তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়ো?
আমি পড়ি না।
স্কুলে যাও না?
উহুঁ।
কী করো তাহলে?
ঘুরে বেড়াই। ইচ্ছেমতো খাইদাই আর ফুটবল, ক্রিকেট, দাঁড়িয়াবাধা ইত্যাদি খেলি। তোমার মা-বাবা, তারা কোথায়?
জানি না।
তুমি কি একাই থাকো?
হুঁ।
একাই কথা বলছে তিন্নি। নিজে নিজের সাথে। হাবীব সাহেব প্রাইভেট পড়াতে এসে বিষয়টা লক্ষ করলেন। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুকের উপর দুটি হাত রাখা। আড়াআড়ি ভাবে। মনে হয় শীত লাগছে। শীতকালে শীত লাগার কথাই। তিনি নিজেই কতোগুলো কাপড় পরে এসেছেন। তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
কাঁপছো কেন? শীত লাগছে বেশি?
হুঁ। এখন খুব শীত করছে।
তুমি এভাবে কেন? এতোক্ষণ তো পড়তে বসার কথা।
এমনি। আপনি বসুন, আমি রেডি হই। বারান্দার চেয়ার ছেড়ে উঠলো তিন্নি। অন্য ঘরে গেলো। স্যার হাবীব চিন্তায় ডুবে গেলেন। হরিণের মতো চঞ্চলা মেয়েটা এমন করছে কেন? মাথাটা খারাপ হয়নি তো?
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। হাবীব সাহেব আঁতকে উঠলেন। তিন্নিকে আসতে তাড়া দিলেন। বুয়া রান্নাঘর ছেড়ে দরজা খুলতে বেরুলো। ওর মা বাবা এসেছে অফিস থেকে। প্রতিদিনই এমন সন্ধ্যায় আসে। মাঝে মাঝে লেট করেও আসে। জ্যাম সমস্যা আজ প্রায় সমগ্র দেশে। তিনি তিন্নির বিষয়টা তাদের বলতে চাচ্ছিলেন। পরক্ষণে ভাবলেন কী মনে করবে? বলারই বা কী দরকার? সম্ভবত এটা কোনো রোগ নয়। অধিক কল্পনা। ছোটো মেয়ে তো! আর ছোটোবেলায় মানুষ কতো কিছুই না করে।
আসলে হয়েছে কী? তিন্নির মনে বড়ো দুঃখ। তার ভাই-বোন নেই। নেই কোনো বন্ধু। বাবা-মা সকাল হলেই যায় অফিসে। বিশাল বাড়ির ভেতরেই সারাটা দিন কাটে তার। বাড়িতে বুয়া আছে। শুধু পান চিবায়। তাকে পান বুড়ি বললেও ভুল হবে না। দারুণ পানখোর এই মহিলাকে তিন্নির পছন্দ হয় না। বাড়িতে কতো খাবার-দাবার! কতো খেলনা সামগ্রী তবুও সে অসুখি। কোনো বন্ধু নেই মনের সুখ-দুঃখের দু’টো কথা বলে সময় কাটানোর জন্য। বাড়ির পূর্বপাশে খুব সুন্দর একটা বাগান। সেই বাগানে কতো নাম না জানা গাছ, কতো ফুল! কিন্তু ফুলের বাগানেও তিন্নির ভালো লাগতো না। তার কোনো বন্ধু নেই যে! একদিন বিকালে সে দেখতে পেলো সেই বাগানের এক কোণায় ফুটে রয়েছে চমৎকার একটা ফুল। ছোট্ট ফুলটিকে তার মনে ধরলো! তিন্নি বললো ছোট্টো ফুল তুমি আমার বন্ধু হবে? না, তা কি করে হয়? তুমি মানুষ। বড়োলোকের একমাত্র আদুরে কন্যা। আর আমি সামান্য এক ঘাসফুল! তাতে কি হয়েছে? তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তা হয় না সোনামনি। আমি বাগানের কোণায় অনাদরে ফোটা এক ফুল! তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে কিভাবে? তা ছাড়া আজ রাতেই আমি ঝরে পড়ে যাবো। আমি চাইলেও তোমার বন্ধু হতে পারি না।
তিন্নির কচি মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। সে বুকের ভেতর দারুণ নিয়ে ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো।
দুই দিন অভিমানে বাগানে গেলো না সে। তৃতীয় দিন আবার গেলো। দেখা পেলো ছোট্ট একটা পাখির। ছোট্ট সুন্দর পাখি। কী ঝলমলে রঙিন ডানা। এ গাছ থেকে ও গাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাহ্, দারুণ ব্যাপার তো! কি চমৎকার ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায় যে দিকে মন চায়! আমিও যদি অমন হতে পারতাম। ভাবতে ভাবতেই সে পাখিকে তার বন্ধু হতে অনুরোধ করলো। আদুরে স্বরে বললো ছোট্ট পাখি, ও প্রিয় পাখি! তুমি কি আমার বন্ধু হবে?
