বজ্রপাত নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল আছে। প্রায় সময় পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই, দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। আজ জানার চেষ্টা করব বজ্রপাতের সৃষ্টি রহস্য। বায়ুমন্ডলের উপরের অংশে নীচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায় যে, নিচের দিক থেকে উপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়। এ ধরণের মেঘকে থান্ডারক্লাউড বলে। অন্যান্য মেঘের মত এ মেঘেও ছোট ছোট পানির কণা থাকে। আর উপরে উঠতে উঠতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে পানির পরিমাণ যখন ৫ মি. মি. এর বেশী হয়, তখন পানির অণুগুলো আর পারস্পারিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। তখন এরা আলাদা হয়ে যায়। ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের এর সৃষ্টি হয়। আর এ আধানের মান নিচের অংশের চেয়ে বেশী হয়। এরকম বিভব পার্থক্যেও কারণেই ওপর হতে নিচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমনহয়। এ সময় আমরা আলোর ঝলকানি দেখতে পাই।
আর ক্রিয়ার সময় উক্ত এলাকার বাতাসের প্রসারন এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দু’টি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে। মার্চ থেকেমে মাসের শেষ পর্যন্ত বিহারের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তখন বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু প্রবাহ এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এই ছুটে আসা আদ্র বায়ু প্রবাহ এই দুয়ের সংঘাতে একটি দুটি করে বজ্র মেঘের সৃষ্ট হয়। আর সেগুলি তীব্র গতিতে মাথা তুলতে থাকে। এই মেঘগুলি থেকে নিঃসৃত শীতল ঝড়ের ঝাপটা সামনের দিকে আঘাত করে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ুস্তর ঐ ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে ওপরে উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গায় নতুন করে বজ্র-মেঘ সৃষ্টিহয়।
সবচেয়ে প্রথম যে একটি দুটি মেঘ তৈরী হয়েছিল তাদেরকে জননী বলা হয়। তবে সামনের দিকে সৃষ্ট হওয়া নতুন বজ্র-মেঘগুলো কে বলা হয় কন্যা। এইভাবে সামনের দিকে ক্রমে অনেকগুলি বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়ে একটা রেখা বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগোয়।
রাডার যন্ত্রে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় যে, কালবৈশাখী মেঘের এই রেখাটি ক্রমে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে এগিয়ে যায়। এই রেখার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ কিঃমিঃ পর্যন্ত হয়। আর বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মত হয়। এই রেখাটি যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে ঝাপটা দিয়ে যায়, সেই অঞ্চলেই কালবৈশাখীর তান্ডবলীলা চলে। ক্রমে ক্রমে এই মেঘ বঙ্গোপসাগরের কাছে পড়লেই এই কাল কালবৈশাখী ঝড় নিস্তেজ হয়ে যায়। কারণ সমুদ্রের ওপর কালবৈশাখী হয় না। মনে রাখতে হবে যে কালবৈশাখী মেঘের বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫- ২০ কিঃমিঃ এর মতো। মেঘগুলি সাধারণত প্রতি ঘন্টায় ২৫-৩০ কিঃমি গতিতে এগোয়। সুতরাং কোনস্থান অতিক্রম করতে এই মেঘগুলির সাধারণত আধঘন্টা থেকে বড়জোর এক ঘন্টার মতো সময় লাগে। বৃষ্টি ও ততক্ষণ হয়। কিন্তু বজ্র মেঘের সঙ্গে অনেক সময় মধ্যস্তর মেঘ থেকেও অনেক সময় বৃষ্টি হয়। এজন্য কোন কোন সময়ে এক ঘন্টারও বেশী সময় বৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও একশটির মত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাও খুবই কঠিন। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশের আগ মুহূর্তে ঘন কালো মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে। গুরগুর মেঘের ডাক শুনলেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে।

বজ্রপাত অনেক ক্ষতিকর হলেও এ ব্যপারে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন-
১.বজ্রপাতের সময় কোন খোলা মাঠে বা খোলা স্থানে দাঁড়ানো যাবে না। যদি ঐ স্থানে কোন বড় গাছ না থাকে, তবে আপনি সেই স্থানের সব থেকে উঁচু ব্যাক্তি। সেই সাথে কোন গাছের নীচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। গাছের উপর বজ্রপাত বেশী হয়।
২. পানির কাছে থাকা যাবে না, রাস্তায় সাইকেল বা মোটরসাইকেলের উপর থাকলে, দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহন করতে হবে।
৩. যদি খোলা মাঠ বা খোলা জমিতে থাকা হয়, তবে লক্ষ্য করুন তার টানা কোন বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে কিনা। যদি থাকে তবে দুই খুঁটির মাঝখানে তারের নিচে পায়ের পাতা উঁচু করে পাতার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে।
৪. বজ্রাহত কোন ব্যক্তিকে কখনো খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না, কারণ তার শরীরে তখনও বিদ্যুৎ থাকতে পারে।
৫. পাকাবাড়িতে আশ্রয় বেশি নিরাপদ। গাড়ির ভিতরও আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। গাছের নিচে, টেলিফোনের খুঁটির পাশে বা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের খাম্বার পাশে দাঁড়ানো মোটেই নিরাপদ নয়।
৬. পানির সংস্পর্শে মোটেই যাওয়া যাবে না। বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার আগেই তা মাটি স্পর্শকরে। সোজাসুজি মানুষের গায়ে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকেস্পর্শ করাও বিপজ্জনক। শুকনা কাঠ দিয়ে ধাক্কা দিতে হবে।
৭.বজ্রপাতের সম্ভাবনা আবহাওয়া বিভাগের রাডারে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নাউকাস্টনিং’ পদ্ধতিতে মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদস্থানে যেতে পারে। এতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।
৮. কোনোকর্ডযুক্ত ফোন ব্যবহার করবেন না। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত ধাতব পদার্থে হাত বা হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন না। বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত পানির ফোয়ারায় গোসল করবেন না। মরা কিংবা পচন ধরা গাছ ও খুঁটি কেটে ফেলতে হবে।
৯. বাসা, অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হলে বিদ্যুৎ সব সুইচ বন্ধ রাখুন, দরজা-জানালা ভালোমতো বন্ধ রাখুন।

Share.

মন্তব্য করুন