ছয়.
ওরা আবার ট্যাক্সি নেয়। তখন সন্ধ্যা নামছে। পাখির ডাকে মুখরিত চারদিক। নিউটনের মনে পড়ছে ওদের বস্তির পাশে আমগাছের ডালে যে নাম না জানা পাখিটা বসে থাকে সেটার কথা। মনে পড়ছে মায়ের কথা। মা এখন কি করছে? একদিকে মৌটুসি বলেছে এক লহমায় সে নাকি তাকে পরীরাজ্য ঘুরিয়ে আনবে অথচ সকাল হচ্ছে, বিকেল হচ্ছে, সন্ধ্যা নামছে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না মৌটুসির কথা।
: আনমনা হয়ে কি ভাবছ এত? মৌটুসি বলে,
নিউটন জবাব দেয় না।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ট্যাক্সি থামে।
ওরা নামে গোলাকৃতির ছাদওয়ালা একটা বাড়ির সামনে। মৌটুসি বলে,
: এটার নাম নভোথিয়েটার। আর একটা নামও আছে ‘বিড়লা প্লানেটরিয়াম।’ এদেশে বিড়লা নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অনেক কাজ করে গেছেন মানুষের জন্য। মন্দির বানিয়েছেন, হাসপাতাল বানিয়েছেন আরও কত কি। বড়লোক তো কতই থাকে, কিন্তু মানুষের সেবায় অর্থ ব্যয় করে কয়জন। কিন্তু দেখ যারা অর্থের পাহাড় রেখে মারা গেছেন তাদের নাম কেউ নিচ্ছে না। নিচ্ছে বিড়লার নাম। কেন? কারণ তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। কথাটা মনে রাখবে কেমন। তুমি একটু এখানে দাঁড়াও, আমি টিকেট কেটে আনি।
প্লানেটরিয়ামের সামনের গাছগুলোর চারপাশ গোল করে বাঁধানো। নিউটন সেখানে বসে ভাবতে থাকে, পরী কন্যা কত ভাল। তাকে কত কত জায়গায় ঘুরাতে নিয়ে যাচ্ছে, কত কিছু খাওয়াচ্ছে। যা জীবনে কখনও সে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর কত টাকা তার জন্য খরচ করছে মৌটুসি। যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই তো টিকেট লাগছে। ওর ভাবনার মাঝেই মৌটুসি এসে যায়। বলে,
: চলো শোর সময় হয়ে গেছে।
: শোর সময় মানে, এটা কি সিনেমা হল নাকি?
: ওই ধরনেরই, তবে সায়েন্সের সিনেমা। দেখলেই বুঝতে পারবে।
ওরা গ্যালারিতে ঢুকে বসে। বিশাল একটা হলে। গোলাকৃতির। মাঝখানে অনেক বড় এটা যন্ত্র। একটু পরেই শো শুরু হয়। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। অজানা অচেনা জায়গায় নিউটনের গা ছমছম করে। ও মৌটুসির হাত চেপে ধরে। মৌটুসি ওর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলে,
: ভয়ের কিছু নেই। এই শো দেখাতে হলে ঘর অন্ধকার করতে হয়। এর পর অন্ধকার আরো ঘন হবে। তুমি ভয় পেও না।
ওর কথা শেষ হবার আগেই নিউটন অবাক হয়ে দেখে তার সামনে তারাজ্বলা আকাশ। সে আকাশে একে একে ফুটে উঠতে থাকে গ্রহ নক্ষত্র। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। ইংরেজিতে কেউ বর্ণনা দিচ্ছে কী দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার একবিন্দুও নিউটন বুঝতে পারছে না। ওর কান্না পেতে থাকে, কেন যে সে ইংরেজি জানে না। প্রথমে সূর্যাস্ত হল। তারপর একে একে আকাশ ভরে উঠল গ্রহ নক্ষত্রে। বিজ্ঞানের নিয়মে যেভাবে ওঠে সেভাবেই হল। শো এগিয়ে গেল, তারপর সূর্যোদয় দেখিয়ে শো শেষ হল।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এল নিউটন। এমন বিস্ময়কর ব্যাপার যে কখনও হতে পারে সে কখনও ভাবেনি। একটা ঘরের মধ্যে নেমে আসতে পারে আকাশ চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র! ও কোন কথা না বলে হাঁটতে থাকে। মৌটুসি সেটা লক্ষ করে বলে,
: কি হল শো ভাল লাগেনি?
: খুব ভাল লেগেছে, কিন্তু ইংরেজিতে কি বলল কিছুই বুঝলাম নাতো তাই মন খারাপ লাগছে। সত্যিই আমি একটা মূর্খ।
: আরে অত মন খারাপ করো না। ইংরেজি না জানলেই মূর্খ হয় নাকি! সবার আগে জানা দরকার, নিজের ভাষা, নিজের মাতৃভাষা। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় মনীষী ছিলেন যারা ইংরেজি জানতেন না, কিন্তু তারাই বেঁচে আছেন তাদের কীর্তির মাধ্যমে। আর যারা গড় গড় করে ইংরেজি বলতেন তারা কোথায় হারিয়ে গেছেন কেউ জানে না, কেউ তাদের নামও করে না।
: তবুও।
: তবুও কি ?
: না মানে শোতে কি বুঝালো বুঝলাম নাতো তাই।
: অসুবিধা নেই তুমি চাইলে আমি বুঝিয়ে দেব। আর হ্যাঁ শোন আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাদের দেশেও নভোথিয়েটার আছে। সেখানে বাংলায় ধারা বর্ণনা করা হয়। একদিন দেখে নিও তাহলে সব বুঝে যাবে। হ্যাঁ ওটা হচ্ছে তেজগাঁয়। বিজয় সরণি দিয়ে একটু এগোলেই বাম হাতে। ওখানে টিকেটের দাম মাত্র একশো টাকা। আর যে আগে যাবে সে আগে টিকেট পাবে। যে কোন শনিবার যেও। ১১টা, ১টা, ৫টা ও ৭টা সময় শো হয়। অন্যদিন কখন হয় আমি ঠিক জানি না। অবশ্য নেটে সার্চ করে তোমাকে বলতে পারি। কিন্তু অত ঝামেলার দরকার কি তাই না। তোমাদের দেশের নভোথিয়েটারের নাম ‘বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার’। আগে ওটার নাম ছিল ভাসানী নভোথিয়েটার। ওটা ৫.৪৬ একর জমির ওপর অবস্থিত। আর গোলাকৃতি যে জিনিসটা এখানে দেখলে যাকে বলে ডোমাকৃতি ওটার উচ্চতা ২১ মিটার। একসাথে ২৭৫ জন বসে শো দেখতে পারে। শোন ওখানে তিন ধরনের শো হয়। প্রথমটা হচ্ছে, ‘জার্নি টু দি ইনফিনিটি’। ওটা এখানকার শোর মত। তারা গ্রহ নক্ষত্র আর বেহেশতি জিনিসের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। ভার্চুয়াল বুঝলে না তাই না? আমিও যে ঠিক বুঝি তা না। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে আছে কিন্তু নেই এমন। যেমন, ধরো এখানে তোমার চোখের সামনে তারাজ্বলা আকাশ তারা চাঁদ সূর্য আছে, তুমি দেখলে কিন্তু আসলে ওরা কিন্তু ওখানে নেই। আর রিয়েলিটি হচ্ছে বাস্তবতা। এটা একটা শো। আর একটা শোর নাম ‘এই আমাদের বাংলাদেশ।’ এ শোতে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ও বলার সাথে সাথে হাততালি দিয়ে ওঠে নিউটন,
: তুমি এটাও জানো। তুমি কত ভাল!
: কী কা- জানব না কেন, এটা তো কালজয়ী ভাষণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। ও তুমিতো আবার কালজয়ী জানে না। কালজয়ী মানে সব কালেই যা জয়ী হয়, যা কালকে জয় করেছে, যা কখনও মরে না। হ্যাঁ তৃতীয় আর একটা শো দেখানো হয়। যেখানে দেখানো হয় বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ক্যানিওন’। এ ছাড়া ওখানে থ্রীডি সিনেমাও দেখানো হয়। এখানকার থেকে তোমাদের নভো থিয়েটার ভালো। তুমি খেয়াল করোনি এখানে যারা পূর্ব পাশে বসেছিল তারা ডেমনেসট্রেশনের সব ছবি মিস করেছে। সব ছবি পশ্চিম পাশে দেখানো হয়েছে তখন। এটা একটা বড় সমস্যা। তুমি তোমার দেশের নভোথিয়েটার দেখে নিও কিন্তু। তোমার জ্ঞান অনেক বাড়বে।
: কিন্তু।
: আবার কিন্তু কি, টিকিটের টাকার কথা ভাবছ? মাত্র তো একশো টাকা। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব।
প্রবলভাবে আপত্তি করে ওঠে নিউটন।
: না না কিছুতেই না। এই যে তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরছ, ভালো ভালো খাবার খাওয়াচ্ছ এটাই যথেষ্ট। এটা নেয়াও উচিত না। আব্বা বলেন, যা তোমার রোজগার না তা কখনও নেবে না।
: ধরো তুমি একটা লটারি জিতলে কিংবা তোমাকে কোন অ্যাওয়ার্ড দেয়া হলো সেটা তুমি নেবে না? সেটাও তো তোমার রোজগার না।
: লটারির ব্যাপারটা আলাদা, তবে নেয়া যেতে পারে। ওটাও তো নিজের টাকায় কেনা টিকেটে বা কুপনে হয়। তা ছাড়া অ্যাওয়ার্ড নিশ্চয়ই কোনো ভাল কাজের জন্য দেয়া হয়। নিশ্চয়ই কোন মেধার বা প্রশংসার কাজ। ওটা নিতে আপত্তি কি। কিন্তু তাই বলে তুমি খামোখা পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে আর আমি নেব সেটা কখনই হবে না।
: আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, অত উত্তেজিত হয়ো না। নিতে হবে না তোমাকে। চলো এবার এগোই।
ওরা এগোয়। নভোথিয়েটারে থাকা অবস্থায় যে বৃষ্টি হয়েছে ওরা তা বুঝতেও পারেনি। রাস্তাগুলো ভেজা ভেজা। গাছের পাতা দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। আর পাতাগুলো পানিতে ধুয়ে একেবারে সতেজ সবুজ। ঢাকার গাছে অবশ্য অনেক ময়লা থাকে। কিন্তু বৃষ্টির পানি পেলে এমনই হয়। বৃষ্টি নিউটনের দারুণ পছন্দ। বৃষ্টিতে লুটোপুটি করে ফুটবল খেলা, বৃষ্টির কাদা পানিতে গড়াগড়ি খাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে ঝাঁপ দেয়া এসব ওর ভীষণ প্রিয়। কিন্তু ঢাকা শহরে কোথায় ও খেলার মাঠ পাবে, আর সাঁতার কাটার জন্য পুকুর পাবে। তবুও সুযোগ পেলেই ও বৃষ্টিতে ভেজে। ও যত ভেজে মা তত বকে। একবার তো বৃষ্টিতে ভিজে একশ চার ডিগ্রি জ্বর বাধিয়ে বসেছিল। সে জ্বর কিছুতেই কমে না। প্রথম দিকে পানি পড়া তেলপড়া দিলেও পরে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়েছিল। তাতেও সুস্থ হয়ে উঠে বসতে পনের দিন লেগে গিয়েছিল। আর ওই পনের দিনে মায়ের দুটো বাসার কাজ চলে গিয়েছিল। আর আব্বা ধারকর্য করে যে চিকিৎসা চালিয়ে ছিলেন সে টাকা শোধ করতে অনেকদিন লেগেছিল। জ্বরের সময়টাতে যখনই চোখ মেলেছে, ও দেখেছে উদ্বিগ্ন আব্বা মা ওর শিয়রে বসা। মা হয় মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন না হয় গামছা দিয়ে গা মোছাচ্ছেন। আর আব্বা ক্রমাগত বলে চলেছেন,
: কি কষ্ট বল দেখি বাবা, কি কষ্ট?
ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর মা মাগুর মাছের ঝোল, চিকন চালের ভাত আর কবুতরের মাংস রান্না করে দিয়েছিলেন। ওসব কোথা থেকে যে জোগাড় হয়েছিল কে জানে। ও সেরে ওঠার পর মা একদিন চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন,
: দেখ বাবা তুই সেরে উঠেছিস এটা আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। তবে বাবা আর কখনও বৃষ্টিতে ভিজিস না। আমরা বড়লোক না, ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনার পয়সা আমাদের নেই। আর কাজ চলে গেলে আর একটা কাজ জোগাড় করতে খুব অসুবিধা হয়। সাবধানে থাকিস বাবা, একটু বুঝে চলিস।
মার কথাগুলো বুঝেছিল নিউটন। সেই থেকে ও চেষ্টা করে বৃষ্টিতে না ভিজতে। তবে বৃষ্টি দেখলেই ওর মন নেচে ওঠে। আজও নেচে উঠল। তবে এখন আর বৃষ্টি নেই। ও মৌটুসিকে বলল,
: গাছের পাতাগুলো কি সুন্দর দেখ!
