রাতের অন্ধকার। আকাশে মেঘ জমে। বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশও আনন্দে ঝলকানি মারে, আলো ছড়ায়। ঝিলিক মারে। শব্দ হয়। ঠাসঠাস ভয়ানক শব্দ। বুক কাঁপানো শব্দ। ভারী হয় আকাশ। নামে বৃষ্টি, আসে ঝড়। এলোমেলো করে দেয় সব।
‘আম কুড়ানীর দিনে এলে ভাই
উড়– উড়– মনে
সারাটা দিন কাটিয়ে দিতাম
আম কাঁঠালের বনে।
দমকা হাওয়ায় হঠাৎ করে
আমটি পড়তো যবে
আঁজলা ভরে ধরবো বলে
ঝাঁপিয়ে পড়তাম সবে।’
ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন যে একটি বছর শেষ হয়ে গেছে তা মোটেও টের পাইনি। এখন হিসাব-নিকাশের পালা। গত একটি বছরে কতোটুকু সাফল্য অর্জন করেছি তাও ভেবে দেখার সময়। গত বছরের সফলতাকে সঙ্গী করেই বরণ করে নিতে হবে নতুন বছরকে। এ প্রশ্নটি তোমাদের ছোটোদের মনেও খোঁচা লাগার কথা। তাই না? এই তো দেখো না চৈতি রোদের দিনগুলো একে একে পার হয়ে গেছে। আবার আমাদের কাছে নতুন বছরের সুসংবাদ বয়ে নিয়ে হাজির হয়েছে পহেলা বৈশাখ।
আজ পহেলা বৈশাখের সকালটায় সবার কাছে কতই না আনন্দ লাগছে। নতুন বছরের আনন্দে গাছেরাও যেন আনন্দিত। নতুন পাতা মেলে তারাও কুটি কুটি হাসছে। পুরনো বছর যেতে না যেতেই আবার হেসে উঠেছে নতুন বছরের ভোর। নতুন বছর এলে তোমাদের কাছে কেমন লাগে? খুব মজা তাই না! মনটা যেন ফুরফুর করে সবার। খুশিতে বাগ বাগ। হৃদয় ভরে ওঠে আনন্দে। তাই তো নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছি আমরা। চারদিকে সবার মুখে মুখে একই কথা, শুভ হোক নববর্ষ। বৈশাখ এলেই আমরা যেমন আনন্দ পাই, তেমনি আকাশ বাতাসও উতলা হয়ে যায়। যেন নিঃশ্বাস ফেলে পৃথিবী।
পৃথিবীর নিঃশ্বাসে বাতাসের সাথে উড়ে বেড়ায় উত্তপ্ততা। গরম, ভীষণ গরম। এমনিভাবে দিনের শেষ হয়। আসে বিকেল। তারপর সন্ধ্যা নামে, নামে রাতের অন্ধকার। আকাশে জমে মেঘ। বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশও আনন্দে ঝলকানি মারে, আলো ছড়িয়ে দেয়। ঝিলিক মারে। শব্দ হয়। ঠাস ঠাস ভয়ানক শব্দ। বুক কাঁপানো শব্দ ভারী হয় আকাশ। নামে বৃষ্টি। আসে ঘূর্ণিঝড়। এলোমেলো করে দেয় সব।
এলোমেলো করে দেয় নতুন জীবন। একসময় আকাশ দুনিয়াটা ঠান্ডা করে দিয়ে শেষ করে তার পহেলা বৈশাখের উৎসব। চৈত্র মাস শেষ হতে না হতেই আমরা ভাবতে থাকি, কখন আসবে আমাদের আকাক্সিক্ষত পহেলা বৈশাখ। অপেক্ষা করতে করতে যেন সময় আর ফুরায় না। ভারি মজা এই দিনে। স্কুল ছুটি। ঘরেও ছুটি। রেডিওতে অনুষ্ঠান। টিভিতে অনুষ্ঠান। শহরজুড়ে অনুষ্ঠানের বান ডেকে যায়। কাগজে কাগজে ছড়া, গল্প, কবিতা। সেই সঙ্গে কালো বর্ণালি বর্ষপঞ্জি। আর আনন্দময় বৈশাখী মেলা। মাটির পুতুল, বেতের ঝুড়ি, বাঁশের বাঁশি, পুঁতির মালা। বকুনি নেই, উপদেশ নেই, কেবলই হাসি, আনন্দ, গান! সত্যিই এ দিনটির তুলনা হয় না। আচ্ছা তোমরা কি বলতে পারো কেন এমন হয়?
