১.
সাজ্জাদকে হাসপাতালে নেয়ার খবর শুনে রনির চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল, আষাঢ়ের আকাশ যেমনটা হয়ে থাকে। বাইক নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো সে। যাওয়ার সময় এক ছোট্ট মেয়ে তার বাইকের নিচে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেল। সাদা দাড়িধারী এক বৃদ্ধ ছোট্ট মেয়েটিকে একটানে বাইকের সামনে থেকে রাস্তার একপাশে নিয়ে এলো। রনি ‘শিট’ বলে আগের মতোই দ্রুতবেগে চলে গেল।
ক্লাস এইটে পড়ে রনি। সাজ্জাদও। তাদের আরও যে ক’টা বন্ধু আছে সবাই ক্লাস সেভেন-এইট-নাইন-এ পড়ে। পড়ে বলতে নামকাওয়াস্তে, পড়াশোনা নেই। সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে দেয়। রাত গাঢ় হলে ঘরে ফেরে, কোনও সময় আবার ফেরেও না! সাজ্জাদ হলো রনির ডানহাত, এত অল্প বয়সেও এরা ডানহাত-বামহাত বনে গেছে! ডানহাত বলে নয়, ছোট থেকেই সাজ্জাদকে খুব ভালোবাসে রনি। সাজ্জাদের কিছু হলে রনি আর ঠিক থাকতে পারে না, যেন রনির প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে সাজ্জাদের মাঝে!
হাসপাতালে পৌঁছে দ্রুত সাজ্জাদের কাছে চলে যায় রনি। সাজ্জাদের মুখে মাস্ক লাগানো, কেমন যেন অসহায়-অসহায় ভাব! পাশে বসে আছে সাজ্জাদের বাবা ও বড় ভাই। রনিকে দেখে তারা কোনও কথা বলল না, আগের মতোই সাজ্জাদের দিকে মুখ করে রইল। রনি জানে- তারা এমনটাই করবে। রনি-সাজ্জাদদের কাজ-কারবার এলাকার কেউই পছন্দ করে না। সাজ্জাদের কাছে গিয়ে রনি তার চোখাচুখি হলো, কুশল বিনিময়ও হলো চোখে চোখে। এখন সাজ্জাদের সাথে কথা বলার কোনও সুযোগ নেই, বলতে চাইলেও পারবে না, কারণ মুখে মাস্ক লাগানো।
রুমে কিছুক্ষণ থাকাতে সাজ্জাদের বাবা ও ভাইয়ের কথায় রনি বুঝতে পেরেছে, তার শ্বাসটানের প্রবলেমটা আবার দেখা দিয়েছে। এটা মাঝেমাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন সাজ্জাদের অবস্থা জবাই করা মুরগির মতো হয়ে যায়।
এরই মধ্যে রনির মোবাইলে একটা কল এলে সে ইশারায় সাজ্জাদকে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কল দিয়েছে সজীব। সে-ও রনির গ্যাংয়ের ছেলে। সজীব জানাল, জয়নালকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। কী কারণে ধরে নিয়ে গেছে তার বিস্তারিত কিছুই জানে না সে। তবে ইভটিজিং সংক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে।
রনি বুঝতে পেরেছে, জয়নালের ব্যাপার যেহেতু সেটা ইভটিজিংই হবে। সে মেয়ে দেখলে আর ঠিক থাকতে পারে না, হাবিজাবি মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। কিছুদিন আগে এক মেয়েকে পেছন থেকে ‘হাই’, ‘হাই’ করে ডাকছিল জয়নাল, মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালে সে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। মেয়েটি তারই ছোটবোন ছিল! পরে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলল, তোকে এত করে ডাকছি কথা কানে যায় না?
ছোটবোন বলল, নাম ধরে না ডেকে ‘হাই’ ‘হাই’ করলে কে কার ডাকে সাড়া দেবে?
রনি খোঁজ নিয়ে দেখল, ইউএনওর ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়েকে ইভটিজিং করার অভিযোগে জয়নালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। থানায় নিয়ে গেছে তাকে। একে তো ইউএনওর মেয়ে, তার ওপর ইভটিজিংয়ের অভিযোগ! এ ব্যাপারে লবিং করেও কাজ হবে না, উল্টো নিজেই ফেঁসে যাবে। এই মামলায় আগাম জামিনের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এসব অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এ ছাড়াও রয়েছে অর্থদণ্ডের বিধান।
সজীবকে বলল, জয়নালের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার নেই, মাথা ঘামালেও কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। তারচেয়ে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সজীবও ‘হ্যাঁ’ বলে ফোন রেখে দিলো।
জয়নালকে গ্রেফতারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই কল আসা শুরু করল রনির মোবাইলে। একটা কল এলো জয়নালের বাবার মোবাইল থেকে। রনি বুঝতে পারল কেন কল দিয়েছে জয়নালের বাবা। সে রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে দিলো। এরপর আরও বহু কল এসেছে, রনি টুকটাক কথা সেরে রেখে দিয়েছে।
এত এত কল আসাতে রনির নিজেরও আলাদা একটা ভাব চলে এলো। দুই বছর আগেও এমনটা ছিল না সে। মাত্র পনেরো বছর বয়স, এই বয়সেই কত বড় বড় লোক তাকে কল করে, তাদের প্রয়োজনে ডাকে, অনুনয় করে। সে অবাক হয়, নিজে নিজে হাসে। কিন্তু ঘরের লোকজন তাকে দেখতেই পারে না, তার কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট তারা।
রনি তার ‘বড়ভাই’কে কল দিলো। এলাকায় অনেকেই নিজেকে ‘বড়ভাই’ দাবি করলেও বড়ভাই আছে একজনই। সবাই তাকে ভালো মানুষ হিসেবে চিনলেও তার আরেকটি চেহারা আছে। যেটা অনেকেই চেনে না, চেনে গুটি কয়েকজনে। রনি একমাত্র তাকেই মানে, তার সব কাজ করে দেয়। বড়ভাইও রনির সব প্রয়োজন মিটায়। রনি যে বাইকটা চালায় সেটাও বড়ভাইয়ের দেয়া, প্রতিদিনকার তেলখরচও বড়ভাই দেন।
রনির সাথে বড়ভাইয়ের পরিচয় পর্বটাও কাকতালীয়। এলাকায় রনি এখন ‘গ্যাং লিডার’ হিসেবে পরিচিত। দুই বছর আগেও সে এমনটা ছিল না। ক্লাস ফাইভে থাকতেও কত ভালো ছাত্র ছিল। নম্র, ভদ্র ছিল। বড়দের দেখলে সালাম দিত। নিয়মিত নামাজে যেত।
শুধু তা-ই নয়, ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে সরকারি বৃত্তি পেয়েছিল! সেই রনি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়ে হঠাৎ পাল্টে গেল, পাল্টাতে লাগল তার স্বভাব-চরিত্র, চালচলন।
রনির ‘গ্যাং লিডার’ হয়ে ওঠার পেছনেও একটা কাহিনি আছে। ক্লাস ফাইভ পাস করে সিক্সে ভর্তি হওয়ার পর নতুন স্কুলে সব নতুন নতুন লাগছিল। পুরনো বন্ধুদের অনেকে একই স্কুলে ভর্তি হলেও শাখা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তাই অনেকটা একা একা লাগছিল রনির। নতুন কাউকে বন্ধু করে নেবে সেই সুযোগও কম ছিল। নতুন স্কুলে সবাই যেন রনির কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চায়! রনি সেটা পরে বুঝেছে। রনি একটা অখ্যাত স্কুল থেকে এসেছে বলেই বাকিরা তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছিল না। কিন্তু তারা জানতো না যে, রনি ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত।
একদিন স্কুলে টিফিন আওয়ারে খেলা শেষ করে সবাই ক্লাসে স্যার আসার অপেক্ষায় ছিল। সবাই যার যার সিটে বসা। এমন সময় একটা আর্তচিৎকার এলো, একই সময়ে ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল! যারা ঘটনার পাশে ছিল, কেবল তারাই বুঝেছে। বাকিরা ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু খুঁজতে লাগল। একটু পরেই দেখা গেল, বসার বেঞ্চজুড়ে রক্ত আর রক্ত! এতক্ষণ যারা হাসছিল তারাও রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ঘটনা রনির পাশের বেঞ্চেই। এক ছেলে দাঁড়ানো ছিল, বেঞ্চে বসতে যাওয়ার আগে তার বসার জায়গায় একটা ক্যাপ খোলা কলম দিয়ে রাখে। যে-ই বসতে গেল অমনি সেটা তার পেছনে বিঁধে গেল। রক্তে সয়লাব হয়ে গেল ছেলেটার প্যান্ট, চিৎকার-হাহাকারে স্যারসহ অন্য ক্লাস থেকেও দৌড়ে এলো অনেকে। দ্রুত ছেলেটাকে বাজারের ডাক্তারখানায় নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো।
ততক্ষণে ঘটে গেছে আরেক কাণ্ড। কে যেন রনির ব্যাগসহ বইগুলো আহত সেই ছেলেটার পাশের সিটে রেখে এলো। ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই রনিকে জোর করে সেই সিটে বসতে বাধ্য করল রবিন ও তার বন্ধুরা!
জামাল স্যার এসে এবার দোষীকে খুঁজতে লাগল। জামাল স্যার একটা আতঙ্কের নাম। ওনার ক্লাসে পড়া না-শিখে কেউ আসে না, পড়া শিখতে না-পারলে সেদিন স্কুলেই আসে না ছাত্ররা। ইয়া মোটা শরীর জামাল স্যারের, হাতের আঙুলগুলো যেন একেকটা ঢেঁড়স, আবার দুই হাত মিলে পাঁচটার মতো আংটি। আংটিগুলো কবে পরেছে কে জানে! আংটির ফাঁকে ফাঁকে ময়লা জমে থাকে! গায়ে ফতুয়া, বঙ্গবন্ধুর চশমার মতো মোটা ফ্রেমের চশমা থাকে চোখে। সিক্সের ক্লাসটিচার হিসেবে জামাল স্যারকে রাখা হয়েছে, যেন স্কুলে আসা নতুন ছাত্ররা ক্লাস ফাঁকি দিতে না পারে। বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন ছাত্ররা যেন একটা নিয়মের মধ্যে থাকে।
রুমজুড়ে নিশ্চুপ নীরবতা, কারো মুখে রা নেই। স্যার বললেন, এই কাণ্ড কে ঘটিয়েছে?
কোনও জবাব না পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কে করেছে বল? নইলে সবক’টাকে রামপ্যাঁদানি দিয়ে পিঠের ছাল তুলে নেবো!
রবিন দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, ঐ বেঞ্চে যেহেতু ঘটনা ঘটেছে, তাহলে ওদেরই কেউ একজন করেছে!
– কেউ একজন নয়, সুনির্দিষ্ট করে বল কে করেছে?
– ওর পাশে বসা ছিল রনি!
– তার মানে কি এই কাণ্ড রনি ঘটিয়েছে?
রবিনের বন্ধুরা তখন একযোগে বলে উঠল, হ্যাঁ স্যার, এই কাণ্ড রনিই করেছে!
স্যার তো রেগেমেগে আগুন। হুঙ্কার দিয়ে বলল, রনি! তুই করেছিস এই কাণ্ড! তোকে তো সিধেশান্ত ছেলে মনে করেছিলাম, ভেতরে ভেতরে তুই কি মানুষের পেছনে কলম দেয়া শুরু করেছিস!
স্যারের এমন কথায় ক্লাসে হাসি শুরু হয়ে গেল, যদিও রবিনদের মুখে তেমন একটা হাসির ছাপ দেখা যাচ্ছে না!
জামাল স্যারের কথার জবাব দিতে যাচ্ছিল রনি, এমন সময় হেডস্যার ঢুকল ক্লাসে। জামাল স্যার সবকিছু বললেন হেডস্যারকে। হেডস্যার বললেন, রনিকে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেয়া হবে, এই স্কুলে তার ছাত্রত্ব বাতিল। আমি আমার স্কুলে এমন বেয়াদব ছেলেকে রাখতে চাই না। একটা বেয়াদব থাকলে তার সংস্পর্শে আরও বেয়াদব তৈরি হবে। তার চেয়ে স্কুলকে বেয়াদবমুক্ত করাই শ্রেয়।
হেডস্যারের এমন কথায় জামাল স্যারও মাথা নেড়ে সায় দিলো। সিদ্ধান্ত হলো, রনিকে স্কুল থেকে টিসি দেয়া হবে।
রনি হেডস্যারকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তিনি তা শোনেনি, উল্টো রনিকে শাসিয়ে বলেছে, জামাল স্যার যেটা বলেছে সেটাই, কোনও কৈফিয়ত দিতে আসবে না।
২.
রনি স্কুল থেকে ফেরার আগেই তার বহিষ্কারের খবর পৌঁছে গেল তার বাবার কাছে। রনির বাবা নিজেও একজন স্কুল টিচার। অন্য একটা স্কুলের। রনি ঘরে পৌঁছে প্রথমেই বাবার তোপের মুখে পড়ল। এক ঝাঁপি বকা শুনল বাবার কাছে। বকা শেষে বলল, স্কুল থেকে তো টিসি দিয়ে দেবে, এবার কোথায় ভর্তি হবি? কোনও স্কুল কি তোকে ভর্তি করাবে?
– এখন যে স্কুলে আছি সেই স্কুলেই পড়ব, অন্য কোনও স্কুলে পড়তে হলে পড়ালেখাই করব না!
– বাড়াবাড়ি করিস না। তোর মতো বেয়াদবের মুখে এমন বাড়াবাড়ি মানায় না, চুপ থাক!
রনির মা এসে বলল, শুরু থেকেই তো ওকে বকে যাচ্ছ? ও কী বলতে চায় তা কি একবারও শুনতে চেয়েছো? না তুমি শুনতে চেয়েছো, না স্কুলের স্যারেরা শুনতে চেয়েছে! আমার নিরপরাধ ছেলেটাকে শুধু শুধু সবাই অপরাধী বানিয়ে ছাড়ছে- বলেই হু হু করে কেঁদে দিলো রনির মা! মায়ের কান্না দেখে রনি নিজেও কেঁদে দিলো। দু’জনকেই কাঁদতে দেখে রনির বাবা বলল, কান্না থামাও, কী ঘটেছে পুরোটা বলো আমায়।
রনির বলা শেষে ওর বাবা বলল, তোমার কথা বিশ্বাস করলাম। কাল তোমার সাথে স্কুলে আমিও যাবো। কোনও ধরনের খোঁজখবর না নিয়ে একটা ছাত্রের জীবন এমনভাবে ধ্বংস করতে পারে না।
পরদিন রনিসহ রনির বাবা স্কুলে গিয়ে প্রথমেই হেডস্যারের রুমে গেল। হেডস্যার তখনও আসেনি। আরেকজন টিচার ছিল, রনিকে দেখে তিনি বললেন, এতটুকুন ছেলে এমন দুষ্টুমি করতে পারে!
কথাটা রনির বাবার সহ্য হলো না, তিনি বললেন, কী দুষ্টুমি করেছে আমার ছেলে? এ কাজটি যে ও করেছে আপনি দেখেছেন?
– দেখতে হবে কেন? সবাই জানে যে, এটা রনিরই কাজ!
– না জেনে কথা বলবেন না। আমি যদি বলি, আপনি কাউকে না- জানিয়ে স্কুলের ডাব বেচে টাকা মেরে দেন, তখন কি আপনি চোর বনে যাবেন? কথা আর বাড়াবেন না, ছাত্রের সামনে আপনাকে অপদস্থ করতে চাই না।
রনির বাবার কথা শুনে স্যারটি চুপ মেরে নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে উঠল।
এরইমধ্যে হেডস্যার চলে এলেন। রনির বাবাকে দেখে সালাম দিলেন। দু’জনই আগে থেকে পরিচিত। কুশল শেষে প্রথমে হেডস্যারই বললেন, দেখছেন, কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়ে বসল আপনার ছেলে! ওকে তো নম্র-ভদ্র হিসেবেই জানতাম!
– হুম, সেটা জানাতেই আপনার কাছে এলাম!
– সেটা জানাতে মানে? আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন হেডস্যার।
-হ্যাঁ, আপনারা যে আমার ছেলেকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে টিসি ধরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একবারও কি ওর কথা শুনেছেন বা শুনতে চেয়েছেন?
– কী বলতে চান!
– বলতে চাই, আমার ছেলে অপরাধী নয়। অপরাধী অন্য কেউ। সেটা খুঁজে বের করুন। আর যদি প্রমাণিত হয় আমার ছেলে অপরাধী তাহলে ওকে বহিষ্কার করে দেবেন, তাতে আমার কোনও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু কারও মুখের কথা বিশ্বাস করে বিনা অপরাধে আমার ছেলের জীবনে দাগ লাগতে পারে না।
– কী বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন।
– আমার ছেলে এই কাজটি করেনি, অন্য কেউ করে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এটাই ফাইনাল কথা। এবার আপনারা খুঁজে বের করুন এই ঘটনার মূল হোতাকে।
রনির বাবার কথায় এমন দৃঢ়তা দেখে হেডস্যার কিছুটা নমনীয় হলো। তিনি পিয়নকে দিয়ে জামাল স্যারকে ডেকে পাঠালেন। জামাল স্যার রুমে এলে হেডস্যার বললেন, জামাল সাহেব, গতকাল কী সব তথ্য দিলেন? ঘটনা আসলে কে ঘটিয়েছে?
– কেন স্যার? এই রনিই তো ঘটিয়েছে, ক্লাসের সবাই সাক্ষী!
ক্লাসের সবাই সাক্ষী? জামাল স্যারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন রনির বাবা।
– হ্যাঁ।
– আপনি কয়জনের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন?
– সবাই তো বলল, রনিই এ কাজ করেছে!
– কারা কারা বলেছে তাদের একবার কি ডাকবেন?
– হুম, ডাকা যায়।
সব শুনে হেডস্যার বললেন, জামাল সাহেব, কারা কারা সাক্ষী দিয়েছিল তাদের ডাকুন।
হেডস্যারের রুম থেকে বের হয়ে জামাল স্যার ক্লাস সিক্সে গিয়ে দেখলেন, রবিনসহ আরও চারজন আজ আসেনি! জামাল স্যারের একটু খটকা লাগল। তবুও তিনি সিক্সের ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল যে আজিমকে আহত করা হয়েছে সে সময় ক্লাসে কে কে ছিলে?
স্যারের কথায় কয়েকজন হাত তুলে জানান দিলো যে, গতকাল তারা ছিল। স্যার তাদের হেডস্যারের রুমে নিয়ে গেলেন।
হেডস্যার তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কাল সবাই ক্লাসে ছিলে?
– হ্যাঁ স্যার।
– ঘটনা কী হয়েছিল বলো তো!
– স্যার, আগে কী ঘটেছে দেখিনি, তবে আজিম চিৎকার দিয়ে ওঠার পর দেখলাম রবিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শম্ভু দ্রুত রনির ব্যাগসহ বইগুলো সরাচ্ছে!
– সরাচ্ছে মানে?
– দেখলাম, রবিনের বইগুলো আজিমের পাশ থেকে সরিয়ে রনির ব্যাগটা আজিমের পাশে দ্রুত রেখে দিচ্ছে শম্ভু! রবিন বসেছিল আজিমের পাশেই।
এ কথা শোনার পর রনির বাবা হেডস্যারের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। হেডস্যারও কিছু একটা আঁচ করার চেষ্টা করলেন।
হেডস্যার বললেন, তারপর?
– তারপর স্যার আর ওভাবে খেয়াল করিনি, আজিমের এমন অবস্থা দেখে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
হেডস্যার অন্য ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী দেখেছো? তোমাদের কি মনে হয় রনি এ কাজ করেছে?
