অল্প জায়গায় অসংখ্য লোকের বাস। তার নাম বস্তি। পলিথিন, চাটাই ও ছালা দিয়ে তৈরি শতশত ঝুপড়িতে বাস করে হাজার হাজার মানুষ। ঈদের আগেই বস্তিটি উচ্ছেদ করা হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দাঙ্গা পুলিশের চৌকস বাহিনী শুরু করবে উচ্ছেদ অভিযান। বস্তি উচ্ছেদের পদ্ধতি জানে অভিজ্ঞ পুলিশ বাহিনী। ঘুম থেকে উঠেই বস্তিবাসীরা দেখবে লাঠি হাতে দাঁড়ানো মারমুখী পুলিশ। হাঁড়ি পাতিল, কাঁথা-বালিশ গুটিয়ে পালাতে থাকবে দলে দলে। আগে নোটিশ দিলে বিপদের সম্ভাবনা। পার্শবর্তী রাস্তায় পার্ক করা ঠেলা গাড়ি ও রিক্সা ভ্যানের নিচে শায়িত পরিবারগুলো দিয়েই শুরু হবে অভিযান। তাড়া খাওয়ার সাথে সাথেই এরা দৌড়াবে। গুছিয়ে নেয়ার মত কিছুই নেই তাদের।
অতি উৎসাহী এক পুলিশ টার্গেট করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটাকে। দামি বিদেশী কম্বলে ঢাকা লোকটার শরীর। ঘাড়ের নিচে দামি মখমল কাপড়ের বড় একটা বালিশ। বস্তিবাসীদের শোয়ার জন্য বালিশ লাগে না। দশ ইঞ্চি একটি ইট হলেই চলে। ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডারের সাথে সাথে হুইসেল বাজিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। হাতের লাঠি দিয়ে গুঁতা মারে টার্গেট করা লোকটার মাথায় সেই পুলিশ।
– এই ব্যাটা, উঠ।
শোয়া থেকে উঠে দামি হাত ঘড়িতে সময় দেখে লোকটা। তারপর চোখ তুলে তাকায় পাশে দাঁড়ানো পুলিশের দিকে।
মানুষ চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয় পুলিশের। এতো ঠেলাগাড়ির নিচে ঘুমানোর মানুষ নয়। রহস্যময় লোকটাকে চেনা দরকার পুলিশের।
‘মধু কুঞ্জের’ মালিক বাবুল চৌধুরী সারা জীবন দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন আর পাঁচ আঙুলে ঘি খেয়েছেন। টাকার ওপর শুয়েছেন কিন্তু শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি। তিনি এখন ঘুম খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ছেলে মেয়েরা শুধু বড় হয়েছে। মানুষ হয়নি একটাও। দিন রাত শুধু খায় আর গায়। ‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও দাও আর ফুর্তি কর।’
অবাধ্য স্ত্রী ক্লাব, পার্টি আর ফাংশন নিয়ে ব্যস্ত। রাত বারটা-একটায় ঘরে ফিরে। সকাল দশটা-এগারটা পর্যন্ত ঘুমায়। ঠিক ঘুম বলা যায় না। বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা। ঘুম ভাঙার পর ডাইনিং রুমে একত্রিত হয় সবাই। মহামিলনের সময় শুরু হয় মহাযুদ্ধ।
– এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?
– সে কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে নাকি ?
– আমাকে দিবে নাতো কাকে দিবে? আই এম ইউর হাজবেন্ড।
– হাজবেন্ড হয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ ?
– তবে কি আমার মাথা বেচে দিয়েছি ?
– তোমার আবার মাথা আছে নাকি? ওটাতো একটা জুনা নারকেল।
ছেলেমেয়েরা ও একেক জন লড়াকু সৈনিক।
– এই কান্তা, ঐ অসভ্য কিসলুর সাথে কোথায় গিয়েছিলি?
– তুমি আবার খুব সভ্য নাকি? তুমি কোথায় কোথায় আড্ডা মার, তা কি আমি জানি না?
