প্রাণীটা লাল শুঁড় উঁচিয়ে হাতির মতো অলস ভঙ্গিতে বসে আছে একটা কাঁচের অ্যাকোরিয়ামে। অ্যাকোরিয়ামটা গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত। জন্ম হওয়ার আগ মুহূর্তে একটি জলজ স্যানিটোরিয়ামে ছিলো তার দেহ। আর মস্তিষ্ক ছিলো অজানা জলশূন্য জায়গায়। শ্বেতকায় হাতির মতো শুঁড় অথচ লাল। প্রাণীটা বহুবার জলজ স্যানিটোরিয়ামে ছিলো, এক দেহ বহু প্রাণীর মস্তিষ্ক বহন করেছে, পরীক্ষার গিনিপিগ হয়েছে, তেমনই একটি পরিক্ষা সম্ভবত হচ্ছে। রাজকীয় ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখ শীতল করে তাকিয়ে থাকলো খাদ্যের আশায়। ক্ষুধা লাগলে মস্তিষ্ক অনেক অজানা বিষয় নিয়ে ভাবে। প্রাণীটা ভাবছে নিজের শরীর নিয়ে। দেহ বলছে- বহুবার এই অ্যাকোরিয়ামে সে এসেছে অথচ মস্তিষ্ক বলছে মাত্র জম্ম নিয়েছে সে। শিশুর মস্তিষ্ক বৃদ্ধের দেহে প্রবেশ করালে যেমনটা হবে ঠিক তেমন ব্যাপার ঘটছে এখন। তার চেনা পরিবেশ স্থল, অথচ জলের ক্ষুদ্র এক প্রাণীর দেহে বাস, ব্যাপারটা তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছে না। অলস দেখা গেলেও মূলত প্রাণীটা গভীরভাবে ভাবছে, তার গরম মাংস দরকার, প্রচুর প্রোটিন দরকার, প্রচন্ড দুর্বল লাগছে।
অ্যাকোরিয়ামের গা ঘেঁষে দু’একটা প্লাঙ্ক জাতীয় ক্ষুদ্র মাছ ছোটাছুটি করছে এদিক সেদিক। গভীর সমুদ্র যেন নিজেই একটা অ্যাকোরিয়াম। আর অ্যাকোরিয়ামের ভেতর আরেকটা ছোট্ট অ্যাকোরিয়ামে দুইটা সত্ত্বা বন্দি। একটা প্রাণী আরেকটা মস্তিষ্ক। অ্যাকোরিয়ামের চারপাশে আলোড়ন তুলে বারবার মাছেরা গুঁতোগুঁতি করছে। কোনো কোনো প্রাণী একটু কৌতূহলী হয়ে নিবিড়ভাবে দেখছে, আবার কোনটা বিরক্ত করতে চেষ্টা করছে। তিমি ছাড়া সমুদ্রের প্রায় বেশিরভাগ প্রাণী শব্দ করতে পাওে না। যদি এগুলো শব্দ করতে পারতো তাহলে খুব বিরক্ত করতো। প্রাণীটার খুব ক্ষুধা লেগেছে , ইচ্ছা করছে দৌড় দিয়ে পাঁচ ছয় গ্রাস প্লাঙ্ক খেয়ে উদরপূর্তি করতে। অথচ সে একটি কাঁচঘরে বন্দি। বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। সেখানে গা লেপ্টে আছে একটা অক্টোপাস।
অক্টোপাসটা কি খাওয়া যায়? প্রাণীটার দেহ চনমনে হয়ে উঠলো, ঘাপটি মেরে বাঘের ভঙ্গিতে বসলো। চিতাবাঘের মতো রণকৌশল ঠিক করছে যেন। অক্টোপাসটার কর্ষিকা বার বার লোপ হচ্ছে, পালানোর অথবা শিকারের আগমূহুর্তে এমন করে ওরা। থলথলে কর্ষিকাগুলো যেন রসে টস টস করছে। অনেকটা টক কিংবা লোভাতুর জিনিস খাওয়ার আগে যেমনটা হয়। তার মানে শিকারেরই প্রস্তুতি নিচ্ছে, ধীরে ধীরে অক্টোপাসের রং পাল্টাচ্ছে। ক্যামোফ্লেজ করে নিজেকে লুকিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরার জন্য এ ভঙ্গি। ভঙ্গিটা মনে হচ্ছে নির্লিপ্ত। কারণ তার শিকার একটা শক্ত অ্যাকোরিয়ামের ভেতর। নিরীহ গোবেচারা ধরনের জুলজুলে চোখ নিয়ে অক্টোপাসটা তাকিয়ে আছে প্রাণীটার দিকে। প্রাণীটাও প্রায় একই দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
নীলাভ টিমটিমে আলো ছুঁড়ে একটা প্রাণী এগিয়ে আসছে। টিমটিমে আলোটা ধীরে ধীরে প্রখর হচ্ছে, যেন চল্লিশ ভোল্টের টর্চলাইট। আলো আরো বাড়লো। প্রাণীটার চোখের আলোকসংবেদী কোষ জ্বলে উঠলো। অন্ধের মতো একটা অনুভুতি হলো যেন। চোখ যখন সয়ে এসেছে তখন সমুদ্র তলদেশ গরম হচ্ছে। ছোটো ছোটো চক্রাকারে এদিক-সেদিক পানির ঘূর্ণন দেখা যাচ্ছে। আশেপাশেই হয়তো কোনো একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্ম হচ্ছে। অ্যাকোরিয়ামটা ঘুরতে ঘুরতে এদিক-সেদিক যাচ্ছে পানির ঘূর্ণনের সাথে। ঘূর্ণনের বেগ বাড়ছে। সব মাছেরা যেন গোপন কোনো আশ্রয়ে লুকিয়ে গেছে পূর্বাভাস আঁচ করতে পেরে। অ্যাকোরিয়াম পানির স্তরগুলো ঘূর্ণনের সাথে অতিক্রম করছে, পরিভ্রমণ করছে যেন।
প্রাণীটা বড়ো ধরনের ব্যাঙের মতো বার কয়েক লাফ দিয়ে অ্যাকোরিয়ামের দেয়ালে বাড়ি খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কারো গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সে যদি দৌড় দেয় এবং বাতাসের সংস্পর্শে আশে, তখন আগুন যেমন আরো ছাড়িয়ে পড়ে, তেমনি প্রাণীটা দুলুনির সাথে আরো জোরে জোরে বাড়ি খেতে থাকলো। শুরু হলো তুমুল ঘূর্ণি। সমুদ্রের পানি যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ক্ষেপে গেছে, কেউ যেন কষে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে অ্যাকোরিয়ামটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অজানার পথে। গভীর সমুদ্র যেন প্রলয়ঙ্করী ও ভয়ঙ্কর কেয়ামতের মতো সমুদ্রগর্ভ থেকে উগরে দিচ্ছে সবকিছু।
২.
