আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করেছে সবুজ গাছের সারির ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা সড়ক ধরে। আকাশ ছোঁয়া পাইন গাছের ছায়া বিস্তার করে আছে চারপাশ। এ-রকম বিশাল বিশাল ঝাউগাছ বাংলাদেশে নাই। আমরা চলেছি পাহাড়ি পথে, দার্জিলিঙের উঁচু উঁচু পাহাড়ের গা কেটে বানানো রাস্তায়। সে কি আনন্দ; সে কি ভয়! একবার আকাশে উঠছি; একবার জমিনে নামছি। দার্জিলিঙ শহর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই পৌঁছে যাবার কথা কালিমপঙে। কিন্তু পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটায় আমরা জ্যামে পড়লাম। পড়ে অবশ্য ভালোই হলো। কারণ যে রাস্তায় আটকা পড়েছি তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে তিস্তা নদীর খর স্রোত। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা সরু নদীর স্বচ্ছ ঢেউ দেখে কি যে ভালো লাগলো কেমন করে বলি। আবার পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ জমে আছে। দুর্গম নদীতীর, ঢেউময় তিস্তার ধারা, ঘন অরণ্যময় পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘপুঞ্জ হাতছানি দিয়ে যেন ডেকে যাচ্ছে আমাদের।

কালিমপঙের পথে
আমরা আবার রওনা দিলাম কালিমপঙের উদ্দেশে। সে কি পাহাড়! দৈত্যের মতো একেকটা বিশাল বিশাল পাহাড়। ঘন অরণ্যঘেরা সেসব পাহাড় দেখে দূর থেকে মনে হয় রহস্য আর গুপ্তধনের দেশ। মেঘে মেঘে ছেয়ে যাওয়া, দিগন্ত ছোঁয়া সেইসব পাহাড় বুকের মাঝে এসে দোলা দেয়, আনচান করে মন শিহরিত হয়।পাহাড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি কালিমপঙের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে। দেখি পথের ধার দিয়ে স্কুলে যাচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে; দেখতে আমাদের চাকমা-মারমাদের মতো।প্রথমে আমরা কালিমপঙ সাইন্স সেন্টারে এসে নামলাম। ঘন মেঘের মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় সেই সেন্টার। এত ঘন মেঘ যে তিন হাত দূরের মানুষকে, কোন কিছুকে দেখা যাচ্ছে না; মনে মনে শিহরিত রোমাঞ্চিত হলাম। আকাশের মধ্যে যেন আমরা হারিয়ে গেলাম। সেকি আনন্দ! সে কি খুশি! যেন আমাদের পিঠে ডানা গজিয়েছে; আমরা উড়তে উড়তে চলে যাবো আরো দূর হিমালয়ের দেশে।

সাইন্স সেন্টারের সামনে ভারতীয় কয়জন বিজ্ঞানীর আবক্ষ প্রতিকৃতি রাখা আছে। ভেতরে প্রবেশ করে চমকে গেলাম: এই পাহাড়ের উপরে দুর্গম অঞ্চলে মেঘের দেশে একটি বিজ্ঞান সেন্টার করা হয়েছে। ভাবতেই এদের বিজ্ঞানপ্রীতি মনে পড়ে। গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, মহাকাশ বিজ্ঞানের বিভিন্ন চিত্রাবলী, সূত্রাবলী, বিভিন্ন ছবি, বিভিন্ন আইটেমের মধ্যে দিয়ে দেখানো হয়েছে এবং বুঝানো হয়েছে বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে। আমরা হঠাৎ এসে পড়লাম একটা আয়নার সামনে; দেখি আমি অনেক লম্বা ও পাতলা হয়ে গেছি। পাশেই দেখি আরেকটি আয়না সেখানে গিয়ে দেখি একদম বেটে ও মোটা হয়েগেছি। বেশ মজা করে আমরা আয়নার সামনে দাঁড়ালাম, নিজেদের বিকৃত আকার দেখে বেশ মজাই পেলাম। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি আমাদের অন্যান্য সাথীরা একটি যাদুর বাক্সে ঢুকেছে। জাদুর বাক্সের মজা হলো- যে অংশটাতে কাচ আছে সেখানে কোন কিছু বা অঙ্গ দেখা যায় না। বাক্সটা গলা পর্যন্ত; বাক্সের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতেই শুধু গলা দেখা যাচ্ছে আর স্বচ্ছ কাচের মধ্যেগোটা শরীর অদৃশ্য; আশ্চর্য হয়ে আমরা বেশ আনন্দ করলাম সেই বাক্স নিয়ে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা বিজ্ঞানের সেই সূত্রগুলো দেখে বেশ খুশি হলো। আমরা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী একসঙ্গে গিয়েছিলাম; সেজন্য শিক্ষার্থীদের নানান বিষয়গুলো দেখিয়ে বেড়ালাম: বিজ্ঞান কিভাবে আমাদের পৃথিবীর মধ্যে কাজ করে। সেন্টার থেকে বের হয়ে প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঘের মধ্যে পাহাড়, সেখানে পার্ক, পার্কের মাঝে দোলনা, ক্যাকটাসের বিশাল বিশাল গাছ, গ্লোব, বসার জায়গা, শিশুদের জন্য খেলার নানান সরঞ্জাম- সবমিলিয়ে চমৎকার একটি পার্ক।সবচেয়ে শিহরণের বিষয় হলো আমরা সবাই জলজ মেঘের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম; সাঁতার কাটছিলাম; একে-অপরকে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিলাম; একটু দূরে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না যেন আমরা মেঘের দেশে লালপরী নীলপরী হয়ে ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সত্যি অসাধারণ আনন্দের সময় কেটেছিল সেই বিজ্ঞান সেন্টারে।