– না, স্যার। রনি এ কাজ করতেই পারে না। তা ছাড়া রনি আজিমের পাশেই ছিল না। আজিমের পাশে ছিল রবিন। সাজ্জাদ বলল।
হেডস্যার বললেন, তোমরা এখন যাও। যদি মিথ্যা বলে থাকো তাহলে তোমাদেরও শাস্তি হবে, মনে থাকে যেন।
ওরা বের হওয়ার পর হেডস্যার রনির বাবাকে বললেন, মনে হচ্ছে এটা রনির কাজ নয়, তবে এখনও নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হতে হলে রবিনকে দরকার। রবিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব বেরিয়ে আসবে। রনিকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটা আপাতত স্থগিত করলাম। রবিনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাকে আসলে স্কুল থেকে টিসি দেয়া হবে!
রনির বাবা বললেন, শুধু রবিন নয়, আরও একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
– কে সে? জামাল স্যার বললেন।
– বলব সময় হলে। কাল রবিনসহ তার বন্ধুদের স্কুলে অবশ্যই হাজির করার ব্যবস্থা নিন। আমিও আসব।
হেডস্যারের সাথে কথা শেষ করে রনির বাবা স্কুল থেকে বের হয়ে গেল, রনি চলে গেল ক্লাসে।
পরদিন রবিন, শম্ভু, নাসির ও মারুফকে স্কুলে হাজির করা হলো। এলেন রনিসহ তার বাবাও। ডেকে আনা হলো রবিনের বাবাকেও। শিক্ষক মিলনায়তনে হেডস্যার, জামাল স্যার, রনির বাবাসহ রনি, রবিনের বাবাসহ রবিন, সাজ্জাদ ও শম্ভু উপস্থিত। প্রথমে কথা শুরু করলেন জামাল স্যার। তিনি বললেন, রবিন গতকাল স্কুলে আসোনি কেন?
– স্যার, মাথাব্যথা করছিল বলে আসিনি!
– আচ্ছা।
– আজও কি মাথাব্যথা ছিল?
– না, স্যার।
– গুড।
– গত পরশু তোমাদের ক্লাসে কী ঘটেছে বলো তো!
– স্যার, আপনি আমাদের ক্লাসে ঢুকছেন ঠিক এমন সময় আমরা আপনাকে সালাম দেয়ার জন্য দাঁড়াই। এমন সময় আজিমের চিৎকার শুনতে পাই। দেখি, রক্তারক্তি অবস্থা!
– কে করেছে এই কাজ?
রবিন একটু ঢোক গিলে বলল, রনি করেছে স্যার!
– তুমি কি রনিকে এই কাজ করতে দেখেছো?
– হ্যাঁ, স্যার!
– সত্যি করে বলো!
– হ্যাঁ, রনিকে করতে দেখেছি।
– তাহলে তুমি রনিকে এ কাজে বাধা দাওনি কেন? বা আজিমকে সতর্ক করোনি কেন?
– স্যার, বলার মতো সময় বা সুযোগ ছিল না!
– তাই!
– হ্যাঁ, স্যার।
– তুমি ছাড়া রনিকে এ কাজ করতে আর কে দেখেছে?
– শম্ভু দেখেছে, স্যার।
হেডস্যার সবার চেহারা পড়তে লাগল, চোখ দুটো সবার চেহারায় ঘুরছে- ফিরছে।
জামাল স্যার এবার শম্ভুকে জেরা করতে লাগল।
– শম্ভু, তুমি কী দেখেছো?
– স্যার, রনির হাতে ক্যাপখোলা কলম দেখেছি।
– আর?
– আর সেটা আজিমের পেছন বরাবর ধরে রাখতে দেখেছি।
– তুমি আজিমের কোন পাশে বসেছিলে?
– মুখোমুখি বসেছিলাম। আজিম পশ্চিমমুখী হয়ে বসেছিল, আমি পূর্বমুখী হয়ে বসেছিলাম।
– তাহলে তুমিই বলো, তোমরা যদি পরস্পরে বিপরীতমুখী হয়ে বসে থাকো তাহলে আজিমের পেছনে রনি কলম ধরে রাখলে তুমি কিভাবে দেখবে?
শম্ভু এবার চুপ মেরে গেল, কোনও জবাব দিতে পারল না।
– বলো! জামাল স্যার চোখ রাঙিয়ে বলল।
শম্ভুর আর কথা বের হয় না মুখ দিয়ে।
জামাল স্যার বলল, আচ্ছা তাহলে বলো, রনির ব্যাগটা রবিনের বসার সিটে কে রেখে এসেছিল?
– আমি জানি না, স্যার।
– তুমি জানো, তোমাকেই বলতে হবে।
– স্যার, আমি জানি না। আজিমের এমন অবস্থা দেখে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
– আচ্ছা।
রনির বাবা, রবিনের বাবা, হেডস্যারসহ সবাই ওদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে এবং দোষী কে বের করার চেষ্টা করছে।
জামাল স্যার এবার বললেন, রনি, তুমি বলো কী ঘটেছে সেদিন?
– স্যার, আপনি ক্লাসে ঢোকার আগ মুহূর্তে দেখি আজিম চিৎকার দিয়ে উঠল। আমি বেঞ্চ ছেড়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলাম। রবিন তার পাশেই দাঁড়ানো ছিল।
– রবিনের হাতে কী ছিল তখন?
– ক্যাপখোলা কলম ছিল স্যার।
– রবিনকে কি আজিমের পেছনে কলম দিতে দেখেছো তুমি?
– না, আমি সেটা খেয়াল করতে পারিনি।
জামাল স্যার এবার সাজ্জাদকে জেরা করতে শুরু করল। তিনি সাজ্জাদকে বলল, সাজ্জাদ, তুমি কী দেখেছো?
– স্যার, আজিম চিৎকার করে ওঠার পর দেখি সবাই আজিমের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন আজিমকে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক এমন সময় দেখি, শম্ভু রনির ব্যাগটা আজিমের পাশের সিটে রেখে রবিনের ব্যাগটা রনির সিটে রেখে দিলো!
– তুমি কি সত্যি দেখেছো?
– জি স্যার, আমি নিজে এমনটা দেখেছি।
সবাইকে জেরা করার পর জামাল স্যার হেডস্যারকে বললেন, স্যার, কিছু বুঝতে পারলেন?
– হ্যাঁ, যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।
রবিনের বাবাকে জামাল স্যার বললেন, আপনার কী মনে হয়? কাকে দোষী মনে হচ্ছে?
– কিছুটা গোঁজামিল মনে হচ্ছে?
– কেমন গোঁজামিল?
– কে দোষী ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। ওদের কথা শুনে সবাইকেই দোষী মনে হচ্ছে!
হো হো করে হেসে উঠলেন হেডস্যার। চুপটি মেরে আছেন রনির বাবা।
হেডস্যার বললেন, দোষী যে-ই হোক তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। কী বলেন?
রনির বাবা বলল, অবশ্যই, এমন বেয়াদব ছেলে স্কুলে থাকলে বাকিরাও বেয়াদব হয়ে উঠবে, নষ্ট হয়ে যাবে প্রজন্ম।
রবিনের বাবা বলল, হ্যাঁ, স্কুল থেকে বহিষ্কার করবেন ঠিক আছে। কিন্তু একজনকে বহিষ্কার করলেই কি সবাই ঠিক হয়ে যাবে?
– কেন হবে না? একজনকে বহিষ্কার করলে বাকিরা সতর্ক হবে। তারা এটাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেবে। হেডস্যার বললেন।
তিনি আবার বলা শুরু করলেন, ওদের সবার কথা শুনেছি। কিন্তু সিদ্ধান্ত হবে আগামীকাল। তবে, তার আগে একটা কাজ আছে, বলছি।
রনি, রবিন, সাজ্জাদ, শম্ভু তোমরা সবাই তোমাদের স্কুল ব্যাগটা এখানে নিয়ে আসো দ্রুত।
ব্যাগ নিয়ে এলে সেগুলো টেবিলে রাখলেন হেডস্যার। তারপর বললেন, তোমাদের কলমগুলো বের করো।
সবাই ব্যাগ থেকে কলম বের করে স্যারের সামনে টেবিলে রাখল। হেডস্যার বললেন, সবাই দেখুন কার কলম কোনটা।
রবিনের বাবা বলল, কলম দিয়ে কী হবে?
– হুম, দেখুন কী হয়!
চারজনের কলম চারটা ব্র্যান্ডের। হেডস্যার এবার তার ডেস্ক থেকে একটা কলম বের করলেন, কলমটা রক্তে মাখা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
রনির বাবাকে উদ্দেশ্য করে হেডস্যার বললেন, স্যার, আপনি বলুন তো, আমার বের করা কলমের সাথে কার কলমটা একই ব্র্যান্ডের?
– রবিনের কলম! রনির বাবা স্বাভাবিক স্বরেই বললেন।
রবিনের বাবা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উঠে বললেন, কলম মিললেই দোষী সাব্যস্ত হয়?
– ঠিক দোষী সাব্যস্ত নয়। আমি জাস্ট একটা জিনিস আপনাকে দেখালাম। আর ওরা আমার ছাত্র, ওদের চোখের ভাষা, শারীরিক ভাষা আমার জানা আছে। ওই যে বললাম না, আগামীকাল সিদ্ধান্ত হবে! হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত আগামীকালই হবে। সবাই আসবেন। কোনও অজুহাতে কেউ না- এলেও সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যাবে। বর্তমানে যে বেয়াদব-প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তা এখনই থামানো উচিত। এবার আপনারা আসতে পারেন, ছাত্ররা ক্লাসে চলে যাও।
৩.
পরদিন। একটু আগেভাগেই এলো সবাই। রবিনের বাবা সাথে করে নিয়ে এলো স্কুল কমিটির সভাপতিকে। সবাই শিক্ষক মিলনায়তনে বসা। রবিনের বাবা বলল, হেডমাস্টার সাহেব, দ্রুত শুরু করুন, আমার একটা মিটিং আছে।
– একটু ওয়েট করুন, আরও একজন আসছে, সে এলেই শুরু করে দেবো।
– আরেকজন কে আবার? সবাই তো এসে গেছে!
– হ্যাঁ, আরেকজন আসছে। তার জন্যই গতকাল সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি।
হেডস্যার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আজিমকে নিয়ে তার বাবা স্কুলের মাঠ পার হয়ে এদিকেই আসছে। আজিমের পরনে লুঙ্গি, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে।
আজিমকে দেখে রবিনের মাথাগরম অবস্থা, তার চোখ পিটপিট করছে। হেডস্যার সেটা খেয়াল করলেন। রনি যেন আশ্বস্ত হতে পারল। শিক্ষক মিলনায়তনে ঢুকে আজিমের বাবা চেয়ারে বসলেন, আজিম অন্যদের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে এমনিতেই বসতে পারছে না। তার এই অবস্থা দেখে শম্ভুর হাসি পেলেও দমিয়ে রাখল সে!
হেডস্যার বললেন, এখন শুরু করা যায়। সবাই এসে গেছে। কোনও ভূমিকা টানার আর প্রয়োজন নেই, রবিনের বাবারও মিটিংয়ের ব্যস্ততা আছে, রনির বাবাও ক’দিন ধরে নিয়মিত এখানে হাজিরা দিচ্ছেন, ওনারও তো স্কুল আছে। তো, আজিম তুমি বলো, তোমার এই অবস্থা কে করেছে?
স্যারের প্রশ্ন শুনে আজিমের কান্না এসে গেল। সে বলল, স্যার, রবিন আমার পাশেই বসা ছিল। সে বিভিন্ন সময় আমার সাথে দুষ্টুমি করত। কিন্তু সেদিন যা করেছে তা আমি মেনে নিতে পারছি না। কলম দিয়ে যা করেছে সেটা রবিনই করেছে। আর এই কলমটা দিয়েই করেছে- বলে কলমটা হাতে নিয়ে দেখাল সে। কলমটা আজিমের হাতে দেখে রবিনের বাবা বলল, কলম তোমার হাতে কী করে? ওটা হেডমাস্টার সাহেবের কাছেই ছিল? কী কাহিনি বানাচ্ছেন বুঝে উঠতে পারছি না!
হেডস্যার বললেন, কোনও কাহিনি নয়। ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে কাজটা রবিনই করেছে, আজিম নিজেই সাক্ষ্য দিলো। আর কলমের ব্যাপার! হা হা হা, গতকাল কলমটা আজিমের কাছ থেকেই এনেছিলাম, আবার তার কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলাম। গতকাল আজিম আসতে পারেনি, ওর খুব ব্যথা করছিল, হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল, তাই সে আসতে পারেনি। গতকাল সে জন্যই তো বলেছি, সিদ্ধান্ত কার্যকর আগামীকাল মানে আজকে হবে।
সবকিছু দেখে স্কুল কমিটির সভাপতি সাহেব রবিনের বাবাকে বললেন, দোষী তো দেখছি আপনার ছেলে। প্রমাণ তো উপস্থিত। আর আপনি আমাকে যা বলেছেন তার সাথে তো মূল ঘটনার কিছুই মিলছে না!
রবিনের বাবা চুপ মেরে মাথা নিচু করে রাখল। নিচ থেকে মাথা তুলে বলল, তাহলে বলতে চাচ্ছেন আমার ছেলেই দোষী!
– বলতে চাইব কেন? আজিমের পাশে বসা, শম্ভুর মাধ্যমে রনির ব্যাগ সরানো, সর্বশেষ ভুক্তভোগী আজিমের সাক্ষ্য- সব মিলিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে রবিনই দোষী। এখন রবিনকে চাইলে আলাদা করে শাস্তি দেয়া যায়, কারণ, সে আমাদেরকে মিথ্যা বলেছে। সে বলেছে, সে এ কাজ করেনি, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সুতরাং স্কুল কমিটির সভাপতি সাহেবসহ উপস্থিত আছেন, আমরা আজকেই রবিনকে টিসি দিয়ে দেবো।
আপনারা যা ইচ্ছা তা-ই করেন বলে রবিনের বাবা উঠে হনহন করে স্কুল থেকে বের হয়ে গেলেন।
রবিনকে সেদিনই টিসি দেয়া হয়নি, সপ্তাহখানেক পরে একটা সময় দিয়ে টিসির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর শম্ভুকে সতর্ক করা হয়েছিল। রনির বাবাও ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করে বাড়ি ফিরেছিল।
তবে আসল ঘটনা ঘটেছে পরে, স্কুল ছুটির পরে। বিকালে স্কুল ছুটি হলে রনি নিত্য দিনকার মতো ফিরছিল। কিছুদূর যেতেই গতিরোধ করে বসে রবিন ও আরও কয়েকটা বখাটে ছেলে। রনি ক্লাস সিক্সে পড়লেও তার শারীরিক গড়ন ও গ্রোথ ছিল ভালো। তখনই তার উচ্চতা ছিল প্রায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি মতো। ক’দিন ধরে এতসব ঘটনার পরও সে নিশ্চুপ ছিল। রবিনের এমন বাধা পেয়ে ক্ষোভে জ্বলে উঠছিল ভেতরে ভেতরে। রবিন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা যে-ই মারতে এলো রনি একপ্রকার একাই দৈত্যের শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। তিনদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ঝাড়তে লাগল। যেটা রবিন কল্পনাই করতে পারেনি। তাদের সবাইকে এমন মার মেরেছে যে তারা মারে, বাপরে বলে নেড়িকুত্তার মতো পালিয়ে যায়।
সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে রনি বাড়ির কাউকে কিছুই বলেনি। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রবিন তার দলবলসহ আবার হামলে পড়ল রনির ওপর। এবার রনি নিরুপায়, সে পেরে উঠতে পারবে না নিশ্চিত। রবিনদের প্রত্যেকের হাতে ছুরি, হকিস্টিক! দেখেই ভিমড়ি খেয়ে গলা শুকিয়ে উঠল রনির। রনি এবার সরাসরি রবিনকে বলল, কেন তুমি আমাকে মারতে চাইছো?
– তোর কারণে আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছে, তাই।
– আমার কারণে কেন হবে? তোমার কারণেই তোমাকে বহিষ্কার করেছে, এতে আমার কী দোষ!
এত দোষ-টোষ বুঝি না বলেই রনির ওপর একযোগে রবিনরা হামলে পড়ল। রনিকে হকিস্টিক দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করে রাস্তায় ফেলে সরে পড়ল রবিন ও তার দল।
রনিকেকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে সে জানে না। একদিন পর হুঁশ ফিরে দেখে সে হাসপাতালে। হাসপাতালে তিনদিন অবস্থানের পর বাড়িতে ফেরে। মনে করতে থাকে রবিন তার সাথে যা যা করেছে সব। এভাবে অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রায় মাসখানেক বাড়িতে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। এদিকে রবিনকে মেরে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে থাকে। এক মাস পর বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে সাজ্জাদের সাথে দেখা করে। কিভাবে রবিনকে শায়েস্তা করা যায় তা নিয়ে সাজ্জাদের সাথে কথা বলে। সাজ্জাদ প্রথমে ‘না’ করলেও পরে সম্মত হয় রনির সাথে। জয়নাল, সজীবসহ আরও কয়েকজনকে দলে ভিড়ায় সাজ্জাদ। এভাবেই একটা গ্যাং তৈরি করে ফেলে রনি, যার লিডার হয় রনি। এরপর নিজেরা প্রতিদিন স্কুল ছুটির বসে আড্ডা দেয়, সময় কাটায়। সুযোগ পেলেই এর ওর গাছের এটা ওটা পেড়ে খেতে থাকে। কেউ বাধা দিতে চাইলে তাদের ওপর চড়াও হয়। আগে সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরলেও ধীরে ধীরে সেটা সন্ধ্যার পর হয়, এমনকি দীর্ঘ রাত করে বাড়ি ফিরতে থাকে। বাবা-মা’র কড়া শাসনকেও আর তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না রনি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর হতেই রনির স্বভাব-চরিত্র কেমন যেন পাল্টাতে থাকে।
ক্লাস সিক্স এভাবেই কেটে গেছে। সেভেনে উঠে পুরাই পাল্টে যায় সে। সাজ্জাদের পরামর্শেই ক্লাস সিক্সে রবিনের ওপরে প্রতিশোধ নেয়নি রনি। সেভেনে উঠে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করে এবং একদিন রবিনকে এমন মার মেরেছে যে, রবিন প্রায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে যাচ্ছিল। টানা তিন মাস পঙ্গু হাসপাতালে ছিল রবিন।
রবিনের বাবা রনির বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ এসে তাকে বারবার খুঁজতে থাকে, কিন্তু পায় না। সে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। এরই মধ্যে এক ‘বড়ভাই’ রনির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। পালিয়ে বেড়ানো অবস্থায় এক রাতে রনিকে পান তিনি। রনিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আশ্রয় দেন। রনি তাকে সব ঘটনা বলা শুরু করতেই তিনি বললেন, বলা লাগবে না, সব জানি আমি।
রনি অবাক হয়ে বলল, কী করে জানেন?
