অহি ছেলেটা যেন কেমন! সব সময় উদাস হয়ে থাকে। কেউ ডাকলে একবারে শুনতে পায় না, কয়েকবার ডাকতে হয়। এ জন্য স্যারের বকাও কম খায় না। স্যার এদিকে পড়ায় আর সে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, মেঘেদের দেখতে থাকে সে। জানালার পাশে বসতে স্যার তাকে কয়েকবার নিষেধও করেছেন, কাজ হয় না। দুয়েক দিন বসে না, তার পর আবার শুরু।
ক্লাস সেভেনের অন্য ছেলেরা তার মতো নয়। তাই তারা অহির সাথে খুব একটা মেশে না। খেলার সময়ও অহিকে ডাকে না তারা। কারণ, দেখা যাবে, খেলার মাঝখানে সে একটা পাখি দেখে সেই পাখিটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। অথবা, পিঁপড়ের সারিবদ্ধ গমন দেখে তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, গোল করার দিকে মনোযোগ দেবে না!
ক্লাসে অহির বন্ধু বলতে কেবল হাসনাইন, হাসু বলে ডাকে সবাই। যা মেশে একটু হাসুর সাথেই মেশে, তার সাথে দু’চারটি কথা শেয়ার করে। হাসু বলে, তুই সারাদিন এমন উদাস হয়ে কী ভাবিস? আর পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, পিঁপড়েদের প্রতি তোর কিসের এতো ঝোঁক?
অহি হাসে আর বলে, সে তুই বুঝবি না।
– কেন, না বোঝার কী আছে? হাসু বলল।
– আচ্ছা, তুই কি কখনো ভেবেছিস যে, প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে উড়বি?
– না, আমার কি পাখনা আছে নাকি যে উড়বো?
– এইতো, বললাম না বুঝবি না!
– না বোঝার কী আছে? তুই কি উড়তে পারবি?
– হুম, দেখিস একদিন আমি ঠিকই উড়বো। সেদিন তোরাও আমার মতো উড়তে চাইবি, কিন্তু পারবি না!
– আসলেই তুই একটা পাগল!
– পাগল নাকি আর কী সেদিন বুঝবি। ওই দেখ কী সুন্দর মেঘ! উড়ে উড়ে যাচ্ছে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাচ্ছে, বাধা দেয়ার কেউ কি আছে? ওই মেঘগুলো যদি ছুঁয়ে দিতে পারতাম!
– মেঘকে ছোঁয়া যায় না, এগুলো বাতাসের মতোই। দেখা যায় কিন্তু ছুঁইতে গেলেই আর থাকে না! হাসু বলল।
– তুই কিভাবে জানিস?
– গত বছর ছোটো চাচ্চুর সাথে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেকে গিয়েছিলাম। কী সুন্দর একটা জায়গা, না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। ওখানে মেঘের ভেতরে থাকা যায়।
– তাহলে যে বললি ছোঁয়া যায় না! অহি বিস্ময় নিয়ে বললো।
– হ্যাঁ, মেঘের ভেতরে থাকবি কিন্তু তুই সেগুলো ছুঁইতে পারবি না। এগুলো অনেকটা তুষারের মতো। আমরা যে কটেজে ছিলাম তার জানালা খুললেই মেঘ আর মেঘ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলতেই দেখি কটেজের ভেতরে মেঘের প্রবেশ! আহ, কী চমৎকার দৃশ্য; জীবনেও ভুলতে পারবো না।
হাসুর কথাগুলো শুনতে শুনতে অহি যেন সাজেকের মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেলো! হাসুর ডাকে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, তাহলে মেঘকে ছোঁয়া যায় না?
– না, যায় না। তুই যদি মনে করিস মেঘকে তুলোর মতো করে ধরবি তাহলে সেটা কোনো দিনও সম্ভব নয়।
হাসুর কথাগুলো ভাবতে থাকে অহি। মেঘের মতো উড়তে না পারলে পাখির মতো উড়াও কি তাহলে অসম্ভব! সে মানতে পারে না।
সেদিন ক্লাসে বিজ্ঞান স্যার পড়াচ্ছিলেন। পড়ার মাঝখানে স্যার দেখলেন, অহি ক্লাসের বাইরে তাকিয়ে আছে, পড়ার দিকে মন নেই তার। স্যার তাকে ডেকে বললেন, এতোক্ষণ কী পড়িয়েছি বল তো!
