বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রবিন। খুবই আদরের। বাবা-মায়ের কাছে কোনো আবদার চাইতে না চাইতেই সেটা পেয়ে যায়। তবে রবিন এখনো ছোটো বলে তাকে একা বাসার বাইরে যেতে দেয় না তার বাবা-মা। যখনই বাবা সুযোগ পায় তখনই রবিনকে ঘুরতে নিয়ে যায়। আর ঢাকা শহরে ঘোরার জায়গাই বা কতটুকু। তারপরও যেটুকু ঘোরার জায়গা আছে সেখানে অন্তত একবার হলেও নিয়ে যায়।
একদিন রবিন তার মায়ের কাছে বলছে, আম্মু শিশুপার্কে নিয়ে চলো। আম্মু বললেন, তোমার আব্বু অফিস থেকে আসুক তারপর দেখা যাবে। এ কথা শুনে রবিন একটু মন খারাপ করলো!
রবিন সময় গুনতে লাগলো। আব্বু কখন আসবে। রবিনের বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় রবিনের জন্য কিছু চকোলেট নিয়ে এলো। চকোলেট নিয়েই রবিন তার বাবাকে বললো, আব্বু আজকে আমাকে শিশুপার্কে নিয়ে চলো না। ঘরে আর ভালো লাগছে না।
ছেলের কথা শুনে ভাবলেন ঠিকই তো বলেছে। এতোটুকু ছেলে যার কোনো বন্ধু নেই। আবার ঘরের বাইরে যেতে পারে না, তাকে তো সময়ও দিতে হবে। রবিনের কথায় তার বাবা রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে বাবা কালকে নিয়ে যাবো। আজকে তো পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে। রবিনের মন খুশিতে ভরে উঠলো।
পরদিন রবিন ও তার বাবা-মা শিশুপার্কে ঘুরতে গেলো। রিকশায় চড়ে যাচ্ছিলো। রবিন কি মনে করে আকাশের দিকে তাকালো!
আব্বু আকাশে ওইগুলো কি উড়ছে! তখন রবিনের বাবা বললো ওগুলো ঘুড়ি উড়ছে। রবিন বললো, ঘুড়ি সেটা আবার কী জিনিস? মানুষ উড়ায় নাকি রিমোট কন্ট্রোলে চলে। রবিনের উদ্ভট কথা শুনে আঁতকে উঠলেন বাবা। মনে মনে ভাবলেন এটা আবার কেমন প্রশ্ন! জবাবে বললেন, না বাবা মানুষই বানায় আবার মানুষই উড়ায়। তুমিও বানাতে পারবে এটা। রবিন একটু ভেবে বললো, আমিও কি উড়াতে পারবো তাহলে! তার বাবা বললেন, হ্যাঁ বাবা তুমিও পারবে।
নোমান সাহেব ছেলের কথা শুনে একটু চিন্তা করতে লাগলেন। ছেলের বয়স এখন আট বছর। অথচ সে ঘুড়ি কী জিনিস সেটাই জানে না। ভুলটা তো আমারই। রবিনকে সব কিছুই তো জানানোর প্রয়োজন আছে। বাইরের পরিবেশ, সমাজ সব কিছুই তো তাকে একদিন জানতে হবে। এখন যদি এরকম হয় তাহলে তো সামনের দিনগুলোতে এগুতে পারবে না। আরো নানান চিন্তা নোমান সাহেবের মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
রবিন শিশুপার্কে ঢুকে দিলো এক দৌড়। আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সারাদিন অনেক ঘুরলো রবিন। অনেক মজা পেয়েছে সে। বাসায় ফেরার সময় রবিনের সেই ঘুড়ির কথা মনে পড়ে গেলো। এবার বাবার কাছে আবদার করলো, আমাকে একটা ঘুড়ি বানিয়ে দাও। নোমান সাহেব একটু বিব্রত বোধ করলেন। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। আচ্ছা ঠিক আছে বাবা এখন তো অনেক ক্লান্ত বাসায় গিয়ে দেখা যাবে।
