স্বননের মহাকাশ ভ্রমণ
৪০২০ সাল।
স্বননের মনটা বড্ড খারাপ। বিজ্ঞানে এ+ না পাওয়ায় মা বকুনি দিয়েছে ওকে। ও রাতে বিছানা থেকে চুপি চুপি উঠে ছাদে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আকাশের দিকে পলকহীন দৃষ্টে তাকিয়ে তারা দেখছে। আচ্ছা, আকাশে কতগুলো তারা আছে? এক লাখ, দুই লাখ, এক কোটি…? গুণে কি শেষ করা যাবে? ও দেখে একটি তারা জ্বলজ্বল দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওরও বুঝি আমার মতো মন খারাপ! আমার চোখের মতো ওরও চোখ অশ্রুতে জ্বলজ্বল করছে?
পরক্ষণেই স্বননের ভুল ভাঙে। আরে কি ভাবছি আমি! ওটা তো মঙ্গল গ্রহ। ওই যে উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি আবছা পথের মতো দেখা যাচ্ছে ওটার নাম হলো ছায়াপথ। স্বনন বিজ্ঞান বইতে এসব পড়েছে; তাই দেখা মাত্রই সব চিনতে পারে। কোনটি ধ্রুবতারা, কোনটি সপ্তর্ষিম-সবই ও চেনে; অথচ আম্মু শুধু শুধু বকে ওকে – ‘গাধা নয়, গর্দভ তুই।’ আচ্ছা, গাধা আর গর্দভের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে? দুটো তো একই প্রাণীর নাম; কিন্তু আম্মু গাধা না বলে গর্দভ বলে ক্যানো আমাকে? বিজ্ঞানে এ+ না পাওয়ায় এত বকাঝকা! বার্ষিক পরীক্ষায় দেখিয়ে দেবে। আজ রাত ছাদেই কাটিয়ে দেবে। ভূতের ভয়ের কথাও মনে হয় ওর। কিন্তু স্বনন বিজ্ঞানের ছাত্র। ও জানে পৃথিবীতে ভূত বলতে কিছু নেই।
হঠাৎ ও লক্ষ্য করল ছাদের পশ্চিম পাশে তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে ‘সাঁৎ’ করে কি যেন নামল। ও দু’হাতে চোখ রগরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকায়। দেখে- একটি সসার ল্যান্ড করছে। গোলাকৃতি এ যানটি থেকে একটি প্রাণী নামছে। প্রাণীটি মানুষের মতো হেঁটে কাছে আসতেই স্বনন দেখল- মানুষ আর বাদুড়ের চেহারার সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক জীব- অনেকটা কার্টুনের ব্যাটসম্যানের মতো। ও বুঝল এটা অন্য গ্রহের জীব অর্থাৎ এলিয়েন।
এলিয়েন স্বননের কাছে এসে বলল, কেমন আছো স্বনন? তোমার মন খুব খারাপ বুঝি?

আরে! ও দেখি আমার নামও জানে; আমার মন খারাপ তাও জানে। ও অন্তর্যামী নাকি? স্বনন শুনেছে এলিয়েনরা খুব উন্নত এবং বুদ্ধিমান প্রাণী। টেলিপ্যাথি ক্ষমতা আছে ওদের।
– কী ভাবছো স্বনন? তুমি কি আমাদের সাথে ভ্রমণে যাবে?
স্বননের মহাবিশ্ব ভ্রমণের অনেক দিনের শখ। মনে হয় এ কথাটাও ওরা জানে। তাই নীরবতা ভেঙে কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে বলে, আগে তোমার পরিচয় দাও? তারপর কোথায় নিয়ে যাবে বলো?
– আমার নাম বনবন। M-7 গ্রহে থাকি; সেখানে তোমাকে নিয়ে যাবো আমি।
– কতদূর এ গ্রহ?
– তোমাদের সৌরজগৎ থেকে আরো ৬টি সৌরজগৎ পাড়ি দিয়ে আমাদের গ্রহে যেতে হয়।
– এত দূর! এ তো এক শ’ বছরের মতো লাগবে।
– তা ঠিক। তোমাদের পৃথিবীর নভোযানে গেলে এক শ’ বছরের মতো লাগবে; তবে তোমরা এখনো আমাদের গ্রহে যাবার জন্য এমন কোনো নভোযান তৈরি করতে পারো নি। আমরা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তোমাকে নিয়ে যেতে পারব।
– ওখানে নিয়ে গিয়ে তুমি আমাকে কী কী দেখাবে?
– ওখানে তোমাকে অদ্ভুত সব জিনিস দেখাব। অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায় তোমাকে ভ্রমণ করাবো।
– বলো কী! সত্যি?
– আগে চলই না আমাদের সাথে।
স্বননের মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। আম্মুর কাছে ও বোকা গর্দভ। এলিয়েনের দেশে থেকে সব কিছু শিখে ও বিজ্ঞানী হয়ে ফিরবে।
– চলো তাহলে। বনবন স্বননকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সসারের ভিতর বসায়। ওরা ওঠা মাত্রই সসার বিদ্যুৎগতিতে চলতে থাকে। চোখের পলকে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সসারটি।

M-7 গ্রহে এসে সসারটি থামে। কয়েক শ’ আলোকবর্ষে পথ পেরিয়ে এসেছে সসারটি, কিন্তু সময় লেগেছে মাত্র এক ঘণ্টা দশ মিনিট। বনবন স্বননের হাত ধরে নামাতে নামাতে বলে, তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে?
– খুব পায়নি; তবে…
– তুমি কি খাবে?
– একটু জুস দিতে পারো।
– এখানে তো পৃথিবীর কোনো খাদ্য পাওয়া যায় না। আর আমরা তো কোনো তরল বা কঠিন খাবার খাই না। আমরা শুধু বায়বীয় খাবার খাই।
– সেটা আবার কেমন?
– আলো, বাতাস এগুলো খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি।
– বলো কী!
– হ্যাঁ, এর অনেক সুবিধে; এতে শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বেশি হয়। আবার সময়েরও অপচয় হয় না।
– মানে?
– মানে তোমাদের মতো আমরা প্রস্রাব-পায়খানা করি না।
স্বনন অবাক নয়নে বনবনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে ভেবে পায় না। বনবন ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, কোনো অসুবিধা নেই। এ গ্রহে তুমি আমাদের খাদ্য খেয়েই বেঁচে থাকতে পারবে। এসো তোমাকে কিছুটা পেট ভরে খাবার খাইয়ে মনটা প্রফুল্ল করে দেই। বলে ও স্বননকে সাথে করে নিয়ে একটি রুমে ঢুকে পড়ে। রুমটি বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। কিছু যন্ত্র থেকে টিমটিম করে আলো জ্বলছে; আর কিছু যন্ত্র থেকে শনশন করে মৃদু-মন্দ হাওয়া বেরুচ্ছে। বনবন বলে, তুমি হালকা খাবে নাকি ভারী খাবার খাবে?
স্বনন বলে, হালকা।
যেখানটায় টিমটিম করে আলো জ্বলছিল বনবন সেখানে গিয়ে ছোট একটি টর্চলাইটের মতো যন্ত্র নিয়ে এসে স্বননের পেটে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর যন্ত্রটি সরিয়ে নিয়ে বলে, এখন কি খিদে অনুভূত হচ্ছে?
স্বনন ঘাড় নেড়ে না-বোধক জবাব দেয়।
– এখন বলো তুমি আগে কোথায় যাবে; অতীত না ভবিষ্যতে?
– সে দেশ কোথায়?
-আমাদের পাশের সৌরজগতের গ্রহ P-21-এ তোমাদের পৃথিবীতে অতীতের সব মানুষজনকে দেখতে পাবে। যেমন তোমার মৃত আত্মীয়-স্বজন- দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রমুখ পূর্বপুরুষকে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গকেও দেখতে পাবে; যেমন- সম্রাট আকবর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ।
স্বনন অবাক কণ্ঠে বলে, তাই নাকি! আর ভবিষ্যতে?
– আমাদের সৌরজগতের তিন সৌরজগৎ পরে F-71গ্রহে আছে তোমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যতের মানুষজন। মনে করো তোমার বা তোমাদের পরিবারে ভবিষ্যতে কে কে আসবে অর্থাৎ এখানে তুমি তোমার উত্তর-পুরুষদের দেখতে পাবে। স্বনন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে বনবনের কথায়। তাহলে চলো আমরা আগে অতীতের গ্রহে যাবার জন্য প্রস্তুত হই। বনবন স্বননকে নিয়ে একটি ধবধবে সাদা যান্ত্রিক পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। স্বনন রূপকথার গল্পে এমন ঘোড়ার ছবি দেখেছে কিন্তু বাস্তবে এমন একটি সুন্দর পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে ও চড়বে তা কল্পনায়ও আসেনি। পক্ষীরাজ ঘোড়াটি বাতাসের গতিতে ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে চলছে। গ্রহ-নক্ষত্রের আলো ঝলমল করছে চারিদিকে। সামনে অসীম শূন্যতা। পক্ষীরাজ চলছে তো চলছেই।

অতীত গ্রহে পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে থামল পাহাড়ি এক ঝর্ণার কাছে। ঘোড়াটি ঝর্ণার পানিতে মুখ স্পর্শ করতেই একরাশ পানি বাষ্প হয়ে ঘোড়ার মুখের সামনে গোলাকৃতি ধারণ করে স্থির হয়ে রইল। পক্ষীরাজ তার যান্ত্রিক মুখ থেকে নলের মতো জিহ্বা বের করে তা শুষে নিলো। স্বনন ঘোড়া থেকে নেমে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কেমন ফুটফুটে জোছনা রাতের মতো স্নিগ্ধ রোদ্দুর। আকাশটা সোনালি রঙের। চারিদিকে সোনালি বর্ণের সব গাছপালা। ফুল-ফলের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ওখান থেকে সুমিষ্ট গন্ধ ভেসে এসে নাকে লাগছে।
বনবন বলল, তুমি কাদের আগে দেখতে চাও?
– আমার দাদা-দাদি পূর্বপুরুষদের।
– বেশ, তাহলে চলো।
বনবন স্বননকে সাথে করে পায়ে হেঁটে বন, পাহাড়, ঝর্ণা পার হয়ে একটি লোকালয়ে এসে পৌঁছাল। সেখানে বিশাল বিশাল সব ঘর-বাড়ি। বাড়ির সামনে দিয়ে কলকল রবে নদী বয়ে গেছে। নদীর দু’ধারে বাগান, বাগানে সব সোনালি বর্ণের গাছপালা। বনবন স্বননকে নিয়ে নদীর ধারে একটি বাগানের গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। বলল, একটু পরেই তোমার আত্মীয়-স্বজন এখানে গোসল করতে আসবে। তার আগে আমরা একটু জিরিয়ে নিই। গাছের সুন্দর সুন্দর ফল দেখে স্বননের খুব খেতে ইচ্ছে করছিল। ফল খাওয়ার কথা বনবনকে বলতেই ও বলল, আমরা এ ফল পেড়ে খেতে পারব না। এ ফল আমাদের ধরা দেবে না।
– ক্যানো? স্বনন একটু অবাক হলো।
– দ্যাখোই না।
স্বনন হাত দিয়ে আঙুরের মতো গোলাকার ফলগুলো ছুঁতেই ফলসহ ডালগুলো উপরের দিকে উঠে গেল। স্বনন ফিরে আসতেই ডালগুলো আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এলো। স্বনন যতবারই ফলগুলো পাড়তে গেল ততবারই ডালপালাগুলো একই রকম ব্যবহার করতে লাগল। ও বনবনের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল, এমন হচ্ছে ক্যানো?
– এ ফল শুধু এখানকার বাসিন্দারাই পেড়ে খেতে পারে। কারণ এ ফলগুলো খেয়েই ওরা জীবন ধারণ করে। তাই ওরা ছাড়া অন্য কেউ এ ফল পাড়তে পারে না।
– তাহলে কী খাবো? খিদেয় তো পেট চোঁ-চোঁ করছে।
– ওরা নিজহাতে পেড়ে খেতে দিলে তুমি এ ফল খেতে পারবে। আর আমিও এখন এ ফল খেতে পারব।
– ক্যানো, তুমি তো আলো বাতাস খাও?
– না, যে গ্রহের যে নিয়ম। এ গ্রহের ফল-মূল সবার খাদ্য। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রুচি পরিবর্তন হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে ওরা লক্ষ্য করলÑ কয়েকজন মানুষ ওদের দিকে আসছে। মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সবাই একই বয়সের; ৩০ কি ৩৩ বছরের মতো সবার বয়স হবে। বনবন ওদেরকে হাত ইশারা করে থামিয়ে দিলো। আপনাদের উত্তর-পুরুষ আপনাদের সাথে দেখা করবে।
– কে সে? একজন জিজ্ঞেস করল।
– ওর নাম স্বনন। দেখেন চিনতে পারেন কিনা।
স্বনন দাঁড়িয়ে সকলকে সালাম দিলো। কিন্তু কেউ ওকে চিনতে পারল না।
স্বনন বলল, আমার বাবার নাম আশরাফুল হোসেন, দাদার নাম মোয়াজ্জেম হোসেন, পরদাদার নাম…। হঠাৎ ওদের মধ্য থেকে একজন স্বননকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল, তুই আমার আশরাফের ছেলে- আমার নাতি। পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠল, ও আমার নাতি আশরাফের ছেলে? স্বননের দাদা জবাব দিলো, হ্যাঁ বাবা। স্বনন দেখল- তার দাদা যাকে বাবা বলছে তার বয়সও তার দাদার সমান। এটা কী করে সম্ভব! স্বনন কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না; বলল, দাদু তোমরা সবাই একই বয়সী ক্যানো?
দাদু বলল, এখানে কারো বয়স বাড়ে না। এখানে কোনো রাত-দিন নেই; অর্থাৎ অতীত ভবিষ্যৎ নেই, সবই বর্তমান কাল।
স্বনন অবাক হয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বননকে নিশ্চুপ দেখে দাদু বলে, দাদিমাদের দেখবি না?
– হ্যাঁ, ওনারা কোথায়?
– ওই বাগানে লুকোচুরি খেলছে।
– ওনাদের কাজ-কর্ম, রান্না-বান্না নেই?
– না। আমরা তো ফল-মুল খেয়ে বেঁচে থাকি। আর এসব গাছের ফল অফুরন্ত, কখনো শেষ হয় না।
– আমার তো খুব খিদে পেয়েছে।
– আরে আগে বলবি তো? বলে দাদু একটি গাছের দিকে হাত বাড়াতেই গাছের ফলসুদ্ধ ডালগুলো এসে দাদুর হাতে ধরা দিলো। দাদু অনেকগুলো ফল পেড়ে স্বননের হাতে দিলো। স্বনন তা থেকে কয়েকটি ফল বনবনকে দিলো। স্বনন আঙুরের মতো ফলগুলো মুখে দিতেই গলে রস হয়ে পেটের ভিতর চলে গেল। কী শীতল আর সুমিষ্ট ফল! স্বননের প্রাণটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। দাদু বলল, চল এবার তোর দাদিদের সাথে দেখা করবি।
স্বনন বলল, না দাদু, আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। পরে একদিন এসে দেখা করব।
– কোথায়?
– দাদু, আমরা এখন সম্রাট আকবর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এসব গুণীজনকে দেখতে যাবো।
– এ তো এ গ্রহের প্রায় শেষ প্রান্তে, যেতে অনেক সময় লাগবে।
– হ্যাঁ, তাই একটু আগেভাগেই রওনা দেই।
স্বনন দাদু ও তার পূর্বপুরুষদের কদমবুসি করে বিদায় নিলো।

