চল্লিশোর্ধ্ব এক গ্রামীণ ব্যক্তি ফজল আলী। মুখ ভরা চাপ দাড়ি প্রায় নাভি ছুঁই ছুঁই। কথা বললে এমন ভাবে নড়া চড়া করে মনে হয় নদীর তীরে সমতল ভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কাশফুল বাতাসে দুলছে। অবশ্য এটা তার সুন্নতি দাড়ি নয় বরং শখের বশে দীর্ঘ করার মহড়া। লোকমুখে শোনা যায় যেদিন তিনি প্রথম দাড়ি রেখেছিলেন সেদিন নাকি নাভির নিচ পর্যন্ত দীর্ঘ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তার আরেকটি শখ ছিল আমৃত্যু ঘনকালো বাহারি চুলের। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে বয়স ত্রিশ পেরুনোর পরই তা বাতাসের গতিতে উড়ে যেতে থাকে। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পুরো মস্তক এলাকা কেশশূন্য চকচকে ধবল নগরে পরিণত হয়। সূর্যের আলো যখন তার তেল চিকচিকে মাথায় পতিত হতো প্রতিবিম্ব হয়ে আশপাশে অবস্থিত লোকজনের চোখে তির্যক রশ্মির আঘাতে ছানাবড়া অবস্থা হতো। এ নিয়ে অবশ্য ফজল আলীর আক্ষেপের অন্ত ছিল না। মাথায় টুপি দেয়া চরম অপছন্দ হলেও টাক ঢাকার খাতিরে বাধ্য হয়ে তা দিয়ে মস্তক আবৃত রাখতো। ধর্ম কর্মের কোন কথাই তার সাথে আলাপ করা যেতো না। প্রথম দর্শনার্থী বেশভূষায় মুগ্ধ হয়ে অন্তরের সরলতায় যদি নামাজ, রোজা, জাকাত, দান-সদকা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলতো জানবার ইচ্ছায়, তবে ফজল আলীর ধমক খেয়ে বেকুব বনে যেতে হতো।
গ্রামের লোকেরা অবশ্য ফজল আলীকে ফজলা বলে ডাকতেই বেশি অভ্যস্ত। অতি দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেগুলি আরেক ধাপ এগিয়ে কুঞ্জুস ফজলা বলে টিপ্পনী কেটে আত্মতৃপ্তি লাভ করতো। কারণ তার কাছ থেকে কোনোদিন সভা, সমাবেশ, মাহফিল, ইফতার, বিজয় দিবস কোনো উপলক্ষেই একটি মাত্র টাকাও আদায় করা সম্ভব হয় নাই আজ অবধি। দূর বা অদূর ভবিষ্যতে এই সম্ভাবনা একেবারেই শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়। অবশ্য তার বাপেরও নাকি অনুরূপ সুনাম সুখ্যাতি গ্রামের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। তিনিও নাকি আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী কাউকে কোন কিছু দান করা নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল বলে মনে করতেন। এমনকি এক বেলার খাবার তিন বেলা খেয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যক্ষের ধন গড়ে তুলেছিলেন। যা ওয়ারিশ হিসাবে একমাত্র ছেলে ফজল আলীর মালিকানায় এসেছে। ফজল আলীর পিতা নাকি মৃত্যুর সময় অত্যন্ত পছন্দনীয় খাবার খেতে গিয়ে গলধঃকরণ করতে পারেন নাই।
দীর্ঘ দিন ধরে ভালো কোনো খাবার গলদেশ দিয়ে প্রবাহিত না হওয়ায় শুষ্ক ঠনঠনে কণ্ঠনালীতে তা আটকে গিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। মৃত্যু যবনিকার মুহূর্তে তিনি নাকি ছেলেকে তার যোগ্য উত্তরসূরি হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। ওসিয়ত করেছিলেন ছেলের প্রতি বাবার মতো করেই উক্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে। তা যাতে না কমে বরং বাড়ে এর জন্য নিজের পদাঙ্ক অনুসরণ করার পরামর্শও নাকি দিয়েছিলেন।