: খুব সুন্দর। আচ্ছা এখন কোথায় যাওয়া যায় বলত? একটু ভেবে বলে, চলো দীঘায় যাই।
: দীঘা সেটা আবার কোথায়? এখন আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
: চলো দীঘাটা তো দেখি। তারপর কোথাও যেতে ইচ্ছে না হলে যাবে না। চলো।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে গড়ের মাঠে এসে দাঁড়ায়। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ডানা বের করে মৌটুসি। মেলে ধরে,
: চটপট আমার ডানায় বসো। মানুষ দেখলে রক্ষা নেই। অনেক ওপর দিয়ে মানে মেঘের ওপর দিয়ে উড়ব।
: কেন শুনি ওখানে কি বাস ট্রেনে যাওয়া যায় না? আর জায়গাটা কোথায়? ওখানে দেখারই বা কি আছে?
: আরে আছে আছে, দেখার অনেক কিছু আছে। না থাকলে কি যেতাম বল। দীঘা হচ্ছে কলকাতার সাগর পারের রিসোর্ট সিটি। কলকাতা থেকে রেল সড়ক দুই পথেই যাওয়া যায়। ভাল ভলভো বাস আছে। কলকাতা থেকে মাত্র ১৮৭ কিলোমিটার দূরে। গেলেই বুঝবে জায়গাটা কত সুন্দর। তুমি হয়ত ভাবছ এত অল্প পথ আমি কেন তোমাকে ডানায় করে নিয়ে যাচ্ছি। নিয়ে যাচ্ছি কারণ ওপর থেকে তুমি সমুদ্র দেখতে পারবে। ট্রেনে বা বাসে গেলে সেটা পারবে না।
উড়তে লাগল মৌটুসি। আগে ভয়ে মেঘ ধরত না নিউটন। এখন বেশ কয়েকবার উড়ে ওর সাহস বেড়ে গেছে। ও হাত দিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। কী কান্ড মুঠো খুলে দেখে কিছু নেই। অথচ ওরা ঠিকই ভাসছে। কেমন ম্যাজিকের মত মনে হয় নিউটনের। মৌটুসি যেতে যেতে বলে,
: তোমাদের দেশে কক্সবাজার নামে একটা জায়গা আছে জানো? নিশ্চয়ই জানো না। তুমি তো আবার কিছুই জানো না।
‘জানি জানি’ বলে চেঁচিয়ে উঠল নিউটন। আর সেই আবেগের আতিশয্যে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। জোরে আঁকড়ে ধরল মৌটুসিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল,
: উহ আল্লাহ, পড়ে গেলাম
: তোমাকে আগেও বলেছি অত উত্তেজনা ভালো না, আবেগও ভালো না। জানো ভাল কথা। ওটা তোমার দেশ, তুমি জানবে সেটাই স্বাভাবিক।
: তাহলে তুমি যে বললে, আমি কিছু জানি না। কক্সবাজারে সমুদ্র আছে।
: সমুদ্র আছে ওটুকু জানো। ওর বেশি কিছু জানো না। আমিও যে খুব জানি তা না। তবু যেটুকু জানি তোমায় বলছি। কক্সবাজার জায়গাটা বিচের জন্য বিখ্যাত। বিচ বোঝ তো? ওটা হচ্ছে সমুদ্রের পাড়। যাকে ভালো বাংলায় বলে সৈকত। জায়গাটা চিটাগাং শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওটা বিশ্বের বৃহত্তম সিবিচ। বিষবাকলি নদী আর বঙ্গোপসাগরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। বিচের মোট আয়তন ১২৫ কিলোমিটার। ভাবতে পারছ কত দীর্ঘ ওটা। ওই বিচ বালুময় আর সামান্য ঢালু আকৃতির। দেখতে যে কী মনোরম! ছুটি কাটাতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা ওখানে যায়। ওহ তুমি তো আবার পর্যটক বোঝ না। কি করে যে বোঝাই। আচ্ছা ধরে নাও বেড়াতে আসে, ওটাই পর্যটন। ও বিচ শার্কমুক্ত। আর পানি গোসল করার উপযোগী।
: কিন্তু আমি শুনেছি সমুদ্রের পানি লোনা। ওই পানি শুকিয়ে নাকি লবণ বানায়।
: লোনা তো অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ গোসল করে না। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ আসে সূর্য¯œান করার জন্য। সূর্য¯œান বোঝতো ? অবশ্য ওটা তোমার বোঝার কথা না। ওটা হচ্ছে সূর্যের আলোয় গোসল। বিদেশিরা বিচে শুয়ে শুয়ে সূর্যের আলোয় চামড়া পোড়ায়। ওতেই ওদের আনন্দ। এই ব্যাপার অবশ্য আমি থাইল্যান্ডের পাতাইয়াতেও দেখেছি। অসংখ্য মানুষ তোয়ালে পরে বালির ওপর শুয়ে আছে। সেখানে অবশ্য ব্যবস্থা অনেক উন্নত। গোসলের পর নোনাপানি ধুয়ে ফেলার জন্য মিঠে পানির অনেক বাথরুম আছে। কক্সবাজার সমুদ্রে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আর একেবারে মুক্ত হাওয়া। বড় বড় ঢেউ এসে বিচে আছড়ে পড়ে। জোয়ারের সময় পানি বাঁধের ওপর পর্যন্ত উঠে যায়। আবার ভাটায় সে পানি নেমে যায়। কী যে সুন্দর না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ঢাকা আর চিটাগাং থেকে বাস ট্রেন লঞ্চ বিমান সবকিছুতেই যাওয়া যায়।
মৌটুসি থামে। নিউটন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। এত সুন্দর জায়গা আছে তার দেশে আর সে কিছুই দেখল না। মৌটুসি থামতেই ও বলে,
: থামলে কেন বল। আমার শুনতে খুব ভাল লাগছে।
: এই প্রথম কোন জায়গা সম্পর্কে তোমার এতটা উৎসাহ দেখছি। শোন কক্সবাজারের নাম হয়েছে রে, কক্সের নামানুসারে। ১৭ সেঞ্চুরিতে আরাকানরা বার্মা দখল করার পর যিনি বহু বার্মিজ মানুষকে এখানে পুনর্বাসিত করেন। কক্সবাজারের সব জায়গা সুন্দর হলেও বিশেষ আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে হিমছড়ি, সোনাদিয়া দ্বীপ ও রামু। হিমছড়ি সাউথ বিচ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। এখানে আছে ব্রকেন হিল ও ঝরনা। আর আছে ক্রিস্টমাস ট্রি। রামু কক্সবাজার চট্টগ্রাম মেইন রোডে, কক্সবাজার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। ওটা বৌদ্ধদের গ্রাম। অনেক বৌদ্ধ মন্দির আছে ওখানে। আর আছে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি যা সোনা ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য মূল্যবান পাথরে নির্মিত। বাকলি নদীর পাশে টাইগার ক্যানেল। কক্সবাজারের ৮০ কিলোমিটার সাউথে টেকনাফ অবস্থিত। সে আর এক দর্শনীয় স্থান। নাফ নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গার বড় আকর্ষণ সাম্পানে ভ্রমণ করা। আর সেন্ট মার্টিনস হচ্ছে দেশের একমাত্র কোরালদ্বীপ। যার নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ গভর্নর সেন্ট মার্টিনের নামে। স্থানীয় লোকের ভাষায় এ জায়গার নাম ‘নারকেল জিঞ্জিরা।’ এ দ্বীপের আয়তন ৫ স্কয়ার কিলোমিটার। এখানে প্রচুর নারকেল গাছ রয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির সেল ও মাদার অব পার্ল কোনস সেল এখানে পাওয়া যায়। আর ছেঁড়া দ্বীপে মসৃণ পানির ২০ ফিট নিচে জীবন্ত কোরাল পাওয়া যায়।
: বলছ কি তুমি! আবারও চিৎকার করে ওঠে নিউটন,
: ঠিকই বলছি। যাক আর কথা বলার সময় নেই। আমরা দীঘায় এসে গেছি। এবার নামব। সাবধান। গাছপালার ডাল টাল দেখলে আমাকে বলবে আর নিজের মাথা বাঁচাবে।
ওরা একটা বাঁধানো জায়গা দেখে নিচে নেমে আসে। মৌটুসি দ্রুত তার ডানা লুকিয়ে ফেলে। তারপর নিউটনের হাত ধরে এগোতে থাকে। বিচে প্রচুর মানুষ। কেউ ঘুরছে, কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ ডলফিনের খেলা দেখছে। ওরা টিকেট কেটে ডলফিনের খেলা দেখতে ঢোকে। নিউটন অবাক হয়ে দেখে মাছের মত এক ধরনের জিনিস পানি থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে উঠছে, নাচছে, বল খেলছে। একসাথে নিয়ম করে চারটা একসাথে উঠছে। এক অ™ু¢ত ব্যাপার। ও দেখে, ওর চোখের পলক পড়েনা। মৌটুসি সেদিকে তাকিয়ে হাসে। বলে,
: খুব অবাক হচ্ছ তাই না? অবাক হবার কিছু নেই। যে কোন প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিলে সে সব কিছু শিখে নিতে পারে। দেখ না কুকুর কেমন বাড়ি পাহারা দেয়, মোরগ কেমন লড়াই করে, বাদর কেমন খেলা দেখায়, পাখি কেমন কথা বলে। শুধু কি তাই, কুমির ভল্লুক হাতি বাঘ সাপ সবাই খেলা দেখাতে পারে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওই যে বললাম ট্রেনিং। অনেক সময় দেখা যায় যাদের হাত নেই তারা পা দিয়ে লেখে, সবজি কাটে। কিভাবে বলত? প্রশিক্ষণ। আর সাথে থাকতে হয় ধৈর্য, যে দেবে আর যে নেবে দুজনেরই। মনে রাখবে ধৈর্য আর পরিশ্রম সব উন্নতির চাবিকাঠি।
নিউটন হাসে। মৌটুসি এমন ভাবে কথা বলছে যেন ও ওর মাস্টার। অথচ বয়স ওর থেকে বড়জোর দু-এক বছর বেশি হবে।
: কী ভাবছ?
: ভাবছি তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি আমার মাস্টার। আমার থেকে কত্ত বড়।
: দেখ বড় ছোট বলে কথা না। কথা হচ্ছে ভাল কথা বলছি কিনা। এই ধর তোমার কাছ থেকেও তো আমি কত কিছু শিখলাম। এই যে একটু আগে তোমাকে আমি টাকা দিতে চাইলাম। তুমি নিতে অস্বীকার করলে। বললে, অন্যের জিনিস নিতে নেই। নিজে পরিশ্রম না করে যা পাওয়া যায় সেটা রোজগার নয়। এটাও তো একটা বড় শেখার বিষয়। আমি তোমার কাছ থেকে শিখলাম। জানো এই কয়দিনে আমি তোমার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু শিখেছি।
ততক্ষণে ডলফিনের খেলা শেষ হয়েছে। ওরা বিচটা ঘুরে ঘুরে দেখে। প্রচুর বিদেশি বিচে ঘুরছে। কী চমৎকার তাদের পোশাক! ওদের কাছে নিজের পোশাকটা মলিন মনে হয় নিউটনের। ভাবামাত্র ওর পোশাক বদলে যায়। কী করে যে মৌটুসি এভাবে মনের কথা বোঝে! ও কিছু বলতে যায়। মৌটুসি বলে,
: কিছু বলো না। এ পোশাক তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে না। তোমার চারপাশে যারা আছে তারা এই পোশাকটা দেখছে। কিন্তু পোশাকটা আসলে তোমার শরীরে নেই। তোমার শরীরে সেই আগের পোশাকই আছে।
: কিন্তু।
: কোন কিন্তু নেই। দেখে যাও। যতটুকু দেখবে ততটুকুই লাভ। দেখায় কোন ফাঁকি দিতে নেই। কথাটা মনে রাখবে। ফাঁকি দিলে পরে আফসোস করে বলবে, কেন ভাল করে দেখলাম না। তখন কিন্তু হাজার খুঁজেও এ জায়গাটা পাবে না।
ওরা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মৌটুসি বলে,
: চটপটি খাবে, নাকি আইসক্রিম নাকি দুটোই?
