তিন.
মৌটুসি উড়ছে তো উড়ছেই। উড়ছে তো উড়ছেই। উড়ছে আর কথা বলে চলেছে।
: দেখ এই যে এখন আমরা যেখান দিয়ে যাচ্ছি এর নিচে যে নদীটা দেখছ এটা হল পদ্মা নদী। পদ্মা নদীর নাম শুনেছ তো? হ্যাঁ এটা সেই নদী যে নদীর উপরকার সেতু নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে তোমাদের দেশে। এসব নিয়ে আমরা পরীরাও হাসাহাসি করি। এটা অনেক বড় নদী। এ নদীর ইলিশ মাছ বিখ্যাত। একদিন আমি খেয়েছিলাম। প্রচ- বিস্ময়ে নিউটন বলল,
: তুমি আমাদের ইলিশ মাছ খেয়েছিলে। কোথায় কিভাবে খেলে? পরীরা মাছ খেতে পারে?
: অদ্ভুত ছেলে তো তুমি। একসাথে এত প্রশ্ন করলে জবাব দেব কি করে? আর আমি ইলিশ খেয়েছি শুনে তুমি এত অবাকই বা হচ্ছ কেন বুঝলাম না। আমি জানি ইলিশ তোমাদের দুই দেশের মানে বাংলাদেশ আর ভারতের বাঙালিদের খুব প্রিয়। তাই বা বলছি কেন শুধু বাংলাদেশ আর ভারতই নয়, বিদেশিরাও এখন দেদার ইলিশ খাচ্ছে। তাই একদিন আমার খুব জানতে ইচ্ছে হল ইলিশ এমন কি মাছ যা সবাই পছন্দ করে। আমি খেয়ে দেখলাম। কিন্তু আমি ইচ্ছে করলেই তো আর ইলিশ খেতে পারব না বা কিনতে পারব না আর কিনলেও রাঁধতে জানি না তাই আমি করলাম কি, আমি একদিন এক বিদেশি মহিলা হয়ে গেলাম।
: কী কা- তুমি মানুষও হতে পার ?
: পারব না কেন, মানুষ ভূত পেতিœ মাছ গাছ সবই হতে পারি। আচ্ছা শোনই না গল্পটা। তুমি শুধু ডিস্টার্ব করো এটা তোমার একটা খারাপ অভ্যাস। তা আমি বিদেশি রমণী হয়ে তোমাদের কারওয়ান বাজারে ঢুকে পড়লাম।
: তুমি কারওয়ান বাজারও চেন? ওটা কোথায়, কোন জেলায়?
: চিনি, ঢাকায়। ওখানে সব জিনিস পাইকারি দরে পাওয়া যায়। তবে একসাথে বেশি করে নিতে হয়।
: কি আশ্চর্য তুমি যা জান আমি তা জানি না।
: সেটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ নিজেরটা নিজে চেনে না জানে না। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া।
এবার নিউটনের বিস্ময় আর বাধ মানে না। সে চিৎকার করে ওঠে। আর সাথে সাথে নড়ে যায় সে। পরীর পিঠের উপর থেকে সে পড়ে যেতে থাকে। তবে পড়তে পড়তে খাবলে ধরে পরীর ডানা। আর্তচিৎকার করে ওঠে, বাঁচাও বাঁচাও।
মৌটুসি এক ঝটকায় আবার তাকে পিঠে বসিয়ে দেয়। বিরক্তির সাথে বলে,
: তুমি বড় অধৈর্য। অত ছটফট করার কি আছে, পড়ে গেলে কি হত বলত?
: না মানে তুমি রবীন্দ্রনাথের নাম জানো, তার কবিতা জানো, তাই অবাক হলাম। আমিতো মাত্র কদিন আগে রবীন্দ্রনাথের নাম জানলাম। উনি আমাদের বিশ্বকবি।
: উনি আমাদেরও বিশ্বকবি। কবির আবার মানুষের কবি, পরীর কবি এসব কি! কবি হচ্ছে সবার কবি। সব ভাল জীবের কবি, আর খারাপ জীবের যম। আচ্ছা এবার গল্পটা শোন। আমি কারওয়ান বাজারে গেলাম, এক মাছের দোকানদারের সামনে দাঁড়ালাম। সেখানে তখন প্রচ- ভিড়। দাঁড়াবারও জায়গা নেই। তা ছাড়া আমি জানতাম না শুক্রবার দিন সব মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাজারে। আমি ওই শুক্রবারেই গেছিলাম। আর মানুষেরা মোটেও সুবিধার না। দেখছে একজন মহিলা দাঁড়িেেয় আছে তাকে মোটেও জায়গা দেয় না। তুমি কিন্তু বড় হয়ে অমন খারাপ হবে না মোটেও। মনে থাকবে? যাক শোন কোন রকমে তো দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ দোকানির চোখ পড়ল আমার উপর। সে ভাবল বিদেশি যখন যা দাম চাইব তাই দেবে। তাই সে খুশি হয়ে উঠল। অন্য ক্রেতাদের রেখে আমার দিকে তাকাল। আমি তাকে ইলিশ দেখিয়ে বললাম,
: হাউ মাস ?
: ওয়ান, টু, ফোর অর ডজন ?
: আমি দেখলাম ও কিছুটা ইংরেজি জানে। বললাম হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ডজন?
এবার ও একজন ক্রেতার সাহায্য নিয়ে বলল,
: টুয়েলভ পিস।
: ওকে টুয়েলভ পিস হাউ মাস?
এবারও সেই ক্রেতার সাহায্য নিয়ে ও বলল,
: টয়েনটি ফাইভ থাউজেন্ড।
: ওকে ডান।
আমি বার পিস মাছ কিনলাম। কেনার পর পড়ে গেলাম বিপদে। এ মাছ নিয়ে এখন আমি কি করব। মাছ কেনা তো আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্য মাছ খাওয়া। আর ওদিকে মাছ বিক্রি হওয়ামাত্র দোকানি আমাকে তার সামনে থেকে সরাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল,
: ম্যাডাম প্লিজ টেক ইউর ফিশ অ্যান্ড গো। কিন্তু আমি যাবো কোথায়, আর এই মাছ আমি রাখব কোথায়? কাজেই দোকানিকে ইশারায় বার বার ডাকতে লাগলাম। দোকানি কিছুতেই উঠতে চায় না। ও যেন এখন আমাকে চিনছেই না। বার বার শুধু বলছে, গো গো। তখন আমি জোরে বললাম,
: প্লিজ হেয়ার মি। তখন সে আমার কাছে উঠে এল। আমি তাকে নিয়ে একপাশে দাঁড়ালাম। পরিষ্কার বাংলায় বললাম, দেখ যে মাছ আমি কিনেছি তার সব কটা আমি তোমাকে গিফট করলাম। দোকানি হকচকিত হয়ে গেল। সন্দেহের কণ্ঠে বলল, কেন কেন। তুমি কি টাকা ফেরত চাও? সেটা কিন্তু দেয়া যাবে না। আমি কিন্তু মাছ তোমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। বিক্রি করা মাছ আমি ফেরত নিই না। আর হ্যাঁ শোন তুমি এমন পরিষ্কার বাংলা বলছ কি করে? একটু আগেই তো ইংরেজিতে কথা বলছিলে। কে তুমি? বলতে বলতে একটু থমকে গিয়ে বলে, ও তুমি না আপনি।
: অত ঘাবড়ে যেও না, শান্ত হও। আর হ্যাঁ ‘তুমিই’ বল। ওটাই শুনতে ভালো লাগে। আমি ক্রিস্টিনা। আমি সব ভাষা জানি। একজন মানুষ অনেক ভাষা জানতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? যাক শোন তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ। তোমার মাছ আমি ফেরত দিতে চাচ্ছি না। তোমার কাছে আমি টাকাও ফেরত চাচ্ছি না। আমি মাছগুলো তোমাকে গিফট দিচ্ছি।
: কিন্তু কেন?
: তুমি পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে মাছ কিনলে এখন সেটা আমাকে গিফট দিতে চাচ্ছ। গিফটই যদি দেবে তাহলে মাছ কিনলে কেন? না না ও মাছ নিয়ে আমি কোন বিপদে পড়তে পারব না। বিদেশিদের বিশ্বাস নেই। তোমার মাছ তুমি নিয়ে যাও এবং খুব তাড়াতাড়ি। তোমার জন্য আমার বেচাকেনায় ডিস্টার্ব হচ্ছে। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমার এরই মধ্যে।
: শোন তোমার যা ক্ষতি হয়েছে আমি পুষিয়ে দেব। তুমি মন দিয়ে আমার কথা শোন। তুমি জানতে চাচ্ছিলে না আমি কেন তোমাকে মাছগুলো গিফট করতে চাই। আমি আসলে গত রাতে স্বপ্ন দেখেছি কারওয়ান বাজারের সবচেয়ে ভাল মাছওয়ালাকে আমি যেন এক ডজন মাছ গিফট করি।
এবার হাঁ করে তাকিয়ে রইল মাছওয়ালা। তারপর অস্ফুুটে বলল,
: তুমি স্বপ্ন দেখেছ একজন মাছওয়ালাকে মাছ গিফট করতে। তুমি নিশ্চয়ই কোন বিদেশি মাছওয়ালাকে গিফট করার স্বপ্ন দেখেছ।
: আরে না না, কারওয়ান বাজারের সবচেয়ে ভাল মাছওয়ালাকে গিফট করার স্বপ্ন দেখেছি।
: তুমি জানলে কি করে আমি সবচেয়ে ভাল মাছওয়ালা?
: তোমার চেহারাই বলে দিচ্ছে। কি সুন্দর ঝাঁকড়া চুল তোমার আর কি বড় বড় চোখ।
এবার মাছওয়ালা ভীষণ খুশি হয়ে গেল। সে বার বার নিজের চুলে হাত বুলাতে লাগল। মুখে বলল,
: তা যা বলেছ, আমার মাও তাই বলত। কিন্তু তুমি সব মাছ আমাকে দিয়ে দেবে এটাই বা কেমন দেখাবে। অন্তত একটা দুটো নাও।
: না মাছ নেব না, তবে তুমি যদি চাও তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার বউয়ের হাতের মাছ ভাজা, মাছ রান্না খেয়ে আসতে পারি। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে বাঙালির হাতে ইলিশ রান্না খাই। তবে না থাক তাতে তোমার ব্যবসার ক্ষতি হবে।
: না না কোন ক্ষতি হবে না। আমি আমার ভাইকে বসিয়ে রেখে যাচ্ছি। তুমি একজন বিদেশি একটু ইলিশ রান্না খেতে চেয়েছ এ যে আমার কত বড় সৌভাগ্য বল। চল। তুমি আমার বাড়িতে গেলে আশপাশের লোকের কাছে আমার ইজ্জতও বাড়বে। তবে কি জানো আমি কিন্তু খুব গরিব। ছোট্ট একটা ঘরে থাকি। তোমাকে বসাবার মত জায়গা নেই ঘরে। কোন ডাইনিং টেবিলও নেই। আমরা মাটিতে বসে খাই।
: তাতে কি আমি মাটিতে বসে তোমাদের সাথে খাব বাঙালি কায়দায়।
: মাছওয়ালা, পরে জেনেছিলাম ওর নাম রহমত। ও আমাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে গেল। আর সাথে নিল সবচেয়ে বড় ইলিশটা। যেতে যেতে আমাকে বলল, বুঝলে মেমসাহেব এটা হচ্ছে পদ্মার খাঁটি ইলিশ। এই যে দেখছ বুকের দিকটা চওড়া। আর যেগুলোর বুকের দিকটা চিকন বুঝবে ওটা অন্য কোন নদীর মাছ, পদ্মার বলে চালাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি বললে, পদ্মার খাঁটি ইলিশ তাহলে পদ্মায় কি নকল ইলিশও হয়। ও খুব হাসল। যেতে যেতে বলল, আর কি খাবা বলো? আজ আমার হাতে অনেক টাকা। তুমি একাই তো পঁচিশ হাজার দিয়েছ। আবার ওই মাছই বিক্রি হবে পনের বিশ হাজারে। আমি একদিনেই বড়লোক হয়ে গেলাম। বলো কি খাবা তরমুজ, রসগোল্লা, পান্তুয়া। আমার উত্তরের অপেক্ষা করল না ও। সামনে যা পেল তাই কিনল। একসময় ওকে আমি মানা করলাম। আমরা যাচ্ছিলাম একটা সিএনজিতে। ও আমাকে খাতির করে রিক্সার বদলে সিএনজি নিয়েছে। আর তোমাদের ঢাকা শহরে যা জ্যাম। বার বার আটকে যাচ্ছিল সিএনজি। আমি দরদর করে ঘামছিলাম। রহমত বারবার বলছিল, আমি জানি মেমসাহেব তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করব বলো। রাস্তার জ্যামের উপরে তো আমার হাত নেই। আর সিএনজিতে এসি থাকে না।
: আরে না না আমার কোনই কষ্ট হচ্ছে না। মুখে বলছিলাম বটে কিন্তু মনে মনে ভাবছিলাম যদি আমার ডানায় ওকে বসিয়ে নিয়ে যেতাম তাহলে কখন চলে যেতাম ওর বাড়িতে। কিন্তু সেটা করলে ও জেনে যাবে আমি পরী। কোন অবস্থাতেই জানানো যাবে না আমি পরী। তাহলে ও ভয় পেয়ে যাবে। আর আমার ইলিশ মাছ খাওয়া হবে না। আমাদের একটা অসুবিধা হচ্ছে আমরা মানুষ হতে পারি, পশু পাখি সব হতে পারি কিন্তু ডানা পুরোপুরি অদৃশ্য হয় না। তাই ডানা দুটো ভাঁজ করে রাখতে হয়। কৌশলে ডানা ভাঁজ করে ওর পাশে বসে আছি আমি। ও নানান ধরনের গল্প করছে। মাছের ব্যবসায় কত লাভ হয়, কোথা থেকে মাছ কেনে, হরতালের কারণে মাঝে মাঝেই তাদের নানারকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফরমালিন না দিলে মাছ পচে যায় আর দিলে সরকার জরিমানা করে। এটা কি ঠিক বলো তো মেমসাহেব? এসব নানা ধরনের কথা বলল ও। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
: আচ্ছা তোমাদের দেশে এত ঘন ঘন হরতাল হয় কেন বলত? আমাদের রাজ্যে তো কোন হরতাল নেই। ও বলল, বোঝোনি মেমসাহেব, একদল গদিতে যেতে চায় আর একদল গদি আঁকড়ে থাকতে চায়। তাই নিয়ে যত মারামারি, পেট্রল বোমা আরও কত কি। ওদের কোন অসুবিধা নেই, অসুবিধা হচ্ছে আমাদের মত গরিব মানুষের। হরতাল হলে ট্রাকের ভাড়া বেড়ে যায়। তাই মাছের দামও বেড়ে যায় আর মানুষ আমাদের সাথে রাগারাগি করে। মাছ কেনে না। ওরা হরতাল করে আর আমরা মরি।
: ঠিক একই কথা বলে আমার আব্বা। আব্বা তো রাজমিস্ত্রির যোগালের কাজ করে। দেশে হরতাল লেগেই আছে। তাই মানুষ এখন আর বিল্ডিং বানায় না বললেই চলে। রাজমিস্ত্রিরা অন্য কাজে লেগে গেছে আর রাজমিস্ত্রি না থাকলে যোগালের কাজ কি তুমি বলো। আব্বা বলে, ওরা তো দিব্বি আছে। ওদের ছেলেমেয়েরা ইউরোপ আমেরিকায় থাকে। এ দেশে বোমা মারলেও ওদের কিছু না, গাড়ি পোড়ালেও ওদের কিছু না। যত কষ্ট আমাদের মত গরিব মানুষের।
: সত্যি তোমাদের এ জিনিসটা আমার খুব খারাপ লাগে। আমাদের দেশে কোন দলাদলি নেই, সভা নেই, মিটিং নেই, হরতাল নেই, ইলেকশন নেই, কিছুই নেই। আমাদের যা আছে তা সবাই সমান ভাগাভাগি করে খাই। আমি রাজকন্যা, আমিও যা খাই একজন মজুরের মেয়েও তাই খায়। ওখানে কোন ভেদাভেদ নেই।
: কি বলছ তুমি পৃথিবীতে এমন দেশ আছে নাকি ! ওটা পরীর দেশ বলেই সম্ভব। মানুষের দেশ হলে এমন হতো না। যাকগে তুমি তোমার ইলিশ মাছ খাওয়ার গল্পটা শেষ করো।
: হ্যাঁ যা বলছিলাম। গল্প করতে করতে আমরা ওর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। পাশাপাশি কয়েকটা টিনের ঘর তার একটাতে ও থাকে। বস্তি টাইপেরই তবে বস্তির থেকে একটু উঁচু মানের। সামনে খানিকটা জায়গা। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে। সাধারণত বস্তির সামনে এমন জায়গা থাকে না, আর ঝকঝকেও হয় না। যাহোক রহমতকে দেখে ওর বউ বেরিয়ে এল। আমাকে দেখে ওর কপাল কুঁচকে গেল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ও কে?