অহি চুপ মেরে আছে।
পড়ার সময় তো সে অমনোযোগী ছিলো, সে কিভাবে বলবে!
স্যার বললেন, ক্লাসের বাইরে বই হাতে দাঁড়িয়ে থাক, যতোক্ষণ পড়া দিতে পারবি না ততোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি!
– স্যার, ক্লাসের ভেতরে দাঁড়াই- অহি অনুনয় করে বলল।
– কোনো কথা নয়। যেখানে বলেছি সেখানেই দাঁড়া। কথা বাড়ালে মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখবো।
অহি কথা না বাড়িয়ে ক্লাসরুমের সামনে বারান্দায় বই হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। তাকে এই অবস্থায় দেখে ক্লাসের দুই-একজন হি হি করে হেসে উঠলো। স্যার তাদের হাসি থামিয়ে আবার পড়ানো শুরু করলো।
পড়া শুরুর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অহি স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালো। স্যার বললো, কী হলো?
– স্যার, পড়া দিতে পারবো।
– বলিস কী! শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক হয়ে গেলি নাকি? ঠাট্টা মিশিয়ে স্যার বললেন।
– পারবো স্যার, নেন।
– না পারলে এবার সোজা মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখবো!
– জি স্যার।
স্যার কটমট চোখে বইটা হাতে নিয়ে পড়া জিজ্ঞেস করতে লাগলো আর অহি স্যারের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলো। তার জবাব শুনে স্যারসহ ক্লাসের অন্য ছাত্ররাও হতবাক হয়ে গেলো! স্যার বললেন, পাঁচ মিনিটে কিভাবে এতো কঠিন প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারলি?
– স্যার, আমার একটু পড়লেই হয়ে যায়। শুধু মনোযোগটা ভালো করে দিতে হয়।
স্যার অবাক হয়ে বললো, তাহলে মনোযোগ পড়ায় না দিয়ে বাইরে দিস কেন?
অহি জবাব দেয় না, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। স্যার অহিকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, শুধু অহি কেন, মনোযোগ দিয়ে পড়লে তোমরাও ওর মতো পারবে। স্যারের চোখ ভিজে গেলো মনে হচ্ছে।
একদিনের ঘটনা। বিকালে স্কুল ছুটির পর কেউ কেউ স্কুল মাঠে খেলে, বেশির ভাগই বাড়ি ফেরে। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, ছাত্রদের ছায়া দ্বিগুণ-ত্রিগুণ হয়ে রাস্তার পাশের জমিতে হেঁটে চলেছে। ছাত্রদের দীর্ঘ ভিড়। সাথে শিক্ষকেরাও আছেন। শিক্ষকেরা ছাত্রদের অতিক্রম করার সময় ছাত্ররা সালাম দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াচ্ছে। অহি একটু আগেই বের হয়েছিলো স্কুল থেকে, সে সবার সামনে। হাঁটতে হাঁটতে অহি দেখতে পেলো তার সামনে লাঠি হাতে গুটি-গুটি পায়ে, ধীওে ধীরে হাঁটছেন ‘বুড়াহুজুর’। বুড়াহুজুর এলাকার খুব সম্মানিত একজন শিক্ষক। বাংলা, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ভাষা ও জ্ঞানে তিনি দারুণ পারদর্শী। বর্তমানে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদেরও শিক্ষক তিনি। অহির বাবা, দাদারও শিক্ষক। বয়স শতক ছুঁই-ছুঁই বা তারও বেশি। এখনো চশমা ছাড়া বই-কোরআন পড়তে পারেন। তাকে দেখে অহি তার হাঁটার গতি শ্লথ করে। অহির হাঁটা শ্লথ হলেও বাকিরা এগিয়ে যেতে চাইলে সে বাধা দিয়ে ইশারায় বললো, দাঁড়াও, বুড়াহুজুর আগে চলে যাক, তারপর আমরা যাবো। কয়েকজন তার কথায় পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে বিজ্ঞান স্যার সেই ছাত্রদের থামিয়ে দিয়ে চুপিস্বরে বললেন, থামো, আগে বুড়াহুজুর চলে যাক, তারপরে যাবে। স্যারের কথায় কেউ আর সামনে আগায়নি। বুড়াহুজুরের হাঁটার গতি এতোই শ্লথ যে পেছনে ছাত্র-শিক্ষকের দীর্ঘ লাইন হয়ে যায়। দূর থেকে মনে হচ্ছে, ত্রাণের জন্য দীর্ঘ লাইন ধরে আছে কিছু লোক!
