মুসলমাদের জন্য বছরে দুটি ঈদ রয়েছে। একটি হলো ঈদুল ফিতর অন্যটি হলো ঈদুল আজহা। এ দুটি দিনই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্ববহ। এটি আমাদের জাতীয় জীবন ও সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে একাকার হয়ে। এটা শুধু মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, গোটা জাতির জন্য শিক্ষামূলক সামাজিক উৎসবও বটে। সুতরাং এটি সমাজের প্রতিটি মানুষকে সমানভাবে আলোড়িত করে। আর একজন কবি বা গীতিকারের সংবেদনশীল হৃদয়ে তো এর ছোঁয়া লাগবেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই ঈদ বাংলার কবি সাহিত্যিকদের ও গীতিকারদের ও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ঈদকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কবি সাহিত্যিক গান, কবিতা, গল্প, নাটক, ছড়া ইত্যাদি রচনা করেছেন, সমৃদ্ধি করেছেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা বাংলা গানে ঈদ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আমরা সবাই জানি বাংলা ভাষায় ঈদকে নিয়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইসলামের সুগভীর মর্মবাণী সমৃদ্ধ গান রচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর ভূবন কাঁপানো সুরের দোলা
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ।
তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত মুর্দ্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত ও দুশমন হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরীদ।’
এই গানটি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের কাছে একটি অসাধারণ ঈদ সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর এই গান না হলে ঈদুল ফিতরই অপূর্ণ থেকে যায়। এই মন মাতানো গানের মাধ্যমেই সবুজ বাংলায় স্বাগত জানানো হয় ঈদকে।
গানে, সুরে, ছন্দে কবি গোলাম মোস্তফার চোখেও ঈদের ছবি ভাসছে এইভাবে-
‘আজ নতুন ঈদের চাদঁ উঠেছে
নীল আকাশের গায়।
তোরা দেখবি কারা ভাই বোনেরা
আয়রে ছুটে আয়।’
আমাদের ঐতিহ্যের অনন্য পুরুষ, ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রপথিক কবি ফররুক আহমদ পুরো দুনিয়াকে ঈদগাহর সাথে তুলনা করে লিখেছেন।
‘আজকে এল খুশীর দিন
দেখনা চেয়ে খুশীর চিন
দেখনা চেয়ে আজ রঙিন
খুশীর ঝলক ঈদগাহে।
জামাত ছেড়ে থাকবে যে
ঘরের কোণে রইবে সে
রইবে হয়ে একপেশে
একলা থাকার দুঃখ তাই।
সবাই মিলে একদলে
এক আশাতে যাই চলে
এক আশাতে যাই বলে
ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।’
অধিকাংশ কবি সাহিত্যিক আর গীতিকারগণ ঈদের দিনকে খুশির দিন হিসেবে চিত্রিত করলেও বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন ব্যতিক্রম সুর-
‘ঈদের খুশি অপূর্ণ রয়ে যাবে ততদিন
খোদার হুকুমাত হবে না কায়েম
কায়েম হবে না যতদিন।
যেখানে মানুষ অধিকার হারা
যেখানে জীবন দুঃখে শোকে ভরা