বনবন আর স্বনন আরবি তাজি ঘোড়ার মতো একটি সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। চড়া মাত্রই ঘোড়াটি উল্কাবেগে ছুটে চলল। কিছুক্ষণ পর ওরা একটি উদ্যানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। উদ্যানটি বিভিন্ন পয়েন্টে ভাগ করা। একেক পয়েন্টে কয়েকজন করে লোক বসে বসে বিভিন্ন খেলা খেলছে। ওরা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল- সম্রাট আকবর আর নবাব সিরাজউদ্দৌলা দু’জন বসে দাবা খেলছে। অন্য পাশের গোল পয়েন্টে কবি নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ বসে লুডু খেলছে। স্বনন উৎফুল্ল হয়ে দৌড়ে ওদের কাছে যেতে চাইল; কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই বৈদ্যুতিক শকের মতো অদৃশ্য কোনো শক্তির সাথে শক খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। স্বনন আস্তে আস্তে বিরস বদনে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল পাশে দাঁড়িয়ে বনবন মৃদু হাসছে। বনবনের হাসিতে স্বনন একটু রেগে গেল। বলল, আমি ব্যথা পেলাম আর তুমি হাসছো?
বনবন বলল, তুমি তো আমার কাছে কিছু না শুনেই দৌড় দিলে। যদি শুনে যেতে তবে এমন ব্যথা পেতে না।
– মানে?
– মানে হলো ওদের কাছে তুমি যেতে পারবে না; ওরা তোমার আত্মীয় নয়। তা ছাড়া ওরা ভি.আই.পি লোক, ওদের সাথে সবাই দেখা করতে পারে না।
– কথাও বলতে পারব না?
– না।
– তবে…?
– ওরা কি করছে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সব দেখতে পারবে।
– কি আর করা! তাহলে তাই হোক।

স্বনন ও বনবন অদূরে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখতে লাগল। প্রথমে ওরা সম্রাট আকবর আর নবাব সিরাজউদ্দৌলার দাবা খেলা দেখতে লাগল। দেখল ওরা দাবার গুঁটিগুলো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া না করে মুখ দিয়ে গুঁটিগুলো চালনা করছে। অর্থাৎ ওরা মুখ দিয়ে গুঁটিগুলোকে যে আদেশ দিচ্ছে গুঁটিগুলো বাধ্যসৈন্যের মতো তা পালন করছে। স্বনন মুগ্ধ হয়ে ওদের খেলা দেখতে লাগল। ও আরো দেখল- গুঁটিগুলো খাওয়ার সময় হাত দিয়ে ইশারা করতেই একগুঁটি আরেক গুঁটিকে ভেঙে ফেলছে। ও হঠাৎ খেয়াল করল- উভয়ের দাবার গুঁটিতে ‘রাজা’ নেই। এমন সময় আকবর হাত দিয়ে ইশারা করতেই তার দাবার গুঁটিগুলো সিরাজের চারপাশে ঘিরে ধরল। এরপর দু’জনেই আসন থেকে উঠে দাঁড়াল। স্বনন বুঝতে পারল এবার খেলা শেষ হয়ে গেল।
এবার স্বনন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লুডু খেলা দেখতে অদূরে দাঁড়াল। ও শুনতে পেল রবীন্দ্রনাথ বলছে-
ছয় পড় ছয়
হোক এবার জয়।
বলার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ছক্কা পড়ল। রবি ঠাকুরের গুঁটি দ্রুত বেগে এগিয়ে যেতে লাগল। নজরুল বুঝি এবার হেরেই যায়। নজরুল বেগতিক দেখে বলল-
খা গুঁটি খা
খেয়ে এগিয়ে যা।
এবার নজরুলের গুঁটি রবীন্দ্রনাথের গুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রবি ঠাকুর দেখল তার গুঁটি একে একে খেয়ে শেষ করে ফেলছে নজরুলের গুঁটি। তাই সে প্রাণপণে বলল-
ওর গুঁটি ধর
না হলে মর।
এবার নজরুলের গুঁটি অন্য দিকে সরে গেল। এভাবে দুই কবি ছড়া কেটে আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমে লুডু খেলতে লাগল। স্বনন ওদের খেলা দেখে বলল এ খেলা শেষ হবার নয়, চলো এবার ফিরে যাওয়া যাক।
বনবন বলল, তাহলে চলো এবার ভবিষ্যৎ গ্রহ F-71-এ দিকে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হই।

F-71 গ্রহে যাবার জন্য বনবন স্বননকে নিয়ে একটি অত্যাধুনিক সুপারসনিক নভোযানে চড়ে বসল। যানটি আলোর তৈরি; আলোর গতিতেই এটি চলে। নভোযানে ওঠা মাত্রই ওটি ছুটে চলল আলোর গতিবেগে। কিছুক্ষণ পর দেখল একটি তামাটে গ্রহে ওরা চলে এসেছে। এখানে কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। নদী-নালাও তেমন একটা নেই। তবে রাস্তাগুলো বেশ সুন্দর চকচকে, প্রশস্ত। এসব রাস্তায় কিছু গাড়ি চলছে বিদ্যুৎগতিতে। তবে আকাশ পথেই বেশি যান চলাচল করছে। কিছুদূর এগোতেই স্বননের চোখে পড়ল কতকগুলো গভীর খাদ। এগুলো কি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে? স্বনন বনবনকে জিজ্ঞেস করল।
বনবন বলল, না। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে অতি বেগুনি রশ্মির ফলে। এ গ্রহের জীবগুলো অনেক উন্নত কিন্তু নগর সভ্যতার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এখানে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ এত বেশি যে ধীরে ধীরে ওজোন স্তরে বহু ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এখানে ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।
– তাহলে তো এখানে বেশিক্ষণ থাকা ক্ষতির কারণ হতে পারে।
– তা ঠিক। তাহলে দেরি না করে এক্ষনি তোমার উত্তর-পুরুষের খোঁজে যাওয়া যাক।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে উত্তর পুরুষের খোঁজে পথ চলতে লাগল। প্রচ- গরম। পথে দু’-একটা খেজুর আর নারকেল গাছ ছাড়া কোনো গাছ চোখে পড়ল না ওদের। স্বননের পানি পিপাসা পাচ্ছিল। ও একটি ডাবগাছ দেখে তার নিচে বসে পড়ল। কিন্তু গাছের দিকে চেয়ে দেখল কোথাও কোনো ডাব নেই। বনবন স্বননের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, এখানকার গাছে কোনো ফল হয় না। আর এদের খাদ্যও ফল নয়। এরা শুধু ট্যাবলেট খেয়ে জীবন ধারণ করে। এরা পিপাসা মেটানোর জন্য একটি এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য দুটি ট্যাবলেট খায়।
– তাহলে তো আমাদেরও তাই খেতে হবে। কিন্তু এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে?
– ওই সামনের দোকানেই আমরা পেয়ে যাবো।
– ঠিক আছে।
ওরা কিছুদূর গিয়ে একটি দোকানে একটি শিশু বসে আছে। ওর কাছে থেকে দু’জন দুটি ট্যাবলেট কিনে খেয়ে পিপাসা মেটাল। স্বনন পকেটে হাত দিয়ে দোকানদারকে টাকা দিতে চাইল কিন্তু শিশু দোকানদার টাকা নিলো না।
শিশু দোকানদার বলল, এখানে সব কিছুই ফ্রি, কোনোরূপ বেচাকেনা হয় না।
দোকান থেকে বিদায় নিয়ে যেতে যেতে স্বনন বনবনকে বলল, আচ্ছা, দোকানে কোনো বড় মানুষ নেই ক্যানো?
– এখানে কোনো বড় মানুষ নেই। সবাই শিশুর মতো দেখতে কিন্তু এদের বয়স অনেক। এরা জরা ও মৃত্যুকে জয় করেছে ঠিকই কিন্তু এদের উচ্চতা কমে গেছে।
– তাহলে আমাদের উত্তর-পুরুষদেরও তো বয়স অনেক।
– হাঁ, তবে ওদের পুনর্জন্মের জন্য পৃথিবীতে শূন্য বয়স অর্থাৎ শিশুর বয়স দিয়ে পাঠানো হয়।
ওরা কথা বলতে বলতে একটা শিশুপার্কের মতো জায়গায় এসে দাঁড়াল। ওখানে একই বয়সের সব শিশু খেলাধুলা করছে। স্বনন ওদের দেখে বলল, এখানেই বুঝি আমার উত্তর-পুরুষ আছে?
– হ্যাঁ।
– এদের চিনব কী করে?
– এদের চিহ্নিত করা কঠিন।
– তাহলে উপায়? ওদের সাথে কি আমি কথা বলতে পারব না?
– কিভাবে পারবে? তুমি কিংবা ওরা কেউ তো কাউকে চিনো না। তবে একটা উপায় আছে, তোমার চেহারার সাথে যে শিশুগুলোর চেহারার মিল আছে- তারাই তোমার উত্তর-পুরুষ হতে পারে।
– এত শিশুর মধ্যে ওদের বাছাই করা কিভাবে সম্ভব?
– তা ঠিক। কিন্তু উপায় একটা বের করতে হবে। বনবন দ্রুত গতিতে চিন্তা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর উৎফুল্ল হয়ে বলে, পেয়েছি!
– কী পেলে?
– তুমি তোমার বংশধরদের ভবিষ্যতে যে যে নাম রাখবে সেগুলোর মোটামুটি একটা তালিকা তৈরি করে ফেলো।
– কী রকম?
– যেমন তোমার ছেলেমেয়ের নাম কী হবে, নাতি-নাতনির নাম কী হবে? ইত্যাদি…।
স্বনন পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে তাড়াতাড়ি আট-দশটা নাম লিখে ফেলে। বনবনকে লিস্টটি দেখিয়ে বলে, এই দু’জন আমার ছেলে-মেয়ে; আর বাকিগুলো ওদের ছেলেমেয়ে অর্থাৎ আমার নাতি-নাতনি।
– এখন তুমি ওই সব নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাক দাও।
স্বনন প্রথমে পিন্টু আর রূপা বলে জোরে ডাক ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলেশিশু ও একটি মেয়েশিশু স্বননের পাশে এসে দাঁড়াল। বনবন বলল, ওরা দু’জন তোমার ভবিষ্যৎ ছেলেমেয়ে হবে। তবে তুমি যত ছেলেমেয়ের নাম লিখবে ততই এখানে এসে জড়ো হবে। এবার বাকিগুলোর নাম ধরে ওদের ডাকতে বলো।
ওরা তিতাস, কাজল, সজল, সোহাগ এবং মিকা, বাতুল, তুলি, রিফা, বলে চিৎকার দিয়ে ডাক ছাড়ল। এবার চারজন ছেলেশিশু ও চারজন মেয়েশিশু পিন্টু আর রূপার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
বনবন বলল, এরা হবে পিন্টু, রূপার ছেলেমেয়ে অর্থাৎ তোমার নাতি-নাতনি। এভাবে তুমি যত উত্তর-পুরুষদের ডাকবে তত শিশুরা এখানে এসে জড়ো হবে।
স্বনন ওদের দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ও সকলের মাথায় হাত বুলিয়ে ওদের বিদায় দিলো। বনবনের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো এবার ফেরা যাক।