না ভাই, মানুষের বন্ধু হয়ে কাজ নাই!
কিন্তু কেন? ভারী অবাক হলো তিন্নি। আকাশের সাথে আমার মিতালি। বাতাসে ভর করে আমি ভেসে বেড়াই আপন মনে! বিল্ডিংয়ে আমার মন টিকবে না। তাছাড়া মানুষ অনেক দুষ্টু। এই তো সেদিন এক মানুষ আমার এক ভাইকে ধরে তার ডানা ভেঙে দিয়েছিলো।
তুমি যা চাইবে তোমাকে তাই দেবো। তোমাকে আদর করবো। মজার মজার খাওয়াবো। তবু আমার বন্ধু হও। প্লিজ! প্লিজ!
তুমি কি আমাকে খোলা আকাশ দিতে পারো! লাল সবুজ প্রকৃতি, স্বচ্ছ বাতাস, ফুলের মুগ্ধকর সুবাস! না তুমি দিতে পারবে না। তাই বলি কি ভাই, তুমি বরং অন্য কাউকে দেখো!
এবার তিন্নি সত্যি খুব কষ্ট পেলো। কেউ তার বন্ধু হতে চায় না। তার মন এক্কেবারেই ভেঙে গেলো। পরদিন ঝলমলে বিকেল। সে ছাদে উঠলো। মন খারাপ করে বাইরে বৃষ্টি দিলো। বাইরে কি সুন্দর খোলা প্রান্তর। প্রশস্ত রাস্তাঘাট। বিভিন্ন যানবাহন ও কল্পনায় দেখলো বয়ে চলা নদী। নদীর ঢেউ, মাছ ধরা জেলেদের ক’খান নৌকা। আর নদীর ধারে লাল ফুল ফুটে থাকা বিশাল একটা গাছ। থোকা থোকা লাল ফুল! ইশ, ওই লাল ফুলগুলো যদি আমার বন্ধু হতো! এমন সময় বুয়া এলো। ভাবনা ভঙ্গ হলো। সে বললো স্যার ডাকছে। নিচে নেমে এসো। কিন্তু ও গেলো না। শেষে স্যার হাবীব এলেন। বললেন তিন্নি তোমার কষ্ট আমি কিছুটা বুঝি। কেউ তোমার বন্ধু হতে চায় না। তাই তোমার এতো দুঃখ। চলো নিচে যাই। তোমার জন্য বইমেলা থেকে বই এনেছি। বই তোমার বন্ধু হবে। উপকারী বন্ধু। সব সময়ের জন্য। স্যার হাবীব খুব ভালো মানুষ। সচেতন। উচ্চ শিক্ষিত। ভালো পড়ান। সুনাম আছে চারদিকে। তিন্নির বাবার অনুরোধে তিনি তিন্নিকে পড়ান। তিনি প্রাণের বইমেলায় যান আজ। বই কিনেন অনেক। ক্লাস ফাইভ পড়–য়া তিন্নির জন্যও নিতে ভুলেননি। নিচে সোফায় বসেই তিনি তাকে গল্পের বই দিলেন- ‘ঘাসের বনে কাটুস কুটুস- আমিরুল ইসলাম’, ‘আমি বাবার লাল পরী-ওবায়দুল সমীর’, ‘বায়োস্কোপ- ফারুক নওয়াজ’, ‘কাঠঠোকরা কাঠবিড়াল- শামীম