সে অনেকদিন আগের কথা। তখন দুনিয়ার বুকে গৌরবের সাথে চলছে ইসলামের সোনালি যুগ। আমিরুল মুমিনিন হিসেবে হযরত ওমর ফারুক রা. ইসলামী খিলাফতের মহান দায়িত্ব পালন করছেন। সে সময় তিনি ছিলেন অর্ধেক পৃথিবীর মহান অধিপতি।
সে যুগে আরব ভূখণ্ডে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র ‘মদিনা’র পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কায়সার ও কিসরা নামে দুটি রাজ্য ছিলো। সেগুলো ছিলো বর্তমান আমেরিকা, রাশিয়ার, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো সুপার পাওয়ার তুল্য ও প্রচণ্ড প্রভাবশালী রাষ্ট্র। সব ধরনের শক্তি ও সামর্থ্যরে দিক থেকে কায়সার ও কিসরা রাষ্ট্র দুটি ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদেরকে যুদ্ধে হারাবার মত শক্তি কারোই ছিলো না। তাই কায়সার ও কিসরার শাসক গোষ্ঠীরও দম্ভ এবং অহঙ্কারের সীমা-পরিসীমা ছিলো না। ওরা এত শক্তিশালী আর অহংকারী হলে হবে কী! আল্লাহ পাক তাদের এই দম্ভ ও অহংকারকে বেশি দিন কিন্তু টিকে থাকতে দেননি।

মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত ওমর রা. এর হাতে কায়সার ও কিসরার শাসকগোষ্ঠীর দম্ভ ও অহংকারকে চিরদিনের জন্য মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহর রহমতে হিকমাত ও সাহসিকতার সাথে আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ফারুক রা. খুব সহজেই কায়সার ও কিসরার শাসকগোষ্ঠীরকে পরাজিত করেন। তিনি কায়সার ও কিসরাকে মদিনার খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই রাজ্য দুটিকে একত্রিত করে এর নাম রাখা হয় ‘সিরিয়া’। এই সিরিয়া ইসলামী খিলাফতের একটি অন্যতম প্রদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন এই সিরিয়া এতোটা বিশাল ছিলো যে, তখনকার সেই বিশাল সিরিয়া ভেঙেই বর্তমানে যুগে চারটি বড় বড় রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। যার মাঝে আজকের আরব্য দেশ সিরিয়া অন্যতম।
আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ফারুক রা. পরহেজগারি ও অন্যান্য যোগ্যতার বিবেচনায় সাহাবী হযরত উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. কে সেই বিশাল সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেন। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব লাভের পর হযরত উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. খুবই সততা ও নিষ্ঠার সাথে প্রদেশের শাসনভার পরিচালনা করতে থাকেন। এতে তার বেশ সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সুখ্যাতির খবর আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ফারুক রা. এর কানেও পৌঁছে।
ব্যাপারটা কতটুকু সত্য তা যাচাই করার জন্য তিনি একবার সিরিয়া সফরে যান। সফরে গিয়ে হযরত ওমর ফারুক রা. মনে মনে ভাবলেন, সবার আগে তিনি মুসলমান ভাইদের অবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখবেন। সে অনুযায়ী তিনি গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘুরে ঘুরে জনসাধারণের ভালো-মন্দ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। সফরের এক পর্যায় একদিন হযরত ওমর রা. সিরিয়ার গভর্নর উবায়দা রা. কে বললেন, আমার মন চাচ্ছে এবার আপনার ঘরটা কেমন তা দেখবো।
সাথে সাথে উবায়দা রা. বিনয়ের সাথে বললেন- আমিরুল মুমিনিন, আমার ঘর দেখলে হয়তো কিছু চোখের পানি ঝরানো ছাড়া আপনার আর কোন লাভই হবে না। তবুও হযরত ওমর রা. বায়না ধরলেন- আমার তো মন চাচ্ছে, আমার ভাইয়ের ঘরটা একবার ঘুরে ফিরে দেখবো।
গভর্নর তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর রা. কে তার ঘর দেখাতে রাজি হয়ে গেলেন। তাই একদিন হযরত উবায়দা রা. হযরত ওমর রা. কে নিয়ে তার ঘরের দিকে রওয়ানা হলেন। কিন্তু দু’জন একসাথে চলছেন তো চলছেনই। এভাবে যেতে যেতে শহরের শেষ প্রান্তে একটা খোলা ময়দানে এসে থামলেন। তখন হযরত ওমর রা. অবাক হয়ে বললেন- হে উবায়দা! তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছো?
উবায়দা রা. বিনয়ের সাথে বললেন- আমিরুল মুমিনিন আমি তো আপনাকে আমার ঘরেই নিয়ে যাচ্ছি।
জবাব শুনে হযরত ওমর রা. আর কথা বাড়ালেন না। তিনি হযরত উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. এর সাথে ফের হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোতে লাগলেন। এভাবে যেতে যেতে তাঁরা একবারে জনবসতির বাইরে ঘাসের তৈরি একটি ঝুপড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তখন সিরিয়ার গভর্নর হযরত উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. বললেন- আমিরুল মুমিনিন এটাই আমার ঘর। হযরত ওমর ফারুক রা. কোন রকম কথা না বলে সোজা ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। তিনি ঘরের ভেতর তেমন আকর্ষণীয় দামি আসবাবপত্র বা আলিশান কোনো কিছুই দেখতে পেলেন না।
তবে দেখতে পেলেন মেঝেতে শুধু একটি সাধারণ নামাযের বিছানা বিছানো আছে। সেটা ছাড়া ব্যবহারের জন্য আর অন্য কোন সামগ্রী নেই! ওমর ফারুক রা. এবার রীতিমত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- উবায়দা, তুমি এখানে কিভাবে বেঁচে আছো? তোমার আসবাবপত্র কোথায়?
হযরত উবায়দা রা. একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে মাচানের মতো বাঁধা কাঠের তাক থেকে একটি পাত্র বের করে আনলেন। দেখা গেলো, সে পাত্রে কিছু পানি আর তার মধ্যে কয়েক টুকরা রুটি ভেজানো। ওমর ফারুক রা. গভীর মনোযোগের সাথে দুচোখ ভরে সেটা দেখলেন।
এতে হযরত উবায়দা রা. কিছুটা বিব্রত হয়ে নিবেদন জানালেন- আমিরুল মুমিনিন, আমার যে দায়িত্ব! সে দায়িত্ব পালনের পর খাবার রান্না করার কোনো সময় থাকে না। তাই আমি পূর্ণ এক সপ্তাহের রুটি এক মহিলাকে দিয়ে তৈরি করিয়ে নেই। আমার যখন ক্ষুধা পায় তখন সে রুটি এই পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে আমার জীবন ভালোই কাটছে।
হযরত ওমর ফারুক রা. বললেন- তোমার আর মালামাল এবং আসবাবপত্র কোথায়? প্রশ্ন শুনে হযরত উবায়দা রা. বেশ লজ্জিত হয়ে বললেন- আমিরুল মুমিনিন! আর মালামাল দিয়ে কী করবো? কবর পর্যন্ত পৌঁছতে তো এতোটুকুই যথেষ্ট।
আমিরুল মুমিনিনের নিজের হাতে নিযুক্ত সিরিয়ার গভর্নর হযরত উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এই হাল দেখে হযরত ওমর ফারুক রা. এর দু’চোখে নেমে এলো নোনা পানির ঝর্ণাধারা। অস্ফূট কণ্ঠে তিনি বললেন- এ পৃথিবী আমাদের সকলকেই বদলে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর কসম, তুমি হযরত রাসূল সা. এর কালে যেমন ছিলে এখনো তেমনি রয়ে গেছো। এই বলে তিনি দু’চোখ ভাসিয়ে খুব করে কাঁদতে শুরু করলেন।

Share.

মন্তব্য করুন