– চুপ থাক, আর কোন দিন দেখলে ঠ্যাং ভেঙে লুলা করে রাখব।
– হয়েছে, তোমাকে আর গার্জিয়ানগিরি দেখাতে হবে না। ‘চালনি সুচকে বলে, তোমার পিছনে ছেঁদা’।

কথা কাটাকাটি কখনো মাথা ফাটাফাটিতে গড়ায়। কিন্তু উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল পেরিয়ে মধু কুঞ্জের বাইরে যায় না।
স্ত্রী-সন্তান, বাড়ি-ঘর কোন কিছুর প্রতি এখন আকর্ষণ নেই বাবুল চৌধুরীর। দোতালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে অপলক চেয়ে থাকেন ঐ বস্তির দিকে।
নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ঐ বস্তির মানুষগুলো। রাতের নিদ্রা দিনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ও ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দেয়। কঠোর পরিশ্রম ও দুঃখ কষ্ট মোকাবেলার শক্তি নিয়ে ভোর আসে তাদের জীবনে প্রতিদিন। আল্লাহর কথা এরাই মেনে চলেছে, “আমি দিন দিয়েছি রোজগারের জন্য, রাত দিয়েছি প্রশান্তির জন্য।”
সারারাত বিছানায় এপাশ ও পাশ করে বাবুল চৌধুরী। সিডাকসিন ও ভ্যালিয়াম এখন অকার্যকর। সকালের দিকে সামান্য তন্দ্রা আসে কিন্তু প্রশান্তি আসে না। বস্তি ও অভিজাত এলাকার মাঝখানে বায়তুল আমান মসজিদ। দুই এলাকার অসম বাসিন্দাদের একমাত্র সেতুবন্ধ। দুই এলাকার কিছু লোক নামাজের সময় এখানে মিলিত হয়। জুমার নামাজের সময় বেশি লোক সমাগম হয়। দামি দামি গাড়ি বহরে ভরে যায় সামনের মাঠ। ফটকের সামনের বসে ভিক্ষুকের লম্বা লাইন। দোতালার কার্নিশে দাঁড়ালে এসব দৃশ্য চোখে পড়ে বাবুল চৌধুরীর। সি.ডি. প্লেয়ারে এবা, ভনিয়াম, মাইকেল জ্যাকসনের পপ সঙ্গীত ও মিউজিকের তালে তালে যুগল নৃত্য এখন আর ভাল লাগে না। কিছুদিন আগে হাছন রাজা আর লালনগীতির কয়টি ক্যাসেট কিনে এনেছিলেন। কানের কাছে প্লেয়ার রেখে খুব নিচু সাউন্ডে শোনেছেন কয়টি গান,
খাঁচার ভিতন অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পাড়লে মনোভেরি দিতাম পাখির পায়,
কেমনে আসে যায়?
সারারাত ঘুমহীন কাটানোর পর মনে হলো পৃথিবীতে আরো সুর আছে, যে সুরের সাথে এতদিন তার পরিচয় ছিল না। মুয়াজ্জিনের আজানের সুর কতো মধুর হতে পারে যারা ফজরের আজান শোনেনি তারা কখনো বুঝবে না। বিবাহের পর প্রথম রাতে স্ত্রীর ধাক্কায় ঘুম ভেঙেছিল বাবুল চৌধুরীর।
– ওঠ, আজান হচ্ছে।
– তাতো রোজই হয়, কিয়ামত পর্যন্ত হবে। তার জন্য ঘুম নষ্ট করতে হবে নাকি? ছোটকালে স্কুলে কবিতা পড়েছিল-
কে মোরে শোনালে ঐ সুমধুর আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কবিতায় শুধু শব্দ ছিল, কোন সুর ছিল না। তাই তখন প্রাণ আকুল হয়নি, ধমনীও নাচেনি। ‘আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম। হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ।’ ঘুম থেকে নামাজ উত্তম। এসো নামাজের দিকে, এসো কল্যাণের পথে।
নামাজের দিকে যাত্রার এই আহবানে কি সত্যিই কোনো কল্যাণ আছে, একটু পরখ করে দেখতে চায় বাবুল চৌধুরী। অট্টালিকা ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মসজিদের দিকে। চাইনিজ রেস্তোরাঁর মত ডিম লাইটের আলোতে কিছু মানুষ নির্বাক পাথরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে এক মহা শক্তির সামনে। সেহেরি খেয়ে মসজিদে এসেছে তারা। ফজর পড়ে আবার একটু ঘুমাবে।
অন্যান্য নামাজিদের অনুকরণে বহু কষ্টে দু’রাকাত নামাজ পড়ে। অনভ্যস্ত শরীর নিয়ে হাঁটুর ওপর ভর করে বসা কষ্টকর হলে ও রুকু-সিজদা ভালই লেগেছে। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় গেটের সামনে আসতেই শুনতে পায় সুরেলা কণ্ঠ। নতুন গান, নতুন সুর। ভিক্ষুকটি কোন সঙ্গীত শিক্ষালয় থেকে আয়ত্ত করেছে এই সুর-ছন্দ?