ঝড়ে ল-ভ- হয়ে আছে সোনাদিয়া দ্বীপ। সব নৌকা ঘাঁটে ফিরলেও হরিদাশের নৌকা এখনো নোঙর করেনি। সারাবেলা খোজাখুঁজির পর হরিদাশের স্ত্রী সখিবালা লক্ষ্মী আরতির বন্দোবস্ত করেছে। লক্ষ্মী দেবীকে পূজো দিলে হরিদাশের সদগতি হবে। পূজোর ধুপ ধুনো আর শখের ডাক মাঝ দরিয়া থেকে পেয়েই বুঝি ফিরে এলো হরিদাশের নৌকা। কিন্তু নৌকায় হরিদাশ নেই, শুধু নৌকার গলুইয়ে পড়ে আছে ভাঙা কিছু কাঁচ। হরিদাশের ছোটো ছেলেটা মাছ দেখলেই খলবল করে উঠতো। নৌকার গলুই ভর্তি মাছগুলো নিয়ে পুতুল পুতুল খেলতো। হরিদাশ হাটে নিয়ে মাছ বেচে কখনো মা লক্ষ্মীর পুতুল আবার কখনো কৃষ্ণ রাধার পুতুল কিনে আনতো।
সুশান্ত সারাদিন সেসব নিয়ে পড়ে থাকতো। খেলনা মন্দির বানিয়ে পূজো দিতো। আজ সব কেমন বিমর্ষ হয়ে আছে, চিমশানো কিশমিশের মত পাংশু হয়ে আছে মুখ। বেচারা অনেকক্ষণ ধওে কাঁদতে কাঁদতে এখন আর কাঁদতে পারছে না। সুশান্ত বার বার খেলনা লক্ষ্মীটা বের করে বলছে ‘এ্যাই মা, বাপরে কনে নিলি?’
প্রাণীটা মুক্ত বাতাসের শ্বাস নিচ্ছে, সব বাতাস যেন শুষে ফেলবে। বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ। ধীরে ধীরে দুলতে দুলতে নৌকার গলুই থেকে নেমে এলো। সাগরের দিকে স্থির চোখে তাকালো, এই ঝড় তাকে মুক্তি দিয়েছে। তাকে আর স্যানিটোরিয়ামের ছুরির নিচে যেতে হবে না। তার দেহে আর অন্যকোনো প্রাণীর মস্তিস্ক প্রতিস্থাপিত হবে না। স্মৃতি হাতড়ে সে নিজেকে খুঁজে পেতে চাইলো। আসলে সে কি ছিলো এবং কেমন ছিলো। চোখের সামনে শুঁড় তুলে ধরে নিজেকে অদ্ভুত চোখে দেখতে লাগলো। লাল ডোরাকাটা শুঁড়টা কিলবিল করছে যেন। পোষ মানছে না তার। মস্তিষ্কের কমান্ড ভালোভাবে নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে নির্জীব হয়ে যাচ্ছে, আবার সচল হচ্ছে।
সমুদ্রের দিকে আবার তাকালো। ভয়ঙ্কর এক শব্দ করলো। এ শব্দের তীব্রতা কুড়ি হাজার হার্জের বেশি। মানুষের কান কুড়ি হার্জ থেকে কুড়ি হাজার হার্জের মধ্যে শুনতে পারে। এই শব্দ শুনলে যে কেউ হার্টফেল করতো। প্রাণীটি কি সমুদ্রকে বিদায় জানাচ্ছে? নাকি ভর্ৎসনা করছে। এ সমুদ্র তাকে নিয়ে বার বার খেলছে। স্থলের প্রাণী জলে কেমন আচরণ করে তা দেখার জন্য তাকে গিনিপিগ হতে হয়েছে, তার শরীর বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ছুরির আঘাতে। প্রাণীটার মুখ কুঁচকে উঠলো, সংকোচিত হয়ে এলো চোখ। সম্ভবত সে কাঁদতে চাইছে। জলের কোনো প্রাণী স্থলের প্রাাণীদের মতো কাঁদতে পারে না। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, প্রাণীটার অশ্রুগ্রন্থি যেন সচল হলো। চোখ ভিজেও উঠলো একটু।
হরিদাশের ছোট্ট ছেলে সুশান্ত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে গভীর ঘুম। খুব ছোট থাকতে হরিদাশ সুশান্তকে এভাবেই সাঁতার কাটা শিখিয়েছিলো। সুশান্ত যেন ঘুমের ঘোরে সেই সময়ে ফিরে গেছে, আস্তে ধীরে সাঁতার কাটছে। বাবা তার পেটের তলায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সুশান্তের কাতুকুতু লাগছে, সে ঘুমের মাঝে খিল খিল করে হাসছে। সখিবালা আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সুশান্তের গায়ে। সিঁদূর মুছে গেছে কপাল থেকে। শঙ্খবালা, নাকফুল সব খুলে নিরাভরন সখিবালা ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে আছেন। সুশান্তকে বাপের মাছ ধরার পেশায় যেতে দেওয়া যাবে না। মানুষ খেকো সমুদ্র তার সন্তানকেও কেড়ে নিতে পারে।
আর সুশান্ত? ঘুমের ঘোরে বৈঠার ছপাছপ শব্দ শুনে, ধীরে ধীরে সাগরের দিকে এগিয়ে যায়। মাছের বিশাল বিশাল ঝাঁকের ভেতর তার নৌকা টেনে সেয়ানা মাছগুলো গলুইতে রেখে আবার জাল টানে। তার চোখে স্বপ্নের মতো কিলবিল করতে থাকে হাজারো মাছ। সে স্বপ্নের সমুদ্রে ভয় থাকে না। জলোচ্ছ্বাসের মতো উচ্ছাস থাকে।
৩.