: কোনটাই খাব না।
: কেন পয়সার জন্য? অত ভেবে না তো। একসময় রোজগার করে ডবল খাইয়ে দিও। এই নাও।
ওরা আইসক্রিম খায়। তারপর চটপটি। নিউটনের হাতের খাবার শেষ হবার আগেই মৌটুসি বলে,
: শোন আইসক্রিমের ক্যান, চটপটির ঠোঙা বিচে ফেলনা যেন। ওই যে দেখ একটু পর পর বিন আছে, ওখানে ফেল। তোমাদের অতবড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার কেন অতটা জনপ্রিয় নয় বলত? কারণ তোমরা বিচটা পরিষ্কার রাখতে পারোনি। তোমাদের জনগণ সচেতন না। তারা কলা খাচ্ছে, খোসা ছুড়ে ফেলছে, বাদাম খাচ্ছে কাগজ ছুড়ে ফেলছে, পানি খাচ্ছে বোতল ছুড়ে ফেলছে। ময়লায় ময়লায় বিচ সয়লাব। শুধু কি তাই, যা পাচ্ছে তাই পানিতে ছুড়ছে। আর তোমাদের সরকারেরও বিচ বা পানি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই। তাই তো অত বড় সমুদ্র সৈকত নিয়েও তোমরা কিছুই করতে পারছ না। কিন্তু যাও থাইল্যান্ডে। ওই অতটুকু একটা কৃত্রিম সৈকত কত ঝকঝকে রেখেছে তারা। যাও ভিয়েতনামের হে লং বেতে। একই অবস্থা। শুধু পারলে না তোমরা। না কক্সবাজার না কুয়াকাটা না বান্দরবান না রাঙ্গামাটি।
: কেন এ রকম হয় বলত?
: বুঝলে না, মানুষ তো প্রথম শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। পরিবারই শেখায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবে না। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলবে। ময়লা ছড়িয়ে ফেলবে না। কোন ঠোঙা বা পলিথিনে ভরে মুখ বেঁধে ফেলবে। তারপর ধরো ফুল পাতা ছিঁড়বে না। সকাল বিকেলে নিয়ম করে দাঁত মাজবে, নখ কাটবে, সর্দি ফেলবে না যেখানে সেখানে। কিন্তু তোমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারে এসব শেখানো হয় না। অনেক বড়লোকের পরিবারেও হয় না। আমি দেখেছি।
: কিন্তু আমরা গরিব হলেও আমার মা আব্বা এসব আমাকে শিখিয়েছেন। আরও অনেক কিছু তারা শিখিয়েছেন। যেমন গুরুজনদের সম্মান করবে, ছোটদের ¯েœহ করবে, অসুস্থকে সেবা করবে, দুস্থের পাশে দাঁড়াবে, মিথ্যা কথা বলবে না, সকালে ঘুম থেকে উঠবে। আরও কত কি!
: এ জন্যই তো তোমাকে আমার এত ভাল লাগে। শুনে শুনে তোমার আব্বা-মাকেও আমি ভালবেসে ফেলেছি। যাব একদিন তাদের দেখতে।
: কিন্তু কিভাবে যাবে? আমার আব্বা মা বলেন জিন পরী দৈত্য দানো কিছুই নেই। দেখ এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত। আমি জানি, আমার আব্বা-মা যা বলেন সবই সত্যি। কিন্তু তুমি আছ আমি দেখছি।
: আরে না, তোমার আব্বা মায়ের এই কথাটাও সত্যি। আমি আছি, আবার আমি নেই। ধরে নাও না যা সব ভাল, সুন্দর তাই পরী আর যা মন্দ খারাপ তাই দৈত্যদানো। যাক চলো, আমার মনে হয় এখানে আর দেখার কিছু নেই। এবার আমরা যেতে পারি।
: হ্যাঁ শোন একটা কথা। আমি আর কোথাও যেতে চাই না। আব্বা মার জন্য আমার ভীষণ মন কেমন করছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরতে চাই। তোমার দেশে না গেলে হয় না?
: আরে আমার দেশে যেতে সময় লাগবে না। এক লহমায় চলে যাব। কিন্তু তুমি কি শান্তিনিকেতন দেখতে চাও না, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে চাও না?
: না অন্য সময়। তুমিতো বলেছ আমি নাকি আমার আব্বা মাকে নিয়ে আসব এদেশে। তখন অনেক সময় ধরে সবকিছু দেখব। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন কি অত অল্প সময়ে দেখা যায়!
: তা তুমি ঠিকই বলেছ। অবশ্য তোমাদের দেশেও কবিগুরুর অনেক কিছু আছে। জীবনের অনেকটা সময় তো তিনি শিলাইদহে ছিলেন। পদ্মায় বোটে বোটে ঘুরেছেন। তোমাদের শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে কবিগুরুর কুঠিবাড়ি রয়েছে। রয়েছে তাঁর অনেক স্মৃতি। সেই উপেনের তিনবিঘা জমিও আছে শিলাইদহে।
: উপেন কে?
: ওহ তাইতো, তুমিতো আবার তিনবিঘা জমি কবিতা পড়োনি। ওটা রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত কবিতা। পড়ে নিও পারলে। তাহলে বুঝবে উপেন কে। আর কবিতায় যে আমগাছের কথা আছে সেটা ওখানে আছে।
: কী কা- পরীরা কবিতাও পড়ে নাকি!
: কেন পড়বে না কেন। পরীদের কি পড়তে নিষেধ আছে? আমিতো হিমু সমগ্রও পড়েছি। জানো আমার খুব ইচ্ছে করে হিমুর মত হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু আমিতো মেয়ে।
: কিন্তু তুমিতো ইচ্ছে করলেই ছেলে হতে পার।
: তা পারি, কিন্তু ইচ্ছে করে না। যাকগে তাহলে চল আমরা রওনা দিই। নাও ডানায় ওঠ। এবার অনেকটা দূর যেতে হবে।
মৌটুসি ডানা মেলে উড়তে থাকে। ওড়ে আর কথা বলে, মনে রেখ আমরা এখন ইন্ডিয়া ছাড়ছি। এদেশের প্রেসিডেন্টের নাম প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে এদেশ স্বাধীন হয়। এদের মুদ্রার নাম রুপি। এই দেশের সাউথে ভারত মহাসাগর, সাউথ ওয়েস্ট আর সাউথ ইস্টে বঙ্গোপসাগর। পাকিস্তান আর চীনের সাথে এদের বর্ডার আছে। থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ার সাথেও বর্ডার আছে। প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর মালদ্বীপ। এদেশের রাজধানী নয়াদিল্লি। সবচেয়ে বড় শহর মুম্বাই। অফিসিয়াল ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি। আর আঞ্চলিক ভাষা অসমিয়া, বাংলা, মারাঠি, মনিপুরি, তেলেগু, তামিল থেকে উর্দু পর্যন্ত। যাক আমরা এবার উত্তর প্রদেশ হয়ে বামে ঘুরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে তুরস্ক ইতালি হয়ে আমেরিকা পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে আমার দেশ খুব দূরে না। সেখানে গেলেই আমাদের যাত্রা শেষ।
: শেষ মানে কি বলছ তুমি, আমি ফিরব না? আমি কিন্তু এখনই লাফ দেব।
: আরে পাগল ফিরব তো অবশ্যই। ওই পর্যন্ত যাব সেটাই বললাম। ভয় পেও না, আমি তোমাকে ঠিকঠাক ফিরিয়ে আনব।
সাত.
মৌটুসি উড়ছে আর অনর্গল কথা বলে চলেছে। এ পরীটার সব ভাল শুধু বেশি কথা বলা ছাড়া। এত কথা মানুষ বলতে পারে! এ তো আবার মানুষ নয়, পরী। আব্বা একদিন মাকে বলেছিলেন, ওনার সাথে একজন কাজ করে তিনি বেশি বকেন বলে সবাই তাকে বকাউল্লাহ বলে। মৌটুসি আর এক বকাউল্লাহ। নিউটন ভাবতে থাকে, উল্লাহ সাধারণত ছেলেদের নামের সাথে থাকে। মেয়েদের কি কখনও উল্লাহ বলা যায়? তাহলে কি বলা যায়? বকা বেগম, বকা খাতুন, বকা খানম নাকি বকা আখতার? না একটাও মানাচ্ছে না। বরং ওকে ‘বকা পরী’ বললেই বেশি মানাবে। বলবে নাকি ওকে কথাটা। না থাক ও যদি রেগে যায়।
মৌটুসি কথা বলছে আর নিউটন ঢুলছে। ওর কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ঘুমালে যদি পড়ে যায় এই ভয়ে ঘুমাতেও পারছে না।
মৌটুসি বলে চলে,
: বুঝলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল নেপালটা তোমাকে দেখাব। নেপাল খুব সুন্দর দেশ, পাহাড়ি জায়গা। হিমালয় আছে। অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। সেদিনের ভূমিকম্পে ‘ভক্তপুর’ নামের ঐতিহাসিক জায়গাটা মাটির সাথে মিশে গেছে। খুব খারাপ লাগে ভাবলে জানো। গৌতম বুদ্ধের নাম জানোতো? বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। উনি নেপালের গ্রাম কপিলাবস্তুতে জন্মেছিলেন। নেপাল স্বাধীন দেশ। নাম ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল। জনসংখ্যা ২৭ মিলিয়ন। এটা আয়তনের দিকে থেকে বিশে^ ৯৩তম বড় আর ৪১তম জনবহুল দেশ। হিমালয়ের একটা শাখা কিন্তু পাকিস্তানেও আছে। ওটার নাম কারাকোরাম। এই দেখ বলতে বলতে আমরা পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছি। এই যে নিচে তাকিয়ে দেখ এটা ইসলামাবাদ, পাকিস্তানের রাজধানী। বামে তাকাও। প্রচুর ফুল দেখতে পাচ্ছ তো? ওটা শালিমার গার্ডেন। তুমি কি নিচে নেমে ঘুরে দেখতে চাও?
: না না কিছুতেই না।
: অত উত্তেজিত হলে কেন ? কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
: না আমার মন খারাপ।
নিউটন ফুঁপিয়ে কাঁদে।
: আরে পাগল কেঁদো না, কেঁদো না বলছি। তোমার কান্না দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। শোন আমি সবই জানি। থাক তোমাকে নামতে হবে না। তবে জানতে তো কোন দোষ নেই। কোন দেশকে পছন্দ না করলেও সে দেশ সম্পর্কে জানা ভাল তাই না? শোন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি। ভাষা ইংরেজি ও উর্দু। আঞ্চলিক ভাষা পাঞ্জাবি পশতু সিন্ধিসহ অনেকগুলো। জনসংখ্যা ১৮০ মিলিয়ন। এটা পৃথিবীর ষষ্ঠ জনবহুল দেশ। আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ৩৬তম বড় দেশ। এ দেশে আরব সাগর আর গালফ অব ওমান নামে দুটো সাগর আছে। কাছাকাছি দেশ ইন্ডিয়া আফগানিস্তান ইরান ও চায়না। অফিসিয়াল নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।
: থাক থাক মৌটুসি পরী ওদের কথা আর শুনতে চাই না। তুমি উড়ে চল তাড়াতাড়ি।
: হ্যাঁ তাই করছি। খুব দ্রুত উড়ছি আমি। চিন্তা করো না, দু এক মিনিটের মধ্যেই আমরা আফগানিস্তানের সীমানার মধ্যে এসে যাবো। এই দেখ বলতে বলতে এসে পড়েছি। তাকিয়ে দেখ নিচে আফগানিস্তান। এ দেশ সাউথ আর সেন্ট্রাল এশিয়ায় অবস্থিত। জনসংখ্যা ৩২ মিলিয়ন। বিশে^র ৪২তম জনবহুল দেশ। এই দেশের চারদিকে আছে পাকিস্তান, ইরান, তুর্কেমিনিস্তান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও চীন। অফিসিয়াল ভাষা পাসতো ও দারি। এরিয়া ৬৫২ কিলোমিটার। এদেশে পানি নেই বললেই চলে। আফগানিস্তান নামটা পার্সিয়ান। এখানে প্রাচীন ইরানিয়ানসহ বিভিন্ন সিভিলাইজেশনের লোক বাস করেছে। বাস করেছে খিলজি কাবুলশাহী। মোগল ডায়নেস্টিও এখানে রাজত্ব করেছে। সবশেষে ছিল হোতাক ও দুররানী ডায়নেস্টি। রাজধানী কাবুল। মুদ্রা আফগানি। আর শোন আফগানিস্তানেও কিন্তু হিমালয়ের একটা অংশ আছে তার নাম হিন্দুকুশ।
: এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
: ইরান। ইরানের পর তুরস্ক। তারপর ওই যে বললাম ইতালি আমেরিকা হয়ে আমার দেশে। ফেরার সময় সেই একই পথ। অবশ্য তুমি যদি চাও পথ বদলাতে পারি।
: সে পরে দেখা যাবে। আগে চলত।
: হ্যাঁ এইত আবার উড়তে শুরু করলাম। এক্ষুনি ঢুকে যাব ইরানে। তুমি জানত মুহূর্তের মাঝেই আমি চলে যেতে পারি হাজার মাইল। ও একটা কথা তোমায় বলি, তুমি যে আমার ডানায় চড়ে ঘুরছ কেমন লাগছে তোমার বললে নাতো?