পহেলা বৈশাখই হলো বছরের প্রথম দিন। পহেলা ডানা মেলে এদিনে। বৈশাখ আবার ঋতুরও শুরু। বৈশাখ নিয়ে আসে প্রথম ঋতুর নতুন সমাহার। বাংলার আকাশে বাতাসে বৈশাখ তার আগমন ঘোষণা করে। আলোড়ন তোলে নিষ্প্রাণ শহরেও। পাখির কলকাকলি নদীর তিরতিরে স্রোত, পবন মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান, আর সবুজের রাজ্যে নিয়ে যায় আমাদের পহেলা বৈশাখ। আচ্ছা তোমরা কি বলতে পারো, কবে থেকে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়? নববর্ষ পালন আজকের নয়। খ্রিষ্টপূর্ব দু’হাজার সালেও মেসোপটেমিয়ায় নববর্ষ পালনের রেওয়াজ ছিলো বলে জানা যায়। তখন কখনো মার্চ মাসে আবার কখনো সেপ্টেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে নববর্ষ পালিত হতো। আরও অনেক পরে জানুয়ারি মাস থেকে বর্ষ গণনা ও পহেলা জানুয়ারি নববর্ষ পালন শুরু হয়।
পৃথিবীর সকল দেশেই দেখা যায় প্রকৃতি একটি পর্যায় থেকে আর একটি পর্যায়ে উত্তরণের সময় মানুষ কিছু আচার ও অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সে সময়টিকে চিহ্নিত করে রাখতে চায়। এই আয়োজন আর উৎসবই হলো নববর্ষ। আমাদের দেশে নববর্ষ কখন আসে? গ্রীষ্মের খরতাপে যখন প্রকৃতি অস্থির, ফসল ফলাবার জন্য যখন বৃষ্টির প্রয়োজন তখন সেই বৃষ্টির আবাহনের সঙ্গে আসে নববর্ষ। আমরা প্রার্থনা করি বৃষ্টি আসুক। নববর্ষ এলে আমাদের দেশে যে আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়Ñ তার মধ্যেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। পুণ্যাই হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের গান ও আনন্দ প্রকাশের অনুষ্ঠান, চড়ক মেলা ইত্যাদি এর অন্যতম।
দেশের ব্যবসায়ী সমাজ সারা বছর এ দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে, অপেক্ষায় থাকে। পহেলা বৈশাখ এলেই দেশজুড়ে খোলা চত্বরে বসে মেলা। নববর্ষের এ মেলা কতই না আনন্দ বয়ে আনে। মেলায় বাঁশি, খেলনা, ডুগডুগি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি সবার মন কাড়ে। এ ছাড়া মাটি ও কাঠের তৈরি নানা সরঞ্জাম কেনার ধুম পড়ে যায়। লাঠি খেলা, সার্কাস, পুতুল নাচ, গানের আসর বসে।
তাহলে তো বুঝতেই পারছো, পহেলা বৈশাখে কেন এতো আনন্দ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ এভাবে আমাদের জীবনধারায় নতুন প্রেরণার জন্ম দিয়ে যায়। আর এরমধ্য দিয়েই আমরা খুঁজে পাই বেঁচে থাকার আনন্দ। জীবন সংগ্রামের উদ্দীপনা। এদিনে আমাদের কামনা নতুন বছরটি সুখ-শান্তি আর ফসলে ভরে উঠুক আমাদের চাতাল। প্রকৃতি আর না হোক নিষ্ঠুর। আমরা চাই সুন্দর সময়, সুন্দর দিন, সুন্দর রাত, সুন্দর সমাজ আর সুন্দর একটি পৃথিবী। সেই সুন্দরের ধারাই বয়ে আনুক বাংলা নববর্ষ।

Share.

মন্তব্য করুন