– সব খবর আমার কাছে মুহূর্তে মুহূর্তে চলে আসে। আমি এলাকার ‘বড়ভাই’। তুমি হয়তো নাম শুনে থাকবে।
– আপনিই সেই বড়ভাই! আপনার নাম অনেক শুনেছি, সাজ্জাদ বলেছিল। ভাবছিলাম, একবার আপনার সাথে দেখা করব। আজ সত্যি সত্যি দেখা হয়ে গেল।
– হুম। দেখা যেহেতু হয়েই গেল তবে শুনে রাখো, তুমি এখন থেকে আমার হয়ে কাজ করবে। তোমাকে খুঁজতে শুধু পুলিশ কেন কেউই আর হানা দেবে না। তুমি এখন থেকে স্বাধীনভাবে এলাকায় চলা ফেরা করবে। তোমার ইচ্ছেমতো ঘুরবে, ফিরবে আর আমার কথা মতো কাজ করে দেবে।
মুহূর্তেই প্রস্তাবটা লুফে নিলো রনি। তার এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার। এরপর থেকে রনিকে এলাকায় পুলিশ আর কোনও ধরনের হয়রানি করেনি। রবিনও যেন তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে।
এভাবেই এলাকায় রনি প্রকাশ্যে চলাফেরা শুরু করে। তার কোনো কাজে কেউ বাধা দেয় না। ধীরে ধীরে সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বড়ভাইয়ের নির্দেশে বিভিন্ন দোকান থেকে মাসোহারা নিতে থাকে। বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলে। এসব করতে গিয়ে তার একটা গ্যাং তৈরি হয়ে যায় আর সে হয়ে ওঠে লিডার। এ ছাড়াও রাস্তায় স্কুল-মাদরাসার ছাত্রীদের টিজ করা, শিক্ষকসহ বড়দের সামনে সিগারেট খাওয়াসহ কোনও কিছুই বাদ দেয় না। রনির বন্ধুরাই বেশি করত এসব। রনি সিগারেটের অভ্যাস করেনি, আবার রাস্তায় মেয়েদের টিজও করত না। সে সবকিছুতে নেতৃত্ব দিত আর ওদের কাজে চুপ থেকে সম্মতি দিত।
মাস তিনেক আগের ঘটনা। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় শাহ পরান হোটেলের ম্যানেজারকে মারধর করেছে রনিরা।
ফুটপাথে তরমুজ বিক্রেতা তাদেরকে বাকিতে না দেয়ায় নাজেহাল করে ছেড়েছে। তাকে নালায় নামিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকে তোমাকে তরমুজ ছুঁড়ে মারব, যতটা ধরতে পারবে না, মানে নালায় পড়ে যাবে ততটা তরমুজ আমাদের ফ্রি দিতে হবে। এভাবে তার দিকে বিশটা তরমুজ ছুঁড়ে মেরেছিল, বেচারা তিনটা তরমুজ ধরতে পারেনি। তার বদলে রনিরা তিনটা তরমুজ তার কাছ থেকে ফ্রি নিয়ে চলে গিয়েছিল। একইভাবে রাস্তার কাজ করতে আসা ঠিকাদারের কাজ বন্ধ করে দিয়ে বিশ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছিল। এগুলো তারা প্রকাশ্যেই করেছে। এদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে কেউ এদের বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পায় না। যার দরুন তারা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করে।
বড়ভাই তাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে এটা ওটা আনাতো, সে-ও বড়ভাইয়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দ্রুতই প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। কোনও মিছিলে, মিটিংয়ে ছেলে পেলে দরকার হলে কম সময়ে রনি তা চোগাড় করে দিত। স্কুলে ক্লাস না-করেও পরীক্ষা দেয়ারও সুযোগ করে দিয়েছে এই বড়ভাই। বড়ভাইও তার কোনো আবদার অপূরণ রাখে না।
সর্বশেষ ক্লাস এইটে যখন ওঠে বড়ভাই তাকে একটা বাইক কিনে দেয়। শুধু বাইক নয়, নিত্য দিনকার তেলখরচও বড়ভাই দেয়।
রনিকে কক্সবাজার পাঠিয়ে দুটো প্যাকেট আনিয়ে বিরাট অঙ্কের টাকা কামিয়েছে বড়ভাই। সেই থেকে রনির প্রতি বড়ভাইয়ের বিশ্বাস ও আস্থা বেড়ে গেছে। রনি অবশ্য তখনও জানতো না সেই প্যাকেটে কী ছিল। প্যাকেট আনার সপ্তাহখানেক পরে জানতে পেরেছে সেই প্যাকেট দুটোতে ইয়াবা ছিল। জানার পর রনির অবশ্য একটু খারাপই লেগেছিল। কারণ, সে নানা অপকর্ম করলেও প্রথম থেকেই মাদকবিরোধী ছিল। সে কখনও সিগারেট বা নেশাজাতীয় কোনও কিছু গ্রহণ করেনি। এসব তার ঘেন্না লাগে। প্যাকেটে কী ছিল জানলে হয়তো কোনোভাবে এড়িয়ে যেত সে।
৪.
রনির কল রিসিভ করে বড়ভাই বলল, রনি, তোমাকে আমিই কল দিতে যাচ্ছিলাম, দেখি তুমিই দিয়ে বসে আছো, হা হা হা! শোনো, তোমাকে একটা কাজে যেতে হবে, দ্রুত আমার বাড়িতে আসো। রনি বলল, বড়ভাই, আমার একটা কথা ছিল…
রনিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বড়ভাই বলল, আমার বাড়িতে চলে আসো, ওখানেই শুনব তোমার কথা। কল কেটে দিলেন তিনি।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামে। লোকজন বাজার থেকে ফিরছে। রাস্তায় লোকের আনাগোনা। রনি দ্রুত বড়ভাইয়ের বাড়িতে যায়। সোজা ঢুকে যায় রুমে। সালাম দিয়ে রনি জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ দ্রুত ডাকলেন যে!
– কাজ আছে, তার আগে তোমার কী কথা যেন ছিল সেটা বলো।
– হুম, বলছিলাম জয়নালকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, বের করার কোনও ব্যবস্থা যদি করতেন। বের না করেন, অন্তত আদালত পর্যন্ত যেন না যায় এই মামলা! গেলেই শাস্তি হয়ে যাবে!
– এত বেপরোয়া হলে চলে! আকাম করছে ঠিক আছে, এত অসতর্ক হলে চলে? হাত আগুনে দিচ্ছে নাকি পানিতে দিচ্ছে দেখে দেবে না? দিলো তো দিলো ইউএনওর মেয়ে দিকে! যত্তসব। রেগে গজগজ করে বললেন বড়ভাই।
– কিছু একটা করা যায় না?
– আমি দুপুরে কল দিয়েছিলাম ইউএনও সাহেবকে। তিনি গরম দেখিয়ে বললাম, এই বখাটে পোলাপান যেখানে আমার মেয়েকে টিজ করছে, এরা তো কাউকে বাকি রাখবে না, এদের শাস্তি হওয়া দরকার। আপনি এদের জন্য সুপারিশ করবেন না।
– তারপর?
– তারপর আমি আর কী বলব। তবুও হালকা বলে রেখেছি, এখন যদি ওর শাস্তি হয় তো জেল থেকে বের হওয়ার পর আবার তার প্রতিশোধস্পৃহা বেড়ে আরও খারাপ কিছু না করে ফেলে! এবারের মতো ছেড়ে দেন, ওকে আমি বুঝিয়ে বলব, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করে।
– তিনি কী বললেন?
– একটু চুপ থেকে বললেন, চারদিকে জ্বালা। এরপর কল কেটে দিলেন।
– দেখা যাক কী করেন। এবার বলুন, কেন ডেকেছেন?
– ডেকেছি একটা জরুরি কাজে। পারলে এখনি পাঠিয়ে দিতাম, কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় পারছি না।
– কোথায়?
– মহেশখালী। তোমাকে মহেশখালী যেতে হবে।
– মহেশখালী! অবাক হয়ে বলল রনি।
– হ্যাঁ, ভয় পেলে নাকি?
– না, তবে কোনও সময় যাইনি তো, তাই একটু…
– যাও, একা একা যাও। দেখবেÑ অনেক কিছু জানছো, শিখছো।
– মহেশখালী দক্ষিণ দিকে জানি, কিন্তু কিভাবে যেতে হয় তা তো জানি না!
– একদম সোজা। কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে বাঁশখালীর ডাইরেক্ট গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে করে আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালীর শেষ সীমানা টইটং হয়ে পেকুয়া চৌমুহনী যাবে। সেখান থেকে সিএনজিতে করে বদরখালী ব্রিজ যাবে। সেখান থেকে আবার সিএনজিতে করে মহেশখালী ডাকবাংলো মোড়ে পর্যন্ত যাবে। ওখানেই মহেশখালী পৌরসভা, তোমাকে সেখানে যেতে হবে।
– আচ্ছা। কিন্তু বড়ভাই আমার একটা আপত্তি আছে।
– কী আপত্তি?
– কোনো প্যাকেট-ট্যাকেট নিতে বা আনতে হলে আমি পারব না! নরম সুরে বলল রনি।
– আরে না, এবার প্যাকেটের কাজ কারবার না। আমি একটা চিঠি পাঠাবো, সেটা ইউএনও অফিস থেকে সাইন নিয়ে তুমি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অফিসে জমা দেবে।
– আবার কক্সবাজারও যেতে হবে?
– হ্যাঁ, ওখানেই মূলকাজ। তোমাকে সব বলে দেবো। আগে মহেশখালী পৌঁছো।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
রনিকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, ভোর ৬টায় রওনা দেবে, আর কক্সবাজারে কাজ শেষে তোমার ইচ্ছে হলে বেড়াতে পারো, থাকতে পারো কয়েকটা দিন। নতুবা চলে আসবে।
রনি ‘আচ্ছা’ বলে বড়ভাইয়ের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
বাড়িতে যখন পেঁৗঁছে তখন রাত নয়টা। রনির একমাত্র ছোটবোনটা টেবিলে পড়ছে। রনিকে দেখে একটু হেসে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো সে। রনি তার রুমে ঢুকে ছোট্ট একটা ব্যাগে কাপড় চোপড় গোছাতে লাগল।
বাড়িতে রনির সাথে কেউ খুব একটা কথা বলে না। না বাবা, না মা, বোনটাই যা একটু কথা বলে। বেপরোয়া জীবন শুরু করার পর থেকে বাবাÑমা’র অনেক বকাঝকা শুনেছে, এখনও শোনে, কিন্তু সে সেসব আর আমলে নেয় না। সে তার মতোই চলতে থাকে। আগে সবাই একসাথে খেতে বসত, এখন বসে না। রনি একাই খায়। খেয়েই নিজের রুমে চলে যায়। আজ খাওয়া শেষে রনি তার মাকে বলল, কাল ভোরে মহেশখালী যাব।
মা বলল, তো আমি কী করতাম?
– কিছু করতে হবে না। যাব যে সেটা জানিয়ে রাখছি।
মা আর কিছু বলল না, রনিও কথাটা বলে নিজের রুমে চলে গেল।
রনির বেপরোয়া হয়ে ওঠার পর থেকে তার মা শান্তিতে নেই। ছেলের জন্য মন কাঁদে সারাটাক্ষণ। নামাজের পর মুনাজাতে কত কী বলে দোয়া করে তার হিসাব নেই। তবুও ছেলেটার কোনও পরিবর্তন হয় না। দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে উঠছে, বাড়ির প্রতি আগে যে টান ছিল সেটাও যেন কমে গেছে তার। যা একটু আদর করে, কথা বলে ছোটবোনটার সাথেই। তার জন্য বিভিন্ন সময় এটা ওটা আনে। আর সম্পর্ক খারাপ বেশি বাবার সাথেই। যে বাবা রনিকে না দেখে থাকতে পারতো না সেই বাবা বলতে গেলে এখন তার সাথে কথাই বলে না। ঘরে ঢোকা মাত্রই বকাঝকায় বিষিয়ে তোলে। এ জন্য রনিও পারতপক্ষে তার বাবার মুখোমুখি হয় না।
রাতেই গুছিয়ে রেখেছিল ছোট্ট একটা ব্যাগ। কোথাও যাওয়ার সময় হাতে ব্যাগ বা এ জাতীয় কোনও কিছু রাখতে চায় না রনি। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে তার, পরাধীন পরাধীন লাগে। তবুও দূরের যাত্রা বলে ব্যাগটা নিল।
খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে রনি কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ হতে বাঁশখালীর একটা বাসে উঠল, যেটা একেবারে বাঁশখালীর শেষপ্রান্ত ও পেকুয়ার টইটং পর্যন্ত চলে যাবে। অবশ্য বাসের টিকেট কেটে যে সময়টুকু অবশিষ্ট ছিল তখন হালকা নাস্তা করে নিয়েছে।
রনি কখনও এই পথ দিয়ে যায়নি, তাই তার সবকিছু নতুন নতুন লাগছে, অন্যরকম আনন্দ অনুভব হচ্ছে। তখনও পর্যন্ত রোদ না ওঠায় চারদিকে একটা ছায়া ছায়া ভাব, শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল। যখন আনোয়ারা অতিক্রম করছিল রাস্তার দুইপাশের সারি সারি সবুজ বৃক্ষ দেখে নিমিষেই মন ভালো উঠল। কত সুন্দর! যেন প্রকৃতি তোরণ সাজিয়েছে অভিযাত্রীদের জন্য! এসব দেখে রনি এককথায় মুগ্ধ। আনোয়ারা ও বাঁশখালীর মাঝখানে আছে এক ব্রিজ, শঙ্খসেতুর ওপর। যেটা আনোয়ারাÑবাঁশখালীকে সীমান্তরেখায় বিভক্ত করেছে। শঙ্খনদীর দুইপাশ জুড়ে সবুজের সমারোহ, বৃক্ষ আর বৃক্ষ। অল্প একটু দূরে শিল্পকারখানা আছে মনে হচ্ছে, কোথাও কোথাও চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে রনির বেশ ভালোই লাগছে। রাতে যে মনখারাপিটা ছিল সেটা দূর হতে শুরু করেছে।
যেতে যেতে বড়ভাইয়ের কথাগুলো মনে পড়ছে। গতকাল তিনি বলেছিলেন, নতুন জায়গায় গেলে অনেককিছু জানার আছে, শেখার আছে। রনির মনে হলো সে অনেক কিছুই শিখছে এই যাত্রাপথে। শঙ্খব্রিজ পার হয়ে একটু যেতেই বাঁশখালীর শুরু। আনোয়ারার মতো বাঁশখালীর রাস্তার দুই পাশেই সারি সারি বৃক্ষ। সামনে যেতে যেতে রনি অবাক হচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে সবুজ বৃক্ষ ছাড়াও বিলজুড়ে নানান সবজির ক্ষেত। যতই সামনে যায় রনির মুগ্ধতা বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে ক্ষেতের পর এবার দেখল লবণের মাঠ! রনি কখনও লবণের মাঠ দেখেনি। লবণচাষিরা মাঠ থেকে লবণ আহরণ করছে। সাদা সাদা লবণের স্তূপগুলো দেখতে কী সুন্দর। রনির ইচ্ছে হচ্ছে, গাড়ি থেকে নেমে একবার লবণের মাঠ থেকে ঘুরে আসতে! কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। যে কাজে যাচ্ছে সেটা শেষ হওয়ার পর সুযোগ হলে একবার ঘুরে দেখবে। রাস্তার দুই পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গাড়ির গতি কমে স্থির হয়ে গেল। এসে গেছে টইটং, যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে একে একে। রনিও নেমে একটু হেঁটে সামনে গিয়ে সিএনজিতে উঠে পেকুয়া চৌমুহনীতে চলে গেল। সেখানে চা খেয়ে আবার সিএনজিতে উঠল, গন্তব্য বদরখালী। বদরখালী ব্রিজ থেকে সোজা মহেশখালী। পেকুয়ার রাস্তাঘাট সুন্দর, পরিপাটি। এখানে বেশ উন্নয়ন হয়েছে দেখাই যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে মাছের ঘের, লবণমাঠ আর খাল। রনি যখন বদরখালী ব্রিজের কাছে পৌঁছে তখন সকাল দশটা। বদরখালীর পরিবেশটা একটু ভিন্ন, এখানকার লোকজনের চলাফেরা, চেহারা, কথাবার্তাও ভিন্ন।
বদরখালী ব্রিজে গাড়িতে উঠে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছে, কারণ সিএনজি ফিলাপ না হলে যাবে না। পাঁচজন যাত্রী পূর্ণ হওয়ার পরে তবে ছেড়েছে। সামনে যত যাচ্ছে সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে রনিকে। যেনবা বলছে, ‘রনি! আর ফিরে যাসনে, এখানে থেকে যা! তোর জীবনটা তো জীবনই না। দেশের এত সৌন্দর্য দেখা থেকে তুই ঘরে বসে, হেসে খেলে, আড্ডা দিয়েই কি বঞ্চিত হবি?’
রনির আরেক সত্তা বলছে, ‘না, এই ভালো লাগা সাময়িক। তুমি এখানে থাকতে পারবে না, তোমার মন টিকবে না এখানে। সবকিছু নতুন দেখছো বলেই হঠাৎ ভালো লেগে উঠছে, এই ভালো লাগা ক্ষণিকের। তোমাকে ফিরে যেতে হবে তোমার ঘরে।’
এসব ভাবছে আর চারদিক দেখছে রনি। হঠাৎ দেখল, রাস্তার পাশে, পাহাড়ের পাদদেশে পানের বরজ আর বরজ! হ্যাঁ, তার মানে মহেশখালী এসে গেছে! মিষ্টি পানের জন্য মহেশখালী দেশজুড়ে বিখ্যাত। কত গানে মহেশখালীর এই পানের কথা আছে!
মহেশখালী বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। রাস্তার পাশের পাহাড় দেখে রনি সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে। গাড়িতে থাকা এক যাত্রী বলল, সামনেই আদিনাথ পাহাড়। রনির মনে পড়ল আদিনাথ পাহাড়কে নিয়ে বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ। প্রবাদটা মনে করে নিজে নিজে হেসে নিল একবার। তার বন্ধু শম্ভু বহুবার এই পাহাড়ে এসেছে, বহুবার এই পাহাড়ের গল্প করেছে। এখন সেসব মনে পড়ছে তার। আদিনাথ পাহাড় ফেলে আরও মিনিট বিশেক পর এলো গোরকঘাটা ডাকবাংলো মোড়। রনিদের সেখানেই নামিয়ে দিলো গাড়ি। ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে নিলো কিভাবে ইউএনও অফিসে যেতে হবে। সে মতে খুব দ্রুত সেখানে চলে গেল। মহেশখালী উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকাটা বিশাল। একটা বিরাট দিঘিকে কেন্দ্র করে উপজেলা পরিষদ অফিস, তার পাশেই ইউএনওর বাসা। দিঘির পাড়ে ছায়াময় স্থানে বসার সুব্যবস্থাও করা আছে। সবকিছু দেখে মন ভরে গেল রনির।
বড়ভাইকে কল দিলো রনি। পৌঁছার খবর পেয়ে বড়ভাই বলল, বাহ, খুব দ্রুত পৌঁছে গেলে তো! শোন, ইউএনও অফিসে আমার এক বন্ধু আছে, তুমি তার কাছে যাও। তাকে আমি কল দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি। রনি সেই অফিসে গেল, তার আগেই বড়ভাই তার বন্ধুকে সবকিছু জানিয়ে দিলো। রনি জানতে পারল, ইউএনও সাহেব জরুরি মিটিংয়ে কক্সবাজার আছেন, তাকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একটু বিরক্ত হয়ে উঠল সে। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা কঠিন। চিঠিটা অফিস সহকারীকে দিয়ে সে বের হয়ে গেল।
চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আসলেই সুন্দর জায়গাটা। দুপুরে একটা হোটেলে গিয়ে ভাত খেয়ে নিল। প্লেটে দেয়া ভাতগুলোর রঙ একটু লালচে হলেও কেমন একটা সুগন্ধ বের হচ্ছে! খেতে বেশ ভালোই লাগছিল। খাওয়া শেষে সে আবার ইউএনও অফিসে গেল। অফিস সহকারী বলল, স্যার আসতে আরও দেরি হবে। আপনি চাইলে বসতে পারেন অথবা বাইরে ঘুরতে পারেন। রনি বলল, আপনি আমার নাম্বারটা রাখেন। স্যার এলে আমাকে জানাবেন। আর আপনার নাম্বারটাও দিন প্লিজ। নাম্বারটা নিয়ে রনি আবার বের হয়ে দিঘির পাড়ে থাকা সিটে গিয়ে বসল। সেখানে আরও কিছু লোক বসা ছিল।
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দাড়িধারী এক লোককে দেখে রনির কেমন জানি পরিচিত মনে হলো! কোথায় দেখেছে তাৎক্ষণাৎ মনে করতে না পারলেও একটু পরেই মনে পড়ে গেল তার। সেদিন সাজ্জাদকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার সময় তার বাইকের ধাক্কা থেকেই এই লোকটাই পিচ্চি এক মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। লোকটার চোখাচুখি হতে রনি চোখ ফিরিয়ে নিলো। লোকটাও নিশ্চুপ বসে আছে। একটু পরে আবার চোখাচুখি হতেই রনি সালাম দিলো লোকটাকে। সালামের জবাব নিয়ে লোকটা বলল, তুমি এখানে! কী কাজে এসেছো?