এবার বাড়ি অর্থাৎ পৃথিবীতে ফেরার পালা। স্বনন বনবনের সাথে সেই সসারে উঠে বসল। সসার পূর্বের মতো বিদ্যুৎগতিতে পৃথিবীর পথে চলতে লাগল। চারিদিকে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র পার হয়ে অসীম শূন্যতার পথে চলছে সসার। চলছে তো চলছেই। প্রথমে স্বননের ভালো লাগলেও হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এতক্ষণ মহাকাশে আলো থাকলেও ক্রমশ অমাবস্যা রাতের মতো গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছে। স্বনন কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বনবনকে জিজ্ঞেস করল, এত অন্ধকার ক্যানো; কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না?
বনবন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ল। কোনো জবাব দিলো না। বনবনের নীরবতায় স্বননের মনে এক অজানা আশঙ্কা জমাট বেঁধে উঠল। স্বনন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, কী হলো কথা বলছো না ক্যানো?
বনবন ভারী গলায় বলল, আমাদের সসারটি ভুলক্রমে কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
– বলো কী!
স্বনন বিজ্ঞান বইতে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে পড়েছিল। এটা ভয়ঙ্কর এক জায়গা। এর কোনো কূলকিনারা নেই; একবার ঢুকলে বেরনো মুশকিল। স্বনন মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগল।
সসার চলছে তো চলছেই। নিরেট কালো অন্ধকার পথের যেন শেষ নেই। হঠাৎ স্বননের কানে এক অদ্ভুত ধরনের চিৎকারের শব্দ কানে এলো। মনে হলো আশপাশে কোথাও কেউ ভয়ানক বিপদে পড়ে চিৎকার করছে।
স্বনন ভয়ার্ত কণ্ঠে বনবনকে জিজ্ঞেস করল, ওসব কিসের শব্দ?
বনবন বলল, তোমাদের ধর্মগ্রন্থে দোজখ বা নরক বলে যে স্থানের উল্লেখ আছে; আমরা বোধ হয় তার আশপাশে দিয়ে যাচ্ছি।
– তার মানে?
– তার মানে হলো ওখানে তোমাদের পৃথিবীর পাপী মানুষদের রাখা হয়েছে। তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে; মনে হচ্ছে ওই আর্তচিৎকার ওদেরই।
– ওরা কোথায়?
– হয় তো এই কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেই কোথাও আছে; তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
– ক্যানো?
– কৃষ্ণগহ্বর এক বিশাল অন্ধকার জায়গা; এর রহস্য যেমন তোমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখনও ভেদ করতে পারেনি, তেমনি আমরাও উদ্ঘাটন করতে পারিনি। মহাবিশ্বের রহস্যের কাছে বিজ্ঞানীরা এখনো অসহায়।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চারিদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বনবন বলল, আমরা বুঝি কৃষ্ণগহ্বর থেকে মুক্ত হলাম।
স্বনন আল্লাহর নামে শুকরিয়া আদায় করে বলল, আল্লাহ আমাদের বিশাল মুসিবত থেকে বাঁচালেন। আমরা পৃথিবীতে আর কতক্ষণের মধ্যে পৌঁছব?
– এই তো আর কয়েক মিনিট লাগবে।
কথা বলতে বলতে স্বনন হঠাৎ লক্ষ্য করল সসারটি একটি ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে ল্যান্ড করছে।
বনবন বলল, এসো আমরা এসে গেছি।
স্বনন সসার থেকে নেমে চারিদিকে ভালো করে দেখে নিলো- কেমন অচেনা অচেনা লাগছে। বনবনকে বলল, এ কোথায় নিয়ে এলে?
– ক্যানো তোমাদের বাড়িতে।
– না ভুল করে অন্য কোথাও নিয়ে এসেছো?
– না অন্য কোথাও নয়, তোমাদের বাড়িতেই নিয়ে এসেছি। ভেতরে গিয়ে দ্যাখো।
– আমাদের বাড়ি তো একতলা ছিল।
– আগে দ্যাখোই না। তাহলে চলি বন্ধু! বনবন স্বননের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সসারে উঠে পড়ল।

২.
জার্নি টু বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

-জ্যামাইকাতে তো বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাছ দিয়ে যেতে হয়, তাই না?
– হ্যাঁ, কিন্তু হঠাৎ এ কথা ক্যানো? স্বননের কথায় কম্পিউটার মনিটর থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলল সহপাঠী জনসন।
– ওখানে একটা সেমিনার আছে। নাসার তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বোধ হয় আমাকেই যেতে হবে।
– তাই নাকি! আর কে কে যাচ্ছে?
– তোমার নামও আছে।
– বলো কি! আগে বলো নি ক্যানো?
– এইমাত্র সার্চ করে সিওর হলাম।
– আমি কি তোমার মতো এত ট্যালেন্ট? তুমি এত অল্প বয়সে যে নাম করেছো- তোমার মতো হতে হলে আমার আরো এক যুগ লাগবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো তুমিই সেরা।
– না, আরো একজন আছে।
– কে সে?
– সেলিম শাহরিয়র।
– হ্যাঁ, ওনাকেও চিনি। উনি তো আমাদের অগ্রজ।
– এখন আসল কথায় আসি। আগামী মঙ্গলবার আমাদের রওনা হতে হবে জ্যামাইকার উদ্দেশে।
– কয়টার ফ্লাইট?
– দাঁড়াও, ভালো করে সার্চ দিয়ে দেখে নিই। সিজান আবার কম্পিউটারে মনোযোগী হয়।
স্বননের পুরো নাম অবিক আশরাফ স্বনন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ মেধাবী বিজ্ঞানী। বাবা-মা দু’জনেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর খানেক পূর্বে ওরা আমেরিকাতে আসেন। স্বননের বয়স তখন ১১ বছর। আর বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।
স্বনন মনিটর থেকে মুখ তুলে বলে, হ্যাঁ, আগামী মঙ্গলবার রাত দশটার ফ্লাইটে আমরা জ্যামাইকার উদ্দেশে যাত্রা করছি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমরা কালকের মধ্যেই সংগ্রহ করে নেবো।
– বুঝলাম সব কিন্তু ওখানে সেমিনারটা কিসের ওপর?
– বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য উদ্ঘাটনের সম্পর্কে।
– ও তো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার! অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী এর রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন, অনেক লেখক এ সম্পর্কে অনেক বইও লিখেছেন, কিন্তু এর রহস্য তিমিরেই রয়ে গেছে।
– দ্যাখো, পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আজ যা অসম্ভব দুদিন পরেই তা সম্ভব। এক সময় চাঁদে যাওয়া অসম্ভব ছিল, এখন তা সম্ভব হয়েছে। এই সেমিনারের পরই তোমার বা আমার পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম নির্ধারণ হবে।
– এ ব্যাপারে আমি তো তোমার চেয়ে অনেক অজ্ঞ।
– এত ভয় পাচ্ছ ক্যানো ফ্রেন্ড!
– না, ঠিক তা নয়…। চলো এখন উঠি, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ওপর আরো কিছু বই কিনতে হবে।
– হ্যাঁ চলো, সব গুছিয়ে নিই গে।

DC-13 বিমানটি নিউইয়র্ক থেকে রাত দশটা পাঁচ মিনিটে জ্যামাইকার উদ্দেশে ফ্লাই করল। বিমানটি তেমন বড় নয়। যাত্রী আছে মোট ৭১ জন। জানালার গ্লাসের ভিতর দিয়ে বাইরে চোখ রাখল স্বনন। আলো ঝলমল নিউইয়র্ক শহরটি চোখের পলকে নাই হয়ে গেছে। বাইরে অসীম শূন্যতা। মেঘমুক্ত নীলাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। হঠাৎ দূরে একটা অভিনব আলোকচ্ছটা দেখে স্বনন পাশে বসা জনসনকে উদ্দেশ্য করে বলল- জন, দ্যাখো! দ্যাখো! কী সুন্দর একটা আলোর কু-লী! কোনো উত্তর না পেয়ে স্বনন জনের মুখের দিকে তাকাল; দেখলো- ও ঘুমে বিভোর। এত অল্প সময়েই ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেটা? স্বনন বিরস বদনে পুনরায় জানালার দিকে চোখ ফেরালো। নিঃসীম রাতের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে DC-13 দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। স্বনন লক্ষ্য করল লোকালয়গুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, কোথাও লোকালয়ের কোনো আলো চোখে পড়ছে না। নিচের দিকে ভালো করে নজর দিয়ে দেখল- নিচে বিশাল কালো জলরাশি। ও বুঝতে পারল আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ওরা ছুটে চলছে।
DC-13 চলছে তো চলছেই। কোনো কূলকিনারা নেই। স্বননের ঘুম চলে আসছিল। পাশে বসা জনসন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে বিদ্যুৎচ্ছটা চোখে পড়তেই চমকে উঠল ও। দেখলো- সাগরের পর ঘন কালো মেঘ থেকে উজ্জ্বল কয়েকটা সাদা আলোকচ্ছটা ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। আলোগুলো নিভে যাওয়ার পর পরই কেমন গুমোট অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক। একটু পরেই স্পিকারে ভেসে এলো- সাইক্লোন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আপনারা সকলেই সতর্ক থাকুন। কেউ বেল্ট খুলবেন না।

DC-13 উড়ে চলছে পূর্বের মতোই। স্বনন বুঝতে পারল হয়ত বারমুডার কাছ দিয়ে যাচ্ছে বিমানটি। ও জনসনকে জাগাল। বলল, দ্যাখ তো কোথা দিয়ে যাচ্ছি আমরা?
ঘুমকাতুরে জনসন চোখ রগরাতে রগরাতে বলল, পৌঁছে গেছি নাকি?
– দূর! বিপদের আশঙ্কা টের পাচ্ছি।
– কি বলিস ফ্রেন্ড! জনসনের মুখ মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে গেল।
– দেখছ না প্লেন কেমন চক্কর খাচ্ছে। বলার সঙ্গে সঙ্গে DC-13 একটা মোচড় দিয়ে নিচ থেকে উপরে উঠে গেল। জনসনের দেহটা ছুটে এসে স্বননের গায়ের ওপর পড়ল। জোড়হাতে সকল যাত্রী বেল্ট ও সিট আঁকড়ে ধরে পড়ে রইল। বার বার চক্কর খেতে খেতে DC-13 ক্রমশ নিচের দিকে ধাবিত হতে লাগল। জনসন গলায় ঝুলানো ক্রস চিহ্নটা বার বার বুকে ও কপালে ছোঁয়াতে লাগল। ও মুখ শুকনো করে স্বননের দিকে ফ্যাল-ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। স্বননও মনে মনে দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলো। এমন বিপদের মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এক অজানা আকর্ষণে বিমানটি ক্রমশই নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যাত্রীদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল। অনেকেরই বেল্ট ছিঁড়ে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ প্রচ- গতিতে এক যাত্রী ছুটে এসে স্বননের গায়ের পর পড়ল। স্বনন বুঝতে পারল আর রক্ষা নেই। এবার DC-13 বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অতল গহ্বরে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাবে, সকল যাত্রীর সলিল সমাধি হবে। স্বননের বুকটা দুরু দুরু কেঁপে উঠল। এমন সময় হাউমাউ করে কান্নার শব্দ ভেসে আসল কানে। দেখল দূরে ছিটকে পড়া জনসন কাকে যেন জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। হঠাৎ প্রচ- এক ঝাঁকুনি দিয়ে উচ্ছলিত জলরাশির মধ্যে DC-13 আটলান্টিকের অতল তলে তলিয়ে গেল। স্বনন আর কিছু দেখার সুযোগ পেল না।

স্বনন যখন চোখ মেলে তাকাল; দেখলো-একটি বরফযুক্ত সবুজ ভূমিতে পড়ে আছে। এখানে সে এলো কিভাবে? প্লেনের আর সব মানুষজনই বা গেল কোথায়? সবাই মরে গেছে, নাকি হারিয়ে গেছে? সে কি এ দ্বীপে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছেছে? স্বনন আর কিছু মনে করতে পারল না।
আস্তে আস্তে উঠে বসল স্বনন। উপরের দিকে তাকাল- আকাশে মেঘ নেই কিন্তু সূর্যটা আবছা আলো দিচ্ছে। ঘাসের পর বরফ পড়ে থাকলেও তেমন শীত লাগছে না। উঠে দাঁড়িয়ে কোথাও যাবার পরিকল্পনা করল ও। কিন্তু কোথায় যাবে ও? চারিদিকে তো অবারিত সবুজ। তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে দেখল। নাহ্! কোথাও বসতি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে দূরে কোথাও ঘন অরণ্যের মতো মনে হলো ওর কাছে। ওখানে হয় তো মানুষজন থাকতে পারে। অনেক দ্বীপেই তো মানুষজন থাকে। দেখা যাক কী আছে কপালে?

স্বনন জোর কদমে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে সত্যি একটা বড় অরণ্যের কাছে এসে পৌঁছল। অরণ্যটি তেমন গহিন নয়। সারি সারি লম্বা সব গাছপালা। ফাঁকা জায়গাগুলোতে লতানো কিছু গাছও রয়েছে। হঠাৎ ও লক্ষ্য করল একদল হাতি দল বেঁধে কোথাও যেন যাচ্ছে। এত বড় হাতি এর আগে কখনো দেখেনি। পৃথিবীর কোনো বন-জঙ্গলে এত বিশাল আকৃতির হাতি আছে বলে মনে হয় না। ওদের দেখে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘ম্যামথ’-এর কথা মনে পড়ে গেল স্বননের। হাতির দল ওর সামনে দিয়ে চলে গেলে স্বনন বনের ভেতর ঢুকে পড়ল। প্রচ- ক্ষুধা পেয়েছে ওর। কোথাও যদি ফল-মূল পাওয়া যায়! ও খাবারের সন্ধানে হাঁটতে লাগল। যেতে যেতে পথের একপাশে দেখল-কতগুলো কলাগাছ খ- খ- অবস্থায় পড়ে আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু কাঁচা-পাকা কলার ছড়া। ও তাড়াতাড়ি কয়েকটা পাকাকলা কুড়িয়ে নিলো। একপাশে ঘাসের ওপর বসে গো-গ্রাসে কয়েকটা কলা খেয়ে নিলো।
হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে স্বনন চমকে উঠে দাঁড়াল। শব্দটি চেনা চেনা মনে হচ্ছে; কিন্তু মনে করতে পারল না। কিছুক্ষণ পরেই ও দেখতে পেল- একটি বড় ডাইনোসর আর একটি ছোট ডাইনোসরকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। ও কি স্বপ্ন দেখছে? গায়ে চিমটি কাটল। পৃথিবীতে তো এখন ডাইনোসর নেই! ডাইনোসরেরা তো বাস করত সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে! এদের এখন শুধু গল্পে-সিনেমায় দেখা যায়Ñ বাস্তবে নয়। তাহলে সে কোথায় এসে পৌঁছেছে? পৃথিবীর কোনো ভূখ-না অন্য কোথাও? স্বনন চিন্তায় পড়ে গেল। ডাইনোসরেরা চলে যাওয়ার পর স্বনন কিছুটা ভীতুপদে এগোতে লাগল। তাহলে কি এটি পৃথিবীর কোনো দ্বীপ নয়? সে কি তবে অন্য কোনো গ্রহে এসে পৌঁছেছে? অন্য কোনো গ্রহ হলে পৃথিবীর জীবজন্তু এখানে থাকবে ক্যানো? জীবজন্তু থাকলে তো মানুষেরও দেখা পাবার কথা? কিন্তু কোথায় তারা?
স্বনন হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা একটি মাঠের মতো জায়গায় এসে পৌঁছাল। তাহলে এটাই বনের শেষ প্রান্ত। ওই তো একটি মসজিদের গম্বুজের মতো মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই ওখানে মানুষের বসতি আছে। স্বনন মসজিদের দিকে দ্রুত পা বাড়াল।

