কতটা ব্যথিত হলে একজন মানুষ মরার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে, বলতে পারেন?
ফাহিম ইন্টারমিডিয়েড পড়ুয়া এক ছোট ছেলে এবং অনেক আত্মসম্মানবোধ তার মধ্যে। কিন্তু যেন এই বয়সই তাকে অনেক বড় করে তুলেছে। জীবন যুদ্ধে যুদ্ধ করা হাজারো সৈনিকের তালিকায় আজ তার নাম লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। জীবন সম্পর্কে এই ছোট্ট ছেলেটা আজ অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন, তাইতো এ জীবন না রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
যাহোক, আজ দেড় মাস হল ফাহিমের শুকনো কাশি আর সর্দি। কাশ উঠলে থামানো যায় না, ওষুধও খেয়েছিল অনেক টাকার কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কোন রোগের লক্ষণ তাও সে জানে না। এখন প্রয়োজন কোনো ভালো মেডিসিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার। কিন্তু পর্যাপ্ত টাকার অভাব। এমনিতেই প্রাইভেট শিক্ষকদের তার টাকা দিতে অনেক অসুবিধা হয়। মধ্যবিত্ত পরিবার বলে হিমশিম খেতে হয় । তার ওপর আবার মাসের শুরুতে। এখন আবার চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা। সামান্য কটা টাকা দিয়েছে ফাহিমকে। ঢাকা শহরের ডাক্তারগুলোর ভিজিট আর এক্সরে রিপোর্টের মত রিপোর্টে তা অত্যন্ত নগণ্য। আজ আবার সে আগের মত পল্লী চিকিৎসকের দুটো ওষুধ নিয়েছে। কাজ হবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ আগের একগাদা ওষুধ কোনো কাজে আসেনি। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তার।
আর এই অসহায়ত্বের একমাত্র কারণ দরিদ্রতা অর্থাৎ টাকার অভাব। কোথায় পাবে সে টাকা, মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বাবা যে এত টাকা দিতে পারে না। আজ পর্যন্ত অনেকে তাকে জিজ্ঞাসা করেছে যে, সে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে না কেন? নীরবভাবে সেই এক উত্তর, ‘ওষুধ খাচ্ছি তো নিয়মিত’। এটাকে তো দরিদ্রতা ঢাকার ক্ষুদ্র প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তব অভিনয়ও বলতে পারি।
দরিদ্রতা ঢাকতে কত কিছুই না করতে হয় দরিদ্রকে।
সবকিছু শোনার পরে,
– আচ্ছা তোর কয় মাস ধরে সমস্যা হচ্ছে বললি?
– ভাই দেড় মাসেরও বেশি হবে মনে হয়।
কিছুক্ষণ নীরবতা, নীরবতা কাটিয়ে, হাঁফ ছেড়েÑ
– ও আচ্ছা, আয় আমার সাথে।
চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে চিন্তা করছে রফিক,
কী করা যায়? সত্যিই কি করার মত কিছু নেই? নাকি কিছু করতে পারি? এসব ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপে চা শেষের দিকে। নিজের অজান্তেই কাপের তলায় পড়ে থাকা চাটুকুও খেয়ে ফেলেছে রফিক, যেটুকু স্বভাবতই খাওয়া হয় না। চা শেষ হতে না হতেই রফিক সিদ্ধান্ত নিল যে, ফাহিমকে ডাক্তার দেখানোর টাকা সে দেবে। কিন্তু সে কি নেবে? না, ছেলেটা যে বড় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন।
যদিও নেয় তাহলে হয়তবা অন্য খাতে খরচ করবে, কারণ সেও তো লেখাপড়া করে।
তাহলে?
না, আমি নিজেই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। রফিক এরকমটাই ভাবছে।
চা খাওয়া শেষে রফিক বিল দিতে গিয়ে নিজের মানিব্যাগের টাকার দিকে তাকায়। অনেকগুলো টাকা। দুদিন ধরে কারো সাথে দেখা হয়নি, আড্ডা দেয়া হয়নি, তাই হয়ত টাকার পরিমাণটা একটু বেশিই। তাছাড়া, বাবার কাছে মিথ্যা বলা সেই হাজার টাকার নোটটিও নজরে পড়ল তার। হঠাৎ আজকে সে ভাবছে, এই যে এতগুলা টাকা হয়ত সে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় উড়িয়ে দেবে, নয়ত বার্গারের পিছনে ফুরিয়ে যাবে। তাতে কী লাভ? কিন্তু সেই টাকা দিয়ে যদি কারো অমূল্য জীবনের উপকার হয় তাহলে তো সে টাকা খরচ করা সার্থক।
সার্থকতা আর অসার্থকতা নিয়েই তো জীবন।
জীবনে বাবার টাকা তো আর কম খরচ করা হয়নি, তাই হয়ত টাকার অভাব বুঝতে পারিনি। কিন্তু ফাহিমের মত কেউ হয়ত আমার থেকে টাকার প্রয়োজনটা বেশি বোঝে, যদিও আমার থেকে ছোট। এখানে সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, ‘যাঁহারা বৃহৎ সূক্ষ্ম একত্র দেখিয়া কার্য করেন, তাঁদেরই প্রশংসা করি।’ তাই শেষ পর্যন্ত রফিক তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।
– চল আমার সাথে।
– আর কোথায় যাব ভাই? আমাকে তো যেতে হবে।
– আজকে না হয় একটু লেট করে যাবি। কোনো সমস্যা হবে?
