নদীর তীরে ঘন জঙ্গল। কেয়ার ঝোপের ছোপ ছোপ অন্ধকারে বাস করে কতক শিয়াল। নদীর ধারে তাদের বাড়ি হওয়ায় খাবার দাবারের অভাব হয় না কখনো। বুড়ো শিয়ালরা নদীর কিনারায় কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে বসে থাকে। কামড় দেয়ার সাথে সাথে টান দিলে লেজের সাথে উঠে আসে ছোট-বড় কাঁকড়ারা। আর এতেই চলে যায় শিয়ালদের আহারের কাজ।
কিশোর শিয়ালরা বেজায় দুষ্টু। বুড়োদের কথা একদমই শুনে না। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে। কখনো কখনো মানুষের বসতবাড়ির কাছাকাছি চলে যায়, আর পোষা কুকুরের তাড়া খেয়ে ফিরে আসে জঙ্গলে। বসতবাড়ির আশপাশ থেকে হাঁস-মুরগির লোভনীয় গন্ধ ভেসে আসে নাকে। কিন্তু সাহস করে অত কাছাকাছি যাওয়া হয়ে ওঠে না কখনো। পোষা কুকুরের সতর্ক পাহারা আর গৃহস্থের উপস্থিতি টের পেয়ে জিবে জল নিয়ে জঙ্গলে ফিরতে হয় সবসময়।
একবার শিয়ালদের জঙ্গলে বেড়াতে এলো তাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ও তার কিশোর শিয়াল। কিশোর শিয়ালটি ছিল অত্যন্ত ধূর্ত। চটজলদি ভাব জমিয়ে নিল সমবয়সীদের সাথে। গল্পের ছলে গৃহস্থের বাড়ির হাঁস-মুরগির অবাধ বিচরণের কথা শুনে ফেলে সে। আর পায় কে তারে! ‘হুক্কা হুয়া হু হু’ বলে অমনি লাফ দিয়ে ওঠে শিয়ালটি- আজ রাতেই অপারেশন চালাতে হবে।
কিন্তু উৎসাহে ভাটা পড়লো তখন, যখন শুনলো রাতে হাঁস-মুরগিদের আলাদা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। তবুও অতিথি শিয়ালের তর সইছে না। মুরগিদের চলাফেরা আন্দাজ করতে একজনকে সাথী করে শীতল হাওয়ায় সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে গেলো সে। গৃহস্থের বাড়ির কাছাকাছি ঝোপের আড়ালে থেকে হাঁস-মুরগি প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে খড়ের গাদার পাশে দু’টি নাদুস নুদুস কুকুরছানাকে দেখে জিবে জল এসে গেলো অতিথি শিয়ালটির। আর তখনই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। সাথে আসা শিয়ালটিকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো কুকুরছানাগুলো কোনো ঘরে বদ্ধ থাকে না বরং খড়ের গাদার পাশে তাদের রাতযাপন।
জঙ্গলে ফিরে জরুরি সভার আহবান করে অতিথি শিয়ালটি।
‘আজ ডিনারে কুকুরছানার মেন্যুটা ভালোই জমবে। আর কত নদীর কাঁকড়া খেয়ে পেট নষ্ট করবো, খাবারে পরিবর্তন আনা দরকার। কী বলো সবাই?’
