আমাদের ঘোরাঘুরির অভ্যাসটা অনেকটা পুরনো। আমাদের বলতে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে। ঘোরাঘুরির জায়গার মধ্যে অবশ্যই তা নতুন ও আকর্ষণীয় হওয়া চাই। এক জায়গায় বার বার যেতে তেমন ভালো লাগে না। তবে তা মনোরম আকর্ষণীয় পরিবেশ হলে ভিন্ন কথা। দূরে কোথাও না যেতে পারলেও বাড়ির আশপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রতিদিন বিকালে যাওয়া হয়। তাতে কতোটা তৃপ্তি কাজ করে তা না বুঝলেও এটা ঠিক বুঝতে পারি একেবারে মন্দ লাগে না। ঘোরাঘুরির অভ্যাসকে কেন্দ্র করেই একদিন হঠাৎ করে চলে গেলাম বন্ধুর বরই বাগানে, সাথে আরেক বন্ধু হালিম। বরই বাগান বলতে, তার বাবা ব্যবসায় করে বলে বাড়ি থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি চরের মধ্যে বরই বাগান কিনে রেখেছে। চার পাশে পানি আর পানি মধ্যে চর জেগে উঠেছে সেখানে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বরইসহ নানান ধরনের সবজির চাষ হয়। চরটির লম্বায় প্রায় ৩ কিলোমিটারের ওপরে। সেখানে যাওয়ার জন্য তেমন কোনো সড়ক না থাকলেও ছোটো বা বড়ো নৌকা দিয়ে খুব সহজে যাওয়া যায়। দূর থেকে কেউ দেখলে মনে করবে একটি টাইটানিক জাহাজ ভেসে আছে আর তার বুকে সবুজে সবুজে খেলা করছে। এই চরটির নাম দিয়েছে মাঝের চর বা মাইঝ্যার চর আবার কেউ কেউ ধাঁধার চর বলেও জানে। আমি অনেক বার চরটির নাম শুনেছি ও পত্রিকাতে নিউজ দেখেছি কিন্তু যাওয়ার মতো তেমন সুযোগ হয়নি। সে সূত্র ধরেই হোক আর অন্য কিছুই হোক আমি ও হালিম একদিন প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম কাপাসিয়ার রানিগঞ্জ বাজারে। সেখান থেকে সামনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো পানি আর পানি। নদীর তীরে কয়েকটি ছোট ডিঙ্গি নৌকাসহ মাঝি বসে আছে। আমি ও হালিম কাছে গিয়ে বললাম দাদা ধাঁধার চর যাবেন? আমাদের কথা শুনে সবগুলো মাঝি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় আমাদের উপস্থাপনাটাই ছিলো অদ্ভুত ধরনের বা বড়ো ধরনের কোনো অন্যায় করে ফেলেছি। কারও মুখে কোনো কথা নেই। এর মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো ‘সেখানে যাওয়া তো নিষেধ।’ আমি অনেকটা চমকে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু কেন? এবার উনি বর্ণনা শুরু করলেন। কয়েকদিন আগে ওখানে নাকি এক লোককে খুন করা হয়েছিলো। তাই থানা থেকে ওখানে যেতে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। আরো কতো কী! ওনার কথা শুনে আমি আনন্দের পরশ গুটিয়ে অনেকটা ভয় পেতে শুরু করলাম। কথার মধ্য দিয়ে এক মাঝি বলে উঠলো, আমি যাবো। ওনার কথা শুনে আমরা নৌকায় উঠে বসলাম। এবার উনি বলছেন আগে বলে নেয়া ভালো। ভাড়া দিতে হবে পাঁচশো টাকা। আমি ও হালিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন, কেন? এতো ভাড়া কেন? এখানেই তো, ওই যে দেখা যায়। উনার এক কথা সব দায় দায়িত্ব উনার নিজের, সব ঘুরে দেখাবেন উনি। তাই টাকার পরিমাণ একটু বেশি। মাঝির সাথে কথা বলতে বলতে চর থেকে ফোন দিলো কাউছার। কাউছার হচ্ছে আরেকজন বন্ধু যাকে উদ্দেশ্য করে আজকে এখানে আসা। সে চরের মধ্যে তার ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত তবু সবকিছু খুলে বললাম তাকে। সে তো আমার কথা শুনে পুরোপুরি অবাক। বাধ্য হয়ে তার কাজ ফেলে নৌকা নিয়ে আমাদেরকে নিতে সে নদীর তীরে এলো। ভেতরে ঢুকতেই সবুজ আর সবুজ গাছপালা। চরের মধ্যে যখন