: মেহমান। বিদেশি মেহমান। এ বস্তিতে কখনও কারো বাড়িতে কি বিদেশি মেহমান এসেছে তুমি বল? ওকে বসাও।
: আমার বিদেশি মেহমান দরকার নেই।
: আহ রাগ করছ কেন, আগে শুনবে তো পুরোটা। মেমসাহেব আসার পথে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন উনি এলে তুমি রাগ করবে কিনা। আমি আরও তোমার কত প্রশংসা করলাম। বললাম তুমি তেমন মেয়ে না, তুমি আমাকে সন্দেহ করো না। বাড়িতে মেহমান এলে তার যতœ করো প্রাণ দিয়ে। এখন দেখছি ভুল কথা বলেছি।
: আমি এ কথা কখনও বলিনি। বুঝলাম বউকে ঠা-া করার জন্য রহমত এসব কথা বলছে। তবে এ কথার পর ওর বউ একটু থমকে যায়। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। তারপর বলে,
: আইসো, ঘরে বসো। কিন্তু কেন আইলে তাই বুঝলাম না।
: আরে শোন উনি একজন অদ্ভুত মহিলা। আমার কাছ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে এক ডজন ইলিশ মাছ কিনেছেন আর কিনেই সব মাছ আমাকে গিফট করেছেন।
: কও কি ? ক্যান?
: উনি নাকি স্বপ্ন দেখেছেন কারওরান বাজারের সবচেয়ে ভাল মাছ ব্যবসায়িকে এক ডজন মাছ কিনে গিফট করতে। আমারে ওনার সবচেয়ে ভাল মানুষ মনে হয়েছে তাই গিফট করেছেন। তা উনাকে আমি বললাম, অন্তত একটা মাছ নেন। তখন উনি বললেন, মাছ নিয়ে কী করবেন। উনি তো রাঁধতে জানেন না। তবে বাঙালি বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না খাওয়ার উনার খুবই ইচ্ছে। তাই আমি উনারে সাথে করে এনেছি ইলিশ রান্না খাওয়াতে। ভুল করেছি?
: আরে না না কও কি। হিন্দুরা কয় অতিথি নারায়ণ। আসো আপা বসো। এই যে এই চেয়ারটাতে বসো।
: ওর বউ আমাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার আছে, আছে একটা চৌকি আর একটা আলনা। চৌকির উপর পরিপাটি করে বিছানা পাতা। আমাকে বসিয়ে একটুক্ষণ পর ফিরে এল বউ। হাতে এক গ্লাস পানি আর প্লেটে কি যেন। বলল,
: নেও আপা মিষ্টিমুখ করো। এইটা আমাদের দেশের গুড়ের বাতাসা। খুব মজা খাইতে। আজকাল শহরের লোকেরা এসব খায় না কিন্তু আমি খাই। খাইয়া দেখো ভাল কি না।
: আমি ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম। আর মুখে দেয়ামাত্র রসে গাল ভরে গেল। কি যে ভালো সে বাতাসা। ওর বৌ বলল,
: খাজুরার গুড়ের বাতাসা। ভাল না?
: খুব ভাল। থাকলে আমাকে আরেকটা দাও।
ও হাসিমুখে আমাকে আরেকখানা বাতাসা এনে দিল। তারপর বলল, তুমি এখন বিশ্রাম নেও আপা। আমি ইলিশটা রান্না করি। ও ভাল কথা ইলিশ ভাজা খাবা না রান্না?
: তোমার যেটা ইচ্ছা।
: ঠিক আছে ঠিক আছে, তুমিই বা বুঝবা কি করে কোনটার কি স্বাদ। আমি ইলিশের নানান পদ রান্না করব। আর আমার ছেলের বাপ আসার সময় রসগোল্লা পান্তুয়া আরও কি কি যেন কিনে আনছে তোমার জন্য। খাওয়ার পর ওসবও খাইতে হবে।
: ও চলে গেল। ঘরে এখন আমি একা। আমি ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে আমার চোখ গেল বিছানায়। কী চমৎকার একটা কাঁথা বিছানায় পাতা। বাঙালিরা এটাকে বলে নকশিকাঁথা। রাস্তার ধারে প্রতিদিনই এমন অনেক কাঁথা আমি বিক্রি হতে দেখেছি। কিন্তু এই কাঁথা একেবারেই অন্য রকম। এত সুন্দর কাঁথা আমি কখনও দেখিনি। আমি খেয়াল করে দেখলাম, একটা নয় অমন কাঁথা আরও দুটো আছে। তাহলে একটা কাঁথা ওদের কাছে চাওয়াই যায়। ওদের দাম দিয়ে দিলেই হবে। এমন কাঁথা পেলে আমার মা ভীষণ খুশি হবেন।
এসব যখন ভাবছি তখন ঘরে এল রহমত। আমি তাকে দেখে বললাম,
: ব্যাপার কি রহমত আসার পর থেকে তোমাকে দেখছি না। কোথায় গেছিলে?
: আরে বলো না, আমার বউ কুসুম বলল, বিদেশি মেহমান এসেছে, নানান পদের রান্না খাবে, মিষ্টি মেঠাই খাবে তা খাওয়ার পর মিষ্টি পান না খেলে একটু মুখ মিষ্টি হবে কি করে। যাও পান নিয়ে এস। আমি ওর কথায় মিষ্টি পান আনতে গেছিলাম। এই যে দেখো পান। কত রকমের মশলা দিয়ে যে বানায় এই পান। এটা এ শহরের মানে ঢাকার স্পেশাল। তাই তোমার জন্য আনলাম।
আমি এর আগে কোনদিন পান খাইনি। পান খেতে কেমন লাগে জানিও না। শুনেছি পানের সাথে সুপারি নামের একটা জিনিস খায়, আবার কেউ কেউ জর্দাও খায়, তামাকও খায়। ওগুলো বেশি খেলে মানুষ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। খাব তবে সাবধানে, দেখে শুনে। আমি বললাম, কড়া জর্দা আনোনি তো রহমত?
রহমত হেসে উঠল,
: তুমি জর্দার কথাও জানো মেমসাহেব? কিছুই দেখছি তোমার কাছে নতুন না।
: আমরা গল্প করতে লাগলাম। এর মাঝে রহমত দুই তিনখান চিনেমাটির বাসন গ্লাস বের করে ধুয়ে এনে টেবিলে বসিয়ে দিল। আমি বললাম,
: এ ছোট্ট টেবিলে তিনজনের হবে না। তোমার সাথে তো আগেই কথা ছিল মাটিতে বসে খাব। সেটাই খাব।
রহমত প্লেট গ্লাস টেবিল থেকে নামিয়ে নিল। মাটির উপর মাদুর পেতে সেখানে গ্লাস প্লেট রাখল। কুসুম নিয়ে এল ধোঁয়া ওঠা লালচালের ভাত, সাথে ইলিশভাজি, ইলিশের তরকারি, ইলিশের ভর্তা, ইলিশের ডিম ভাজি আর ইলিশের তিন চারটে পদ। সাথে মুরগির মাংস আর ঘন ডাল। আমি বললাম,
: ঘন ডাল করেছ তা ঠিক আছে কিন্তু আজ তো মুরগি খাওয়ার কথা ছিল না। ওটা কেন রাঁধলে?
: আমার পালের মুরগি। ডিম দিচ্ছিল। খেয়ে দেখো। খেতে মুখ ফিরবে না। নাও আপা। এই তুলে দাও না।
: তুমিও আমাদের সাথে বসো।
: আমি একটু পরে খাই আপা?
: না না কিছুতেই না। তুমি না খেলে আমি খেতে বসব না।
সুতরাং ওরা দু’জন আমার সাথে খেতে বসল। কুসুম পরম যতেœ তুলে তুলে খাওয়াল। মনে হল ও যেন আমার কত দিনের চেনা। তোমাদের বাঙালিদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি দেখেছি। মেহমান পেলে তাকে খাওয়ানোর জন্য পাগল হয়ে ওঠ। নিজেদের খাবার কোথা থেকে আসবে সে খেয়াল করো না। তাই তো সারা পৃথিবীতে বাঙালির মেহমানদারির এত সুনাম। কুসুমের রান্না মুখে দিয়ে আমি অবাক! এত সুস্বাদু কোন রান্না হয়? আমার ধারণা ছিল পরীদের রান্নার ওপর কোন রান্না নেই। আমি অবশ্য এখনও তাই মনে করি। কিন্তু সেদিন কুসুমের রান্না খেয়ে মনে হয়েছিল বাঙালির রান্না পরীদের রান্নার কাছাকাছি।
এবার নিউটন কথা বলে উঠল,
: তোমার এই কথা আমি মানতে পারলাম না। ‘নিজেকে যে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়’ এ কথাটা আমার আব্বা বলে। শোন মৌটুসি পরী, হতে পারে তোমাদের দেশের রান্না ভাল কিন্তু অন্য কোন দেশের রান্না তোমার দেশের রান্নার মত ভাল হবে না এটা তোমার মনগড়া কথা।
: আরে আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? তোমাকে তো কিছু বলিনি।
: বলেছ। একজন বাঙালিকে বলা মানে আমাকে বলা। আমি তোমার দেশে যেতে চাই না। আমাকে সেই দিঘীতে নামিয়ে দিয়ে এসো। আমি বাড়ি যাবো।
: কী কা- তুমি দেখি খুবই জেদি ছেলে। সব কথা না শুনে আগেই রেগে গেলে এ কেমন কথা! হ্যাঁ শোন কুসুম তো থরে থরে খাবার সাজালো। সে খাবার মুখে তুলে আমি হাঁ। এমন ইলিশ ভাজা আমি কখনই খাইনি। ইলিশের সাথে যে পিঁয়াজ রসুন ভাজা হয়েছে সেটাও চমৎকার। ওই এক ইলিশ দিয়েই ভাত খাওয়া হয়ে যায়। আর ইলিশ রান্না দিয়ে তেল গলে গলে বের হচ্ছিল। একটা রান্নার চেয়ে আর একটা ভালো। আমি পাগলের মত খেতে লাগলাম। আমিও খাচ্ছি আর কুসুমও প্লেটে ঢালছে। খেতে খেতে পেট ফুলে উঠল। ঢেঁকুর উঠতে লাগল আমার। আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া ছাড়লাম। রহমত তার হাতের পানটা এগিয়ে দিল। পান মুখে দিয়ে আমার খুব ভাল লাগল। খাওয়ার পর কুসুমকে বললাম,
: আমার কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে, বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। আমার মা বলেন কখনও ভরপেট খেতে নেই। ভরপেট খেলে খাবারের আসল টেস্ট পাওয়া যায় না। একটু যদি কম খেতাম আরও ভাল লাগত। কিন্তু তোমার রান্না এতই ভালো যে লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। বেশি বেশি খেয়ে ফেললাম। বলছি কি আমি একটু গড়িয়ে নি তারপর যাবো?
: নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তুমি এখানে এই খাটের উপরে শীতল পাটিতে শোও। বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর চা কফি মিষ্টি খেয়ে তবে যাবে। আর আমি ভেবেছি আইসক্রিমের বাক্সে তোমার জন্য কয়েকখানা মাছ ভাজা দিয়ে দেব।
মনে মনে বললাম, সেতো খুব ভাল হবে। এমন মাছভাজা পেলে আমার মা দারুণ খুশি হবে। মুখে বললাম,
: আর একটা জিনিস তোমার কাছে চাই কুসুম। এই নকশিকাঁথাটা। কিনে নেব তোমার কাছ থেকে। এর বিনিময়ে তোমাকে আমার গলার এই মুক্তার মালাটা দেব।
কুসুমের চোখ চকচক করতে লাগল। ও তাড়াতাড়ি বলল,
: শুধু ওটা কেন আরো দুটো আছে, তিনটেই নিয়ে নাও। আর তোমার গলার সবকটা মালা আমাকে দিয়ে দাও। আমার হীরা মুক্তার মালার খুব শখ।
: ঠিক আছে ঠিক আছে। একটার জায়গায় তিনটে পেলে তো আরো ভালো। তুমি বিকেলে সব গুছিয়ে দিও কেমন।
ওরা দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুমের মাঝে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে কখন যে কাপড়ের নিচ থেকে আমার ডানা দুটো বেরিয়ে পড়েছে জানি না। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে দেখে কুসুম ঢুকল ঘরে। ঢুকেই আর্তচিৎকার করে উঠল,
: ওমা ওটা কী!