না, লোকালয়ে কোনো বাঘ-ভালুক ঢোকেনি। অথচ একের পর এক সাবাড় হয়ে যাচ্ছে গবাদিপশু, গ্রাামে ছড়াচ্ছে নানারকম মিথ। রাখাল বালকের গল্পের মতো বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে বলে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের। কেউ বলে দানব পড়েছে গ্রামে, জলের দানব নাকি ঘূর্ণিঝড়ের সাথে সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসেছে। দানব নাকি শিকল পরে জলাশয়ে লুকিয়ে থাকে। কোনো কোনো রাতে শেকলের ঝম ঝম আওয়াজ শোনা যায়। নিধিরাম মাঝির ছোট্ট মেয়েটি পানিতে ডুবে গেলো যেদিন, সেদিন থেকে ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো। পুরো জেলেপাড়ার একান-ওকান ফুসফাস, জলদানব জলদানব…।
মাছ ধরা ক্ষান্ত দিয়েছে নিতাইসহ আট-দশজন মাঝি। সুশীল মাঝি দিন কয়েক আগে মাছ ধরতে গিয়ে নৌকার গলুইতে বড়ো ধরনের খামচানোর দাগ পায়। ঐদিন থেকে তার নাওয়া খাওয়া শেষ। ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে থাকা কুপি। আগে প্রচুর নৌকা মাছ ধরতে যেতো। সন্ধ্যা হলেই মাছের ঝাঁক নামতে দেখা যেতো। মাঝ সমুদ্রের নৌকাগুলো থেকে টিমটিমে আলো এক নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করতো। এখন কেমন বিরান কালো মরুদ্যানের মতো খা-খা করছে সমুদ্র।
ঝড় অনেকবার হয়েছে, তবে সমুদ্র দৈত্যের এমন ভয় আদৌ কোনোবার ছড়ায়নি। দিন দু’য়েক যেতে না যেতে ঘরে ঘরে কান্নার রোল থামিয়ে দিচ্ছে মাঝিদের জীবন। আসলে কি সমুদ্র-দৈত্য বলে কিছু আছে? নাকি ব্যাপারটা কাকতালীয়, কে জানে। সমুদ্র পাড় থেকে ধীরে ধীরে পাততাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে জেলে পাড়ার মানুষরা। এদিন অমুক যাচ্ছে তো ঐদিন অমুক যাচ্ছে। এভাবেই বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একটি জেলে পাড়া! কিন্তু কিছু যুবক তো সাহসী থাকে, নিতাইরামের মেঝো ছেলেটা ক্ষুদিরাম, দশ বাড়ি হল্লা করে মাঝিদের জড়ো করলো। সে বললো-‘আমাগোরে আবার সমুদ্রে যাওন লাগবো, সমুদ্র আমাগো খাওন দ্যায়, সমুদ্রের কাছে বারবার ধরনা দেওন লাগবো। সমুদ্র আমাগো বাপ। চল আবার ল, আবার যাই।’ ক্ষুদিরামরা আট মাঝি আবার দাঁড় ছাড়লো। ক্ষুদিরামরা কি ফিরতে পেরেছে? কে জানে!
প্রাণীটার গায়ে লেপ্টে আছে সামুদ্রিক প্রবাল। শরীরটা হিঁচড়ে টানতে টানতে হাঁটতে লাগলো। ঝড়ের পর আকাশ থাকে টলটলে পরিষ্কার, এমনকি পথঘাটও। না থাকে মানুষ, না থাকে অন্যকিছু। শুধু ল-ভ- হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি। টিনের-খড়ের উড়ে আসা চৌচালা কিংবা গাছের শাখা পড়ে থাকে। প্রাণীটা সেসব গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্যথা পাচ্ছে বৈকি, গুঙিয়ে পিছু ফিরে আবার হাঁটা ধরছে। সে তার টার্গেট সেট করেছে। যেখানে গেলে সে একই সাথে খাদ্য পাবে, আবার পৃথিবীকে দেখতে পারবে তেমন স্থান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড় তাকে টানছে। পাহাড়ে উঠলে বিশাল অ্যাঙ্গেলে টার্গেটেড শিকারকে আকর্ষণ করা যাবে।
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিপদ আর রোমাঞ্চ থাকে। একটা নীরব ধ্যান থাকে। পাহাড়ের সে ধ্যান ভেঙে প্রাণীটা উঠছে। গাছপালা চুরমার করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাড়া খাওয়া এক দঙ্গল মহিষ যেমন হয়রান হয়ে ছোটে, ঠিক তেমন করে এক ঝাঁক পাখি পাহাড় থেকে উড়াল দিলো। প্রাণীটা পাহাড়ের একটি বিশেষ জায়গা বেছে নিলো, একটা বৃত্ত আঁকলো। এর ভেতর খাদ্য আসবে।
৪.