ক্যাকটাস বাগান
সাইন্স সেন্টারের আনন্দ বুকে নিয়ে আমরা চললাম অন্য একটি পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে অবাক; দেখি ক্যাকটাসের বাগান ও নার্সারি। একে ক্যাকটাস সাম্রাজ্য বলা যায়। পৃথিবীর সব ধরনের ক্যাকটাস যেন এখানে সংগ্রহ করা হয়েছে; সারি করে সেগুলো বিন্যাস্ত। কত রকম কত রঙের কত আকারের ছোটবড় বিশাল লম্বা, লাল সবুজ হলুদ বিচিত্রপ্রজাতির ক্যাকটাস এখানে জাগ্রত। ক্যাকটাসের যে তাবু আছে সেই তাবুর মাঝে দাঁড়িয়ে ক্যাকটাসের সঙ্গে ছবি তুললাম। কোন কোন ক্যাকটাস আমাদের চেয়ে অনেক উঁচু; কাঁটাযুক্ত লোমযুক্ত এক একটা ক্যাকটাস বাংলাদেশের কুমড়ার মত। ক্যাকটাসের রাজ্য থেকে বের হয়ে মুগ্ধতা আর বিস্ময় সঙ্গে করে নিয়ে আমরা ‘ডেলো’র উদ্দেশে রওনা দিলাম।

ডেলোর ফুল বাগান
দেখতে দেখতে যখন ডেলোতে এসে নামলাম তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিলো। আমরা স্থানীয় বাজারে বিশাল আকারের ছাতা কিনে ছাতা মাথায় টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বেড়াতে গিয়ে পৌঁছালাম এক বিস্ময়কর জায়গায়। অজস্র ফুলের বন্যায় ফুলের এক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে এখানে। ফুলগুলো মনে হচ্ছিলো যেন কাগজের বানানো। রাস্তার দুপাশে, বাগানে অজস্র ফুলের সভা: সাদা লাল নীল বেগুনি হলুদ ফিরোজা আসমানী কতশত রকম ফুল; ফুলের রাজ্য যেন একটা। সেই ফুলবাগানের মাঝেই রেস্টহাউজ দেখতে পেলাম। দোতলা ছিমছাম যেন একটা দুর্গ; রেস্ট হাউজে রাত্রি যাপন করা যায়; সেই পাহাড়ের চূড়ায় ফুল বাগানে রাত কাটানোর কথা ভাবলেই রোমাঞ্চ জাগে। এখানে নাকি কবি রবীন্দ্রনাথ একবার এসেছিলেন। একজন কবির তো আসারই কথা: এত সৌন্দর্য, রহস্য আর আনন্দে কবিরাই ভালো মতো উপভোগ করতে পারে সবকিছু।

