ফুটবল গোলের খেলা। আর গোল করতেই যেন সবচেয়ে পছন্দ করেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। স্পেনের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে একের পর এক ম্যাচে দর্শকদের মাতিয়ে চলছেন। ১৫ বছর ধরে বিশ্ব ফুটবলে দাপটের সাথে বিচরণ করছেন এই ফরোয়ার্ড। অথচ এক সময় অসুখের কারণে যার খেলাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো। সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে রোনালদো ফিরেছেন বিশ্ব ফুটবলকে নেতৃত্ব দিতে। পায়ের জাদুতে কোটি দর্শকের ঘুম কেড়ে নেয়া রোনালদো যেন প্রতিপক্ষের গোল রক্ষকদের জন্য আতঙ্ক। গোল করার স্বভাবজাত দক্ষতা আর ক্ষিপ্রগতি তাকে বানিয়েছে মহাতারকা। জাতীয় দল কিংবা ক্লাব সবখানেই সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় নামটি তার।
১৯৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্তুগালের মাদেরিয়া দ্বীপে জন্ম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নামের সাথে মিলিয়ে পুত্রের নাম রাখেন রোনালদোর বাবা-মা। বাবা জোসে দিনিস আভেইরো পেশায় ছিলেন মালী। অবসরে কাজ করতেন একটি ফুটবল দলের কর্মচারী হিসেবে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া রোনালদো সাত বছর বয়সে খেলতে শুরু করেন সেই ক্লাবেই। স্থানীয় অপেশাদার ক্লাবটির নাম অ্যান্দোরিনহা। এরপর দুই বছর খেলেন ন্যাশিওনাল নামের একটি ক্লাবে। এখানে নজর কাড়েন সকলের। ১২ বছর বয়সে স্পোর্টিং সিপি দলে যোগ দেন দেড় হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড ফিতে।
শৈশব থেকেই পড়াশুনার চেয়ে ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিলো বেশি। ১৪ বছর বয়সে শিক্ষকের সাথে বেয়াদবির কারণে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় রোনালদোকে। লেখাপড়া সেখানেই শেষ। পরিবারের সম্মতি নিয়ে আধা পেশাদার ফুটবল খেলতে শুরু করেন রোনালদো। তবে ১৫ বছর বয়সের সময় ধরা পড়ে জটিল একটি অসুখ যাকে বলা হয় রেসিং হার্ট- অর্থাৎ হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। জটিল এক অপারেশন করা হয় তার হৃদপিন্ডে। কেউ ভাবতে পারেনি ছেলেটি আবার ফুটবল মাঠে ফিরতে পারবে; কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো, ছিলো রোনালদোর অদম্য মনোবল। পুরো সুস্থ হয়েই তিনি আবার মাঠে ফেরেন। যুব দল হয়ে দ্রুত জায়গা করে নেন স্পোর্টিং সিপি ক্লাবের মূল দলে। এই দলটির হয়ে ২০০৩ সালে বিখ্যাত ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে একটি প্রীতিম্যাচ খেলে ক্লাবটির বিখ্যাত কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের নজরে পড়েন এই তরুণ। মাত্র এক ম্যাচ দেখেই ফার্গুসন বুঝেছিলেন যে এটি একটি রত্ন, এক কোটি ২২ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে তাকে কিনে নেয় ম্যানইউ। রোনালদোর বয়স তখন ১৮ বছর। এরই মধ্যে পর্তুগালের যুব দল, অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে জায়গা করে নেন জাতীয় দলেও। সেখানেও রোনালদো সান্নিধ্য পেয়েছেন তখনকার বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড়ো তারকা লুইস ফিগোর।
ম্যানইউতে অ্যালেক্স ফার্গুসনের তত্ত্বাবধানে দারুণ সময় কাটতে থাকে রোনালদোর। শুধু কোচ নয়, একজন অভিভাবক হিসেবে ফার্গুসনকে পান তিনি। তার ছায়ায় বিচ্ছুরিত হতে থাকে প্রতিভা। এনে দিতে থাকেন একের পর এক শিরোপা। ক্লাবটিকে টানা তিনটি প্রিমিয়ার লিগ ও একটি করে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ক্লাব বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সে প্রথমবার জিতেছেন বিশ্বসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ফিফা ব্যালন ডি অ’র। ২০০৯ সালে রেকর্ড আট কোটি পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রায় ৮০ হাজার সমর্থক এসেছিলো ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে স্বাগত জানানোর জন্য। ২৫ বছর আগে নাপোলিতে ম্যারাডোনাকে স্বাগত জানাতে আসা ৭৫ হাজার সমর্থকের রেকর্ডও ভাঙে সেদিন।