সাথে সাথে ছুটে এল রহমত।
: আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। ঘরে দোর দেও বউ, ওটাকে আটকাতে হবে।
ওরা দোর দিতে লাগল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে জানালার একটা কবাট খোলা পেলাম। ওটা ভেঙে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। তারপর উড়ে চললাম আকাশে। আশ্চর্য যারা একটু আগে এত যতœ করে খাওয়ায় তারাই মুহূর্তের মধ্যে এমন হিং¯্র হয়ে যায় কি করে আমি বুঝি না!

চার.
মৌটুসি উড়ে চলেছে। ওর ডানায় চড়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল নিউটনের। মাঝে মাঝে সোঁ করে উপরে উঠে যাচ্ছে আর পরক্ষণে নিচে নামছে। ভয় পেয়ে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে নিউটন। মৌটুসিকে গালিগালাজও করছে।
: ব্যাপার কি তুমি অমন জোরে উড়ছ কেন শুনি? অত এঁকে বেঁকে যাচ্ছ কেন? তোমার ডানার উপরে যে একজন আছে তাকি ভুলে গেছ?
: তাড়াতাড়ি করে না গেলে চলবে কি করে। আমার দেশ দেখিয়ে তোমাকে তো আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। অত ভয় পাচ্ছ কেন তুমি? আচ্ছা ভিতুর ডিম তো তুমি!
: এই খবরদার খবরদার বলছি আমাকে ভুলেও ভিতুর ডিম বলবে না। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশের মানুষ। পরীরা কি কখনও যুদ্ধ করেছে নাকি যুদ্ধ বোঝে?
: বুঝি বুঝি আমরাও যুদ্ধ বুঝি। একবার রাক্ষসরা আমাদের দেশে হামলা করেছিল। আমরা ওদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম হ্যাঁ।
: ওই গল্প নিয়েই থাক। জানো দেড়শত বছর ব্রিটিশরা আমাদের দেশ দখল করে রেখেছিল আর তাদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর দেশ শাসন করতে শুরু করল পাকিস্তানিরা। আমরা তাদের এমন মার দিয়েছি যে বাপের নাম ভুলে গেছে। আর কখনও কারো দেশ দখল করে রাখার কথা ওরা স্বপ্নেও ভাববে না বুঝেছ। নাও এবার একটু আস্তে ওড়ো।
: কেন তুমি একটু শক্ত হয়ে বসতে পারো না ?
: না পারি না। শোন মৌটুসি পরী আমি কিন্তু তোমার দেশে যেতে চাইনি। তোমার দেশ দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আমি জানি আমার দেশ পৃথিবীর সেরা দেশ। তুমি কিন্তু আমার অনিচ্ছাতে আমাকে নিয়ে যাচ্ছ। তুমি যদি এমন করো আমি আর যাবে না। বাঙালির জেদ তো জানো না। দরকার হলে আমি তোমার ডানা থেকে লাফ দেব।
: থাক থাক অত রাগ করতে হবে না। আমি আস্তে উড়ছি।
মৌটুসি উড়ে চলে। মাঝে মাঝে খাবলা দিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করছে নিউটন। কী কা- হাতের মুঠো থেকে গলে গলে সরে যাচ্ছে মেঘ। কিছুতেই যেন মুঠোবন্দি করতে পারছে না। মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা পড়ছে ওর পুরো শরীর। পরক্ষণে আবার সরে যাচ্ছে। রৌদে ঝলমল করছে ওর শরীর। একটু পরে আবার মেঘ গলে বরফের কুচি জমছে ওর মাথায়। অথচ হাজার চেষ্টা করেও নিউটন এক টুকরো মেঘ বা কিছু বরফের কুচি মুঠোয় বন্দি করতে পারল না যা ও মাকে দেখাতে পারে। মৌটুসি কথা বলেই যাচ্ছে।
: তবে কি জানো নিউটন ইলিশের স্বাদ আমি কোনদিন ভুলবো না। কী ভাল যে খেতে আর ওই মাছওয়ালার বউ কুসুমের রান্নার যে কী স্বাদ! ওর ইচ্ছে ছিল আমার মুক্তো হীরের মালাগুলো নেয়ার। দিয়ে আসা হল না। তোমার কাছে দিয়েও তো লাভ নেই। তুমি অনেক দূরে থাকো। জানো ভাবলে ভীষণ মন খারাপ হয় আমার। খুব যতœ করে খাইয়েছিল আমাকে। মাছের কাঁটা বেছে বেছে খাইয়েছিল। ইলিশ মাছের কাঁটা কিন্তু মারাত্মক।
: হ্যাঁ আমার গলায় একবার বিঁধেছিল। কিছুতেই সে কাটা যায় না। আমার গলায় খচখচ করছিল। আমি ব্যথায় কাঁদছিলাম। তখন মা আমাকে শুকনো ভাত দলা করে করে খাইয়েছিল। আর সেই শুকনো ভাতের ধাক্কাতে কাটা চলে গেছিল।
: তাই নাকি। শুকনো ভাত খেলে কাটা চলে যায়?
: হ্যাঁ। এরপরে যদি আর কাটা ফোটে খেয়ে দেখ কাটা চলে যাবে।
: আরে না আর কখনও মাছ খাওয়া হবে না। কাটাও ফুটবে না। যাকগে শোন এই যে এখন আমরা পশ্চিম বাংলায় ঢুকছি। এই যে এই জায়গাটা পশ্চিমবাংলা। এটা ঝাড়খন্ড, এই যে এটা উত্তর প্রদেশ। আরও খানিকটা উড়ে যায় মৌটুসি তারপর বলে,
: এই যে এই যে দেখ এটা মাউন্ট গঙোত্রি হিমবাহ। এখান থেকে বরফ গলে গলে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি হয়েছে। আর সেই গঙ্গা বাংলাদেশে মানে তোমাদের দেশে গিয়ে পদ্মা হয়েছে। গঙ্গা নদী হিন্দুদের কাছে খুব পবিত্র। সব হিন্দুরই মনে বাসনা থাকে গঙ্গা¯œান করার। ওরা মনে করে গঙ্গায় ¯œান করলে মানুষ পবিত্র হয়।
: তুমি এত কথা জানলে কি করে?
: আর জানব না কেন। আমি তো অনেক দিন কলকাতায় ছিলাম। শুধু কলকাতাতেই বা কেন, আমি দিল্লি বোম্বে সব জায়গাতেই ছিলাম। আমি আগ্রার তাজমহল দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর জয়পুরেও গেছি। ওটার নাম পিংক সিটি।
: কোথায় যাওনি তাই বল দেখি তুমি ?
: আরে সব জায়গাতেই গেছি। শোন সে গল্প তোমায় বলি। আমি একদিন দিল্লির আকাশ দিয়ে উড়ছি। হঠাৎ বাতাসে কেমন যেন একটা চমৎকার খাবারের গন্ধ পেলাম। এ গন্ধ আমার অচেনা। আমি কোনদিন এমন গন্ধের খাবার খাইনি। আমার জিহ্বায় জল চলে এল। সেদিন আমার তেমন কিছু খাওয়াও হয়নি। সকালবেলা যখন প্রাসাদ থেকে বের হই তখনও নাস্তা তৈরি হয়নি। আর মায়ের শরীরও কিছুটা খারাপ ছিল তাই তাকে ডাকিনি। ফ্রিজে অবশ্য বাসি খাবার ছিল। সেটা খেতে আমার ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম কিছুটা ঘুরে গিয়ে খাব। তা উড়তে উড়তে এতটা দূরে চলে এসেছি বুঝিনি। খাবারের গন্ধে ক্ষিদে চনমনিয়ে উঠল। নিচে তাকিয়ে দেখি ওটা ‘প্রেসিডেন্টস হাউজ’। মানে রাষ্ট্রপতির বাড়ি। আমি উড়ে এসে বসলাম প্রেসিডেন্টস হাউজের পাশে একটা ঝোপানো গাছে। কী যে কঠিন পাহারা চারদিকে। মনে ভয় ছিল আমাকে দেখলে ওরা গুলি করে দেবে।
: কেন গুলি করবে কেন?
: বোঝনি ওদিন ছিল প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির অভিষেক। সোনিয়া গান্ধী এসেছে, রাহুল গান্ধী এসেছে, মনমোহন সিং এসেছে, অটল বিহারি বাজপেয়ি এসেছে আরও কত কত বিশিষ্ট লোক।
: প্রণব মুখার্জি কে? সোনিয়া গান্ধীই বা কে?
: কী কা- তুমি প্রণব মুখার্জির নাম জানো না। আরে উনি ভারতের প্রেসিডেন্ট।
: না জানি না। ওনার নাম জানার আমার দরকার কি। শেখ হাসিনার নাম জানি। উনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের নাম জানি। উনি আমাদের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গভবনের ছবিও আমি দেখেছি কাগজে। ওখানে প্রেসিডেন্ট থাকেন। সংসদ ভবনের ছবিও দেখেছি। ওখানে এমপি সাহেবরা মিটিং করেন।
: আরে না না মিটিং না, মারামারি করেন।
: করতে পারে, তবে আমি ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্টকে দেখিনি। ওনাদের দেখার আমার কি দরকার?
: তোমাদের প্রতিবেশী দেশ, তা ছাড়া তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওরা কত সাহায্য করেছে। তবে হ্যাঁ তুমি ছোট মানুষ এত কথা তোমার জানার কথা না। তবে শুনে রাখ সোনিয়া গান্ধী হচ্ছে রাজিব গান্ধীর স্ত্রী। আর রাজিব গান্ধী ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে। ইন্দিরা গান্ধী জওহরলাল নেহেরুর মেয়ে। এরা সবাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তার এক দেহরক্ষী আততায়ীর হাতে নিহত হন। রাজিব গান্ধীকে হত্যা করে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আত্মঘাতীরা। রাহুল গান্ধী সোনিয়া আর রাজিব গান্ধীর ছেলে। সোনিয়া বিদেশি মহিলা কিন্তু ভারতে রয়ে গেছেন। আমি যখন গেছিলাম তখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। কংগ্রেস হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী- সোনিয়া গান্ধীর দল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। একজন নামকরা অর্থনীতিবিদ। নির্বাচনে জেতার পর সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য পার্টি থেকে সিদ্ধান্ত হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করেন। ক্ষমতা পেয়েও ছেড়ে দেয়ার এমন দৃষ্টান্ত তোমাদের দেশে নেই। শুধু তোমাদের দেশে কেন, পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। অবশ্য কংগ্রেস এখন আর ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। আর প্রধানমন্ত্রী হয়েছে নরেন্দ্র মোদি। তোমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এসব কথা অবশ্য তোমার জানা থাকার কথা না।
: দেখ আমরা গরিব। স্কুলেও পড়ি না, বইপত্র নেই। খবরের কাগজ কেনার পয়সা নেই। টেলিভিশন নেই। জানব কি করে বল? তবে আমি অন্যদের কাছ থেকে একটু একটু পড়তে শিখেছি। আমিই তো আমার মায়ের লটারির টিকেট মিলিয়ে দিই।
: স্কুলে পড়না মানে ? তুমি স্কুলে যাওনা ?
: না। স্কুলে যাওয়ার পয়সা কোথায় পাব আমি! স্কুলে মাস মাস বেতন দিতে হয়, টিচার রাখতে হয়, বইপত্র খাতা পেন্সিল কত কিছু লাগে। ওসব পাবো কোথায়। আমরা তো খুবই গরিব। আমরা তিনবেলা ভাত ভালোমত খেতে পাইনা। তবে কি জানো আমার আব্বা-মায়ের খুব ইচ্ছে আমাকে লেখাপড়া শেখানোর। কিন্তু পয়সার জন্য পারেনা। আমার মা মাঝে মাঝেই লুকিয়ে কাঁদে। এই দেখনা। আমার মা আমার নাম রেখেছে নিউটন। নিউটন নাকি একজন খুব বড় বৈজ্ঞানিকের নাম। আমার মার খুব ইচ্ছে আমিও একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হব। কিন্তু কি করে হব বল। আমরা যে বড় গরিব। তাই আমার মা কি করে জানো? আমার মা লটারির টিকেট কেনে আর ভাবে একদিন টিকেটে প্রাইজ পাবে। আর সেই প্রাইজের টাকায় আমাকে পড়াবে।
নিউটনের কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ হয় মৌটুসির। এই মানুষগুলোর কোন না কোন সমস্যা লেগেই আছে। ওরা যা চায় কখনই তা পায়না। কি এমন অসুবিধা হত যদি নিউটনরা একটু বড়লোক হত আর স্কুলে যেতে পারত। ও মনে মনে ঠিক করে, কিছুতেই নিউটনদের অভাব ও রাখবে না। ওদের কয়েক বস্তা টাকা দিয়ে দিলেই হবে। সেই টাকায় ওরা বড়লোক হয়ে যাবে। নিউটন স্কুলে পড়তে পারবে।
: শোন নিউটন অত মন খারাপ করোনা। তোমাকে বড়লোক বানিয়ে দেয়া আমার জন্য কোন ব্যাপারই না। তুমি যখন ফিরবে আমি তোমার সাথে কয়েক বস্তা টাকা দিয়ে দেব। সেই টাকা দিয়ে তোমরা জমি কিনবে, দালান বানাবে, স্কুলে ভর্তি হবে কেমন ?
চীৎকার করে ওঠে নিউটন। আর সে চীৎকারের সাথে সাথে সে নড়েচড়ে ওঠে। পড়তে পড়তে আবারও সে সামলায়
: কি হল অমন চীৎকার করছ কেন ?
