শুধু বাংলাদেশ নয়, সুন্দরবন এ পৃথিবীর এক অতুলনীয় সম্পদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বাংলাদেশের প্রাণস্বরূপ এ সুন্দরবনে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা খাল আর নদী। সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ কেইবা হাতছাড়া করতে চায়। হাতছাড়া করতে চাইনি আমিও। সঙ্গী তেরোজনের একটি দল। সবার চোখে মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস। চট্টগ্রাম থেকে মংলাগামী বাস ছাড়ল বিকেল ৪টায়। বলছি ১৩ মার্চ ২০১৭ তারিখের কথা।
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা নিয়ে সুন্দরবন গঠিত হলেও এর কিছু অংশ (এক-তৃতীয়াংশ) পড়েছে ভারতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় বিশ হাজার বর্গ কি.মি. থাকলেও বর্তমানে তা কমে দশ হাজার কি.মি.তে ঠেকেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ কি.মি., যা সুন্দরবনের বর্তমান মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ।
রাত ১টা। আমাদের বহনকারী বাস পৌঁছল মাওয়া ফেরিঘাটে। সামনে বিস্তৃত নদী পদ্মা। ফেরিতে পার হতে হবে পদ্মার ওপারে। সর্বনাশা পদ্মার সাথে এ আমার প্রথম সাক্ষাৎ। ফেরিতেও চড়া হয়নি আগে। পুলক জাগছে শরীর ও মনে। ফেরিতে ওঠার জন্য যানবাহনের দীর্ঘ সারি। বাসের হেলপার জানাল জ্যাম বেশ দীর্ঘ। নদীর ওপারে ফরিদপুরের আটরশিতে ওরশ হওয়ায় জ্যাম খুব তীব্র আকার ধারণ করছে। ফেরিতে উঠতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ন্যূনতম ২৪ ঘন্টা। শুনেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। স্থানীয় যাত্রীরা যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের দলনেতা সালাহ উদ্দীন ভাইও গভীর ঘুমে মগ্ন। জেগে আছে শুধু কয়েকজোড়া চোখ। চারদিকে নাক ডাকার শব্দ সাইরেনের মত বাজছে।
বালেশ্বর, কুঙ্গা, পশুর, শ্যালা, রায়মঙ্গল, হরিণঘাটা, মালঞ্চ, দুধমুখী প্রভৃতি সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া উল্লেখযোগ্য নদী। এ ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোটখাটো খাল, ডোবা, খাড়ি ইত্যাদি। সুন্দরবনের বর্তমান আয়তনের ৩১.১ শতাংশই জলাধার। ভোরের আলো ফোটার আগেই এসব নদী, খাল, ডোবায় ঝাঁক বেঁধে হরিণদের পানিতে নামার দৃশ্য ভাসছিল চোখের তারায়। হঠাৎ কানে এলো হালুম…! ভয় পেয়ে দৌড়ে পালানোর আগেই জাবেদ ভাই জানাল আমরা এখনো মাওয়া ঘাটেই আছি! আর হালুম শব্দটি নকল! সেই নকল ‘হালুম’ একটু আগেই মামুন ভাইয়ের গলা দিয়ে নিঃসৃত হয়েছে!
ভোর হলো মাওয়া ঘাটে। বাস দশ হাতও সামনে এগোতে পারেনি। জানা গেল আরও ২৪ ঘন্টায়ও বাস ফেরি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো। স্পিড বোটে পদ্মা পার হয়ে মাদারীপুরে উঠলাম। সেখান থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করা হলো মংলা পর্যন্ত। মাদারীপুর-ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট হয়ে যখন মংলায় পৌঁছলাম তখন ভর দুপুর। ঠিক বারোটা। দেরি না করে আমরা অপেক্ষারত লঞ্চে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পশুর নদীর বুকে ভেসে চললাম আমরা। দীর্ঘ ২০ ঘণ্টার ক্লান্তি পেছনে ফেলে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো অবারিত সুন্দরবনের দিকে। এর মধ্যে দুপুরের খাবার সম্পন্ন হলো। লঞ্চ চলছে। তেরো জোড়া চোখে খেলা করছে রোমাঞ্চকর সবুজ স্বপ্নেরা…।