সেখানে আকাশের ঈদের ঐ চাদঁ
মেঘেই ঢাকা যে চিরদিন।
যেখানে জুলুম সীমা ছেড়ে যায়
কুফরি বাতিল শুধু বেড়ে যায়
সেখানে মানুষের হৃদয়াবেগ
থাকে না থাকে না অমলিন।’
কবির এ গানের কথাগুলো যৌক্তিক। কারণ দুনিয়ায় খোদার হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর এ বৈষম্য দূর হলেই ঈদ হবে সত্যিকার আনন্দের দিন; তা সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম-প্রীতি আর শান্তির পরশ।
তিনি তাঁর আরেকটি গানে লিখেছেন-
‘ঈদের রাতে হয় মুনাজাত কবুল
বলেছেন যে মুহাম্মদ রসূল
এই রাতে তাই প্রাথর্না তো শুধু
ইরাকীদের জয়ী করো ওগো
জয়ী করো চেচেন যোদ্ধাদের ও
কাস্মীরে দাও বিজয় দান
মুসলমানের পানে একটু ফিরে চাও।
ঈদের রাতে হয় মুনাজাত কবুল
ভাসিয়ে দিলাম তাই দুচোখের কুল।’
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি ও গীতিকার গোলাম মোহাম্মদ তাঁর গানের মধ্যে ঈদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে-
‘অনুরাগে রঙিন গোলাপ তুলে
ফুলদানি সাজিয়েছি প্রীতির ফুলে
আমাদের চোখে প্রেম সুরমা আকাঁ
ঈদের খুশি আজ মেলেছে পাখা।
সোনালি-জরিন দিন আলো ঝরানো
দোলা দিল দোলা দিল মন ভরানো
বুকে প্রেম মুখ মিঠে হাসিতে মাখা।
আজ মহা মিলনের চলেছে মিছিল
ঈদ এলো ঈদ এলো প্রেমে ঝিলমিল।”
প্রখ্যাত ছড়াকার, সফল গীতিকার সাজজাদ হোসাইন খান তার গানে ঈদের সুুন্দর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে-
‘ঈদ আসে ঈদ যায় ঈদ থাকে ঝুলে
হৃদয়ের রেনু মেখে গোলাপের ফুলে।
আকাশের ছাদ ভেঙে ঈদ উঠে হেসে
ঈদ হাটেঁ তারাদের গাও ঘেষেঁ ঘেষেঁ।
… … …
রঙমাখা প্রজাপতি জোনাকির বাতি
ঈদ যেন সাগরের ঢেউ মাতামাতি।
সূর্যের দড়ি বেয়ে ঈদ আসে নীচে
উম উম ভালবাসা আসে পিছে পিছে।
সম্প্রীতি বন্ধন ঈদ তার নাম
স্নেহের সবুজ খামে মধু আনজাম।’
বাংলা গানের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মোশাররফ হোসেন খানের গানের বিশাল বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে ঈদ কেন্দ্রিক অনেক মন মাতানো, হৃদয় দোলানো গান।তার অসংখ্য গানের মধ্য থেকে পাঠকদের জন্য উপহার দিচ্ছি হৃদয় হরণকরা এ গানটি।
‘ঈদ মানেতো খুশির খেলা
ফুলের মতো গন্ধে দোলা
ছন্দে ঝরা বিষটি ধারা
টাপুর, টুপুর
ঈদ মানেতো দেদোল দোলা
সকাল দুপুর।
ঈদ মানেতো বিভেদ ভোলা
খোকা খুকুর হৃদয় খোলা
মোমের নূপুর,
ঈদ মানেতো ভোর সকাল
দুয়ার খোলা
ঈদ মানেতো
মন সাগরে ঢেউয়ের দোলা।”
নববই দশকের শক্তিমান কবি, খ্যাতিমান গীতিকার জাকির আবু জাফর তার গানে ঈদের নান্দনিক ছবি একেঁছেন এভাবে-
‘ঈদের মতই সবার জীবন আনন্দময় হোক,
সেই আনন্দে ওঠুক মেতে সারা বিশ্বলোক।
ঈদ আনন্দ ঈদ আনন্দ জীবন জাগার গান,
জীবন জুড়ে সাজায় সুখের অনন্ত উদ্যান।
স্বপ্ন ভরা প্রাণের আবেগ অশেষ মায়ালোক।
অন্য রকম সুখের মেলা অন্য রকম সুর,
বুকের মাঝে ছড়িয়ে রাখে জীবন্ত রোদ্দুর।
ঈদের গানে প্রাণের বীণা ভোলায় দুঃখ শোক।’