: না তুমি কোন টাকা দেবেনা। তোমার কাছ থেকে টাকা নিলে আব্বা-মা আমাকে বাড়ি ঢুকতে দেবেনা। আমার আব্বা মা বলেন, নিজের রোজগারের টাকা ছাড়া কারো কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেবেনা। ওটা ভিক্ষা। আমি ভিক্ষা নেবনা।
এবার মৌটুসির মেজাজ খারাপ হয়। মানুষের সন্তানদের গুমোর বড় বেশি। কেউ যদি খুশি হয়ে কিছু দেয় তা নিতে ওদের অসুবিধা কোথায় ? যাকগে যা ইচ্ছা ওরা করুক। ওর ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই নিউটন বলে
: তুমি বলছিলে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গেছিলে সে গল্পটা কর
: হ্যাঁ ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি বাঙালি। তার স্ত্রীর নাম শুভ্রা। আগে ওনার নাম ছিল গীতা। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দরা গান্ধি ওনার নাম দিয়েছিলেন শুভ্রা। আরে তোমাদের বাংলাদেশেরই তো মেয়ে। তোমাদের বাংলাদেশে নড়াইল নামে একটা জেলা আছে, তোমাদের যশোরের পাশেই তো নড়াইল, সেই জেলার মেয়ে শুভ্রা মুখার্জি। কি হল নড়াইলের নামও জানোনা। তুমি কি জানো বলত? আরে আমি পরী, পৃথিবীর বাইরে থাকি অথচ কত কিছু জানি। শিল্পী এস এম সুলতানের নাম শুনেছ ? উনি সেই শিল্পী যিনি সব সময় ভাবতেন এদেশের মানুষ হবে পেশীবহুল শক্তিমত্ত। যারা অশুভ শক্তির সাথে লড়াই করবে। তাই তিনি সব সময় পেশীবহুল মানুষের ছবি এঁকেছেন। কখনই কোন রুগ্ন কাতর মানুষের ছবি তিনি আঁকেননি। সেই এস এম সুলতানের বাড়ি নড়াইলে। কবিয়াল বিজয় সরকারের বাড়িও নড়াইলে। ওই নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা মুখার্জি। তা আমি ভাবলাম প্রেসিডেন্ট যখন বাঙালি নিশ্চয়ই কিছু মাছ টাছের ব্যবস্থা থাকবে। আবার মাটন চিকেন তো থাকবেই। হা করে তাকিয়ে আছ কেন ? মাটন চিকেনও বোঝ না তুমি? আরে মাটন মানে খাসির মাংস বুঝেছ আর চিকেন হচ্ছে মুরগি। না তোমাকে নিয়ে খুব সমস্যা। তুমি লেখাপড়া তো জানোই না, বাড়ি থেকেও কিছু শেখনি। যাকগে যা বলছিলাম, আমি বসে আছি গাছে। আর ভাবছি কখন টুক করে নেমে খাওয়ার ঘরে ঢুকে যাব। কী জমকালো আলো দিয়ে যে চারধার সাজানো হয়েছে। আর ফুলে ফুলে সয়লাব চারদিক। অনেক বড় একটা প্রাঙ্গণে অভিষেকের ব্যবস্থা হয়েছে।
: অভিষেক হলে কি হয়?
: আর কিছু না। সবাই মিলে বরণ করে নেয়, খাওয়া দাওয়া হয় এসব আর কি। কেন তুমি জানোনা তোমাদের দেশে যখন মন্ত্রী নির্বাচিত হয় তখন তো বঙ্গভবনের দরবার হলে তাদের শপথ পড়ানো হয়। প্রধান বিচারপতি তাদের শপথ পড়ান। আবার প্রেসিডেন্ট এবং স্পিকারও শপথ পড়েন। সেটাও খুব জমজমাট অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী থাকেন, বড় বড় মানুষেরা সেখানে উপস্থিত হন। ওই দিন অবশ্য শপথের ব্যবস্থা ছিলনা। শপথ আগেই হয়ে গিয়েছিল। অতিথিরা আসছেন। আস্তে আস্তে পুরো মাঠটা ভরে উঠছে। ওয়েটাররা ট্রেতে করে শরবত, কোল্ড ডিংকস, বাদাম, ফিস ফ্রাই, চিকেন এসব সার্ভ করছে। আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। আমি দ্রুত নামতে গেলাম। কিন্তু নামতে গিয়েই হল বিপত্তি। একটা গাছের ডালে আমার জামা আটকে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গেল। এখন উপায়! এই ছেঁড়া জামা পরে তো আর প্রেসিডেন্টের সম্বর্ধনায় যাওয়া যাবেনা। এখন কি করব আমি। ভীষণ কান্না পেল আমার। এদিকে নানারকম খাবারের সুঘ্রাণে আমার জিহ্বা দিয়ে টসটস করে পানি পড়ছে। আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম। তারপর উড়ে চললাম। আমি গিয়ে হাজির হলাম দিল্লির নামকরা বড় মার্কেটে। মার্কেট তখন বন্ধ হয় হয় অবস্থা। আমি একটা দোকানের সাটার আধখোলা পেয়ে ঢুকে গেলাম। দোকানি তেড়ে এল।
: বের হন, বের হন। আমরা দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।
: কোথায় বন্ধ! খোলা পেলাম বলেই তো ঢুকলাম। এই যে ভাই এই গাউনটার দাম কত?
: ওটার অনেক দাম। আপনি কিনতে পারবেন না।
এবার আমার মেজাজ ভীষণ খারাপ হল। আমি হলাম পরীরাজ্যের রাজকন্যা। আমি হিরের খাটে মাথা আর সোনার খাটে পা রাখি। আর ও বলছে এই গাউন আমি কিনতে পারব না।
: তোমাকে কে বলল এই গাউন আমি কিনতে পারব না?
: তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওটার দাম পঞ্চাশ হাজার রুপি।
: শোন শুধু এই গাউন কেন, এ দোকানে যতগুলো গাউন আছে আমি সব কিনব। দাও প্যাক করে দাও। কি হল দাও?
: আগে টাকা দাও।
: মানুষের সন্তানদের এই জন্যই আমি পছন্দ করি না। এরা কাউকে বিশ্বাস করে না। আমি বললাম, এই নাও টাকা। এবার জামা কাপড় দাও।
টাকা দেখে দোকানি অবাক। সে তাড়তাড়ি গাউনগুলো প্যাক করে দিল। কিন্তু আমি রাগ করে সব কাপড় কিনলাম ঠিকই, এখন এত কাপড় দিয়ে আমি কি করব। সেই কাপড় নেয়ার জন্য আমাকে একটা ট্রাক ভাড়া করতে হলো। আমি ট্রাকে কাপড়ের গাঁটরি তুলে রওনা দিলাম। তবে রওনা দেয়ার আগে ওদের ট্রায়াল রুমে ঢুকে সবচেয়ে ভালো গাউনটা পরে নিলাম। তা দেখে দোকানি বলল, আপনাকে একদম পরীর মত লাগছে।
: কিন্তু এই একটু আগে আমাকে আপনার ফকিরনীর মত লাগছিল তাই না? আমি গাউন কিনতে পারব এটা বিশ্বাস করেননি।
: আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। প্লিজ মাফ করে দেন।
ট্রাক চলতে শুরু করল। আমি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে মাইক দিয়ে বাচ্চাদের ডেকে ডেকে গাউন দিতে লাগলাম। বাচ্চারা দামি দামি গাউন পেয়ে কি যে খুশি হল। এইভাবে অল্পক্ষণের মধ্যে আমি প্রেসিডেন্টস হাউজে এসে পৌঁছালাম। প্রেসিডেন্টস হাউজে কিন্তু ইচ্ছা করলেই যে কেউ ঢুকতে পারে না। আমন্ত্রণপত্র লাগে। আমার ওসব নেই। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে টুপ করে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তারপর উড়ে গিয়ে হাজির হলাম প্রাঙ্গণে। প্রাঙ্গণের একপাশে চমৎকার একটা স্টেজ বানানো হয়েছে। সেই স্টেজে মাত্র কয়েকটা চেয়ার। একটা চেয়ারে বসা রাষ্ট্রপতি, পাশে তার স্ত্রী আর ঠিক তার পাশে সোনিয়া গান্ধী। পাশেই একটা চেয়ার খালি ছিল। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। বসেই হাত বাড়িয়ে দিলাম প্রথমে প্রেসিডেন্ট তারপর তার স্ত্রী আর তারপর সোনিয়া গান্ধীর দিকে। ওরা আমার সাথে করমর্দন করল বটে কিন্তু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। ততক্ষণে আরো অনেকে ফিসফাস করতে লাগল,
: কে কে এই মহিলা?
: কোন বিদেশি কূটনীতিক হবে বোধ হয়!
: তাই বলে স্টেজে একেবারে প্রেসিডেন্টের পাশে। কূটনীতিকদের জন্য তো আলাদা জায়গা করা হয়েছে।
আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি কি মারাত্মক ভুল আমি করে ফেলেছি। এরপর যদি ইনটেলিজেন্সের লোকেরা এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার খাওয়ার বারোটা বাজবে। আমি ‘একসকিউজ মি’ বলে তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে নেমে এসে অনেক মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম। এবার আমি নিরাপদ। আমি একটা আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওয়েটারের হাত থেকে জুস আর ফিশফ্রাই নিয়ে খেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ এটা ওটা খাওয়ার পর আমি হাজির হলাম বুফে টেবিলে। তোমাকে আর কি বলব নিউটন টেবিলের পাশে গিয়ে তো আমি অবাক। এত বড় সাইজের মাছের পেটি যে হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। পরে জেনেছিলাম ও মাছের নাম পাঙ্গাশ। আর গলদা চিংড়ি এক একটা এক এক কেজি। আমি প্লেটে শুধু মাছই নিলাম। ভেবে দেখলাম রাইস নেয়া বোকামি। আর মাটন বিফ চিকেন নিতে ইচ্ছে হল না। কী চমৎকার যে ছিল বিশাল সাইজের রুইমাছ ভাজি আর চিংড়ির মালাইকারি। আর ওই দিনই প্রথম আমি পাঙ্গাশ মাছের পেটি খেলাম। শোন তোমাদের দেশের অনেক কিছুই আমার অপছন্দ। এই ধরো তোমাদের ঢাকা শহর। কী যে যানজট আর কী নোংরা তোমাদের ওই শহর। একবার বের হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকতে হয়। তোমাদের রাস্তার মোড়ে মাড়ে কতকগুলো ট্রাফিক সিগন্যাল দেয়া আছে তার একটাও কাজ করে না। যদিওবা কখনও করে সে সিগন্যাল না মানে জনগণ না মানে ট্রাফিক পুলিশ। আর রাস্তা বোঝাই ফিটনেসবিহীন গাড়ি। তোমরা কতকগুলো ওভারব্রিজ বানিয়ে রেখেছ সেখান দিয়ে কেউ যাতায়াত করে না। সেখানে ফকিরেরা ঘুমিয়ে থাকে। আন্ডারপাসেরও সেই একই অবস্থা। আর কি নোংরা যে তোমাদের এই শহর। এই রাস্তা বানানো হচ্ছে তো ওই রাস্তা ভাঙা হচ্ছে। খোলা ড্রেনে ভনভন করছে মশা মাছি। আর শহরে না আছে কোন মাঠ না একটুকরো খোলা জায়গা। একটা অসহ্য পরিস্থিতি। আর ফকির! ওরে বাপরে বাপ!
: শোন আমি মিরপুরে থাকি। মিরপুরেরও অনেক ভেতরে। ওখানে অনেক খোলা জায়গা আছে, মাঠও আছে।
: মিরপুর তো আর পুরো ঢাকা শহর না। আর ও মাঠ, খোলা জায়গাও বেশিদিন থাকবে না আমি হলফ করে বলে দিচ্ছি। তোমাদের কিছুই আমার ভালো লাগে না। শুধু ওই মাছ ছাড়া। তা সেই মাছ আমি আবার খেলাম রাষ্ট্রপতির বাড়িতে।
: তুমি বড় পেটুক।
: অমন ভাল খাবার পেলে তুমিও পেটুক হতে। আরে শুধু কি মাছ নাকি, হাজার রকমের আইটেম ছিল। পেস্তা দিয়ে একটা পায়েস বানিয়েছিল মনে হচ্ছে এখনও মুখে লেগে আছে। শোন শোন যাবার পথে খেয়াল করবে। যদি দেখ কোথাও কোন খাওয়ার আয়োজন হচ্ছে আমাকে বলবে। একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করে যাব আমরা কেমন।
মৌটুসি পরীর এ প্রস্তাব ভাল লাগল নিউটনের। তার সত্যিই খুব ক্ষুধা পেয়েছে। পরীতো খালি উড়েই চলেছে। একবারও খাওয়ার কথা বলছে না। সেই কখন তার নিজের দেশে যাবে আর খাওয়া হবে তার ঠিক আছে। তা ছাড়া পরীদের রান্না কেমন হবে কে জানে। যদি ওরা না রেঁধে কাঁচা জিনিস খায় তখন কেমন হবে। আর ওরা নাকি ফলমূল বেশি খায়। নিউটনের আবার ফরমূল মোটেও পছন্দ না। কিন্তু এত উঁচু থেকে নিচে কোথায় কি খাওয়ার আয়োজন হচ্ছে ও বুঝবে কি করে। অদ্ভুত কথা !
: কী ভাবছ নিউটন?
: ভাবছি তুমি তো খালি উড়েই চলেছ। ভুলেও তো একবার খাওয়ার কথা বলছ না।
: এই যে এখনই তো বললাম। আসলেও কিছু খাওয়া দরকার। চলো দেখি নিচে নামি।
মৌটুসি তার গতি স্লো করে। আস্তে আস্তে নামতে থাকে। ওরা একটা জনবহুল রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। মৌটুসি মুহূর্তের মধ্যে ঝকঝকে চুলের এক বিদেশি মহিলা হয়ে যায়। ওর মুখ দিয়ে ইংরেজির তুবড়ি ছুটতে থাকে। আর নিউটন নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। কোথায় তার পরনের সেই রঙচটা টিশার্ট আর ছেঁড়া হাফপ্যান্ট! কিছুদিন আগে আব্বা ১০ নং গোলচক্করের ফুটপাথ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে টিশার্টটা কিনে দিয়েছিলেন। সেদিন ফুটপাথে যে টিশার্টগুলো ছিল সবগুলোরই দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা। দোকানি দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল, পঞ্চাশ পঞ্চাশ পঞ্চাশ। নিউটনের গায়ের শার্টটা অনেক আগেই ছিঁড়ে গেছিল। ওকে একটা শার্ট কিনে দেয়ার পয়সা কিছুতেই জোগাড় করতে পারছিলেন না ওর আব্বা। বেশ কদিন ফুটপাতে ঘুরে দেখেছিলেন শার্টের দাম টিশার্টের দামের চেয়ে বেশি। তাই শেষমেশ ঠিক করেছিলেন ওকে একটা টিশার্ট কিনে দেবেন। তা ছাড়া টিশার্টে একটা বাড়তি সুবিধে আছে। গেঞ্জি জাতীয় এই কাপড়গুলো বেশ মোটা। সহজে ছেঁড়ে না। আর মোটা বলে শীতের সময়ও কাজে দেয়। তাই ওর বাবা ঠিক করেছিলেন আপাতত টিশার্ট কিনে দেবেন। পরে পয়সা জোগাড় করতে পারলে না হয় একখানা শার্ট কিনে দেবেন। নিউটনকে নিয়ে ১০ নং এর ফুটপাতে গেছিলেন আব্বা। বেশ লম্বা দেখে এই টিশার্টটা নিয়েছিলেন। না না করে উঠেছিল নিউটন
: এই টিশার্টটা অনেক বড়। দেখছ না হাঁটু পর্যন্ত পড়েছে। একটু ছোট একটা নিই?