পাহাড়ের চারিদিকে আকাশছোঁয়া পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। পাহাড়ের চূড়ায় বসার জায়গা; সেই জায়গায় বসে পাহাড়ের ঢাল দেখতে চাইলাম কিন্তু ঘন মেঘের আস্তরণে কিছু দেখা গেল না। মনে হলো সাদা ঘন মাঘ মাসের কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি।। আশঙ্কা-আনন্দ-ভয়-শিহরণ-বিস্ময়ও উপভোগ একসঙ্গে আমাদের মাঝে কাজ করছিল। ডেলো পর্যটন কেন্দ্র ভালো মত ঘুরেফিরে আবার রওনা দিলাম অন্য এক পর্যটন কেন্দ্রে। দার্জিলিঙের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পাহাড়ের শরীর কেটে সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ছুটে চলা। জানালা দিয়ে দূর দিগন্তের মেঘমালা দেখা যায়, ওখানেও দূর পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র ঘরবাড়ি। ওরাও নিশ্চয় এভাবেই আমাদেরকে দেখছে ভাবছে। প্রতিটা পাহাড়ের গায়ে অজস্রঘরবাড়ি, মার্কেট, রাস্তা, ভবন, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ। সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায়ঝিকিরমিকির চলছে রেলগাড়ি। ট্রেনের জানালা দিয়ে হাতে ও মনে মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাতাস ছুঁয়ে আমরা চললাম অন্য এক পাহাড়ের দেশে।

পাহড়ি হ্রদে মেঘের মিছিল
বৃষ্টির মধ্যেই রওনা দিলাম মিরিকের পথে। বৃষ্টি হচ্ছে আর আমরা পাহাড়ি পথ ধরে চলেছি যেন সব পেয়েছির দেশে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল পাহাড়ি চায়ের বাগান। পাহাড়ের গায়ে খাঁজকাটা চায়ের বাগানমন ভরিয়ে দিলো; সবুজের বিপ্লব বিস্তার মনকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গেল কল্পনার রাজ্যে। আমাদের সিলেটের যে পাহাড়গুলো আর টিলাগুলো তার চেয়ে দশগুণ হবে এত বড় বড় পাহাড়; তার গায়ে চায়ের বাগান। দার্জিলিঙের চায়ের অনেক সুনাম শুনেছি; এবার চায়ের বাগান দেখলাম এবং চায়ের স্বাদ উপভোগ করলাম- দারুণ চায়ের স্বাদ। মিরিক এক বিস্ময়কর প্রকৃতির রহস্য। সাত হাজার ফিট উঁচুতে পাহাড়; সেই পাহাড়ের মাঝে একটি বিশালাকার হ্রদ। হ্রদের পানির ঢেউ খেলে যাচ্ছে; তার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সাঁতারকাটা মেঘের হাঁসগুলো। আমরা সেই হ্রদে একটি ছোট্ট নৌকা নিয়ে ভেসে চললাম মেঘের সঙ্গে সঙ্গে; মেঘগুলো আমাদের শরীরে মনে আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে থাকলো আনন্দ দিতে থাকলো আনন্দের সাথে।মিরিকের চমৎকার বিশাল হ্রদের ঢেউ আমাদের মোহিত করলো। পথের ধারে সেই বিশাল উঁচু ঝাউ গাছগুলো যেন পাহারা দিচ্ছে হ্রদকে।এখানে ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা আছে। আমাদের অনেকেই সেই ঘোড়ায় চড়ে ছুটে বেড়ালো। সেই সব আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মত না।

ফেরার পথে
মিরিকের আনন্দ উপভোগ করে আমরা ফিরে এলাম শিলিগুড়ি শহরে। মহানন্দা নদীর ধারে শিলিগুড়ি শহর। কালিমপঙে যেতে তিস্তায় দেখলাম অনেক পানি;মাঝে মাঝেজল-বিদ্যুৎ প্লান্ট এবং মহানন্দা নদীতেও দেখলাম অনেক পানি। অথচ এই নদীর ধারা বাংলাদেশে এসে শুকনো মরুভূমি। বুঝলাম প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি নিশ্চয়ই একদিন তার ক্ষতির প্রতিশোধ নেবে। দার্জিলিঙ শহর, কালিমপঙ, ডেলো ও লিরিক ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম শিলিগুড়ি হয়ে স্বদেশে। সফরের সঙ্গে ছিলো আনন্দ, শিহরণ, রহস্য, উদ্দীপনা, রোমান্স, সংশয়আর ভয়। সেইসব অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম অবশেষে। এই ভ্রমণ জীবনে কখনো ভুলব না, সম্ভব নয়।

Share.

মন্তব্য করুন