স্বনন কাছে এসে দেখলÑ না এটা কোনো মসজিদ নয়। পৃথিবীর ঘরবাড়ি বা কোনো স্থাপনার সাথে এর কোনোরূপ মিল নেই। স্থাপনাটি ইট-পাথরের তৈরিও নয়। দেখে মনে হচ্ছে সীসা বা সিলভার দিয়ে তৈরি। আকৃতিও ভিন্ন রকমের- অনেকটা নভো থিয়াটারের মতো। স্বনন দরজার সামনে দাঁড়াতেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে দরজার পাল্লা ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। ও ভেতরে ঢুকতেই পাল্লাটি আবার বের হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল।
ভেতরে ঢুকে স্বনন বিস্মিত হয়ে গেল। অদ্ভুত কারুকার্যে স্থাপনাটি তৈরি। এমন স্থাপত্যশৈলী পৃথিবীর কোথাও নেই। সব কিছুই কেমন ঝলমলে আলোকময়Ñ যেন প্রতিটি বস্তু থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্বনন বিশাল হল রুমটি ঘুরে ঘুরে যতই দেখতে লাগল ততই সে মুগ্ধ হতে লাগল। কিন্তু কোথাও মানুষজন নেই ক্যানো? কিভাবে ডাকবে ওদের? এরা কি পৃথিবীর মানুষ না কি অন্য কেউ? ওরা কি ওর ভাষা বুঝবে? নাকি এখানে কেউ নেই? ও এক স্বপ্নের জগতে ঘুরপাক খেতে লাগল।
স্বনন ঘুরতে ঘুরতে একটি আসনে বসে পড়ল। আসনে বসে ও চিন্তা করতে লাগল- যেহেতু এখানে বসার ব্যবস্থা রয়েছে সুতরাং মানুষজন থাকার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু কথা না বললে কিংবা শব্দ না করলে ওরা ওর উপস্থিতি টের পাবে কী করে? স্বনন উচ্চস্বরে একটা গান ধরল-
হায় রে কপাল মন্দ
চোখ থাকিতে অন্ধ
এ জীবন জ্বইলা পুইড়া শেষ তো হলো না…।
গান শেষ হতে না হতেই রুমের মধ্যে অদ্ভুত একটা শব্দ হলো। একটা ধোঁয়ার কু-লীর মতো বস্তু এসে স্বননের কয়েক গজ সামনে পড়ল। আস্তে আস্তে সে ধোঁয়ার কু-লী মূর্ত হতে লাগল। স্বনন আলাদিনের চেরাগের গল্প পড়েছে। সিনেমা-নাটকেও দেখেছে। চেরাগ থেকে এ রকম ধোঁয়ার কু-লী পাকিয়ে দৈত্য বেরিয়ে আসে। ও কিছুটা ভড়কে গেল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষণ পর স্বনন চোখ খুলে দেখল-ধোঁয়ার কু-লীটা আর কিছু নয়- একটা গোলাকার চাকতির মতো যান বা সসারের ধোঁয়া। তবে এ ধোঁয়া পৃথিবীর ধোঁয়ার মতো নয়, কোনো এক প্রকারের গ্যাস হবে হয় তো।

সসার থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে স্বননের দিকে এগোতে লাগল। ওকে মানুষ বললে ভুল হবে, দু’পাওয়ালা অদ্ভুত জীব বলাই ভালো। লম্বা ছিপছিপে দেহ। দুটো হাত ও দুটো পা রয়েছে জীবটির। মানুষ এবং বাদুড়ের চেহারার সংমিশ্রণ রয়েছে মুখে। সেখানে মাত্র তিনটে ছিদ্র রয়েছে। স্বননের মনে হলো ওই ছিদ্রগুলোই চোখ ও নাক-মুখের কাজ করে। অদ্ভুত জীবটি কাছে এসে ওর কানে ও মুখে হেডফোনের মতো একটি ছোট্ট যন্ত্র লাগিয়ে দিলো। এর পর লম্বা আঙুল তুলে কথা বলতে ইশারা করল।
স্বনন বলল, তুমি কে?
অদ্ভুত জীবটি জবাব দিলো, আমার নাম বনবন। আমাকে চিনতে পারোনি স্বনন?
– হ্যাঁ, নামটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
– ছোটবেলায় তোমাকে একবার আমি আমাদের গ্রহে ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়ছে। তুমি ভালো আছো তো বনবন?
– হ্যাঁ। তোমাকে ওখানে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম যদিও চেহারার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
– এটা কোন জায়গা?
– এটা ‘প্যারালাল ইউনিভার্সাল’- যা তোমাদের পৃথিবীরই মিরর ইমেজ।
– সেটা আবার কী?
– তুমি বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মধ্য দিয়ে এখানে ঢুকে পড়েছো। এর আগে অনেকেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ঢুকেছে কিন্তু অধিকাংশই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। সবার আসার ক্ষমতাও এখানে থাকে না। তবে যাদের জীবনীশক্তি বেশি তারা এখানে টিকে যায়।
– কি বলছো এসব!
– ঠিকই বলছি। আমরা কেউ মিথ্যে কথা বলি না। আমিই তোমাকে বারমুডার সুড়ঙ্গ পথ থেকে উদ্ধার করে এখানকার দ্বীপে রেখে এসেছিলাম। আমরা তোমাদের পৃথিবী সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী।
– ক্যানো?
– বলতে পারো এটা আমাদের মহাকাশ গবেষণারই একটা অংশ। তবে বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানতে পারিনি। এ ব্যাপারে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারো।
– হ্যাঁ। স্বনন মাথা ঝাঁকাল। তবে তার আগে বলো কী হবে পৃথিবী সম্পর্কে জেনে?
– পরে বলছি। চলো। বনবন স্বননকে ওখান থেকে উঠিয়ে পাশের একটা রুমে নিয়ে গেল।

স্বনন রুমে ঢুকে আরো অবাক হয়ে গেল। দেখল বনবনের মতো আরো অনেকে কম্পিটারের মতো যন্ত্রের সামনে বসে আছে। প্রায় সারা শরীরেই ছোট ছোট যন্ত্রপাতি। মনিটরের সামনে তাকিয়ে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। বনবন বলল, ওরা সবাই মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। কোথাও আমাদের চেয়ে উন্নত বা অনুন্নত জীব আছে কি না।
– তা জেনে তোমাদের কী লাভ?
– তুমি বোকার মতো প্রশ্ন করছো ক্যানো? তুমিও তো এখন একজন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী মানেই তাদের মধ্যে থাকে সবসময় কল্যাণ চিন্তা। এখানে যাদের দেখছ তারা সবাই বড় মাপের বিজ্ঞানী। আমাদের চেয়ে যারা সভ্যতায় পিছিয়ে আছে তাদেরকে আমরা হাতে-কলমে সভ্যতা শিখিয়ে আসি। আমরা চাই মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহের জীবেরা উন্নত থেকে উন্নততর হোক।
– বুঝলাম না। আবার অজ্ঞতা প্রকাশ করে স্বনন কিছুটা লজ্জিত হলো।
– তোমাদের গ্রহেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে গিয়েছিলেন।
– ক্যানো গিয়েছিলেন?
– তোমাদের পূর্বপুরুষদের সভ্যতা শিখাতে। গ্রিক সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা এটা তো আমাদেরই অবদান।
– বলো কী!
– হ্যাঁ। পিরামিড তৈরি করার কলাকৌশল তো আমরাই শিখিয়েছি। ওই সময়ে তোমাদের পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধিমত্তা এত উন্নত ছিল না। কিভাবে মৃতদেহ সজীব রাখা যায় তার জন্য রাসায়নিক বস্তু আমরাই সরবরাহ করেছি।
– তারপর?
– এরপর গ্রিক এবং ভারতেও গিয়েছি। কিভাবে জমি চাষ করতে হয়, কিভাবে ফসল ফলাতে হয়Ñ এসব তোমাদের পৃথিবীর লোকদের শিখিয়েছি। আমাদের উন্নত প্রযুক্তি আর ক্ষমতা দেখে ওরা তো আমাদের দেবতা মনে করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা চলে আসার পর অনেকে আমাদের কল্পিত মূর্তি বানিয়ে পূজাও করেছে; হয় তো এখনও করছে।
– কী বলছ এসব!
– হ্যাঁ, মানুষের মনে যখন শিক্ষা-দীক্ষা কম থাকে তখন কুসংস্কার এবং অলৌকিকত্ব গেড়ে বসে। বিজ্ঞান যত অগ্রসর হচ্ছে কুসংস্কার-অলৌকিকত্ব তত দূর হচ্ছে।
– তা ঠিকই বলেছ তুমি।
– আর এ কারণেই আমাদের বিজ্ঞানের অসীম ক্ষমতা দেখে তখনকার পৃথিবীর মানুষেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেবতা জ্ঞানে পুজো করেছে।
– এখন তোমাদের কার্যক্রম কী?
– আমাদের কার্যক্রম তো যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছেই। অসীম এ মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে করতে মাঝে-মধ্যে তোমাদের পৃথিবীর কথাই ভুলে যাই। তবে যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’-এর গবেষণা কেন্দ্রে ট্যুরে আসি তখন পৃথিবীর কথা আমাদের মাথায় আসে। এ কারণে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে দুর্যোগে পতিত অনেককেই আমরা মাঝে-মধ্যে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।
– তোমরা আসলে কোন গ্রহের বাসিন্দা?
– মনে নেই, M-7 গ্রহের বাসিন্দা।
– এই প্যারালাল পৃথিবীটা কোন জগৎ?
– এটা যেহেতেু পৃথিবীর মধ্যেই অবস্থিত সুতরাং এটি ত্রিমাত্রিক জগতের আওতাভুক্ত। তবে আমরা মাঝে মাঝে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পিছনে ফেলে এখানকার কিছু কিছু মানুষকে আমাদের ওখানেও নিয়ে যাই।
-তার মানে তুমি তোমাদের M-7 গ্রহের কথা বলছ।
– হ্যাঁ।
– আমি এখান থেকে আবার কিভাবে পৃথিবীতে ফিরব?
– তা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজেই তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো। তার আগে তোমাদের বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বলো?

স্বনন পৃথিবী সম্পর্কে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। পৃথিবীর সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু পৃথিবীর মানুষেরা পারমাণবিক বোমার ধ্বংসাত্মক ব্যবহার, খুনোখুনি নিয়ে মেতে আছে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যে দূষণ হচ্ছে সে সম্পর্কে কি কিছু বলবে? স্বননকে চুপ থাকতে দেখে বনবন বলে ওঠে, কী ভাবছ?
– কী বলব ভেবে পাচ্ছি না?
– তোমাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলো?
– আমরা চাঁদে গিয়েছি কিন্তু এ পর্যন্ত মঙ্গলে যেতে পারিনি।
– চাঁদ! সেটা কোথায়?
– সেটি আমাদের পৃথিবীরই একটি উপগ্রহ।
হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে বনবন। চাঁদ তো একটা ছোট্ট উপগ্রহ। ওখানে এখনো আমাদের যোগাযোগ হয় তাই চিনতে পারিনি। তবে তোমাদের সৌরজগতের গ্রহ বৃহস্পতিতে গিয়েছি আমরা। ওখানে আমাদের স্বাধীন চিন্তার রোবট জাতি রয়েছে।
– আমরা পৃথিবীবাসীরা কি ভবিষ্যতে তোমাদের মতো উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণী হতে পারব?
– ক্যানো পারবে না?
– তোমাদের মতো সময় জ্ঞান, ন্যায়-নিষ্ঠতা, কর্মদক্ষতা এগুলোর তো চরম অভাব- আমাদের মধ্যে।
– তা ঠিক। এগুলো তোমাদের আগে কাটিয়ে তুলতে হবে। এগুলো ছাড়াও তোমাদের মধ্যে আরো বড় সমস্যা আছে।
– কী?
– তোমরা খাবারের জন্যই অধিকাংশ সময় নষ্ট করে দাও। চিন্তা বা গবেষণার সময় পাও কখন?
– তা ঠিক। খাবারের জন্য তোমরা সময় অপচয় কর না?
– না। আমরা তো বায়বীয় খাবার খাই, বায়ু আলো খেয়ে বেঁচে থাকি। সময় নষ্ট হবে কিভাবে?
– তোমাদের বংশ বৃদ্ধি হয় না?
– হয়। যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা আমাদের কোষ থেকে ক্লোনের মাধ্যমে আরেকটা জীব তৈরি করে ফেলি। দেখছ না আমাদের সকলের চেহারা সে জন্য একই ধরনের।
স্বনন বনবনের কথায় তাকাল কম্পিউটারে কর্মরত সব বিজ্ঞানীর মুখের দিকে। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর বলল, হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। তবে তোমাদের কি মৃত্যু নেই?
– আছে। তবে আমরা সব ধরনের জরা-ব্যাধিকে জয় করে দীর্ঘজীবন লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।
– তোমরা কত বছর বাঁচো?
– গড়ে পনের শ’ বছর।
– তোমরা কি মৃত্যুকে জয় করার ব্যাপারে কিছু ভাবছ?
– হ্যাঁ, এখন কোষ নিয়ে গবেষণা করছি। বৃদ্ধ কোষগুলোকে যদি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায় তবে আমরা হয়ত একদিন অমর হতে পারব। একটু থেমে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বনবন বলে অনেক কথা হলো, এবার বলো তুমি কি খাবে?
– এখানে আসার পথে কয়েকটা কলা খেয়েছিলাম। এখন প্রচ- ক্ষুধা পেয়েছে।
– তোমরা তো দিনে তিন-চার বার খাও। আমরা কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার খাই। যা হোক, তুমি কি খেতে চাও?
– আমি ভাত-মাছ খেতে চাই।
– এখানে তো ভাত পাওয়া যাবে না। তবে মাছ বা ফল-মূল তোমাকে খাওয়াতে পারব।
– আচ্ছা ফল-মূল দিলেই হবে। এবার বলো আমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিবে কখন?
– এত ব্যস্ত হচ্ছ ক্যানো? খাওয়ার পর পরই তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো। কথা শেষ করে বনবন ওর হাতের যন্ত্রটার ওপর একটা ফুঁ দিলো। কিছুক্ষণ পরে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রলিতে বিভিন্ন রকমের ফল-মূল চলে এলো।