কত পয়সা কত খানে অকারণে চলে যায়,
গরিব জনে দান করিলে আখেরাতে পাওয়া যায়,
বাড়ি বাড়ি করলে ভাই, এই বাড়িতো তোমার না,
কবর হইবে আসল বাড়ি ভাইবা কেন দেখ না,
বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সার দেমাগে মন ভরে না,
দুই চক্ষু বুজিয়া গেলে কবর হইবে ঠিকানা।

কে এই গানের রচিয়তা ও সুরকার? বাবুল চৌধুরীকে লক্ষ্য করেই কি লেখা এই গান? গানের শেষ আবেদনটি ভিক্ষুকের একান্ত নিজস্ব।
দানকারীদের পিতা-মাতা সুখে রাইখো কবরে
নূরের তাজ পরাইয়া উঠাইও রোজ হাসরে।
দিয়া যান ভাই দিয়া যান। জাকাত- ফেতরা – জানের সদগা-দিয়া জান। রোজার মাস বড়ই ফজিলত মাস। বাবুল চৌধুরী বাড়ির পথে না যেয়ে হাঁটতে থাকে উল্টা পথে বস্তির দিকে। খোলা আকাশের নিচে ছালার চট ও কাঁথা মুড়ি দেয়া লোকগুলো গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে একে একে। রমজানের শেষ দশক রোজগারের মৌসুম। ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয়ের সুযোগ কুলি, মজুর, রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুক ও খুদে ব্যবসায়ীদের। বস্তির পাশে দেখার মত কিছু নেই। তবু অবাক হয়ে সব দেখে বাবুল চৌধুরী। মাটির ওপর শুয়ে আছে একটি শিশু। মাথার নিচে কোন বালিশ নেই। শরীর থেকে কিছু হলুদ পদার্থ নির্গত হয়ে চটচটে হয়ে আছে। তার ওপর ভনভন করছে কয়টা মাছি।
যে দৃশ্য কল্পনা করলেও বমি আসার কথা, তা মনোযোগ দিয়ে দেখে। শিশুদের এমনিতেই সুন্দর দেখায়, ঘুমন্ত শিশুরা আরো সুন্দর ও মায়াবী। নিজের ছেলেমেয়েরা যখন এই বয়সের ছিল, তখন আদর সোহাগ করার সুযোগ হয়নি। দিন কেটেছে ব্যবসার কাজে, রাত কেটেছে পার্টি-ফাংশনে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে আয়া-বুয়াদের কোলে। এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে আদর- যত্নের। বাবা মরলে সম্পত্তি কিভাবে ভাগ বাটোয়ারা করবে সে চিন্তায় আছে ছেলে মেয়েরা। সিনেমার ভালো গানও কোন ভালো চিন্তা জাগায়নি কারো মনে। মায়ের মত আপন কেহ নাইরে দুনিয়ায়। মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না?