ও হাতে করে ছোট একটা টিশার্ট নিয়েছিল। কিন্তু আব্বা ওর হাত থেকে টিশার্টটা নিয়ে রেখে দিয়ে ওই লম্বা ঝুলের টিশার্টটাই কিনেছিলেন নিউটনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও। দোকানিকে টাকা দিয়ে বেরিয়ে এসে ওর কাঁদো কাঁদো মুখে আদর করে বলেছিলেন,
: মন খারাপ করিস না বাবা। তোর হাফপ্যান্টটা ছেঁড়া। একটু লম্বা টিশার্ট হলে ছেঁড়াটা দেখা যাবে না তাই নিলাম। যখন তোকে একটা নতুন প্যান্ট কিনে দিতে পারব তখন একটা টিশার্ট বা শার্ট যা চাস কিনে দেব।
তখন নিউটন বুঝতে পেরেছিল আব্বা কেন তাকে লম্বা টিশার্ট কেনার জন্য এত চাপাচাপি করলেন। ভীষণ কান্না পেয়েছিল তার। কিন্তু কি আর করা। তারা গরিব মানুষ। ইচ্ছা হলেই যে কোন কিছু তারা কিনতে পারে না। তা সেই টিশার্টটাই এতদিন ধরে পরছে সে। পরতে পরতে টিশার্টটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন একটা প্যান্ট বা শার্ট আর কেনা হয়নি। সেই টিশার্ট পরেই সে মৌটুসির ডানায় চড়েছিল। এখন ডানা থেকে নেমে অবাক হয়ে সে দেখল তার গায়ে চমৎকার একটা শার্টিনের শার্ট। পরনের প্যান্টটা গ্যাবার্ডিনের। কী সুন্দর যে রং সে প্যান্ট আর শার্টের। নিউটন বার বার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না এ প্যান্ট শার্ট সে পরেছে। কী এক ভোজবাজির মত এ প্যান্ট শার্ট মৌটুসি তাকে পরিয়ে দিল। নিউটন এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
: আচ্ছা তুমি যে এখানে নামলে এখানে তো কোন খাবার জায়গা দেখছি না। না কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট না দোকানপাট?
: হোটেল রেস্টুরেন্ট দোকানপাট ছাড়া বুঝি খাওয়া যায় না? তুমি খালি দেখে যাও আমি কী করি। মৌটুসি হাতের ইশারায় একটা ট্যাক্সি ডাকল। গতি স্লো হতে হতে ট্যাক্সিটা থেমে গেল। মৌটুসি ট্যাক্সিতে উঠে বলল,
: প্লিজ গো টু নিজাম।
ট্যাক্সি তরতর করে এগিয়ে চলল। হোটেল নিজামের সামনে এসে ট্যাক্সি থামল। মৌটুসি ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে ঢুকল। থরে থরে টেবিল চেয়ার। শাহি বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। বিরিয়ানির গন্ধে মৌ মৌ করছে বাতাস। একটা টেবিল চেয়ারও খালি নেই। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে। কিন্তু মৌটুসির চমৎকার গাউন আর সিল্কের ঝলমলে চুল দেখে দুটি তরুণ সিট ছেড়ে দিল।
: সিট ডাউন প্লিজ।
খুব মজা লাগল নিউটনের। খাবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কেউ সিট ছেড়ে দেয় এই প্রথম নিউটন দেখল। ওর মনে হলো মৌটুসির সিল্কের গাউন আর ওর শার্টিনের শার্টের জন্যই এটা ঘটল। ও খেয়াল করে দেখেছে সবাই ঘুরে ঘুরে ওদের পোশাক দেখছে। একটা বাচ্চা ছেলে তো নিউটনের শার্ট দেখে কান্না জুড়ে দিল।
: বাবা আমার ওই রকম জামা চাই।
: আচ্ছা আচ্ছা দেব বাবা।
চেয়ারে বসে নিউটন ফিসফিস করে বলল,
: এটা কোন জায়গা?
: কলকাতা।
: সেকি তুমি না বললে আমরা গঙ্গোত্রি হিমবাহে চলে গেছিলাম। ওখান থেকে আফগানিস্তানে ঢোকার কথা।
: হ্যাঁ তাই গেছিলাম। কিন্তু তুমি খেতে চাইলে তা আমি চিন্তা করে দেখলাম ভাল খাবার মানে বাঙালি খাবার কলকাতা ছাড়া আর কোথায় পাব! অবশ্য এখন আমরা যে বিরিয়ানি খাব এটা ইরানি বিরিয়ানি। এই হোটেল ‘নিজাম’ বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত। সারাক্ষণ এখানে ভিড় লেগেই থাকে। কখনও একটা চেয়ারও ফাঁকা পাওয়া যায় না। একদল খেলে আরেক দল দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য আমাকে বিদেশি মনে করে ওরা সিট ছেড়ে দিয়েছে বোধ হয়। এমন ওরা সাধারণত দেয় না। কলকাতাতে সারা বছরই বিদেশি পর্যটক গিজগিজ করে।
: শোন এমন দোকান শুধুু কলকাতাতেই আছে ভেবো না, ঢাকাতেও আছে। পুরনো ঢাকার হাজির বিরিয়ানি বিখ্যাত। অরিজিনাল যে দোকান সেখানে সকালের দিকে মাত্র দু তিন ডেকচি রান্না হয়। ওই বিরিয়ানি শেষ হয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না। শাল পাতার ঠোঙায় করে সে বিরিয়ানি বিক্রি হয়
: শোন নিউটন ও বিরিয়ানির কথা আমি জানি। কিন্তু এখন নাকি আর সে হাজির বিরিয়ানি নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে একশ একটা দোকান হয়েছে। কোনটা যে আসল আর কোনটা যে নকল বোঝা কঠিন। তারপর আরও এক বিরিয়ানি দেখলাম তোমাদের ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছে। নান্নার বিরিয়ানি।
: কী কা- তুমি নান্নার বিরিয়ানির কথাও জানো?
: জানব না কেন, কিন্তু এই নিজামের কোন ব্রাঞ্চ নেই বুঝেছ। তাই এটা নকল করার কোন সুযোগ নেই। খেয়ে দেখ কি দারুণ জিনিস। এই খাবার খাওয়ানোর জন্যই তো তোমাকে আনলাম। অবশ্য আরো একটা উদ্দেশ্য আছে। ভাবছি কলকাতাতে যখন এলামই একটু ভালো করে কোলকাতাটা তোমাকে দেখাই। ধরো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নভো থিয়েটার, সায়েন্স সিটি এসব। আর তুমি যদি চাও শান্তিনিকেতনটাও দেখিয়ে আনতে পারি। তুমি নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনের নাম শোননি?
নিউটন মাথা নাড়ে।
: শুনবেই বা কি করে। স্কুলে তো যাওনি। স্কুলে গেলে রবীন্দ্রনাথের নাম জানতে। চিৎকার করে ওঠে নিউটন।
: স্কুলে না গেলে কি হয়েছে আমি রবীন্দ্রনাথের নাম জানি। উনি অনেক বড় কবি। ওই যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আছে না ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ওটা উনি লিখেছেন।
: বাব্বা তুমি দেখছি অনেক কিছু জানো নিউটন। তুমি রবীন্দ্রনাথের নাম জানো। হ্যাঁ জানো ওই রবীন্দ্রনাথ এই কলকাতা শহরে জন্মেছেন। জোড়াসাঁকো নামে একটা জায়গা আছে সেখানকার ঠাকুর বাড়িতে।
: তাই নাকি? আমি ওখানে যেতে চাই।
: তোমাকে নিয়ে যাব। আর যদি সময়ে কুলাতে পারি তোমাকে শান্তিনিকেতনেও নিয়ে যাব। ওখানে রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। ওখানে বিশ্বভারতী নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেটাও তোমাকে দেখানোর ইচ্ছে আমার। তবে সবই নির্ভর করছে তোমার ইচ্ছের ওপর। তুমি কতটা সময় থাকবে, কোথায় কোথায় যেতে চাইবে সেটার ওপর।
বলতে বলতে ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি চলে আসে টেবিলে। সাথে বোরহানি আর ফিরনি। কী যে চমৎকার স্বাদ সে বিরিয়ানির। আর ফিরনির মধ্যে অনেক বাদাম আর কিশমিশ। এমন ফিরনি কোনদিনই খায়নি নিউটন। ওর মা মাঝে মাঝে গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না করে। পয়সার অভাবে পরিমাণমত গুড় দিতে পারে না, আর দুধ তো দিতে পারেই না। বাদাম কিশমিশ পেস্তা এসব দেয়ার কথা ওরা ভাবেই না। গোগ্রাসে খেতে থাকে নিউটন। ওর গালের পাশে ফিরনি লেগে থাকে। তা দেখে মৌটুসি ওর হাতে একটা টিসু এগিয়ে দেয়।
: নাও নাও মোছ, ওভাবে খায় না।
নিউটন লজ্জা পায়। টিসু দিয়ে মুখ মুছে এবার সন্তর্পণে খেতে থাকে যাতে গালে লেগে না যায়।

পাঁচ.
ওরা খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে আসে। নিউটন ভীষণ খুশি। এমন খাওয়া সে জীবনে খায়নি। জীবনে দু’-একবার বিরিয়ানি সে খেয়েছে, পোলাউও খেয়েছে ঈদে। কিন্তু এ বিরিয়ানি একেবারে আলাদা। মৌটুসি পরী বলল, এটা ইরানি বিরিয়ানি। বাব্বা ইরানিরা এমন সব মজাদার খাবার খায়।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখে ভীষণ গরম। দু’ মিনিটেই ঘেমে যায় নিউটন। মৌটুসি বলে,
: শোন তুমি কিন্তু ভেবো না এই শহরের ওপর দিয়ে তোমাকে আমি পিঠে করে নিয়ে যাব। তোমাকে পিঠে নিয়ে আমি যদি উড়ি শহরের লোকজন ভাববে কোন আজব প্রাণী ওদের আক্রমণ করতে এসেছে। সাথে সাথে সৈন্য সামন্ত ডাকবে। গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেবে আমাকে।
: আর আমাকে বুঝি দেবে না? তুমি তো খুব খারাপ মেয়ে। তোমাকে ভেবেছিলাম ভাল,
: আসলেই আমি ভাল। নিজের কথা সারাক্ষণ চিন্তা করো তোমরা, মানুষেরা। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু তোমরা ভাবতে পারো না। আমরা তা ভাবি না। ওটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।
নিউটন মজা পায়। পরীরাও তাহলে মানুষের মত মুখ ফসকে কথা বলে। তাহলে মানুষে আর পরীতে তফাত থাকল কোথায়?
মৌটুসি বলে,
: শোন এই গলিটা থেকে আমাদের আগে বের হতে হবে। বড় রাস্তায় না গেলে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। এরা বেশ ভাল, তোমাদের মত না। সামনে কোন মানুষ দেখলে গাড়িগুলো স্লো করে দেয়। আর ইচ্ছেমত দাম হাঁকায় না। ধরো মিটার ট্যাক্সিরও একটা রেট বেঁধে দেয়া আছে। ওই রেটের বাইরে এরা কখনই যায় না। আর তোমাদের ঢাকায় নামে মিটার ট্যাক্সি, কখনই মিটারে যাবে না ওরা। ইচ্ছেমত দাম হাঁকাবে। এসি দেখিয়ে ট্যাক্সিতে উঠাবে তারপর এসি বন্ধ করে দেবে। অথচ পয়সা নেবে এসির। আর তোমাদের রিক্সাওয়ালারা সিটের ওপর পা তুলে বসে থাকবে। কোথাও যেতে বললে উত্তরও দেবে না। যাবে নিজেদের ইচ্ছেমত, রিক্সা ক্যাব দুটোই। ধরো আমার মতিঝিল যাওয়া দরকার, যাবে না। বলবে যাবে ধানম-ি। সত্যি এক অদ্ভুত শহর তোমাদের।
: তুমি কিন্তু বাড়িয়ে বলছ। সব রিক্সাওয়ালা সব ক্যাবওয়ালা একরকম না।
: শোন সিটের ওপর পা তুলে বসে থাকা চরম অভদ্রতা মনে রাখবে। শুধু রিক্সাওয়ালা বলে না, সবার ক্ষেত্রেই বলছি কথাগুলো। আমার মা বলেন, গুরুজনকে শ্রদ্ধা, ছোটদের ¯েœহ যারা না করে তারা কিসের মানুষ! আর এটা করতে হবে সবার সাথে। শুধু আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের সাথে না।
: কেন যেন তুমি আমাদের ঢাকাকে মোটেও পছন্দ করো না।
: আরে না। যা ভালো তাকে সবাই ভালো বলবে। এই ধরো মাছওয়ালার বউ কুসুম আমাকে কত যতœ করে খাওয়ালো। আমি কি কখনও তাকে খারাপ বলব বলো? বলব না। আসলে হয়েছে কি একবার আমি ঢাকায় ক্যাবে চড়েছিলাম। বিজয় সরণি থেকে উত্তরা যেতে আমার কাছ থেকে ভাড়া নিল এক হাজার টাকা। আর কি করল জানো? একটু গিয়েই এসিটা বন্ধ করে দিল। কি গরম যে ছিল তখন। এই এখনকার মতোই। আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। দেখ পরীরাজ্য চিরবসন্তের দেশ। ওখানে না আছে শীত না আছে গ্রীষ্ম। তুমিতো জানোই বসন্তকালে কি চমৎকার আবহাওয়া থাকে। আমার দেশে সারা বছর ওই রকম আবহাওয়াই থাকে। আর সেই আমি একটা বন্ধ ক্যাবে গরমে পাগল হয়ে গেলাম। সেদিন একটু বাতাসও ছিল না। আমি বার বার ওকে বললাম এসিটা ছাড়তে, ও ছাড়ল না। বলো এটা কি ঠিক? ও আরও কি করল জানো। এক হাজার টাকা ভাড়া ঠিক করে গেলাম। উত্তরা পৌঁছে ভাড়া দিতেই আমাকে বলল, আমার বখশিশ। আমি কিসের বখশিশ জানতে চাইলে ও বলল, আমাদের এখানে নিয়ম ভাড়ার সাথে বখশিশও দিতে হয়। আর তুমি বিদেশি, তুমি বেশি দেবে। আমার কাছ থেকে আরো পাঁচশ টাকা বেশি নিল। তুমি নিশ্চয়ই বলবে না ও ভাল কাজ করেছে?
