চারি দিকে পানি আর তার মাঝে শুষ্ক স্থান, যেখানে বিকাশ ঘটে জীবের, তাকেই বলে দ্বীপ। প্রকৃতিতে এরকম দ্বীপের অভাব নেই বললেই চলে। কিন্তু আজ তোমাদের এমন এক দ্বীপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যে দ্বীপ সম্পূর্ণ তৈরি হয়েছে মানুষের দ্বারা, আর সব থেকে মজার বিষয় এই দ্বীপ ভাসমান, অর্থাৎ এই দ্বীপের স্থান পরিবর্তন করা যায় অনায়াসে। তাহলে চলো শুরু করা যাক! দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর টিটিকাকা হ্রদে ভাসমান এই দ্বীপ। ছোট ছোট মোট ৪৮টি দ্বীপ মিলে তৈরি হয়েছে বিশাল এই দ্বীপ। এই দ্বীপে বসবাস করে ‘উরু’ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, প্রাচীন এই জাতিগোষ্ঠী নিজেরা দ্বীপ বানিয়ে বসবাস করা শুরু করে ১৪ শতক থেকে, এর আগে এরা আমাদের দেশের বেদে জাতিগোষ্ঠীর মত খড় বা ছনের তৈরি নৌকায় বসবাস করত। তারা পানির ওপর বসবাস শুরু করে অনেকটা নিজেদের আত্মরক্ষার তাগিদেই, এরা যে অঞ্চলে বসবাস করে সে অঞ্চলে বসবাস করে ‘এমারা ইন্ডিয়ান’ নামে আরেক জাতিগোষ্ঠী। আর একই এলাকায় দু’টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থাকলে যা হয়, এলাকা নিয়ে সব সময় হতাহতের মত ঘটনা ঘটত। আর উরু জাতিগোষ্ঠী এমারা ইন্ডিয়ানদের মত শক্তিশালী না হওয়ায় এরা নিজেদের সরিয়ে নেয় পানির উপর। আর এভাবেই তারা তৈরি করে ফেলে নিজেদের জন্য দ্বীপ। যে দ্বীপে শত শত বছর ধরে বসবাস করছে তারা।
এই দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে মূলত নলখাগড়া গাছ দিয়ে, যার আঞ্চলিক নাম ‘টরটোরা’। নলখাগড়ার আঁটি বেঁধে বেঁধে ভেলার মতো করে এই দ্বীপ তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও থাকে বিভিন্ন গাছের মূল আর কান্ড, যা এই দ্বীপকে আরো মজবুত করতে সহায়তা করে। যেহেতু এই দ্বীপ মূলত নলখাগড়া গাছ দিয়ে তৈরি আর এটি পানির উপরে সব সময় ভাসমান থাকে, তাই প্রতি মাসেই পুরাতন নলখাগড়াগুলো, যেগুলো দিয়ে দ্বীপটি বানানো হয়েছিল সেটি পরিবর্তন করা লাগে। আর এই কাজের জন্য প্রতি মাসে এই দ্বীপে বসবাসকারী একজন নির্বাচিত হন, যিনি পুরাতন নলখাগড়া গাছগুলো বদলে দেন। এই দ্বীপের ওপর তৈরি বাড়ি আর নৌকাগুলোও একইভাবে তৈরি করা হয়। এই নৌকা আর বাড়িগুলোর আয়ুষ্কাল একেবারে কম হয়।
পানির মধ্যে মাটি নেই। অথচ বসবাসের জন্য যা প্রয়োজন তার সবই আছে এই দ্বীপে! ঘরবাড়ি, পশুপাখি, মানুষ। চলে রান্নাও। লেক টিটিকাকা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি আকর্ষণীয় ও রহস্যময় স্থান। বলিভিয়া এবং পেরুর মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। একইসঙ্গে এটা দক্ষিণ আমেরিকার সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সুন্দর এবং চিত্তাকর্ষক একটি স্থান।
এখানকার অধিকাংশ মানুষ উরোস দ্বীপের অধিবাসী। অধিবাসীদের অধিকাংশ প্রাচীন মানুষদের বংশধর। তারা ভাসমান ঘরে বসবাস করতে ভালোবাসেন। সেটা আবার হ্রদের মাঝে। শত শত বছর ধরেই এটা চলে আসছে। ইনকার রাজা তাদের একসময় এভাবে তাদের বসবাস করতে বাধ্য করে।