হঠাৎ করে লাল হওয়া শুরু করেছে বোয়ালিয়া ঝর্ণার পানি। একজন মানুষের শরীরে ছ’-সাত লিটার রক্ত থাকে। এ রক্ত যদি পানির সাথে মিশে তাহলে তেমন কোন বড়ো রকমের বিপর্যয় ঘটবে না। পানি লাল হয়ে যাওয়াতে মানুষের কী এক ধারণা হলো, এগুলো নাকি রক্ত মিশে লাল হয়েছে। তাহলেতো পাহাড়ে বিশ-ত্রিশজন মানুষ খুন হয়েছে। ধারণা ভুল প্রমাণ করতে মিন্টু মিয়া পাঁচজন জওয়ান নিয়ে ঝর্ণার দিকে গেলো। ঝর্ণার যতো কাছে যাচ্ছে পানি ততো গাঢ় লাল দেখাচ্ছে। ঝর্ণার দশ হাত দূরে সাত-আটটা শার্ট-প্যান্ট এলোমেলো পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কেউ কাপড় খুলে রেখে ঝর্ণায় গোসল করতে নেমেছে। কিন্তু মানুষগুলোর কোথাও কোন চিহ্ন নেই, স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।
মিন্টু মিয়া এই মানুষ গুলো সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, দু’দিন আগে ঢাকা থেকে আটজনের একটা দল পাহাড়ের দিকে এসেছিলো। পথে রমজানের দোকান থেকে কী সব হাবিজাবি কিনেছে। রমজানই আটজনের হিসাবটা দিলো। একজনের হাতে গিটার ছিল। বাকিদের হাতে কী বাঁশি, উকুলেলে এইসব ছিলো। নতুন আবিষ্কৃত ঝর্ণাটা একবার ম্যাপ করে নিলো মিন্টু, ঝর্ণার পরিধি আর গভীরতা জানতে হবে। তার কাছে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো একটা ফ্যাদোমিটার আছে। যদিও এটি সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপক যন্ত্র, তবুও একটা চেষ্টা করা আরকি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্থানে সেট করে গভীরতা নির্ণয় করেছিলো মিন্টু, ঠিক যেখানে ঝর্ণার পানি পড়েছিলো ঐ জায়গার গভীরতা পরিমাপ করতে গিয়ে অবাক হলো সে। অন্যান্য জায়গায় সর্বোচ্চ আট দশ ফ্যাদম মানে প্রায় কুড়ি মিটার পর্যন্ত গভীর হলেও এই একটা জায়গায় যেন ফ্যাদম গ্রাফ শুধু নিচেই নামছে। তাহলে কি এটাই সেই পাতালপুরীর পথ? মিন্টু ব্যাপারটা নিয়ে হালকা একটু ঠাট্টাও করলো সঙ্গীদের সাথে, এই ঠাট্টা করা মানে ভয় ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাওয়া। আসলেই ভয় পেয়েছে মিন্টু। স্রেফএকটা দল হাওয়া হয়ে গেছে, ব্যাপারটা মানতে পারছে না সে। মিন্টু মিয়া ঝর্ণার একদম উপরে উঠে এলো, পাখির দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো চারপাশ। কোথাও হারিয়ে যাওয়া দলের চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা।
শার্ট প্যান্টগুলো ছাড়া কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। মিন্টু ভাবলো এমনও তো হতে পারে তারা পথ হারিয়ে অন্য পথ দিয়ে নেমে গেছে অথবা…। আর ভাবতে পারছে না, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে তারা কোথায়। হাঁটতে হাঁটতে তারা দুর্গম থেকে দুর্গম জায়গায় যাচ্ছে, পাহাড়ের এই স্থানটা অনেকটা মরুভূমি কিংবা আমাজনের গহীনের মতো। কেমন একটা গুমোট নীরব ব্যাপার ছড়িয়ে আছে সবদিকে। মিন্টুরা যেন ঘুরেফিরে একই জায়গায় এসে পড়ছে বারবার, একইরকম গাছ প্রায় সবখানে। হাঁটতে হাঁটতে উপত্যকার মতো একটা জায়গায় এসে পৌঁছালো তারা। চারিদিকে গভীর বন। মাঝে খোলা উঁচু ঢিবি, যেন এক জীবন্ত গোলক ধাঁধা! তারা যখন ঝর্ণায় উঠছিলো তখন সূর্য মাথার উপর ছিলো, কিন্তু এখানে এসে অবাক করা ব্যাপারের মুখোমুখি হলো তারা। এতোক্ষণে সূর্য হেলে পড়ার কথা। অথচ সূর্য ম্রিয়মাণ ঠিকই, তবে এই সুর্য অস্তগামী সূর্য না, বরং উদয় লগ্নের সূর্য।
মিন্টুর সাথে বহুরকম যন্ত্র থাকে। কাজের সময় ব্যাকপ্যাক থেকে একটা একটা বের হয়। এখন বের হলো সূর্যেও তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র পাইরোমিটার। অপটিক্যাল পাইরোমিটারটা অনেকটা পুরনো পদ্ধতির। তবুও কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মিন্টু মিয়া অবাক হয়ে দেখলো যে, তাপমাত্রার যে পাঠ দেখাচ্ছে পাইরোমিটার তা কখনোই সম্ভব না। সূর্য এতো কাছাকাছি হতেই পারে না। হয় পাইরোমিটারে ভুল হচ্ছে অথবা তার মাথা ভজগট পাকিয়ে ফেলেছে। বাতাসও যেন এখানে একটু অন্যরকম। কেমন গা ছমছমে ভাব, সব যেন থমকে আছে। তার ব্যাগে সূক্ষ্ম সময় পরিমাপক যন্ত্র ক্রনোমিটার আছে।
তারা কি সময়ের কোনো স্তর পার করে চলে এসেছে? নিজের কাছে ব্যাপারটা প্রচ- ভয়ের হলেও সঙ্গীদের সাহস যোগাতেই কিনা ক্রনোমিটারটা বের করে স্টপ ওয়াচ চালু করলো। একজায়গায় ফেলে রেখে তারা আলোচনা করতে বসলো কিভাবে এই গোলক ধাঁধা থেকে বের হওয়া যায়। মনে হচ্ছে মিন্টুরা একটা যে গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছে তা থেকে বের হওয়া অসম্ভব। ধীরে ধীরে মনোবল দুর্বল হয়ে এলো। শেষ চেষ্টা, মিন্টু একটা ছক আঁকলো মানচিত্রের মতো। প্রত্যেককে তাদের নিজস্ব চিন্তা থেকে একটি নির্দিষ্ট পথ ধরতে বললো। কেউ যদি লোকালয়ে পৌঁছাতে পারে তাহলে সে যেন তাদের আটকে পড়ার খবর লোকজনকে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত কি তারা লোকালয়ে পৌঁছতে পেরেছিলো?