খাওয়া শেষ করে স্বনন বলল, তোমরা কি আমাদের উন্নত প্রযুক্তি শেখাতে পৃথিবীতে আবার যাবে?
– তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে তোমাদের পৃথিবীকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে আমরা মাঝে-মধ্যে যাই। যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রযুক্তি শেখাতে ওখানে গিয়েছিল তখন পৃথিবীর মানুষ অজ্ঞ বর্বর হলেও তাদের মনটা ছিল সহজ-সরল। তাদের মধ্যে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, দলাদলি খুনোখুনি ছিল না। সত্যযুগের মানুষেরা তো সততার দিক দিয়ে দেবতার মতোই ছিল। কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছে পৃথিবী। তোমরা এখন নিজেরাই মারামারি খুনোখুনি করে মরছ। তোমাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অত্যাচার ভয়াবহ রকমের বেড়ে গেছে। যার দরুন তোমাদের সভ্যতা সুষ্ঠু ভাবে বিকশিত হতে পারছে না। সভ্যতার চরম শিখরে তোমাদের পৌঁছানোর কথা ছিল কিন্তু এ সব কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে।
– তাহলে তোমাদের যাবার ইচ্ছে নেই পৃথিবীতে?
– আপাতত নেই। এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
স্বনন উঠে দাঁড়িয়ে বনবনকে অনুসরণ করল।

স্বনন যখন চোখ মেলে তাকাল তখন দেখলÑ ও একটা ছোট্ট দ্বীপে পড়ে আছে। আরে আমি এখানে কখন পৌঁছলাম। এটি কি আগের দ্বীপেরই কোনো অংশ? চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখল ও। নাহ্, এটি কোনো নতুন দ্বীপ মনে হচ্ছে। কিন্তু বনবন আমাকে না বলেই চলে গেল? স্বনন কিভাবে এখানে এলো তা মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ও বুঝতে পারল বনবন ওকে চৈতন্যহীন করে নিয়ে এসে এখানে ফেলে চলে গেছে। ওরা পৃথিবীর মানুষের কাছে ধরা দেবে না, সবকিছুই রহস্যের মধ্যে রাখতে চায়।
স্বনন দেখল দ্বীপটিতে তেমন গাছপালা নেই। জনবসতিও থাকার কথা নয়। কিভাবে ও দেশে পৌঁছবে? সাগরের দিগন্তরেখা বরাবর তাকাল। দেখলÑ অনেক দূরে বিন্দুর মতো কিছু চোখে পড়ছে। বুঝতে পারল ওগুলো জাহাজ। মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলোÑআজ হোক কাল হোক একদিন সে দেশে ফিরতে পারবেই।
কয়েক দিন পর স্বনন জাহাজে চেপে দেশে অর্থাৎ আমেরিকায় পৌঁছে গেল। নাসায় পৌঁছা মাত্রই হৈ-চৈ পড়ে গেল চারিদিকে। সবাই জানত বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কবলে পড়ে তরুণ বিজ্ঞানী স্বননের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ওকে ফিরে পেয়ে সকলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল।

৩.
মহাজাগতিক বিপর্যয়

-হ্যালো স্বনন, শুনতে পাচ্ছিস; এই মাত্র খবর পেলাম জাপান আমেরিকায় নিউইয়র্কে নিউক্লিয়ার বোমা ফেলেছে।
– কি বলছিস মিমো! এদিকে শুনতে পেলাম রোবট বিজ্ঞানী দ্বারা তৈরীকৃত অতিপারমাণবিক বোমা চীন নিক্ষেপ করেছে পাকিস্তানে। তোরা বাংলাদেশে ভালো আছিস তো?
– বলতে পারছি না। সারা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ আর যুদ্ধ! এর মধ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ থাকে কি করে? আমরা BSAC (Bangladesh Space And Aeronautics Centre) বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছি কী করে বাংলাদেশের সব সাধারণ জনগণকে বাইরের গ্রহে স্থানান্তর করা যায়।
– শোনো বন্ধু, সৌরজগতের প্রায় সব গ্রহই তো আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান দখল নিয়ে নিয়েছে। সব গ্রহেই ওদের লোকজন আছে। ওসব গ্রহও নিরাপদ নয়।
– ঠিক বলেছো। তাই আমরা খুঁজছি সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহ; যেখানে আমরা সবাই নিরাপদে থাকব।
– পেয়েছ কি?
– ১৫.৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে একটি গ্যালাক্সিতে রোবট বিজ্ঞানীদের পাঠিয়েছি। ওরা সংবাদ পাঠিয়েছে মানুষের বসবাস উপযোগী দু-একটি গ্রহ পাওয়া যেতে পারে। একটু থেমে তরুণ বিজ্ঞানী মিমো বলল, তোর মঙ্গলের অবস্থা কেমন?
– মঙ্গলেও অমঙ্গল দেখা দিয়েছে। এখানেও মানুষজন ভালো অবস্থায় নেই। প্রথমে মঙ্গলে উপনিবেশ গেড়ে ছিল ব্রিটিশরা কিন্তু এখন ওদের তেমন প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই। এখন ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখানে বেশি। ইরান চাইছে এখানে মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে কিন্তু রাশিয়ার অভিবাসীরা এতে ভেটো প্রদান করেছে; কারণ মঙ্গলে রাশিয়ার রোবট সৈন্য ও বিজ্ঞানী উভয়ই বেশি।
– তাহলে তো ওখানেও যুদ্ধ লাগার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
– হ্যাঁ। বৃহস্পতির খবর জানিস?
– আমাদের বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানী ওখানে ছিল। ওর কাছে শুনেছি বৃহস্পতি রোবট জাতি দখল করে নিয়েছে। ওখানে পৃথিবীতে যত মানুষ ছিল প্রায় সবাইকে তারা মেরে ফেলেছে; অনেকেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে।
– তাহলে বৃহস্পতিতে এখন কোনো মানুষ নেই।
– না।
– এখন পৃথিবীর মানুষদের উপায় কী?
– উপায় একটা বের করতেই হবে। মানুষকে এ মহাজগতে টিকে থাকতে হলে সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে হবে।
– সেই চেষ্টাই তো করে যাচ্ছি।
– এই মুহূর্তে যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়?
– যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন অনেক বিপর্যয় ঘটেছে। প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়Ñ মহামানব নোয়া মহাপ্লাবন থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেছিলেন বিশাল নৌকা তৈরি করে।
– কিভাবে?
– পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য তিনি একজোড়া করে প্রতিটি প্রাণীর প্রজাতিকে তার নৌকায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। আমরাও মানবজাতিকে রক্ষার জন্য পৃথিবীতেই এমন বন্দোবস্তের চেষ্টা করছি।
– কেমন?
– বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ভারত মহাসাগরের তলদেশে মানুষের জন্য আবাস তৈরি করার কাজ শুরু করা হয়েছে। আমেরিকাও ইতোমধ্যে আটলান্টিকের তলদেশে উপনিবেশ তৈরি করে বসতি স্থাপন শুরু করে দিয়েছে।
– বাঁচলাম! স্বনন একটি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরপর দুজনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে BSAC -এর তরুণ বিজ্ঞানী মিমোসা মিমো। অবিক আশরাফ স্বনন ওর বন্ধু। দুজন একই সঙ্গে কাজ করত নাসায়। মিমো দেশের টানে নিজ বাসভূমে ফিরে এসেছে। স্বনন বর্তমানে মঙ্গলের একটি ব্যুরো অফিসে প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছে। মঙ্গলে বিশ্বের প্রধান দশটি দেশের উপনিবেশ আছে; তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। মঙ্গলকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলে প্রথমে রাশিয়া। এ জন্য ওখানে রাশিয়ার জনবলই বেশি। বর্তমানে মানুষ ও রোবট জাতি সমপর্যায়ের রয়েছে। মঙ্গলে এখন কর্তৃত্ব নিয়ে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব চলছে- রাশিয়া, আমেরিকা, ইরান ও রোবটদের মধ্যে। মহাজাগতিক শক্তির দিক দিয়ে কারো চেয়ে কেউ কম যায় না।
ইরান চাচ্ছে মঙ্গলে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে। এ জন্য তারা রোবট জনগণকেও ইসলামি দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু রোবট জনগণ তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ওদিকে আমেরিকাও তাদের খ্রিস্টান বানানোর প্রলোভন দেখিয়েছে। কিন্তু এটাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আর রাশিয়া চাচ্ছে সর্বজনীন একটা জাতি গড়তে। কিন্তু রোবটরা কাউকে বিশ্বাস করছে না। মানুষের ন্যায়-নীতির প্রতি ওদের বিশ্বাস বা আস্থা উঠে গেছে।
রোবটরা মানুষের অধীনতা মানতে নারাজ। তারা স্বাধীন বৃহস্পতির মতো এখানেও স্বাধীন ‘রোবট ল্যান্ড’ গড়ে তুলতে চাচ্ছে। বৃহস্পতিতে মানুষের বসবাসযোগ্য করে তুলতে এবং মহাকাশ গবেষণার জন্য পৃথিবীর মানুষেরা প্রথমে স্বাধীন চিন্তার রোবট বিজ্ঞানী TRI -কে প্রেরণ করেছিল। ওর সঙ্গে কয়েকটি সহযোগী রোবটও ছিল। রোবট বিজ্ঞানীরা মানুষের কথামত গবেষণা না করে তারা রোবট জাতির জনবল বৃদ্ধি করে। তারা বৃহস্পতিতে পূর্বে বসবাসরত M-7 গ্রহের তৈরি রোবটদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আরো উন্নত শ্রেণীর রোবট তৈরি করে। বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতি ও পেশার রোবট রয়েছে ওখানে। যার ফলে ওরা হতে পেরেছে পৃথিবী ও মঙ্গলের রোবটদের চেয়ে শক্তিশালী। এ কারণেই ওখানে ওরা মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। সেই সাথে বৃহস্পতির রোবটজাতি মঙ্গলের রোবটজাতিকে মদদ জোগাচ্ছে মঙ্গলে স্বাধীন ‘রোবট ল্যান্ড’ গড়ে তুলতে।
মঙ্গলে BSAC -এর ব্যুরো অফিসে কয়েকজন রোবট বিজ্ঞানী ছিল। এদের কাজের অগ্রগতি জানতে স্বনন গবেষণা কক্ষে ঢুকল। রোবট বিজ্ঞানী R-21 -কে ডাকল। R-21 পাশের রুমে ছিল। গটমট গড়ে হেঁটে এসে মিমোর সামনে দাঁড়াল। স্বনন বলল, কী খবর R-21?
R-21 বলল, ভালো।
– গবেষণার অগ্রগতি কেমন?
– আমরা এখনও মানুষের বসবাস যোগ্য কোনো গ্রহ পাইনি।
– R-13 -কে পাঠানো হয়েছিল না মহাশূন্যে?
– হ্যাঁ।
– তার খবর কী?
– এখনো সংবাদ পাইনি; কোথায়, কত দূর আছে তা এখনও জানা যায় নি।
– কী বলছো এসব! সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ওর গতিবিধি লক্ষ্য করনি?
– না জনাব।
স্বনন যেমনি অবাক হয় তেমনি চিন্তায় পড়ে যায়। ওদের তো ভুল হবার কথা না। কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ও নীরবতা ভঙ্গ করে বলে, ঠিক আছে তুমি এখন যাও।
রোবট R-21 চলে গেলে মহাশূন্যের শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা চালু করে স্বনন। কী ব্যাপার! একটাও তো চালু হচ্ছে না। পর পর তিনটি মনিটর চালু করার চেষ্টা করে ও। চতুর্থটা হঠাৎ চালু হতেই দেয়ালের বিশাল মনিটরে ভেসে ওঠে বৃহস্পতি গ্রহের দৃশ্য। এসব দেখে কী লাভ? R-13-কে তো বৃহস্পতি গ্রহে পাঠানো হয়নি, ওকে পাঠানো হয়েছে সৌরজগতের বাইরে ‘বাভাগ’ গ্রহে। ক্যামেরার সুইচ বন্ধ করতে যাবে এমন সময় R-13 ছবি দেখে চমকে ওঠে স্বনন। আরে! R-13 ওখানে ক্যানো? ওকে তো বৃহস্পতিতে পাঠানো হয়নি? নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র পাকাতে ওখানে গিয়েছে। স্বনন মনোযোগ সহকারে সিসি ক্যামেরা সার্চ করতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখেÑ জ-১৩ বৃহস্পতির রোবটদের সাথে বৈঠক করছে। ওখানে রাশিয়া, ইরান, আমেরিকা প্রায় প্রত্যেক দেশের প্রাক্তন অভিজ্ঞ রোবট বিজ্ঞানীরা রয়েছে। স্বননের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়Ñ নিশ্চয়ই ওরা মঙ্গলে স্বাধীন ‘রোবট ল্যান্ড’-এর জন্য ওদের কাছে সাহায্য নিতে গিয়েছে। তাহলে তো আর ওদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। খবরটা অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের জানাতে হয়। স্বনন সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে রাশিয়া, আমেরিকা, ইরান প্রভৃতি দেশের বিজ্ঞানীদের খবরটা জানিয়ে দেয়। ওর কথা শুনে সবাই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে।