– জরুরি একটা অফিসিয়াল কাজে এসেছি!
– তুমি চাকরি করো নাকি?
– না। চাকরি করা ছাড়া কি অফিসিয়াল কাজে আসা যায় না?
– তা যাবে না কেন? তুমি রেগে যাচ্ছো নাকি?
– না। মোটেও রাগছি না।
– ও আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে।
– আপনি কী জন্য এসেছেন?
– আমিও জরুরি একটা কাজে এসেছি। কাজ সেরে আজ সন্ধ্যায় কক্সবাজার চলে যাব।
এর পর লোকটার সাথে রনি আর কথা বাড়ায়নি। কখন কী বলে বসে বলা মুশকিল, তারচেয়ে দূরে থাকাই শ্রেয়।
একটু পরে রনি সেই অফিস সহকারীকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, ইউএনও সাহেব আজ আসবেন না। রনির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ইউএনও সাহেব আসবেন না মানে তাকে রাতটা এখানে কোথাও কাটাতে হবে! ভাবতেই ভয় খেয়ে গেল সে। কারণ, সে একা ঘুমাতে পারে না। রুমে একা ঘুমাতে তার ভয় করে। সে তৎক্ষণাৎ বড়ভাইকে কল দিয়ে জানালে তিনি বললেন, ভয় পাবার কিছু নেই। পাশে একটা বাংলো আছে, রাতটা তুমি ওখানেই থাকবে। রনি বলল, আমি একা একা থাকতে পারি না!
– কী বলো! তুমি না গ্যাং লিডার! গ্যাং লিডারের এত ভয় থাকতে নেই। একটা রাত একা থেকে দেখো। দেখবে তোমার সাহস অনেক বেড়ে গেছে!
রনি ভাবল, আসার আগে বড়ভাই বলেছিল, একা ঘুরে আসো, অনেককিছু জানতে পারবে, শিখতে পারবে! আসলেই সে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পেরেছে এ যাত্রায়। সে সিদ্ধান্ত নিল, রাতটা বাংলোতে থাকবে। বড়ভাই তাকে একটা নম্বর দিয়ে বলল, এই নম্বরে যোগাযোগ করে বাংলোতে যেও।
এরপর রনি এখানে ওখানে ঘুরে সন্ধ্যা কাটিয়ে একটু রাত করে বাংলোতে গেল।
সময় যেন কাটছেই না। অপেক্ষার সময়গুলো সহজে ফুরোয় না, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হয়। সেখানে যে গার্ড ছিল তার সাথে কথা বলে একটা রুম ভাড়া নিল এক রাতের জন্য। গার্ডকে সে জিজ্ঞেস করল, রুমে কি আর কেউ থাকবে?
– হ্যাঁ, একজন থাকবেন। একটু আগে রুম বুকিং দিয়ে গেল।
রনির বুক থেকে যেন একটা পাহাড় নেমে গেল, যাক, অন্তত এত বড় বাংলোতে একা একা রাত কাটাতে হবে না!
চাবি নিয়ে রনি ভাড়াকৃত রুমে গিয়ে দেখল, একটা রুমে চারটা খাট বিছানো! একটু অবাক হলো সে! বাংলো মানে সে ভেবেছিল আলিশান কিছু হবে! এখন দেখা যাচ্ছে এটা প্রাইমারি স্কুলের সেই ক্লাসরুমের মতো!
ব্যাগটা রেখে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে একটা খাটে বসল।
বসে মিনিট দুই যেতেই দরজায় নক হলে রনি দরজা খুলে হতবাক হয়ে গেল। গার্ডের সাথে করে এসেছে সেই পাঞ্জাবি পরিহিত দাড়িধারী লোকটা! গার্ড বলল, রুমে যে আরেকজন থাকবে বলেছিল ইনিই সেই লোক!
রনি হেসে বলল, ও আচ্ছা, আসুন। গার্ড নিচে চলে গেল।
রুমে ঢোকার পর লোকটাকে রনি বলল, আপনার না আজ সন্ধ্যায় কক্সবাজার ফেরার কথা!
– হ্যাঁ, ফেরার কথা ছিল, কিন্তু কাজ শেষ না-হওয়াতে ফেরা হয়নি। কাল ফিরতে হবে।
– ও আচ্ছা।
– তুমি কি বারবার আমাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছো?
– না।
– বিরক্ত হলে আমি পাশের রুমে গিয়ে থাকতে পারি, ওই রুমটাও খালি আছে।
– না, না, আপনি এখানেই থাকুন। আমি বিরক্ত হচ্ছি না।
লোকটা বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এসে রনির সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। একপর্যায়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল, তুমি কিসে পড়ো?
ক্লাস এইটে পড়ি স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো রনি।
– তোমার মা-বাবা আছে না?
– হ্যাঁ, মা-বাবা আছেন, একটা ছোট্টবোনও আছে।
– তাই! বেশ তো! তো, নিশ্চয় বাড়ির জরুরি কাজে এসেছো?
– না, বাড়ির কাজে নয়, অন্য একটা কাজে এসেছি। ইউএনও অফিসে একটা চিঠি দিতে এসেছি।
– আজকাল কি সেই যুগ আছে! কুরিয়ারে দিলেই তো পৌঁছে যেত!
– এটা খুবই জরুরি একটা চিঠি। ইউএনও অফিস থেকে সেটা আবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছাতে হবে কালকের মধ্যে।
– ও আচ্ছা, আচ্ছা! তো, কালকেই কি বাড়ি ফিরবে?
– ইচ্ছে আছে, তবে কক্সবাজার গিয়ে ভালো লাগলে হয়তো একদিন থেকে যাব।
– বেশ তো। একটা কথা বলব?
– কথা তো অনেকগুলো বলেছেন এরই মধ্যে, বলুন… একটু হেসে বলল রনি।
লোকটাও হেসে বলতে শুরু করল, আচ্ছা, তোমার তো বয়স অনেক কম। এই বয়সে তোমাকে এতদূরে একা একা পাঠালো যে! কিংবা তুমিই এলে যে!
এটা শোনার পর রনির একটু খারাপ লাগল। সে বলল, বয়স কম হলে কি একা আসা যায় না? এখন কি সেই যুগ আছে?
– তা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে না?
পড়ালেখার কথা বলাতে রনির মেজাজ ধরে গেল। বাড়িতেও শুধু পড়ালেখার কথা আর এতদূরে এসেও পড়ালেখার কথা শুনতে হচ্ছে! তবুও রাগ দমিয়ে সে বলল, এক-দুই দিনে কী এমন ক্ষতি হবে? কোথাও বেড়াতে গেলেও তো এমনই হতো।
লোকটা এরপরে আর কথা বলেনি। রুমে একটা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। রনি তার বিছানায় শুতে গেল।
৫.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল লোকটা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রনি লোকটাকে বলল, বের হবেন নাকি?
– হ্যাঁ, বের হবো।
– কই যাবেন?
– আমার একটা কাজ আছে, সেটা সেরে চলে যাবো।
– ও আচ্ছা। তুমি কবে বের হবে?
– একটু পরে আমিও বের হবো।
আচ্ছা, আমি বের হচ্ছি। ভালো থেকো বলে তিনি বের হয়ে গেলেন।
ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা নিয়ে গার্ডকে রুমের বিল পরিশোধ করে বের হয়ে গেল রনি। সকালের নাস্তা সেরে চলে গেল ইউএনও অফিসে। তখনও কক্সবাজার থেকে ফেরেননি তিনি। আবার অপেক্ষা করতে লাগল সে। বারোটার দিকে ইউএনও সাহেব ফিরলে কাজটা সেরে নিল। অফিস সহকারীর আবদারে তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হলো। ইউএনও অফিস থেকে বের হয়েই বড়ভাইকে কল দিলে তিনি বললেন, থ্যাংকস। এবার কক্সবাজারে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ে চলে যাও। সেখানে আমার লোক আছে, তার নম্বর তোমাকে দিচ্ছি। কাজটা শেষ করে আমাকে কল দিও। ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দিলো রনি।
একটা রিকশা নিয়ে জেটিঘাটে চলে গেল। স্পিডবোটে উঠতে যাবে এমন সময় রনি সেই লোকটাকে দেখতে পেল। তাকে দেখেই রনির এবার সন্দেহ জাগল। সে যেখানেই যাচ্ছে এই লোকটার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। লোকটা কি তাকে ফলো করছে! তাকে ফলো করারই বা কী আছে! সে তো কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। এসব ভাবতে ভাবতেই লোকটার পাশে বসে পড়ল। লোকটা বলল, ফ্রি হয়ে গেছ?
– হ্যাঁ, একটু আগে ফ্রি হলাম। আপনি কই যাবেন?
– কক্সবাজার যাব। সেখান থেকে বাড়ি যাব।
ততক্ষণে স্পিডবোট ছেড়ে দিয়েছে। গতি প্রথমে কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়তে শুরু করেছে। গতি বাড়াতে রনির একটু ভয় ভয় লাগছিল। স্পিডবোটের নিচে যেন কেউ একজন ধাক্কাচ্ছে, একটু হলেই উল্টে যাবে! রনি তার পাশে বসা সেই লোকটার হাত ধরে ফেলল। লোকটাও রনির বাহু শক্ত করে ধরে রেখে যেন অভয় দিলো। যতক্ষণ লোকটা রনির হাত ধরা ছিল ততক্ষণই যেন সে একটা আস্থার মধ্যে ছিল। কক্সবাজার পৌঁছতে তাদের মাত্র সতেরো মিনিট লেগেছে। ছয় নম্বর জেটিঘাটে পৌঁছে লোকটা বিদায় নিয়ে একদিকে চলে গেল, রনি চলে গেল জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে।
সেখানে পৌঁছে রনি তার বড়ভাইয়ের দেয়া নম্বরে কল দিলে তিনি রিসিভ করে তাকে একটু ওয়েট করতে বলল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে এসে রনির কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। রনি বড়ভাইকে কল দিয়ে জানালে তিনি বললেন, তুমি দশটা মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আবার কল দিচ্ছি।
সেই দশ মিনিট রনি এদিক-ওদিক হেঁটে পার করে দিয়েছে। ঠিক দশ মিনিট পরে বড়ভাই কল দিয়ে বলল, তুমি কি আজ কক্সবাজারে থাকবে? থাকলে তোমার জন্য একটা হোটেলে রুম বুকিং দেবো।
রনি একটু ভেবে বলল, না, আমি সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রাম ফিরব। মাঝখানের এই কয়েক ঘণ্টা হয়তো ঘুরে দেখব।
– সমস্যা নেই। থাকা না-থাকা তোমার ইচ্ছা। আজ যদি আসো তবে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
– আবার কী কাজ?
– শোনো, কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা সিএনজি নিয়ে তুমি ঈদগাহ বাজারে আসবে। সেখানকার জোনাকি স্টোরের সামনে এক লোক তোমাকে একটা প্যাকেট দেবে। তুমি জাস্ট সেটা বহন করে নিয়ে আসবে।
– কিসের প্যাকেট বড়ভাই? রনি উদগ্রীব হয়ে বলল।
– কিসের প্যাকেট সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
– আমাকে বলেন কিসের প্যাকেট। না-জেনে কোনও কিছু বহন করে নেয়া সম্ভব নয়।
– রনি শোন, আমার কথাকে ‘না’ করো না। কিসের প্যাকেট সেটা তোমার জেনে কাজ নেই। তোমাকে বলছি, তুমি নিয়ে আসবে। নইলে সমস্যা হবে।
‘নইলে সমস্যা হবে’ কথাটা শুনে রাগে রনির গা জ্বলে উঠল। সে কোনও উত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো। সে ভাবছে, তাকে দিয়ে আবার মাদক চোরাচালান করানো হচ্ছে নিশ্চয়! রাগ সামলে সে ভাবতে লাগল কিভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়! এরই মধ্যে বড়ভাই আবার কল দিলেন রনিকে, সে রিসিভ করল না। সে ভাবল, বার্মিজ মার্কেট থেকে বোনের জন্য একটা জামা ও কিছু আচার নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। বড়ভাইয়ের কল আর রিসিভ করবে না। তাই সে বার্মিজ মার্কেটের দিকে হাঁটা দিলো। তখন ঠিক দুপুর, কড়কড়া রোদ মাথার ওপর। সূর্য ব্যস্ত শাসনে। রনির মোবাইলে এরই মধ্যে আরও কয়েকবার কল এলো, ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকেও কল এলো কিন্তু সে একটাও রিসিভ করেনি। বার্মিজ মার্কেটে ঢুকতে যাবে এমন সময় একটা মেসেজ এলো। “রনি বাড়াবাড়ি করো না, যা বলেছি তা-ই করো। নইলে বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে”। এটা দেখে রনির আবার গা জ্বলা শুরু হয়ে গেছে। সে মেসেজের তোয়াক্কা না করে শপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। মিনিট পনের পরে সজীবের কল এলে রিসিভ করে বলল, কী জন্য কল দিয়েছিস? বড়ভাইয়ের দালালি করতে?
– আরে না! তোর বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেও স্কুলে টিফিন ছুটিতে খেলতে দেখা গেছে, এখন নাকি পাওয়া যাচ্ছে না!
– কে বলল তোকে?
– স্কুলের টিচার।
রনি কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। মনে মনে বলল, বাহ, কত দ্রুত সময়ে বড়ভাই হুমকি রেডি করে ফেলল! দেখা যাক।
সজীবের কলের মিনিট পাঁচেক পরে বড়ভাইয়ের কল এলো। রনি ইচ্ছে করে রিসিভ করেনি। একটু পর সে-ই কল দিলো বড়ভাইকে। তিনি রিসিভ করে বললেন, খুব বড় গ্যাং লিডার হয়ে গেছ না! এতবার কল দিচ্ছি রিসিভ করোনি কেন? আমার ক্ষমতা তুমি এখনও দেখনি। দেখতে চাও নাকি? ঘরে একটা কল দিয়ে দেখো!
রনি এ প্রান্তে এতক্ষণ চুপ ছিল। সে বলল, ঘরে কল দিতে হবে না, যেটা দেখিয়েছেন সেটা ক্ষমতা নয়। ওসব নিয়ে কথা বলতে বা শুনতে চাচ্ছি না। আর ঈদগাহ বাজারে কার সাথে জানি দেখা করতে বলেছেন তার নম্বর দিন।
বড়ভাই বললেন, এই তো লাইনে এসে গেছ। গুড বয়। তোমার বোনের কিচ্ছু হবে না। জাস্ট তোমাকে লাইনে আনতে তাকে একটু আড়াল করেছি মাত্র!
রনি মনে মনে বলল, সময় আসুক, আমি তোমাকে আমেরিকার ‘লিটল বয়’ বানিয়ে ছাড়ব!
শপিং শেষ করে রনির বিচের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আর যায়নি। তার আদরের বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছিল। যেন কিছু একটা হারানোর আভাস পাচ্ছিল। বড়ভাইয়ের সাথে কথা বলে অন্তত আশ্বস্ত হলো। তাই বাড়িতেও বোনের খবর জানতে আর কল দেয়নি সে। সজীবকে একটা কল দিয়ে বলল, বাড়িতে গিয়ে মাকে বলে আয়, তারা যেন দুশ্চিন্তা নাÑকরে। বলবি, অন্যজনকে নিতে গিয়ে ভুলে আমার বোনকে নিয়ে গেছে। খুব দ্রুত ফিরে আসবে। শুধু মাকে জানাবি এ কথা, আর কেউ যেন না জানে। সজীব ‘আচ্ছা’ বলে কলে কেটে দিলো।
কথা শেষ করে রনি দ্রুত একটা সিএনজি নিয়ে ঈদগাহের পথ ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঈদগাহ বাজারে পৌঁছে বড়ভাইয়ের দেয়া নম্বরে কল দিলো। লোকটা বলল, একটু দাঁড়াও, আমি আসছি। কিছুক্ষণ পর লোকটা এসে তাকে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, সাবধানে নিয়ে যেও। সাথে নিয়মিত চলাচলকারী একটা বাসের টিকেট দিয়ে বলল, এখানে একটু পরেই বাসটি আসবে, তুমি টিকেটটি দেখিয়ে উঠে পড়বে। আর নতুন ব্রিজে গিয়ে তুমি তোমার পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করবে।
লোকটা যাওয়ার পর প্যাকেটটা ব্যাগে ভরে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই বাসটি ঈদগাহ বাজারে এসে দাঁড়ালে রনি তাতে দ্রুত উঠে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ল।
দুপুরে টেনশন ও দৌড়াদৌড়িতে কিছু খাওয়া হয়নি। বাস যখন আমিরাবাদ এসে যাত্রাবিরতি করল ব্যাগটা নিয়ে নেমে পেটভরে খেয়ে নিল। বাস ছাড়ার পর এক ঘুম দিলো কর্ণফুলী ব্রিজের আগে মইজ্যারটেক এসে জাগল সে। জায়গা মতোন এসে জেগেছে বটে! সেখানেই নেমে গেল। টোলবক্সের আগেই চেকপোস্ট। সেখানে কক্সবাজার থেকে আসা প্রায় প্রতিটি বাস ও সন্দেহজনক গাড়ি নিয়মিত চেক করে পুলিশ।
না জাগলে নিশ্চিত চেকপোস্টে ধরা খেয়ে যেত, ধরা খেলে সব শেষ। বড়ভাইয়ের আস্থা, লাভ, নিজের জেলের ঘানি এবং ছোটবোন। সবকিছুুই জড়িত এতে।
তখন রাত নয়টা। লোকজন ও গাড়িতে ভরপুর। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর খেয়াল করল, এক মহিলা ব্রিজ পার হওয়ার গাড়িতে উঠতে চেয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। একে তো পুরুষদের ঠেলাঠেলি, তার ওপর ভারি একটা বস্তা মহিলার। রনি তার কাছে গিয়ে বলল, কী জ্যাম আর ঠেলাঠেলি! গাড়িতে ওঠাই মুশকিলের।
– হ্যাঁ, বাবা। অনেকক্ষণ ধরে উঠতে চেয়েও পারছি না।
রনি বলল, আপনার তো দেখি বস্তা আছে, উঠতে পারবেন? নয়তো আপনি আমার ব্যাগটা নিন, আপনার বস্তাটা আমি নিই। আপনি বস্তার ভারের কারণে বারবার উঠতে চেয়ে পারছেন না!
মহিলা বেশ খুশিই হলো। তিনি বললেন, সেটা করলে ভালো হয়। রনি আর দেরি না-করে দ্রুত বস্তাটা নিয়ে একটা গাড়িতে উঠে পড়ল, পেছন পেছন মহিলাও রনির ব্যাগটা নিয়ে উঠল। কর্ণফুলী ব্রিজ পার হয়ে রনি বস্তাটা নিয়ে নেমে পড়ল, মহিলাও নেমে ব্যাগটা রনিকে দিয়ে বস্তাটা নিয়ে নিল। তারপর রনির গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, উপকার করেছ বাবা আমার।
রনি একটা হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য একটা সিএনজি ধরল। সিএনজিতে উঠে সজীবকে কল দিয়ে জানতে চাইল, বোন বাড়িতে ফিরেছে নাকি?
সজীব জানাল, হ্যাঁ, সে তো সন্ধ্যার আগে-আগেই ফিরেছে।
তার মানে, রনি ঈদগাহ বাজার থেকে গাড়িতে ওঠার পরপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বোনকে।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা বড়ভাইয়ের কাছে চলে গেল সে। দরজায় নক করতেই বের হয়ে এলো বড়ভাই। রনি প্যাকেটটা দিয়ে খরচের বাকি টাকা বড়ভাইকে দিতে গেলে তিনি বললেন, রাখো ওটা তোমার কাছে, তোমার খরচের জন্যই তো দিয়েছি।
– খরচ যা করার করেছি, এটা খরচ হয়নি।
– রেখে দাও তোমার কাছে। আর কাল দেখা করবে আমার সাথে। কথা আছে, কাজ আছে।
কথা না-বাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বলে রনি নিজেদের বাড়ির দিকে চলে এলো।
বাড়ি গিয়ে দরজা নক করতেই বের হয়ে এলো বাবা! রনি একটু থতমত খেয়ে গেল। বাবার চোখ লাল, চেহারার দৃশ্যও সুখকর নয়। দরজা আটকে ধরে বলল, এত রাতে কোত্থেকে এলি?
