ঈদ মুসলিম মিল্লাতের ঘরে ঘরে একটি আনন্দঘন দিন। রোজার শেষে ঈদ আসে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে প্রত্যেক মুসলমানের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা নিয়ে। ফি বছর আকাশ পথে দুইবার চন্দ্র পরিক্রমাকে হিসেব করে আমরা দুইটি বড় উৎসব করি। এই দুই উৎসবের নাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এই উৎসব দু’টি হয় হিজরি চাঁদের হিসেবে। এই উৎসব ছড়িয়ে দেয় বিশ্ব মুসলমানের আত্মার গভীরে মিলনের এক স্পন্দিত আলোড়ন। সর্বত্র গরীব-ধনী সবার মধ্যে উচ্চারিত হয় সাম্যের জয়গান, মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে বেজে ওঠে খুশির নহ্বৎ। যারা অভাবি-দুঃখি প্রকৃতিগত কারণে নানান সুখ-সুবিধা ও ভোগ-বাসনা থেকে বঞ্চিত, অভাব-অনটনে নিপীড়িত তারাও এই দিনে একটি বেহেস্তি আনন্দ মনে-প্রাণে উপলব্ধি করে। এই দুই ঈদে মহান আল্লাহ মুসলমানদের চিন্তা বিবেককে পরিশুদ্ধ করে সমস্ত বছরে জমে থাকা মনের যত জরা-গ্লানি, আবর্জনা দুরীভূত করে দেয়। সব মুসলমান এই দিনে একটি ঐশী চেতনায় উজ্জীবিত হয়। সে চেতনা হল মুসলমান মাত্র ভাই ভাই। দুঃখি যারা, অভাবি যারা সুখে-দুখে জীবন-যন্ত্রণার ঘাত-প্রতিঘাতে সুখ বৃক্ষের ফল ফসলাদি থেকে বঞ্চিত, তাদেরও আনন্দের সাথী করার জন্য এবং আল্লাহর তরফ থেকে আনন্দের সওগাত বিতরণের জন্য এই মহতী উৎসব। তাই বলে এই আনন্দ-উন্মাদনা বর্তমান দিনের আনন্দ অনুষ্ঠানের মত উলঙ্গ আস্ফালন নয়। অতিরিক্ত খুশিতে পাগল হয়ে, পাগলের মত নাচন নয়। নীতিহীন, বিবেকহীন কোনো আনন্দ উৎসব ইসলামের বিধানে নাই। এই আনন্দ তাওহীদবাদী মানুষের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে আসা স্বর্গীয় আনন্দ উৎসব। এই সুমহান আনন্দের প্রথম সূচনা আমাদের রসুলের হিযরতের পর থেকেই।
দেখতে দেখতে বয়সের অনেক সিঁড়ি পার হয়ে আরেক জগতে প্রবেশ করার অপেক্ষায় আছি। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-অস্টেলিয়া-উত্তর আমেরিকা-নরওয়ে-সুইডেন-সৌদি আরবের ঈদ উৎযাপনের নানা রূপ দেখেছি। ভিন্ন রকমের পোশাক-আশাক, আচার পদ্ধতি মানুষের সঙ্গে মানুষের আন্তরিক বন্ধন সৌহার্দের বন্ধন দেখেছি। তবে যত ভিন্নতাই থাকুক না কেনো ইসলাম প্রদত্ত জীবন বিধানের মধ্যেই সব আনন্দ উদযাপন হয়েছে। ঈদ সম্বন্ধে বলার মতো আরও অনেক কথা বলতে পারতাম, বলার পরিধি এতো সীমিত তাই আমি ঈদ উদযাপনের মহতী কারণগুলো না বলে ছোট করে আমার শৈশবকালের ঈদ স্মৃতির সামান্য রোমন্থন করছি।
আমার দেশ চট্টগ্রাম। শহর থেকে অনতিদূরে চাঁদগাও গ্রামে মৌলবি বাড়ি নামে খ্যাত এক সূফি পরিবারে আমার জন্ম। জন্মলগ্ন থেকে প্রায় বারো বছর আমি এই গ্রামের বাড়িতে বড় হয়েছি। বাবা-জ্যাঠা, দাদী, মা, চাচী, ভাই-বোনদের সঙ্গে যৌথ পরিবারে আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের দিন কেটেছে। বাড়ির সামনের দেউড়িতে অন্যান্য সমবয়সিদের সঙ্গে সকাল বেলা মসজিদের ঈমাম সাহেবের কাছে আমপারা শিখেছি। মা ও দাদীর কাছে শিখেছি নামাজ, আরবি, উর্দূ ও ফারসির হরফ। বাংলা শিখেছি রান্না ঘরে মায়ের কাছে বসে।
