আমাদের এই পৃথিবীটা যেমন অনেক সুন্দর তেমনি বৈচিত্রময়। তার মাঝে কিছু সৌন্দর্য্য এতোই অনন্য যে মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বিজ্ঞানীরা বার বার প্রশ্নের উত্তর দিলেও আমাদের মন থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। কি করে, কীভাবে, কেন হল ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতেই থাকে। এমন অবস্থায় ভিন্নতাকে গ্রহণ করা কঠিনই বটে। পৃথিবীর সমুদ্র সৈকতগুলোর কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আমাদের যা মনে হয় তা হলো, ধূসর বালিঢাকা এক জায়গা; যেখানে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে, পৃথিবীর সব সাগরসৈকত ধুসর বা সাদা নয় বরং কোথাও কোথাও লাল, সবুজ, কালো, গোলাপী ইত্যাদি নানা রঙের। আজ আমরা এখানে এমনই কয়েকটি ভিন্নরকম সুন্দর সমুদ্র সৈকতের কথা তুলে ধরব।

চীনের লাল সৈকত
উত্তরপূর্ব চীনের দাওয়া এলাকার পানজিয়াংয়ের লিয়াওনিংয়ে সৈকতে গেলে দেখবে শুধু লাল আর লাল। এই রঙের কারণ সৈকতের বালু নয়। কেননা পানজিয়াং সৈকত বালুতে ঢাকা নয় বরং এক প্রকার সামুদ্রিক শৈবালে ঢাকা। চেনোপডিয়াসি পরিবারের সুয়েডা সালসা গোত্রের এই শৈবাল গ্রীষ্মকালে যদিও সবুজ থাকে, শরৎকালে উজ্জ্বল লাল বর্ণ ধারণ করে।
লাল সৈকতটি নলখাগড়ায় ভরা বড় এক জলাভূমিতে অবস্থিত। এখানে ২৬০ রকমের পাখি আর ৩৯৯ রকমের বন্য পশু ও গাছপালা মিলিয়ে তৈরি হয়েছে খুব জটিল এক ইকোসিস্টেম। এই এলাকায় পাওয়া যায় বিলুপ্তপ্রায় মুকুটধারী সারস পাখি আর কালো ঠোঁটের শঙ্খচিল। এখানে সারস পাখি এত বেশি দেখা যায় যে পানজিয়াংকে অনেক সময় সারসের ঘর বলেও ডাকা হয়। ১৯৮৮ সালে এলাকাটির গাছপালা ও পশুপাখি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন এই সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপারে দু-চার কথা বলা যাক। সুয়েডা নামের এই শৈবাল লিয়াওয়া বদ্বীপজুড়েই পাওয়া যায়। এপ্রিল বা মে মাসের দিকে জন্মানো এসব শৈবাল শরৎকালে প্রথমে থাকে কমলা, পরে গোলাপি এবং সব শেষে হয়ে যায় টকটকে লাল ।
যদি সৈকতের এই সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করার ইচ্ছা কারো থাকে, তাহলে অবশ্যই মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে জায়গাটিতে যেতে হবে। পর্যটকদের জন্য দুঃখের সংবাদ হলো, সৈকতের বেশির ভাগ অংশেই তাদের যাওয়ার অনুমতি নেই, ছোট একটু অংশ কেবল উন্মুক্ত থাকে দেখার জন্য। আর বিকেল ৫টার পর সৈকতে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষেধ, তাই যেতে হয় এর আগেই।
এটা বিশ্বের সব থেকে বড় এবং সংরক্ষিত নিম্নাঞ্চল যা কিনা সারা বছরই পানির নিচে থাকে। কিছু দূর্লভ ঘাস এবং প্রাণী এখানে পাওয়া যায় যা বিশ্বের আর কোথাও দেখা মেলে না। এখানকার ঘাসগুলো লাল হওয়ার অন্যতম কারণ হল এই জায়গার অত্যধিক লবনাক্ততা এবং মাটির মধ্যে ক্ষারের পরিমাণের ব্যাপকতা। শতাধিক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আছে এই লাল রঙের আগাছা বা ঘাস যা কিনা এই সমুদ্র সৈকতকে দিয়েছে এক অপরূপ সৈৗন্দর্য।
এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় লাল জলাশয় এই কারণেই এটি চীনদেশের অন্যতম ট্যুরিষ্ট স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সৈকতটি পৃথিবীর সবচে’ বড় লাল জলাভূমি। এখানে উল্লেখ যোগ্য কিছু পাখি পাওয়া যায় যা সত্যিকার অর্থে বিরল। যেমন, লাল মুকুট বক এবং সাউন্ডারস গাল নামের দুটি পাখির আবাসস্থল।