কবি ও গীতিকার আসাদ বিন হাফিজের কলমে ঈদের চিত্র ফুটে উঠেছে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে-
‘সকল ফুলের সেরা গোলাপের ফুল
সকল মানব সেরা পেয়ারা রাসূল
সকল ঘরের সেরা কাবা মসজিদ
বছরের সেরা দিন খুশি ভরা ঈদ
সকল খুশির সেরা আশা ভরা ঈদ
পৃথিবীর সেদিন হয় পরম সুহৃদ। ”
বাংলা গানের আলোকিত মুখ আবু তাহের বেলাল ঈদ নিয়ে লিখেছেন সুুন্দর গান। যেমন
“ঈদ মানে তো তোমার আমার নতুন জামাটাও
ঈদ মানে তো ফিরনি সেমাই জর্দা তেহারি
ঈদ মানে তো চটপটি আর কাবাব নেহারি
ঈদ মানে তো জুলুম বাজের জুলুম থামাটাও।
ঈদ মানে তো সমাজ গড়া বিবাদ বিভেদ হীন
ঈদ মানে তো এক কাতারে হাতের সাথে হাত
ঈদ মানে তো হিংসা ভোলার একই মোনাজাত
ঈদ মানে তো দখিন হাওয়ায় শান্তি সুখের বীণ।
ঈদ মানে তো কেউ বড় আর নয়তো ছোট কেউ
ঈদ মানে তো সাদা কালোর দ্বন্দ্ব ভোলার নাম
ঈদ মানে তো নাগাল পাওয়া ছন্দ অবিরাম
ঈদ মানে তো বুকের গাঙে বিমল আলোর ঢেউ।”
খ্যাতিমান গীতিকার তফাজ্জল হোসেন খান ঈদ নিয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন। প্রতি বছর ঈদ এলেই শিশুরা সমবেত কন্ঠে কোরাস তোলে এভাবে-
‘আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে
দুলছে খুশির নদী প্লাবনে
ঘরে ঘরে জনে জনে
আজি মুখর হব মোরা গানে গানে
ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আজ
বল ঈদ মোবারক আজ।’
সিরাজুল ইসলামের গানে ঈদের প্রতিফলন দেখতে পাই এমনিভাবে
‘সাওয়ালের খুশির খবর নিয়ে দুনিয়ায়
জান্নাতী সুধা ঝরে যেন তার অপরুপ জোছনায়
নতুন ছন্দে সে খুশির বাণী
আকাশে বাতাসে করে কানাকানি
ব্যথিত ধরণী খুশিতে আবার ঈদের মহিমায়।’
এভাবেই আমাদের বাংলা গানের সুর ও ছন্দে ঈদের শিক্ষা, মহিমা এবং গরিমা ভাস্বর হয়ে উঠেছে। যুগের পর যুগ রচিত হয়ে চলেছে, ঈদের গান। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ঈদকে কোনো কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারই খুশি ও আনন্দের কেবল ঝর্নাধারা হিসেবে চিহ্নিত করেননি; বরং তাদের দৃষ্টি ও মননের সীমায় আছে সু-ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতা, এক, সাম্য আর মহামিলনের এক বৈশ্বিকবোধ। মূলত এটাই তাদের গানের মূল সুর। রমজানুল মোবারক ও ঈদ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও রাসূল (স.) যে ধরনের শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন, ঈদ বিষয়ক গানে আমরা তারই প্রতিধ্বনি লক্ষ করি। সন্দেহ নেই, ঈদ মুসলিম মিল্লাতের জন্য একটি সার্বজনীন আনন্দ উৎসব। কিন্তু সেই সাথে আবার স্বাতন্ত্রিকও বটে। কারণ ঈদের এই সাম্যের শিক্ষা ও বৈশিষ্ট্য একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মে লক্ষ্য করা যায় না। ঈদের গান ও এই সার্বভৌম উদার শিক্ষা ধারণ করেই বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীর মত। বাংলা গানে এটাও একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঐশ্বর্য বটে।