৫.
স্টিম বাথ নিচ্ছেন মজিদ সাহেব, এ গোসলটা ভ্যাপসা ভাঁপের মধ্যে করতে হয়। মনে হতে পারে অস্বস্তিকর অবস্থা, কিন্তু বলাবাহুল্য মজিদ সাহেবের তেমনটা লাগছে না। বরং স্বস্তি বোধ করছেন তিনি। মেজাজ এতোক্ষণ খিঁচড়ে ছিলো, এখন কিছুটা লাইনে এসেছে। ঘরের ভেতর থেকে রবি ঠাকুরের গান ভেসে আসছে- ‘আমারো পরান যাহা চায়…।’ মেয়েটা ক্রমশঃ বড়ো হয়ে উঠছে। এই তো সেদিনও মুখে বোল ফোটেনি। আধো ভাঙা গলায় ডাক দিতো ‘বা’! ধীরে ধীরে বা থেকে ‘আবা’ হয়ে তারপর ‘বাপ’ কখন থেকে ডাকা শুরু করেছে তা ঠাহর করতে পারছেন না তিনি।
ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন মজিদ সাহেব, শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে গেছে স্টিম বাথে। তিনি হালকা গলায় ডাক দিলেন- ‘নুহা, নুহা’! নুহা সম্ভবত রবীন্দ্র সংগীতের নরম সুরে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তোয়ালে আনতে নিজেকেই যেতে হবে। ভারী শরীর টেনে তুললেন তিনি। ঘামে জবজবা পা হঠাৎ পিছল খেলো। খুব জোরে ‘মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে ভারী শরীরটা নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মজিদ সাহেব। চিৎকারের শব্দে দৌড়ে এলো নুহা। বাষ্প স্নানে গা পানিতে ভিজে না। উল্টো ঘামে ভিজে। মজিদ সাহেব ডায়াবেটিস রোগী। ডায়াবেটিস রোগীদের এই গোসল নেওয়া মানা। ইদানিং রোগীদের জন্য চিনি ফ্রি বিস্কিট, মধু আরো কত কি বের হয়েছে।
নুহা তার স্কুলব্যাগে করে প্রতিদিন খুঁজে খুঁজে এসব ফালতু জিনিসপাতি আনে। বাবার মন ভালো করার যথেষ্ঠ চেষ্টা করে। আজও এনেছে। ডায়াবেটিস রোগীদের স্পেশাল লেমুদি। নুহা ফ্রিজ থেকে বরফ নিলো দু’টুকরো। ব্লেন্ড করা এককাপ লেবুরস নিলো। বেকিং সোডা নিলো একটুক। তারপর লেমুদি ঢেলে দিলো জগে। পুদিনা পাতা, শসা আরো কি হাবিজাবি দিলো।
‘বাবা, এই নাও। এটা খাও।’
‘তোমাকে না কতোবার বলেছি, যদি তোমার স্টিম বাথ নিতেই হয় আমাকে বলবা। বলবা না তো,
কষ্টটা কে করছে?’
মাথা ধরে বাবার মুখে স্মুদি দিতে দিতে বললো নুহা।
মজিদ সাহেব কিছু বলছেন না। পত্রিকাটা হাতে নিলেন। তরুণ এক বিজ্ঞানীকে নিয়ে ফিচার করেছে পত্রিকা। ‘নাসায় কাজ করা বাংলাদেশী এক বিজ্ঞানী’ শিরোনামে। মজিদ সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন ব্যাপার টা এমন না। বরং দিনকয়েক পরপর নাসায় অমুক, ফেসবুকে তমুক কিংবা গুগলে বাংলাদেশী শিরোনাম দেখতে দেখতে তিনি বিরক্ত প্রায়।
ফিচারটিতে তরুণ বিজ্ঞানীর জীবনের সাথে পরিচিত করা হচ্ছে এভাবে- ‘সুশান্তের প্রতিটা দিন শুরু হয় বুকে হাত রেখে আমার সোনার বাংলা গেয়ে।’
‘আরে ব্যাটা, এতো বড়ো দেশপ্রেমিক হলে দেশ থেকে গেলি ক্যা? যত্তোসব!’ মুখ কুঁচকে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন মজিদ সাহেব।
ইদানিং যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ছেন আসাদ সাহেব। ঘুম যেন তাকে পেয়ে বসেছে। ঘুমের ঘোরে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলেন।
‘তুমি কিন্তু তোমার নাম এখনো বললে না। বল তো তুমি কে?’
‘আমি স্বপ্নমানব।’
‘না, তুমি আমার কল্পনা। তুমি ঠিক আমাকে নিয়ন্ত্রণ কর নাকি আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করি, তা ঠিক বুঝছি না।’
‘পৃথিবীর সব প্রাণী স্বাধীন। কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করে না আমি যদ্দুর জানি।’
‘না, তোমার জানায় ভুল আছে। পৃথিবীর সব মানুষ শৃঙ্খলিত। আমার এ শৃঙ্খল সহ্য হয় না।’
‘আচ্ছা আসাদ সাহেব, আপনিও কি শৃঙ্খলিত?’