বুড়াহুজুর যখন বাড়ির কাছে পৌঁছে তখন মাগরিবের আজান হচ্ছিলো। ছাত্র-শিক্ষকেরা ততোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলো, একজন ছাত্রও বুড়াহুজুরকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়নি।
শিক্ষককে সম্মান করার এই ঘটনা দেখে বিজ্ঞান স্যার অহির প্রতি যেন আরও আকৃষ্ট হয়ে গেলো, অবাক তো বটেই।
পরদিন স্কুলে গেলে হাসু বললো, স্যার, অহি নাকি পাখির মতো আকাশে উড়বে!
বিজ্ঞান স্যার হাসুর দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয় উড়বে।
– কেমনে স্যার? ওর কি পাখির মতো ডানা আছে?
– ডানা ছাড়াও ওড়া যায়!
– ডানা ছাড়া উড়তে গেলে তো মাটিতে পড়ে যাবে অহি!
– সে তুমি বুঝবে না। অহি যেহেতু বলেছে, নিশ্চয় সে উড়বে। তখন তোমরা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে আর বলবে, অহি, সত্যি সত্যি তুই উড়ছিস? আমাদেরও তোর মতো ওড়ার সুযোগ দিবি না?
এসব কথা শুনে অহি চুপ মেরে যায়, সে কথার প্রত্যুত্তর দেয় না। ক্লাসজুড়েও নীরবতা নেমে আসে।
অহির মামা প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও অহিদের বাড়িতে আসে। গত দুই মাস আসেনি, আজ এলো। মামা এলে অহির আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে যায়। মামা তাকে চমৎকার সব কথা বলে, মোবাইলে থাকা ভিডিও দেখায়। অহির নতুন নতুন, অদ্ভুত সব ভিডিও দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু তার কাছে মোবাইল না থাকায় সে এসব দেখতে পারে না। মামা এলেই তবে দেখতে পারে।
মামা আসার পর থেকে অহি মামার মোবাইল নিয়ে মেতে আছে। নতুন নতুন কতো আশ্চর্য সব ভিডিও, অহি দেখে আর হতবাক হয়। এমনই একটা ভিডিও দেখে অহির চোখ যেন আটকে যায়! ভিডিওতে দেখা যায়, একলোক একটা উঁচু জায়গায় একটা পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ে একটা যন্ত্র লাগানো, যন্ত্র থেকে হাত পর্যন্ত একটা তারের সংযোগ। হাতে একটা সুইচ। সুইট টিপলেই লোকটি উড়ে উড়ে চারদিকে আধ-মাইল মতো যায়, আবার ফিরে আসে! ওড়ার সময় প্লেনের মতো গড় গড় শব্দ হয়। এই ভিডিও দেখার পর অহির বিস্ময়ের সীমা থাকে না। মানুষ তাহলে উড়তেও পারে! সে তার মামাকে দেখায়। মামা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, এ আর এমন কী! একদিন মানুষ ডানা লাগিয়ে কোনো শব্দ ছাড়াই আকাশে উড়ে বেড়াবে, দেখিস।
অহিও মাথা নেড়ে সায় দেয়। মনে মনে বলে- হ্যাঁ, একদিন ডানা লাগিয়ে কোনো শব্দদূষণ ছাড়াই আকাশে উড়বো। পাখিদের যেন কোনো সমস্যা না হয় এমন করেই উড়বো।
অহি ভাবে- এই ভিডিওটা হাসু ও বিজ্ঞান স্যারকে দেখাতে পারলে ভালো হতো।

Share.

মন্তব্য করুন