রবিন খুবই ক্লান্ত ছিলো বলে রাতের খাবার কোনোমতে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। আর এদিকে নোমান সাহেবের চোখে কোনো ঘুম নেই। ঘুম হবেই বা কেমন করে। ছেলের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। নোমান সাহেবের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেলো। আর ভাবতে লাগলেন, গ্রামে দলবেঁধে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা, একসাথে মাছ ধরা, পাঠশালায় যাওয়া, আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আরো কতো কি! সেসব কথা ভাবতে ভাবতে নোমান সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে রবিন ঘুম থেকে উঠেই তার বাবাকে খুঁজতে লাগলো। রবিন তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করলো, আব্বু তার জন্য ঘুড়ি বানিয়েছে কিনা। রবিনের আম্মু একটু বিপদেই পড়ে গেলেন। বললেন, তোমার আব্বু বলেছে অফিস থেকে এসে তোমার সাথে কথা বলবে। রবিনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। রবিনের আম্মু সেটা বুঝতে পেরে রবিনকে সান্ত¡না দিতে থাকলেন। আর এদিকে নোমান সাহেব ভেবে দেখলেন গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলে কেমন হয়। রবিনের চাচাতো ভাইয়েরা আছে, ওদের কাছে থাকলে অনেক কিছুই শিখতে পারবে। ঢাকায় থাকলে আমার ছেলেটা কিছুই শিখতে পারবে না।
নোমান সাহেব চিন্তা-ভাবনা করেই বাসায় ফিরলেন। বাসার কলিংবেল চাপতেই রবিন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। সালাম দিয়ে বললো, আব্বু আমার ঘুড়িটা কি তুমি বানিয়েছো? নোমান সাহেব একটু হেসে বললেন, বাবা এখানে তুমি ঘুড়ি উড়ানোর জায়গা পাবে না। তার চেয়ে চলো তোমাকে কালকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো। রবিন অবাক হয়ে বললো কোথায় যাবে আব্বু!
তোমার নিজের বাড়িতে। তখন রবিন বললো নিজের বাড়ি! সেটা আবার কোথায়? নোমান সাহেব বললেন, সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে বাবা। তোমার আম্মুকে বলো কাপড়গুলো গুছিয়ে নিতে। আমরা আজকে রাতেই রওনা দেবো। রবিন আর চিন্তা-ভাবনা না করেই কাপড় গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রবিনের আম্মু নোমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার আপনি হঠাৎ করেই বাড়িতে যাচ্ছেন কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি। নোমান সাহেব বললেন না, কোনো সমস্যা হয়নি। রবিনকে তার গ্রামের সৌন্দর্য, মানুষ, প্রকৃতি সবই দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি। রবিনের আম্মু বুঝতে পারলেন। তাই কথা না বাড়িয়ে গ্রামের দিকে রওনা হলেন।
সকালে পৌঁছানোর পরই রবিন দেখলো আরে এতো শহরের মতো না। আমাদের বাসার মতো তো নয়ই, অনেক সুন্দর জায়গা। খোলা জায়গা, বাড়ির সামনে সবাই বসে আছে। খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রবিন। তাঁর আব্বুকে জিজ্ঞেস করে, এটা কি আমার বাড়ি। তখন রবিনের দাদুভাই এসে বলেন, হ্যাঁ দাদুভাই এটা আপনার বাড়ি।
