মেহজাবিনরা ঢাকায় নতুন এসেছেন। বাবা তাকে ঢাকায় ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। মেহজাবিন ক্লাস ফোরে পড়ে। ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাট ভালো করে চেনে না ও। তাই বাবা অফিস যাওয়ার সময় তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যান। স্কুল ছুটি হলে মা গিয়ে নিয়ে আসেন।
ঘুম থেকে উঠা, স্কুলে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া করা, খেলাধুলা করা এমনকি টিভিতে কার্টুন দেখা পর্যন্ত সবকিছু সে রুটিন মাফিক করে। বাবা তাকে রুটিন মাফিক জীবন চলতে শিখিয়েছেন। প্রথমে প্রথমে রুটিন মাফিক জীবনে চলতে গিয়ে তার একটু একটু সমস্যা হলেও এখন আর কোনো সমস্যা হয় না তার। বরং ভালো লাগে।
বাবা তাকে আরো শিখিয়েছে কিভাবে সুন্দরভাবে জীবন গড়তে হয়। একবার হেরে গেলে কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হয়। একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কিভাবে সকল প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। রুটিন মাফিক জীবন চলার কারণে অল্পদিনের মধ্যে একজন ভালো ও আদর্শ ছাত্রী হিসেবে তার নাম স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে। স্যারদেরও বিশেষ দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। তাকে পেয়ে স্যারেরাও যেন গর্বিত। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা সবখানে তার সরব উপস্থিতি। একবার ভিকারুন্নিসা স্কুলের সাথে তার স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিটিভি সেই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। আর ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের একজন মাননীয় মন্ত্রী। সেই বিতর্ক অনুষ্ঠানে মেহজাবিনের তীক্ষè বুদ্ধির কারণে তার স্কুল প্রথম হয়েছিল।
তা দেখে হেড টিচার সে কী খুশি!
গর্বে যেন আকাশ ছুঁয়ে যায় তাঁর মাথা!
একদিন স্কুল ছুটির সময় শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে মেহজাবিনের মা যথাসময়ে স্কুলে আসতে পারলেন না।
মেহজাবিন স্কুলের বারান্দায় চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখছে। ঝুম বৃষ্টি।
এই মেহজাবিন?
মেহজাবিন মাথা ঘুরিয়ে দেখল অনুশা। তার পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। কিরে অনুশা, কিছু বলবে?
অনুশা বলল, ওভাবে কী দেখছ রে?
বৃষ্টি।
তাই বুঝি ?
হুম। বৃষ্টি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
আর বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে না?
ভিজিনি কোনো দিন।
মেহজাবিনের কথা শুনে অনুশা অবাক। কী বলো? কোনো দিন ভেজোনি !
না তো।
কেন?
বাবি বলেছে, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর-সর্দি হয়। বাবাকে বাবি বলে ডাকে মেহজাবিন।
কচু।
অনুশার দিকে তাকাল মেহজাবিন। মানে?
মানে, বৃষ্টিতে ভিজলে কোনো জ্বর-সর্দি হয় না।
বাবি যে বলেছ!
আরে, বাবা-মায়েরা এমনিতেই ওসব কথা বলে। তুমি বৃষ্টিতে ভিজেই দেখো না, কী মজা!
মেহজাবিন দেখলো স্কুলের অনেক ছাত্র-ছাত্রী বৃৃষ্টির পানিতে ভিজছে। দাপাদাপি করছে। লাফালাফি করছে। অনুশাও দৌড়ে গেলো মাঠে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা হাত পূর্বে আর একটা হাত পশ্চিমে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে। বৃষ্টির পানি তার হাঁ করা মুখে পড়ছে। সে ঢক ঢক করে বৃষ্টির পানি গিলছে। কিছুক্ষণ এভাবে বৃষ্টির পানি গিলার পর আবার দৌড়ে এলো মেহজাবিনের কাছে। বলল, এই মেহজাবিনÑ আয়, আয়। তাড়াতাড়ি মাঠে আয়। বৃষ্টি ছেড়ে যাবে তো!
বৃষ্টির পানিতে ভেজা ঠিক হবে কী হবে না- ভাবতে ভাবতে অনুশা এসে তার হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল বৃষ্টির পানিতে।
বৃষ্টিতে ভিজতে কী যে আনন্দ !
খুশিতে লাফাতে লাগল মেহজাবিন।
অনুশা এসে তার দুই হাত ধরল।
তারপর দুইজনে হাত ধরে চারপাশে ভিন ভিন করে ঘুরতে লাগল।
পরদিন অনুশা বলল, কি রে মেহজাবিন, জ্বর-সর্দি লেগেছে নাকি?
না।
বলেছিলাম না, কচু! বাবা-মায়েরা ওসব অনেক কথাই বলে, বুঝলে? বাবা-মায়ের সব কথা শুনতে হয় না।
অনুশার কথা শুনে মেহজাবিন মনে মনে ভাবে তাহলে কী বাবি সত্যিই এতোদিন আমাকে সব মিথ্যে কথা বলে আসছে? মিথ্যে বলে আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে?
বাবির প্রতি প্রচ- রাগ আর অভিমান হয় তার।
ধীরে ধীরে অনুশার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ঘন হয়, আর বাবির সঙ্গে বাড়ে দূরত্ব!
আস্তে আস্তে মেহজাবিন রুটিন মাফিক জীবন থেকে সরে আসে। লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলা নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে ও। বাবা-মা তাকে অনেক বুঝায়, কিন্তু তার অভিমানী মনে বাবা-মায়ের সব কথা মিথ্যা মনে হয়। বিষাদের মতো ঠেকে! ফলে বাবা-মায়ের কোনো কথা শোনে না সে। নিজের খেয়াল খুশির মতো চলতে থাকে।
আসে পরীক্ষা।
পরীক্ষা দেয় সে।
পরীক্ষার ফল বের হলে প্রচ- শক খায় মেহজাবিন। প্রথম স্থান থেকে চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে সে। জীবনে এই প্রথম কোনো পরীক্ষায় তাকে প্রথম স্থান হারাতে হলো। প্রথম স্থান হারিয়ে খুব কান্না পাচ্ছে তার। চোখের পাতা ভিজে আসছে।
মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ও। নিজের রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ভীষণ অবসন্নতা গ্রাস করে বসেছে তার শরীর আর মনে। এখন সে তার ভুল বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে বাবা-মায়ের কথা না শোনার কারণে আজ তার রেজাল্টের এই পরিণতি!
গালের ওপর তপ্ত গরম তরল কিছু পড়লে চমকে উঠে মেহজাবিন। দেখে বাবি পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বাবির চোখের গরম পানি তার গালে টপটপ করে পড়ছে। হেড টিচার ফোনে বাবিকে তার রেজাল্টের কথা জানিয়েছেন। বাবিও মেয়ের এই অধঃপতন মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। তিনিও কাঁদছেন। মেহজাবিন উঠে বাবিকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বলল, সত্যিই বাবি, আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি। তোমার কথার অবাধ্য হওয়ার কারণে আজ আমার রেজাল্টের এই পরিণতি! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবি। আমি আর কোনো দিন তোমার কথার অবাধ্য হবো না। তোমার সব কথা শুনবো। সব।
Share.