‘হ্যাঁ আমিও। আমি সুহার মায়ায় শৃঙ্খলিত। এ শৃঙ্খল কেটে আমাকে একা হতে হবে। শূন্য হতে হবে।’
‘আপনি একা হতে চান কেন?’
‘আমি একা না হলে নিজের মতো ভাবতে পারছি না। ঘুমাতে পারছি না। আমি আমাকে খুঁজে পাচ্ছি না ।’
আসাদ সাহেব আঁতিপাঁতি করে কি জানি খুঁজছেন বিছানায়। চোখ বন্ধ অথচ বালিশের তলায় হাতড়াচ্ছেন। টেবিলে হাতড়াচ্ছেন। অবশেষে কিছু একটা পেলেন যেন। কলম। সুহা ঘুমন্ত আসাদ সাহেবের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইদানিং সুহা আসাদ সাহেবের ঘরের দেওয়ালে টেবিলে এমনকি বিছানায় পর্যন্ত হিজিবিজি লেখা খুঁজে পাচ্ছে। আজ দেখলো আসাদ সাহেবের পুরো ঘরে সাদা কাগজে একটি বৃত্ত আঁকা। তবে বৃত্ত বললে ভুল হবে। ডিম্বাকৃতির এ চিহ্নটাকে ঠিক বৃত্ত বলা যায় না। সুহা এই সাইনটার মানে খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ তার মনে হচ্ছে আসাদ সাহেবের এই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার সাথে এই সাইনটার কোন সংযোগ আছে।
সুহা ব্লেড সিরিজে ড্রাকুলার সাইন অথবা নাৎসিদের স্বস্তিকা চিহ্নের কথা ভাবলো। এমন কিছু নয় তো? সুহা চিহ্নটি স্ক্যান করলো। সার্চ ইঞ্জিন বেশ কিছু চিহ্নের সাথে মিল দেখালো। একটি সাইনে সে ক্লিক করলো। ঠিক এই চিহ্নটির মতো। দেখতে দেখতে ঘুম এসে গেলো। কড়া কফি খেলো। ক্যাফেইনে আমেজে ঘুম নামলো দু’চোখে।
ঘামে ভিজে যাচ্ছেন আসাদ সাহেব, কলারের বাঁ পাশটা বারবার ঘাম মোছার ফলে কালচে রং হয়ে গেছে। কারেন্ট আসার কোনো নাম নেই। কিছুক্ষণ পরপর উঠে বসে পড়ছেন তিনি। শার্টটা কোনোরকম খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে আবার বালিশে মাথা দিলেন। ভয়ানক স্বপ্ন দেখছেন এখন।
এটি রেম পর্যায়। এই সময় চোখ বন্ধ থাকে অথচ মানুষ অবচেতনভাবে জেগে থাকে। এ সময় একই সাথে স্বপ্নও দেখতে পারে আবার মানুষের হাঁটাচলা ঘড়ির টিকটিক সব শুনতে পারে মানুষ। আসাদ সাহেব গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ শুনলেন। এমনকি কেউ একজন ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে তাও শুনলেন। কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলে যেমন হয় তেমন হুড়মুড় করে জেগে উঠলেন তিনি।
‘কে? কে? সুহা?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমি। পানি খাবে?’
আসাদ সাহেব বলার আগেই পানি ঢেলে বাবার মুখের সামনে গ্লাস এনে হাজির করলো সুহা। পানি খেয়ে বারকয়েক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিলেন আসাদ সাহেব।
‘বাবা, কোন সমস্যা?’
‘না, ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। এখনো বেশ স্পষ্ট মনে আছে। তুই শুনবি?’
‘বলো!’
‘দেখলাম একখন্ড বরফ ধীরে ধীরে কালো হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড পানির অভাব। বরফটুকু খাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছি। দেখি কালো বরফটি আলকাতরার মতো গাঢ় তরল হয়ে গেছে…।’
‘বাবা, তোমার এখন ঘুমানো প্রয়োজন। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে তোমার চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে। হতে পারে জন্য তুমি এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছো। তোমাকে আমি বরফ দিয়ে কিছু শরবত বানিয়ে দেবো?’
আসাদ সাহেব হ্যাঁ-হুঁ কিছুই বললেন না। তিনি জানেন, না বললেও সুহা ঠিকই শরবত বানিয়ে নিয়ে আসবে। সুহা উঠে গেলো।
আসাদ সাহেবের এ কয়দিন একদম ঘুম হচ্ছে না। চোখ বুজলেই আবোল তাবোল দেখছেন। সেদিন দেখলেন, তার শরীরের সব রক্ত গাঢ় নীল হয়ে যাচ্ছে। রাতে আঙুল একটু কেটে দেখলেন আসলেই কিছু হয়েছে কি না তা দেখতে। সুহা তাকে এ অবস্থায় দেখে তো শকড। অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত ডাকতে বসেছিলো। সুহার গলা শোনা যায়।
‘বাবা, কফি দেবো?’
ঐ জিজ্ঞেস করা পর্যন্তই। না বললেও বানিয়ে নিয়ে আসবে। কফি আর বিস্কিট নিয়ে রুমে ঢুকলো সুহা।
‘বাবা, ফ্রয়েড কি বলে জানো?’
‘কি?’
‘যে সব কথা, যে সব কাজ- তুমি বলতে পারো না এবং করতে পারো না, সে সব কিছু অর্থাৎ অবদমিত জিনিস স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। তোমার একটু হালকা হওয়া দরকার। কোথাও বেড়িয়ে আসবে?’
‘আমিও তাই ভাবছি। কোথায় যাওয়া যায়?’
‘কুয়াকাটা চলো! কয়েকদিন সংসারের গোলমেলে গন্ডি থেকে দূরে থাকি।’
৬.