আমাদের বাড়ির সীমানা ছিল সুবিশাল। সামনে মসজিদ সংলগ্ন বিশাল দিঘী ও গোরস্থান। তারপরে ভেতর বাড়ি। ভেতর বাড়িও দু’ভাগে বিভক্ত। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে পড়ে একটা বড় উঠান তারপরে দেউড়ি। দেউড়ির পাশ দিয়ে ভেতর বাড়িতে যেতে যে কোনও ধরনের গাড়ি যাওয়ার সুবিশাল রাস্তা। রাস্তার পরে ছোট আরেকটি উঠান। বাড়িতে যে কোনও অনুষ্ঠান হলে পুরুষদের বসার ব্যবস্থা ছিল বড় উঠানে। বহিরাগত মহিলাদের বসার ব্যবস্থা হতো বিশেষ করে বিয়ে-শাদিতে ছোট উঠানটিতে সামিয়ানা টাঙিয়ে। সব উৎসবের আয়োজন এভাবেই হত।
আমাদের বাড়ির পরিসর অনেক বড় হলেও দাদা ছিলেন দু’জন মাত্র। তাদের ছেলে ছিল চারজন। পশ্চিম ও পূর্বদিক ভাগ করে দু’টি মাত্র বাড়ি ছিল গোটা সীমানা জুড়ে। আবার পুরো সীমানা গড়খাই দ্বারা বেষ্টিত। মসজিদের সামনের বড় দিঘী ছাড়া ভেতরে মেয়েদের গোসল ও অন্যান্য কাজের জন্য ছিল আরো একটি দিঘী। দাদীর ওযুর জন্য বিশেষ করে তৈরি হয়েছিল ঘরের সাথে লাগোয়া আরেকটি ছোট পুকুর। ঘর-পুকুর-উঠান ছাড়াও পিছনে ছিল গাছগাছালি সবজি চাষের উপযোগী বিশাল বাগিচা। পাটি বেতের ঘেড় দেওয়া ছিল পুরো সীমানাই। বিশাল এলাকা বলে বাঁশ বা ইটের দেয়াল সম্ভব ছিল না। বেত ঝাড় দিয়ে সীমানা নির্দিষ্ট ছিল। বেত ঝাড়ের ওপারে থাকত গড়খাই এর বেষ্টনি। যাতে বাড়িতে মসজিদের সম্মুখে রাস্তা ছাড়া কোনো অপরিচিত মানুষ ঢুকতে না পারে। ভেতর পুকুরের পাড়েও থাকত অসংখ্য আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তাল, বরই, পেয়ারা ছাড়াও আরো অনেক রকম ফলজ গাছ। আমরা জেনেছি, এ সমস্ত গাছ সব বিদেশ থেকে বাপ-চাচাদের আনা। বাঁশের ঝাড় ছিল অনেক। মেয়েদের জন্য ছিল গোসল করার মধ্যপুকুরে জলঘাট। বসত ঘরের পিছনের দিকে কোনও পরপুরুষের আনাগোনা নিষিদ্ধ ছিল। একমাত্র তারা আসতে পারত গাছগাছালির ডাল কাটা, পুকুরে মাছ ধরা বা দাদীর কোনও প্রয়োজন থাকলে।
সাধারণত আমাদের বাড়িতে বর্ষীয়ান পুরুষ খুবই কম ছিল। শিক্ষিত পরিবার বলেই বাবা, চাচা, জ্যাঠাসহ সবাই নানান দেশে কর্মরত থাকতেন। থাকতেন কলকাতায়, আকিয়াব, বার্মা ও বাহরাইন ইত্যাদি জায়গায়। সরকারি ছুটিতে যখন তারা বাড়ি আসতেন, তখন বাড়ি হয়ে উঠত উৎসবমূখর আনন্দ নিকেতন। নিথর, নিস্তব্ধ বাড়িটা যেনো হেসে উঠত। বাড়ির যাবতীয় কাজ-কাম করার জন্য কয়েকটি পরিবারের উপর ভার ছিল। এই সমস্ত পরিবারগুলোর জন্য দাদা লিখিতভাবে দান করে গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ির উত্তরাংশের একটা জায়গা। ঐ জায়গাটার নাম ছিল উত্তর পাড়া। বেত ঝাড় ও গড়খাই দিয়ে ঐ জায়গাটাও আলাদা ছিল।
আমাদের বাড়ির বেশির ভাগ সময় পুরুষ শূন্য থাকাতে উত্তর পাড়ার বর্ষীয়ান বিশস্ত কিছু লোকজন দাদীর কথা মত বাড়িতে কাজে-কর্মে সাহায্য করত। তাদের মাশোয়ারা দেওয়া হত জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য। দাদী ছিলেন বাড়ির একমাত্র বয়স্ক মুরুব্বি। প্রখর ব্যক্তিত্বশালীনি মহিলা। শবে বরাত থেকে ঈদ আসা পর্যন্ত বাড়িকে পরিস্কার ও সুন্দর করে রাখার জন্য তাদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হত। সারাবছর ধরে পিছনের বাগিচায় যত আগাছা, বড় বড় গাছের শুকিয়ে যাওয়া ডাল এবং পুকুরের পানা পরিস্কার করা ছিল পুরুষদের প্রধান কাজ। আমাদের বাড়ি ছিল টিন দেওয়া মাটির ঘর। মাটির দেয়াল লেপা-মোছা করা, বাড়ির ভেতরের ঝুলকালি পরিস্কার করার কাজ করত মেয়েরা। সবকিছুই চলত দাদীর তত্ত্বাবধানে।