– মহেশখালী গিয়েছিলাম।
– মহেশখালীতে তোর কী কাজ?
– আমার নয়, বড়ভাইয়ের কাজে।
– বড়ভাইয়ের কাজে নাকি নিজে বড়নেতা হতে?
– আগে ভেতরে ঢুকি, তারপর বলছি।
– তোকে ঘরে ঢুকতে দেবো না, এই ঘর আজ থেকে তোর জন্য নিষিদ্ধ। কোথায় থাকবি থাক, এখানে তোর জায়গা হবে না।
– কেন রেগেছো বলবে তো, হঠাৎ এসব বললে কী বুঝব?
– তুই তোর বোনকে নিয়ে অপহরণ নাটক সাজাসনি? এখন এসে অভিনেতা সাজা হচ্ছে।
– মোটেও না। আপনি ভুল বুঝেছেন বা আপনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
– ভুল বোঝার কী আছে? সবার মুখে মুখে রটে গেছে, তুই-ই এই অপহরণ নাটকটা করতে মহেশখালী যাবার নাম করে সরে পড়েছিস!
– আচ্ছা আমি বোনকে কেন অপহরণ করতে যাব? তাকে অপহরণ করে আমার কী লাভ? আমি তোমাদের কাছে এমন কিছু দাবি করেছি যে, তা তোমরা দিচ্ছ না বলে বোনকে অপহরণ করে সেটা পূরণের চেষ্টা করছি! তোমার কী মনে হয়?
ততক্ষণে মা ও বোন দরজার ওপাশে এসে হাজির। মায়ের চোখ ফোলা ফোলা, বোনের আতঙ্কও যেন এখনও কমেনি!
এবার মা কথা বলা শুরু করল। তিনি বললেন, তুই যদি অপহরণ না করে থাকিস তবে তুই যেদিন ঘর থেকে বের হয়ে গেলি তার পরদিনই কেন ও অপহৃত হবে?
– সেটা বোনকে জিজ্ঞেস করো। সে তো নিশ্চয় দেখেছে তাকে কারা নিয়ে গেছে, দেখেনি?
– সেটা দেখেই তো নিশ্চিত হয়েছে। তোর গুন্ডা বন্ধুরাই তাকে স্কুলের টিফিন ছুটিতে তোর কথা বলে নিয়ে গেছে!
– কী বলো! কারা নিয়ে গেছে?
– এত সাধু সাজতে হবে না, তোর মতো নির্লজ্জ, বেহায়া একটা সন্তানের বাপ যে আমি সেটা ভাবতেই ঘেন্না হয়। রেগেমেগে বলল বাবা।
রনির এবার প্রায় কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। তাকে দুদিক থেকেই ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। সে বলল, তোমরা বিশ্বাস করো এই অপহরণ নাটকটা আমি করিনি। আমি জানতামই না যে এরকম একটা নাটক করে আমাকে হুমকি দেবে এবং আমাকে দিয়ে একটা অন্যায় কাজ করানো হবে!
– সারাদিনই তো অন্যায় কাজে ব্যস্ত থাকিস, তুই আবার কোন অন্যায় কাজে না করেছিস? বাবা ঠাট্টা মেশানো সুরে বলল।
রনি তার মা-বাবাকে বড়ভাইয়ের করা সবকথা বুঝিয়ে বললে তারা তাকে ঘরে ঢোকালো। ঘরে ঢুকেই বোনকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলল। সেটা দেখে মা-বাবা দুজনেরই চোখে পানি চলে এলো।
ব্যাগ থেকে বের করে বোনের জন্য আনা জামাটাসহ নানারকম আচারের প্যাকেটগুলো বোনের হাতে তুলে দিলো।
এসব পেয়ে বোনের খুশিও দেখার মতো ছিল, তার এতক্ষণকার মলিন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
৬.
রাতে ঘুমাতে গিয়ে সারাদিনের কথাগুলো একেকটা মনে পড়ছে। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দাড়িধারী লোকটা, বড়ভাইয়ের আচরণ, সজীবের ফোনকল, সর্বশেষ ঘরে ঢোকার মুহূর্তে বাবার আচরণÑসবকিছুু মনে পড়ছে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম আসছে না কোনওভাবেই। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। তার মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নিল। মাকে ভাত দিতে বলে স্কুলের ব্যাগ গোছাতে লাগল। ভাত খেয়ে যে-ই স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিতে গেল অমনি মা এসে বলল, স্কুলব্যাগ নিয়ে কই যাস?
– স্কুলে যাই।
– স্কুলে কোনও কাজ আছে নাকি?
– এভাবে বলছো কেন? পড়ার জন্য কি স্কুলে যেতে পারি না?
– পারিস। তবে নিয়ম করে গেলেই হলো। কারও সাথে ঝগড়া বাঁধাবি না।
আচ্ছা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রনির স্কুলব্যাগ কাঁধে দেখে রাস্তায় পরিচিতরা একবারের পর দুইবার করে তাকাতে লাগল। হঠাৎ এই পরিবর্তনে সবাই মোটামুটি হতবাক। স্কুলে পৌঁছলে সেটা আরও বেড়ে যায়। ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও অবাক হয়ে গেল। যে শিক্ষকরা তার সাথে কথা বলত না, এড়িয়ে যেত, তারাও ভাবতে লাগল রনির হঠাৎ কেন এই আগমন? তারাও কিছু বুঝে উঠতে পারল না।
ক্লাসের একপাশে গিয়ে বসল সে। তাকে দেখে অন্য ছাত্ররা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেমনটা চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার দিকে দর্শনার্থীরা তাকায়!
ক্লাসটিচার মোজাম্মেল স্যার ক্লাসে ঢুকলে সকলে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। তারপর ছাত্ররা রনির দিকে তাকাতে লাগল, যেনবা স্যারকে ইশারা করে বোঝাতে চাইছে, স্যার, ক্লাসে আজ কে এসেছে দেখেন! এলাকার গ্যাং লিডার এসেছে, কত অপকর্মই না সে করেছে। এখন আবার স্কুলে এসেছে! স্যার রনির দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকায়নি। এরপর রোলকলে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সবার নাম ডাকতে ডাকতে যখন রনির নাম এলো তখন তিনি হাজিরাখাতা থেকে মাথা উপরে তুলে রনির দিকে তাকালেন। বললেন, তুমি ক্লাসে এসেছো? কতদিন পর এলে?
– জানি না স্যার, অনেকদিন হবে।
– বেড়াতে এসেছো নাকি নিয়মিত হবে?
– নিয়মিত আসবো, স্যার।
স্যার বললেন, বসো। স্যারের এমন আচরণে ছাত্ররা অবাক এবং হতাশ। তারা ভেবেছিল, মোজাম্মেল স্যারের বেত ও রনির পিঠে আজ কথা হবে! কিন্তু তার ছিটেফোঁটাই দেখা গেল না।
কারও কারও মনে এলো, স্যার কি ভয়ে কিছু বলেনি বা করেনি! কিন্তু মোজাম্মেল স্যার তো এমন নন, তিনি কাউকে ভয় পান না, কারও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না, সে যে-ই হোক। একবার রনির বড়ভাই এসএসসির টেস্টে ফেল করা এক ছাত্রকে পাশ করিয়ে দেয়ার আবদার নিয়ে এলে হেডস্যারসহ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। তখন সাহস করে দাঁড়িয়ে এই মোজাম্মেল স্যারই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিল। বড়ভাই শেষমেশ না পেরে ‘হুম-হাম’ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাই মোজাম্মেল স্যার রনিকে বা তার বড়ভাইকে ভয় পাবে এমনটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে অনেকের। এখানে অন্যকোনও ব্যাপার থাকতে পারে।
সেদিনের মতো সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ক্লাস শেষ করেছিল রনি। কারও সাথে ঝগড়া করেনি, স্যারের সাথে বেয়াদবি করেনি। ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে সজীবকে ডেকে নিল একপাশে। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে তার লালিমা দেখানো শুরু করেছে মাত্র, পাখিদের ওড়াউড়িও শেষ হয়নি। দুজনে গিয়ে নিরিবিলি একটা জায়গায় বসল। সজীব বলল, এভাবে ডেকে আনলি কেন? আর তোর কাঁধে স্কুলব্যাগ কেন?
– স্কুলব্যাগ নেয়া যাবে না?
– তা বলিনি। অনেকদিন তো স্কুলে যাস না, তাই…
– হুম, এখন থেকে স্কুলে যাব, নিয়মিত ক্লাস করব।
– হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত!
– হুম, গুণ্ডাগিরি করতে ভালো লাগছে না আর, সারাদিন এটা-ওটা নিয়ে টেনশনে থাকতে হয়!
– তোর কিসের টেনশন? তুই তো গ্যাং লিডার। বড়ভাইয়ের কাজ করবি, টাকা কামাবি আর টাকা ওড়াবি!
– বড়ভাই যদি বেঈমানি করে তাহলে সেই বড়ভাইয়ের কাজ আমি করি না, করতে বাধ্য নই।
– বড়ভাই আবার তোর সাথে কী বেঈমানি করেছে? করেছে নাকি!
রনি তখন কক্সবাজারে যা যা ঘটেছে সব বলল। আর বোনকে অপহরণের ব্যাপারটা তো সজীব জানেই। সব শুনে সজীব বলল, তাহলে কি তুই বড়ভাইয়ের কাজ আর করবি না?
– ঠিক জানি না করব কি না। তবে বড়ভাই আমার বোনকে নিয়ে যা করেছে আমি মানতে পারছি না। আমি চুপচাপ আছি তখন থেকে, কিন্তু আমার মন কেমনভাবে যে জ্বলছে তা কাউকে দেখাতে পারছি না। আজ আমার সাথে করেছে, কাল তোর সাথে যে করবে না তার কী বিশ্বাস! আমি একটা ব্যাপার ধরতে পেরেছি যে, এরা যতক্ষণ স্বার্থ থাকে ততক্ষণ আদর-আপ্যায়ন করে, স্বার্থ ফুরালেই ডিগবাজি মারে!
-সে যা-ই বল, আমি বড়ভাইয়ের দল ছাড়তে পারব না!
– কেন? ছাড়তে পারবি না কেন?
– কারণ, বড়ভাইয়ের দেয়া টাকা দিয়েই আমাদের পরিবার চলে। বড়ভাইয়ের কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে সবার।
– আচ্ছা, এখনই ছাড়তে হবে এমন তো বলছি না। ধীরে ধীরে সরে পড়বি।
– কেমনে সম্ভব? তোদের পরিবারের মতো আমাদের পরিবার তো অতটা সচ্ছল নয়।
– সচ্ছল না হলেও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ তোকে যে এত কথা বলেছি তা যেন কারও কানে যায়, বড়ভাইয়ের কানে তো নয়ই!
– সেটা নিশ্চিত থাকতে পারিস। অন্তত তোর সাথে বেঈমানি করব না।
আশ্বস্ত হলাম বলে সেদিনের মতো দুজন বিদায় নিয়ে দুদিকে চলে গেল, সূর্য তখন পাটে নামতে শুরু করেছে।
এভাবে আরও সাত-আটদিন কেটে গেল। এই কয়দিন রনি নিয়মিত স্কুলে গিয়েছে, ক্লাস করেছে। মোবাইলও বন্ধ রেখেছে স্কুলের সময়টায়। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়নি। গ্যাংয়ের ছেলেদের সাথেও আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করেনি। এই ক’দিনের পরিবর্তনে মা-বাবা দারুণ খুশি। রনি যেন সেই আগের রনিতে ফিরে এসেছে।
সাজ্জাদ কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতেই বিশ্রাম নেয় ডাক্তারের পরামর্শ মতে। সাজ্জাদের একটা বড় রোগ ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে, তার কিডনিতে প্রোবলেম দেখা দিয়েছে। যার কারণে তার খিঁচুনি হচ্ছে, চোখের চারপাশ কালো হয়ে ফুলে গেছে। পেশাবের জ্বালাও বেড়েছে। ডাক্তার সাহেব পরামর্শ দিয়েছেন, বেশি বেশি পানি খেতে। আর কোনও জটিল বিষয় মাথায় না ঢুকাতে। কিডনিতে সমস্যা হয়েছে শোনার পর সাজ্জাদের মন খারাপ বেড়ে গেছে। শারীরিক দুর্বলতার চেয়ে মনের দুর্বলতাই যেন বেশি ভোগাচ্ছে।
রনি তাকে দেখতে গেল। এই ক’দিন তার খবরাখবর নেয়া হয়ে ওঠেনি। যাওয়ার সময় তার জন্য দুটো বড় তরমুজ নিয়ে গেছে। কোথায় যেন পড়েছিল, তরমুজ খেলে পেশাবের জ্বালাপোড়া কমে, দ্রুত পেশাবও হয়।
সাজ্জাদদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে রনি একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। সেদিন হাসপাতালে দেখতে গিয়েও এমন অবস্থায় পড়েছিল। তবুও সাহস করে ঘরে ঢুকেই সাজ্জাদের দেখা পাওয়াতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি। সাজ্জাদ নিজেই ডেকে নিয়ে ভেতরে বসাল। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলো। সাজ্জাদের অসহায়ত্ব দেখে রনির মন কেমন করে উঠল! অসুস্থতার সময় মানুষের প্রকৃত অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। সাজ্জাদ বলল, একটা কথা শুনেছি, সত্যি নাকি?
– কোনটা? রনি বলল।
– তুই নাকি স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিস?
– হ্যাঁ।
– হঠাৎ কী মনে করে?
– ভাবছি, পড়ালেখায় মন দেবো।
– তা তো ঠিক আছে। কিন্তু হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন?
রনি তখন তার সাথে বড়ভাইয়ের যা যা হয়েছে সব খুলে বলল। শুনে সাজ্জাদ বলল, বড়ভাই তোর বোনকে নিয়ে যা করেছে মোটেও ঠিক করেনি। কিন্তু বড়ভাইয়ের দল ছাড়লে বা ওনার কাজ না-করলে তো গ্যাং লিডার থাকতে পারবি না! তখন?
– আরে, এসব এখন আর ভাল্লাগছে না। গ্যাংজীবন কাটিয়ে কী লাভ! মানুষ তো ভালো চোখে দেখে না। আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে গুণ্ডা-মাস্তান বলে!
– সেটা কি আগে থেকে জানতি না?
– জানতাম। কিন্তু তখন বুঝিনি। এখন বুঝলাম। বড়ভাইয়েরা হচ্ছে ফুল যতক্ষণ সুবাস বিলাবে ততক্ষণ হাতে রাখে, এরপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তোর যে অসুখ হলো, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলি, একবারও কি দেখতে গেছে নাকি ফোন করে জানতে চেয়েছে?
– না, একবারও ফোন করেনি।
– কিংবা ধর, জয়নালকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল, তাকে বাঁচানোর জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
রনির এতসব কথায় সাজ্জাদ দ্বিধায় পড়ে গেল। বড়ভাইয়ের কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়, এলাকায় আলাদা প্রভাব খাটানো যায়। দল ছেড়ে এলে সব বরবাদ হয়ে যাবে। রনি কিছুক্ষণ থেকে সাজ্জাদের কাছ থেকে চলে এলো।
রনির ফোন বন্ধ পাওয়াতে বিকেলে সজীবকে দিয়ে ডাকা পাঠিয়েছে বড়ভাই। সজীব এসে বলল, তোকে এখন যেতে বলেছে বড়ভাই।
রনি বলল, বড়ভাইয়ের মুড কী রকম দেখেছিস?
– খারাপ না, স্বাভাবিক।
সজীবের সাথেই বড়ভাইয়ের কাছে গেল রনি। সজীবকে বিদায় করে দিয়ে রনিকে নিয়ে বসল বড়ভাই। তিনি বললেন, কী হলো তোমার? হঠাৎ ফোন টোন বন্ধ করে রেখেছো যে!
– কিছু না, এমনিতে।
– এমনি এমনি কেউ ফোন বন্ধ রাখে?
– স্কুলের সময়টাতে বন্ধ রাখি।
– বাহ, স্কুলে যাচ্ছো তাহলে!
– হ্যাঁ, এখন থেকে নিয়মিত স্কুলে যাব, ক্লাস করব।
– বেশ তো। তবে কাল তোমাকে একটা কাজে যেতে হবে।
– কোথায়?
– ঢাকায়।
– ঢাকায় কেন?
– ঐদিন যে প্যাকেট এনেছো সেটা ঢাকায় পৌঁছে দিতে হবে।
– অন্য কাউকে পাঠান, আমার স্কুল আছে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল রনি।
– অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি চালাক আছো, পরিস্থিতি সামলে নিতে পারো, তাই তোমাকে পাঠাতে চাচ্ছি।
– কিন্তু আমি যেতে পারব না!
– কেন পারবে না?
– এসব আমার ভালো লাগছে না। ইয়াবা বা কোনও মাদকদ্রব্য আনা-নেয়ার জন্য আমাকে রিকোয়েস্ট করবেন না, প্লিুজ।
– তোমার সমস্যা কী?
– বললাম তো এসব আমার ভালো লাগছে না। সারাদিন টেনশনে থাকতে হয়, তা ছাড়া ইয়াবা খুব বেশি ক্ষতি করে ফেলছে আমাদের তরুণসমাজকে।
– বাহ, জ্ঞান দেয়া শুরু করেছো দেখছি। মনে হচ্ছে, সেমিনারে শ্রোতা হয়ে আছি।
– আমি এখন বের হবো।
– দাঁড়াও, তোমার সাথে আরও কথা আছে।
– জি, বলেন।
– যে জীবনে ঢুকে গেছ এ জীবন থেকে বের হওয়া কঠিন। এখান থেকে বের হলে লাশ হয়ে বের হতে হয়।
– আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?
– মোটেও না। তবে, বাস্তবতা কী হয় তা জানিয়ে দিচ্ছি।
রনি সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে বড়ভাইয়ের কাছ থেকে চলে এলো।
পরদিন সকালে জয়নালকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। জয়নালের বাবার কাকুতিমিনতির পর ইউএনও মুচলেকা নিয়ে ছেড়েছে তাকে। ছাড়া পাওয়ার পর জয়নালের ক্ষোভ ছিল দেখার মতো। রনির সাথে দেখা হওয়ার পর প্রথমে কথাই বলেনি। পরে রনি খুব অনুনয় করে বোঝালো যে, সে বড়ভাইকে বলেছিল, তিনি পাত্তাই দেননি। তিনি বলেছেন, এসব নারীঘটিত ব্যাপার রিস্কি, নিজেই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
এটা শুনে জয়নালের মেজাজ আরও গরম হয়ে যায়। সে বড়ভাইয়ের নাম ধরে অশ্লীল গালাগাল শুরু করে দিয়ে বলল, বড়ভাইয়ের আর কোনও কাজই করব না। আমাদের বিপদ-আপদে যদি এগিয়ে না আসে সেই বড়ভাইয়ের গোষ্ঠী কিলাই আমি!
৭.
জয়নালের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর রনি বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, পথেই সেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দাড়িধারী লোকটার সাথে দেখা। দেখার সাথে সাথে সালাম দিলো রনি। জবাব নিতে নিতে তিনি বললেন, কেমন আছো?
– ভালো।
– আপনি কেমন আছেন?
– আমিও ভালো।
– আপনার সাথে বারবার দেখা হচ্ছে, সব জায়গায়!
– হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছি। তোমাকে আর আমাকে দিয়ে বোধ হয় কিছু একটা হবে?
– মানে? কিছু একটা মানে!