কুয়াকাটার হোটেল সুনীল, চারতলায় দু’টো রুম ভাড়া নিয়ে সুহা ও আসাদ সাহেব উঠেছেন। রাতে কফির সাথে ভালো রকমের গল্প জমলো।
‘বাবা, স্বপ্নগুলো নিয়ে কী ভাবছো, হতে পারে তুমি কিছু একটা করতে চাইছো। কিন্তু পারছো না। মানে অবদমিত সেই জিনিসটা স্বপ্ন হয়ে দেখা দিতে চাইছে। তুমি তো মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণী সম্পর্কে জানোই, ব্যাপারটা কী ঘটলো? পর্যায় সারণী নিয়ে যখন কোন সমাধান হচ্ছে না, তখন মেন্ডেলিফ স্বপ্নে মৌলগুলোর বিন্যাস কৌশল দেখতে পান। তুমিও কি তেমন কিছু করতে চাইছো? ইদানিং যেখানে সেখানে ডিম্বাকৃতির শূন্য আঁকছো, শূন্য জিনিসটার প্রতি এতো ইন্টারেস্টেড হলে কেন?’
‘দেখ মা, শূন্য নিয়ে পরে আসছি। রসায়নের বেনজিন চক্র নিয়েও একটা গল্প আছে যেটা তুই জানিস নিশ্চয়। অগাস্ট কালকুলেল স্বপ্নে দেখলেন একটা সাপ চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে লেজের দিক থেকে নিজের দেহ খেয়ে ফেলছে। ব্যাস, বেনজিন চক্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেলো! আমি সেফ গল্প মনে করি এগুলোকে।’
‘বাবা, স্বপ্ন এতোটা অর্থহীন হলে স্বপ্নবিজ্ঞান জিনিসটা থাকবে কেন?’
‘তাও ঠিক, আমি তো অর্থহীন বলিনি। বলেছি স্বপ্নের বাস্তবতাকে সাপোর্ট দিতে যে কল্পগল্প উপস্থাপন করা হয় তাই অর্থহীন। মেন্ডেলিফ বা কালকুলেলের সব সাধনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে যদি এই স্বপ্ন তাদের জীবনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বুঝলি?’
সুহা আসাদ সাহেবের ধরন পেয়েছে। একমত না হলে চুপ করে থাকবে। এখন যেমন আছে।
ভোর পাঁচটা। আসাদ সাহেবের ঘুম ভাঙলো আজানের সুরে। ঘুম মানে আধবোজা চোখে রাত পার করা আরকি। আস্তে দরজা ঠেলে বের হলেন। সৈকতে খালি পায়ে হাঁটছেন তিনি, বালি ঈষদুষ্ণ। কোরাল রিফ, প্রবালের দেখা মিললেই তিনি বাচ্চাদের মতো আনন্দ পান। কয়েকটা সামুদ্রিক শামুক নিলেন আর নিলেন বেশ কিছু প্রবাল। খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে এলেন। পায়ের অস্থির ভাবে বুঝা যায়, ক্লান্তি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্লান্তির দরকার ছিল। এখন খুব ঘুম হবে।
সুহা চোখ ছোট ছোট করে প্রবালগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রবাল জিনিসটা কৌতূহল জাগানিয়া একটা জিনিস। না উদ্ভিদ না প্রাণী। অ্যারিস্টটল-আল বিরুনী দু’জনই কনফিউশনে ছিলেন এটি উদ্ভিদ নাকি প্রাণী তা নিয়ে। অ্যারিস্টটল এটিকে জুয়োফাইটা বলে সাব্যস্ত করেছেন। সর্বশেষ উইলিয়াম হার্শেল এটাকে প্রাণী বলে নিশ্চিত করেন। প্রবালকে স্পর্শ করলে রেসপন্স করে আবার দেহের ভিতর থাকা শৈবাল থেকে উৎপাদিত খাদ্য পায়। প্রবাল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা জিনিস।
সুহা এই প্রবালটাকে চেনে। হাতে গোনা যে কয়টা প্রবাল সমুদ্রের তলদেশে থাকে এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাহলে কি এটি গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে? কিন্তু কিভাবে? কিভাবে- এই প্রশ্নের খোঁজেই মূলত আসাদ সাহেব প্রবালগুলো তুলে এনেছেন। বাবা ঘুমাচ্ছেন। সুহা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এ সময় হুড়মুড় করে জেগে উঠলেন আসাদ সাহেব। সম্ভবত কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। কপালের দু’পাশে ঘামের চিকন সুতা আঁকা। সুহা কপাল মুছে দিতে দিতে বললো- ‘বাবা, কী হয়েছে?, আমাকে খুলে বলো না একটু।’ আসাদ সাহেব উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন।
বাবার মাথায় পানি ঢালতে একটা বড় বালতিতে পানি নিলো সুহা। পানি এনে রুমে ঢুকতেই দেখে আসাদ সাহেব কোথায় যেন যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন। সে বললো- ‘বাবা, বের হবে নাকি?’
‘হ্যাঁ মা, একটা কাজ আছে পাহাড়ে যাবো সার্ভে করতে।’
‘মানে কি বাবা! এখন আবার কিসের সার্ভে?’