তারপর চলত ঈদকে বরণ করার প্রস্তুতি। নতুন কাপড় কেনার ধুম। নিজের ঘরের লোকদের ছাড়াও পাড়া প্রতিবেশিদের নতুন কাপড় দেওয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি। মনে হত ঈদের আগেই ঈদের খুশির বার্তা সমস্ত বাড়ি জুড়েই। আমাদের কাপড়-চোপড় আসত বেশিরভাগ সময় বিদেশ থেকে। ঐ কাপড় দেখতে চাইলে দাদী সহজে আমাদের দেখতে দিতেন না। একটা টিনের ট্রাংকে রেখে দিতেন তালা মেরে। আমরা সময় পেলে সেই ট্রাংকের পাশে ঘুরঘুর করতাম। না দেখেও ট্রাংকের কাছে গেলে নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ পেতাম।
ঘরে ঘরে ঈদের প্রস্তুতি চললেও সবাই রমজানের সংযম, আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা, দান-খয়রাত ও অন্যান্য কাজ-কর্ম রমজান মাসের নিয়ম অনুযায়ী করতেন। ভোর রাতে বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে সেহরি খাওয়ার প্রতি আমাদের লোভ থাকত সর্বদা। অনেক সময় মা ও দাদী আমাদের বুঝাত যে আমাদের রোজা রাখার বয়স হয়নি। তাই রাতে কষ্ট করে ঘুম থেকে না উঠে বরং ফজরের নামাজের সময় উঠে নামাজ আদায় করা উচিৎ। দাদীর এসব কথায় আমরা ছোটদের খুব মন খারাপ হত। কারণ, সবার মুখে মুখে শুনতাম সেহরি খাওয়া একটা সোওয়াবের কাজ। সেহেরি খেতে পারলে মনে মনে খুব আনন্দ পেতাম এবং গৌরব বোধ করতাম। তাই সেহেরির সময় হওয়ার পূর্বেই ঘুম থেকে জেগে চুপচাপ বিছানায় বসে থাকতাম। ফলে মা ও দাদী ডেকে সেহরি খাওয়াতেন। মধ্যখানে ঠাট্টা করে কাজের মেয়েরা বলত- ‘অ বোইন কেউ দেখবে না কলা গাছে একটা কামড় দিয়া আস ইফতার হয়ে যাবে। রোজাও হবে। তারপর তোমাদের আমি গোপনে খাইয়ে দেব। তোমাদের রোজা ভাঙবে না।’
মাঝে মাঝে রোজা রেখে আবার কোন কোন দিন না রেখেও বাড়ির মুরুব্বিদের রোজা রাখা দেখে অনেক কিছু শিখেছি। শেখার মধ্যে প্রথম শিখেছি ভোর রাতে ঘুম থেকে জাগার অলসতা দূর করা। জেনেছি সেহরি খাওয়া সুন্নত। দিন শেষে আবার ইফতার করাও সুন্নত সেই ধারণা সে সময়ে পেয়েছি। এই সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একটা অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা, আন্তরিক তাগিদে ঠিক সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে নিজের মধ্যে একটা আনন্দ খুঁজে পেয়েছি। সারা বছর কোরআন না পড়লেও রমজান মাসে কোরআন খতম দেওয়ার জন্য সমবয়সিদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকত। যে রমজান মাসে শেষ করতে পারত তাদের মুরুব্বিরাও বিশেষ উপহার দিতেন। এটা ছিল আমাদের জন্য বাড়তি আনন্দ। অর্থাৎ বারো মাসের মধ্যে রমজান মাসটাই অন্যান্য মাস থেকে ব্যতিক্রমে ভরপুর এবং ইসলামের বহু সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করে দিয়েছে। এই বয়সে এসে বুঝি ইসলাম কত পরিশীলিত, কত নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল জীবন গঠনের পথ নির্দেশক।