পিতার ওসিয়ত পূরণ করতে গিয়ে ফজল আলী কোনো দিন কোনো শখ করেন নাই যেখানে অর্থ খরচার ব্যাপার জড়িত থাকে। এমনকি দাম্পত্য জীবনের বিশটি বছর পেরিয়ে গেলেও সন্তান গ্রহণের ভাবনা মাথায়ই আনেন নাই কোনদিন, পাছে খাদ্যে অংশীদার বৃদ্ধি পেয়ে পুঞ্জীভূত সম্পদে হ্রাস ঘটে এই ভাবনায়। এ নিয়ে যে তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়াঝাঁটি মাঝে মধ্যে হয় না এমন নয়। প্রতিবেশীরা প্রায়ই দুইজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পান। কিন্তু আত্মসম্ভ্রম ভয়ে কেউই তাতে কান করতে সাহস পান না। একপর্যায়ে তার স্ত্রী মনের দুঃখে নিঃসঙ্গ জীবনের বিস্বাদে বিনিয়ে বিনিয়ে বুক ফাটা রোদন শুরু করলে প্রতিবেশীরা শুধু থামতে বলে সান্ত¡না দেন। স্ত্রী তখন চাপা গলায় বলেন, ‘মানুষটিকে কি আল্লাহ কোন শখ দেয় নাই’ অমনি ফজল আলী চিৎকার করে বলে উঠে ‘তাহলে কি আমার দাড়ি রাখা বিনা শখে?’ গরিব মিসকিন অসহায় সাহায্যপ্রার্থীরা কোনো দিন তার বাড়ি থেকে সামান্যতম প্রার্থিত বস্তু পেয়েছে এমন নজির পাওয়া দুষ্কর। তবুও অবুঝ মনের অসহায় গরিবেরা তার দরজায় টোকা দিতে কোনো দিন ভুল করেন না। যদি কখনও ফজল আলীর ইস্পাত কঠিন শক্ত মনে মায়ার বারি সিঞ্চিত হয়ে একটু নরম হয় এই আশায়।
অভাবী ও অসহায় মানুষের ঘন ঘন বাড়িতে প্রবেশ, তাদের করুণ কাকুতি মিনতি আর বারান্দায় বসে সুরেলা রোদন তার মনে মায়ার উদ্রেক হওয়ার পরিবর্তে আরোও বিষিয়ে উঠলো। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো বাড়ির চারপাশে ঘিরে দেবে। যাতে বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। পিতার মৃত্যুর পর এই প্রথম বড়ো অংকের অর্থ গচ্চা দিয়ে মোটা সিটের ঢেউটিন কিনে বাড়ির চৌহদ্দি ঘিরলো ফকিরমুক্ত নিরাপদ আবাস গড়ার ইতর মানসে। এতে অবশ্য হঠাৎ একদিন তার রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিলো। সেখানেও ডাক্তার বাবদ বেশ কিছু টাকা খরচা করতে হয়েছিলো। দুঃখের ব্যাপার হল কাঠমিস্ত্রির পারিশ্রমিক আর টিনের দাম প্রদান করার জন্য চৌকির নিচে গর্ত করে পলিথিনে মুড়ে পুঁতে রাখা টাকার বান্ডিলগুলো বের করতে গিয়ে দেখা গেল সবগুলো টাকার দুই- তৃতীয়াংশ বেরসিক নিষ্ঠুর উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। তার রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ বলে আহুত ডাক্তার মশাই জানিয়েছিলেন।
ইতোপূর্বে ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়ার নজির ফজল আলীর পরিবারে ঘটে নাই। একবার তার স্ত্রীর বেশ শক্ত বেরাম হয়েছিলো। টানা বাইশ দিন জ্বর নিয়ে বিছানায় কাতরিয়েছে বেচারি। ক্রমান্বয়ে অবস্থার অবনতি হলে গ্রাম্য কবিরাজের পরামর্শে কলপোনাত পাতার রস বানিয়ে জোর করে মুখে ঢেলে দেয় ফজল আলী। তিক্ততার বিস্বাদে পুরো মুখম-ল বাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে সেই রস গলধঃকরণ করেছিলো ঠিকই তবে নাড়িভুঁড়ি জায়গামতো ছিলো কি না কে জানে। পরে অবশ্য ভয়ে সেই যে জ¦র পালিয়ে গিয়েছে আজ অবধি এই বাড়ির ত্রিসীমানার ভেতরে প্রবেশ করার সাহস পায় নাই।