রিয়ালে এসে যেন ফুটবল বিশ্বে আবির্ভূত হন অন্য এক রোনালদো হিসেবে। ফরোয়ার্ড রোনালদো পরিণত হন রীতিমতো গোলমেশিনে। এ সময় তার স্কোরিং দক্ষতাই তাকে বিশ্বসেরা ফুটবলারদের ছোট্ট তালিকায় স্থান করে দেয়। রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়ে দলটিকে এনে দিয়েছেন ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ২টি স্প্যানিশ লা লিগা, ২টি কোপা ডেল রে, ২টি উয়েফা সুপার কাপ এবং ৩টি ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দলের হয়ে ২৫টি শিরোপা জিতেছেন এই সুপারস্টার। ৭ নম্বর জার্সি পরেন বিধায় ভক্তরা ভালোবেসে ডাকে- সিআর সেভেন। এক সময় শিরোপা খরায় ভুগতে থাকা ক্লাবটিকে আবার সেরার মর্যাদা এনে দিয়েছেন তিনি।
মেসির সাথে তার দ্বৈরথ বেশ জমজমাট কয়েক বছর ধরে। কখনো মেসি এগিয়ে যান তো, পরের ম্যাচেই রোনালদো। এক ম্যাচে মেসি হ্যাটট্রিক করেন তো পরের ম্যাচেই তিনি। অনেক বছর ধরেই এই দু’জনের মধ্যে কে সেরা সেটি নিয়ে বিতর্ক চলছে। জিতেছেন মেসির সমান ৫টি ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার (২০০৮, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭)। স্পেনের পেশাদার ফুটবল লিগ লা লিগায় রেকর্ড ৩৪টি হ্যাটট্রিক আছে রোনালদোর। টানা ছয় মৌসুমে গোল করেছেন ৩০ কিংবা তার বেশি। রিয়াল মাদ্রিদের সর্বকালের সেরা গোলদাতার রেকর্ড ইতোমধ্যেই নিজের করে নিয়েছেন। পর্তুগালের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডও তার দখলে। বল নিয়ে দ্রুত গতিতে ঢুকে পড়েন প্রতিপক্ষের ডি বক্সে। গতিময় ডজে বোকা বানান প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের। আর এরপর বুলেট গতির শট আশ্রয় নেয় জালে। জাতীয় দলের হয়ে ১৪১ ম্যাচে ৮১টি গোল তার। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭৫২ ম্যাচে গোল ৫৬৬টি। যার মধ্যে ২৮৮টি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে (৩০৭ ম্যাচে)।
ক্লাবের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও রোনালদোর সাফল্য কম নয়। ২০০৮ সাল থেকে অধিনায়কত্ব করছেন জাতীয় দলের। ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য ইউরো জেতা। পর্তুগালকে ২০১৬ সালে চ্যাম্পিয়ন করেছেন ইউরোপ মহাদেশের ফুটবল আসর ইউরোতে। ফাইনালে মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়লেও তার সতীর্থরা শেষ পর্যন্ত শিরোপা নিয়েই মাঠ ছেড়েছে। এর আগে ২০০৪ সালের ইউরোর ফাইনাল খেলা দলেও ছিলেন তিনি। আর এই জায়গাটিতেই তিনি লিওনেল মেসির চেয়ে এগিয়ে আছেন। ক্লাব ফুটবলের সাফল্যে রোনালদোর চেয়ে এগিয়ে থাকলেও জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত কোনো শিরোপা জিততে পারেননি মেসি।
দুর্দান্ত ফর্মে থেকেই রাশিয়া বিশ্বকাপে পা রাখছেন রোনালদো। পর্তুগাল দল হিসেবে কখনোই বিশ্বকাপের ফেভারিটদের তালিকায় থাকে না। তবে গত ইউরো জয়ই প্রমাণ করে দলটির সামর্থ্য আছে। আর রোনালদোর মতো তারকা যে দলে আছে তাদের শিরোপার দৌড় থেকে একেবারে ঝেড়েও ফেলা যাবে না। দেশ ও ভক্তরাও মুখিয়ে আছে বিশ্বকাপে এই তারকার সেরা নৈপুণ্য দেখার আশায়।
২০১৬ ও ১৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হয়েছেন রোনালদো। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ফ্যাশনেবল। পোশাক, চুলের ডিজাইন সব কিছুতেই তার নুতনত্ব। গাড়ির বিষয়েও তার শখ জগৎবিখ্যাত। পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল হিসেবে পরিচিত অন্তত ২০টি গাড়ি আছে তার গ্যারেজে। এগুলোর একেকটির দাম শুনলেও চমকে উঠতে হয়। এই যেমন গত বছর ফেরারি এফ১২ টিডিএফ মডেলের গাড়ি কিনেছেন। গাড়িটির দাম গোপন রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ পাউন্ডের (চার কোটি দশ লাখ টাকা) বেশি হবে। আছে পোরশে ৯১১ কারেয়া টুএস ক্যাব্রিওলেট, যা গোটা পৃথিবীতেই আছে মাত্র ৩৬৫টি। ব্যক্তিগত জীবনে চার পুত্রসন্তানের জনক। রোনালদোর বসবাস স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে।

Share.

মন্তব্য করুন