আগেই বলেছি বাড়িতে লোক সংখ্যা খুব কম। আবার বিদেশ থেকে যারা আসে তাদের সংখ্যা খুব বেশি না। তা সত্ত্বেও ইফতারির আয়োজন করতে হত প্রচুর। পিয়াজি, ছোলা, মুড়ি, চিড়া, পাকা কলা, শরবত এসব তো থাকতই। তারপরেও জিলাপি, হাতে করা পিঠা এবং পায়েস- এসবও করতে হত। কারণ মসজিদেও ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ইফতারের তিন ভাগের দুই ভাগই মসজিদে দিতে হত। ইফতারি তৈরি করতে উত্তর পাড়ার মেয়েরা মাকে সাহায্য করতেন। ঘরের মধ্যে ইফতারের পদগুলো সাজাতে শুরু করতে হত আসরের পর থেকেই। লম্বা পাটি বিছিয়ে তার উপর দস্তরখানা বিছিয়ে লবণ, আদাও রাখা হত একটা প্লেটে। সব পদের ইফতারি প্লেটে প্লেটে সাজানো থাকত। আমরা রোজা না থাকলেও ইফতারি খাওয়ার অংশিদার ছিলাম। বড়দের সাথে সাথে আমাদেরও ইফতারের ব্যবস্থা থাকত। যদিও আমরা আসরের পর থেকেই ইফতারি বানানোর শুরু থেকেই উত্তর পাড়ার বুয়াদের কাছ থেকে চুপিসারে কিছু কিছু ইফতারি আগেই খেয়ে ফেলতাম। এই ভাবেই রমজান মাসের উৎসব চলত।
ইফতার শেষে বাড়ির পুরুষরা মসজিদে যেতেন নামাজ পড়তে। অনেকে একবারেই তারাবি পড়ে ঘরে ফিরতেন। এবং রাতে একবারেই সেহরিতে খেতেন। রমজান মাসের ইসলামের জীবন ধারার জীবনের এই নিয়মতান্ত্রিক গতি প্রবাহ কোন সংস্কৃতিতে আছে বলে মনে হয় না। এ যেনো মানুষকে নতুন করে তৈরি করে, নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত করে। সারা বছরের জন্য জীবনকে নিয়মের মধ্যে থেকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে। এধরনের অসংখ্য শিক্ষায় মানুষকে ‘সিরাতাল মুসতাকিম’Ñএর পথে চলার শিক্ষাই আমরা প্রতি মুহূর্তে পেয়ে থাকি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না। তাই মুসলমানদের জীবনের এই দুর্গতি।
রমজান শেষে আমরা আরেকটি আনন্দময় দিনের জন্য মনেপ্রাণে শিহরণ অনুভব করি। সেই আনন্দময় দিনই হচ্ছে ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ হলেও ফিতর মানে অনেক অর্থ বোঝায়। আমরা সহজ ভাবে বুঝবো নিজের জীবনের সমস্ত বিপদ-আপদ কেটে যাওয়ার জন্য আল্লাহর নামে অভাবিদের ঈদের আনন্দ সফল করার জন্য ছদকা দেওয়া। অর্থাৎ দান-খয়রাত করা। বিত্তশালী যারা তাদের জন্য আরো বড় নির্দেশ আছে। বিত্তের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দান করতে হবে। এই দানকে বলা হয় যাকাত। এই যাকাতের টাকা অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণে, হোটেলে, রেস্তরাঁয় গিয়ে আরামের নামে ব্যয় না করে আল্লাহর পথে ব্যয় করার শিক্ষাও এই ঈদ আনন্দের মধ্যেই নিহিত। এই সমস্তকে উপেক্ষা করছি বলেই আমরা আজ বিপদগামী। ঠিকানাবিহীন।