সবাই লেজ উঁচিয়ে সমস্বরে ‘হুক্কা হুয়া’ বলে সম্মতি জানালো। কিন্তু কিভাবে হিংস্র কুকুরীর কাছ থেকে তার ছানাগুলো চুরি করা যায় সেই ফন্দি আঁটতে শুরু করলো সবাই।
বোকা-সোকা টাইপের এক লম্বু শিয়ালের প্রস্তাব উপস্থাপন হলো শুরুতেই- ‘আমরা দু’চার কেজি কাঁকড়ার বিনিময়ে তার কাছ থেকে বাচ্চাগুলো চেয়ে আনবো।’
আরেকজন শিক্ষিত শিয়ালের প্রস্তাব- ‘বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করার নাম করে নিয়ে এলে বরং ভালো হয়।’
সভার মধ্য থেকে নেতাগোছের এক শিয়ালের ধমক খেয়ে চুপ করলো সভায় উপস্থিত শিয়ালেরা। নেতা শিয়ালের মাথায় বুদ্ধির জোয়ার বইছিলো তখন। সে কুকুরছানা চুরির কৌশলগুলো সবার কানে কানে বলে দিলে শুরু হয় শিয়ালনৃত্য। আর ‘হুক্কা হুয়া’ গানে মেতে উঠে পুরো জঙ্গল।
সন্ধ্যার লাল টুকটুকে সূর্যটা টুপ করে হারিয়ে গেলো নদীর ওপারের গ্রামটার আড়ালে। ধীরে ধীরে নেমে এলো অন্ধকার। তারাদের মিটিমিটি আলো আকাশজুড়ে। আলো-আঁধারির মিতালি আর জোনাকির ওড়াউড়ি চলছিলো নদীর তীর জুড়ে। কেয়ার ঝোপে।
পরিকল্পনা মাফিক বের হলো কিশোর শিয়ালের দল। দুই গ্রুপে ভাগ হলো সবাই। প্রতি গ্রুপে তিনজন করে সদস্য। পা টিপে টিপে পৌঁছে গেলো গৃহস্থের বাড়ির সদর দরজার পাশে। দরজার ওপাশ থেকে খিল আঁটা। এর মধ্যেই তিন সদস্যের একটি দল বাড়ির দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। আরেক দল উত্তর পাশে। একটু পরেই দক্ষিণ পাশে অবস্থানকারী শিয়ালের দলটি ‘হুক্কা হুয়া’ বলে ডেকে ওঠে। খড়ের গাদার পাশেই বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে ছিলো কুকুরীটা। হঠাৎ শিয়ালের আগমনী ধ্বনিতে রেগে মেগে তাড়া করলো শিয়ালদের। তারাও কষে দৌড় লাগালো দক্ষিণ দিকেই। দক্ষিণ থেকে আরো দক্ষিণে। এই সুযোগে উত্তরে ওঁৎ পেতে থাকা তিন শিয়ালের একজন দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলো আরেকজন দেয়ালের ওপর আর অন্যজন দেয়ালের ওপাশে। এ হাত ও হাত করে কুকুরের বাচ্চাগুলোকে দেয়াল পার করলো। মিশন দেখতে কিছু শিয়াল ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। বনভোজনের ভাগ পেতে তারাও বেরিয়ে এলো। আর দেরি না করে কুকুরের বাচ্চাগুলো নিয়ে কেটে পড়লো শিয়ালের দলটি।
রাতে সবাই জড়ো হলো নদীর ধারে।
কিশোর শিয়ালদের বনভোজন দেখতে এলো বুড়ো শিয়ালরা। বনভোজনে কুকুরের বাচ্চা খাওয়ার আয়োজন দেখে বুড়ো শিয়ালরা নারাজ হলেও কৌশল করেই বুঝতে দেয়নি দুষ্টুগোছের কিশোর শিয়ালদের। ভোজন পর্বের আগে বক্তব্য দেয়ার জন্য আহবান করা হলো কেয়ার ঝোপের সবচেয়ে প্রবীণ ও শিক্ষিত শিয়ালটিকে। সে আগে কুকুরের বাচ্চাগুলোকে নিজের কাছে এনে তারপর বলতে শুরু করলো- শোন আমার প্রিয় কিশোর শিয়ালগণ, কুকুর আমাদের প্রজাতিরই একটি প্রাণী। কুকুরের সাথে আমাদের শারীরিক মিল থাকলেও চরিত্রগত দিক থেকে কোন মিল নেই। ওরা প্রভুভক্ত। গৃহস্থের হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে বাড়ির সবকিছু চোরের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে বিশ্বস্ততার সাথেই। ওরা আমাদের শত্রু বলে ওদের বাচ্চাদের খাওয়া কি ঠিক? এটা ভারি অন্যায়। ওদের হত্যা করে তোমরা শিয়াল সমাজকে কলঙ্কিত করতে চাও?
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, না না।
একটি শিক্ষিত কিশোর শিয়াল বললো, আমরা ওই পাজি নেতা শিয়ালটির কুবুদ্ধিতে বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছি। আমরা আর এমন জঘন্য কাজ করবো না। আজকের বনভোজনটা কাঁকড়া দিয়েই হবে।
এবার কিশোর শিয়ালদের দ্বিতীয় মিশন শুরু হলো। তারা শিয়ালের বাচ্চাগুলোকে মা কুকুরের কাছে নিয়ে চললো। বাড়ির কাছাকাছি রেখে ‘হুক্কা হুয়া’ বলে ডাক দিতেই ছুটে এলো কুকুরীটা। শিয়ালগুলো ঝোপের আড়াল থেকে দেখলো ছানাগুলো ফিরে পেয়ে কুকুরী তার জিব দিয়ে চেটে চেটে ওদের আদর করতে শুরু করলো। মায়ের এমন মমতা দেখে চোখ ভিজে জল নেমে এলো কিশোর শিয়ালদের।

Share.

মন্তব্য করুন