সুন্দরবনে রয়েছে নানা রকম উদ্ভিদ। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, ধুন্দল, শাল ইত্যাদি বৃক্ষের পাশাপাশি রয়েছে বেতগাছ, গোলপাতা, হিতাল, আমুর, কেওড়া, নলখাগড়া, ঘাস ও গুল্ম ইত্যাদি। রয়েছে হরেক রকমের অর্কিড। হরিণের নাগালসীমা পর্যন্ত সুন্দরী গাছের পাতাগুলো এমনভাবে খাওয়া যে মনে হবে কোন দক্ষ মালী বাগানের পাতাগুলো কাঁচি দিয়ে ছেঁটে রেখেছে। ভূমিজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা আকারের শ্বাসমূল।
পশুর নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে। নদীর দুই তীরে গোলপাতার ডগাগুলো বাতাসে কেঁপে কেঁপে যেন অভিবাদন জানাচ্ছে আমাদের। হাতের ডান পাশে পড়ল ‘করমজল’ পয়েন্ট। পশুর পার হয়ে আমাদের লঞ্চ প্রবেশ করল শ্যালা নদীতে। সূর্যের তাপ ততক্ষণে কমে এসেছে। হেলে পড়েছে পশ্চিমের কোলে। সামনেই চাঁদপাই রেঞ্জ। লঞ্চ থামল। বন বিভাগের একজন গানম্যান দেয়া হলো আমাদের সাথে। জায়গাটা বাগেরহাটই। আমরা নেমে নিকটস্থ বাজারে গেলাম। কেনা হলো গরম গরম জিলেপি। এই সুযোগে লঞ্চ ইঞ্জিনের টুকটাক সমস্যাও সারিয়ে নেয়া হলো। ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। যাত্রা শুরু হলো পুনরায়।
সুন্দরবনের স্থলে যেমনি আছে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আনাগোনা তেমনি রয়েছে নানা প্রজাতির হরিণ, বানর, বনমোরগ, বাদামি কাঠবিড়ালি, বুনোশূকরসহ বিষধর সাপের বসবাস। জলভাগে রয়েছে বিরল প্রজাতির ডলফিন, শুশুক, কুমির, কচ্ছপ ইত্যাদি। রয়েছে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া ও চিংড়ি, ৯ প্রজাতির শামুক এবং কয়েক শত প্রজাতির মাছ। নানা আকার ও প্রকারের বক, মাছরাঙাসহ রয়েছে ২৭০ রকমের পাখি। আছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির ওড়াউড়ি। মাছ ধরার জন্য জেলেদের দিনরাত বিরামহীন প্রচেষ্টা, মৌয়ালদের অবিরত ছুটোছুটি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
জীবনে প্রথম নদীতে রাত কাটানোর শিহরণ শরীরকে স্থির হতে দেয়নি তখনো। কিছুটা শীত শীত আবহাওয়া বিরাজ করছে। কেটে যাচ্ছে আঁধারের বলিরেখা। সবাই তখনো ঘুমে। চুপি চুপি গিয়ে বসলাম চালকের পাশের আসনে। তখন ভাটা চলছিল। কাদায় পা ডোবানো কয়েকটা ধলি বক দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। কাপ্তান হুঁশিয়ার করে দিলো যে আওয়াজ করা যাবে না। মানুষের আওয়াজ শুনলে আশপাশে থাকা হরিণেরা বনের ভেতরে চলে যাবে। বলতে বলতেই দেখা মিলল এক পাল হরিণের। ততক্ষণে চোখ মুছতে মুছতে লঞ্চের ডেকে এসে উপস্থিত সবাই। খুব সরু কয়েকটি খাল অতিক্রম করে লঞ্চ যখন কটকা পয়েন্টের কাছাকাছি নোঙর করল তখন সকাল নয়টা।
আগেই বলেছি তখন ভাটা। সামনের খালটা অপেক্ষাকৃত বেশি সরু আর পানি কম হওয়ায় বড় লঞ্চটি অপেক্ষাকৃত বড় খালে নোঙর করে ছোট লঞ্চটি নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কিছুক্ষণ সরু খালে চলার পর লঞ্চ থামল। আমরা নেমে এলাম স্থলভাগে। কটকা সৈকতে যাওয়ার জন্য এখান থেকেই হাঁটা শুরু করতে হবে। সবার হাতে হাতে পানির বোতল পৌঁছে গেল ততক্ষণে। আমাদের নিরাপত্তায় আসা বন বিভাগের গানম্যানও প্রস্তুত। হাতে গজারি লাঠি নিয়ে প্রস্তুত আমাদের গাইড জাহিদ মোল্লাও। মার্চ অন! শুরু হলো ১৩ জোড়া পায়ের অভিযান। সুন্দরবনের বুক চিরে। সামনে বাংলাদেশের বিপজ্জনক সৈকত কটকা।
দুই মিনিট হাঁটতেই দেখা মিলল বিশাল হরিণের পালের। চোখ-কান খাড়া করে আমাদের আগমনে অবাক হয়েছে মতো ভাব করল। জাহিদ মোল্লা সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। শব্দ শুনলে পালিয়ে যেতে পারে বাঘ! ততক্ষণে দৌড় শুরু করল হরিণ দলের কয়েক সদস্য। সাথে সাথে সবাই। বাঘের দেখা আর মেলে না। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সবাই। মাটিতেই কী যেন আবিষ্কার করে! হিড়িক পড়ে ছবি তোলার। কী? কী? জবাব পাওয়া যায় একটু পরই। এ হচ্ছে বাঘের পদচিহ্ন। বাপরে!
