীদের হাত-পা নিয়ে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করতেন। রোগীদের পুনর্বাসন নয়, মৃত্যুই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। দিনে দিনে তিনি পুরোপুরি উন্মাদে পরিণত হন এবং হাসপাতাল নামক সেই বিল্ডিংয়ের বেল টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রায় একশো বছর আগে সেই হাসপাতালের স্থাপনাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলেও পর্যটকরা নাকি এখনো সেখানে ঐ উন্মাদ চিকিৎসকের মরণ চিৎকার শুনতে পান।

হাসপাতাল বন্ধের কয়েক বছর পর পর্যন্ত দ্বীপটি জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। এরপর ১৯৬০ সালে ইতালি সরকার একটি বেসরকারি মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয় পোভেগ্লিয়াকে। দ্বীপের নতুন মালিক তার পরিবারকে নিয়ে কয়েকদিন এখানে সময় কাটান। কিন্তু সেখানে তাদের শিশু পুত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ায় কিছুদিন পর তারাও এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যান। এরপর আরেকটি পরিবার এই দ্বীপটিকে হলিডে হোম তৈরি করার জন্য কেনেন। কিন্তু তারাও একদিন পর এই জায়গাটিকে ত্যাগ করেন।

কান্না-জড়ানো-বিস্ময়কর-দ্বীপ-4বলা হয় যে, দ্বীপের মালিকের মেয়েকে কেউ কামড়ে দেয়। যার ফলে তাকে ১৪টি ইঞ্জেকশন নিতে হয়। সে যাত্রায় মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার বাবা-মা আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। এই সমস্ত ঘটনার পর কয়েকজন বিষয়টিকে নিয়ে তদন্ত করার চেষ্টা করেন। যারা এখানে সত্যতা সন্ধান করতে গিয়েছিলেন তারাও জীবিত ফিরে আসেননি। আর যারা জীবিত ফিরে এসেছিলেন তারা বলেন এখানে প্লেগ রোগীদের আত্মা রয়েছে। কিন্তু এই ভুতুড়ে দ্বীপের সত্যতা এখনও রহস্য হয়ে রয়েছে।

উত্তর ইতালি ভিনিস্বাসী উপহ্রদে অবস্থিত এই দ্বীপে তাই এখন জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সরকার এখানে যাওয়ার ব্যাপারে জনগণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলেদের জালে অনেক সময় মানুষের হাড় উঠে আসে। সব মিলিয়ে পোভেগ্লিয়া হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুপুরী, আর সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাসের কেন্দ্রস্থল।

Share.

মন্তব্য করুন