ইমাম গাজ্জালির নাম আমরা সবাই জানি। হিজরি পনেরো শতকে তিনি দুনিয়ায় জ্ঞান গরিমার আলো ছড়িয়ে ছিলেন। তিনি ইরানের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তখনকার দিনে যারা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে চাইতো তারা নিশাপুরে গিয়ে হাজির হতো। তখন নিশাপুর ছিলো জ্ঞানার্জনের কেন্দ্র।
ইমাম গাজ্জালি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর আরো অধিক জ্ঞান লাভের জন্য নিশাপুরে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি ছিলেন খুবই প্রখর ও ধীশক্তির অধিকারী। তাই সহজেই তিনি শিক্ষকদের কাছে প্রিয় ছাত্রের মর্যাদা লাভ করেন। কোনো কিছু যাতে ভুলে না যান, এ জন্য গাজ্জালি তাঁর শিক্ষকদের সব কথা ও উপদেশ লিখে রাখতেন। শুধু তাই নয়, তিনি এসব লেখা অত্যন্ত যত্নসহকারে বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করে সংরক্ষণ করতেন। আর এসব বিষয় তিনি তাঁর জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান বলে বিবেচনা করতেন।
কয়েক বছর পর ইমাম গাজ্জালি তাঁর দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন। তিনি তাঁর সকল দলিল ও জ্ঞানের লিখিত সঞ্চয় ভালো করে বেঁধে নিলেন। তারপর একদিন তিনি একটি কাফেলার সাথে তাঁর দেশের উদ্দেশে রওনা হলেন। পথিমধ্যে কাফেলাটি একদল ডাকাতের হাতে ধরা পড়লো। ডাকাতরা সবার মূল্যবান জিনিসপত্র সব লুট করে নিয়ে গেলো। গাজ্জালির বোঝাটিও ডাকাতদের চোখে পড়লো। ডাকাতরা এই বোঝার মধ্যে কী আছে তা তালাশ করে দেখতে চাইলো।
‘তোমরা আমার সবকিছু নিয়ে নাও কিন্তু আমার এই বোঝায় তোমরা হাত দিও না।’ বললেন ইমাম গাজ্জালি। গাজ্জালির এই কথায় ডাকাতদের সন্দেহ বেড়ে গেলো। তারা ভাবলো নিশ্চয়ই এই বোঝায় মূল্যবান কিছু থাকতে পারে। গাজ্জালি নিশ্চয়ই তা লুকানোর চেষ্টা করছে। তাই ডাকাতরা বোঝাটি খুললো। কিন্তু ডাকাতরা কিছু লিখিত নোট ছাড়া বোঝায় আর কিছুই পেলো না।
ডাকাতরা বললো, এগুলো কী? এগুলো কী কাজে লাগবে?
ইমাম গাজ্জালি জবাবে বললেন,
‘এসব কাগজের কোনো মূল্য তোমাদের কাছে হয়তো নেই। অথচ আমার কাছে এগুলোর মূল্য অনেক বেশি।’
ডাকাতরা এ বিষয়ে জানার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো। কি এমন প্রয়োজন এসব কাগজ দিয়ে, তারা ইমামকে জিজ্ঞেস করলো।
ইমাম গাজ্জালি জবাবে বললেন,
‘এগুলো আমার শ্রমের ফসল। তোমরা যদি এগুলো নষ্ট করে দাও, তা হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আমার জীবনের বহু বছরের ফসল ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ডাকাতদের একজন বললো,
‘তুমি যা জানো, এসব কাগজে কি তাই লেখা আছে?’
ইমাম বললেন,
হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক।
ডাকাত বললো,
‘বেশ, এই কয়েক টুকরো কাগজে যে জ্ঞানের কথা লেখা আছে, তা যদি সহজে চুরি হয়ে যায়, তা হলে তা মোটেও জ্ঞান নয়। তুমি চলে যাও এবং এটা সম্পর্কে ও তোমার সম্পর্কে ভেবে দেখো।’
একজন সামান্য ডাকাতের এই মন্তব্য ইমাম গাজ্জালির মনকে কঠোরভাবে নাড়া দিলো। তিনি ভাবলেন, তিনি তোতা পাখির মতো কতোগুলো জ্ঞানের কথা জেনেছেন এবং তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি মনে করলেন, আসলে তিনি জানেন বেশি, কিন্তু তিনি কম ভেবেছেন। তাই তিনি যদি প্রকৃত অর্থে ভালো ছাত্র হতে চান, তা হলে তাকে জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে হবে। চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। তা নিয়ে গভীর ভাবতে হবে। আর তারপর তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।
এরপর থেকে ইমাম গাজ্জালি জ্ঞানের প্রতি আরো গভীর মনোনিবেশ করলেন। ফলে তিনি দুনিয়ার একজন বড়ো মাপের পন্ডিত ও ইসলামী চিন্তাবিদ হতে পেরেছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি একবার মন্তব্য করেন,
‘সবচেয়ে ভালো উপদেশ ছিলো সেটি, যেটি আমি লাভ করেছিলাম একজন ডাকাতের কাছ থেকে। আর এই উপদেশই আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিলো।’

Share.

মন্তব্য করুন