– না, সেরকম নির্দিষ্ট কিছু না। তবে যেভাবে বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে, তাই বললাম।
– আপনার সাথে এতবার দেখা হলো বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম না একটিবারও!
– তুমি তো তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকো, তাই হয়তো!
রনি একটু লজ্জা পেল বোধ হয়, মাথা নিচু করে ফেলল।
লোকটা বলল, দেশকে ভালোবাসো?
– বাসি তো, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছেন যে!
– কারণ আছে। কেমন ভালোবাসো সেটার একটা পরীক্ষা নিতে চাই, দেবে?
– হ্যাঁ, দেবো।
– আচ্ছা, আগে বলো আমাদের দেশ যদি আক্রান্ত হয় তখন তুমি কী করবে?
– আমার সাধ্যমতো প্রতিরোধ করব।
– তুমি কি পারবে? তোমার তো বয়স এখনও অনেক কম! মাত্র ক্লাস এইটে পড়ো!
– বয়স কম হলেও আমার উচ্চতা এখন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। শরীর-স্বাস্থ্যও বেশ ভালো। তাছাড়া, আপনি বোধ হয় জানেন না, আমি এই এলাকার গ্যাং লিডার। এখানকার সব কিশোর-তরুণ আমাকে লিডার হিসাবে মানে!
– বেশ তো। দেখি তোমার লিডারশিপ কেমন? তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক!
– এখনই? নেন পরীক্ষা, সমস্যা নেই।
– আরে না না, এত দ্রুত পরীক্ষা নেবো না। পরীক্ষক হিসেবে আমি অত কাঁচা না, আমি আমার পরীক্ষার্থীকে প্রস্তুতি নেয়ার সময় দেবো। তারপর পরীক্ষা নেবো।
-আচ্ছা, তা-ই হোক। কিন্তু আপনি আপনার বাড়ি কোথায় বললেন না যে!
– আমার বাড়ি তোমার পাশের ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের শেষ সীমানায়। একদিন বেড়াতে নিয়ে যাবো তোমায়।
– আচ্ছা।
– তোমার নিশ্চয় আরও বন্ধু আছে, যেহেতু তুমি গ্যাং লিডার!
– নিশ্চয় আছে, অনেক বন্ধু। পুরো একটা গ্যাং আছে।
– তার থেকে চার-পাঁচজনকে বেছে নাও, যারা তোমার খুব কাছের। যাদের তুমি বিশ্বাস করো, তোমাকেও তারা মানে, বিশ্বাস করে।
– হুম, নেবো। ওদের এনে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।
– আচ্ছা। কখন দেবে?
– এখন বললে এখনই ডাকতে পারি।
– এখন না, কাল বিকালে যখন তুমি স্কুল থেকে ফিরবে, তখন ওদেরকে নিয়ে এসো। আমি তোমাদের স্কুলের ওদিকটায় থাকব।
– আচ্ছা তা-ই হবে।
লোকটা বিদায় নিয়ে চলে গেল। রনির কেমন যেন লাগছে। এই লোকটা কী পরীক্ষা নিতে চায় কে জানে! তবে লোকটাকে খারাপ মনে হয়নি। দেখা যাক কী পরীক্ষা নেয়। এসব ভাবতে ভাবতে রনি বাড়ির দিকে চলল।
কিন্তু রনির তর সইছিল না, কী পরীক্ষা নেয় তা দেখার। পরদিন স্কুলে গেল যথারীতি। স্কুল গিয়ে দেখল সাজ্জাদও এসেছে। সাজ্জাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর না অসুখ! স্কুলে এলি যে!
– বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই।
– ভালো করেছিস।
তারা কথা বলার মাঝখানে সাজ্জাদ বলল, ওই দেখ তো, জয়নালের মতো মনে হচ্ছে না?
– হ্যাঁ, কিন্তু সে তো ক্লাস করার মতো ছেলে না!
– দাঁড়া, দেখি। কাছে আসুক।
কাছে আসতেই স্পষ্ট হলো ওটা জয়নালই। রনি ও সাজ্জাদ হতবাক! তারা নিজেরাই জয়নালের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে! স্কুলে রাস্তায় তুই?
– আর বলিস না, বাবা জোর করে পাঠিয়েছে!
– ভালোই তো!
– খুব মন খারাপ করে বেরিয়েছিলাম। এখন তোদের দেখে ভালোই লাগছে। তোদের যে স্কুলে পাবো এটা জানলে হয়তো অতটা মন খারাপ হতো না!
– যাক, সবাই একসাথে হলাম। সজীবটা থাকলে হালি পুরাতে পারতাম। হো হো করে হেসে বলল সাজ্জাদ।
জয়নাল বলল, সাজ্জাদ, তোর অসুখের কথা শুনেছি, কিন্তু তোকে দেখতে যেতে পারেনি, স্যরি।
– ব্যাপার না। তোর জন্যও তো আমরা কিছুই করতে পারিনি।
আচ্ছা যাক সেসব কথা। তোরা স্কুলে এসে ভালোই করেছিস। নয়তো তোদের ডাকতে হতো। একটা নতুন তথ্য আছে। আজ স্কুল ছুটির পর এক লোকের সাথে দেখা করব আমরা। রনি এক নিঃশ্বাসে বলে থামল।
– কোন লোক?
লোকটার সাথে রনির কোথায় কোথায় দেখা হয়েছে, কী কী হয়েছে সব বলল তাদের। সব শুনে সাজ্জাদ বলল, ঠিক আছে। দেখি কী পরীক্ষা নেয়।
জয়নাল বলল, পরীক্ষা-টরীক্ষা ভালো লাগে না রে, কোনও কাজ-টাজ দিলে করে দেখিয়ে দিতাম যে, আমরাও পারি।
– দেখি না আগে, পরীক্ষা নেয় নাকি কাজ দেয়। রনি বলল।
তারপর তারা ক্লাসে চলে গেল। আজ অন্য ছাত্ররা একটু হতবাক বেশিই হলো। কারণ শুধু রনি একা নয়, সাজ্জাদ, জয়নালও স্কুলে এসেছে! তাদের দেখে ছাত্রদের গুনগুনটা বেড়ে গেল। একেকজনে একেক কথা বলছে। রনিরা সেসব শুনলেও না শোনার মতো হয়ে আছে।
ক্লাস শেষে ছুটির পর তারা স্কুল থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। স্কুলের অন্য ছাত্ররা তখন বাড়ি ফিরছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রদের আনাগোনা কমে আসে।
রনি খেয়াল করল, দূর থেকে এক লোক সাইকেল চালিয়ে আসছে। পেছনের ক্যারিয়ারে আরও একজন আছে। কাছে আসতেই বুঝল, সেই লোকটা। যখন একেবারে কাছাকাছি এসে সাইকেল থামাল, তখন পেছনের জন দ্রুত নেমে গেল। তাকে দেখে তো বিস্ময়ের শেষ নেই রনিদের! এ যে সজীব!
রনি বলল, সজীব তুই! ওনাকে চিনিস নাকি?
– তার আগে বল, তুই কেমনে চিনিস ওনাকে? আমার সাথে তো মাত্রই পরিচয় হলো!
রনি সংক্ষেপে জানিয়ে দিলো লোকটার সাথে কিভাবে তার পরিচয় হলো।
সজীব বলল, আমি ওদিকেই গিয়েছিলাম। তিন চারটা ছেলে হঠাৎ আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই মারতে শুরু করল। উনি এসে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। উনি কারাতে জানেন। মাত্র তিন মিনিটে সেই ছেলেগুলো মার দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন!
– বলিস কী!
– একদম, যেটা বলেছি সেটাই।
লোকটা এতক্ষণ চুপ ছিল। তিনি বললেন, ছেলেগুলো নেশা করে। কার সাথে কখন কী করে বসে নিজেরাই জানে না। সজীবকে মার খেতে দেখে তখন এগিয়ে গেলাম।
রনি বলল, এরাই আমার খুব কাছের বন্ধু। আর একজনকে পাইনি যেটাকে আপনিই নিয়ে এলেন সাইকেলের পেছনে করে!
– সজীবও কি তোমাদের কাছে বন্ধু?
– হ্যাঁ।
– তাহলে তো ভালোই হলো!
সজীব বলল, তোরা স্কুলে আসিস?
– হ্যাঁ, আজ থেকে আসা শুরু করেছি।
সাজ্জাদ বলল, আপনি কারাতে জানেন?
– হ্যাঁ, শিখে রেখেছি আত্মরক্ষার জন্য। আমি পুরো চট্টগ্রাম ডিভিশনে ব্ল্যাকবেল্টপ্রাপ্ত। শিখে রেখেছি বলেই আজকে সজীবকে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম।
– হুজুর হয়েও!
– হুজুর হলে কি এসব শিখতে নেই? আত্মরক্ষার জন্য মৌলিক কিছু কৌশল সবারই শিখে রাখা উচিত। আর আমি তো হুজুর নই!
– কে বলল আপনি হুজুর নন!
– শুধু পাঞ্জাবি আর দাড়ি থাকলেই কি হুজুর হয়ে যায়? তাহলে তো তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেক বড় হুজুর বলে দাবি করে বসবে!
এটা শোনার সাথে সাথে সাজ্জাদ নিজে তো হাসলোই, রনিরাও হো হো করে হেসে উঠল।
– শোন, দাড়ি-টুপি বা পাঞ্জাবি পরলেই হুজুর হয়ে যায় না। ইসলাম ও কুরআন, হাদিস, ফিকহের জ্ঞান যাদের আছে এবং যারা এসব মেনে চলে তারাই হুজুর বা আলেম। তাই যাকে তাকে হুজুর বলে হুজুরদের অপমান করতে যেও না। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। এতক্ষণ ওনার কথায় মুগ্ধ হয়েছিল। রনিরা এবার অবাকের চেয়েও অবাক হয়ে গেল।
রনি বলল, আমি তো আপনাকে হুজুর আঙ্কেল সম্বোধন করব ভাবছিলাম!
– হুজুর আঙ্কেল নয়, শুধু আঙ্কেল ডেকো।
‘আচ্ছা’ একযোগে মাথা নেড়ে বলল তারা।
লোকটা এবার কথা শুরু করল। রনিকে গতকাল যে পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেছে তা আবারও সংক্ষেপে বলল। সব শুনে সজীব বলল, তাহলে বলুন কী সেই পরীক্ষা?
সজীবের কথায় সবাই ওপর-নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
লোকটা চারদিকে একবার তাকালেন, তারপর বলা শুরু করলেন। তোমাদের একটা কাজ দেবো, কাজটা তোমাদের সমাধা করতে হবে। আমি তোমাদের সব ধরনের সাহায্য করব। কাজটা তোমরা পারলেও কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, না পারলেও কিছু বলার দরকার নেই। এখন আমার হাতে হাত রেখে কথা দাও যে, এই কাজটার ব্যাপারে আমরা পাঁচজন ছাড়া বাইরের আর কেউই জানবে না। সে তোমাদের যতই ঘনিষ্ঠজন হোক না কেন।
এটা বলেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, ওনার হাতের ওপর রনিরাও একে একে হাত রেখে বলল, আমরা পাঁচজন ছাড়া এই ব্যাপারটা কেউ জানবে না, জানাবোও না।
রনিদের কথা শেষ হলে লোকটা তার অপর হাতটা সব হাতের ওপর রেখে বলল, তা-ই যেন হয়।
লোকটা আবার বলা শুরু করল, আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক এখান থেকে এক কিলোমটার দূরে আমাদের ওয়ার্ড। সজীবের সাথে যেখানে আমার দেখা হলো। ওখান থেকে দুই কিলোমটার সামনে গেলে একটা পাহাড়। তোমাদের যা করতে হবে ওখানেই করতে হবে। ওই পাহাড়ের পাদদেশে কিছুদিন আগে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠেছিল। প্রথমে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। মিডিয়ার লোকজন এসে ছবি তুলে ভিডিও করে নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছিল। একটু পেছনে ভাবলে হয়তো তোমাদের মনেও পড়তে পারে। ওখানে ছোট্ট একটা কূপ ছিল, সেই কূপ থেকে আগুন ধরাতে অনেকেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, অনেকে বলেছে জায়গাটা অভিশপ্ত। মিডিয়ায় নিউজ হওয়ার পরে সবাই বুঝতে পেরেছে ওখানে গ্যাস থাকতে পারে। মানে গ্যাসক্ষেত্র থাকতে পারে।
তার কিছুদিন পরে সরকারের লোকজন এসে জায়গাটা চিহ্নিত করে এবং পরীক্ষার জন্য আলামত নিয়ে যায়। এরপর তারা আর এসেছে কি না কিংবা আলামত পরীক্ষার ফলাফল কী পেয়েছে আমরা সাধারণ জনগণ জানতে পারিনি।
বাংলাদেশের জন্য এরকম একটা গ্যাসক্ষেত্র বর্তমানে খুবই জরুরি। চারদিকে গ্যাসের জন্য হাহাকার আর দিনে দিনে গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে। এই মুহূর্তে এরকম একটা গ্যাসক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাবে, তা মেনে নিতে পারছি না।
– এগুলো তো বিরাট ব্যাপার, আমরা কী করতে পারি? রনি বলল।
– হ্যাঁ, বিরাট ব্যাপার। আমরা যা করতে পারি তা বলছি তোমাদের। এখন কুমিল্লার তিতাস গ্যাস দিয়েই চলছে সারাদেশে। সিলেটেও প্রচুর গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। হরিপুর, ছাতক, কৈলাসটিলায় রয়েছে গ্যাসক্ষেত্র, এতদিন এগুলোর ওপরই ভরসা করে বাংলাদেশ চলেছে। বলতে গেলে সিলেট গ্যাসের ওপর ভাসছে!
– চট্টগ্রামে গ্যাসক্ষেত্র নেই? জয়নাল বলল।
– আছে। বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র চট্টগ্রামে। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র। এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন প্রায় শেষ। যা শুনছি বাংলাদেশে যে গ্যাস মজুদ আছে তা দিয়ে মাত্র আগামী ষোলো বছর চলবে, এরপর শেষ।
– শেষ মানে?
– শেষ মানে এরপর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। এখন তো লাইনের গ্যাস ব্যবহার করছি আমরা, তখন আমাদের গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে।
– এখনও তো অনেকেই সিলিন্ডার ব্যবহার করে!
– হ্যাঁ, সিলিন্ডার ব্যবহার করছে। সেটাই ভালো। আমরা কদর বুঝি না। লাইনের গ্যাস যারা ব্যবহার করে তারা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, সারাদিন মিটিমিটি জ্বালিয়ে রাখে, এমনকি বাচ্চার কাঁথা শুকানোর জন্য পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহার করে।
– চট্টগ্রামে কি আর কোথাও গ্যাসক্ষেত্র নেই?
– আছে, কুতুবদিয়ায় আছে। তবে সেদিন একটা পত্রিকায় দেখলাম বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রচুর গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে কিন্তু সেসব তুলতে গেলে যা খরচ হবে তাতে পোষাবে না। গ্যাসের চেয়ে খরচই বেশি পড়বে। কিন্তু বিদেশে হলে এসবে এত খরচ পড়ত না। আমরা মুখে বলি দেশ ডিজিটাল হয়ে গেছে, বাস্তবতা অনেক দূর! তবে আফসোসের কিছু নেই, ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে একটা, তা থেকে ৭০০ বিলিয়ন ফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
– আমার মনে হয় চট্টগ্রামের আরও বহু জায়গায় এরকম গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যাবে! সাজ্জাদ বলল।
– পাওয়া যাবে মানে? অলরেডি পাওয়া গেছে না! আমরা যার কাছ থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছি।
– এখন আমরা কী করতে পারি?
– কদিন আগে থেকে ঐ পাহাড়ের পাশে কিছু লোক অস্থায়ী ঘর করে থাকা শুরু করেছে। আশপাশের লোকদের সাথে কথা বলে জানলাম, এরা এখানকার লোক নয়। হঠাৎ তারা ওখানে কেন ঘর করে থাকতে যাবে এ নিয়ে আমার মনে সন্দেহ জাগে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারা নাকি সরকারের লোক, পরীক্ষা করতে এসেছে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে তাদের আচরণ, কথাবার্তায় আমার তেমনটা মনে হয়নি।
– কেমন মনে হয়েছে? রনি বলল।
– মনে হয়েছে তারা ভিন্ন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। তার সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকতে পারে!
– কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কী?
– উদ্দেশ্য কী তা ক্লিয়ার নয়। ক্লিয়ার করার জন্যই তোমাদের কাজ করতে হবে, জেনে নিতে হবে যে তারা আসলে কী জন্য এখানে এসেছে।
– একটা সন্দেহ থেকেই কি আমরা এভাবে কারো বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতে পারি? তা ছাড়া তারা সরকারের লোক বলে পরিচয় দিয়েছে। সজীব বলল।
– তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা হলো ওরা গ্যাসক্ষেত্রের কোনও ধরনের ক্ষতির উদ্দেশ্যে এসেছে কি না। সেটা হলে আমাদের নিজেদের জন্য ক্ষতি, পুরো দেশের জন্য ক্ষতি। তাই এটা আমাদের জানা খুবই প্রয়োজন।
– কী করতে হবে বলেন, আমরা করব। রনি বলল। বাকিরাও মাথা নেড়ে রনির কথায় সম্মতি দিলো।
লোকটা বলল, তোমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে খবর নাও কী করতে চায় তারা। কী বলছে, কী করছে সব খবর নাও। এক ভাগে রনি ও সাজ্জাদ, আরেক ভাগে সজীব ও জয়নাল থাকবে। তবে তোমাদের গতিবিধি যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায়। তোমরা কালই কাজে নেমে পড়ো। কাল ঠিক এই সময়ে আমি এখানেও আসব। যতটুকু পারি আমিও নিজেও গোপনে খবর নেব।
আজ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, একটু পরেই মাগরিবের আজান দেবে। তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। ও হ্যাঁ, তোমাদের যে কারো মোবাইল নম্বরটা আমাকে দাও। নাম্বার নিয়ে লোকটা সাইকেলে উঠে প্যাডেল মারতে মারতে দূরে মিশে গেল, রনিরাও সন্ধ্যার আঁধারে আলো থেকে হারিয়ে গেল
৮.
রনির বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে ওর মা বলল, এত দেরি হলো যে, আবার কোথাও ব্যস্ত হয়ে পড়লি নাকি!
– আরে না, আজ থেকে সাজ্জাদ, জয়নালও স্কুলে আসা শুরু করেছে। তাদের সাথে কথা বলে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেল।
হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে আয় বলে রনির মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
চা খেয়ে নিজের রুমে গিয়ে চেয়ারে বসল। ভাবতে লাগল, লোকটা কী কাজে না আবার তাদের জড়িয়ে ফেলছে! কে জানে কী থেকে কী হয়! তবে লোকটাকে খারাপ মনে হয়নি। বাংলাদেশের গ্যাস ও গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে যা বলেছে রনি এতদিন তা জানতই না। লোকটার কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে আলোচনা শোনার পর কেমন যেন আগ্রহ জমে গেল! কিন্তু বড়ভাইয়ের থেকে সে এখনও আলাদা হয়ে যেতে পারেনি- এই দুশ্চিন্তাটাই তাকে গিলে খাচ্ছে। মাথার ওপর একটা বোঝা যেন এখনও রয়ে গেছে!