লাল বালুর সৈকত
ইকুয়েডরের গালাপাগোস সমুদ্র সৈকত। এখানকার সমুদ্র সৈকতের রঙও দারুণ। একেবারে লাল। আসলে এই অঞ্চলে অনেক আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আর সেটা থেকে নির্গত লাভা মিশে, সমুদ্র সৈকতের রঙ হয়ে যায় একেবারে লাল। অনেকটা সুড়কির সমুদ্র সৈকত মনে হতে পারে আপনার। লাল বালুর সৈকত গালাপাগোসের রাবিডা। কোরাল এবং আয়রন সমৃদ্ধ লাভা পানির সাথে মিশে এই সমুদ্র সৈকতের বালুর রঙ পরিবর্তন করেছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় রক্ত লাল বালুর সমাহার।

বিশ্বের চমৎকার কিছু গোলাপী সৈকত
গোলাপী রংয়ের সমুদ্র সৈকত! অবাক হওয়ার কিছু নেই, বিভিন্ন রং এর চমৎকার সৈকতের মধ্যে গোলাপী রংয়ের সমুদ্র সৈকতও আছে। এ সৈকতগুলো গোলাপী হওয়ার কিছু ব্যাখ্যা আছে অবশ্য। ছোট্ট লাল এক প্রকারের জীব এই গোলাপী রংয়ের পিছনে কাজ করে।
এই জীবগুলো শেল এবং মৃত কোরালের উপর জন্মায়। পরে এগুলো সমুদ্রের পানিতে পড়ে এবং ঢেউয়ের সাথে ধুয়ে সৈকতে চলে আসে। সৈকতের বালিতে মিশে গিয়ে একটা গোলাপী রং তৈরি করে। আবার কখনো কখনো কোরাল অথবা শেল থেকে অমেরুদ-ী জলজ জীব যেমন হার্মিট ক্রাবের ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের প্রাকৃতিক ফর্মুলেশন থেকে এই গোলাপী রং তৈরি হয়। কিছু সৈকত অনেক বেশি গোলাপী, আবার কিছু সৈকতের রং একটু ফ্যাকাসে। এসো আমরা বিস্ময়কর কয়েকটি গোলাপী সৈকতের কথা জেনে নিই।
গ্রেট সান্তা ক্রুজ আইল্যান্ড : ফিলিপাইনের জামবোঙ্গা শহরে ছোট্ট দ্বীপের নাম গ্রেট সান্তা ক্রুজ আইল্যান্ড। এটি কোরালিন বালির অপূর্ব গোলাপী সৈকত হিসেবে বিখ্যাত। এরকম সৈকত খুবই বিরল পৃথিবীতে। ফিলিপাইনের অসংখ্য চমৎকার সব সৈকতের মধ্যে গ্রেট সান্তা ক্রুজই একমাত্র গোলাপী রঙের সৈকত। লাল পিপি কোরাল বালির সাথে মিশে সৈকতটি গোলাপী রং ধারণ করেছে।
বার্মুডার গোলাপী সৈকত : ক্যারাবিয়ান সমুদ্রের এই দ্বীপটি আসলে একটি জমজ সৈকত, বার্মুডা এবং এন্টিগুয়া যা ক্যারাবিয়ান সমুদ্র এবং আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত। সৈকতের পশ্চিম দিকটি ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে এবং এর সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিচ্ছে চমৎকার গোলাপী বালি। দক্ষিণ-পশ্চিমের সৈকতটি সবচেয়ে সুন্দর। এরকম বিস্তৃত সৈকত খুব একটা দেখা যায় না, যা কিনা সূক্ষ্ম শঙ্খ-শেল রঙ আর সাদা বালির প্যাচ দিয়ে বোনা।
বালোস লেগুন বিচ অফ ক্রিট : এই চমৎকার সৈকতটি অবস্থিত গ্রীসে। উপদ্বীপটি গ্রামভাউসা এবং কোস্ট অব ক্রিটের মাঝে রয়েছে। অগভীর এবং উষ্ণ পানি গোলাপী বালির রেখা তৈরি করেছে, যা যে কোনো ভ্রমণকারীকে অবাক করে দেবে। সূক্ষè এই গোলাপী রং তৈরি হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন শেলের গুঁড়ো বালিতে মিশে। সৈকতে প্রচুর পাথর আর ক্লিফ রয়েছে যা উপদ্বীপটিকে ধরে রেখেছে।