: খুব ভালো লাগছে জানো, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কত কিছু দেখছি আমি, কত কিছু জানছি। এত কিছু কোনদিন দেখতে পাবো ভাবিনি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি খুব ভাগ্যবান তাইতো দীঘিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলরাক্ষসের খপ্পরে পড়লাম আর তুমি আমাকে রক্ষা করলে। যেসব জায়গা তুমি দেখাচ্ছ, যেসব দেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছ এসব দেশের নামই শুনিনি কখনও। যদি লেখাপড়া জানতাম তাহলে হয়ত কিছু কিছু জানতে পারতাম। কিন্তু আমিতো কখনই স্কুলে যাইনি আর যাওয়া হবেও না। আমরা বড্ড গরিব।
: ওভাবে বোলো না। মনের দিক দিয়ে যে গরিব সেই প্রকৃত গরিব। তুমি বড় মনের ছেলে আমি বুঝতে পারছি। আর শোন তোমায় একটা কথা বলি। আগেও বলেছি বোধহয়। স্কুল কলেজে গিয়েই যে সব কিছু জানতে হবে, বা জানা যায় তা কিন্তু না। তুমি কি আরজ আলি মাতব্বরের নাম শুনেছ ?
: না, উনি কে ? মাতব্বররা তো সাধারণত গ্রামে থাকে। গ্রামের নেতা গোছের লোক হয়। সবাই তাকে মান্য করে আবার ভয়ও পায়। ভয়ে মান্য করে আর কি।
: তুমি বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। তবে এই মাতব্বর সে মাতব্বর না। উনি একজন লেখক। উনি নিভৃত পল্লীতে বসে যা লিখে গেছেন তা অন্য কেউ লিখতে পারেনি। উনি স্কুল কলেজে যাননি। তোমাদের কবি নজরুলও তো তাই। তাই না? উনি তোমাদের রণসঙ্গীত লিখেছেন, ‘চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’। আহ কি গান। শুনলেই যেন রক্ত গরম হয়ে যায়। এই দেখ কথা বলতে বলতে ইরানে ঢুকে পড়েছি। আমরা এখন ইরানের উপর দিয়ে যাচ্ছি। মন দিয়ে শোন, তোমাকে ইরান সম্পর্কে কিছু কথা বলি। একটা দেশে আসবে আর সে দেশ সম্পর্কে জানবে না সেটা ঠিক না। ইরান শব্দটা পার্সিয়ান। ইরানকে পার্সিয়াও বলা হয়। অফিসিয়াল নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’। দেশটা পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত। আশপাশের দেশ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তাজাকিস্তান, রাশিয়া, তুর্কেমেনিস্তান। পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। পশ্চিমে তুরস্ক। ইরানের রাজধানী তেহরান। ভাষা পার্সিয়ান। এ ছাড়া আজারবাইজানি আর আরবি ভাষাও প্রচলিত। ধর্ম শিয়া ইসলাম। এ দেশের সুপ্রিম লিডার আলী খোমেনি, প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি। জনসংখ্যা ৭৮ মিলিয়ন। মুদ্রা রিয়াল।
: আচ্ছা মৌটুসি এসব জেনে আমি কি করব? কি লাভ আমার? আর কতক্ষণই বা মনে থাকবে?
: সব কিছু কি লাভের জন্য মানুষ জানে? কিছু কথা তোমাকে আমি বলছি আজ। আমি তোমাকে যা যা বলছি কোন দিনই তুমি তা ভুলবে না কেমন। শোন আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি। ইরান হল কবি-সাহিত্যিকের দেশ। পৃথিবীর বিখ্যাত কবিরা এখানে জন্মেছিলেন। তাঁরা সব অমর হয়ে আছেন। যেমন ধরো ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, রুমি, সাদি। এরা যে কে কার থেকে বড় বলা কঠিন। কবি ফেরদৌসির কথা শোন। উনি ১১ শতাব্দীর কবি। তুমি ‘শাহনামার’ নাম শুনেছ? শোননি তো? না শোনারই কথা। যারা অনেক অনেক ডিগ্রি নিয়েছে তারা অনেকেই ফেরদৌসির নাম জানে না। শাহনামাকে বলা হয় পার্সিয়ান বুক অব কিংস। এটা একটা কবিতা। আর এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম কবিতা। ফেরদৌসি ইরানের খোরাশান প্রদেশের তুস নগরীতে এক ল্যান্ড ওনারের পরিবারে জন্মগ্র্রহণ করেন। তিনি তুস নগরীতে তার নিজের বাগানে সমাধিস্থ আছেন।
ততক্ষণে নিউটন একটু নড়ে চড়ে বসেছে। কবি-সাহিত্যিক আর বড় মানুষের গল্প শুনতে তার খুব ভাল লাগে। তারা কি করে অত বড় হল তার জানতে ইচ্ছে করে। তারা কি করে মানুষের মনের কথা জেনে যায় নিউটন বুঝতে পারেনা। ওই যে নজরুল লিখেছে, আমি হব সকাল বেলার পাখি। তার ওতো প্রতিদিন সকালবেলার পাখি হতে ইচ্ছে করে। এ কথা নজরুল বুঝলেন কি করে?
: কি হল শুনছ তো?
: শুনছি। তুমি বল।
আর এক বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম। ফেরদৌসির সময়কার। তিনি শুধু কবি নন, গাণিতিক জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, ভূগোলবিদ, শিক্ষক। কি নন তিনি? কিন্তু তাঁর কবি খ্যাতি যতটা হয়েছে অন্যগুলো তা হয়নি। এটা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক। তিনি কিন্তু সব কিছুতেই সেরা ছিলেন। তিনি প্রচুর গানও লিখেছেন। জন্ম ইরানের নিশিপুরে। সমরকন্দে লেখাপড়া করেন। এরপর বুখারা চলে যান। সেখানে এলজাবরার উপর একটা বিখ্যাত বই লেখেন। নিশাপুরে খাইয়াম গার্ডেনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এই সমাধি ইরানিয়ান আর্কিটেকচারের ক্ষেত্রে এক মাস্টারপিস। এই সমাধি দেখতে প্রতি বছর বহু লোক আসে। তার ‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’ বিখ্যাত ইংরেজ কবিরা অনুবাদ করেছেন। ফলে সারা পৃথিবীব্যাপী তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
: তুমি কি ওর কবিতা জানো?
: কেন শুনতে ইচ্ছে করছে? বাহ! দুই এক লাইন বোধ হয় বলতে পারব। মনে আছে,
এইখানে এই তরুতলে
তোমার আমার কৌতূহলে
এখানে যে ক’টি দিন কাটিয়ে দিয়ে যাব
সঙ্গে থাকবে মধুর পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আর একখানি ছন্দমধুর কাব্য হতে নিয়ে।
ভাল লাগল তোমার?
: খুব ভাল। দেখ উনিও কিন্তু লেখাপড়া করার কথা বলেছেন। কাব্য মানে বই তো? আর তুমি বললে পড়ালেখার দরকার নেই। উনি খাবার চেয়েছেন অল্প, কিন্তু বই চেয়েছেন।
: তুমি কিন্তু আবারও আমাকে ভুল বুঝলে। আমি কখন বললাম বই পড়ার দরকার নেই? আমি বলেছি স্কুল কলেজে না পড়লেও জ্ঞানী হওয়া যায়, শিক্ষিত হওয়া যায়। যাকগে এবার বলব শেখ সাদির কথা। শোন শেখ সাদি আর একজন বিখ্যাত কবি। ইরানের সিরাজ নগরীতে তাঁর জন্ম। শিশুকালে তাঁর বাবা মারা যান। কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি বড় হন।
: হ্যাঁ তাইতো। বাবা না থাকলে দেখবে কে। আমি তো আব্বা মা না থাকার কথা ভাবতেও পারি না।
: তাহলেই বোঝ। এই দুনিয়ায় অসংখ্য শিশু আছে যাদের জন্ম দিতে গিয়ে তাদের মা মারা যায়। অসংখ্য শিশু আছে যারা শৈশবেই বাবা মা হারায়। তারা কত কষ্টে বড় হয় ভাব। হয়ত আর্থিক অনটন কারো থাকে, কারো থাকে না। কিন্তু বাবা-মায়ের স্নেহ মমতা ভালবাসা আদর তারা পায় না। তাদের সবার প্রতিই আমাদের ভালবাসা থাকা উচিত, দরদ থাকা উচিত কি বল ?
: অবশ্যই ওদের সবার প্রতিই আমার ভালোবাসা আছে, দরদ আছে।
: এই জন্যইতো তুমি আমার বন্ধু। কত ভাল ছেলে তুমি। আর একটা কথাও মনে রাখবে, শুধু মাতৃ-পিতৃহারা শিশুই নয়, প্রতিবন্ধী আর অসুস্থ শিশুদেরও আমাদের ভালবাসা উচিত। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। ঠিক না?
: ঠিকই বলেছ। তাছাড়া পশু-পাখিদের প্রতিও আমাদের দরদি আর সহানুভূতিশীল হতে হবে। পশু-পাখি দেখলেই খাঁচায় বন্দি করলাম বা মেরে দিলাম এটা কিন্তু ঠিক না।
: ঠিক বলেছ। আমি না একদিন এক বাসায় একটা শালিখকে ঘরবন্দি করে মেরে ফেলতে দেখেছিলাম। ওরা নাকি ওটা ভেজে খাবে। আমার খুব দুঃখ হয়েছিল।
: কেউ যদি খেতে চায় খাবে, কিন্তু খাওয়ার আগে এভাবে ঘর বন্ধ করে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা অন্যায় না তুমি বল? মৌটুসির গলা ধরে আসে।
: খুব অন্যায়। যাক ওসব ভেবে আর মন খারাপ করো না। জানো মৌটুসি আমি ভেবে অবাক হচ্ছি তুমি কেমন বড়দের মত কথা বলছ। এতসব তুমি জানো কি করে এটাও আমি বুঝি না।
মৌটুসি হাসে। বলে,
: থাক অত বোঝার দরকার নেই। শেখ সাদির কথা বলছিলাম, সেটাই শোন। উনি ১৩ শতকের কবি। জ্ঞানান্বেষণে এক সময় তিনি নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর এক সময় তিনি সুফিদের দলে নাম লেখান। সুফিরা তখন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ছিল। এক সময় ক্রুসেডাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আর সেখানে দাস হিসেবে তাকে ৭ বছর কাটাতে হয়। তার কবিতার কথা খুব গভীর আর কবিতায় তিনি অনেক সামাজিক আর নৈতিক বিষয় যোগ করেছেন। তার কবিতার বই পশ্চিমা দুনিয়ায় খুবই জনপ্রিয়। তার দুটি বিখ্যাত বই হচ্ছে গুলিস্তান ও বুস্তান (গুলিস্তা ও বুস্তা)। গুলিস্তার একটা অংশের নাম ‘বনিআাদম’, যা খুবই জনপ্রিয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের জনগণের সম্মানে দেয়া রিসেপশনের ভাষণে সাদির কবিতার দু’ লাইন আবৃত্তি করেন,
: মার্কিন কি। আর বারাক ওবামা কে?
: সেটাও তো কথা। তোমার তো বারাক ওবামার নাম জানার কথা না। উনি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট, উনি ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। উনি হাওয়াইয়ের হনলুলুতে জন্মগ্রহণ করেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হারভার্ড ল স্কুলের গ্র্যাজুয়েট উনি। হারভার্ড ল রিভিউএর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিনেট মেম্বারও ছিলেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন রিপাবলিকান পার্টির মেককেইনকে পরাজিত করে। ওই বছরই উনি নোবেল প্রাইজ পান। ২০১২ সালে পুনঃ নির্বাচিত হন রিপাবলিকান পার্টির মিট রমনিকে পরাজিত করে। দেখ তুমি আবার জিজ্ঞাসা করো না রিপাবরিকান পার্টি কি? ওসবে তোমার দরকার নেই।
নিউটন হাসে। বলে,
: কিন্তু ওনার বাবা মা?