চলে গেলাম তখন বুঝাই মুশকিল চরে আছি না কি অন্য কোথাও আছি। কারণ চারদিকে শুধু গাছ ও সবজি ক্ষেত, যার কারণে কোনো পাশের পানিই চোখে পড়ে না। চরের দুই পাশ দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজির ক্ষেত। মধ্য দিয়ে রয়েছে কলা বাগান, লেবু বাগান, পেয়ারা বাগান, বরই বাগানসহ নানান ধরনের গাছ। প্রকৃতিকে ভালোবাসে এমন মানসিকতা যাদের মাঝে রয়েছে তাদের ঘোরার জন্য ধাঁধার চর হচ্ছে একটি উপযোগী জায়গা। বরই বাগান থেকে নিজের হাতে বরই ছিঁড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। ছোটো ছোটো বরই গাছ, মাটিতে দাঁড়িয়েই নিজের ইচ্ছা মতো বরই ছেঁড়া যায়। আমি ও হালিম বরই ছিঁড়ে নিজের প্যান্ট ও শার্টের সব ক’টি পকেট বরই দিয়ে ভরে নিলাম। এখন হাঁটছি আর বরই খাচ্ছি। কাউছার চর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। হঠাৎ সে বলছে রাতে নাকি চরের মাটি কাঁপে ও অদ্ভুত রকমের কিছু শব্দ করে। তার কথা শুনে নিজের অজান্তেই মনের ভিতরে একটা ভয়ঙ্কর অনুভূতির সৃষ্টি হতে লাগলো। অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ধাঁধার চরে একটি রাত কাটাবো। আমার কথার পক্ষে তাদের দু’জনের কারও মত নেই। তার সবচাইতে বড়ো কারণ হচ্ছে রাতে অদ্ভুত কিছু ভয়ঙ্কর আওয়াজ এবং চরের মধ্যে কোনো ঘর-বাড়ি নেই যার ফলে বিদ্যুৎও নেই। তাদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাত কাটানোর পরিকল্পনা বাদ দিলাম, তবে আমরা বনভোজন করতে চাই। বনভোজনের পরিকল্পনা সকলের মতের পক্ষে বলে তারিখও নির্ধারণ করে ফেললাম।
আমাদের গ্রাম থেকে বনভোজনের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার হলো, পাতিল ও মসলাও নেয়া হলো। চরে পৌঁছানোর জন্য পরিবহন হিসেবে ঠিক করলাম পিকআপ। এই খোলামেলা পরিবহনটি ঠিক করার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তভাবে হইহোল্লা করা। হালিম খান, কাউছার, জুয়েল, আলমগীর, মাসুদ, মুকদাদুল, জাহিদুলসহ আমরা প্রায় পনেরো জন বনভোজনের জন্য যাত্রা শুরু করলাম। নদীর তীরে পৌঁছে কাউছারের ছোটো নৌকা দিয়ে দু’বারে আমরা নদী পার হলাম। সব জিনিসপত্র গুছিয়ে একেক জন এককে কাজ করে ইট বসিয়ে রান্না বসিয়ে দিলাম। কেউ রান্না করছে, কেউ বসে গল্প করছে আবার কেউ মাদুরের ওপর শুয়ে আছে।
ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক একটা তখন দল বেঁধে আমরা সকলে নদীতে গেলাম গোসল করার জন্য। কেউ সাঁতার কাটে, কেউ ডুব দেয় আবার কেউ এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে। গোসল করার সময়গুলো ক্যামেরায় বন্দি করে রেখেছে জুয়েল। গোসল শেষে সবাই এক সাথে খেতে বসলাম। একটি বনের ভেতরে বসে খেতে অন্যরকম লাগলেও মজা কিন্তু কোন অংশে কম নয়। সবাই সবার মতো পেট পুরে খেলাম। খাওয়ার পর কয়েক মিনিট সকলে বসে গল্প শেষে ঘুরতে বের হয়ে গেলাম। আমরা অবস্থান করেছিলাম চরের মাঝামাঝি অংশে। প্রথমে আমরা উত্তর দিকে গেলাম তারপর দক্ষিণ দিকে গেলাম। সকলে দল বেঁধে হাঁটছি আর আশপাশের সকল পেয়ারা গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। যখনই চোখে পেয়ারা পড়ছে তখন সকলে লাফিয়ে গাছে উঠে পেয়ারা ছিঁড়ে আনছে আবার কেউ কেউ নিচ থেকেই ঢিল ছুঁড়ে মারছে। এভাবেই পুরো চর ঘোরার পর যখন বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো তখন আমরা সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা শুরু করলাম।

Share.

মন্তব্য করুন