গ্রামের পাশে এক মস্ত দিঘী। কচুরিপানায় ঠাসা। সমস্ত দিঘী জুড়ে প্রায় সমান উচ্চতার কচুরিপানা। তবুও মাঝে মধ্যে ঢিবির মতো কয়েক স্তূপ রয়েছে। সেই কচুরিপানার ঘন স্তূপে বাস করতো এক সাদা বক, তার স্ত্রী ও দুই শিশু। পুরো দিঘী জুড়ে সাদা বকের আদিপত্য। দিঘীর যে যে জায়গায় কচুরিপানা নেই সেখানটায় বসে সাদা বক শিকার ধরে। দিঘীর জলে গ্রামের লোকেরা গোসলও করে না, মাছও ধরে না। তাই সেখানে নিরাপদে মাছ বড়ো হয় আর সাদা বক গপাগপ মাছ ধরে। বউ বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট করেছে সাদা বক।
দিন যায়, মাস যায়। সাদা বকের সুখেই দিন কাটে। একদিন সেই দিঘীতে আরেক বকের আগমন ঘটলো। লাল বক। দেখতে বেশ চমৎকার। সেও তার বউ বাচ্চা নিয়ে এখানে এসেছে। কচুরিপানার উঁচু একটা ঢিবি দেখে বাসা তৈরি করেছে। সেও দিঘীর এক কোণে মাছ শিকারের জায়গা পেয়েছে। সেদিন গ্রামের এক লোক বড়শি দিয়ে মাছ ধরবে বলে দিঘীর উত্তর পূর্ব কোণে একটা জায়গার কটুরিপানা তুলে ফেলেছিলো। এতে বেশ সুবিধাই হলো লাল বকের। যখন লোকটি বড়শি নিয়ে চলে যায় তখন লাল বক সেখানে ওঁৎ পেতে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য মলা, শিং, কৈ ইত্যাদি সেই ফাঁকা জায়গায় হাজির হয়। লাল বক তখন ঝুপ করে পানিতে পড়েই মাছ ধরে ফেলে। আর সাথে সাথে পৌঁছে দেয় বাসায়। লাল বকের গিন্নি খায় আর বাচ্চাদের খাওয়ায়। অল্প দিনেই তাদের স্বাস্থ্যটাস্থ্য বেশ ভালো হয়ে গেলো। এটা দেখে সাদা বকের সহ্য হয় না। সে ভাবে কোত্থেকেরে বাবা নাজিল হলো এই লাল বক। সব মাছ সাবাড় করে নিচ্ছে। অচিরেই দিঘীর সব মাছ শেষ করে ফেলবে।
একদিন সাদা বক ও লাল বকের দেখা হলো। যদিও এর আগে দূর থেকে চোখাচুখি হয়েছে তবে কোনো কথা হয়নি। আজ ধরতে গেলে গায়ে পড়েই লাল বকের সাথে সাক্ষাৎ করলো। উদ্দেশ্য হলো লাল বকের হাল অবস্থা জানা আর কবে বিদায় নিবে তার হদিস বের করা।
সাদা বক বললো, ‘কেমন আছো ভাই?’
‘ভালো, খুব ভালো’
‘কিভাবে?’
লাল বক সরলভাবে বললো, ‘দেখ সাদা ভাই, প্রথমত প্রতিবেশী হিসেবে তুমি অত্যন্ত ভালো। এই যেমন আমাকে দেখতে এসেছো, খোঁজ খবর নিচ্ছো। দ্বিতীয়ত- এখানে বাসা বানিয়ে খুব নিরাপদে আছি। মাঝে মধ্যে অবশ্য মাছ শিকারি লোকটি আসে তবে আমার কোনো ক্ষতি করে না। তৃতীয়ত- এখানে খাবারের কোনো অভাব নেই। যখনই চাই, তখনই খাবার পাই। কাজেই মনস্থ করেছি, বংশানুক্রমে এখানেই থেকে যেতে চাই। সাদা বক মনে মনে ভাবে- শালা, আমি যে জন্য এখানে এসছি তোর সাথে সাক্ষাৎ করতে তা জেনেই গেছি। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা! কিভাবে তুই এই দিঘী ছেড়ে না যাস্ তা দেখছি। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করলো না। মুখে হাসির একটা রেখা টেনে বললো, ‘লাল ভাই, ভালো! খুব ভালো হয়েছে। তোমাকে পেয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে। তোমার বউ বাচ্চা নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে এসো। খুব ভালো লাগবে। লাল বক বললো, আচ্ছা।