বাড়ির চারিদিকে শক্ত মজবুত করে ঘেরার পরেও নাছোড়বান্দা ভিক্ষুকদের আনাগোনা এতোটুকু কমে নাই। দুশ্চিন্তায় ফজল আলীর কেশবিহীন দীর্ঘ কপালে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কয়েকটি রেখা ফুটে ওঠে। নিরবচ্ছিন্ন ভাবনায় অতিক্রান্ত হয়ে যায় কয়েকটি রাত। চোখের পাতা থেকে নিদ্রা বা তন্দ্রার আনাগোনা পালিয়ে যায় দূরের কাঁটাবনে। খেজুরের মাদুর বিছানো শক্ত বিছানায় সারা রাত এপাশ ওপাশ করতে করতে অবশেষে ফজল আলীর মাথায় খেলে যায় এক অভিনব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। রাস্তার ধার থেকে তার দেউড়ি পর্যন্ত ছিলো দশ হাত নিজস্ব জমি অর্থাৎ মূল রাস্তা থেকে ১০ হাত ভেতরে তার বাড়ির অবস্থান। রাস্তা এবং বাড়ির দিকে দেড় হাত করে তিন হাত জায়গা ফেলে রেখে সাত হাত চওড়া এবং চার হাত গভীর একটি গর্ত খনন করার ভাবনা তার মাথায় আসে।
যেই ভাবা সেই কাজ। গর্ত খননের পরে নিজের ঝাড় থেকে কিছু আধপাকা বাঁশ কেটে আট হাত দীর্ঘ একটি চাঙ তৈরি করে। নিজের প্রয়োজনে গর্তের ওপর চাঙ ফেলে বাহিরে যাওয়া আবার প্রয়োজন শেষে চাঙ ফেলে বাড়িতে ঢোকা নিত্যকাজে পরিণত হয়। মাঝের সময়টুকুতে চাঙ তুলে রাখার অঘোষিত দায়িত্ব তার স্ত্রীর কাঁধেই বর্তায়। ভাবনার আরোও গভীরে গিয়ে মাঝে একদিন পাশের গ্রাম থেকে বাবলার বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত ডাল এনে গর্তের ভেতরে ফেলে রাখে। যাতে কোন অবাধ্য চালাক ফকির বা পাড়ার দুষ্টু বালকের দল তা ডিঙিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে না যেতে পারে। তার স্ত্রী অবশ্য মাঝে মাঝে তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে নাই বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু ফজল আলীর কৃপণতার কাছে বউয়ের সমস্ত নীতিবাক্য নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়।
মাস যায় বছর যায়। অবাঞ্ছিত লোকের আনাগোনা বন্ধ হওয়ায় ফজল আলী নিশ্চিন্ত হয়। ওদিকে আধপাকা বাঁশে ঘুণ লেগে হালকা হতে থাকে। কিন্তু ফকিরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেয়ে ফজল আলীর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। প্রতিদিনের মতো বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চাঙের ওপর পা রাখার সাথে সাথে হুড়মুড় করে ভেঙে গর্তের ভেতর পড়ে যায় ফজল আলী। নিচে গচ্ছিত বিষাক্ত বাবলার পচা কাঁটায় মুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় তার কঙ্কালসার দেহটি। অস্ফুট স্বরে ভেসে আসে একটি করুণ আর্তনাদ, ‘ওরে আমার ফুলটসি’ যা আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে প্রবেশ করে নিকট কর্মব্যস্ত মানুষের কর্ণকুহরে। প্রতিবেশীরা ছুটে এসে অনেক কষ্টে গর্ত থেকে টেনে তুলে আনে তাকে। কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে যায় অনেক। গর্তের পাড়িতে পরে থাকে ফজল আলীর রক্তাক্ত নিথর দেহটি। নিস্তব্ধ দেহের ওপর ধপাস করে পড়ে যায় এক অবলা অসহায় নারীর জীবিত শরীর। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিবেশীরা দু’টি কবর খোঁড়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন।
Share.