আগামিকাল ঈদ হবে কিনা তা জানতে চাঁদ দেখার জন্য আসরের পর থেকেই আমরা ভেতর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে গহীন জঙ্গলে গজানো গাছের শিকড়ে বসে থাকতাম। আমাদের বাড়ির পুরুষ মুরুব্বিরা বের না হলেও উত্তর পাড়ার অনেক মুরুব্বিরা আসতেন চাঁদ দেখার জন্য। দূর আসমানে চিকন চাঁদের দেখা পেলে আমরা লাফিয়ে উঠতাম খুশিতে। মুরুব্বিরা বলতেন হাত তুলে মোনাজাত কর। তোমাদের জন্য আনন্দের সওগাত এসেছে। মোনাজাত করে সবাই হইহুল্লোড় করে যার যার ঘরে ফিরে যেতাম। ঈদের আগে রাতে উত্তর পাড়ার মেয়েরা এসে মা-দাদীকে নানান ভাবে সাহায্য করত। সেমাই, পিঠা বানিয়ে দিয়ে যেত। চালের গুড়ায় গুড়, নারিকেল, দুধ মিশিয়ে বড় হাড়িতে এক ধরনের পিঠা রান্না হত। আমাদের অঞ্চলে এই ধরনের পিঠাকে বলা হয় গুড়া পিঠা। ঈদের দিনে যে কেউ আসলে এই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হত।
ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙত কিন্তু শীতের দিন হলে পুকুরে গোসল করা সহজ হত না। বাড়ির পেছনের বাগিচায় একটা গোসলখানা ছিল। ড্রাম ভর্তি পানি থাকত। ওখানেই আমরা গরম পানি দিয়ে গোসল করতাম। গোসল শেষে ঘরে ফিরে আসতাম। মন থাকত নতুন পোশাকের দিকে। কিন্তু দাদীকে বলার সাহস পেতাম না। কিন্তু দাদী চাঁদরাতেই ট্রাংক থেকে পোশাক বের করে রেখে দিতেন। মা গোসল করে আসতেই বলতেন, তোমাদের কাপড় অমুক জায়গায় রাখা আছে, সঙ্গে আতর-সুরমাও আছে। নতুন পোশাক পড়েই মুরব্বিদের সালাম কর। তারপর আসো মিষ্টি খাওয়ার জন্য। এরই মধ্যে পাড়াপড়শির ছেলেমেয়েরা আমাদের বাড়িতে আসত মুরুব্বিদের সালাম করতে। সালাম করে তারা পেত সেলামি। এগুলো যাকাতের বাইরে। শুধু বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যই। তারপরে তাদের মিষ্টি দেওয়া হত। মিষ্টি খাওয়ার পর সবাই নিজের খুশি মত এপাড়া-ওপাড়ায় ঘুরে বেড়াত। গরীব-ধনী বলে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। সবাই সবার বাড়িতে যেতে পারত। এবং মিষ্টি মুখ করত। ঈদের জামায়াত শেষে পাড়ার অধিকাংশ পরিচিত লোকজন প্রথমেই আসত আমাদের বাড়িতে। দাদীকে সালাম করার জন্য। আমরা কিন্তু বাড়ির সীমানা ডিঙিয়ে অন্য কোনও বাড়িতে যেতে পারতাম না। দুই বাড়ির লোকজন বাহির থেকে যারা আসতেন, তাদের নিয়ে আমরা ঈদ উদযাপন করতাম। মা-চাচীরা সকাল থেকে এত ব্যস্ত থাকতেন যে ঠিক সময়ে গোসলও করতে পারতেন না। প্রায় যোহর ও আসরের মধ্যখানে একটু অবসর পেলে গোসল সেরে দাদী ও বাড়ির অন্যান্য মুরুব্বিদের সাথে বয়স বুঝে পায়ে ধরে সালাম করার ফুরসৎ পেতেন। বাবা, জ্যাঠারা ও যারা বিদেশ থেকে আসত, বহুদিন পর দেশে আসার কারণে তাদের ব্যস্ততা ছিল গ্রামবাসিদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সাধ্যমত তাদের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা।
এভাবেই কেটে যেত আমাদের ছোট বেলার ঈদ উৎসব। এই উৎসবকে বলা হয় রোজাদারদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কার। ছোট কালের ঈদ আমাদের জন্য অনেক আনন্দ এবং উৎসব হলেও বর্তমানে সেই আনন্দ আর পাই না। ভালো খাবার আর নতুন পোশাক ধুম-ধারাক্কা গানের মধ্যেই ঈদের মহান আদর্শ বিলীন হয়ে গেছে। এজন্য আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে জীবনের প্রথমবেলার দিনক্ষণকে ঠিকমতো কাজে লাগানোর।

Share.

মন্তব্য করুন