ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রাম ঘেঁষে পাহাড়ি নদী তিরতির করে বয়ে
গেছে। সেই নদীর পাড়ে একটা ঘর। দোচালা কাঠের ঘর। বেশ
মজবুত করে ঘরের চারপাশে কাঠের বেড়া দেয়া।
সেইঘরে থাকে ছোট্ট এক মেয়ে, নাম পাপু। মেয়ে তো নয় যেন
একটা ফুটন্ত গোলাপ। হাসি তার ঠোঁটে সব সময় লেগেই আছে।
কিন্তু এত সব হলে কী হবে, আত্মীয় বলতে এ দুনিয়ায় তার কেউ
নেই।
তার সঙ্গী বলো আর সাথি বলো, আছে মাত্র দু’জন। জন আর টুটু।
লোম ঝুমঝুম কুকুরছানা আর হলুদ করবী ফুলের মতো তুলতুলে
মোরগছানা।
জন আর টুটু পাপুর সব সময়ের সাথি। তারা পাপুর সব
ফাইফরমাশ খাটতেও এক পায়ে খাড়া। এছাড়াও পাপুর আর
একজন বন্ধু আছে। সে হচ্ছে নদী পার হয়ে ক্যাকটাস ঝোপ রেখে
হ্রদের পাড়ের নীল ঘণ্টি ফুল। ঘণ্টি ফুল হাওয়ায় দোলে আর মাথা
দুলিয়ে গান করে।
শীতের সকালে পাপু তার আদরের কুকুর আর মুরগি ছানাকে খেতে
দিচ্ছিল। টুটু জনের চেয়ে বেশি ছটফটে। খাবার সময় গোলমাল
করছিল বেশি। তাই মাঝে মাঝে ধমকও খাচ্ছিল পাপুর কাছে।
অবশ্য জন আর টুটু জানে এগুলো হচ্ছে পাপুর আদরের ধমক।এদিকে হয়েছে কী, ওই নদীতে বাস করত এক কুমির। সে ছিল ভয়ানক
লোভী। সব সময় ভাবত এটা খাবে, ওটা খাবে। একদিন কী করে তার
নজর পড়ল পাপুর ওপর। কিন্তু পাপুকে বাগে আনবার কোনো রকম
সুযোগই পাচ্ছিল না সে।
সেদিন সকালবেলা পাপু যখন তার ছোট্ট বন্ধুদের খাওয়াচ্ছিল তখন বেড়ার
ফাঁক দিয়ে জুলজুল চোখে দেখছিল পাপুকে। আর মনে মনে ভাবছিল ওই
মেয়েটিকে খেতে নিশ্চয়ই খুব সুস্বাদু হবে! কিন্তু ঘরের চারপাশে কাঠের
বেড়াটাই বড় বাধা। কোনো মতেই ওর ভেতর মাথা গলানো যায় না।
বেড়ার ভেতর থেকে একবার বের হলে হয়। এই ভেবে সে নদীতে গিয়ে
নামলো। আর নজর রাখতে লাগল, কখন পাপু ঘর থেকে বের হয়।
পাপু, জন আর টুটুকে খাইয়ে দাইয়ে মনে করল আজ একবার ঘণ্টি ফুলের
কাছে যাবে। বেশ কয়েক দিন হলো সেখানে যাওয়া হয়নি। অথচ প্রতিদিন
তার ঘন্টি ফুলের কাছে একটিবার যাওয়া চাই-ই চাই।
সেখানে গিয়ে পাপু ঘণ্টি ফুলের সাথে গল্প করে। ঘণ্টি ফুলের গান শোনে।
তারপর এক পাত্র পানি ফুল গাছের গোড়ায় ঢেলে দেয়। আজ তাই পাপু
সকাল সকাল একটা পাত্র আর জন- টুটুুকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল।
ওদিকে কুমিরও তক্কে তক্কে আছে। মেয়েটা বের হলেই হয়। কিন্তু যখন
দেখল পাপু নদীর পাড় দিয়ে না গিয়ে অন্য পথে রওনা হয়েছে। তখন মনে
মনে চিন্তা করল এখন কী করি?