আবার চলতে থাকি ভরদুপুরের গনগনে সূর্যের তাপ উপেক্ষা করে। কত প্রজাতির বৃক্ষ যে আছে সন্দরবনে তার সবগুলোর দিকে একবার করে তাকাতে গেলেও মাস কয়েক সময় লাগবে বোধ করি। ঝোপ জঙ্গল উপেক্ষা করে চলতে থাকি তবু। স্মার্ট ফোনের স্মৃতি ভারি হতে থাকে ক্রমেই। মাঝে মধ্যে এগাছ ওগাছের সাথে বাড়ি খাচ্ছে যুগের নবতর সংযোজন সেলফি স্টিকগুলো। অনেক গাছেই ঝুলতে দেখা যাচ্ছে নানা আকারের বানর।
নির্জন তো বটেই সৌন্দর্যের দিক থেকেও কটকার মতো সৈকত বিশ্বে বিরল। তবে বিপজ্জনক হওয়ায় পানিতে নামা বারণ। কটকায় পা রাখতেই অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠে দেহমন। কী যে অনুপম, কী যে ¯িœগ্ধ-সুন্দর, লিখে বোঝানো অসম্ভব। সৈকতে স্তরে স্তরে জমে আছে বনের নাম না জানা হাজারো বুনোফুল। সৈকতের এখানে ওখানে এখনো রয়ে গেছে ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী সিডরের ক্ষতচিহ্ন। শেকড় উপড়ে ফেলা গাছ, ডালপালা হারানো বিরানবৃক্ষ, উজাড় হওয়া বন আমাদের মনে করিয়ে দিলো সেই ভয়াল রাতের কথা।
স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনেই কিছু ছবি তুলে রাখার তাগিদ অনুভব করলাম। কিছুক্ষণ হৈ হুল্লোড়, মাতামাতি, হাঁটাহাঁটি। তারপর ফেরার পালা। কটকা সৈকতের আরেকটা বিশেষ দিক হলো এ সৈকতে দাঁড়িয়ে জোরে আওয়াজ করলে বন থেকে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আমারা কয়েকজন ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করে নিলাম। সৈকতের ভেজা বালির মায়া কাটিয়ে আবার হারিয়ে গেলাম বনের গহিনে।
কটকা অভয়ারণ্য পেরিয়ে আমরা গেলাম কটকা খালের পশ্চিম পাশে। সেখানে আছে বন বিভাগের অফিস। কাঠের তৈরি টেইলটি পর্যটকদের চলাচলে কিছুটা স্বস্তি জোগায়। এখানেও দেখা মিলল পালে পালে মায়া হরিণের। সিডরের ধ্বংসযজ্ঞের দেখা মিলল এখানেও। এখানকার সৈকতে সূর্যাস্ত অবলোকন বেশ উপভোগ্য হলেও সে আশা অপূর্ণ রেখেই ফিরতে হলো লঞ্চে। বেজে উঠল বিদায়ের করুণ সুর। লঞ্চ চলতে শুরু করল। গতি বাড়ছে।
লঞ্চে ফিরেই গোছলের প্রতিযোগিতা। কার আগে কে গোসলখানায় ঢুকবে তা নিয়ে যখন মধুর লড়াই তখন শুরু হলো নদীর পানি দিয়ে গোছলের হিড়িক। গাইডের দুই সহকারী পানি উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে সহযোগিতা করলেন। পানি নোনা হওয়ায় চুল ঝরঝরে না হলেও গোছল করে বেশ তৃপ্তি পাওয়া গেল। তারপর খাওয়ার পর্ব শেষ করে জমল গানের আসর। গভীর মর্মাথের গান জমছিল না বলে প্যারোডির পসরা সাজাতে বাধ্য হলেন গায়ক প্যানেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। ভাটার টান লাগে দুই দিনের মুখরতায়। রাত্রির কোলে ঢলে পড়ে আমার সঙ্গীরা। এক সময় আমিও। লঞ্চের গতি মন্থর।
রাত বাকি থাকায় মংলায় ফিরলেও লঞ্চে কাটাতে হল আরো ঘন্টা তিনেক। ভোর হলে উঠে এলাম স্থলভাগে। সাথে সুন্দরবনের স্মৃতি দুই কেজি করে মধু। আসার আগে আরো ঘুরে এলাম খান জাহান আলী (রহ.) এর মাজার, ষাটগম্বুজ মসজিদ, ঘোড়া দিঘী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মসাগর প্রভৃতি স্থান। সন্ধ্যার কিছু আগেই চেপে বসলাম চট্টগ্রামগামী বাসে। বাস ছাড়ল। শরীরে তখনো লেগে আছে সুন্দরবনের ঘ্রাণ। মন পড়ে আছে সুন্দরবনের গহিনে।
Share.