পরদিন স্বননের নেতৃত্বে মানব বিজ্ঞানীরা জরুরি মিটিংয়ে বসে। মিটিংয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়Ñকিভাবে রোবটজাতির ষড়যন্ত্র থেকে মঙ্গলের মানবজাতিকে রক্ষা করা যায়। এমনিতেই পৃথিবীতে মানুষে মানুষে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধ ছাড়াও বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, ওজোন স্তর ক্ষয়, বিভিন্ন কারণে পৃথিবী মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ কারণেই নিরাপদ বসবাসের জন্য পৃথিবী থেকে কিছু মানুষকে মঙ্গলে প্রেরণ করা হয়েছিল। ভুলটা হয়েছিল মানুষের পূর্বে রোবট পাঠিয়ে। ভুল বলাও যাবে না। রোবটরাই প্রথমে এসে মঙ্গলকে মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল। ওদের এ অবদান অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে ওরা সংঘটিত হতে থাকে। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিপরীতে মঙ্গলে রোবটদের কর্তৃত্বই প্রাধান্য পায়। কারণ রোবটদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব-বিভেদ নেই। ফলে মানুষ আর ইচ্ছে মতো ওদের পরিচালিত করতে পারছে না।
এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে বৃৃহস্পতিতে। বৃহস্পতি আর মঙ্গলে প্রায় একই সঙ্গে রোবট পাঠানো হয়েছিল। মঙ্গলে রোবট আর মানুষ সহাবস্থানে থাকলেও বৃহস্পতিতে থাকেনি। বৃহস্পতির রোবটজাতি কয়েক বছরের মধ্যেই মানবজাতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে ফেলে। বুদ্ধি আর কৌশলে ওরা বিভক্ত মানবজাতিকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। বর্তমানে ওখানে শুধু রোবটজাতিই বসবাস করছে। এখন মঙ্গলে স্বাধীন ‘রোবট ল্যান্ড’ গড়ে তোলার জন্য ওরাই ওখান থেকে কলকাঠি নাড়ছে। বিবিধ আলোচনা শেষে স্বনন সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে, এখন আমাদের করণীয় কী?
– করণীয় আর কী, ওদের ধ্বংস করে দেয়া। একটু রাগান্বিত স্বরে রাশিয়ার বিজ্ঞানী লেভ গ্যাগারিভ বলেন,
– ওদের ধ্বংস করলে আমরা বাঁচব কী করে, সে উপায়টাও খুঁজে বের করতে হবে। আমেরিকার বিজ্ঞানী মাইকেল টমসন বলেন,
– হ্যাঁ তা ঠিক। এ জন্য আমাদের মঙ্গলের মানবজাতিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। বললেন ইরানের বিজ্ঞানী সালাম আব্দুস।
– কিন্তু কোথায় সরানো হবে? চীনা বিজ্ঞানী জিং জিয়াং বললেন।
-ক্যানো, পৃথিবীতে? জাপানি বিজ্ঞানী ইশিউরো বললেন,
– তা ঠিক হবে না। সবার কথা মনোযোগ সহকারে শোনার পর বাংলাদেশের বিজ্ঞানী স্বনন দৃঢ় স্বরে বলল,
– ক্যানো? সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।
– কারণ, পৃথিবী কিছুদিনের মধ্যেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীকে ধ্বংস না করলেও মঙ্গল ও বৃহস্পতির রোবটজাতি আমাদের ছাড়বে না। কাজেই এর আগেই আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
– বিকল্প ব্যবস্থাটা কী?
– ওরা পৃথিবীর স্থলভাগ সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারলেও জলভাগ সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।
– বুঝলাম না ব্যাপারটা, সহজ করে বলুন।
– আমরা যদি পৃথিবীর বৃহৎ জলরাশির তলদেশে অর্থাৎ সাগর-মহাসাগরের তলদেশে আপাতত অস্থায়ী মানববসতি গড়ে তুলি তাহলে কিছুদিনের জন্য হলেও নিরাপদে থাকতে পারব।
– খুব ভালো কথা! উৎফুল্ল হয়ে উঠল আমেরিকান বিজ্ঞানী টমসন। আমাদের দেশ তো অলরেডি আটলান্টিকের নিচে উপনিবেশ তৈরি করে ফেলেছে।
– তাহলে এটাই সিদ্ধান্ত যে, মঙ্গলের সকল মানুষকে স্থানান্তরের পরই রোবটজাতিকে ধ্বংস করে ফেলা হবে। সভাপতি প্রবীণ বিজ্ঞানী জিং জিয়াং কথাগুলো বলে মিটিংয়ের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে সভাস্থল ত্যাগ করলেন।

BSAC -এর অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী মিমোসা মিমো এসেছে ভারত মহাসাগরের তলদেশে নির্মিত ‘সাগর নীড়’ পরিদর্শন করতে। সঙ্গে আছেন ভারতের বিজ্ঞানী মি. বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। বাংলাদেশ ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘সাগর নীড়’ তৈরি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সাগরের উপরিভাগ অনেকটাই দূষণযুক্ত। তলদেশের পানি তেমন দূষিত না হলেও ধীরে ধীরে ওখানেও প্রভাব বিস্তার করছে। পানি দূষণের কারণেই সাগরে আগের মতো প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ নেই- অধিকাংশ জলজ প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাগর তলায় যে সব মনোরম উদ্ভিদের বাগান ছিল তাও আর চোখে পড়ে না। পঞ্চম সহস্রব্দ পর্যন্ত শ’ খানেক মহাযুদ্ধের বিরূপ প্রভাব আর অতিসভ্যতার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই মূলত এর জন্য দায়ী।
মিমো আর বিশ্বজিৎ দুজনেই উপনিবেশের এরিয়ায় প্রবেশ করল। ওরা রকেটের ন্যায় সূক্ষ্মাকৃতির একটি অত্যাধুনিক ডুবো-রকেটে করে এখানে এসেছে; যেটি স্থল, জল ও আকাশপথে চলতে পারে। দুজন ঘুরে ঘুরে দেখল- বিশাল এক প্রান্তরের মতো জায়গাটি। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের দশ গুণের মতো হবে। সাগরের এক হাজার ফুট মাটির নিচে খনন করে স্থানটি তৈরি করা হয়েছে। এর জন্য কাজ করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েক হাজার রোবট শ্রমিক। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের জন্য সাগরের উপরে জলভাগের সাথে একটা বৃহদাকৃতির সুড়ঙ্গ পথ বা টানেল তৈরি করা হয়েছে। এ পথ দিয়েই পৃথিবীর স্থলভাগ থেকে এখানে পৌঁছানো যায়। এ ছাড়া শুধু বিজ্ঞানীদের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য আরেকটি গোপনীয় সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে।
মিমো ও বিশ্বজিৎ ঘুরতে ঘুরতে একটা ব্যালকুনির সামনে এসে দাঁড়াল। মিমো বলল, মি. বিশ্বজিৎ; সবকিছুই চমৎকার হয়েছে শুধু একটি জিনিসের অভাব রয়েছে।
– কী জিনিস সেটা?
– গাছপালা।
– আপাতত গাছপালা এখানে লাগানো যাবে না।
– ক্যানো? ঠিক বুঝ…!
এমন সময় মিমোর ইথার যন্ত্রটিতে সংকেত বেজে উঠল। কানে দিতেই বুঝতে পারলÑ মঙ্গল থেকে স্বনন কল করেছে।
– হ্যালো, কী খবর স্বনন?
– দুঃসংবাদ মিমো। রোবটরা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে।
– ক্যানো?
– ওরা আমাদের গোপন বৈঠকের কথা জানতে পেরেছে।
– তোমরা কী করছো?
– আমরাও বসে নেই। সব দেশের অভিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের মোকাবেলা করছি। কিন্তু পেরে উঠছি না। আমাদের বহু মানুষ মারা পড়েছে। তাড়াতাড়ি স্থানান্তর না করতে পারলে বাকি সবাই মারা পড়বে।
– অত উদ্বিগ্ন হয়ো না। আমরা ভারত মহাসাগরের তলদেশে উপনিবেশের কাজ শেষ করেছি। শিগগিরই বাংলাদেশ ও ভারতের সব মানুষকে এখানে নিয়ে আসব। মঙ্গলের অভিবাসীদেরও এখানে আনার ব্যবস্থা করছি।
– বেশি দেরি করো না। তুমি আজই একটা নভোযান পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
– ঠিক আছে। মিমো লাইন কেটে দিয়ে কথাগুলো বিশ্বজিৎকে জানায়। বিশ্বজিতের পরামর্শে মঙ্গলে দুটো নভোযান পাঠানো হয়। এত করে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিবাসীরা মঙ্গল থেকে সরাসরি এখানে চলে আসতে পারবে। স্ব-স্ব দেশ থেকে আরো কিছু নভোযান পাঠানোর জন্য ওরা দ্রুত ডুবো-রকেটে চড়ে বসল।

রোবট সৈন্যদের হাতে মঙ্গলে অনেক মানুষ মারা পড়েছে। অল্পকিছু মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছেন মানব বিজ্ঞানীরা। সেসব মানুষকে সঙ্গে সঙ্গে স্ব-স্ব দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তারা। যে সব দেশে সাগরের তলদেশে উপনিবেশ রয়েছে সেখানেও কিছু মানুষকে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন এরপর বৃহস্পতির রোবটজাতি পৃথিবীর ওপর আক্রমণ চালাবে। আমেরিকান বিজ্ঞানী মাইকেল টমসন ক্রোধে কাঁপছিলেন। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির অতীত ঐতিহ্য রয়েছে। সুদূর অতীতে তারা সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছে। অথচ এখন নিজ তৈরিকৃত স্বাধীন রোবটদের কাছে নিজেরাই হেরে যাচ্ছে।
ইরানের বিজ্ঞানী সালাম আব্দুসের চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছে ক্রোধের রেখা। মুসলমানদেরও একটা সোনালি অতীত রয়েছে। এক সময় অর্ধ পৃথিবীরও বেশি শাসন করেছে তারা। তখন পৃথিবী ছিল কি শান্তিময়! আর আজ! মানুষে মানুষে, রোবটে মানুষে যুদ্ধ। থমথমে পরিবেশের নীরবতা ভঙ্গ করে স্বনন বলে উঠল, এখন কী করা যায়?
– আর দেরি নয়। আমাদের সাধারণ মানুষদের তো স্থানান্তর শেষ হয়েছে। এখন আমরা একটা নভোযানে চড়ে পৃথিবীর উদ্দেশে পাড়ি জমাবো। বললেন বিজ্ঞানী গ্যাগারিভ।
– তার মানে আমরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। টিপ্পনী কাটল ইশিউরো।
– পালাব, তবে ওদের শেষ করে দিয়ে। দৃঢ়স্বর গ্যাগারিভের।
– আমরা চলে যাবার পূর্বে মঙ্গলে ইলেকট্রিক রে ফেলে চলে যাব। তাতে ওদের সব রোবটের কলকব্জা শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে যাবে; এতে ওরা সবাই ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। বললেন প্রবীণ বিজ্ঞানী জিং জিয়াং।
– বেশ ভালো বুদ্ধি! খুশিতে লাফিয়ে উঠল স্বনন।
– ঠিক আছে, আর দেরি নয়। এক্ষুনি প্রস্তুতি নেই গে।
– হ্যাঁ, সবাই আরেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন; মঙ্গলের রোবটরা ধ্বংস হবার পরপরই কিন্তু বৃহস্পতির রোবটেরা পৃথিবীতে আক্রমণ করে বসবে। এ জন্য আপনারা স্ব-স্ব দেশে গিয়ে সবাইকে সতর্ক বাণী পৌঁছে দিবেন। আর যত শিগগির মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সাগরের উপনিবেশে অথবা সৌরজগতের বাইরে অন্য কোনো গ্রহে সবাইকে স্থানান্তর করতে হবে।
– ঠিক বলেছেন। আলোচনা শেষে সবাই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের দিকে পা বাড়াল।

মঙ্গলে রোবটজাতির পুরোপুরি ধ্বংসের সংবাদ কানে পৌঁছানো মাত্রই বৃহস্পতির রোবটজাতি হিংসায় জ্বলে উঠল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে রোবটবিহীন অত্যাধুনিক নভোযান প্রেরণ করল পৃথিবীতে। নভোযানগুলো পৃথিবীর মহাকাশ সীমায় পৌঁছেই প্রবল বর্ষণের মতো কসমিক রে নির্গত করতে লাগল। দেখতে দেখতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক মারা পড়ল। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নভোযানগুলোকে যথাসাধ্য প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল। কয়েকটি নভোযানকে লেসার রশ্মি সাহায্যে ঝলসে দিয়ে ভূপাতিতও করেছে। ক্রমে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধল পৃথিবীতে বসবাসরত রোবট বিজ্ঞানীরা। যুগে যুগে ঘরের শত্রু বিভীষণ-মিরজাফররা যেমন ছিল এ যুগেও তেমনি আছে। রোবট বিজ্ঞানীরা আড়াল থেকে বৃহস্পতির নভোযানগুলোকে সমূহ বিপদের সতর্ক সংকেত জানিয়ে দিলো। ওরা ভিন্নপথে পৃথিবীর ওপর কসমিক রে বর্ষণ করতে লাগল। মানববিজ্ঞানীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। তারা জরুরি বৈঠক ডেকে পৃথিবীর জীবিত মানুষদেরকে দ্রুত গতিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিলো।
ইতোমধ্যে রাশিয়া ও আমেরিকার বিজ্ঞানীদের যৌথ চেষ্টায় পৃথিবী থেকে ১৫.৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে মানুষের বসবাসের উপযোগী একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছে। গ্রহটির নাম ‘রামিকা’। ওখানে মানুষের মতো এক ধরনের জীব রয়েছেÑ যাদেরকে পৃথিবীর মানুষেরা এলিয়েন বলে থাকে। এ এলিয়েনরা মানুষের চেয়ে নিম্ন বুদ্ধিস্তরের। তাদের রয়েছে দুটি পা, একটি হাত ও একটি চোখ। সমস্ত মুখম-লে একটি মাত্র ফুটো রয়েছে। ওই একটিমাত্র ফুটো দিয়ে ওরা বায়বীয় খাবার খেয়ে থাকে। কোনো কিছু বললে সাপের মতো জিহ্বা বের করে; এতে মনে হয় তাদের অন্য কোনো শ্রবণেন্দ্রীয় নেইÑ জিহ্বা দিয়েই তারা শ্রবণের কাজ করে থাকে। এদের প্রধান টোটোর সাথে যোগাযোগ করে পৃথিবীর (রাশিয়া ও আমেরিকার) মানুষকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তারা মানবজাতিতে সাদরে গ্রহণ করেছে।
রামিকা গ্রহের পাশেই আরেকটি মানব বসবাস উপযোগী গ্রহ রয়েছে। এর নাম ‘বাভাগ’। এখানেও এলিয়েনরা রয়েছে, তবে তারা প্রযুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে অনেক উন্নত। দেখতে রামিকা গ্রহের এলিয়েনদের মতোই। সুদূর অতীতে ওরা একই গোত্রভুক্ত ছিল। এ গ্রহের এলিয়েনরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। তারা মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য গবেষণায় ব্যস্ত। এ গ্রহের এলিয়েনদের সাথেও যোগাযোগ রয়েছে তাদের। তারা এখানকার এলিয়েনদের উন্নত প্রযুক্তি শেখাতে মাঝে-মধ্যে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালা করে থাকে।
পৃথিবীর মানুষের কপাল খুব খারাপ। তারা সাগরের তলদেশেও বেশিদিন বসবাস করতে পারল না। আটলান্টিকের তলদেশে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে আমেরিকার উপনিবেশ ধ্বংস হয়ে গেল। এ সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মহাসাগরের উপনিবেশ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণকে বাভাগ গ্রহে স্থানান্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। এ উপনিবেশের বিজ্ঞানীরা মাসখানেক আগে এ গ্রহটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল।
স্বনন রামিকা গ্রহের নভোযান ফেল করে মহাচিন্তায় পড়ে গেল। মৃত্যু বুঝি অতি নিকটে চলে এসেছে হঠাৎ তার পুরনো এলিয়েন বন্ধু বনবনের কথা মনে পড়ল। ইথার যন্ত্রের মাধ্যমে বনবনের সাথে যোগাযোগ করতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই বনবন এসে হাজির হলো। বনবন তার অত্যাধুনিক সসারে করে স্বননকে সঙ্গে নিয়ে গ-৭ গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