শেষে অনেক ভেবে চিন্তে যে পথে পাপুরা যাচ্ছে তার মাঝখানে এক হাতে
একটা কলার পাতা নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে রইল। কুমির মনে মনে ভাবল
আমি যেভাবে দাঁড়িয়ে আছি তাতে পাপু ভাববে সত্যি বুঝি একটা
কলাগাছ। অতএব নির্ভাবনায় পাশ দিয়ে যাবে। আর অমনি ওকে ধরে
একেবারে নদীর ভেতর নিয়ে যাবো। এই সব ভেবে সে অপেক্ষা করতে
লাগল।
পাপু পথ দিয়ে খানিক দূরে এসে তো অবাক! দেখে পথের মাঝে মস্ত একগাছ। অথচ একটি পাতা ছাড়া তার অন্য কোনো পাতা
নাই।
সে ভাবল এমন অদ্ভুত কোনো গাছ আছে বলে তো জানি
না! আরো একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারল, এ নদীর সেই
বুড়ো কুমির। অমনি বাঁচাও বাঁচাও বলে জন আর টুটুকে
নিয়ে দে ছুট। কুমিরও ধাওয়া করল বটে কিন্তু পাপুদের
সাথে দৌড়ে পেরে উঠল না।
প্রথম চেষ্টা যে এইভাবে বানচাল হয়ে যাবে কুমির তা
ভাবতে পারেনি। ভাবতে লাগল কী করে ফের পাপুকে
ধোঁকা দিয়ে কাছে আনা যায়। এবার কুমির অনেক চিন্তা
করে অন্য উপায় ঠিক করল। ঘণ্টি ফুলের কাছে যেতে যে
নালা আছে ওর ওপর চিত হয়ে সাঁকোর মতো হয়ে
থাকবে। তারপর গায়ের ওপর দিয়ে একবার গেলেই
হয়। কথাটা ভেবে মনে মনে পুলকিত হলো সে।
পাপু নালার কাছে এলো। পুলের ওপর উঠতে যাবে প্রায়।
এমন সময় তার মনে পড়ল এ নালার ওপর তো কোনদিন
সাঁকো ছিল না। এটা হলো কবে? একটু লক্ষ করে দেখে,
ওমা এ সে সেই বুড়ো কুমির! সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে
দৌড় আর দৌড়। ছুটতে ছুটতে ঘোরা পথে ঘণ্টি ফুলের
কাছে সবাই এলো। তারপর আদর করে পাপু ঘণ্টি ফুলের
ওপর পানি ঢেলে দিল। ঘণ্টি ফুল এতদিনের অভিমান
ভুলে খুশি মনে মাথা দোলাতে লাগল। পাশে বসে জন
আর টুটু সব দেখতে লাগল দুষ্টুমি ভরা চোখে।
এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো এক জলহস্তী।
সে পাপুকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল- কেমন
আছো পাপু সোনা? অনেকদিন দেখা হয়নি তোমার
সাথে। মনটা ছটফট করে। আসলে কি জানো, আমি
হলাম তোমার সবচাইতে বড় বন্ধু। কারণ আমি এদের
সবার চেয়ে আকারে বড়। তাই বন্ধু হিসাবেও আমি বড়।
হিপোর কথা শুনে জন, টুটু ও ঘণ্টি ফুল দুঃখে অভিমানে
মাথা নোয়াল। পাপুরও খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু এ
মুহূর্তে সে কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না।
আসলে সে তো তার ছোট্ট বন্ধুদের খুব ভালোবাসে।
হিপো আবার বলল, পাপু হেঁটে আসতে নিশ্চয়ই তোমার
কষ্ট হয়েছে। তোমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে
পাচ্ছি। চলো ওই ঝোপের কাছে যাই।
তারপর পাশের ঝোপের কাছে গেল দু’জন। ক্যাকটাস
ঝোপের কাছের কাঠের গুঁড়ির মতো কী একটা ছিল।
হিপো ওটা দেখিয়ে বলল-চলো ওই কাঠের গুঁড়িতেই
বসি। মজা করে গল্প করব দু’জন।
আসলে কিন্তু ওটা কাঠের গুঁড়ি নয়। ওটা হচ্ছে সেই বুড়ো
কুমিরের লেজ। সে কখন যেন চুপি চুপি এসে ক্যাকটাস
ঝোপটার ভেতর মাথা সেঁধিয়ে কেবল লেজটা বের করে
পড়ে আছে। কেউ জানে না।
পাপু যেই গুঁড়িটার ওপর বসল, অমনি কুমির মাথা ঘুরিয়ে