সাদা বকের মনে শান্তি নেই। কোত্থেকে এক উটকো এখানে এসে দিঘীর একপাশ জুড়ে বসেছে। যেভাবে বংশ বিস্তার করছে, অচিরেই নাতি-পুতিতে ভরে যাবে এ পাশটা। আর খাবার দাবারের চাহিদাও বেড়ে যাবে। আমারও নাতি পুতিতে যখন ঘর ভরে যাবে তখন আমারও খাবারের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন কী আর করব? অচিরেই এর সমাধান না হলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। সাদা বকের বন্ধু ছিলো মাছ রাঙা। সে যখন দিঘীর একপাশে একটা ডালে বসে শিকার ধরতো তখন থেকে সাদা বকের সাথে তার সখ্য। সাদা বক মনে মনে ভাবলো- বিষয়টা নিয়ে মাছরাঙার সাথে আলাপ করি।
মাছরাঙা বললো- আমিও বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না এমন নয়। কারণ লাল বক এখানে আসার পর থেকে আমি খাবারের অভাব বোধ করছি। মাঝে মধ্যে মাছ ধরতে পারি তখন মজা করে খাই। কিন্তু যেদিন ধরতে পারি না সেদিন উপোস থাকতে হয়। এক কাজ করো সাদা ভাই। সাদা বক বললো- কী কাজ? আমার এক শিয়াল বন্ধু আছে। দেখি ওকে দিয়ে কিছু করানো যায় কি না। সাদা বক বললো- ভাই দেখ চেষ্টা করে। এটা তোমার ও আমার উভয়েরই সমস্যা। মাছরাঙা শিয়ালকে ঘটনাটি বললে- শিয়াল অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে বললো- এ আর এমন কী! যদি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারো তাহলে আমি এর সমাধান করে দিবো। মাছরাঙা আর সাদা বক ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। মাছরাঙার কথামতো সাদা বক, লাল বকের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। একদিন সাদা বক তার স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে লাল বকের বাসায় বেড়াতে যায় আবার আরেকদিন লাল বক তার স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে সাদা বকের বাসায় বেড়াতে আসে। খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি সবই হয়। সাদা বক কৌশলে সেদিন একটা মাগুর ধরেছিলো। ঐ মাগুর দিয়ে পেট পুরে খাইয়ে ছিলো লাল বককে।
একদিন বোশেখ মাসের পড়ন্ত বিকেল। ভ্যাপসা গরমে গা জ্বালা করছিলো। ঝড়-ঝাপটা হতে পারে। গ্রামের উঁচু গাছ-গাছালির মাথা বরাবর লাল সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। লাল বকটা তার স্ত্রীর সাথে খোশগল্প করছিলো আর স্ত্রী বকটা তার ছোট্ট ডানা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করছিলো। ঠিক ঐ সময় সাদা বক এসে ডাকলো- লাল ভাই ও লাল ভাই! লাল বক বাসা থেকে বেরিয়ে সাদা বকের ডাকে সাড়া দিলো। আরে লাল ভাই এই গরমে বাসায় বসে কী করছো? চলো বেড়িয়ে আসি। লাল বক বললো- সে তো ভালোই হয়। চলো, কোথায় বেড়াতে যাবে? সাদা বক বললো, ঐ তো হিজল তমালের বনের ধারে। ঐ বড়ো রাস্তা পেরিয়ে দূরে যেখানে বন বনানী এর পাশে একটা মস্ত বড়ো বিল। সেখানে সাদা লাল অজস্র বক অসংখ্য শিকার ধরে, ফুর্তি করে খায় এবং তারপরে চলে যায় যার যার গন্তব্যে। লাল বক বললো, চল সেখানেই যাই। দেখে আসি নতুন জায়গাটা।
দু’জনে দিলো উড়াল। উড়ে উড়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসে সেই বন বনানীর ধারে বসলো দু’জন। ওদিকে মাছরাঙা তার শিয়াল বন্ধুকে নির্ধারিত জায়গায় উপস্থিত হতে বলেছে। চালাক শিয়াল হিজল-তমালের বনে লুকিয়ে বসেছিলো। সাদা বক আর লাল বক যখন গল্পে নিমগ্ন তখন চতুর শিয়াল চুপি চুপি বকদের একেবারে পিছনে চলে এলো। মাছরাঙার কথামতো লাল বককে ধরার কথা থাকলেও শিয়াল কাছাকাছি পৌঁছে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো। শিয়াল দেখলো লাল বকের চেয়ে সাদা বকের শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো। আকারেও বেশ বড়ো। আর লাল বক দেখতে সুন্দর হলেও শরীর শীর্ণকায়। শিয়ালের এক গ্রাসও হবে না। আবার চতুর শিয়াল চিন্তা করলো এক সাথে দু’টোকেই ধরে ফেলি। কিন্তু যেভাবে ওরা বসেছে তাতে দু’জনকে ধরা সম্ভব নয়। তরতাজা-টসটসে সাদা বকটা দেখতে যেমন তুলতুলে তেমনি আকারও অনেকটা বড়ো। একটা ভালো গ্রাস হবে বলে মনে হয়। তাই শিয়াল আর লোভ সামলাতে পারলো না। মাছরাঙার কথামতো লাল বককে হত্যা করার কথা থাকলেও শিয়াল সাদা বককেই পছন্দ করলো এবং ওকেই পিছন থেকে খপ করে ধরে ফেললো। আর লাল বক আচমকা ধাওয়া খেয়ে দিলো উড়াল। শিয়াল আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে সাদা বককে সাবাড় করলো।

Share.

মন্তব্য করুন