রনি ভাবল, না, এটা দ্রুত ঝেড়ে ফেলতে হবে। বড়ভাইয়ের সাথে একটা ফয়সালা করে ফেলতে হবে।
সাজ্জাদ, জয়নাল তার কথা রাখলেও সজীবকে এখনও বাগে আনা যায়নি। রনিকে সে ভালোবাসলেও বড়ভাইয়ের নুন খাওয়া ভুলতে পারছে না। তাকে যেকোনোভাবে বড়ভাইবিমুখ করতেই হবে।
ক্লাসের পড়া শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে যায়। বহুদিন পরে বই নিয়ে পড়তে বসেছে। এখনও অনেক কিছু জানার বাকি। সেই লোকটা যা যা বলেছে সব নতুন কথা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পড়লে, খবরাখবর রাখলে রনি নিজেও এসব জানতে পারতো। পড়া শেষে ভাত খেতে যায় সাড়ে দশটার দিকে। এরপর মোবাইলে কিছুক্ষণ গেম খেলে। তারপর ঘুমাতে যায়।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে রনি সোজা চলে গেল সাজ্জাদের বাড়িতে। তখনও তাদের বাড়ির দরজা খোলেনি। রনি জানালাটা খুলে ফিসফিস করে সাজ্জাদকে ডাকতে লাগল। সাজ্জাদ বেঘোর ঘুমে, রনির ডাক তার কানে পৌঁছছে না। অনেক ডাকার পরও যখন সাজ্জাদের ঘুম ভাঙেনি, রনি একটা লাঠি নিয়ে সাজ্জাদের পায়ে ঘষতে লাগল। একপর্যায়ে সাজ্জাদ জেগে চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় রনি বলে উঠল, চিল্লাবি না, আমি রনি, আমি রনি! তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়, কাজ আছে।
রনির কথায় আড়মোড়া ভেঙে দ্রুত বের হয়ে এলো সাজ্জাদ। রনি তাকে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল।
সাজ্জাদ বলল, কই যাচ্ছি?
– চল, গতকাল আঙ্কেল যে বলল, ওখানেই যাচ্ছি। সারাদিন তো সময় পাব না, তাই ভোরে রওনা দিতে হচ্ছে!
– কাল বলে রাখলেই পারতিস!
– স্যরি, ভুলে গিয়েছিলাম।
তারা দ্রুত হেঁটে মেইন রাস্তায় উঠল। তখনও লোকজনের আনাগোনা সরব হয়ে ওঠেনি। সূর্য উঠতে ঢের দেরি। গাড়ি চলাচলও বেশি না। তারা একটা সিএনজিতে উঠে পাশের ওয়ার্ডের বাজারে নেমে গেল। বাজার থেকে আঙ্কেলের দেওয়া নির্দেশনা মতো চলতে লাগল। হ্যাঁ, দূর থেকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটি অস্থায়ী ঘর।
ধীরে ধীরে তারা পাহাড়ের পথ বেয়ে একটু ভেতরে চলে গেল। দূর থেকে দেখতে লাগল ঘরগুলোতে লোকজনের আনাগোনা আছে কি না। আনাগোনা না দেখে তারা ঘরগুলোর দিকে যেতে লাগল। কাছে যেতেই দেখতে পেল সেই গ্যাসক্ষেত্রটা। তার অল্প দূরেই অস্থায়ী ঘরগুলো। এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি বাসিন্দারা। সাজ্জাদকে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে গেল রনি। চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল। সন্দেহ করার মতো তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। তা ছাড়া গ্যাসক্ষেত্রটা ঘরগুলো থেকে দূরেই আছে। অন্য কোনও পথ দিয়ে যাওয়ার রাস্তা আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটা জিনিস দেখল। পিলারের মতো একটা ধাতব দণ্ড মাটি থেকে খুঁড়ে বের করার চেষ্টা চলেছে। কাজ পুরোটা শেষ হয়নি, অর্ধেকে আটকে আছে। হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে কাজ শেষ করতে পারেনি। রনি ভাবছে, এই পিলার দিয়ে কী করবে? গ্যাসক্ষেত্রের ক্ষতি করতে কোনও বোমাটোমা পুঁতছে না তো! বোমার কথা মনে আসাতে নিজেও একটু ভয় খেয়ে গেল। আশপাশে আরেকবার তাকিয়ে সোজা সাজ্জাদের কাছে চলে এলো। সাজ্জাদকে সব বলতে বলতে পাহাড়ের পথ বেয়ে মূল রাস্তায় চলে এলো। সেখান থেকে সিএনজিতে করে বাড়ি পাশে পৌঁছে গেল। স্কুলে দেখা হবে বলে রনি চলে গেল, সাজ্জাদও তার বাড়ির দিকে চলে গেল।
আজ সজীবও স্কুলে এলো। সজীবকে দেখে বাকি তিন বন্ধুর চেহারার সজীবতাও যেন বেড়ে গেল! এমনিতেই স্কুলের পরিবেশটা দারুণ। স্কুলের চারপাশের সারি সারি মেহগনি গাছ লাগানো, মাঝখানে একটা-দুটা পাম গাছ। তার মাঝখানে স্কুলের সবুজ মাঠ। যেন ছবির মতো! এই স্কুলে এলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো। বিকেল হলে অনেকে স্কুল মাঠে বসে আড্ডা দেয়, সময় কাটায়। বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়। তারা ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করে, সন্ধ্যা হলে সবাই আবার বাড়ি ফেরে। শহরে হলেও এখানকার লোকদের বেশিরভাগই স্থানীয়।
ক্লাস শুরুর আগে সজীব ও জয়নালকে ডেকে রনি সকালের কথাগুলো বলল। শুনে সজীব বলল, বাহ, তোদের ডিউটি তাহলে সকাল সকাল শেষ করে এলি! আমাদেরটাই বাকি রয়ে গেল। কখন যাবি? স্কুল ছুটির পরে? জয়নালকে বলল সজীব।
– স্কুল ছুটির পরেই তো, আর সময় কই?
– না মানে, টিফিন ছুটিতে যদি কাজটা সেরে আসতে পারি, তাহলে স্কুল ছুটির পরে আঙ্কেলের সাথে বসে আলাপ করা যেত!
– ওহ হো, আঙ্কেল যে আসবে সে কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম!
রনি বলল, তা-ই কর। টিফিন আওয়ারে তোরা দেখে আয়, বেশি সময় লাগবে না।
টিফিন ছুটির বেল পড়তে না পড়তেই সজীব ও জয়নাল স্কুল থেকে দ্রুত বের হয়ে সোজা চলে গেল। দূর থেকে দেখতে পেল কিছুলোক কাজ করছে। মাটি খুঁড়ছে। পাহাড়ের পথ বেয়ে তারা অস্থায়ী ঘরগুলোর কাছাকাছি চলে গেল। কাছে যেতেই দেখল লোকগুলো খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করে দিয়ে তাদের দিকে আসছে। সজীব ও জয়নাল দু’জনই একটু ঘাবড়ে গেল, যদিও সেটা বুঝতে দিলো না তাদের। লোকগুলো কাছে এসে বলল, কী চাও তোমরা?
– কিছু না। জয়নাল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল।
– তো, এখানে কী?
– আপনারা এখানে কী করেন? সজীব বলল।
– তা কি তোমাদের বলতে হবে?
– না, বলতে হবে না। আর আমরাও এখানে কী জন্য এসেছি তাও আপনাদের জানতে হবে না!
– কী বলতে চাও?
– কিছু না। আমরা ঘুরছি। হঠাৎ আপনারা এসে প্রশ্ন শুরু করে দিলেন! আমরা কি ইন্টারভিউ দিতে আসছি নাকি?
ধুর, পাগল কোথাকার- বলে তারা আবার কাজে নেমে গেল, খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দিলো। যে খুঁড়ছে তার পাশেই দুটো ধাতব পিলার। দেখতে অনেকটা হিন্দুদের শিবলিঙ্গের মতো! ওদুটো দেখে সজীব বলল, জয়নাল দেখে রাখ। রনি এটার কথাই বলেছে।
জয়নাল বলল, হ্যাঁ, তা-ই তো দেখতে পাচ্ছি। চল, এখানে আর কাজ নেই। গ্যাসক্ষেত্রের যে কথাটা বলল তার কিছুই তো দেখতে পেলাম না। আঙ্কেলকে বললে উনি বুঝবেন। চল, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
স্কুলে যখন পৌঁছে তখন ক্লাস শুরু হয়ে পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে দেখে স্যার এখনও আসেননি। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো দু’জনে। তারা ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথে রনি ও সাজ্জাদও তাদের কাছে চলে এলো। সজীব সংক্ষেপে বলে দিলো যা যা দেখেছে।
স্কুল ছুটির পর গতকালের সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল রনিরা। তারা কথা বলছিল এমন সময় দূরে দেখা গেল সাইকেল চালিয়ে আঙ্কেল আসছেন। কাছে আসা পর্যন্ত তারা আঙ্কেল আসার দিকে তাকিয়ে রইল। সাইকেল থেকে নেমেই সবার কুশল জিজ্ঞেস করল, তার আগেই রনিরা সালাম জানাল হাসিমুখে।
সাইকেলটা একটা গাছে হেলান দিয়ে রেখে সবাই সবুজ ঘাসে বসে পড়ল। আঙ্কেল বললেন, কার কী অবস্থা? কী বুঝলে?
রনি তার দেখায় যা যা দেখল বলল। সজীবও তার দেখায় যা যা দেখল ও তাদের সাথে তার যে কথা হলো সেসব জানাল।
সব শুনে আঙ্কেল বললেন, তোমরা যে গুরুত্ব নিয়ে দায়িত্বটা পালন করেছো, প্রথমে তার জন্য ধন্যবাদ। দ্বিতীয়ত একটা কথা বলি, আমিও আমার মতো করে আবার পর্যবেক্ষণ করেছি জায়গাটা। প্রথমে গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে যে সন্দেহটা করেছিলাম এখন দেখছি সেটা নয়। এখানে অন্য ব্যাপার আছে।
– পিলার নিয়ে কী করবে ওরা? মাটি খুঁড়ে ওটা বের করছে কেন? সাজ্জাদ বলল।
– সেটাই মূলকথা। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এ ধরনের পিলার নিয়ে একশ্রেণীর প্রতারক নিয়মিত প্রতারণা করে যাচ্ছে। এই পিলারগুলোকে মহামূল্যবান ম্যাগনেটিক পিলার নাম দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছে যে, এই পিলারের আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক দাম!
– কিন্তু এই পিলার মাটির নিচে কেন? কারা পুঁতে রেখেছে?
– সেটাই তো আসল কাহিনি। এদেশে ব্রিটিশদের শাসনকালে সীমানা পিলারগুলো ফ্রিকোয়েন্সি অনুযায়ী একটি থেকে আরেকটির দুরত্ব মেপে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিলো। যেগুলোর মধ্যে পিতল, তামা, লোহা, টাইটেনিয়ামসহ ধাতব চুম্বকের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কারণে বজ্রপাত হবার সময়ে ইলেকট্রিক চার্জ তৈরি হয়। সেটি সরাসরি এই পিলারগুলো চুষে নেয়াতে আর্থিংয়ের কাজ করতো। এতে করে বজ্রপাত হতো কিন্তু মানুষ মারা যেতো না।
– এখন তো প্রতি বছর বজ্রপাতে সারাদেশে প্রচুর লোক মারা যায়! রনি বলল।
– হ্যাঁ। সীমান্ত পিলারগুলোর মধ্যে থাকা তামা পিতল, টাইটেনিয়াম জাতীয় ধাতবের সমন্বয়ে তৈরি বলে এগুলো বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। এতে করে বজ্রপাত হলে দ্রুত ইলেকট্রিক চার্জ হয়ে চুষে নিত। এখন যেহেতু এগুলো চুরি হচ্ছে, মাটি থেকে একশ্রেণীর লোক চুরি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তাই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। আগে কি বজ্রপাতে এত লোক মরার খবর পেতাম? পেতাম না।
– তক্ষক নিয়েও তো মানুষ কিছুদিন আগে এরকম প্রতারণা শুরু করে দিয়েছিল! জয়নাল বলল।
– হ্যাঁ। তক্ষক, যেটাকে আমরা স্থানীয় ভাষায় ‘টোট্টেং’ বলে থাকি। এটা নিয়েও কম প্রতারণা করেনি মানুষ। আড়াইশ গ্রামের একটা তক্ষক নাকি এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়! এরপর তক্ষক ধরার হিড়িক পড়ে যায়। কে কিনেছে, কে বিক্রি করেছে তার খবর নেই। শুনেছে লাখ টাকায় বিক্রি হয়, তারপর থেকে শুরু! কী এক কাণ্ড! হুজুগে বাঙালি লোকে এমনিতে বলে না! আচ্ছা, আমরা কাজের কথায় আসি। যেরকম ভয় পেয়েছিলাম সেরকমটা নয় ভেবেই ভালো লাগছে। তোমরা যদি পাশে থাকো তো ওদেরকে এই পিলারগুলোও নিয়ে যেতে দেবো না। এই পিলারগুলো ব্রিটিশেরা জেনেবুঝেই পুঁতেছিল, যাতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু না হয়।
– কিভাবে তাদের বাধা দিতে পারি?
– এক কাজ করি। আমরা তাদের ঘরের পাশে গিয়ে কাজগুলো দেখতে থাকব। তারা যদি আমাদের দেখতে না দেয় তো হইচই শুরু করে দেবো। এরপরে লোকজন জড়ো হলে সবাইকে জানিয়ে দেবো যে তারা এটা অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এটা টোটালই আমাদের দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
সিদ্ধান্ত হলো, বৃহস্পতিবার যেহেতু হাফ ছুটি, সেদিনই কাজটা করতে হবে। ছুটির পরপরই সেখানে চলে যাবে সবাই। কথা শেষ করে যে যার মতো চলে গেল সেদিনের মতো।
রনিদের চারজনকেই ডেকে পাঠাল বড়ভাই। ডাক পেয়ে রনিরা নিজেদের ভেতর কথা বলে নিল আগে। তারপর একসাথেই গেল বড়ভাইয়ের কাছে। তাদের দেখে বড়ভাই বলল, বাহ, চারজনই একসাথে এলে, দারুণ। তোমরা চারজন একসাথে থাকলে আমি আস্থা নিয়ে থাকতে পারি, নির্ভার থাকতে পারি। কিন্তু গত ক’দিন ধরে তোমরা আমার সাথে কোনও যোগাযোগ তো করছোই না, আমার করা কল পর্যন্ত রিসিভ করছো না! কারণ কী? তোমরা কি খুব ব্যস্ত?
– ব্যস্ত না। ইচ্ছে হচ্ছে না তাই করছি না। জয়নাল একটু রূঢ় স্বরেই বলল।
বড়ভাই বলল, জানি, তুমি আমার ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু তুমি এমন কাজ করেছো, এমন লোকের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছো, যার কারণে তোমার জন্য সুপারিশের উপায় ছিল না।
– আপনিই যদি আমাদের বাঁচাতে না পারেন তো আপনার কাজ করে কী লাভ!
– যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। রনি তোমাদের কী অবস্থা বলো…
– আছি, বেশ ভালোই আছি।
– ভালো আছো বলেই কি আমার ফোন রিসিভ করছো না?
– ঠিক সেটা নয়। সকালে স্কুলে যাই, বিকেলে ফিরি। সন্ধ্যার পর নিজের পড়াশোনা থাকে, তাই ফোনটা সারাদিন বন্ধ থাকে। রাতে কিছু সময়ের জন্য ব্যবহার করি। তাই পাচ্ছেন না।
– কিন্তু তোমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে আমার ব্যবসা তো লাটে উঠবে। এভাবে তো চলতে পারে না! এ মাসের দোকানের চাঁদাও এখনও তোলোনি, সেদিন ঢাকায় যেতে বলেছিলাম, তা-ও যাওনি, এভাবে তো চলতে পারে না!
– ক্ষমা করবেন বড়ভাই, আমি আর ওসব করতে পারব না।
– এভাবে বললে তো হবে না। আগে যেমনটা করেছো, সেভাবেই করতে হবে। নয়তো সমস্যায় পড়বে। সজীব, তুমিও তো ইদানীং যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছো! ব্যাপার কী?
– ভালো লাগছে না আর। সবাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত, ক্যারিয়ার ডেভেলপ কিভাবে করবে সেসব নিয়ে ব্যস্ত, আর আমরা কী সব করে বেড়াচ্ছি, যার কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না। তাই নতুন করে পড়াশোনায় মন দিয়েছি।
– হা হা হা! বাহ, জ্ঞানীদের মতো করে বললে! পড়াশোনা করে কী হবে? টাকা-ই তো কামাবে! টাকা ছাড়া কোনও দাম নেই। তোমার টাকা আছে তো সবাই তোমাকে সম্মান করবে, তোমার পেছন পেছন ঘুরবে। আর পড়াশোনা করে সেই কখন চাকরি হবে, টাকা কামাবে, টাকা জমাবে তার কোনও নিশ্চয়তা আছে? এখন থেকে টাকা কামানো শুরু করো, কাজে দেবে। শিগগির নেতা হতে পারবে!
– পড়াশোনা করে যদি কোনও কাজে না আসে তাহলে আপনার মেয়েকে কেন পড়ালেখা করাচ্ছেন? তাকেও স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। রনি ঠাট্টা মিশিয়ে বলল।
ঠিক সেটাই বড়ভাইয়ের গায়ে লাগল। তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার মেয়েকে নিয়ে কোনও কথা বলবে না, একদম জিভ কেটে ফেলব! কথা শিখেছো না? প্রশ্রয় দিয়েছি বলে মাথায় ওঠার চেষ্টা করো না।
– নামতেই তো চেষ্টা করছি, নামতে তো দিচ্ছেন না!
– হ্যাঁ, নামাবো, খুব শিগগির একেবারেই নামিয়ে দেবো। ক’টা দিন অপেক্ষা করো। সব শিয়ালের মুখে এখন একই রা!
বড়ভাইয়ের উত্তেজিত অবস্থা দেখে রনিরা সবাই একে একে বের হয়ে চলে এলো, তিনিও তাদের সাথে আর কথা বললেন না।
বৃহস্পতিবার এলো। স্কুল ছুটির পর ব্যাগগুলো দ্রুত রেখে এলো বাড়িতে। তারপর চারজন এক সাথে চলে গেল পাশের ওয়ার্ডের সেই জায়গাটাতে, যেখানে অস্থায়ী ঘর করেছে লোকগুলো। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন আঙ্কেল। তিনি রনি ও সজীবকে বললেন, তোমরা যাও, কথা বলা শুরু করো।
রনি ও সজীব পাহাড়ের পথ দিয়ে লোকগুলোর অস্থায়ী ঘরের কাছে চলে গেল। তাদের দেখে ঘর থেকে কয়েকটা লোক বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
– কিছু না, ঘুরছি। আপনারা কী চান?
লোকগুলো আর বাধা দিলো না। রনিরা ঘরগুলোর কাছে গিয়ে সব দেখতে লাগল। সেদিন যে কয়টা পিলার দেখেছিল, আজ দেখল তাতে আরও বেড়েছে। গুনে তেরোটি পিলার পেল। সজীব বলল, সেদিন একবার এসেছিলাম, চেহারা বোধ হয় ভুলে গেছেন! আচ্ছা বলুন তো, এসব পিলার দিয়ে কী করবেন? কোথা থেকে এসব পিলার নিয়ে এসেছেন?
– তা তোমাকে বলতে বাধ্য নই। তোমাদের আসতে দিয়েছি, ব্যস। দেখে চলে যাও।
– না, যাবো না। আপনাদেরও নিয়ে যাব।
– আমাদেরও নিয়ে যাবে মানে? কী বলছো এসব?
রনিরা আর দেরি না-করে চিৎকার শুরু করে দিলো, তাদের চিৎকার শুনে আঙ্কেলসহ জয়নালেরা আরও লোক নিয়ে হাজির। তারা এসে বলতে লাগল, কী হলো? কী হলো? তোমারা চিৎকার করছিলে কেন?
– দেখেন না আমরা ঘুরছিলাম এদিকে, কিন্তু এই লোকগুলো আমাদের ঘুরতে দিচ্ছে না!
আঙ্কেল বললেন, কেন? কেন? ঘুরতে দেবেন না কেন?
– ওরা আমাদের ঘরের দিকে যেতে চাচ্ছে, তাই।
– আপনাদের ঘর? আপনারা হঠাৎ এখানে ঘর তুলেছেন কেন? এটা কি আপনাদের জায়গা? আর এই যে পিলার দেখছি, এসব কোথা থেকে এনেছেন?