নিউটন কোন কথা বলে না। সত্যিই ড্রাইভার খুবই খারাপ কাজ করেছে। হ্যাঁ আব্বা-মাও মাঝে মাঝে বলে ঢাকার রিক্সাওয়ালা ট্যাক্সি ড্রাইভাররা মানুষকে ঠকিয়ে অনেক টাকা নেয়। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এসব খবর বের হয়। আজকাল অজ্ঞান পার্টি নামের এক ধরনের খারাপ মানুষ বেরিয়েছে। তারা রিক্সা সিএনজি ক্যাবের ড্রাইভারের সাথে যোগসাজশে কোন একটা নির্জন জায়গায় যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে তার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে তার চোখ মুখে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয়। চোখের মাঝে মরিচের গুঁড়ো গেলে কি অবস্থা হয় ভাবতেই শিউরে ওঠে নিউটন। এ ছাড়াও কিছু লোক বাস, ক্যাবযাত্রী আর পথচারীদের ডাব কলা আর নানান ধরনের জিনিস খাইয়ে অজ্ঞান করে ছিনতাই করে। এদের সাথেও বাস ড্রাইভার রিক্সাচালকদের যোগাযোগ থাকে। এগুলো সত্যিই খুব খারাপ। টাকার জন্য মানুষের জীবনের ওপর আঘাত করা অন্যায়। হ্যাঁ এ কথা ঠিক ওরা গরিব মানুষ। ওদের উচিত পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাটিয়ে রোজগার করা। অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেয়া না। নিউটনের আব্বা একথাই তাকে বলে। নিউটন মনে মনে ভাবে, সে যখন রিক্সা চালাবে কখনই যাত্রীদের সাথে অন্যায় করবে না, বরং তাদের উপকার করার চেষ্টা করবে।
ওর চিন্তার মাঝেই কথা বলে ওঠে মৌটুসি। আমি জানি তুমি কী ভাবছ। ভাবছ ওই ক্যাবচালক সেদিন খুব খারাপ কাজ করেছে। আর ভাবছ তুমি যদি কখনও রিক্সাচালক হও কোন অন্যায় করবে না যাত্রীদের সাথে। তাইতো? আরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? আমি মানুষের মনের কথা কিছু কিছু পড়তে পারি। সব সময় সব যে পড়তে পারি তা না। তবে এখন তোমারটা পড়তে পারছি। তুমি সত্যিই খুব ভাল ছেলে। এমনই থেকো চিরদিন। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসো, মানুষের কল্যাণে লেগো।
: তুমিওতো খুব ভাল। তুমি না থাকলে আজ আমি ওই ভয়ানক জলরাক্ষসের হাত থেকে বাঁচতে পারতাম না।
: আরে না, ওটা কিছু না। দেখ ওই যে একটা ক্যাব আসছে, ওটাতেই আমরা উঠব।
মৌটুসি হাতের ইশারায় ক্যাবটাকে ডাকে। ক্যাব দাঁড়িয়ে যায়। ওরা ওঠে। মৌটুসি বলে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
ক্যাব ছুটছে। নিউটন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে চারদিক। তার জীবনে এই প্রথম কোন বিদেশি শহরে আসা। কলকাতার কথা সে জানে। ওদের বস্তিতে তিন চারটে ঘরে টেলিভিশন আছে। সেখানে স্টার জলসা আর জি বাংলা চলে। মা মাঝে মাঝে সেখানে সিরিয়াল দেখতে যায়। মা-চাচিরা গল্পও করে। কিন্তু ও যে কখনও এখানে আসতে পারবে ভাবেনি। আব্বা মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে ওর। আহারে ওরা যদি এই শহরটা দেখতে পেত। কী ভালোই যে হতো। সে একা একা একটা বিদেশি শহর দেখল আর তার আব্বা মার জীবনে সেটা দেখা হবে না। ও হাতের উল্টো পিঠে চোখ মোছে। মৌটুসি কথা বলে ওঠে।
: শোন অত মন খারাপ করে না। কিছুই বলা যায় না। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি নিজেই একদিন তোমার আব্বা মাকে এই কলকাতাতে বেড়াতে নিয়ে আসবে।
নিউটন আবারও অবাক হয়। মৌটুসির জন্য কিছুই ভাবতে পারছেনা ও। যা ভাবছে তাই বুঝে ফেলছে মৌটুসি। অদ্ভুত ব্যাপার তো! কিন্তু ও কেন বলল একদিন সে আব্বা মাকে নিয়ে কলকাতাতে আসবে। ওদের তো সংসারই চলে না। ও কি করে আব্বা মাকে নিয়ে বেড়াতে আসবে! বলেছে একটা কথার কথা আরকি!
নিউটন এ ভাবনা ঝেড়ে ফেলে আবার চারপাশে তাকায়। ক্যাব চলছে। এ শহরে জ্যাম আছে তবে ঢাকার মত অতটা না। অনেকগুলো ফ্লাইওভার ওর চোখে পড়ল। রাস্তায় অনেক সাইকেল। আগে তো ঢাকার রাস্তায় সাইকেলই দেখা যেত না। এখন অবশ্য সাইকেল বেশ বেড়েছে। ছেলেরা যেভাবে গাড়ি ঘোড়ার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে সাইকেলে যায় দেখে ভীষণ ভয় লাগে নিউটনের।
ক্যাব এসে থামে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে। মৌটুসি মিটার দেখে ভাড়া মিটায়। ক্যাব ড্রাইভার একটা কথাও বলে না। মৌটুসি বলে,
: শোন টিকেট কাটতে হবে। তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি টিকেট নিয়ে আসি।
টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকে ওরা। সামনে মার্বেলের এক প্রাসাদ। বিশাল উঁচু সিঁড়ি। অনেকগুলো সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওরা বারান্দায় আসে। মৌটুসি বলে,
: আশ্চর্য তো তুমিতো জিজ্ঞাসাও করলে না আমরা কোথায় এলাম। শোন এটার নাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ভিক্টোরিয়ার নাম জানো? জানো না? জানার কথাও না অবশ্য। উনি ইংল্যান্ডের রানী ছিলেন। একসময় ইন্ডিয়া শাসন করেছেন। জানো তো ব্রিটিশরা দেড়শত বছর ভারতবর্ষ পরাধীন করে রেখেছিল। তখন তোমাদের বাংলাদেশও ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল। তোমাদের দেশও শাসন করেছে ব্রিটিশ। তোমাদের ঢাকাতেই তো ভিক্টোরিয়া পার্ক রয়েছে, তা ছাড়া ভিক্টোরিয়া কলেজ আছে একাধিক। যাক যা বলছিলাম। তা সেই রানীর রাজত্বের ২৫ বছর পূর্তি স্মরণে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের নামকরণও করা হয় রানীর নামে।
: প্রাসাদটা কী সুন্দর।
: আরে সুন্দরতো হবেই। এটা একটা মার্বেলের প্রাসাদ। এই প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯০৬ সালে। ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম এমারসন এটার আর্কিটেক্ট ছিলেন। আর এটা বানাতে খরচ হয়েছিল ১,০৫,০০,০০০ রুপি। যার পুরোটাই এসেছিল ডোনেশন থেকে। মানে বুঝেছ তো, মানুষ দিয়েছিল এই ভবন বানানোর বিপুল পরিমাণ টাকা।
: তুমি এমনভাবে বলছ যেন মার্বেলের প্রাসাদ এই একটাই আছে। আর কোথাও নেই। আমাদের ঢাকার লালবাগ কেল্লা কি এর চেয়ে খারাপ তুমি বল?
: তোমার একটা সমস্যা কি জানো, তুমি যাই দেখ তাই-ই নিজের দেশের সাথে তুলনা কর। আমি কি কখনও বলেছি তোমার দেশে মার্বেলের প্রাসাদ নেই বা লালবাগ কেল্লা এটার চেয়ে খারাপ। নাও লালবাগ কেল্লার কথা পরে হবে। এখন এ মেমোরিয়াল ঘুরে ঘুরে দেখ। এখন কিন্তু এটা একটা জাদুঘর বুঝতে পারছ তো? দেখ ভুলেও কোনকিছু যেন ধরো না, বা ছুঁয়ে দিও না। তুমিতো আবার পড়তে জানো না। এখানে একটু পর পরই লেখা আছে হাত দেয়া নিষেধ।
মনে মনে ভীষণ রাগ হয় নিউটনের। পরীর সব ভাল শুধু বেশি কথা বলা ছাড়া। কথায় কথায় বলছে আমি পড়তে জানি না। এতটুকু পড়তে আমি ঠিকই জানি। বাগানে বা পার্কে যে লেখা থাকে, ‘ফুলগাছে হাত দেয়া নিষেধ’ তাকি আমি পড়তে পারি না। খুব পারি। কিন্তু এই কথাগুলো ও পরীকে বলে না। গুম হয়ে থাকে। ও ঘুরে ঘুরে মিউজিয়াম দেখে। আরও অনেক পর্যটক এসেছে। ওরা একতলা দেখা শেষ করে দোতলায় যায়। একসময় দেখা শেষ করে নিচে নেমে আসে। ক্যাবে উঠতে উঠতে মৌটুসি বলে,
: কেমন লাগল ?
: ভাল।
: শুধু ভাল ?
: হ্যাঁ শুধু ভাল। শোন তোমায় আমি বলি। আমি একবার লালবাগ কেল্লায় গেছিলাম। কী যে সুন্দর। আর ওখানকার বাগান দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। কী সবুজ কী সবুজ! জানো ওটাকে বলে রাজকীয় বাগান।
মৌটুসি হাসে, বলে,
: তোমার মাথা থেকে দেখছি লালবাগ কেল্লা যাচ্ছেই না। তোমার কি ধারণা আমি ওটা দেখিনি? খুব দেখেছি। আমি যেখানে যাই সেখানকার সব কিছুই ঘুরে ঘুরে দেখি। শোন তোমায় বলি, লালবাগ কেল্লা মোগল আমলে তৈরি। ওটাকে লালবাগ ফোর্টও বলা হয়। ও ফোর্টের আগের নাম ছিল আওরাঙ্গাবাদ ফোর্ট। কারণ ওই এলাকাটার নাম ছিল আওরাঙ্গাবাদ। ফোর্টটা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ওই কেল্লাটা খুবই জনপ্রিয় আর পরিচিত। মোগল বাদশাহ প্রিন্স মোহাম্মদ আজমের সময় এটি নির্মিত হয়। তিনি ছিলেন স¤্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে। সেই সময় তিনি তৎকালীন বাংলাদেশে ১৫ মাস ছিলেন। এরপর তার বাবা আওরঙ্গজেব তাকে ডেকে পাঠান। ফলে ভবনের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। তখন ঢাকার নতুন সুবেদার ছিলেন শায়েস্তা খান। তিনি অসমাপ্ত কাজ শেষ করায় হাত দেন। কিন্তু সমাপ্ত করতে পারেননি। কাজ চলাকালে তার কন্যা ইরান দুখত (পরীবিবি) ইন্তেকাল করেন। আর তাতেই তার মনে হয় এই ফোর্ট ভয়াবহ। তাই তিন কাজ অসমাপ্ত রাখেন।
নিউটন অবাক হয়ে শুনছিল আর ভাবছিল এই মৌটুসি পরী কি না জানে। সে যা জানে না তার সবই তো মৌটুসি জানে। ও একটু থামতে নিউটন আগ্রহভরে বলে,
: থামলে কেন বলো। খুব ভাল লাগছে শুনতে। সত্যি তুমি কত কিছু জানো,
: আরে না, হ্যাঁ শোন ওই ফোর্ট খুবই উন্নতমানের লালমাটির তৈরি। ওই ফোর্টের তিনটা প্রধান অংশের একটা পরীবিবির কবর। একসময় রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করায় ওই এলাকার জৌলুস কমে যায়। শায়েস্তা খান ঢাকা ছেড়ে চলে যান। মোগল শাসন শেষ হয়ে যাবার পর ওই কেল্লা পরিত্যক্ত হয়। ১৯৪৪ সালে ওই এলাকার নাম আওরঙ্গবাদের স্থলে লালবাগ রাখা হয় আর ফোর্টের নামও বদলে গিয়ে হয়ে যায় লালবাগ ফোর্ট। ওই ফোর্টের পশ্চিম দিকে রয়েছে একটা মসজিদ। মোগল আমলে ওখানে নামাজ পড়া হতো, এখনও হয়। ফোর্টের পূর্ব পশ্চিমের মাঝের অংশে আছে পরীবিবির সমাধি। আর পূর্ব পাশে দেওয়ানি আম। ওখানে বসে তখনকার বাদশাহরা সপ্তাহে একদিন সাধারণ জনগণের কথা শুনতেন, তাদের নির্দেশ দিতেন। ওই ফোর্টে একটা রাজকীয় বাথরুম আছে যার নাম হামমাম। শায়েস্তা খান ওই ফোর্ট সমাপ্ত করতে পারেননি। কিন্তু তিনি পরীবিবির সমাধির নকশা করেন। ওখানে অনেক বিরল ইসলামি আর্ট, মার্বেল টাইলস আর হস্তশিল্প সামগ্রী আছে যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। নয়টি কক্ষ ওসব জিনিসে সাজানো আছে। মিনারের একেবারে উঁচু অংশের ছাদ কালো মার্বেলে তৈরি আর মিনার কপার দিয়ে ঢাকা। ওই ফোর্টের তিনটি ফটক আছে যার একটি বুড়িগঙ্গার দিকে। এক সময় স¤্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে তার মেয়ে পরীবিবির স্মরণে এই এলাকা দান করেন। প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন লোক ওই এলাকাটা দেখতে যায়।
আমিও গিয়েছিলাম বুঝেছ। তুমি যেমন ওখানকার ঘাস দেখে অবাক হয়েছিলে আমিও তাই। আমি কি করেছিলাম জানো। আমি সটান শুয়ে পড়েছিলাম ওখানকার ঘাসে। আর সাথে সাথে একটা লোক এসে বলেছিল, ‘এখানে শোয়া বারণ।’ তুমি ঠিকই বলেছ সত্যিই ফোর্টটা দুর্দান্ত। আর বুড়িগঙ্গা! সেটা এক চমৎকার নদী। কিন্তু কি জানো কয়েক বছর আগে বুড়িগঙ্গাকে যেমন দেখেছিলাম এবার তা দেখলাম না। নদীর চারপাশে শুধুই কলকারখানা। আর সেসব কলকারখানার ময়লা পড়ছে নদীতে। কী যে ময়লা তোমাদের বুড়িগঙ্গার পানি! আর কী গন্ধ! দেখলে সত্যি কষ্ট হয়। নদীতে সে ঢেউও কিন্তু নেই। বলো আমি কি ভুল বলছি?