কান্নার গান শোনে হাসে, মৃত্যুর গান শোনে নাচে চৌধুরী পরিবার।
কী চমৎকার চোখ ধাঁধানো গুলিস্তান আর নবাবপুর।
দম ফুরাইলে যাইতে হবে একলা আজিমপুর।
সব কিছুতেই শুধু আমোদ-ফুর্তি।

রাস্তার শেষ মাথায় বস্তির কোণে একটি চায়ের দোকান। লম্বা তক্তা দিয়ে তৈরি বেঞ্চ। চুলার ওপর বিরাট লোহার কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে ছোট ছোট ডাইলপুড়ি। ডাইলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভেতরে দেয়া হয় আলু ভর্তা। নড়বড়ে বেঞ্চের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসতেই অন্যান্য খরিদদার অবাক হয়ে তাকায় নতুন এই মানুষটির দিকে।
বাবুল চৌধুরী অর্ডার দেয়-
– এদিকে চারটা পুড়ি দাও।
পুরান টিনের থালায় ৪টা পুড়ি ও কিছু টমেটুর সালাদ দিয়ে যায় একটি বাচ্চা ছেলে। খেয়ে একটা এক শ’ টাকার নোট এগিয়ে দেয় হোটেল মালিকের দিকে।
– এই সকাল বেলা এত বড় নোটের ভাঙতি পামু কই।
– রেখে দাও, পরে খেয়ে শোধ করে নেব।
– আপনের কাছেই রাহেন স্যার। ভাঙতি অইলে পরে দিয়েন।
– আমার কাছে পরেও কখনো ভাঙতি হবে না। ভাঙতির কারবার নাই আমার। সব জায়গায় চেক পেমেন্ট করি।
নোট হাতে নিয়ে দোকানদার কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে। লোকটা চলে যাওয়ার পর নোটটা ক্যাশ বাক্সে রেখে দেয়।
ঘরে ঢুকে দেখে স্ত্রী এখনো ঘুমাচ্ছে। মুখ থেকে লালা বের হয়ে লেপ্টে আছে বালিশ। চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান মেরে বিছানা থেকে তুলে দেয়ালের দিকে ধাক্কা মারে। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে কিছুক্ষণ হতভঙ্গের মত দাঁড়িয়ে থাকে মিসেস চৌধুরী। ঘুমের ঘোর কাটতেই ফুঁসে উঠে প্রচন্ড আক্রোশে।
– এমন জানোয়ারের মত করছ কেন ? ভূতে পাইছে নাকি?
– জানোয়ারের দেখছটা কী? লাত্থির আগে তাড়াতাড়ি গোছল করে ভদ্র মহিলার মত রান্নাঘরে যাও। পায়জামা পাঞ্জাবিটা ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে রেখ। জুমার নামাজ পড়তে যাবো।
আজীবন তোষামোদে অভ্যস্ত স্বামীর কণ্ঠে আজ আদেশের সুর। স্ত্রী আর কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পারে, আদেশ আদেশই। না মানলে খবর আছে।
মসজিদ মাদরাসা আলেম ওলামাদের প্রতি বাবুল চৌধুরী সব সময়ই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন। ধর্মদ্রোহী নাস্তিক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা ছিলেন প্রভাবিত। এরা সাম্প্রদায়িক, ফতোয়াবাজ, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, নাস্তিক, উন্নয়ন ও প্রগতির দুশমন। নজরুলের কবিতা পড়েও তিনি নেতিবাচক দিকটাই করায়ত্ত করেছেন :
হায়রে ভজনালয়-
তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়।

কালো আলখেল্লা ও কালো পাগড়ি পরা ইমাম সাহেবকে অন্যরকম মনে হয়। হাতের লাঠিটাও যেন বীরত্বের প্রতীক। দোয়া দরুদের ফজিলত, প্রতি অক্ষরে দশ নেকির হিসাব, নেকির ওজন ইত্যাদি কোন বয়ান নেই ইমামের খুতবায়। খুতবার সাবজেক্ট স্কুলে পড়া একটি বাণী, জরপয ধৎব হড়ঃ ধষধিুং যধঢ়ঢ়ু.