৪.
হোয়াইটহোল
সসারটি কিছুক্ষণ ছুটে চলার পর হঠাৎ করে ওর চারপাশে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তবুও সসারটি ছুটে চলছে। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে কী এক অজানা আকর্ষণে আলোর গতিতে ছুটে চলছে সসারটি। সসারের মধ্যে আছে স্বনন আর গ-৭ গ্রহের এলিয়েন বন্ধু। স্বননকে পৃথিবীর দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচাতে সংবাদ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে M-7 গ্রহের সেই অকৃত্রিম বন্ধু বনবন। কিন্তু পথিমধ্যে ওরা এমন একটি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে- কে জানে? বনবনের পাশে বসা স্বননকে বলল, তোমার ভয় লাগছে না তো? অন্ধকারে বনবনের চোখ-মুখ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু শব্দ শুনে ও জবাব দিলো, ভয় তো লাগতেই পারে, আমরা কোথা দিয়ে যাচ্ছি?
– মনে হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের পাশ দিয়ে।
– অ্যা! বলো কী! মানে সেই ভয়ঙ্কর কৃষ্ণ গহ্বরের চক্রের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি? স্বনন যতটা ভয় পেয়েছিল না, তার চেয়ে দশগুণ বেশি ভয় পেয়ে গেল। কম্পিত স্বরে বলল, এখন উপায়?
– এত ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ের তেমন কারণ দেখছি না তো।
– তোমরা তো ভয়কে জয় করেছো। কিন্তু আমরা তো মানুষ; আমরা এখনো ভয়কে জয় করতে পারিনি।
– সাহস না থাকলে কোনো কিছু জয় করা সম্ভব হয় না। ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণগহ্বরে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন এর শেষ দেখে ছাড়ব।
– যদি আমাদের নভোযান ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়?
– হবে না। ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তারা মনে করত এর মধ্যে কিছু পতিত হলেই সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায়। আসলে এর শেষ এখনো কেউ জানে না। ধ্বংস হয় নাকি অন্য কোথাও যেয়ে পৌঁছে তা কেউ এ পর্যন্ত জানতে পারেনি। আর আমাদের নভোযানটি অত্যাধুনিক এবং অনেক শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় একটি নভোযান; কাজেই তেমন কিছু হবে না।
– আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।
– মনে সাহস সঞ্চার করো। আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এর রহস্য উন্মোচন করা। আজ ভাগ্যক্রমে যখন ঢুকেই পড়েছি তখন এর শেষ দেখেই ছাড়ব। শেষের কথাটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে বনবন।
– কী আজগুবি কথা বলছো তুমি। আমরা কৃষ্ণ গহ্বরের হাত থেকে বাঁচতে পারলে তো?
– দ্যাখো বিজ্ঞানী স্বনন, দিনের পর যেমন রাত আসে, অন্ধকারে পর তেমনি আলো থাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অসীম অন্ধকারের পর অবশ্যই আমরা আলোর সন্ধান পাবো।
– দেখা যাক। হতাশার সুর স্বননের।
স্বননদের স্বয়ংক্রিয় নভোযানটি কি এক অজানা চৌম্বকীয় আকর্ষণে ছুটে চলছে তো চলছেই। কত সময় ধরে চলছে তার কোনো হিসেব নেই। চারিদিকে আলোকহীন এক অসীম শূন্যতা। নভোযানের ভিতরে এবং বাইরের বাতিগুলোর আলোও শুষে নিয়েছে ব্ল্যাকহোলের এই অজানা শক্তি। এ কেমন স্থান? এ থেকে ওরা নিষ্কৃতি পাবে কিভাবে? নভোযানটি চলতে চলতে এক সময় প্রচ- শক্তিতে বিস্ফোরিত হয়। এর পর কে কোথায় যায় নিকষ কালো মৃত্যুর মতো অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না।

স্বননের যখন জ্ঞান ফিরল দেখল- ও একটি রুমের ভিতর শুয়ে আছে। আরে! এ তো আমরাই রুম। আমার গবেষণা কক্ষ। সেলফের সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, বিজ্ঞানের বইপত্র সবই তো আমার। আমি তাহলে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম? স্বনন মনে মনে এসব চিন্তা করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। দেখি তো পাশের রুমে বন্ধু সহকর্মী জনসন আছে কি না। স্বনন রুমের বাইরে পা বাড়াল। স্বনন রুমে ঢুকে দেখে জনসন নেই। জনসনের রুমই তো মনে হচ্ছে; তবে জনসন কোথায় গেল? জনসন! বন্ধু জনসন! কোথায় তুমি? স্বনন উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল। ডাক শুনে দ্রুত গতিতে একটা জীব এসে ওর কয়েক গজ দূরে উড়তে লাগল। জীবটির মুখ ঈগলের মতো; পাখাও আছে। তবে মানুষের মতো একটি পা-ও রয়েছে তার। পেটের নিচে থেকে স্পিঙের মতো গোটানো পা ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে মাটিতে স্ট্যান্ড করল। নদীর তীরে বাঁশের খুঁটিতে মাছরাঙা যেমন মাছ শিকারের আশায় বসে থাকে দূর হতে অনেকটা তেমনই মনে হতে লাগল জীবটিকে। জীবটি জিজ্ঞেস করল, তুমি কাকে চাচ্ছ?
পাখির মতো অদ্ভুত জীবটির মুখে কথা শুনে স্বনন অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তুমি কে? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?
জীবটি শান্তস্বরে বলল, আমি উড়িউড়ি, এখানকার বাসিন্দা। এখানে যে ভাষায়ই কথা বলো না ক্যানো সবাই সবার ভাষা বুঝতে পারে। এমন কি ইশারা-ইঙ্গিতের ভাষাও বোঝা যায়।
– আরে! এটা তো আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর কোনো দেশে তোমার মতো এমন অদ্ভুত জীব তো দেখিনি কখনো?
– তুমি ভুল করছো। এটা তোমাদের পৃথিবী নয়। এটা ‘হোয়াইটহোল’।
– কী!
– হ্যাঁ। এটা ব্ল্যাকহোলের পরবর্তী জায়গা।
– কিন্তু…কিন্তু এটা তো আমাদের পৃথিবীর মতোই…।
– তা তুমি ঠিকই বলেছো। ব্ল্যাকহোলের চক্রে পড়ে তোমাদের সসারটি পথ হারিয়ে ফেলেছিল। পরিশেষে তোমরা দুর্ঘটনায় পতিত হও। আমরা তোমাকে সার্জারির মাধ্যমে সারিয়ে তুলেছি।
– কিভাবে এখানে এলাম। আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।
– আমরা পরিব্রাজকের কাজ করি, মহাজগৎ ঘুরে ঘুরে সৃষ্টির সব রহস্য পর্যবেক্ষণ করি। ভ্রমণরত অবস্থায় আমরা তোমাদের সাক্ষাৎ পাই এবং এখানে নিয়ে আসি।
– আমার বন্ধু বনবন কোথায়?
– ওকে আমরা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি।
বনবনের মৃত্যু সংবাদে স্বননের মন খারাপ হয়ে গেল। মনের অজান্তে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিচে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ভারী গলায় বলল, তোমাদের জগৎটা কি আমাদের পৃথিবীর মতোই?
– কিছুটা তবে পুরোপুরি নয়।
– তবে যে আমার গবেষণা কক্ষ, এখানকার ঘর-বাড়ি, গাছপালা আমাদের পৃথিবীর মতোই মনে হচ্ছে।
– এসব তৈরি করা হয়েছে তোমার মেমোরি সেল ঘেঁটে। তোমার স্মৃতিতে যা সংরক্ষিত ছিল তা থেকেই এখানে সব কিছু তৈরি করা হয়েছে।
– কী আশ্চর্য! তোমরা কি পৃথিবীর মতো সব কিছুই তৈরি করতে পারবে?
– না।
– তোমাদের হোয়াইটহোল কেমন?
– তোমাকে সবই দেখাব। এখানে কোনো দুঃখ-বেদনা নেই। এখানে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করে।
– তাই নাকি!
– চলো, এখন পরিদর্শনে যাওয়া যাক।
– হ্যাঁ, চলো।

উড়িউড়ি স্বননকে নিয়ে হোয়াটহোলের মূল ক্যাম্পাসের পথে যাত্রা শুরু করল। স্বনন একটি সুন্দর মনোরম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। উড়িউড়ি স্বননের পাশে পাখির মতো পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছিল। ওড়ার পূর্বে ওর পা’টি স্পিঙের মতো পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। রাস্তার দু’পাশে সব বড় বড় গাছপালা যেন সাজানো-গোছানো বনভূমি। তার পাশে কলকল রবে বয়ে যাচ্ছে ¯্রােতসিনী নদী। স্বনন লক্ষ্য করল নদীর সবুজ জলে বিভিন্ন রঙের মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে।
স্বনন কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠল, নদীর পানিও সবুজ! ব্যাপার কী?
– এখানকার সব কিছুই চিরহরিৎ। এখানকার গাছপালাগুলো মরে না, এজন্য পাতাও হলুদ রঙ ধারণ করে না। শুধু গাছপালা নয়, কোনো জীবেরই মৃত্যু নেই এখানে। অনন্ত জীবন এদের।
– কেউ বৃদ্ধ হয় না?
– না। তোমরা যারা পৃথিবী কিংবা বাইরের গ্রহ থেকে যারা এসেছো তারাও কেউ বৃদ্ধ হবে না এবং মৃত্যু বরণ করবে না।
– বলো কী! আমি ছাড়াও পৃথিবীর মানুষ আছে নাকি?
– হ্যাঁ। তোমার মতোই দুর্ঘটনায় পতিত হবার পর আমরাই ওদের এখানে নিয়ে এসেছি।
– তারা কোথায় আছে।
– এই তো, কিছুদূর গেলেই দেখতে পাবে। তার আগে আমাদের দেশটা ঘুরিয়ে দেখাই এবং এর সম্পর্কে তোমাকে ধারণা দেই।।
– দেশ! ‘হোয়াইটহোল’ আসলে কী?
– দেশ বলতে নিজ বাসভূমকেই বোঝাচ্ছি। ‘হোয়াইটহোল’ আসলে কোনো গ্রহ নয়, এটি ব্ল্যাকহোলের চৌম্বকীয় আকর্ষণে ছুটে চলা একটি গ্রহাণু। ব্ল্যাকহোলের সঙ্গেই এটিও অসীম যাত্রায় রত।
– তার মানে এটি শুধু একদিকে ছুটেই চলছে!
– হ্যাঁ।
– এখানে আর কে কে আছে?
– মূলত এটি মহাজগতের একটি সরাইখানায় পরিণত হয়েছে। এখানকার নিজস্ব বাসিন্দারা আত্মগোপন করে থাকে। তাদের সচরাচর দেখা যায় না। সবাই এখানে অন্য গ্রহ থেকে আসা উদ্বাস্তু-শরণার্থী।
– তুমি?
– আমিও। তবে আমি অন্যগ্রহের উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণী দ্বারা সৃষ্ট রোবট-প্রাণী।
– রোবট-প্রাণী! স্বননের আবার অবাক হবার পালা।
– হ্যাঁ। অন্যগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা যখন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে এখানে এসেছিল তারাই পরে আমাদের তৈরি করে পরিব্রাজক বানিয়েছে। তাদের আদেশেই নবাগতদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
– খুব ভালো সিদ্ধান্ত। একটু থেমে স্বনন দূরে তাকিয়ে দেখল- পৃথিবীর মতোই কিছু দালান-কোঠা আর গাছপালা। বলল, ওগুলো কাদের ঘরবাড়ি? কেমন চেনা চেনা লাগছে।
– ওগুলো তোমাদের পৃথিবীর মানুষেরই ঘরবাড়ি; যারা এখানে এসেছিল তোমার মতোই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে।
– তাহলে চলো ওখানে যাওয়া যাক।
– হ্যাঁ।