এ কথার প্রতিবাদ করার কোন উপায় নিউটনের নেই। তার আব্বাও মাঝে মাঝে এ কথা বলেন। বলেন আর আক্ষেপ করেন। মানুষ নাকি তাদের যত ময়লা সব এনে ঢালছে বুড়িগঙ্গায়। এটা কোন কথা হল!
: শোন তুমি কিছু বলছ না বলে আমি বুঝতে পারছি আমার কথার সাথে তুমি একমত। হ্যাঁ আমিতো শুনলাম তোমাদের দেশের একদল লোক ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ আন্দোলন করছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। শোন একটা কথা মনে রাখবে, আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে, নাহলে ওই পরিবেশ বাঁচাও, নদী বাঁচাও দিয়ে কিছু হবে না।
ওরা এগিয়ে চলে। নিউটনের বিস্ময় বাড়ে। কত কিছু জানে মৌটুসি। কতই বা ওর বয়স। বড়জোর নিউটনের থেকে দুই চার বছরের বড়। তাতেই ও পৃথিবীর এত কিছু জেনে ফেলেছে, এত কিছু বুঝে ফেলেছে। ও মৌটুসিকে বলে,
: আচ্ছা তুমি কোন স্কুলে পড়? ওটা কি বাংলা স্কুল নাকি ইংরেজি? কলেজে নিশ্চয়ই পড়ে না। অত বড় তো তুমি না।
হো হো করে হেসে ওঠে মৌটুসি। সে হাসি যেন থামতেই চায় না।
: তুমি অত হাসছ কেন? এমন কি হাসির কথা বললাম। তুমি এত ছোট মানুষ অথচ এত কিছু জানো তাই ভাবছি নিশ্চয়ই তুমি কোন ভাল স্কুলে পড়।
মৌটুসির হাসি যেন থামতেই চায় না। হাসতে হাসতে ও বলে,
: আরে বোকা আমাদের দেশে তোমাদের দেশের মত স্কুল কলেজ মাদরাসা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। না ইংরেজি না বাংলা না আরবি। আর ওসব ভাষায় পড়ে আমরা করব কি। ওর একটাও আমাদের ভাষা না। আমাদের ভাষা পরীর ভাষা। শোন আমাদের পড়ার দরকার হয় না। আমরা জন্ম থেকেই সব জানি বুঝলে। আর পড়ে ডিগ্রি নিয়ে আমরা কী করব। আমরা তো তোমাদের মত চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য করি না।
: তাহলে?
: তাহলে কি সেটা আমাদের দেশে গেলেই বুঝতে পারবে। এখন চলো সায়েন্স সিটিতে যাই।
: সেটা কোথায় ?
: তা দিয়ে তোমার দরকার কি। আমার সাথে আছ, আমি যেখানে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, যা দেখাচ্ছি, দেখে যাও। ট্যাক্সি নিতে হবে। জায়গাটা বেশ দূরে।
: বেশ দূরে যখন চলো পরে যাই। আগে আশপাশের জায়গা দেখেনি। তুমি কি একটা নভোথিয়েটারের কথা বলেছিলে।
: ওটা পরে দেখব। আমি ঠিক জানি না রাতে সায়েন্স সিটি খোলা থাকে কিনা। সরকারের আন্ডারে মানে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স অর্থাৎ মিনিস্ট্রি অব কালচারের অধীনে সায়েন্স সিটি। সরকারি ব্যাপার, রাতে খোলা নাও থাকতে পারে। তাই রিস্ক নেয়ার দরকার কি। চলো আগে ওটা দেখে নি।
ওরা কিছুটা হাঁটে। হঠাৎ দমকা বাতাস ওঠে। মৌটুসির চমৎকার গাউন বাতাসে উড়তে থাকে। রাস্তার মানুষেরা তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখে। ভয় পায় মৌটুসি। যেকোনো মুহূর্তে ওর ডানা বেরিয়ে পড়তে পারে। ডানা লুকাতে হিমশিম খায় ও। মানুষেরা যেমন ভাল, তেমনই হিং¯্র। ওরা মানুষকে আদর করে, যতœ করে, দেখাশুনা করে, রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করায় কিন্তু যদি ওরা বুঝে যায় মৌটুসি ওদের লুকিয়ে কিছু করছে, যদি বুঝে যায় ও আসলে পরী, ডানা লুকিয়ে মানুষের ছদ্মবেশে এসেছে তাহলে ওরা তাকে মেরে ফেলতেও কার্পণ্য করবে না। নিউটন মৌটুসির দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করে। এই পরীটা তার কত উপকার করেছে, ও না থাকলে সে জলরাক্ষসের হাত থেকে রক্ষাই পেত না। কিছুক্ষণ আগে মৌটুসি যেমন ওর পিঠে আলতো হাত দিয়ে অভয় দিয়েছিল সেই একইভাবে অভয় দেয় নিউটন। বলে,
: ভয় পেও না, কিচ্ছু হবে না। সবাই এখন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। তোমার দিকে তাকাবার সময় কারো নেই। এখনই বাতাস থেমে যাবে। শোন তোমার দেশ তো চির বসন্তের দেশ। আমার দেশ তা নয়, আমার দেশে ছয় ঋতু। ঝড় জলোচ্ছ্বাস টর্নেডো প্রতি বছরই আমাদের আঘাত হানে। তাই ওসবের সাথে আমাদের ভাল পরিচয়। আমি বলছি এ বাতাস এখনই থেমে যাবে। একটু স্থির হও তুমি।
সত্যিই কয়েক মিনিটের মধ্যে বাতাস থেমে যায়। অবাক হয়ে নিউটনের দিকে তাকায় মৌটুসি। ফিসফিস করে বলে,
: যা ভেবেছিলাম তা না, এ অনেক কিছু জানে।
নিউটন মনে মনে হাসে। মৌটুসি ততক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। আত্মবিশ্বাসও ফিরে এসেছে ওর। ওরা হাঁটতে থাকে। আর হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা ক্যাব পেয়ে যায়। ওরা এসে নামে কলকাতা সায়েন্স সিটির সামনে। এ সিটি জেএসবি হালডন এভিনিউতে। এর ঠিক উল্টোপাশে প্রতি বছর বইমেলা হয়। এ সিটি ১ জুলাই ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। মৌটুসি বলে চলে,
: শোন এখানে আছে গ্যালারি, সায়েন্স পার্ক, আদার ফ্যাসিলিটিজ, সায়েন্স এক্সপ্লোরেশন হল। অনেক বড় জায়গাতো। এটাতে গাড়িতে করে ঘোরার ব্যবস্থা আছে। চলো একটা গাড়িতে উঠি।
ওরা গাড়িতে ওঠে। এ গাড়ির ওপরে একটা আচ্ছাদন আছে ঠিকই, কিন্তু চারদিকটা খোলা। ফলে সব কিছু দেখা যায়। যেতে যেতে নিউটন দেখে চমৎকারভাবে ছাঁটা গাছ আর অজ¯্র ফুল। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে। খলবল করে হাসছে। একটু বড় যারা তাদের হাতে শোলার ঠোঙায় চটপটি আর ফুচকা। আরও কি সব নিউটন নাম জানে না। মৌটুসি বলে,
: একটা জিনিস তোমায় বলি, পরীরাজ্যে বহু খাবার জিনিস আছে। সেসব খাবারের স্বাদ কী অপূর্ব তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। বহুদূর থেকে সে খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু পরীরাজ্যে চটপটি আর ফুচকা নেই। প্রথম দিন আমি চটপটি খেয়েছিলাম তোমাদের ঢাকায় ধানমন্ডি ৫ নং রোডের মাথায় বসে। ওখানে সব সময় একটা চটপটির গাড়ি থাকে আর তার সামনে বেছানো থাকে অনেকগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ওখানে চটপটি খেতে আসে। কেউ আসে গাড়ি করে, কেউ পায়ে হেঁটে। আগে ও রাস্তায় রিক্সা চলত না। এবার দেখলাম দিব্যি রিক্সা চলছে। ব্যাপারটা হয়েছে কি, আমি একদিন অদৃশ্য হয়ে ওই ফুচকার গাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম বেশ কিছু লোক ওখানে বসে কি যেন খাচ্ছে। তাদের চোখ মুখে কী গভীর তৃপ্তি! যেতে যেতে আমি শুনলাম কেউ একজন বলছে, ভাই আর একটু টক দাও না। দোকানি টক দিল। আর ওই লোকটা টক দেয়া খাবারটা মুখে তুলে টকাস টকাস আওয়াজ করতে লাগল। আমি তাকিয়ে দেখলাম ওখানে বসে যারা খাচ্ছিল সবারই চেহারায় একই ছাপ, মানে তৃপ্তির ছাপ। আমার কৌতূহল হলো। আমি মুহূর্তে অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হলাম। সুন্দর রঙের কারুকাজ করা একটা কামিজ আর জরির ওড়না পরে দোকানির সামনে দাঁড়ালাম। দোকানি চোখ তুলে তাকালো। আমি বললাম ফুচকা। ফুচকার পরে খেলাম চটপটি। খেতেই থাকলাম। আমি সেদিনই বুঝলাম কেন সবাই দূর দূরান্ত থেকে এখানে খেতে আসে। এ খাবারের কোন তুলনা হয় না। আহা কি খাবার! এই দেখ বলতে বলতে জিভে জল এসে গেল। আমি ঠিক করে রেখেছি একবার মার জন্য ওই ফুচকা আর চটপটি নিয়ে যাব। জানো আমার মা বড় ছেলেমানুষ। খিলখিল করে সারাক্ষণ হাসে। আর খাবার দেখলে খুবই খুশি হয়। আমি নিশ্চিত ওই চটপটি খেলে মা বার বার আমাকে বলবে, যাতো মা আমার জন্য চটপটি আন। আচ্ছা তুমি কখনও ধানমন্ডি ৫নং রোডের চটপটি খেয়েছে?
নিউটন কোন জবাব দেয় না। এ এক অদ্ভুত মেয়ে। পৃথিবীর কি ও খায়নি আর কোথায় যায়নি সেটাই নিউটনের এখন প্রশ্ন। ঢাকায় বাস করে তার ধানমন্ডি ৫ নং রোডের ফুচকা খাওয়া হল না আর ওই মেয়ে পরীরাজ্য থেকে এসে চটপটি ফুচকা খেয়ে তার গল্প করছে।
: কি হলো খাওনি তো? অসুবিধা নেই। আমি একদিন তোমাকে ওখানে চটপটি খাওয়াতে নিয়ে যাব। একবার খেলে আর ভুলতে পারবে না। আরে দেখ আমি কি গাধা, সায়েন্স পার্ক না দেখে চটপটির গল্প করছি। নাও ভাল করে দেখ চারদিকটা। ওই দেখ একটু পর পর কত বেঞ্চি পাতা। মানুষ ক্লান্ত হলে সহজেই ওখানে বসতে পারে। দেখ কত লোক বসেছে। আর উপরে তাকাও। তারের ওপর দিয়ে ওটা কি চলছে বলতে পার? ওটার নাম কেবলকার। ভয় পাচ্ছ নাকি? আরে ভয় পেও না। ওটা বিদ্যুতে চলে, কোন অসুবিধা নেই। চড়বে নাকি? চল চড়ি।
: আরে না না। মা শুনলে বকবে
সত্যি কথা বলতে কি কেবলকারে চড়ার ইচ্ছে নিউটনের ষোল আনা। কিন্তু মনে ভয়ও আছে। ওই অতটুকু তারের ওপর দিয়ে গাড়ির মত ওই জিনিসটা যাচ্ছে। কত উঁচুতে ওগুলো। একবার যদি তার ছিঁড়ে পড়ে যায় হাড় গোড়ের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
: চড়বে না তাহলে? থাক ইচ্ছে না হলে চড়ার দরকার নেই। ওই যে ওই স্ট্যাচুগুলো দেখেছ? ওগুলো ভারতের জাতীয় নেতাদের।
এবার গাড়ি মোড় ঘোরে। মৌটুসি বলে,
: ওই যে ওটা ইভালুয়েশন পার্ক। ওই যে ওখানে প্রচুর জীব জন্তুর ছবি দেখতে পাচ্ছ। আর ওই দেখ কত আয়না।
ততক্ষণে গাড়ি আরও এগিয়েছে। মৌটুসি বলে,
: ওই যে দেখ ওখানে আছে সোলার সিস্টেম। আর ওই যে ওখানে টানেল। আর একটা কথা, এখানে কিন্তু থ্রীডি সিনেমাও দেখানো হয়। আছে শরীর চর্চার ব্যবস্থা আর স্পেস টাইম রকেট। শোন তোমাকে বললেই তো গাল ফুলাবে কিন্তু বলতে আমাকে হবেই। তোমাদের দেশে কিন্তু এমন একটা সায়েন্স পার্ক নেই। হ্যাঁ মানছি তোমাদের দেশে নানা ধরনের পার্ক আছে। দুলাহাজরা সাফারি পার্ক, অনেকগুলো ইকো পার্ক আর সবশেষে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। হ্যাঁ ওই পার্কটা মারাত্মক সুন্দর। আমি যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন কি হয়েছিল জানো। আমি একজন রাজনীতিবিদের চেহারা নিয়ে ঢুকেছিলাম। তাই আমাকে খাতির করে ওরা আমার গাড়ি নিয়ে ঢুকতে দিয়েছিল। সাধারণত লোহার জালি দিয়ে ঘেরা গাড়িতে করে পর্যটকরা পার্কের মধ্যে যায়। ওখানেও তাই যাচ্ছিল। আমার গাড়িটা যথেষ্ট মজবুতই ছিল। তবে লোহার জালি দেয়া গাড়ির চেয়ে কিছুটা নিচু। তা হল কি জানো, গেট দিয়ে গাড়িটা ঢুকল। যাচ্ছে যাচ্ছে। একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেশ দূরে ঘাপটি মেরে বসে ছিল।। আমার গাড়ি দেখে সে গাড়ির পেছনে দৌড়াতে লাগল। দু একবার সে গাড়ির ব্যাকে থাবাও দিল। এভাবে কিছুদূর যাবার পর সে ক্লান্ত হল। কারণ ততক্ষণে আমরা স্পিড অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি। এরপর পিছু নিল একটা সিংহ। কেশর দুলিয়ে সে প্রথমে হাঁটতে শুরু করল, তারপর দৌড়। সত্যিই তখন তাকে বনের রাজা মনে হচ্ছিল।
: তোমার ভয় লাগেনি?