টাংসি বিচ অফ লমবক : পশ্চিম নুসা টেঙ্গারার ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ হল লমবক। এটি লেসার সান্দা দ্বীপের একটি অংশ। এর টাংগী সৈকত বা গোলাপী সৈকত পৃথিবীর অন্য সব সৈকত থেকে আলাদা। এর এই অসাধারণ রং এসেছে কোরাল রীফের ভাঙন থেকে। এটি এতই প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত যে এখানে পর্যটক খুব একটা আসে না। তাই নির্জনতার সমূহ স্বাদ পাওয়া যায় এখানে, আর দেখতে পাওয়া যায় নয়নাভিরাম দৃশ্য।
বোনাইর গোলাপী সৈকত : ক্যারাবিয়ান দ্বীপে অবস্থিত লিউয়ার্ড এন্টাইলস-এর সৈকত এটি, যা একত্রে আরুবা এবং কুরাকাওয়ের সাথে মিলে সাউথ আমেরিকার এ বি সি আইল্যান্ড তৈরি করেছে। বিচিত্র সব দৃশ্যের সমাহার এই সৈকতটি পর্যটক মনে তৈরি করে ভিন্ন এক আবেদন। মিহি গোলাপী বালি, অসীম আকাশ আর সমুদ্রের নীল সব মিলিয়ে বোনাইর সৈকত মন ভরিয়ে দেয় স্নিগ্ধতায়।
গোলাপি বালির সৈকত, বাহামা : একেবারে ঝকঝকে গোলাপি বালির সৈকত দেখতে হলে যেতে হবে বাহামায়। বাহামার অসংখ্য চমৎকার সৈকতের মধ্যে গোলাপি বালির সৈকতটি আকর্ষণ করে সবাইকে। ৩ মাইল দীর্ঘ সৈকতটি যেন শান্তির ওপর নাম। সমুদ্রের পানি এখানে উষ্ণ এবং শান্ত। এই সৈকত গোলাপী হওয়ার কিছু ব্যাখ্যা আছে অবশ্য। ছোট্ট লাল এক প্রকারের জীব এই গোলাপী রং এর জন্য দায়ী। এই জীবগুলো শেল এবং মৃত কোরালের উপর জন্মায়। পরে সেই শেল বা কোরালগুলো সমুদ্রের পানিতে পড়ে এবং ঢেউয়ের সাথে ধুয়ে সৈকতে চলে আসে। অসংখ্য গোলাপি শেল এবং কোরাল বালির সাথে মিশে একটা গোলাপি রং তৈরি হয়।
পাপাকোলিয়া সবুজ বালির সৈকত, হাওয়াই : ঘাস ও গাছের পাতা সবুজ হয়, কিছু কিছু প্রানীর গায়ের রংও হয় সবুজ। বালিও কিনা সবুজ রঙের হয়? একেবারে গুড়ো ঘাসের মত সারা সৈকতজুড়ে এই বালি যেন রচনা করেছে এক অনন্য কবিতা। মিশেছে সমুদ্রের নীলের সাথে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ঘন ঘাসে ঢাকা কোন মাঠ সমাপ্তি খুঁজে নিয়েছে সমূদ্রে অথবা মাঠকে গ্রাস করছে উত্তাল ফেনিল স্রোতরাশি। লাভা দ্বারা গঠিত মিনারেল অলিভাইন যা কিনা সমুদ্রের পানি দিয়ে শীতল হয়েছে কালক্রমে তা এই সবুজ রং ধারণ করেছে।
পুনালু কালো বালির বিচ, হাওয়াই : এক হাওয়াইতে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও বিস্ময়। এবার বালির রং একেবারে কালো। বাসল্ট লাভার কারণে বিচের বালির রং হয়েছে কুচকুচে কালো। তপ্ত লাভা যতই পেয়েছে সমূদ্রের শীতলতার স্পর্শ ততই পরিণত হয়েছে বালিতে এবং রং হয়েছে গভীর নিকশ রাতের মত অন্ধকার। হাওয়াই ভ্রমণে বিচই আকর্ষণ। তার মাঝে এই বৈচিত্র মুগ্ধ করবে আপনাকে। কালো বালির সৈকতের এক পাশে নীলাভ সমুদ্র আর আরেক পাশে সবুজ গাছের সারি, ঘন বন। অদ্ভুৎ রঙের বিন্যাস অবাক করে ভ্রমণকারীদের আজও।

Share.

মন্তব্য করুন