পৃথিবীর কলোনির সামনে এসে দাঁড়াল স্বনন। উড়িউড়ি একটা গাছের ডালে জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসে পড়ল। স্বনন চারিদিকে চোখ বুলাল। অনেকগুলো বিল্ডিং তবে সবগুলোই এই আকৃতির নয়। কোনোটি আমেরিকান স্টাইলে, কোনোটি নেপালি স্টাইলে, কোনোটি বা বাংলাদেশের স্টাইলে তৈরি করা। গাছপালাগুলোও এক দেশের নয়; কোথাও ইউক্যালিপটাস, কোথাও ওক, কোথাও বা রয়েছে বাংলাদেশের আমগাছ। স্বনন চোখ নামিয়ে পাশের গাছের ডালে বসা উড়িউড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন যেন একটু এলোমেলো লাগছে। উড়িউড়ি বলল, এখানে তোমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকের বাস। যারা যে পরিবেশে মানুষ হয়েছে তাদেরকে ঠিক সেই পরিবেশই তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তারা যেন মনে করে পৃথিবীতেই বাস করছে।
– তারা কি বুঝতে পারে না যে অন্য স্থানে এসেছে।
– বুঝতে পেরেছে কিন্তু তারা এই পরিবেশ পেয়ে এখানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
– খুব ক্লান্ত বোধ হচ্ছে। একটু বসি। কিছু পানীয় খাওয়াও দরকার।
– তাহলে চলো বাংলাদেশের ব্লকে যাই, কেননা তুমি আমেরিকান হলেও তোমার অস্থিমজ্জায় আছে বাংলাদেশ। ওখানে তোমাদের দেশের লোক এবং খাবার উভয়ই মিলবে।
স্বনন উড়িউড়ির সঙ্গে বাংলাদেশের প্যাটার্নে তৈরি একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই দেখল- রুমের ভিতর বিছানায় একজন মানুষ ঘুম পাড়ছে। আরেকজন ল্যাবরেটরি টেবিলের পর একটি বিড়াল ও একটি বানর নিয়ে কি যেন করছে।
উড়িউড়ি লোকটির কাছে গিয়ে বলল, জনাব কামাল; ওনাকে একটু জুস খাওয়াতে পারেন?
– অবশ্যই! অবশ্যই! কামাল সাহেব দ্রুত ওখান থেকে সরে পাশের শেলফ থেকে একটি এক বোতল জুস এনে স্বননের হাতে দিলো।
স্বনন এক চুমুকে জুসটুকু খেয়ে নিয়ে ‘আহ!’ শব্দে ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলল। তারপর কামাল সাহেবকে উদ্দেশ করে বলল, আপনি ওখানে কী করছিলেন?
কামাল সাহেব বললেন, আমি বাংলাদেশের একজন জেনেটিক বিজ্ঞানী ছিলাম। অনেক বড় বড় আবিষ্কার করেছি। দু’-তিনটি প্রাণীর জিন গবেষণা করে একটি ভিন্ন প্রাণী সৃষ্টি করেছি। কিন্তু এখানে আসার পর তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারছি না।
– রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি কোনো কিছুর অভাব নেই তো?
– না।
– তবে?
– আমি আগের মতো তেমন বুদ্ধি খাটাতে পারছি না। বুদ্ধিটা কেমন ভোঁতা হয়ে আসছে।
– আপনি কতদিন এখানে আছেন?
– পৃথিবীর হিসেবে প্রায় ১০০ বছর।
– বলেন কী! আপনার বয়স তো ৫০-৬০ বছরের মতো হবে।
– হ্যাঁ আমি এই বয়সেই এখানে এসেছিলাম কিন্তু আমার বয়স বাড়েনি।
কামাল সাহেবকে দেখে উড়িউড়ির পূর্বের কথার প্রমাণ পেল। এত দীর্ঘজীবী অমর এরা অথচ কি দুর্ভাগ্য এদের! কেউ পৃথিবীর মতো স্বাধীন চিন্তা করতে পারছে না, এর রহস্যটা কী? উড়িউড়ির দিকে তাকিয়ে স্বনন প্রশ্ন করল, এখানে বুদ্ধি বিকশিত হচ্ছে না ক্যানো?
উড়িউড়ি বলল, সবাই এখানে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে এসেছে। এদের সম্পূর্ণ সুস্থ করতে এদের দেহ-মস্তিষ্ক কেটে-ছেঁটে ওলট-পালট করা হয়েছে। তারা পুনর্জীবন ফিরে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু জানো তো জোড়াতালি কোনো জিনিসই ভালো হয় না। তাছাড়া সময় এখানে স্থির; এ কারণেও বুদ্ধি ঠিকমত বিকশিত হচ্ছে না। উড়িউড়ির কথায় স্বনন বুঝতে পারল এখানকার অফুরন্ত সুখ আসলে সুখ নয়। এর মধ্যেও রহস্যের গন্ধ পেতে লাগল।

স্বনন স্বাধীন চিন্তা খাটাতে চেষ্টা করল। ও হোয়াইটহোল আর পৃথিবীর মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য খুঁজে বের করল। এতে ওর মাথায় কিছু প্রশ্ন চলে এলো। যেমন :
১. পৃথিবীতে জন্ম-মৃত্যু আছে এখানে তা নেই। কিন্তু কেন?
২. এখানে কারো বয়স বাড়ে না। যে যে অবস্থায় এসেছে সেই অবস্থায়ই আছে। এর কারণ কী, সময় এখানে স্থির বলে?
৩. এখানে যারা বসবাস করছে তাদের পৃথিবীর মতো বুদ্ধি বিকশিত হচ্ছে না। এর জন্যও কি সময় দায়ী?
৪. পৃথিবীতে নিজস্ব প্রাণী আছে এখানকার কোনো নিজস্ব প্রাণী নেই। উড়িউড়ি যে আদি বাসিন্দাদের কথা বলছিল, তাহলে তারা কারা?
পরিশেষে স্বনন সিদ্ধান্ত নিলো উড়িউড়িকে ছাড়া ও একাই এসব রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করবে বিশেষ করে আদিম বাসিন্দাদের অনুসন্ধান, ওরা কোথায় আছে? ওর মনে হতে লাগলÑ কেউ হয় তো চক্রান্ত করে সবাইকে মেধাশূন্য করে রাখছে কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? যা হোক, ও এর রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাবে।
স্বনন উড়িউড়িকে বিদায় দিয়ে দিলো। বলল, আজ থেকে ও কামাল সাহেবের সাথেই থাকবে। প্রয়োজন হলে তাকে ডাকবে। উড়িউড়ি পাখা মেলে চলে গেল। উড়িউড়ি চলে যাবার পর স্বনন কামাল সাহেবে কাছে থেকে সমগ্র হোয়াইটহোল সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিলো। পরিশেষে কামাল সাহেব বলল, আমিও এর রহস্য সম্পর্কে পুরোপুরি জানি না। হোয়াইটহোলের রহস্য উদ্ঘাটনে স্বনন বেরিয়ে পড়ল। আসলে হোয়াইটহোল কী? নাকি এটি পুরোপুরিই মায়ার জগৎ? এখান থেকে বেরনোর উপায় কী? স্বনন একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আর বিভিন্ন চিন্তা মাথায় আসছিল। দু’পাশে সবুজ বৃক্ষরাজি। যতদূর চোখ যায় যেন খালি সবুজের সমারোহ। সবুজ ছাড়া যেন কোনো রঙ নেই। দূরে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড় দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ও পাহাড়ের কাছে এসে দাঁড়াল। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গুহার মতো মনে হচ্ছে। ও একটি গুহার দিকে এগিয়ে গেল।
কোনোরূপ চিন্তা না করেই স্বনন একটি গুহার ভিতর ঢুকে পড়ল। কেমন আবছা অন্ধকার! মনে কিছুটা ভয় ভর করলেও ও সাহস নিয়ে এগুতে থাকল। যত এগোচ্ছে ততই যেন আরো ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পথ। অন্ধকারে এক মোড়ে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল স্বনন। ও আবার উঠে দাঁড়াল। দিকহীন ভাবে সে আবার পথ চলতে লাগল। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হঠাৎ আলোর আভা দেখে চমকে উঠল। ও আলোকিত স্থানটির দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। কাছে এসে দেখল ভিতরে মশাল জ্বলছে। এ যে আদিম পরিবেশ! ভিতরে আর বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা! স্বনন অবাক হয়ে গেল। ও মশাল প্রজ্বলিত গুহার ভিতর ঢুকে পড়ল।
স্বনন ঢোকার কিছুক্ষণ পর একটা বনমানুষের মতো প্রাণী এসে ওর সামনে দাঁড়াল। ওর হঠাৎ উপস্থিতিতে স্বনন চমকে উঠল। প্রাণীটিকে দেখতে আদিম মানুষের মতো। সে স্বননের দিকে কিছুক্ষণ অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। এরপর রাগত মুখভঙ্গি করল। তাতে স্বনন বুঝতে পারল সে বলছে, এখানে এসেছো ক্যানো?
স্বনন জবাব দিলো, রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য।
আদিম মানুষটি বুঝতে না পেরে পুনরায় ইশরা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করল, কিসের জন্য?
– একানকার স্থায়ী বাসিন্দা কারা?
– সেটা জেনে কী হবে?
-এমনি। কৌতূহল বলতে পারো।
আদিম মানুষটি মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমরাই এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।
– তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই?
– এত কিছু জেনে তোমার কি লাভ? তুমি কোথা থেকে এসেছো? তোমার পরিচয়?
– আমি স্বনন, পৃথিবী থেকে এসেছি।
– কি বললে! পৃথিবী থেকে?
– হ্যাঁ, এতে অবাক হবার কি আছে?
আদিম মানুষটি মাথায় হাত দিয়ে আবার কিছুক্ষণ চিন্তায় রত হলো। কি বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না বোধ হয়। শান্তস্বরে স্বননের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ বলব, সব বলব তোমাকে। তুমি যে আমাদের জাত ভাই।
– জাতভাই! স্বনন অবাক হলেও মনে মনে ভাবল, হ্যাঁ, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো আদিম মানুষই ছিল। এ জন্যই হয় তো…।
– এসো আমার সাথে। আদিম মানুষটি হাত ধরে টেনে গুহার বাইরে যাবার পথে হাঁটতে লাগল।

স্বনন আর আদিম মানুষটি পাহাড়ের বাইরে বের হয়ে ছোট্ট একটি টিলার পাশে এসে বসল। টিলার ওপাশে ঘন বনভূমি। সেখানে বিভিন্ন জীবজন্তু আনাগোনা করছে। পাশে স্বচ্ছ একটা নদী বয়ে গেছে। দূরে আরেকটি উঁচু স্থান থেকে জলপ্রপাতের পানি এসে নদীতে মিশছে। স্বনন দেখল ওখানে আরো কিছু আদিম মানুষ জলকেলি করে গোসল করছে। আদিম মানুষটি বলতে থাকল :
আমাদের এই হোয়াইটহোল এক সময় পৃথিবীরই একটি অংশ ছিল। সভ্যতার উষালগ্নে পৃথিবীতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়; সে ভূমিকম্পে পৃথিবীর একটি অংশ ভেঙে আলাদা হয়ে যায়। সেই অংশ প্রচ- গতিতে ছুটতে ছুটতে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পতিত হয়। ছুটতে ছুটতে একসময় ব্ল্যাকহোলের শেষ প্রান্তে এসে এক শক্তিশালী চৌম্বকীয় আকর্ষণে আটকে যায়।
স্বনন অবাক বিস্ময়ে শুনছিল আদিম মানুষটির কথা। মনের অজান্তেই বলে ফেলে, তারপর?
– তোমাদের পৃথিবীর যে প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগর রয়েছে সেখানেই ছিল আমাদের এই হোয়াইটহোল। ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ওখান থেকে এই অংশ চ্যুৎ হওয়ার ফলে পৃথিবীতে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়- আর সেটাই হলো আজকের প্রশান্ত মহাসাগর।
আদিম মানুষটির কথায় স্বননের চোখ ক্রমশ বড় হয়ে উঠছিল। এর মধ্যে মনে একটি প্রশ্নের উদয় হলো। কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য বলল, তোমরা এসব জানলে কী করে?
– সম্প্রতি বাইরের গ্রহ থেকে আসা বুদ্ধিমান এলিয়েনরা এসব আমাদের বলেছে। এ ছাড়া তারা আমাদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে, সভ্য মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছে কিন্তু পারেনি। আমরা এমন এক জায়গায় আটকে আছি যেখানে সময় স্থির। তাই যে যে অবস্থায় আছে সে সে অবস্থায়ই থেকে যায়। তোমাদের পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু আমরা একই জায়গায় আছি।
– কিন্তু এখানে তো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও রয়েছে।
– এসব করেছে অন্যগ্রহ থেকে আসা উন্নত প্রাণীরা। কিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই ‘হোয়াইটহোল’ মহাশূন্যের এক ভয়াবহ চক্রের ফাঁদে পড়ে গেছে- যা থেকে কারো নিস্তার নেই। কথাটি শুনে স্বননের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। বিরস মুখে বলে, তাহলে এখান থেকে বেরনোর কোনো উপায়ই নেই?
– না। তবে একমাত্র ঈশ্বর বা প্রাকৃতিক পরিবর্তন ছাড়া এটা হবার নয়।
– তাহলে কি আমরা অনন্তকাল এখানেই থেকে যাবো?
– তার তো কোনো বিকল্প দেখছি না।
স্বননের মনটা আরো বিছণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমে একটা ষড়যন্ত্রের কথা মনে হলেও এখন দেখছে, না এখানে ষড়যন্ত্রে কিছু নেই। প্রকৃতির ফাঁদে পড়ে মূলত সবাই এখানে অসহায়। আপাতত দৃষ্টিতে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য মনে হলেও মূলত এখানে কোনো সুখ নেই। এমন একঘেয়ে জীবন কে চায়? বৈচিত্র্যহীন এমন অনন্ত জীবন নিয়ে কী লাভ? পৃথিবীর জন্য স্বননের মনটা হাহাকার করে ওঠে। আদিম মানুষটি নিঃশব্দে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। দু’জনের চোখেই জল টলমল করছে; শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষ।

Share.

মন্তব্য করুন