: ওনার মা স্টানলি হ্যান ডুনহাম আর বাবা বারাক ওবামা স্যার, স্ত্রী মিশেল ওবামা আর দুই মেয়ে সাসা ও মালিয়া ওবামা। উনি একটা ইন্টারভিউতে কি বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন ওনার পরিবার হচ্ছে ‘মিনি ইউনাইটেড ন্যাশন’। বোঝ তাহলে পরিবারকে উনি কত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন! ইউনাউটেড ন্যাশন হচ্ছে জাতিসংঘ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
: তাতো ঠিকই, পরিবারের মত গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু আছে নাকি। পরিবার মানে আব্বা-মা ভাইবোন তাইতো। আমার অবশ্য ভাই বোন কিছুই নেই। একটা ভাই বোন থাকলে কি যে ভাল হতো! মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে আমার। কিন্তু শোন আমার আব্বা মা সবার উপরে আমার কাছে।
: ঠিকই বলেছ, ওই যে তোমরা কি যেন বল, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। ওটা একদম সত্যি।
: বেহেশত টেহেশত আমি জানি না। আমি জানি আমার আব্বা মা-ই আমার কাছে সব। তুমি জানো আমার মা না খেয়ে আমার জন্য খাবার রাখে। আমি ঠিকই বুঝতে পারি। অসুখ হলে রাত জেগে আমার সেবা করে। আর আমার আব্বা আমার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রোজগার করে।
: তুমি ভাল ছেলে তাই ওদের ভালবাসা, ওদের কষ্ট বোঝ। যাক অন্যান্য ইরানি কবিদের কথা শুনবে না?
: শুনব। তুমি বলো।
: আচ্ছা এবার বলব কবি রুমির কথা। ওনার পুরো নাম জালাল উদ্দিন রুমি। উনি ১৩ শতকের কবি। সুফিবাদ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সমস্ত এশিয়ার মানুষ তার লেখা দ্বারা প্রভাবিত। আমেরিকান মুসলমানদের কাছে তার বই খুবই জনপ্রিয়। তাকে ‘বেস্ট পপুলার আর বেস্ট সেলিং’ পোয়েট বলা হয়। অর্থাৎ উনি যেমন জনপ্রিয় তেমনই ওনার বই বিক্রি হয়। ওনার বেশির ভাগ কবিতা ফারসি ভাষায় লেখা। তবে উনি টার্কিস আরবি ও গ্রিক ভাষাতেও কিছু কিছু লিখেছেন। ওনার কবিতার অনুবাদ ফারসি ভাষাভাষী, তুরস্ক, আজারবাইজান ইউএই ও সাউথ এশিয়ার জনগণ সাগ্রহে পড়ে। তাঁর সাহিত্য শুধু ফারসি নয়, টার্কিস, পাঞ্জাবি, হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘মসনবি।’ এ বইতে ২৭০০০ লাইন পার্সিয়ান কবিতা আছে। তার আর একটা বিখ্যাত বই ‘শামস ই তাবরেজি।’ এ বই তাঁর শিক্ষক শামসের নামানুসারে।
: ওনার বাবা-মা সম্পর্কে বল?
ইরানের খোরাশানের বালখ শহরে ওনার জন্ম গ্রামীণ বাবা মায়ের ঘরে। ওই জায়গাটা এখন আফগানিস্তানে। তবে এটা নিয়ে মতভেদ আছে। দেশ ভেঙে ভেঙে এখন এত ছোট হয়ে যাচ্ছে যে কোনটা আগে কোথায় ছিল বোঝা মুশকিল। কেউ কেউ বলেন সেই জায়গাটা বর্তমান তাজাকিস্তানে।
: কবিদের অনেক কষ্ট হয় তাই না?
: তা লিখতে গেলে কষ্ট তো করতে হয়ই। ভাবতে হয়, মানুষ দেখতে হয়, ঘুরতে হয়, মানুষের মন বুঝতে হয়। এবার তোমাকে বলব কবি হাফিজের কথা। উনি ১৪ শতকের করি। ফারসি ভাষায় লিখতেন। ইরানের প্রতি ঘরে ঘরে তার বই দেখা যায়। ইরানিরা কথায় কথায় প্রবাদ হিসেবে তার কবিতার লাইন আওড়ায়। তার গজল খুবই জনপ্রিয়। ইরানের সঙ্গীত বিশেষ করে লোকগীতি, গান আর আর্টেও হাফিজের কবিতা আর গজলের প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে। তোমাদের বাংলা ভাষাতেও আছে। ওমর খৈয়ামের অনুবাদও আছে। ইরানের সিরাজ নগরে হাফিজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত একটা মার্বেলের তৈরি সমাধি আছে। যা দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য লোক সেখানে যায়।
: শেখ সাদিরও তো সিরাজ নগরীতে জন্ম? ফেরদৌসি আর রুমির খোরাশানে জন্ম তাই না?
: ঠিক তাই। তুমি তো দেখছি দারুণ মেধাবী। লেখাপড়া শিখলে তুমি সেরা হবে। আমার ভীষণ ভাল লাগছে। এবার গিয়েই তুমি স্কুলে ভর্তি হবে।
: কি যে তুমি বলছ পাগলের মত।
: আমি পাগল না, ঠিকই বলছি। তুমি দেখে নিও। আমি বললাম।
: তুমি জ্যোতিষ নাকি।
: আমি শুধু জ্যোতিষ না, অনেক কিছু। আমি ভাল মানুষকে সাহায্য করি, তোমাকেও করব।
: আমি তোমার সাহায্য নেব না।
: তাও করব দেখে নিও। তুমি স্কুলে পড়বে, কলেজে পড়বে, অনেক বড় হবে, মানুষের কাজে লাগবে। যাক আমরা এবার তুরস্কে ঢুকছি।
: তুমি কি এবার তুরস্ক সম্পর্কে বলতে শুরু করবে নাকি? আমার কিন্তু ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
: না না ঘুমানো চলবে না। এই তো আর সামান্য পথ। হ্যাঁ শোন তুরস্ক শব্দটা টার্কিস। এ দেশের অফিসিয়াল নাম রিপাবলিক অব টার্কি। এটা পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত। তবে এ দেশের একটা অংশ ইউরোপের মধ্যে রয়েছে। ৮টা দেশের সাথে এদেশের বর্ডার রয়েছে। বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, ইরান, আজারবাইজান ও সিরিয়া। রাজধানী ইস্তাম্বুল। অফিসিয়াল ভাষা তুর্কিস। প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েব এরদোগান। জনসংখ্যা ৭৭ মিলিয়ন। মুদ্রা টার্কিস লিরা। আর এদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট কে জানো?
: কে?
: মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক। আতাতুর্ক শব্দের অর্থ টার্কিসদের জনক। এদেশের জনগণ তাকে এই নাম দিয়েছে। আর সংসদে পাস করে নিয়েছে যে এ নাম আর কেউ গ্রহণ করতে পারবে না। উনি কিন্তু কামাল পাশা নামেও পরিচিত। কবি নজরুল ইসলাম ওনাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সে কবিতার নাম কামাল পাশা। তাঁর জন্ম ১৮৮১ সালে আর মারা যান ১৯৩৮ সালে ৫৭ বছর বয়সে। তিনি অটোমান রাজত্বকালে সারোনিকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রথম জীবনে কাঠ ব্যবসায়ী পরবর্তীতে একজন মাইনর অফিসার ছিলেন। তিনি ১৯১৯ সালে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি মিলিটারি স্কুলে যান, সেখান থেকে মিলিটারি একাডেমিতে।
এরপর তিনি সামরিক অফিসার হন। ১৯২১ সালে তিনি প্রভিশনাল সরকার গঠন করেন। ১৯২৩ সালে অটোম্যানরা বিদায় হলে তিনি তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। এরপর তিনি তুরস্কের পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। তাঁর উদ্যোগে অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক আর বাধ্যতামূলক করা হয়। নারীদের সামাজিক রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়। জনগণের উপর থেকে করের বোঝা কমানো হয়। তখন শধু তার নেতৃত্বে তুরস্কে একটাই দল ছিল। তারাই জনগণের জন্য কাজ করেছে। তুরস্কের আঙ্কারা শহরের কেন্দ্রস্থলে মার্বেলের তৈরি তার একটা সমাধি আছে। ওই সমাধিতে যদি ঢুকতে হয় তাহলে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য হ্যাট বা টুপি খুলে ঢুকতে হয়।
: ঠিকই আছে, যে বড় তাকে তো সম্মান দিতেই হবে। আমার আব্বা এ কথাই বলেন।
: সত্যি তোমার আব্বা তোমাকে অনেক ভাল ভাল কথা শিখিয়েছেন। তিনি একজন মহৎ মানুষ। আমরা এবার ইতালিতে ঢুকব।
: তুমি ইতালিতে ঢোক আর যাই করো আমি কিন্তু চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আমি ঘুমাবো। তুমি তোমার দেশে গিয়ে আমাকে জাগাবে।
: আর একটু, আর একটু গল্প করি। হ্যাঁ তখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার ডানায় বসে উড়তে তোমার কেমন লাগছে। তুমি কিছু একটা বলতে শুরু করেছিলে কিন্তু শেষ করোনি। বলত কেমন লাগছে তোমার?
: এখন অবশ্য খুব ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যদি এখান থেকে পড়ে মরে যাই আমার আব্বা-মা জানতেও পারবে না। ওরা শোকে পাগল হয়ে যাবে। আমি ওদের একমাত্র ছেলে।
নিউটন প্রায় কেঁদে ফেলে।
: আরে পড়বে কেন। আমি আছি না। ঠিক আছে তোমার যখন অত ঘুম পাচ্ছে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। এই নাও এই বেল্টটা দিয়ে আমার সাথে নিজেকে বেঁধে নাও। তাহলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
নিউটন বেল্টটা ভাল করে বেঁধে নেয়। তারপর মৌটুসিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। উহ শব্দ করে ওঠে মৌটুসি।
: এই তোমার আঙুলে বড় বড় নখ। নখ কাটো না? আমার দেশে গিয়েই নখ কাটবে। ওই যে তোমরা কি যেন বল, হ্যাঁ ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ’। শোন নিয়মিত নখ আর শরীর পরিষ্কার করবে। খাবার আগে হাত ধোবে, বাথরুম সেরে সাবান দিয়ে হাত ধোবে। মনে থাকবে তো?
ততক্ষণে নিউটন ঘুমিয়ে পড়েছে। ও শুনেছে কিনা কে জানে। মৌটুসি হাসে। কথাগুলো ওকে আবার বলতে হবে।
আট.
মৌটুসি কতক্ষণ উড়েছে জানে না নিউটন। ও তখন গভীর ঘুমে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ও। স্বপ্ন দেখছে ওর মা একটা চমৎকার লাল ডুরে শাড়ি পরেছে আর তার মাথার লম্বা চুলগুলো বেণীতে বাঁধা। বেণীর দু’গোড়ায় টকটকে দুটো জবা ফুল। মা একবাটি বোঝাই রসগোল্লা এনে ওর সামনে ধরে বলছে,
: নে বাবা খা। আজ একটা শুভ দিন, তুই স্কুলে যাবি। তাই মোড়ের দোকান থেকে কিনলাম। বলতে বলতে নিউটনের খাওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেই ওর মুখে রসগোল্লা তুলে দিলেন মা। আহ কি মিষ্টি সে রসগোল্লা। ‘মা আর একটা দাও’ বলার আগেই ঘুম টুটে গেল নিউটনের। আর ঘুম ভাঙার সাথে সাথে চমৎকার একটা সুগন্ধ এসে ঝাপটা দিল ওর নাকে। সবচেয়ে দামি সুগন্ধিও বোধ হয় এত ভাল গন্ধ দেয় না। এ কোন জায়গা ভাবতে ভাবতে ওর মনে পড়ল পরীর ডানায় বসে উড়ে চলছিল ও। এখন মৌটুসি পরী আস্তে আস্তে নামছে। ওর মনে পড়ল জোড়াদীঘিতে জলরাক্ষস ওকে আক্রমণ করেছিল আর ওকে উদ্ধার করে মৌটুসি তার ডানায় তুলে নিয়ে উড়ছিল নিজের দেশের পথে। ওর একটু ভয় ভয় লাগল। আস্তে ডাকল,
: মৌটুসি পরী।
: এতক্ষণে ঘুম ভাঙল তাহলে। আমরা পরীরাজ্যে পৌঁছে গেছি। নামো এবার।
নিউটন নামল আর চারদিকে জ্বলে উঠল হাজার হাজার বাতি। লাল নীল হলুদ সবুজ। আর কী চমৎকার একটা বাজনা বাজতে লাগল। মৌটুসি ওর হাত ধরে এগোল।
: চলো সামনেই আমাদের প্রাসাদ। ওখানে আছেন আমার মা বোন।
ওরা হাঁটছে। গাছের ডাল থেকে পাখিরা কলস্বরে বলছে,
: স্বাগতম পরী রাজকন্যা, স্বাগতম নতুন অতিথি। পরীরাজ্যে তোমার আগমন শুভ হোক।
গাছের ফুলের কুঁড়িগুলো ওদের দেখে ফুটতে থাকে। গাছে গাছে নতুন নতুন পাতা গজাতে থাকে। সবাই একযোগে বলে,
: স্বাগতম নতুন অতিথি, স্বাগতম পরী রাজকন্যা।
বাতাস দোল খেতে থাকে। নিউটনের চোখ মুখে পরশ বুলাতে বুলাতে ওরা বলে,
: স্বাগতম নতুন অতিথি, স্বাগতম আমাদের রাজ্যে। কী নামে ডাকব তোমায়?
