একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। আমার খুব কাছের এক আত্মীয়ের ছেলে এসএসসি দিয়েছে। শহরেই তাদের বসবাস। বাবা প্রবাসী। ঘরের আর কেউ তেমন কোন কাজের সাথে জড়িত নয়। আরো দুই সন্তানের মধ্যে একটা সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। অন্যটা এখনো খুব ছোটো। ছেলেটাকে পরীক্ষার আগের সময়গুলো বেশ গাইড করা হলো। নিয়মিত ক্লাস। কোচিং। বাসায় স্যার রাখাসহ যা যা করে এখনকার সময়ে তার সবই করা হলো। মাঝে মধ্যে আমার আসা-যাওয়া ছিলো বিধায় কিছুটা হলেও দেখেছি। পরীক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট এর সময় আসে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ছেলেটার এক বিষয়ে ফেল আসে। যদিওবা এই বিষয়ে পরীক্ষা নাকি এবার বেশ কঠিন হয়েছে বলে শুনেছি।
রেজাল্ট বের হওয়ার দিন রাতেই আমি ঐ বাসাতে যাই। যদিও না যাওয়াটা উত্তম ছিল। কিন্তু কেন যেন বিরত থাকতে পারলাম না। বিশেষ করে ছেলেটার সাথে আমার একরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। যাইহোক আগপাছ ভাবতে ভাবতে বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। দরজায় বেশ কয়েকবার নক করলাম। কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। নিজের ওপর এক রকম বিরক্তি নিয়েই ফিরতে যাবো এমন সময় দরজা খুলে দিলো কেউ। ভেতরে গিয়ে বসলাম। না কেউতো আসছে না। আমি ছেলেটার রুমে গেলাম। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তোলে। মারাত্মক অবস্থা! কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলিয়ে একেবারে লাল করে ফেলেছে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে সান্ত¡না দেই। এমন সময় ছেলেটার দাদি এসে হাজির। উনার চাহনি খুব একটা সুবিধাজনক মনে হলো না। আর সেটাই ঘটলো তখনি। আমার সামনেই কর্কশ ভাষায় একগাল বকাঝকা করে নিলেন। (না জানি এর আগে আরো কতো কিছুই না করেছেন!)
দাদুর বকে যাওয়া সবগুলো কথা যেন আমার বুকে এসে তীরের মতো আঘাত করতে লাগলো। এতোটুকুন এই ছেলেটা কিভাবে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে! এবার ওর মাও এসে হাজির। উনি তো আরেকটু এগিয়ে। বাসায় রাখা ওর স্যারদের নাকি ডেকে নিয়ে কৈফিয়ত চাইবেন। এবার আরেকটু বেশি চিন্তায় পড়ে গেলাম। না জানি কি সব ঘটতে যাচ্ছে। ভালোর জন্য এসে বিপদে পড়েছি বুঝি! স্যাররা তো তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলেটাও চেষ্টা করেছে। এই বিষয়টা একটু হার্ড হয়েছে বলে ওর কপালে আজ এতসব! সাথে নিরপরাধ শিক্ষকদেরকেও কথা শুনতে হবে? দাদু আর মা দু’জন কেবল বলেই যাচ্ছেন।
একটু সাহস করেই উনাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বললাম। যাতে করে এখানেই উনারা থেমে যান। সম্মানী মানুষরা (শিক্ষক) যেন কোনোভাবে অসম্মানিত না হোন। আমি আমার মতো করে বলে সেখান থেকে চলে আসি।
সেদিনের সৃষ্ট উদ্ভট পরিস্থিতি আমাকে বারবার তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
জানি না পরবর্তীতে কী ঘটেছিল সেখানে। জানার চেষ্টাও করি নি। তবে ছেলেটার পড়াশোনা নাকি এখানেই থামিয়ে দেয়া হয়। এই একটুখানি ব্যর্থতা মেনে নিতে পারেননি বলেই কিছুদিন পর ছেলেটাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এইতো গেলো একটামাত্র ঘটনা। এরকম অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে আমাদের সমাজে। বাবা-মা, পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে গিয়েই এমন হাজারো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।
আর শিক্ষিত করে তোলার জন্য আমরা যতটা না পেরেশান, শিশুটাকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিন্দুমাত্র পেরেশানি আমাদের কারো মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। কেবল শিক্ষিত হয়েও হবেটা কি? যদি মানুষের মতো মানুষ না হয়। এক্ষেত্রে আমাদের বড়দের দায় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
আমরা সবাই খুব দ্রুত বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। বিশেষ করে আমাদের দেশের তরুণরা। আর এই প্রবণতা দিনদিন মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েই চলছে। একবার ব্যর্থ হয়ে গেলে পুনরায় চেষ্টা করার প্রবণতা একদম নেই বললেই চলে। এ জন্য আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই এ দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না। আশার বাণী কেউ শুনায় না। ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে পুনরায় চেষ্টা করার মতো সুযোগটা আমাদের কেউ করে দেয় না। মনীষীর উক্তি ধরেই বলতে হয়, ‘দিন শেষে তারাই সফলকাম হয়, যারা ঠিকে থাকে।’
আসলেই তো, আমরা টিকে থাকতে পারি না। লেগে থাকার অভ্যাসটা আমাদের গড়ে ওঠেনি এখনো। সামান্যতেই ভেঙে পড়ি। এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করার মতো কেউ নেই। যার দরুন প্রতিনিয়ত এসবের ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের।
‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখো শতবার’-এই কবিতাটি ছোট ক্লাসে আমরা অনেকেই পড়েছি। ভালো লাগতো বারবার মুখে আওড়াতাম। কি বুঝাতে চেয়েছেন কবি সেটা তখনো বুঝার যোগ্যতা হয়নি। এখন বুঝতে পারছি কি সুন্দর শিক্ষণীয় কথাটাই না বলেছেন কবি। এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে কতো নিগূঢ় তাৎপর্য বিদ্যমান। আমাদের সবার জীবনে কবির কথাটাই জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে।
উপরের গল্পটা দিয়েই শেষ করতে চাই-
ঐ ছেলেটার সামান্য ব্যর্থতাটুকুন পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি। তাকে বকুনিঝকুনি ছাড়া একবারও আশার কথা কেউ বলেনি। তাকে পুনরায় সুযোগ করে দেয়া হয়নি। নিশ্চয় ছেলেটা চেষ্টা করে এই সামান্য ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠতে পারতো। আজ বিদেশের মাটিতে বসে এই মুহূর্তে হয় তো এসব নিয়ে ভাবছে না। তবে জীবনের একটা পর্যায় এসে নিশ্চয় ফিরে যাবে সেদিনের ঘটনায়। তখন আর কিছু করার থাকবে না। কেবল বাবা-মা কিংবা পরিবারের প্রতি অভিশাপ দেয়া ছাড়া।
যত দিন পর্যন্ত এই জায়গাগুলাতে পরিবর্তন না আসবে ততদিন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথটা কঠিন থেকে আরো কঠিন হবে।

Share.

মন্তব্য করুন