লোকগুলো চুপ মেরে গেল, কোনও জবাব তারা দিতে পারল না।
এরই মধ্যে রনিসহ বাকি লোকজন এসে তাদের ঘিরে ধরল। একসাথে এত লোক দেখে তারা ভড়কে গেল। আঙ্কেল বললেন, তোমরা এদেরকে ধরে রাখো, একটাকেও যেতে দেবে না। পুলিশকে খবর দেয়া আছে, আমি ফোন করে আসতে বলে দিয়েছি। কয়েকজন মিলে তাদের বেঁধে রাখল। ততক্ষণে আঙ্কেলসহ রনিরা লোকগুলোর অস্থায়ী ঘরগুলোতে ঢুকে পড়ল। ভেতরে গিয়ে দেখতে পেল ধাতব পিলারের স্তূপ। গুনে দেখল তাতে তেরোটি পিলার।
আঙ্কেল তাদের ঘরসমূহ তন্নতন্ন করে দেখল। আর কিছুই পাওয়া গেল না। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। এসেই আঙ্কেলকে হাত উঠিয়ে সালাম দিলো। রনিরা তো অবাক! পুলিশ সালাম দিচ্ছে আঙ্কেলকে!
এরই মধ্যে পুলিশ তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে জানল, এরা একটা প্রতারক চক্র। সারাদেশে এদের গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ব্রিটিশদের পুঁতে রাখা পিলারকে তারা ‘ম্যাগনেটিক পিলার’ বলে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে এরা।
পিলারগুলো জব্দ করে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল। ওদেরকে গাড়িতে তোলার পর আঙ্কেল পুলিশ অফিসারকে বলল, ওদের কাছ থেকে জেনে নেবেন যে, এই পিলারগুলো তারা কোন কোন জায়গা থেকে তুলে এনেছে। তারপর আপনার দায়িত্বে সেগুলো যেন একই জায়গায় পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। অনেক খুশি হবো। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনার অনুরোধ মতোই কাজ হবে, ভাববেন না। আপনিসহ এই ছেলেগুলোকে অনেক ধন্যবাদ, তাদের সহযোগিতায় এই প্রতারক চক্রকে ধরা সম্ভব হয়েছে। কথা শেষ করে তারা গাড়ি ছেড়ে দিলো। স্থানীয় লোকজনও যে যার মতো চলে গেল।
এতক্ষণ খেয়ালই করা হয়নি যে, জয়নাল নেই। জয়নালকে না দেখে আঙ্কেল বলল, ও কোথায়?ও কই গেল?
– তা-ই তো! কই গেল সে? সাজ্জাদ বলল।
তাদের কথা শেষ হতে না হতে দেখতে পেল জয়নাল পাহাড় থেকে নেমে এদিকেই আসছে।
কাছে এলে সজীব বলল, কই গিয়েছিলি?
জয়নাল ইশারায় হাতের দুই আঙুল দেখিয়ে বলল, দুই নাম্বার সারতে গিয়েছি!
জয়নালের এমন জবাব শুনে আঙ্কেলসহ সবাই হেসে উঠল।
আঙ্কেল তাদেরকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে চলে যাবে এমন সময় রনি বলল, আপনাকে পুলিশ সালাম দিলো কেন?
– আমি এক সময় পুলিশের ডিএসবিতে ছিলাম। তারা সেটা জানে। জানে বলতে, আমি তাদেরকে ইনফর্ম করার আগে আমার পরিচয় জানিয়ে রেখেছি, যেন কাজে গাফলতি না করে। তাই তারা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে।
– তা-ই বলেন! আমার প্রথমদিকেই সন্দেহ হয়েছিল! রনি বলল।
– কী সন্দেহ হয়েছিল?
– আপনি কোনও একটা গোয়েন্দা সংস্থায় আছেন- এমনটা বারবার মনে হচ্ছিল।
– ঠিক আছে, তবে কাউকে এই পরিচয় জানানোর প্রয়োজন নেই। যেকোনও ভালো কাজে আমাকে পাবে। আমার হেল্প লাগলে বলিও, যতটুকু সম্ভব করব। তোমরা সবাই ভালো থেকো, আমার জন্য দোয়া করবে।
আসসালামু আলাইকুম, আমাদের জন্যও দোয়া করবেন বলে আঙ্কেলকে বিদায় জানাল।
আঙ্কেলের অবয়ব ধীরে ধীরে দূরে মিলে গেলে রনি বলল, জয়নাল, তুই পাহাড়ের দিকে কী জন্য গিয়েছিলি?
জয়নাল এক গাল হেসে বলল, আর বলিস না। পুলিশগুলোকে দেখে লজ্জা লাগছিল। থানায় নেয়ার পর এরা আমাকে দেখেছিল। এখন যদি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করতো যে, তুমি এখানে? তখন আঙ্কেলের সামনে জবাব দেয়ার মতো কিছুই পেতাম না। তাই পুলিশ দেখে সরে পড়েছি। জয়নালের কথা শেষ হতে না হতেই সবাই একযোগে হো হো করে হেসে উঠল।
শনিবার। স্কুল ছুটি হয়েছে একটু আগে। রনির বোন বাড়ি ফেরেনি। চারদিকে শোনা যাচ্ছে রনির বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না। রনির কানেও এলো। স্কুল থেকে বাড়ির পথে ছিল সে। দেরি না করে দ্রুত হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা শোনার সাথে সাথে বড়ভাইয়ের চেহারা ভেসে উঠল তার মনে। বাড়িতে পৌঁছে দেখে আসলেই তার বোন স্কুল থেকে আর ফেরেনি। রনির একটু আগে তার ছুটি হয়, সে হিসাবে আরও আগে বাড়ি পৌঁছার কথা। সজীবকে কল দিলো রনি। সজীব রিসিভ করলে বলল, বোনকে তো আবার পাওয়া যাচ্ছে না!
– বলিস কী!
– হ্যাঁ। স্কুল থেকে এখনও বাড়ি ফেরেনি। বাবাও স্কুলে। এদিকে মা তো কেঁদেকেটেই অস্থির। এখন কী করব?
– কেউ কি আবার অপহরণ করেছে? তোর কী মনে হচ্ছে?
– সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে অপহরণই করা হয়েছে। জাস্ট আমাকে বাগে আনার জন্য।
সজীব বলল, এখন কী করবি?
– তুই আমার বাড়িতে আসতে পারবি?
– হ্যাঁ, আসছি…
– সাথে করে জয়নালকেও নিয়ে আসবি।
আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিলো সজীব।
অল্প সময়ের মধ্যে সজীব ও জয়নাল চলে এলো, সাজ্জাদকে তার আগে ডেকে এনেছে রনি। তার মন ভালো নেই। বোনকে হারিয়ে কেমন যেন হয়ে গেছে, চেহারায় তার ছাপ স্পষ্ট।
রনিদের ঘরের একটা রুমে গিয়ে বসল চারজনই। রনি বলল, কী করা যায়? বড়ভাইয়ের কাছে যাবো?
জয়নাল বলল, মাথা খারাপ! প্রশ্নই আসে না!
– তাহলে? রনি হতাশামাখা কণ্ঠে বলল।
– জয়নাল, ব্যাপারটা তুই বুঝতে পারছিস না। ওটা রনির বোন। রনিই বুঝবে বোন হারানোর অনুভূতি! এখন রাগ দেখানোর সময় না। সাজ্জাদ বলল। সজীবও তাতে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
জয়নাল বলল, ব্যাপার তা না। শোন, তোদের একটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি, দেখবি ঠিকই রনির বোনকে ফেরত দিয়ে গেছে!
এটা শুনেই রনির চেহারায় ঔজ্জ্বল্য দেখা গেল। চারজনই দ্রুত বের হবে এমন সময় রনির বাবা ঘরে ঢুকল। তিনিও শুনেছেন, ঘরে ঢুকেই তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। রনির মায়ের কান্না থামছেই না। রাগ থেকে রনিকে বলল, তোর কারণেই আমার মেয়েটাকে বারবার ওরা গুম করে ফেলছে, শুধু তোর কারণেই।
সজীব বলল, আন্টি, একটু শান্ত হোন। আমরা খুব দ্রুত ওকে ফেরানোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। দোয়া করবেন শুধু।
রনির মা আর কিছু বলল না।
দুটো বাইক নিয়ে চারজনই বেরিয়ে পড়ল। তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। পাখিদের কূজন থেমে গেছে। রনিরা ভেতরের একটা রাস্তা ধরে বড়ভাইয়ের বাড়ির দিকে চলে গেল। কাছাকাছি গিয়ে বাইক থামাল। বাইক রেখে সজীব ও জয়নাল চলে গেল বড়ভাইয়ের বাড়ির দরজার পাশে। এমন সময় বাইক নিয়ে বড়ভাইয়ের ঘরের সামনে গিয়ে বারবার হর্ন বাজাতে লাগল রনি। হর্ন শুনে বড়ভাইয়ের মেয়ে দরজা খুলতেই সজীব ও জয়নাল তার মুখ চেপে ধরে দ্রুত নিয়ে এলো। বাইকে মাঝখানে তাকে বসিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল তারা, পেছন পেছন রনি ও সাজ্জাদ।
স্কুলের পেছনে একটা পুরাতন পরিত্যক্ত বিল্ডিং আছে, রনিদের আড্ডার স্থান ছিল এটা। সেখানেই নিয়ে গেল বড়ভাইয়ের মেয়ে রাইমাকে। সে এখনও ছোট, সবে ক্লাস ফোরে পড়ে। তাকে বলল, ভয় পেয়ো না। তোমাকে আমরা কিচ্ছু করব না। তোমার আব্বু রনির বোনকে ধরে নিয়ে গেছে, তাই তোমাকে আমরা ধরে এনেছি। যেন তোমার আব্বু রনির বোনকে ছেড়ে দেয়।
রাইমার কান্না থামছে না। সে খুব বেশি ভয় পেয়ে বলতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দেন, অন্ধকারে আমার ভয় করছে, আমি বাড়ি যাবো।
রনি বলল, একটু পরেই তোমাকে আমরা বাড়ি দিয়ে আসব, ভয় পেয়ো না। আগে তোমার আব্বুর সাথে কথা বলে নিই।
রনি কল দিলো বড়ভাইকে। তিনি রিসিভ করেই বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল না! এত দেরিতে কল দিচ্ছো যে!
– একটা কাজে গিয়েছি, সেখান থেকে একটা চিকেন ধরতে সময় গেছে তো, তাই দেরি হলো!
– চিকেন মানে?
– চিকেন মানে চিকেন!
– কী বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো। তোমার বোনের প্রতি কি তোমার কোনও টান নেই?
– কেন থাকবে না। বোনের জন্যই তো এতসব কাজ করছি!
– হুম, সব কাজ যখন করছো, আমার কাজও আগের মতো করো, বোনকে ফেরত পাবে।
– যদি বলি করব না, তখন?
– তখন আর কী হবে? একটা মাত্র বোনটাকে হারাবে!
– হাহা হা! আর আপনি কী হারাবেন চিন্তা করেছেন?
– চিন্তার কিছু নেই। তোমাদের মতো পোষ্য কুকুর টাকা দিলে অহরহ পাবো!
– সে পাবেন। কিন্তু মেয়ে গেলে তো মেয়ে পাবেন না! রনি বলল।
– কী বলতে চাও?
– বলতে চাই, আমার বোন যেমন আপনার কাছে জিম্মি, তেমনি আপনার মেয়েও আমার কাছে জিম্মি!
– কী!
– হ্যাঁ, একদম। কাঁটা দিয়ে কাঁটা না-তুলে উপায় ছিল না।
– কাজটা ঠিক করোনি!
– আপনার কাজটা কি ঠিক করেছেন? রক্ত তো রক্তই! কারো বোন, কারো-বা সন্তান- এই তো!
– কী চাও তুমি?
– কিচ্ছু না। বোনকে বাড়িতে পৌঁছে দেন, আমি রাইমাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবো। এসব করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। মন থেকে এসব তাড়িয়ে দিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে থেকে। শুধু আমি নই, সাজ্জাদ, জয়নাল, সজীবও আছে।
– ও, সব শিয়াল একই সুরে হুক্কাহুয়া গাইছো!
– বেশি কথা বলে ফেলছেন। মাত্র আধাঘণ্টা সময় দিলাম, বোনকে আমাদের ঘরে পৌঁছে দেন। তাকে পৌঁছানোর পরে রাইমাকে পৌঁছে দেবো। আর কথা দিতে হবে আমার বোনকে নিয়ে সামনে আর কোনওদিন এমন কাজ করবেন না! সাথে সাথে রনি ফোনটা রাইমার মুখের কাছে দিয়ে বলল, তোমার আব্বুর সাথে কথা বলো। রাইমা কান্নার সুরে বলল, আব্বু আমাকে নিয়ে যান, এখানে খুব অন্ধকার। ওর বোনকে আপনি ছেড়ে দেন, নইলে ওরা আমাকে ছাড়বে না। অন্ধকারে আমার আর ভালো লাগছে না।
মেয়ের কান্না দেখে বড়ভাই আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, মা, একটু অপেক্ষা করো, ওরা তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
এরপর রনিকে বলল, ঠিক আছে, তোমার কথা মেনে নিলাম। তোমার বোনকে ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি আমার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো।
রনি বলল, আগে আমার বোনকে বাড়িতে পৌঁছান, তারপর।
মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে রনির বোনকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলো। সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর রনি রাইমাকে নিয়ে থানায় চলে গেল। বৃহস্পতিবার যে পুলিশ অফিসারের সাথে রনিদের আলাপ ও পরিচয় হয়েছিল তার কাছে গিয়ে রনি বলল, এই মেয়েটাকে রাস্তায় পেয়েছি, খুব কাঁদছে। আপনারা ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করলে খুশি হবো। মেয়ের কাছ থেকে ওর বাবার নাম্বারটা নিয়ে পুলিশ ফোন দিলো। রাইমার আব্বু কল রিসিভ করে জানল, তার মেয়ে থানায়। রনিদের চালাকিটা তখন বুঝতে পারল।
তিনি দ্রুত থানায় যান। সেখানে দেখে রনিরা সবাইকে। বড়ভাইয়ের চেহারা তখন রাগে লাল হয়ে আছে। পুলিশের কাছ থেকে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে বড়ভাই বললেন, স্যার, ওরা আমার মেয়েকে অপহরণ করতে চেয়েছিল?
– বলছেন কী? ওরাই তো থানায় নিয়ে এলো মেয়েটাকে!
– না, না, ওরা অপহরণ করতে পারেনি তাই থানায় এসে সাধু সাজার চেষ্টা করছে!
পুলিশ অফিসার বললেন, রনি, ওনার কথা কি ঠিক?
রনির জবাব দেয়ার আগেই রাইমা বলল, হ্যাঁ, ওরাই আমাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে এসেছে!
রাইমার কথায় পুলিশ দ্বিধায় পড়ে গেল!
বড়ভাই বললেন, দেখেছেন? বাচ্চা মেয়ে মিথ্যে বলে না। ওরা অপহরণ করতে চেয়েছিল আমার মেয়েকে!
এবার রনি জবাব দিলো। বলল, স্যার, রাইমা ও তার বাবার কথা আংশিক সত্য, পুরোটা নয়। রাইমাকে কেন ধরে এনেছে তার পুরোটা বিবরণ পুলিশ অফিসারকে দিলো রনি।
মাঝখানে বড়ভাই বলল, ও সব মিথ্যে বলছে।
রনি বলল, মিথ্যে হবে কেন? আপনার আর আমার ফোন আলাপের সব আমি রেকর্ড করে রেখেছি, তাই মিথ্যে বলে পার পাবেন না।
তার কথা শেষ হলে রাইমা বলল, হ্যাঁ, আব্বু ওর বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আগে, সে জন্যই ওরা আমাকে ধরে এনেছে, যেন ওর বোনকে ছেড়ে দেয়।
রাইমার মুখে এমন কথা শুনে বড়ভাই ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন।
পুলিশ অফিসার বললেন, তাহলে তো ঘটনার মূলহোতা আপনি, আপনিই ওদের ঐ কাজে বাধ্য করেছেন। এমনিতেই তো থানায় আপনার নামে অনেক মামলা। রনিরা একটা জিডি করেছে আপনাকে সন্দেহভাজন রেখে, সেই জিডি মতে আপনাকে গ্রেফতার করতে পারি এখন।
রনি বলল, স্যার, আমার বোনকে অপহরণে অভিযোগে ওনাকে গ্রেফতার করুন।
বড়ভাই হতবাক হয়ে গেল। অপহরণ মামলায় ফেঁসে গেলে বড্ড ঝামেলা হবে। ফোনালাপের সব রেকর্ড রনির কাছে আছে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট। তিনি কী করবেন ভাবতে পারছেন না। তবুও বললেন, বিষয়টার তো সুরাহা হয়ে গেছে!
– কই সুরাহা হয়েছে? উত্তেজিত হয়ে জয়নাল বলল। বড়ভাইয়ের প্রতি তার রাগ এখনও কমেনি!
– কেন? রনি তার বোনকে পেয়ে গেছে আর রাইমাকেও আমি পেয়ে গেছি!
– জি না। আপনার কথার কোনও বিশ্বাস নেই! কাল যে এর প্রতিশোধ নেবেন না তার কী বিশ্বাস? সাজ্জাদ বলল।
তার কথা শেষ হতেই সজীব বলল, ক’দিন আগেও তো একবার রনির বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, আপনাকে কে বিশ্বাস করবে? স্যার, ওনাকে গ্রেফতার করুন। আর রাইমাকে আমাদের দিন, আমরাই ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবো!
বড়ভাই ফোন হাতে নিয়ে কল করতে যাবে এমন সময় রনি মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলল, নেতাকে ফোন করতে হবে না, তিনি কিছুই করতে পারবেন না। আপনাকে একটা শর্ত দিচ্ছি, সেটা মেনে নেন, আমি জিডি তুলে নেব।
পুলিশ অফিসার তাদের কথোপকথন শুনে যেতে লাগল।
বড়ভাই বললেন, কী শর্ত?
রনি বলল, আমরা এতদিন আপনার হয়ে অনেক অপকর্ম করেছি, ঠিকমতো পড়ালেখা করিনি, বাবা-মা’র কথা শুনিনি, রাস্তায় টিজ করেছি, চাঁদাবাজি করেছি। আমরা ভালো হয়ে যেতে চাচ্ছি, কিন্তু আপনি আমাদের বারবার আটকে দিচ্ছেন, ভালো হতে দিচ্ছেন না। যার সর্বশেষ উদাহরণ আমার বোনকে অপহরণ এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহ। কিন্তু এখন আমার শর্ত হচ্ছে, আপনি আমাদের এসব খারাপ কাজে আর বাধ্য করবেন না বলে তিন শ টাকার স্ট্যাম্পে সই করতে হবে। এটা করলে পরে আপনার বিরুদ্ধে করা জিডি তুলে নেবো, নইলে নয়।
পুলিশ অফিসার বড়ভাইকে বললেন, কী বলেন? আপনি রাজি?
বড়ভাইয়ের চুপ থাকা দেখে রাইমা বলল, আব্বু রাজি হয়ে যাও, নইলে ওরা আবার আমায় অন্ধকার ঘরে নিয়ে আটকে রাখবে।
রনি বলল, রাইমা, তোমাকে আমরা এতটা অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু তোমার আব্বু আমাদেরকে সারা জীবনের জন্য একটা অন্ধকার জগতে আটকে রাখতে চাচ্ছে। তুমি কী বলো? আমরা কি অন্ধকার জগতে আটকে থাকব?
– না, আব্বু সই করবে। আমিও আর অন্ধকার ঘরে যাব না, আপনারাও অন্ধকার জগতে পড়ে থাকবেন না।
পুলিশ অফিসার বড়ভাইকে বললেন, দেখেন, আপনার ছোট্ট মেয়েটি পর্যন্ত অন্ধকারে থাকতে চায় না। আলোর পথ বাচ্চারাও চেনে, কেবল আপনারাই চিনতে চান না।