ও জবাব দেবার আগেই মৌটুসি বলে, ওর নাম নিউটন। ও আমাদের রাজ অতিথি। সবাই ওকে সম্মান করবে।
মৌটুসির কথা শেষ হবার সাথে সাথে পাখিরা মাথা নোয়ায়, ফুল আর পাতারা মাথা নোয়ায়। নিউটন অবাক হয়ে যায়। সে এক সাধারণ গরিবের ছেলে। তাকে ওরা এত সম্মান করছে!
ওর ভাবনা শেষ হবার আগেই মৌটুসি বলে,
: আবার তুমি নিজেকে সাধারণ ভাবছ, গরিব ভাবছ? তুমি মোটেও গরিব নও, সাধারণ নও। তুমি অসাধারণ।
মৌটুসি সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে। ওর দেখাদেখি নিউটনও ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়ে। চারদিক মৌ মৌ করা গন্ধের মধ্য দিয়ে ওরা হাঁটে। মৌটুসি বলে,
: আমাদের এই রাজ্যে কোন অভাব নেই বুঝেছ। যা চাইবে পাবে, যে যা নিতে চাইবে চোখের নিমেষে পেয়ে যাবে। ওই যে দেখ গাছে গাছে ফল পেকে আছে, ওই দেখ মাঠে ধান, গম, সরিষা। ওই যে পুকুরে মাছ। ওই দেখ কত গরু ছাগল। প্রচুর দুধ হয় এ রাজ্যে। ফল মিষ্টি কিছুরই অভাব নেই। কত খাবে তুমি, যত পারো খাও। অত খাওয়ার মানুষ মানে পরী নেই এখানে। আর এখানে সবকিছুই বারো মাস ফলে। কাজেই শীতের জিনিসের জন্য শীত পর্যন্ত বা গরমের জিনিসের জন্য গরম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এখানকার পানি খুবই মিষ্টি। আর ওই যে দেখ একটু পর পর ঝরনা আছে। ওই দেখ তোমাকে দেখে ঝরনা গান গাইছে। শুনতে পাচ্ছ ? ঝরনা তখন গাইছে,
এসো নতুন অতিথি এসো
আমার পাশে বোসো
একটুখানি হাসো
একটু ভালবাসো ..
: হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। দারুণ তো! আচ্ছা এখানে কি কারো অসুখ বিসুখ হয়?
এবার মৌটুসি একটু চুপ করে যায়। তারপরে বলে,
: মানুষ যেমন সব পারে কিন্তু জীবন দিতে পারে না, ওটা দেন সৃষ্টিকর্তা। এখানেও তাই। পরীদের অসুখ বিসুখ আছে, মৃত্যুও আছে।
: তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই আছে?
: আমাদের রাজ কবিরাজ আছে, তিনি চিকিৎসা করেন।
: দূর এই আধুনিক যুগে কবিরাজি চিকিৎসা! এটা একটা কথা হল। ডাক্তার নেই এখানে, পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই?
: আছে। একজন ভাল ডাক্তারও আছে। পরীক্ষার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সেখানে কেউ যেতে চায় না। পরীরা ইঞ্জেকশনকে খুব ভয় পায়।
হো হো করে হেসে ওঠে নিউটন। পরীরাও তাহলে কিছু জিনিস ভয় পায়।
: হাসছ কেন ?
: এমনি। আচ্ছা আর কত দূর যেতে হবে ?
: ওই তো প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে। চলো যাই।
ওরা ভেতরে ঢুকতেই নহবত বেজে ওঠে। ওদের মাথার উপর ফুল বৃষ্টি হতে থাকে। কে যেন ওদের কপালে ফোটা জাতীয় কিছু দেয়। একজন বয়স্ক পরী মৌটুসিকে জড়িয়ে ধরে। মৌটুসি বলে,
: মা ও আমার বন্ধু নিউটন। মানুষের রাজত্ব থেকে এসেছে। খুব ভাল ছেলে। কোন ভেজাল নেই। আমাদের দেশ দেখাতে নিয়ে এসেছি। এই আমার মা আর এই আমার বোন মৌমিতা।
: খুব ভালো করেছিস। এ রাজ্যে অনেকদিন নতুন অতিথি আসেনি। রাজবাবুর্চিকে বলেছি তার স্পেশাল রান্নাগুলো করতে। নিউটন, এখানে আরাম করে বসো। কইরে ওকে শরবত দে। তুমি বসো বাবা। আমার শরীরটা একটু খারাপ। আমি একটু বিশ্রাম নেব।
: মা তোমার কি হয়েছে ? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মৌটুসি বলে,
: তেমন কিছু না। সেই আগের দুর্বলতাটা। ও ঠিক হয়ে যাবে। তুই ভাবিস না। ও যত্ন নে।
মুহূর্তের মধ্যে শরবত এসে যায়, সাথে ফল আর প্রচুর মিষ্টি। নিউটন এমন শরবত খাওয়া তো দূরের কথা, এমন শরবত যে হয় তাই জানত না। শরবতে চমৎকার এক সুগন্ধি দেয়া। হিম পানিতে বানানো সাথে প্রচুর পেস্তা কিশমিশ আরো যেন কিসব। নিউটনের খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। ও ছোঁ মেরে শরবতের গ্লাস হাতে নেয় সাথে খাবার দাবার। গোগ্রাসে খেতে থাকে ও। কিন্তু একটু খেয়েই লজ্জিতভাবে মৌটুসিকে বলে,
: দেখ ক্ষুধায় আমার কিছুই খেয়াল ছিল না। আমার মা বলেন, সামনে খাবার দিলে আগে অন্যকে খেতে বলতে হয় তারপর নিজে খেতে হয়। আর সবসময় ছোট জিনিসটা, কম জিনিসটা নিজে নিতে হয়। দেখ আমরা গরিব ঠিকই কিন্তু আমার মা অনেক কিছুই জানেন। আজ ক্ষুধায় মায়ের অবাধ্যতা করলাম। চরম অবাধ্যতা। তুমি খাও। আমার খুব লজ্জা করছে।
নিউটন হাত গুটিয়ে নেয়।
: আরে না না, আমি এখন খাবো না। আমার মোটেও ক্ষুধা পায়নি। আমি পরে খাব। তবে হ্যাঁ বলতেই হবে তোমার আব্বা মা তোমাকে খুব ভাল শিক্ষা দিয়েছেন। তুমি ধীরে সুস্থে আরাম করে খাও। আমি তোমার খাওয়ার পর বিশ্রামের জায়গাটা দেখিয়ে দেব।
নিউটন খায় কিন্তু যতটা খাবে ভেবেছিল তা পারে না। তবে খাবারগুলো ছিল দারুণ সুস্বাদু।
: আরে তুমি যে কিছুই খেলে না। এই যে বললে খুব ক্ষুধা পেয়েছে। এক কাজ করো। আইসক্রিম খাও। আমি জানি সব শিশুই আইসক্রিম ভালবাসে।
: আমি শিশু না, কিশোর।
: আচ্ছা আচ্ছা তাই হলো, তুমি কিশোর।
ততক্ষণে প্রচুর আইসক্রিম এসে গেছে। নিউটন খুব একটা আইসক্রিম খায়নি। কিন্তু অনেক আইসক্রিম সে দেখেছে দোকানের শোকেসে। তাছাড়া অনেক রকম আইসক্রিমের ছবিও সে দেখেছে। কিন্তু এখানে যেসব আইসক্রিম দেয়া হয়েছে তা সে কোনদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। কী চমৎকার চমৎকার রং সেসব আইসক্রিমের আর কী তার সুগন্ধ! আর দেখতে কত ভাল!
: একটা চমৎকার চৌকোনা পাত্রে আইসক্রিম তুলে দেয় মৌটুসি। ও পাত্রের নাম কী? বাটি না প্লেট? কিসের তৈরি জিনিসটা? এত চকচকে মসৃণ আর নকশাটা কী সুন্দর! মৌটুসি ওর দিকে পাত্রটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাও।
এবার আর নিউটন ভুল করে না। পাত্র হাতে নেয়। তবে বলে,
: তুমি আগে নাও।
মৌটুসি হাসে। পাত্রে আইসক্রিম নিতে নিতে বলে,
: হ্যাঁ আমি একটু নেব। এই যে এই আইসক্রিমটা, এটার নাম ‘কইকম্বুর।’ পরীদের স্পেশাল আইসক্রিম। আমার খুব পছন্দের। খুব তেষ্টা পেয়েছে তাই খাব।
ওরা আইসক্রিম খায়। একটা শেষ হবার পর মৌটুসি নিউটনের পাত্রে আর একটা তুলে দেয়। খাওয়ার পর ওকে একটা ঘরে নিয়ে যায় মৌটুসি। এমন ঘর নিউটন কখনও স্বপ্নেও দেখেনি। মৃদু আলো জ্বলছে ঘরে। সে আলোর রংটা ও ঠিক বোঝে না, না নীল না সবুজ না হলুদ। অদ্ভুত স্নিগ্ধ একটা রঙ! চমৎকার ফিনফিনে পর্দা সে ঘরে টানানো। কে জানে ওগুলো কি কাপড়। দেখলে মনে হয় খুবই পাতলা অথচ বাইরের কিছুই দেখা যায় না। নিচু একটা কারুকার্য করা খাটে চমৎকার বিছানা। ঘরের মাঝে পুরু কার্পেট পাতা। পা দেয়ামাত্র সে কার্পেট ডুবে যেতে থাকে। ভয়ে উহ করে ওঠে নিউটন। মৌটুসি হাসে। বলে,
: ভয় পেও না, কার্পেটটা খুব নরম। তাই মনে হয় দেবে যাচ্ছে, আসলে দাববে না। একটু হাঁটাচলা করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
পর্দা কার্পেট বিছানা বালিশ সবই সাদা রংএর। মৌটুসি ওকে সব ঘুরে ঘুরে দেখায়।
: এখানে তুমি বসবে, এখানে শোবে। এটা তোমার বাথরুম। তুমি বোধ হয় এ ধরনের বাথরুম কখনও ব্যবহার করোনি। আসো কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তোমাকে শিখিয়ে দি। আর এই যে টেবিলের উপর তোমার জন্য পানি, কোল্ড ড্রিংকস, শরবত, ফলের রস রাখা আছে। যেটা ইচ্ছে হবে খাবে। আর এই যে দেখ, এটা একটা অ্যালার্ম ঘড়ি। ঠিক দু’ঘন্টা পর এটা রিনি রিনি করে বাজবে। তোমার ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভাঙলে ফ্রেশ হয়ে এই আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে পরবে।
মৌটুসি ওকে হাত ধরে আলমারির কাছে নিয়ে যায়। নিউটন দেখে সেখানে থরে থরে কাপড় জামা সাজানো। কী মূল্যবান সেসব কাপড় আর কী তার রং! এমন কাপড় সিনেমায় রাজপুত্রদের পরনেও সে কখনও দেখেনি। এসব তার জন্য!