দ্বীপটি এক ধরনের নলখাগড়া জাতীয় ঘাসে কারুকাজ করা, যেটা টোটোরা নামে পরিচিত। এই টোটোরা হ্রদের পানিতেই জন্মে। উরোস মানুষরা দক্ষতার সঙ্গে এগুলো প্রথমে একসঙ্গে এঁটে বাঁধেন। তারপর সেগুলো কৌশলে ভাসিয়ে রেখে তার ওপরই বছরের পর বছর বসবাস করেন।
হ্রদের মাঝে তৈরি এই টোটোরা নির্মিত দ্বীপ যেন নড়তে না পারে সেজন্য একটি স্থানে বিশেষ পদ্ধতিতে আবদ্ধ রাখা হয়। তারপর যখন প্রয়োজন হয় তখন এটি নৌকার মতো ভাসিয়ে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এই টোটোরা ঘাস অধিবাসীরা ঘর তৈরি, রান্নাবান্নার কাজ, মাছ ধরা, আসবাবপত্র তৈরি এবং নানা ধরনের গহনা তৈরির কাজে ব্যবহার করে।
শিল্প কাকে বলে তা যেন এই দ্বীপের বাসিন্দারা দারুণভাবে আয়ত্ত করেছেন। টোটোরা ঘাসের তৈরি অসাধারণ সব নৌকা, গহনা, তৈজসপত্র সেসবের নিদর্শন।
এখন পর্যটকরা হ্রদের পানি দিয়ে অথবা বলিভিয়ার লা পাজ শহরের এবং পেরুর কাসকো অথবা অ্যারিকুইপা দিয়ে এখানে আসেন। বিমানেও আসা যায়। তবে বিমান থেকে নেমে তোমাকে এগুতে হবে আরও ৪০ মিনিটের রাস্তা।

আমোদ-প্রমোদের হাইটেক ভাসমান দ্বীপ
ঋাবুন, বিশ্বে একদিন দেখা দিল জম্বি। যারা না জীবিত, না মৃত একটা অবস্থার মধ্যে থাকে। শরীর, মস্তিষ্ক এক রোগে আক্রান্ত। কোনও সুস্থ মানুষকে কামড়ে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সেও হয়ে যাবে জম্বি। এমনিতে যারা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, জোরে কোনও আওয়াজ বা নড়াচড়া দেখলেই যারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আওয়াজের উৎসের দিকে ছুটে চলে। জম্বি নিয়ে একাধিক হলিউড সিনেমা তৈরি হয়েছে। এবার এমন এক ১০০ মিটার ব্যাসের দ্বীপ তৈরির প্রকল্প নিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রমোদতরী নির্মাতা সংস্থা বিএমটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ, যা জম্বিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তৈরি হবে সমুদ্রের মাঝে ভাসমান এক দ্বীপ।
কেমন হবে এই দ্বীপ? ‘প্রজেক্ট ইউটোপিয়া’ নামে এই প্রকল্পে যে প্রমোদতরী তৈরি হবে তা দেখতে অন্যান্য প্রমোদতরী থেকে একদম আলাদা, আদতে এটি একটি ভাসমান দ্বীপ, দেখতে পুরোটাই ইউএফওর মত। এই ভাসমান দ্বীপটির ব্যাস ১০০ মিটার এবং ১১টি স্পানের সমন্বয়ে গঠিত। সমুদ্রের সমতল থেকে ২১৩ ফুট উচ্চতায় থাকবে দ্বীপটি। দ্বীপের পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে দেখা যাবে চারি দিকের দৃশ্য।
ভাসমান এই দ্বীপটির ভারসাম্য থাকবে ৪টি পায়ের ওপর। যেগুলি ডিজাইন করা হয়েছে হেলিকপ্টারের পায়ের আদলে। দ্বীপটিকে এই চারটি পায়ে যুক্ত ইঞ্জিন ও প্রপেলারের দ্বারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।
দ্বীপের উপরে ডেকগুলো কাচ দ্বারা ঢাকা থাকবে। যেগুলো সূর্যের আলোকে ফিল্টার করে ভেতরে প্রবেশ করাবে। আবার প্রয়োজনে ছাদ খোলা যাবে। তাজা হাওয়া ভেতরে আসতে দেবে।
এই প্রমোদতরী বা দ্বীপে কয়েকশো মানুষ একসঙ্গে থাকতে পারবেন। তাঁদের জন্য থাকছে আমোদ-প্রমোদের সব সরকম ব্যবস্থা। থাকছে স্যুইমিং পুল, সিনেমা হল, প্রাইভেট ডকিং স্টেশন, কনভার্টেবল ডেক, অর্থাৎ আমোদ প্রমোদের জন্য যা যা প্রয়োজন সব রয়েছে এখানে।

ভ্যাঙ্কুভারের অদ্ভুত ভাসমান দ্বীপ!
কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের উপকূলে ওয়েন অ্যাডামস (৬৬) এবং ক্যাথিরিন কিং (৫৯) দম্পতি গড়ে তুলেছেন এক অদ্ভুত ভাসমান দ্বীপ। তারা দ্বীপটির নাম দিয়েছেন ‘ফ্রিডম কৌভ’ বা ‘স্বাধীন দ্বীপ’।
১৯৯২ সাল থেকে ছোট্ট এই দ্বীপে বসবাস শুরু করেন তারা। দ্বীপ জীবনে তাদের সঙ্গী হয়ে আছে তাদের দুই সন্তান। পানি, মাছ আর নিজেদের গড়ে তোলা নয়নাভিরাম এই প্রাকৃতিক জগতের সাথে এরই মধ্যে পার করে ফেলেছেন চব্বিশটি বসন্ত।
ওয়েন এবং ক্যাথিরিন দু’জনেই শিল্পী। তারা ছবি আঁকা এবং নাচ গান করার পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। মনোরম দ্বীপটিতে তারা গড়ে তুলেছেন- ড্যান্স ফ্লোর, আর্ট গ্যালারি এবং গ্রিন হাউজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফল-ফুল আর সবজি বাগান।
গ্রীষ্মকালে কাছাকাছি একটি জলপ্রপাত থেকে এবং শীতকালে বৃষ্টির থেকে পানীয় পানি সংগ্রহ করেন। সৌরজগৎ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন।
টলমল নীল পানিতে ঘেরা আর নীল সাগরের সীমানায় এই দ্বীপে নিকটবর্তী শহর থেকে যেতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। পর্যটকদের জন্য এই দ্বীপ খোলা থাকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
শহর থেকে দূরে সুখে-শান্তিতে বাস করার আশায় কানাডিয়ান দম্পতি ওয়েন অ্যাডামস এবং ক্যাথরিন কিং বিশ বছরের চেষ্টায় আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছেন কৃত্রিম এই দ্বীপ। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভ্যানকুভার দ্বীপের পাশেই তৈরি করা হয় ভাসমান দ্বীপটি। ১৯৯১ সালে ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপটি তৈরি করা শুরু করেন এই দম্পতি। ২০ বছর পর এটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সেখানেই বসবাস শুরু করেন তারা।
ভাসমান এই দ্বীপে একটি আর্ট গ্যালারি, গেস্ট লাইটহাউজ, ৫টি গ্রিন হাউজ এবং একটি স্টুডিও রয়েছে। তবে শৈল্পিক এই দ্বীপটিতে কোনো ফ্রিজ ব্যবহার করেন না তারা। ৫টি গ্রিনহাউজ থাকায় সবসময়ই টাটকা খাবার পায় অ্যাডামস পরিবার। আর মাছের সরবরাহ তো আছেই। গ্রীষ্মকালে তারা একটি নিকটবর্তী ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করেন। আর অন্য সময় এর মূল উৎসই থাকে বৃষ্টি। তবে দ্বীপটির ফিরোজা ও ম্যাজেন্টা রঙের স্থাপনাগুলো অনেক সময় সবুজ গাছ এবং নীল পানির সৌন্দর্যকেও হার মানিয়ে দেয়। উপর থেকে দেখলে বোঝা যাবে ফিরোজা এবং ম্যাজেন্টা রঙই এখানে আধিপত্য বিস্তার করছে।
দ্বীপটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রথমে ১৪টি সোলার প্যানেল ব্যবহার করেন অ্যাডামস। তবে একটি ঝড়ে প্যানেলগুলো ভেঙে গেলে বিকল্প রাস্তা খোঁজেন অ্যাডামস। এখন তিনি একটি ছোটো হোনডা জেনারেটর ব্যবহার করেন যা ৩ হাজার ওয়াট শক্তি সরবরাহে সক্ষম। অ্যাডামস বলেন, ‘আমরা দু’জনই আমাদের জীবনে অনেক কিছু করেছি, অনেক কষ্টে সময় পার করেছি। তাই আমরা এই ব্যতিক্রমী জীবনের জন্য নিজেদেরকে তৈরি করছিলাম। এখন আমরা সত্যিই ভালো আছি।’ অ্যাডামস এবং কিংকে তাদের এই ব্যতিক্রমী জীবন নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু এর মাঝেই সৃজনশীল কাজের জন্য তারা তাদের সময় বের করে নেন।
ক্যাথরিন কিং একজন চিত্রশিল্পী, লেখিকা এবং সঙ্গীতশিল্পী। অপরদিকে অ্যাডামস একজন ভাস্কর। গ্রীষ্মকালে তাদের শিল্পকর্ম দেখতে পার্শ্ববর্তী টফিনো থেকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু এই মাস্টারপিস কিভাবে তৈরি হলো? হাফিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাডামস জানান, ‘একবার শীতকালে একট ঝড়ে গাছের একটি ডাল ভেঙে পড়ে যায়। আমরা সবগুলো ভাঙা কান্ড জোগাড় করি। পরে এগুলোর মালিকের কাছে এগুলো দিতে গেলে তারা বলে এগুলো তোমাদের কাছে রেখে দাও। তখন আমরা ভাবলাম এখন বোধ হয় আমাদের বাড়ি বানানো উচিত।’ ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মে তারা সব কাঠ ও গাছের ডাল দিয়ে একটি দ্বীপ বানানোর কাজ শুরু করলেন। সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতেই তারা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখনও ঠিক সেই জায়গাতেই দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই বসবাস করছেন অ্যাডামস ও কিং।

Share.

মন্তব্য করুন