আরমান সাহেব প্রতি বছর একাই গরু কোরবানি দেন। মধ্যম আয়ের মানুষ। একা গরু কিনতে একটু কষ্ট হয় ঠিকই কিন্তু দরিদ্র মানুষ ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে গোশতো বিলিয়ে বেশ মজা পাওয়া যায়। তাতে আর কষ্টের কথা মনে থাকে না তার। এবার একটু আগেভাগে গরু কিনেছেন। লাল মোটা তাজা গরু। সকলের পছন্দ। বাড়িতেও বেশ ক’টি গরু রয়েছে। হাড্ডিসার দেহ, লিকলিকে চেহারা। পাঁজরের হাড়গুলো সহজে গোনা যায়। কোরবানির গরু আর বাড়ির গরুর মধ্যে যেন আকাশ-পাতাল তফাত।
আরমান সাহেবের একমাত্র ছেলে রাব্বি। একটা কেজি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। গরুটা দেখে ভীষণ খুশি হয় ‘ও’। আব্বু হাটে যাবার পর একটা পাত্রে খাবার প্রস্তুত করে রেখেছিল রাব্বি। আরমান গরু এনে উঠানে বেঁধে রাখার সাথে সাথে সাড়া পড়ে যায় বাড়িতে। সকলে ছুটে আসে। কারো হাতে হারিকেন, কেউ আনে টর্চ লাইট। কেউ মোবাইল ফোনের আলোয় ভালোভাবে পরখ করে গরুটা। রাব্বি খাবারের পাত্রটা এগিয়ে দেয়। সারাদিন না খাওয়া। খাবার পেয়ে ‘ও’ গপগপ করে খেয়ে ফেলে।
কেমন হয়েছে? জানতে চান আরমান।
সকলের মুখে একটাই উত্তর-খুব ভালো হয়েছে। স্ত্রী ফারজানা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, : তোমার পছন্দের প্রশংসা না করে পারা যায় না। এমন গরুই পুষতে হয়।
: রাব্বি, তোমার মত কী?
: ভালো ভালো ভাল। আব্বু, গরুটা রেখে দাও। এবার বাড়ির গরু কোরবানি দাও।
সকলের মুখে গরুর তারিফ শুনে আরমান বলেন, : সত্যিই ভাল হয়েছে, তাই না? আলহামদুলিল্লাহ আমার টাকা তাহলে বৃথা যায়নি। আল্লাহ নিশ্চয়ই এ কোরবানি কবুল করবেন।
: গরুটা রেখে দাও না আব্বু। ওর খাবার আমিই দেব। তোমাদের কারো কোন কষ্ট করতে হবে না। কী-চুপ হয়ে গেলে কেন?
: তোমরা কোরবানির অর্থই বুঝতে পারোনি। তাই এমন আবদার করছো
রাব্বি কিছু বুঝতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে বাবার দিকে। স্বামীর কথায় খানিকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন ফারজানা। আরমান বলেন : ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছিলেন। সেই হুকুম অনুযায়ী সবচেয়ে প্রিয়ও পছন্দের পশু কোরবানি দিতে হয়। সেরেফ গোশতো খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন অসুস্থ ও অঙ্গহীন পশু কোরবানি দিলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ভুল ভাঙে ফারজানার। ‘সরি’ বলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়ান তিনি। রাব্বি নিজকে অপরাধী মনে করে বিনয়ের সাথে বলে, ভুল হয়েছে আব্বু। কোরবানি সম্পর্কে আমার ধারণা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আরমান বলেন, মনে রেখ, কোরবানির মাংস আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। পশু কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলো সেটাই আল্লাহ দেখবেন। বাবার কথা খুব ভালো লাগে রাব্বির। মনের ভেতর গেঁথে রাখে কথাগুলো।
সেদিন স্কুলে ছড়া লিখতে দেন স্যার। সবাই লিখছে। রাব্বির পাশেই বসেছিল শামীম। ‘ও’ না লিখে চুপচাপ বসে আছে।
: কিরে, বসে আছিস কেন? একদম সহজ ছড়া। তাড়াতাড়ি লিখে ফ্যাল।
: পেনসিল নেই।
শামীমের জবাব শুনে বাবার কথা মনে পড়ে রাব্বির। ওর দুটো পেনসিল। সাথে সাথে ব্যাগ খুলে সবচেয়ে ভালো এবং পছন্দের পেনসিলটা শামীমকে দিয়ে দেয়।
স্কুল থেকে বাড়ি এলে প্রতিদিন ছেলের ব্যাগ তল্লাশি করেন ফারজানা। কোন কিছু ফেলে এসেছে কি না। পেনসিল না পেয়ে রেগে যান তিনি।
: সেদিন খাতা হারালি, আজ পেনসিল নেই। এসব কি শুরু করেছিস ?
: পেনসিলটা শামীমকে দিয়েছি।
: বাবার টাকায় পেনসিল কিনে আরেকজনকে দিয়েছিস! ভালো ভালো খুউব ভালো। দাঁড়া হাতেম তাই হতে পারবি।
পাশের ঘরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলেন আরমান। এবার সামনে এসে জিজ্ঞেস করেন,
: তা শামীমকে পেনসিল দিলে কেন?
: আমার দুইটা পেনসিল। ওর একটাও নেই। আব্বু তুমিই না বলেছিলে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা কোরবানির প্রধান শিক্ষা। এখনো কোরবানির গোশতো হাঁড়ি থেকে ফুরোয়ন্ িএর মধ্যে শিক্ষাটা ভুলে গেলে !
ছেলের কথায় মা বাবা দু’জনেই লজ্জা পান। কোন কথা বের হয় না তাদের মুখ দিয়ে। আরমান রাব্বিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলেন, : আমি দামি গরু কোরবানি দিয়েছি। আর তুই দান করলি সামান্য একটা পেনসিল। আমার মনে হয় গরুর চেয়েও তোর দানের মূল্য অনেক বেশি।
: আব্বু এবার ঈদে আমি দুটো নতুন জামা পেয়েছি। অথছ কলোনি পাড়ার অনিক একটাও কিনতে পারেনি। আমি একটা জামা ওকে দিতে চাই। তোমরা রাজি আছোতো ?
: ভালো হবে, খুউব ভালো। ছোটদের জন্য এটা একটা বড় কোরবানি।

Share.

মন্তব্য করুন