রবিনের ক্লান্ত শরীরটা এক নিমিষেই কেমন ফুরফুরে হয়ে গেলো। বাড়ির পাশেই বিশাল মাঠ। রবিন তার আব্বুকে বললো, আমি কি মাঠে যেতে পারি। নোমান সাহেব বললেন, যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারো। কিন্তু যাবার আগে আমাকে বলে যাবে। রবিন বললো ঠিক আছে আব্বু। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তার বড়ো ভাই। মানে চাচাতো ভাই। রবিনকে বলে, চলো আমরা ঘুড়ি উড়াতে যাচ্ছি। রবিন ঘুড়ির কথা শুনেই চলে গেলো।
ভাইয়াকে বলতে লাগলো ঘুড়ি কিভাবে বানায়। রবিনের বড়ো ভাই বললো, তাহলে চলো আগে বাঁশ বাগানে যেতে হবে। রবিন বললো বাঁশ বাগানে কেন? আরে ভাইয়া চলোই না আগে। তারপর দেখবে। রবিন আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো বাঁশ বাগানে। সেখান থেকে একটা চিকন বাঁশ কেটে আনলো। এরপর চিকন করে কঞ্চি বানালো। কাগজের ওপর কঞ্চিটা বাঁকা করে ধরলো আর রবিনকে বললো দুই পাশে এটা ধরে রাখতে। রবিন তার ভাইয়ের কথামতো ধরে রাখলো। আর একটা লম্বা কঞ্চি কাগজের ওপর রাখলো। দিকটা ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য। বাগান থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনে এলো। আর রবিনকে বললো তুমি এখানে দাঁড়াও আমি গাছে উঠবো। রবিন কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না। ভাইয়া কি তাকে বোকা বানাচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। রবিনের বড়ো ভাই বেল গাছে উঠে কয়েকটা কাঁচা বেল পাড়লো। রবিন ভাবতে থাকলো ঘুড়ির সাথে বেলের কি সম্পর্ক। কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না।
বাঁশের কঞ্চি আর কাগজ মাটিতে রেখে কঞ্চির সাথে বেলের আঠা লাগিয়ে দিলো। এরপর কাগজের সাথে লাগালো। কিছুক্ষণ রাখার পর সুতা ঘুড়িটার সাথে বেঁধে রাখলো। ভাইয়া রবিনকে ডেকে বললো, চলো এবার এটা উড়াবো। রবিন একটু চমকে উঠে বলে ঘুড়ি বানানো শেষ। রবিনের ভাই বলে হ্যাঁ শেষ। এবার এটাকে কিভাবে উড়াবে ভাইয়া? চলোই না দেখাবো। বাতাসের সাহায্যে ঘুড়িটা কয়েকবার উড়ানোর চেষ্টা করলো। রবিনের আর তর সয় না। কি হলো ভাইয়া উড়ে না কেন?
আরে ভাইয়া ধৈর্য ধরো। বাতাস এলেই এটা আকাশে উড়বে। এই কথা বলতে না বলতেই ঘুড়িটা আকাশে উড়তে লাগলো। রবিন হো হো করে হেসে উঠলো। নোমান সাহেব মাঠে এলেন ছেলে কি করছে সেটা দেখার জন্য। এসে দেখলেন ছেলে হো হো করে শুধু হাসছে। আকাশের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলেন ঘুড়ি ওড়ানো দেখেই ছেলে এ রকম করছে। কিছুক্ষণ পর দেখলেন ঘুড়ি আরো অনেক উপরে উঠছে, সেই সাথে এক অন্যরকম শব্দ। ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ করে শব্দ হচ্ছে। রবিন আরোও জোরে জোরে হাসছে। আরে এটা আবার কেমন শব্দ! রবিন এবার ঘুড়ির সুতোটা ধরলো। আরে এতো অনেক ওজন। তখন ওর ভাই বললো বাতাসের কারণে আর অনেক উপরে থাকার জন্য এরকম, বুঝতে পেরেছো ভাইয়া।
রবিন আনন্দে আত্মহারা। নোমান সাহেবেরও একটু প্রশান্তি লাগছে। কারণ ছেলেকে ঢাকায় এরকম আনন্দ দিতে পারতেন না। আজকে রবিনের আনন্দ দেখে সত্যিই নোমান সাহেবের চোখে অশ্রু ঝলমল করছে। হঠাৎ রবিনের চিৎকারে নোমান সাহেব তাকাতেই বাবাকে জোরে জোরে ডেকে বলছে, দেখো আব্বু আমার ঘুড়িটা সবার উপরে।

Share.

মন্তব্য করুন