সুহা প্রচ- বিরক্ত, সে জানে বাবার মাথায় যা ঢুকবে তাই করবে। কাপড় রেডি করছে সুহা।
আসাদ সাহেবের শরীর দুর্বল লাগছে। বাসের সিটে আধো ঘুমঘুম ভাব নিয়ে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন তিনি। কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নটা মাথায় ঘুরঘুর করছে। মানুষ সাধারণত স্বপ্ন ভাঙ্গার দশ সেকেন্ড পর থেকে স্বপ্নটা ভুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু আসাদ সাহেবের চোখে স্পষ্ট পাহাড়টা ভাসছে। পাহাড়ের মাঝে উপত্যকার মতো একটা জায়গা। সেখানে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে একটা প্রাণী। প্রাণীটার গায়ে লেগে আছে প্রবাল কীটের হাঁড় থেকে জন্ম নেওয়া বিরলজাতের প্রবাল। প্রাণীটাকে তিনি গভীরভাবে চেনেন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো এ জলদানব অ্যাকোয়াফিয়েন্দ বানানোর পরিকল্পনা তার মাথায় ঢুকিয়েছিলো মিন্টু নামের একটা ছেলে। তার ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে। কিন্তু অ্যাকোয়াফিয়েন্দ তো গভীর সমুদ্রে থাকার কথা। স্বপ্নে যে তাকে পাহাড়ে দেখালো! ‘ধুর, আমি স্বপ্নকে এতো পাত্তা দিচ্ছি কেন?’ বিড়বিড় করে বললেন।
‘বাবা, তুমি কি বিড়বিড় করছো?’
‘কই না তো!’ সুহার ডাকে চমকে উঠলেন আসাদ সাহেব।
‘দেখো, তুমি চিন্তা করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছো, যেখান থেকে কাউন্সেলিং ছাড়া ফেরাটা অসম্ভব। আমি কী বুঝাতে চাচ্ছি তুমি কি ধরতে পারছো?’
‘দ্যাখ মা, আমি স্বপ্ন জিনিসটাকে বিশ্বাস করি না, তুই স্বপ্ন জিনিসটাকে এতো বেশি আমলে নিচ্ছিস কেন?’
‘তুমি নিজেই কি আমলে নাও না? কুয়াকাটা থেকে ফেরাটা কি স্বপ্ন থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া না?’
আসাদ সাহেব স্বভাবমতো চুপচাপ নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন সুদূরপানে। তার মনে হচ্ছে মেঘগুলো একেকটা পাহাড়, পাহাড়ের মাঝে ডিম্বাকৃতির একটা উপত্যকা।
আসাদ সাহেব কিংবা সুহা দু’জনের কেউই জানে না, তারা যে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পা বাড়াতে যাচ্ছে। আসাদ সাহেবের পা যেন আর চলে না, ঝর্ণার ক্যাসকেড দেখতে দেখতে চোখও ক্লান্ত যেন। সুহা তাজা শরীর নিয়ে আসাদ সাহেবকে পেছনে ফেলে অনেক উপরে উঠে গেছে। তিনি ধীরে ধীরে দম নিয়ে নিয়ে উঠছেন। উঠতে উঠতে যেন পড়ে যাচ্ছেন আবার তাল সামলাচ্ছেন। অনেক উপরে গোলাকৃতির পাহাড় চূড়া। ঠিক এখানেই স্বপ্নে প্রাণীটাকে দেখেছেন। চূড়াটা একটু ভালোভাবে দেখার জন্য একটু গলা বাড়াতেই পা হড়কালেন।
সুহা একটা উপত্যকার মতো ঢালু জায়গা পেলো। এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো বেশ কিছু যন্ত্র। সে অবাক হলো, পাহাড়ের এতো উপরে পাইরোমিটার-ক্রনোমিটার এগুলো কিভাবে আসলো। স্টপওয়াচটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো ২৪৫ ঘন্টা সময় দেখাচ্ছে, তার মানে দশদিন আগে কেউ একজন এখানে এসেছিলো। এদিক সেদিক আরো দু’তিনটা ব্যাকপ্যাক পেলো। নাহ, তাহলে বেশ কয়েকজন এসেছিলো। কিন্তু তারা গেলো কোথায়? বারমুদা ট্রায়াঙ্গল যেমন, এই জায়গাটাও তেমন নয় তো!
হাঁটতে হাঁটতে সে একটা প্রবালের খ-াংশ পেল। গভীর সমুদ্রের প্রবাল পাহাড়ের চূড়ায় কিভাবে আসবে তার মাথায় ঢুকলো না। একটা ব্যপার খেয়াল করলো ঘুরেফিরে এক জায়গাতেই ফিরে আসছে সে। অ্যাকোরিয়ামের বন্ধি মাছের মতো পৃথিবী দেখছে অথচ নামার পথ পাচ্ছে না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো। গভীর ঘুম নেমে এলো চোখে।
প্রাণীটা ভয়ঙ্কর জাল ফেলেছে। জালে ধরা পড়েছে একে একে প্রথমে আটটা পরে পাঁচটা ও এইমাত্র একটা খাবার। এখন যে খাবারটা পেল তা শুঁকে দেখলো। গন্ধটা কেমন পরিচিত! ঘ্রাণেন্দ্রিয় বলছে কাছে পিঠে কোথাও ওই বিজ্ঞানী লোকটি আছেন, যে তাকে জলজ দানব বানিয়েছে। পাহাড়ের এক জায়গা দুমড়ানো মোচড়ানো, এখানেই কোথাও আছে। অন্ধ আক্রোশে নিচের দিকে নামতে থাকলো অ্যাকোয়াফিয়েন্দ।
পরেরদিনের পত্রিকাগুলো এক মহাবিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর শিরোনাম করলো, কিন্তু একটা পত্রিকাও ছবি দিলো না। এতো বিভৎস লাশের ছবি ছাপানোর অযোগ্য। প্রকৃতি কখনোই বিকৃতি সহ্য করে না। এই অ্যাকোয়াফিয়েন্দ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো হতে চায়নি। প্রকৃতির খেয়াল বড় নিষ্ঠুর। সে যখন প্রতিশোধ নেয় তখন অনেক ভয়ংকর প্রতিশোধ নেয়। সেই প্রতিশোধে কোনো বাছবিচার থাকে না, মায়া মমতা থাকে না। অদ্ভুত কারণে এখনো ওই পাহাড় থেকে লাল পানি নামে। কে জানে, প্রাণীটার চোখের জল লাল কি না!