খান যুবরাজ’, ‘নতুন দিনের গল্প শোনো- নকীব মাহমুদ’, ‘কমন স্যার- শাহ আলম বাদশা’ ইত্যাদি। ছড়ার বই দিলেন- ‘মায়ের কাছে যাবো- খালেক বিন জয়েনউদ্দিন’, ‘টুনটুনিটা দুষ্টু অতি- আমিন হানিফ’, ‘এই ছেলেটা সেই ছেলেটা- হাসান আল মাহমুদ’, ‘মিষ্টি কথার খই- শরিফ আহমাদ’, ‘আম পড়েছে আধখানা- শরিফ আহমাদ’, ‘জোনাক জ্বলে কদমতলে- মঈন মুস্তাকিম’, ‘সূর্যিমামার রোদ চিঠি- ফয়েজ হাবীব’ ইত্যাদি।
নতুন বইয়ের কড়কড়ে পৃষ্ঠা দেখছিলো তিন্নি। হঠাৎ পলাশ ফুলের উপর দৃষ্টি আটকে গেলো তার। বললো কি সুন্দর ফুল! বাস্তবে ফুলগুলো দেখতে চাই। আপনি আমায় বলবেন কিভাবে ওই ফুলগুলোর দেখা পাবো? ওই যে বড়ো গাছটার লাল ফুলগুলো! ওগুলোর নাম কী? ও তো পলাশ ফুল! ওই যে থোকা থোকা ফুটে রয়েছে লাল পলাশ! হ্যাঁ,
আমি ওই পলাশ ফুলের বন্ধু হতে চাই। বেশ তো, তুমিও বন্ধু হবে। আমিও পলাশ ফুলের বন্ধু। অনেকেই পলাশ ফুলের বন্ধু। কিন্তু কেন? আরও তো ফুল আছে! কারণ পলাশের রঙ লাল। লাল রঙ দেখে ভাষা শহীদ রফিক, সালাম, বরকত, জব্বাদের মনে পড়ে। সেইসব মহান শহীদের রক্তেই বুঝি পলাশের রঙ লাল। শহীদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতেই বুঝি পলাশের রঙ লাল। শহীদের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই হয়তো পলাশের রঙ লাল! তাইতো ফাল্গুন এলেই, ফেব্রুয়ারি এলেই ফোটে এই ফুল। স্যারের কথাগুলো তার খুব লাগলো।
আচ্ছা স্যার, তাহলে পলাশ ফুলকে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসবো। কিন্তু অন্যগুলো?
অন্যগুলো বাদ নয়! তুমি বরং গোলাপ, বেলি, হাসনাহেনা, জুঁই, সূর্যমুখী, কদম ইত্যাদি সব ফুলকে ভালোবাসবে।
ভালবাসবে চাঁদ-তারা, নদী-নালা, লাল-সবুজ প্রকৃতিকে। এভাবেই দেশের প্রতি ভালোবাসা হবে। আদর্শ নাগরিক হবে। স্যারের কথা শুনে, নতুন নতুন বই বন্ধু পেয়ে তিন্নি খু-উ-ব খুশি হলো। বললো- জি স্যার, আপনার কথা মানবো ইনশাআল্লাহ।

Share.

মন্তব্য করুন