মৌটুসি বলে,
কিছু দরকার হলে এখানে চাপ দেবে। এটা কলিংবেল। সাথে সাথে লোক এসে যাবে। তাছাড়া তোমার দরজার বাইরে সর্বক্ষণ একজন লোক থাকবে। অ্যালার্ম বাজলে তুমি কাপড় পরে রেডি থেকো।
: অত কিছুর দরকার নেই আমার।
: তোমার দরকার নেই, আমাদের আছে। তুমি আমাদের অতিথি, এখানে নতুন। তোমার কি লাগবে না লাগবে আমাদের দেখতে হবে না? এখন তুমি খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। আমি দু’ঘন্টা পর এসে তোমাকে আমাদের রাজ্য ঘুরাতে নিয়ে যাব। ঠিক আছে, আসি তাহলে।
মৌটুসি দরজা টেনে দিয়ে চলে যায়। নিউটন বিছানায় বসে। বসামাত্র অনেকটা দেবে যায় বিছানা। এত নরম বিছানা হয় নাকি ! এটা কি বিছানা নাকি তুলোর বস্তা! ও এবার সাবধানে বসে। তারপর আস্তে আস্তে শোয়। সন্তর্পণে বালিশে মাথা রাখে। বিছানা আর বালিশ থেকে চমৎকার একটা সুগন্ধ ভেসে আসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায় ও।
অ্যালার্মের রিনি রিনি শব্দে ঘুম ভাঙে নিউটনের। কী যে চমৎকার সে বাজনা! ও ধীরে ধীরে চোখ মেলে। আর চোখে মেলেই ঘাবড়ে যায়। এ কোথায় সে! পরক্ষণে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে। ও ওঠে, বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধোয় তারপর আলমারি খোলে। আলমারি খুলে হকচকিয়ে যায়। এত সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় ! এত জামার মধ্যে কোনটা সে পরবে। মাথা ঠা-া রাখতে চেষ্টা করে নিউটন। তার পর বেছে বেছে চমৎকার একটা জামা পরে। মা একবার ঈদে ওর জন্য নীল রংএর একটা শার্ট কিনে এনেছিল। সে শার্ট পরলে বস্তির সবাইকে ডেকে এনে দেখিয়ে বলেছিল,
: দেখ দেখ নীল রংএর জামায় নিউটনকে কেমন রাজপুত্রের মত লাগছে। ও নীল রঙএর একটা পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মার জন্য কান্না পায় ওর। ও ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদে। ও খাটের উপর ঝিম মেরে বসে থাকে। আর তখনই মৌটুসি আসে,
: কি মন খারাপ মায়ের জন্য? অত মন খারাপের কিছু নেই। আর তো মাত্র কিছুক্ষণ। এরপরই চলে যাবে মায়ের কাছে। তখন আমার জন্য মন খারাপ লাগবে দেখো।
ওর কথায় প্রচ- অভিমান হয় নিউটনের। এই কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ ও আর কত দিন করবে। সেকি আর কখনও মায়ের কাছে ফিরতে পারবে!
মৌটুসি হাসে। বলে,
: মনে অবিশ্বাস এনোনা। অকারণে অবিশ্বাস করা ঠিক না। যখন দেখবে তোমার ধারণা ভুল তখন কিন্তু নিজেই কষ্ট পাবে। এসো দেখি তোমাকে রেডি করে দিই।
মৌটুসি নিজ হাতে ওর চুল আঁচড়ায়, স্নো পাউডার মাখায়। গলায় পরায় মূল্যবান জুয়েলারি। পায়ে পরায় চমৎকার নরম স্যান্ডেল। তারপর ওর হাত ধরে বের হয়।
পুরো শহর লাল কার্পেটে মোড়া। ওরা বের হতেই নিউটন দেখে পাখিরা গাইছে, ফুলেরা হাসছে আর বাতাস গানের মত করে বইছে। রাস্তায় যার সাথেই দেখা হচ্ছে সেই হাসিমুখে কথা বলছে। আর পরীগুলো যে কী সুন্দর! কী সুন্দর তাদের গায়ের চামড়া, কী তাদের রং চেহারা আর চুল। আর না বেশি লম্বা না বেঁটে। সবারই পরনে চমৎকার পোশাক। ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মৌটুসি বলে,
: এটা আমাদের পাহাড়। এটার নাম পরীহিল।
নিউটন তাকিয়ে তাকিয়ে পাহাড়টা দেখে। পুরো পাহাড়ের গা জুড়ে ফুল আর ফুল। নিচের দিকে কিছু সবজিও আছে। পাকা তরমুজ, আনারস। আর একেবারে নিচে কাঁদি কাঁদি কলা, আপেল, পেয়ারা, লেবু। সব পেকে লাল হয়ে আছে। আর পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে একটা ঝরনা। অবিরাম সে ঝরনার জল ঝরে পড়ছে। আর তার নিচে অনেক রংএর অনেক মাছ। মৌটুসি বলে,
: মাছগুলো দেখ। খুব সুন্দর না? আমি তো মাঝে মাঝে এই মাছ দেখার জন্যই এখানে আসি। অবশ্য তোমাদের বাবুপুরা নীলক্ষেতে অনেক সুন্দর সুন্দর মাছ পাওয়া যায়। অনেকে সেগুলো কিনে নিয়ে অ্যাকোরিয়ামে রাখে। পাখিও পাওয়া যায়, সুন্দর সুন্দর পাখি। তবে এখানে অনেক মাছ আছে যা তোমাদের ওখানে কেন, পৃথিবীর কোথাও নেই।
: এখানে মাছ থাকবে কি করে। পানি তো বয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝগুলো পানির সাথে ভেসে যাচ্ছে। এভাবে মাছ হয় নাকি?
: খেয়াল করে দেখ মাছগুলো ভেসে যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকার ক্ষমতা ওদের আছে। এ জন্যই তো ওরা পরীরাজ্যের মাছ। তবে এ মাছগুলো দেখার, খাওয়ার না। খাওয়ার মাছ পাওয়া যায় নদীতে। কেমন দেখলে আমাদের পাহাড়টা? তোমাদের খাগড়াছড়ি বান্দরবান রাঙ্গামাটিতেও পাহাড় আছে। ওখানে আমি গেছি। ওখানে এক ধরনের চাষ হয় তাকে বলে জুম। জুমচাষ সারা বছর করা যায়না। আর জুমে কিন্তু সব গাছ লাগানো যায়না। কিছু কিছু গাছ লাগানো যায়। আমাদের এখানে এমন কোন গাছ নেই যা লাগানো যায় না। সব গাছ লাগানো যায় আর মাটি খুবই উর্বর। লাগানোর সাথে সাথেই গাছ হয়ে যায়। সারা বছর এই দেশে ফুল ফোটে, ফল ধরে।
: কিন্তু তোমরা তো ফল খাও না। পেকে পেকে পড়ে আছে। নষ্ট হচ্ছে।
: খাই। যার যতটা লাগে নিয়ে নি। বাকিগুলো পশু পাখি খায়। ওদের তো আমাদের খাবারে অধিকার আছে কি বল? হ্যাঁ তোমাদের মত যত পারি তত নি, না লাগলেও নি, জোর করে নি এমন না। চলো এবার নদীর দিকে যাই।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর পাড়ে আসে। এদেশের আবহাওয়া এতই সুন্দর যে মানুষ ঘামে না। বরং শরীর যেন জুড়িয়ে যায়। রাস্তার চারপাশে গাছ। গাছগুলো মাঝারি আকৃতির। আর সে সব গাছ বোঝাই ফুল আর ফুল। এ যেন পরীরাজ্য নয়, ফুল রাজ্য। ওর মনের কথা বুঝে নিল মৌটুসি বরাবরের মত। বলল,
: তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে বড় বড় গাছগুলো আছে আর তার যে ফুল সেও কিন্তু চমৎকার। বিশেষ করে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। আর তোমাদের সেনানিবাস এলাকায় আছে অজ্রগুলমোহর। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা কি দেখতে। শোন ফুলের কোন বিকল্প নেই। একজন কবি লিখেছেন,
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা / খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে / অর্ধেক ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।
সত্যি চমৎকার। ফুল দেখলে যে কি আনন্দ হয়! আর গাছ দেয় অক্সিজেন। সে অক্সিজেন নিয়ে মানুষ বাঁচে। গাছের সবুজ চোখ আর মন ভাল রাখে। আর সবুজ তোমাদের জাতীয় পতাকার রং। জানত তুমি এসব?
: এসব জানব না কেন। আমাদের জাতীয় পতাকা হচ্ছে সবুজের মধ্যে লাল সূর্য। আর শোন আমি ফুল খুবই ভালবাসি। আমার মাও। মার জন্য ফুল তুলতে গিয়েই তো জলরাক্ষস ধরল আর তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। ভুলে গেলে সে কথা? আর শোন আমাদের নিজের কোন জায়গা নেই তারপরও আমার মা বস্তির কমন উঠোনে ফুলের গাছ লাগায়। আমাদের সরকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে লিখে দিয়েছে,
সবুজে থাকো, সবুজে বাঁচো
সবুজে বেড়ে ওঠো
: বাহ তুমি ভারি ভাল ছেলে। অনেক কিছু জানো। চলো নদীর ধারে এসে গেছি।
ওরা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। এ নদীর পানিও সেই ঘরের আলোর মত। না নীল না সবুজ না হলুদ। আর পানির নিচের পুরোটা দেখা যায়। সেখানে খলবলিয়ে ভাসছে কত রকমের মাছ। সেসব মাছের কোনটাই ওর চেনা না। পানিতে এক বিন্দু ময়লা নেই। নিচের বালির কণাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রং বেরংএর পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। মাঝিরা কি এক অদ্ভুত ভাষায় গান করছে। নিউটন বলে,
: এই নৌকাগুলো কোথায় যাচ্ছে?
: কেন অন্য শহর, বন্দরে। তোমাদের যেমন ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় আর জেলা শহর আছে, গ্রামগঞ্জ আছে আমাদেরও আছে। সেখানে যাচ্ছে এটা তো আমাদের রাজধানী পরীস্থান।
: নৌকায় কি যাচ্ছে?
: পরীরা যাচ্ছে, মালামাল যাচ্ছে। আবার অনেক সময় বিয়ের নতুন বর কনে রাজকীয় নৌকায় যায়।
: কিন্তু তোমাদের তো ওড়ার জন্য ডানা আছে। তাহলে নৌকা কেন?
: নৌকা শুধু নয়, লঞ্চ, জাহাজও আছে। আর শোন ডানা থাকলেই কি ওড়া যায় নাকি সব সময়? এই ধর ছোট শিশু বৃদ্ধ তারা কি উড়তে পারে? তাছাড়া আমরা দূরের পথ উড়ি খুব কাছের পথ হাঁটি আর অল্প দূর হলে নৌকা বাস এসবে যাই।
: কই তোমাদের শহরে তো কোন বাস রিক্সা দেখলাম না?
: আছে, আছে, সবই আছে অন্যপাশে। আমাদের দেশে যে রাস্তা দিয়ে পরীরা হাঁটে সেখানে যানবাহন চালানো নিষেধ। ওতে অনেক এক্সিডেন্ট হয়।
নিউটন মনে মনে বলে, এটা খুব ভাল। তাদের ঢাকায় তো গায়ের উপর রিক্সা বাস তুলে দেয়। একই রাস্তায় বাস ট্রাক কার ঠেলা রিক্সা সবই চলে। মাঝে মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়। কত রোগী যে এভাবে মারা যায় প্রতিদিন, কত একসিডেন্ট হচ্ছে আর কত মানুষ মারা যাচ্ছে তার হিসেব নেই।
: মনে রাখবে জীব হত্যা মহা পাপ। সে হত্যা যদি নিজের হাতে না হয়, নিজের বোকামি বা অসচেতনতার জন্য হয় সেটার দায়ও কিন্তু যে দায়ী তার উপর এসে পড়ে।
: ঠিক বলেছ, খুব ঠিক কথা। আচ্ছা মাঝিরা কি গান গাইছে।
: ওরা পরীদের ভাষায় গাইছে।
: কিন্তু তুমি তো আমার সাথে বাংলায় বলছ। আমি ভেবেছি এটাই তোমাদের ভাষা,
: আরে না, পরীদের ভাষার নাম পরী ভাষা। আমরা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারি। তুমি আমাদের ভাষা বুঝবে না তাই বাংলাতেই বলি তোমার সাথে। ওরা কি গাইছে খেয়াল করে শোন ওরা গাইছে,
রিনি রিনি রিনি
কিনি কিনি কিনি
জিনি জিনি জিনি
রিনি রিনি রিনি
এর মানে হচ্ছে, বন্ধুরা দূর দেশে যাচ্ছি আমি। দোয়া করো যেন সুস্থ দেহে সুস্থ মনে ফিরতে পারি। যাত্রা যেন শুভ হয়। তোমরা ভাল থেক।
: তোমরাও সুস্থ থাকার চিন্তা করো ?
: কেন করব না। শুনলে না আমার মা খুব অসুস্থ। আমরাও তো অসুস্থ হই। আমাদেরও তো রোগ শোক হয়। যাক মাছগুলো দেখ, দারুণ না? শোন পরীরাজ্যের একটা স্পেশাল মাছ আছে। ওটার নাম পরীমাছ। রাতে তোমার জন্য ওই মাছের স্পেশাল ডিস হবে।
ওর কথা শেষ হবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে একজন পরী আসে।
: রাজকন্যা রাজকন্যা, পরীরাণী অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
: বলছ কি তুমি। মার কি হয়েছে? বলতে বলতে ডানা মেলে দেয় মৌটুসি। ‘ওঠ বন্ধু আমার ডানায়, ওঠো তাড়াতাড়ি।’
ওরা পরী রাজবাড়িতে এসে দেখে হুলুস্খুল কান্ড। বাড়ির সবার মুখ থমথমে, সবার চোখে পানি। মৌটুসিকে দেখামাত্র ছোটবোন মৌমিতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরীরানী অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। রাজকবিরাজ তার নাড়ি ধরে রেখেছেন। তার মুখ গম্ভীর।
: কেমন দেখছেন কবিরাজ মশাই। মা হঠাৎ অজ্ঞান হলেন কেন?
: অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। কেন অজ্ঞান হলেন সেটাই তো বুঝছি না। নাড়ির গতি খুবই দুর্বল।
: কিছু একটা করুন। আপনি রাজ কবিরাজ, আপনাকেই তো করতে হবে।
নিউটন রানীমার নাড়ি টিপে পালস দেখে। ওর মুখ আরও গম্ভীর হয়। বলে,
: এসব করিবাজিতে চলবে না। আমি একবার এক কম্পাউন্ডারের কাছে পালস দেখতে শিখেছিলাম। মনে হচ্ছে পালস রেট খুবই কম। এটা ভয়ের ব্যাপার। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকুন।
: কিন্তু ডাক্তার তো ইঞ্জেকশন দেয়।
: এখন ইঞ্জেকশনই দিতে হবে। এ ছাড়া কোন উপায় নেই। না হলে দেরি হয়ে যাবে।
দু’বোন পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর ডাক্তারকে ডাকে। ডাক্তার এসে পালস দেখে, প্রেসার দেখে, তারপর গম্ভীর মুখে একটা ইঞ্জেকশন দেয়। অজ্ঞান অবস্থাতেই রানীমার চোখ কুঁচকে যায়। আর অন্যরা এমন ভাব করে যেন রানীমার হাতের মধ্যে একটা শাবল ঢুকেছে। নিউটনের ভীষণ হাসি পায়। ওরা এত উপর দিয়ে উড়তে পারে আর ইঞ্জেকশনে ওদের এত ভয়। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। আব্বা অনেকবার বলেছেন, বিপদ দেখলেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেবে। কি করে করবে সেটা ভাববে না। ভাবলে দেরি হয়ে যাবে। নিউটন বলে,
: কেমন দেখলেন ডাক্তার সাহেব?
: ভাল না। পালস রেট খুবই কম, প্রেসারও ওঠা নামা করছে। ভীষণ দুর্বল। আমি এখনই রক্ত পরীক্ষা করতে দিচ্ছি। রক্ত পরীক্ষা না করে কিছু বলা যাবে না।
ডাক্তার রক্ত নিয়ে চলে যায়। দশ মিনিট পরে এসে বলে,
: ইমিডিয়েট রক্ত দিতে হবে। একদম রক্তশূন্য হয়ে গেছেন। সে জন্যই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। এখানে কার গ্রুপ এ পজেটিভ?
ওরা কেউ তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না। সুচ ফোটানোর ভয়ে এতদিন ওরা রক্তের গ্রুপ চেক করেনি। কিন্তু পরীরানীর অসুখ বলে কথা! ওরা একে একে রক্তের গ্রুপ চেক করে। এ পজেটিভ গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায় না। এরপর রাজ্যে ঢেঁড়া পেটানো হয়। দলে দলে লোক আসতে থাকে। হঠাৎ নিউটন বলে,
: আমার প্রুপটা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন? অবশ্য আমি মানুষ আর আপনারা পরী। আমি জানি না গ্রুপ মিললেও আমার রক্তে কাজ হবে কিনা।
: খুব হবে। আরে সেই একই ধমনী শিরাতো আমাদের শরীরেও বইছে। আগে রক্তটা পরীক্ষা করি।
রক্ত পরীক্ষা করে চেঁচিয়ে ওঠে ডাক্তার।
: হুররে মিলে গেছে, আর কোন ভয় নেই। এখনই তোমার রক্ত নিয়ে রানীমার শরীরে দিয়ে দিচ্ছি। এবার রানীমা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
পাশাপাশি দুটো বেড। নিউটনের শরীরের রক্ত নল দিয়ে ঢুকছে রানীমার শরীরে। আস্তে আস্তে রানীমার শরীরের সাদাভাব দূর হয়ে রক্তাভা ফুটে উঠছে। কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে প্রাসাদের পরীরা আর মৌটুসি তাকিয়ে আছে কান্নাভরা চোখ নিয়ে। ও এক হাতে ধরে আছে নিউটনের হাত আর একহাতে রানীমার।
নয়.
বাড়ি ফিরছে নিউটন। রানী মা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে বিদায় দিয়েছেন। বলেছেন,
: ভাল থেকো বাবা। তোমার জন্য আমি এ যাত্রা বেঁচে গেলাম
: না রানীমা আমার জন্য না। মহান আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবেন। তিনি পরম করুণাময়।
সারা রাজ্যের লোক চোখে কান্না নিয়ে হাত নেড়ে নিউটনকে বিদায় জানিয়েছে,
: বিদায় রাজ অতিথি, ভাল থেকো। খুব ভাল থেকো।
পরীরানী ওকে নানান উপহার দিতে চেয়েছিলেন। জামা জুতো সোনা হীরে। ও কিছুই নেয়নি। এসব নিলে মাকে সে কি জবাব দেবে। তবে একটা জিনিস সে পরীরানীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
: আপনাদের বাগানের কিছু ভাল ভাল ফুল আর কিছু চারা আমাকে দেবেন। আমার মা ভীষণ ফুল ভালবাসে।
: ওসব আমরা রেডি করেই রেখেছি। মৌটুসি আগেই আমাকে বলেছে আমাদের বাগানের সেরা ফুল আর চারা তোমাকে দিতে।
এবার কৃতজ্ঞ চোখে মৌটুসির দিকে তাকায় নিউটন। এত কিছু মনে রেখেছে মৌটুসি!
এখন মৌটুসির ডানায় নিউটন। ও ফিরছে নিজের বাড়িতে। যেতে যেতে মৌটুসি বলে,
: শোন নিউটন তুমি দু’ চারদিনের মধ্যেই স্কুলে ভর্তি হবে। অনেক বড় হবে তুমি। তোমার বিশ্বজোড়া নাম হবে। তখন কিন্তু তোমার এই বন্ধুর কথা ভুলো না। আর যা করবে মানুষের মঙ্গলের জন্য করবে। আমি শুনেছিলাম মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আজ সেটা তুমি প্রমাণ করে গেলে। তুমি আমার মাকে রক্ত দিয়ে গেলে। যতদিন আমার মা বেঁচে থাকবে, আমি বেঁচে থাকব, এই পরীরাজ্য থাকবে তোমাকে কেউ ভুলবে না। আর যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় আমাকে মনে মনে ডেকো। আমি হাজির হয়ে যাবো। এই যে পরীরাজ্যের ফুল, ফুলের চারা আর দিঘীর সেই শাপলা। ধরো, তোমার মাকে দিও। ভাল থেকো বন্ধু। বিদায়।
নিউটন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই বড় একটা ঝাঁকিুনি খায় সে। মা তাকে ঝাঁকাচ্ছে।
: কিরে এখানে বসে বসে ঘুমাচ্ছিস কেন? আমি তোর আব্বা আর চাচি গল্প করছিলাম। খেয়াল করিনি তুই এখানে বসে ঘুমাচ্ছিস। ওঠ, বিছানায় গিয়ে শো।
নিউটন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। তার ঘোর কাটে না। কোথায় ছিল আর কোথায় এল সে। এতো তার সেই চির চেনা বস্তির ঘর। তাহলে কোথায় সেই পরীস্থান আর কোথায় মৌটুসি! তাহলে ওগুলো কি স্বপ্ন ছিল! তখনই চোখ যায় হাতের দিকে। হাতে সেই টকটকে লাল শাপলা। তেমনই সতেজ। তাহলে কিছুই স্বপ্ন নয়, সবই সত্যি, সবই বাস্তব। ও মার দিকে ফুল বাড়িয়ে দেয়।
: মা ফুলগুলো নাও।
: কী কা-, এই এত রাতে তুই এমন তাজা শাপলা পেলি কোথায়? গেলিই বা কখন, আনলিই বা কখন?
: গেছিলাম মা, মা আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ফুলগুলো নাও।
মা শাপলাগুলো নিয়ে বেণীর গোড়ায় গুঁজে ফেলে। নিউটন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, হাসে। ওর শাপলা আনা সার্থক হয়েছে।
পরদিন সকাল। অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে নিউটনের। ঘুম ভেঙে দেখে মা বাড়িতে। অবাক হয়ে বলে,
: মা কাজে যাওনি?
: শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। ভাবছি আজ কাজে যাব না
: সেতো ভাল কথা, কিন্তু ওরা রাগ করবে না?
: তা করবে। আচ্ছা তুই গিয়ে একটু বলে আসতে পারবি না, আমার মায়ের শরীর খারাপ। আজ কাজে আসতে পারবে না?
: তা পারব। তাহলে ওখানে বলে আমি রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে যাব। আজ থেকে তো আমার রিক্সা চালানোর কথা। মহাজনকে বলে এসেছি।
: না আজ তুই কাজে যাস না। আমি আজ বাড়িতে আছি। তুই বাড়িতে আমার কাছে থাক। এবার তুই পান্তা খেয়ে বেরিয়ে যা। আসার সময় একটা পত্রিকা কিনে আনিস। এই নে টাকা। আজ লটারির রেজাল্ট বেরুবে।
পান্তা খেয়ে বের হয় নিউটন। মার কাজের দুটো বাড়িতে বলে, মহাজনকে বলে একটা পত্রিকা কিনে বাড়িতে ফেরে। যেতে যেতে পত্রিকার হেডলাইনগুলো পড়ে। ছেলে বেলায় পাশের ঘরের রকিবের কাছে সামান্য কিছু পড়তে শিখেছিল ও। গুনতে পারে, দু একলাইন পড়তেও পারে। ও বাসায় ফিরলে মা ওকে দিয়ে টিকেট মেলাবে। ঘরে ফিরে মার হাতে পত্রিকাটা দেয় নিউটন। অসুস্থ মা সাথে সাথে উঠে বসে। নিউটন বলে,
: মা তোমার শরীর খারাপ। একটু শুয়ে থাকো, পরে টিকিটি মিলাও।
: আরে না, তুই আয়।
মা টিকেটগুলো বের করে নিয়ে নিউটনের হাতে দেয়। নিউটন একটা একটা করে মেলায়। ও নিশ্চিত জানে এবারও টিকেট মিলবে না। কেন যে মা খালি খালি টিকেট কেনে আর না মিললে মনমরা হয়ে যায়। দুটো টিকেট মেলানোর পর তৃতীয়টা হাতে নিয়ে মেলাতে বসে নিউটন। প্রথম পুরস্কারে চোখ আটকে যায় ওর। বার বার মেলায়। ততক্ষণে ওর দমবন্ধ হবার অবস্থা। ও চেঁচিয়ে ওঠে,
: মিলেছে মা মিলেছে। ফার্স্ট প্রাইজ বিশ লাখ টাকা।
: বলছিস কি বাপ, বলছিস কি। এইত মাত্র কদিন আগে টিকেটটা কিনলাম। বছরের পর বছর টিকেট কিনি, মেলে না আর চারদিন আগে কেনা টিকেট মিলে গেল আশ্চর্য! নিউটনরে আমাদের ভাগ্য খুলে গেল। এবার আমি তোকে ভাল স্কুলে ভর্তি করব। তুই বড় হবি, অনেক বড়।
নিউটন বিড় বিড় করে বলে,
‘আমি জানি মৌটুসি এটা তোমার কাজ, তোমার।’ ওর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে।
বিশ বছর পর। নিউটন এখন নামকরা বৈজ্ঞানিক। সারা পৃথিবীজোড়া ওর খ্যাতি। ও ঘুরে বেড়ায় বিশ্বব্যাপী এ সেমিনার সে সেমিনার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে। মাঝে মাঝে আব্বা মাকেও সাথে নিয়ে যায়। ওদের ঘুরিয়ে এনেছে নভোথিয়েটার, সায়েন্স সিটি আরও কত কত জায়গা। যেখানেই যায় সব জায়গা নিউটনের চেনা মনে হয়। এসব জায়গা ওকে মৌটুসি চিনিয়ে দিয়ে গেছে। তার ডানায় বসে এসব দেশ ও দেখে গেছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পরীস্থানে যাবার পথ আবিষ্কার করতে পারেনি নিউটন। ভূগোলের কোথাও ওটা নেই।
নিউটন এখন ব্যস্ত এক নতুন আবিষ্কারে। যে আবিষ্কারে উপকৃত হবে পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষ। যে আবিষ্কার আরো সামনে এগিয়ে দেবে সভ্যতার চাকা, ঠিক যেমনটি চেয়েছিল মৌটুসি। নিউটন কাজ করে, কাজ করে যায় কিন্তু কখনই ভোলে না মৌটুসিকে। যখনই ওর কথা মনে পড়ে আপনা আপনি চলে যায় পরীরাজ্যে। মৌটুসি ওর হাত ধরে বলে, স্বাগতম বন্ধু।