আগামীর প্রাণীবিদ বন্ধুরা, আজকে তোমাদের জন্য কুমিরের জাত ভাই ঘড়িয়াল নিয়ে লিখবো। লেখাটি পড়লে তোমাদের অনেক কিছু জানা হবে। আর জানা হলে ভালোও লাগবে আশা করি। সোনামণিরা ঘড়িয়াল হল কর্ডাটা পর্বের কুমির বর্গের মিঠাপানির সরীসৃপ প্রাণী। এ প্রাণীটির শ্রেণীবিন্যাসগত অবস্থান নিম্নরূপ-
জগৎ-Animalia
পর্ব- কর্ডাটা
শ্রেণী – সরীসৃপ
বর্গ-Crocodilia
পরিবার-Gavialidae
গণ-Gavialis
প্রজাতি-Gavialis gangeticus
অর্থাৎ এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানীক নাম হল Gavialis gangeticus এটি আর্ন্তজাতিক নাম। সারা বিশ্বের মানুষ একে এই নামেই চেনে। এর ইংরেজী নাম হল Gharial বা Gavial। ঘড়িয়ালকে ঘাড়েল, বাইশাল, মেছো কুমির ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
এ প্রাণীটিকে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্থান, মিয়ানমার ও ভুটানের মিঠা পানির নদ নদীতে পাওয়া গেলেও এদের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে কমে গেছে। ফলে এটি অত্যান্ত বিপন্ন প্রাণী। এটি IUCN এর বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর সংকলন Red Data Book -এ স্থান পেয়েছে। যেটা কোন ভালো ও সুখের কথা নয়। এখানে তখনই কোন প্রাণীর নাম তালিকাভুক্ত হয় যখন প্রাণীটির অবস্থা খুব খারাপ হয়। অর্থাৎ প্রাণীটির সংখ্যা সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। সহজে দেখা পাওয়া যায় না। ঘড়িয়ালও এখন আমাদের কাছে এরকম একটি প্রাণী। একে সহজে দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাজশাহীর পদ্মা নদীতে এটি এক সময় বেশ দেখা যেত কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না। দু একটি যা চোখে পড়ে সেটা চিড়িয়াখানাতে। এ প্রসংগে একটি ছড়া শোন-
‘রাজশাহীতে ঘড়িয়ালের নেই তো এখন বাসা
মিঠা প্রাণীর এই প্রাণীটা ছাড়ছে বাঁচার আশা।
কমছে শুধু কমছে
ভয়ে ভয়ে জমছে
বিপন্নতায় ঘড়িয়ালটা হচ্ছে তামা কাঁসা।’
ছোট্ট বন্ধুরা, এরা মিঠা পানিতে বসবাস করলেও ডাঙাতেও চলাফেরা করতে পারে। ডাঙাতে বুকে ভর দিয়ে চারপায়ে হাঁটে এরা। এই জন্য এদের সরীসৃপ বলে।
বাংলাদেশে তিন প্রজাতির কুমির পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যে কুমিরটির চোয়াল সবচেয়ে চিকন ও বেশী লম্বা সেটাই ঘড়িয়াল। এদের দেহের মোট দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়। আর বড় ঘড়িয়ালের চোয়াল বা তুন্ড (Snout) ৪-৫ ফুট লম্বা হয়। প্রত্যেক চোয়ালের পাশ ঘেঁষে মোটামুটি একই আকারের ৪৪ থেকে ৪৮ টি দাঁত থাকে। এরা মুখ বন্ধ করে থাকলেও দাঁতগুলো বাহির থেকে দেখা যায়। মুখের হা অনেক দীর্ঘ হয়। জিহবা নীচের তালুর সাথে আটকানো থাকায় এরা ইচ্ছামত জিহবা বের করতে পারে না। টিকটিকি ও সাপরা যেমন পারে তেমনটি এরা পারে না।
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ঘড়িয়ালের পেটের ভেতর যখন ডিম বড় হয় তখন বিলম্ব না করে এরা ডাঙ্গায় উঠে এসে বালির ভেতর ২-৩ ফুট গভীর গর্ত করে তাতে ৪০-৫০ টি ডিম পারে। তারপর বালি দিয়ে ঢেকে দেয়। ঘড়িয়ালরা ডিমে তা দেয় না মুরগীর মতন। বালির উত্তাপেই ডিম ফোটে। মা ঘড়িয়াল ডিমে তাপ না দিলেও বাসার আশপাশে থাকে। অর্থাৎ বাসা পাহারা দেয়। বাচ্চা ফুটে গেলে মা ঘড়িয়ালকেই বাচ্চা বের করার পথ তৈরী করে দিতে হয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হতে সময় লাগে ৬০-৭৫ দিন। ঘড়িয়ালের বাচ্চারা গর্ত থেকে বের হয়েই পানির দিকে ছুটে যায়। কোন কোনটা আবার মায়ের পিঠে চেপে বসে। মা কুমির এগুলোকে পানিতে নিয়ে যায়। মা ঘড়িয়াল কয়েক সপ্তাহ বাচ্চাদের যন্ত নেয়। তারপর আর মা ছেলে মেয়েদের পরিচয় থাকে না। পর হয়ে যায়। কোন সময় সামনে পড়লে নিজের বাচ্চাও পর মনে করে খেয়ে ফেলে। ঘড়িয়ালরা সাধারণত সর্বভূক হয়। এরা সবচেয়ে বেশী খায় মাছ। স্তন্যপায়ী ও নানা কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। এরা সাধারণত ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
সমগ্র পৃথিবীতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্তমানে প্রায় দুইশতটির মত বুনো ঘড়িয়াল রয়েছে বলা হচ্ছে। আর এ রিপোর্টটি ফেব্রুয়ারী ১১সালের। তবে বাস্তবে কতটা রয়েছে তাতো তোমরা বুঝতেই পারছো কিছুটা এ আলোচনা থেকে।
বন্ধুরা, এই ঘড়িয়াল কমে যাবার নানা কারণ রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো।
১। এদের চামড়া, হাড়, মাংস ও দাঁত অত্যন্ত মূল্যবান ফলে মানুষের হিং¯্রতায় এগুলো শিকার হয়েছে নির্বিচারে।
২। নদ-নদীগুলো মরে যাওয়ার ফলে আবাসস্থল অর্থাৎ বসবাসের স্থান নষ্ট হওয়া।
৩। খাদ্য সংকট।
৪। নদী দূষণ তথা পানি দূষণ।
৫। অভয়াশ্রম বা নির্দিষ্ট জায়গা তৈরী করে তাতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করা।
৬। বন্যপ্রাণী নিধন আইন থাকলেও সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা।
বন্ধুরা, তোমরা ঘড়িয়াল কমে যাবার কারণগুলো মনে রাখবে। আর যে কারণে কমে যাচ্ছে সেসব কাজ থেকে অবশ্যই নিজে বিরত থাকবে। অন্যকেও বিরত থাকতে বলবে। তবেই ঘড়িয়াল প্রকৃতিতে থাকবে, পরিবেশ ভালো থাকবে।