– না ভাই।
রফিকের বাসার পাশে যে প্রাইভেট হাসপতালটি সেটি নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশটা বেশ ভালো।
বেশ কিছুদিন হলো এখানে ডিসকাউন্টে চিকিৎসা সুবিধা চালু হয়েছে। তা ছাড়া ফাহিমের তো মেডিসিন ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। এখানে তিন-চার জন মেডিসিন ডাক্তার রয়েছেন। যার মধ্যে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। উনি প্রতিদিনই রোগী দেখেন। শুধুমাত্র ছুটির দিন ব্যতীত। তাই রফিক চিন্তা করল হয়তবা এখানেই ভালো হবে। তারা পৌঁছে গেল সেই হাসপাতলে।
– ভাই হাসপাতালে কেন? ডাক্তার কাছে যাবেন নাকি?
– উহু, না। আমি না তুই যাবি।
– মানে?
– মানে কিছুই না। তোকে ডাক্তার দেখাতে হবে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– কিন্তু ভাই এখন আমার কাছে তো…।
– বলা লাগবে না, তুই আমার সাথে আয়।
শেষ পর্যন্ত সেই মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে গেল সে। ডাক্তারকে দেখিয়ে বের হলে রফিক প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে বলল,
– টেস্ট দেয়নি?
– না। দেয়নি।
যাক কিছুটা ভরসা পাওয়া গেল, সমস্যা তেমন একটা জটিল না। সেখান থেকেই পাঁচ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে ওষুধ কিনে দিল রফিক। খরচ তেমন একটা হয়নি। এখনো তার মানিব্যাগে অনেকগুলো নোট পড়ে রয়েছে। যেগুলো দিয়ে হয়তবা ফাহিমের মত ছেলেদের নিঃসন্দেহে সপ্তাহখানেকের বেশি চলবে।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ফাহিমের চোখ মুখ কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মনে হয় রোগা চেহারার সেই আভাটা নিমিষের মধ্যেই কেটে গেছে। বের হতে না হতেই ফাহিম বলে উঠলÑ
– ভাই আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। আসলে বলার ভাষা নেই আমার। সত্যিই আপনি একজন ভালো মানুষ। কথাটা বলা শেষ না হতেই রফিক মজার সুরে বলে উঠল-
– তুই যে কি বলিস না পাগল-ছাগল। তোরে আবার মানসিক ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না তো?
ঠাট্টা করা তার স্বভাব, আসলে ঠাট্টা করা স্বভাটা গেল না ছেলেটার।
তারপর মৃদু স্বরে একটি কথাই বলল, নিজের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য। আর সেই দায়িত-কর্তব্য পালনে সবারই সচেতন হওয়া উচিত।
বের হয়েই রফিক বলল, আয় কফি খেয়ে আসি এই বলে পাশের ফাস্টফুডের দোকানটার দিকে পা বাড়াতেই,
– ভাই সন্ধ্যে হয়ে গেছে আমাকে যেতে হবে, থাক কিছু খাব না।
রফিক কিছু বলল না। শুধু ফাহিমের চোখের কোণে জমা অশ্রুটুকু পরখ করল।
মুহূর্তে কেন জানি তার ঠাট্টার স্বভাবটা চলে গেল। কিছুটা ম্লান মুখে বিদায় জানাল ফাহিমকে। ফাহিম বাসে উঠছে। রফিক নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ফাহিমের যাওয়ার পথে।
রফিকের বুকে যেন সুখের স্পন্দন। পৃথিবীর বুকের সর্বোচ্চ সুখ ভোগ করছে সে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে তার নিজেকে এই সুখের ভাষা কবির কবিতা বা লেখকের লেখনী দিয়ে বোঝানো যাবে না।
এমন সময় ‘ভাই’ ডাক শুনে চমকে উঠে রফিক। তাকিয়ে দেখে পাশের দোকানের বার্গারওয়ালা সেই ছেলেটি।
– ভাই আজকে গরম গরম চিকেন ফ্রাই। বার্গার আর ব্ল্যাক কফিও প্রস্তুত আছে, আসেন না।
– নারে তুই যা আজকে।
– হাছা কথা ভাই! বিশ্বাস না হলে দেখে লন।
– না, না। বিশ্বাস না হওয়ার কী আছে? আজকে বার্গার না খেয়েও অনেক ভাল আছি, পরে আসব।
চলে গেল রফিক কিন্তু বার্গারওয়ালা সেই ছেলেটি যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। সেও নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কি সত্যিই রফিককে দেখছে, নাকি স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যি সত্যি? সেও যেন অন্য কিছু দেখছে।
দেখছে ভালোবাসা!
একবুক ভালোবাসা!
যাতে রয়েছে সুখের স্পন্দন।
আজকে সে রফিক ভাইকে ভালোভাবে চিনতে পারল, এতদিন ভুল দেখেছে।
Share.