রোম সম্রাট সুরক্ষিত অট্টালিকায় সোনার পালঙ্কে শুয়ে ও কেন ঘুমাতে পারে নাই? খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর (রা) খেজুর গাছের ছায়ায় তলোয়ার ঘাড়ের নিচে দিয়ে কিভাবে প্রশান্তিতে ঘুমিয়েছেন? এসব ইতিহাসের সাথে কিছু বাস্তব উদাহরণ দেন তিনি। ছিন্নমূল মানুষ মাঘ মাসের শীতে ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে কিভাবে ঘুমায়? শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ধনকুবেরদের কেন সিডাকসিন, ভ্যালিয়াম খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হয়?
আরো বাস্তব উদাহরণ। মসজিদে বসে ইমামের খুতবার সময় কারা ঘুমায়? দুশ্চিন্তা আর টেনশনে যারা বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না, মসজিদে এসে কিছু সময়ের জন্য তারা টেনশন ফ্রি হন। তাই ঘুম আসে। শোনে বাবুল চৌধুরী একটু গা ঝেড়ে বসে। ইমাম সাহেব কি কথাটি তাকেই বলছে?
মসজিদের গেটের এত ভিক্ষুক কেন? এটাও চিন্তার বিষয়। পকেটে টাকা নিয়ে কি মানুষ শুধু মসজিদে আসে? শিল্পকলা একাডেমি, স্টেডিয়াম গেট, নাট্যমঞ্চ, মিনাবাজার গেটে এরা বসতে পারে না? সেখানেতো শুধু টাকাওয়ালারাই যাতায়াত করে। হলে যেয়ে বহু সিনেমা দেখেছে বাবুল চৌধুরী। হিন্দি সিনেমায় অন্ধ ভিক্ষারির গান শোনে চোখের পানিও ফেলেছে :
ও বাবু, জানে ওয়ালে বাবু, একি পয়সা দে দে।
সিনেমার গান শোনে কেউ ভিক্ষুক দরদি হয়নি। বাবুল চৌধুরী ও কাউকে পয়সা দেয়নি।
মসজিদ গেটে দাঁড়ালে কিছু না কিছু পায় ভিক্ষুকরা। এখানে এলে কঠিন হৃদয় বিগলিত হয়, দয়া মায়া সৃষ্টি হয়। আর কেউ না জানলেও জানে ঐ ভিক্ষুকের দল। দয়া মায়া আরো বৃদ্ধি ও মন গলানোর জন্য কিছু সুর ও গানের জন্ম দেয় :
– দিয়া যান ভাই, দিয়া যান। দান করলে মান বাড়ে। কামাই রোজগারে বরকত অয়। দিয়া ধন, বুইঝা মন, কইড়া নিতে কতক্ষণ?
অসংখ্য ভিক্ষুকদলের ভিতর থেকে একজন ভিক্ষুককে বাছাই করে বাবুল চৌধুরী। তাকে ফজরের নামাজের সময়ও দেখেছিল। হাত ইশারায় তাকে গেট থেকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে যায়।
– তোমার আজ আর ভিক্ষা করার দরকার নাই। এক হাজার টাকা নিয়ে যাও, ডাটে ঈদ কর। আর আমার জন্য স্পেশালি দোয়া কইরো।
– আল্লায় আফনেরে লাখ টাকার মালিক বানাক, কামাই রোজগারে বরকত দেক, বাপ মারে বেহেস্ত নছিব করুক।
– আরে বেকুফ, এসব দোয়া নয়। আমি এমনিই হাজার কোটি টাকার মালিক। কামাই রোজগারের বরকতে অস্থির।
– আফনে কী চান?
– আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।
– বুঝেছি আফনের মাথার স্ক্রু ডিলা অইছে। আমি অহন যাই।
– আরে বেকুফ, স্ক্রু সারা জীবন ডিলা ছিল। আজ টাইট দেয়া শুরু করছি। সকাল বেলা ওয়াইফরে একটু টাইট দিয়েছি। এখন পোলা মাইয়াগুলোরে যেয়ে টাইট দিমু।
ঈদের আগের কয়টি দিন বাড়িতে শুয়ে বয়ে কাটায় ছেলে মেয়েরা। বড় ছেলের ঘরে সি.ডি বাজছে। ঈদ আনন্দের রিহার্সাল চলছে :
দুনিয়াকা মজা লেলো দুনিয়া তুমারি হায়,
আজি দুনিয়া তুমারি হায়।
দরজায় এক লাথি মেরে ভিতরে ঢুকে আর এক লাথি মেরে সি.ডি. প্লেয়ার টেবিল থেকে মেঝেতে ফেলে দেয়।
– এই সব বাদরামি এ বাড়িতে আর চলবে না, শান্ত সুবোধ ছেলের মত থাকতে পারলে থাক, তা না হলে রাস্তা মাপ।
সকালে মায়ের ওপর যে আদেশ জারি হয়েছে, তার খবর ইতোমধ্যেই ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে গেছে, সবাই টের পেয়েছে, বাবুল চৌধুরী আজ পুরুষ হয়েছে।

রাতে সবাই সুবোধ ভদ্র মানুষের মত ঘুমাতে যায়। ঘুম না এলেও ঘুমের বান করে। চৌধুরী সাহেব দোতালার রেলিং ধরে তাকিয়ে থাকেন বস্তির দিকে। বস্তিবাসীরা এখন ঘুমাতে যাচ্ছে। সারারাত নাক ডেকে ঘুমাবে টেনশন ফ্রি মানুষগুলো। যাকে বলে সাউন্ড স্লিপ।
একটি বালিশ ও একটি কম্বল বগলদাবা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বাবুল চৌধুরী। তার এখন একটু ঘুমের প্রয়োজন। রোম সম্্রাটের প্রাসাদের মত তার মধুকুঞ্জে ঘুম ঢুকার কোন দরজা নেই। গেটের কাছে যেয়ে একটু থমকে দাঁড়ায়। কিছু ঘুমের সাপ্লাই আছে সিঁড়ির গোড়ায়। ঘুম সিঁড়ি টপকাতে পারে না। আব্দুল, চম্পা ও ভুলু কুকুরটা ঘুমাচ্ছে নিজ নিজ জায়গায়।
বস্তির পাশে খোলা আকাশের নিচে ঘুমন্ত লোকগুলো থেকে একটু দূরে একটি কম্বল বিছিয়ে ও একটি গায়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে বাবুল চৌধুরী। শীতল বাতাস আর গরম কম্বলের সংস্পর্শে রাজ্যের ঘুম ছেয়ে ফেলে তাকে। একটানা দীর্ঘ ঘুমের পর পুলিশের লাঠির গুঁতা খেয়ে কম্বল সরিয়ে চোখ মেলে তাকায়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চিনতে পেরে এগিয়ে আসেন।
– স্যার আপনি এখানে?
– আমার একটু ঘুমের দরকার ছিল। তাই এখানে। আপনারা এখানে কেন ?
– পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য যৌথবাহিনী এসেছে বস্তি উচ্ছেদ করতে।
– এখানকার পরিবেশ খুবই ভালো। দারুণ এক ঘুম দিয়েছি।
– এই বস্তির পক্ষে কথা বলার জন্যই কি আপনি এই অ্যাটেম্ট নিয়েছেন ?
– আমি শান্তির পক্ষে। “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” নীতিতে বিশ্বাসী। এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর রাতে ঘুমানোর দরকার। এদের আর কিছু চাওয়ার নেই। ঈদের আগের কয়টা দিন কি সময় দেয়া যায় না? ঈদ তো তাদের জন্যই। বিকল্প ব্যবস্থা না করে এদের ঘুম নষ্ট করবেন না।
– আপনার কথা শুনে আমারও ঘুম পাচ্ছে। আসলে আমারও ঘুমের ক্রাইসিস চলছে।
– তবে দেরি কেন? ডাবল কম্বল আছে। আমার পাশেই শুয়ে পড়–ন। বুঝবেন ঘুম কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী?

Share.

মন্তব্য করুন