পাপুর জামার কোনা কামড়ে ধরল। তারপর হ্রদের দিকে
টেনে নিয়ে যেতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পাপু চেঁচিয়ে উঠে
বলল- হিপো, আমাকে বাঁচাও বাঁচাও। নইলে কুমির
আমাকে খেয়ে ফেলবে।
হিপো পাপুকে বাঁচাবে কী; এসব দেখে সে দিল দৌড়।
আর যাবার সময় বলে গেল, আমি বাঁচাতে পারব না।
কারণ আমি তোমাকে বাঁচাতে গেল কুমির আমাকেই
খেয়ে ফেলবে। আর আমি মারা গেলে তুমি একজন বড়
এবং ভালো বন্ধু হারাবে। আমি চললাম।
হ্রদের পাশেই নীল ঘণ্টি ফুলের গাছ। সে পাপুর ওই
অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে একটা ডাল পাপুুর দিকে এগিয়ে
দিল। আর তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, জন, টুটু কোথায়
তোমরা? শিগগির এসো। আমাদের বন্ধুকে পাজি কুমিরে
ধরেছে।
ঘণ্টি ফুলের চিৎকার শুনে জন, টুটু ছুটে এলো। এসে
দেখে কুমির পাপুকে বেশ খানিকটা পানির ভেতর টেনে
নিয়ে গেছে। সে কোনোক্রমে ঘণ্টি ফুলের ডাল ধরে
আছে। ভয়ে পাপুর মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
কাছে এসেই জন সামনের পা দুটো দিয়ে পাপুর কোমর
জড়িয়ে ধরল। আর টুটু ধরে থাকল জনের লেজ। তারপর
দুদিকে থেকে টানাটানি শুরু হলো। কুমির প্রাণপণ
শক্তিতে পাপুকে টানতে লাগল।
কিন্তু পারবে কেন? জন, টুটু আর ঘণ্টি ফুল ছোট হলে কী
হবে, এরা যে পাপুকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি
ভালোবাসে। তাই সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে তাকে হ্রদের
পাড়ে উঠাতে পারল। ওই হ্রদে ছিল দুটো ব্যাঙ। তারা
এসব দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলে উঠল,
পোড়ামুখো কুমির তোকে দুয়ো, দুয়ো।
এতসব কা-ের পর হিপো দৌড়ে ফিরে এলো, সে দূরে
দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এসেই সে পাপুকে বলল, ঈশ্বরকে
অনেক ধন্যবাদ, কুমির তোমাকে নিয়ে যেতে পারেনি।
বিশ্বাস করো আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। কারণ
আমি তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
এ কথা শুনে পাপু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, না,
তুমি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু নও, তুমি আমার কেউ
নও। নিজের দিকে চেয়ে দেখো, কত বড় তুমি। কত
শক্তিশালী তুমি। অথচ যখন আমি বিপদে পড়েছি তখন
তুমি স্বার্থপরের মতো পালিয়ে গেলে। এতেই বুঝেছি
তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু নও। তুমি হীন, তুমি স্বার্থপর।
তোমার মুখ দেখতেও চাই না। তুমি এক্ষুনি এ জায়গা
ছেড়ে চলে যাও। হতে পারে ঘণ্টি ফুল, জন, টুটু এরা
ছোট। কিন্তু নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও এরা কিভাবে
আমাকে রক্ষা করেছে সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছ।
এরাই আমার প্রকৃত বন্ধু। এরাই আমার সবচাইতে বড়
বন্ধু।
এই বলে পাপু জন, টুটু আর ঘণ্টি ফুলকে আদর করতে
লাগল। হিপো এইসব দেখেশুনে কাঁদতে কাঁদতে আস্তে
আস্তে দূরে চলে গেল।
(রুশ দেশের উপকথা)

Share.

মন্তব্য করুন