: লাগেনি মানে। আমি তখন রীতিমতো কাঁপছিলাম। আমাদের পরীরাজ্যে অনেক জীবজন্তু আছে। কিন্তু তারা এমন হিং¯্র না। আমরা একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত করি। আর এরা একটু ফুরসত পেলেই ঘাড় মটকে দেয়।
কথা বলতে বলতে চেঁচিয়ে ওঠে মৌটুসি,
: ওই দেখ দেখ কী সুন্দর। পানির তরঙ্গের তালে তালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। মনে হচ্ছে পানি কন্যারা যেন নাচছে।
ততক্ষণে সায়েন্স সিটি ঘোরা শেষ। গাড়ি থেকে নেমে মৌটুসি বলে,
: চলো এবার যাই।
: কোথায়?
সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।

ছয়.
ওরা আবার ট্যাক্সি নেয়। তখন সন্ধ্যা নামছে। পাখির ডাকে মুখরিত চারদিক। নিউটনের মনে পড়ছে ওদের বস্তির পাশে আমগাছের ডালে যে নাম না জানা পাখিটা বসে থাকে সেটার কথা। মনে পড়ছে মায়ের কথা। মা এখন কি করছে? একদিকে মৌটুসি বলেছে এক লহমায় সে নাকি তাকে পরীরাজ্য ঘুরিয়ে আনবে অথচ সকাল হচ্ছে, বিকেল হচ্ছে, সন্ধ্যা নামছে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না মৌটুসির কথা।
: আনমনা হয়ে কি ভাবছ এত? মৌটুসি বলে,
নিউটন জবাব দেয় না।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ট্যাক্সি থামে।
ওরা নামে গোলাকৃতির ছাদওয়ালা একটা বাড়ির সামনে। মৌটুসি বলে,
: এটার নাম নভোথিয়েটার। আর একটা নামও আছে ‘বিড়লা প্লানেটরিয়াম।’ এদেশে বিড়লা নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অনেক কাজ করে গেছেন মানুষের জন্য। মন্দির বানিয়েছেন, হাসপাতাল বানিয়েছেন আরও কত কি। বড়লোক তো কতই থাকে, কিন্তু মানুষের সেবায় অর্থ ব্যয় করে কয়জন। কিন্তু দেখ যারা অর্থের পাহাড় রেখে মারা গেছেন তাদের নাম কেউ নিচ্ছে না। নিচ্ছে বিড়লার নাম। কেন? কারণ তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। কথাটা মনে রাখবে কেমন। তুমি একটু এখানে দাঁড়াও, আমি টিকেট কেটে আনি।
প্লানেটরিয়ামের সামনের গাছগুলোর চারপাশ গোল করে বাঁধানো। নিউটন সেখানে বসে ভাবতে থাকে, পরী কন্যা কত ভাল। তাকে কত কত জায়গায় ঘুরাতে নিয়ে যাচ্ছে, কত কিছু খাওয়াচ্ছে। যা জীবনে কখনও সে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর কত টাকা তার জন্য খরচ করছে মৌটুসি। যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই তো টিকেট লাগছে। ওর ভাবনার মাঝেই মৌটুসি এসে যায়। বলে,
: চলো শোর সময় হয়ে গেছে।
: শোর সময় মানে, এটা কি সিনেমা হল নাকি?
: ওই ধরনেরই, তবে সায়েন্সের সিনেমা। দেখলেই বুঝতে পারবে।
ওরা গ্যালারিতে ঢুকে বসে। বিশাল একটা হলে। গোলাকৃতির। মাঝখানে অনেক বড় এটা যন্ত্র। একটু পরেই শো শুরু হয়। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। অজানা অচেনা জায়গায় নিউটনের গা ছমছম করে। ও মৌটুসির হাত চেপে ধরে। মৌটুসি ওর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলে,
: ভয়ের কিছু নেই। এই শো দেখাতে হলে ঘর অন্ধকার করতে হয়। এর পর অন্ধকার আরো ঘন হবে। তুমি ভয় পেও না।
ওর কথা শেষ হবার আগেই নিউটন অবাক হয়ে দেখে তার সামনে তারাজ্বলা আকাশ। সে আকাশে একে একে ফুটে উঠতে থাকে গ্রহ নক্ষত্র। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। ইংরেজিতে কেউ বর্ণনা দিচ্ছে কী দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার একবিন্দুও নিউটন বুঝতে পারছে না। ওর কান্না পেতে থাকে, কেন যে সে ইংরেজি জানে না। প্রথমে সূর্যাস্ত হল। তারপর একে একে আকাশ ভরে উঠল গ্রহ নক্ষত্রে। বিজ্ঞানের নিয়মে যেভাবে ওঠে সেভাবেই হল। শো এগিয়ে গেল, তারপর সূর্যোদয় দেখিয়ে শো শেষ হল।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এল নিউটন। এমন বিস্ময়কর ব্যাপার যে কখনও হতে পারে সে কখনও ভাবেনি। একটা ঘরের মধ্যে নেমে আসতে পারে আকাশ চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র! ও কোন কথা না বলে হাঁটতে থাকে। মৌটুসি সেটা লক্ষ করে বলে,
: কি হল শো ভাল লাগেনি?
: খুব ভাল লেগেছে, কিন্তু ইংরেজিতে কি বলল কিছুই বুঝলাম নাতো তাই মন খারাপ লাগছে। সত্যিই আমি একটা মূর্খ।
: আরে অত মন খারাপ করো না। ইংরেজি না জানলেই মূর্খ হয় নাকি! সবার আগে জানা দরকার, নিজের ভাষা, নিজের মাতৃভাষা। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় মনীষী ছিলেন যারা ইংরেজি জানতেন না, কিন্তু তারাই বেঁচে আছেন তাদের কীর্তির মাধ্যমে। আর যারা গড় গড় করে ইংরেজি বলতেন তারা কোথায় হারিয়ে গেছেন কেউ জানে না, কেউ তাদের নামও করে না।
: তবুও।
: তবুও কি ?
: না মানে শোতে কি বুঝালো বুঝলাম নাতো তাই।
: অসুবিধা নেই তুমি চাইলে আমি বুঝিয়ে দেব। আর হ্যাঁ শোন আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাদের দেশেও নভোথিয়েটার আছে। সেখানে বাংলায় ধারা বর্ণনা করা হয়। একদিন দেখে নিও তাহলে সব বুঝে যাবে। হ্যাঁ ওটা হচ্ছে তেজগাঁয়। বিজয় সরণি দিয়ে একটু এগোলেই বাম হাতে। ওখানে টিকেটের দাম মাত্র একশো টাকা। আর যে আগে যাবে সে আগে টিকেট পাবে। যে কোন শনিবার যেও। ১১টা, ১টা, ৫টা ও ৭টা সময় শো হয়। অন্যদিন কখন হয় আমি ঠিক জানি না। অবশ্য নেটে সার্চ করে তোমাকে বলতে পারি। কিন্তু অত ঝামেলার দরকার কি তাই না। তোমাদের দেশের নভোথিয়েটারের নাম ‘বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার’। আগে ওটার নাম ছিল ভাসানী নভোথিয়েটার। ওটা ৫.৪৬ একর জমির ওপর অবস্থিত। আর গোলাকৃতি যে জিনিসটা এখানে দেখলে যাকে বলে ডোমাকৃতি ওটার উচ্চতা ২১ মিটার। একসাথে ২৭৫ জন বসে শো দেখতে পারে। শোন ওখানে তিন ধরনের শো হয়। প্রথমটা হচ্ছে, ‘জার্নি টু দি ইনফিনিটি’। ওটা এখানকার শোর মত। তারা গ্রহ নক্ষত্র আর বেহেশতি জিনিসের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। ভার্চুয়াল বুঝলে না তাই না? আমিও যে ঠিক বুঝি তা না। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে আছে কিন্তু নেই এমন। যেমন, ধরো এখানে তোমার চোখের সামনে তারাজ্বলা আকাশ তারা চাঁদ সূর্য আছে, তুমি দেখলে কিন্তু আসলে ওরা কিন্তু ওখানে নেই। আর রিয়েলিটি হচ্ছে বাস্তবতা। এটা একটা শো। আর একটা শোর নাম ‘এই আমাদের বাংলাদেশ।’ এ শোতে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ও বলার সাথে সাথে হাততালি দিয়ে ওঠে নিউটন,
: তুমি এটাও জানো। তুমি কত ভাল!
: কী কা- জানব না কেন, এটা তো কালজয়ী ভাষণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। ও তুমিতো আবার কালজয়ী জানে না। কালজয়ী মানে সব কালেই যা জয়ী হয়, যা কালকে জয় করেছে, যা কখনও মরে না। হ্যাঁ তৃতীয় আর একটা শো দেখানো হয়। যেখানে দেখানো হয় বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ক্যানিওন’। এ ছাড়া ওখানে থ্রীডি সিনেমাও দেখানো হয়। এখানকার থেকে তোমাদের নভো থিয়েটার ভালো। তুমি খেয়াল করোনি এখানে যারা পূর্ব পাশে বসেছিল তারা ডেমনেসট্রেশনের সব ছবি মিস করেছে। সব ছবি পশ্চিম পাশে দেখানো হয়েছে তখন। এটা একটা বড় সমস্যা। তুমি তোমার দেশের নভোথিয়েটার দেখে নিও কিন্তু। তোমার জ্ঞান অনেক বাড়বে।
: কিন্তু।
: আবার কিন্তু কি, টিকিটের টাকার কথা ভাবছ? মাত্র তো একশো টাকা। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব।
প্রবলভাবে আপত্তি করে ওঠে নিউটন।
: না না কিছুতেই না। এই যে তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরছ, ভালো ভালো খাবার খাওয়াচ্ছ এটাই যথেষ্ট। এটা নেয়াও উচিত না। আব্বা বলেন, যা তোমার রোজগার না তা কখনও নেবে না।
: ধরো তুমি একটা লটারি জিতলে কিংবা তোমাকে কোন অ্যাওয়ার্ড দেয়া হলো সেটা তুমি নেবে না? সেটাও তো তোমার রোজগার না।
: লটারির ব্যাপারটা আলাদা, তবে নেয়া যেতে পারে। ওটাও তো নিজের টাকায় কেনা টিকেটে বা কুপনে হয়। তা ছাড়া অ্যাওয়ার্ড নিশ্চয়ই কোনো ভাল কাজের জন্য দেয়া হয়। নিশ্চয়ই কোন মেধার বা প্রশংসার কাজ। ওটা নিতে আপত্তি কি। কিন্তু তাই বলে তুমি খামোখা পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে আর আমি নেব সেটা কখনই হবে না।
: আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, অত উত্তেজিত হয়ো না। নিতে হবে না তোমাকে। চলো এবার এগোই।
ওরা এগোয়। নভোথিয়েটারে থাকা অবস্থায় যে বৃষ্টি হয়েছে ওরা তা বুঝতেও পারেনি। রাস্তাগুলো ভেজা ভেজা। গাছের পাতা দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। আর পাতাগুলো পানিতে ধুয়ে একেবারে সতেজ সবুজ। ঢাকার গাছে অবশ্য অনেক ময়লা থাকে। কিন্তু বৃষ্টির পানি পেলে এমনই হয়। বৃষ্টি নিউটনের দারুণ পছন্দ। বৃষ্টিতে লুটোপুটি করে ফুটবল খেলা, বৃষ্টির কাদা পানিতে গড়াগড়ি খাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে ঝাঁপ দেয়া এসব ওর ভীষণ প্রিয়। কিন্তু ঢাকা শহরে কোথায় ও খেলার মাঠ পাবে, আর সাঁতার কাটার জন্য পুকুর পাবে। তবুও সুযোগ পেলেই ও বৃষ্টিতে ভেজে। ও যত ভেজে মা তত বকে। একবার তো বৃষ্টিতে ভিজে একশ চার ডিগ্রি জ্বর বাধিয়ে বসেছিল। সে জ্বর কিছুতেই কমে না। প্রথম দিকে পানি পড়া তেলপড়া দিলেও পরে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়েছিল। তাতেও সুস্থ হয়ে উঠে বসতে পনের দিন লেগে গিয়েছিল। আর ওই পনের দিনে মায়ের দুটো বাসার কাজ চলে গিয়েছিল। আর আব্বা ধারকর্য করে যে চিকিৎসা চালিয়ে ছিলেন সে টাকা শোধ করতে অনেকদিন লেগেছিল। জ্বরের সময়টাতে যখনই চোখ মেলেছে, ও দেখেছে উদ্বিগ্ন আব্বা মা ওর শিয়রে বসা। মা হয় মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন না হয় গামছা দিয়ে গা মোছাচ্ছেন। আর আব্বা ক্রমাগত বলে চলেছেন,
: কি কষ্ট বল দেখি বাবা, কি কষ্ট?
ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর মা মাগুর মাছের ঝোল, চিকন চালের ভাত আর কবুতরের মাংস রান্না করে দিয়েছিলেন। ওসব কোথা থেকে যে জোগাড় হয়েছিল কে জানে। ও সেরে ওঠার পর মা একদিন চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন,
: দেখ বাবা তুই সেরে উঠেছিস এটা আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। তবে বাবা আর কখনও বৃষ্টিতে ভিজিস না। আমরা বড়লোক না, ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনার পয়সা আমাদের নেই। আর কাজ চলে গেলে আর একটা কাজ জোগাড় করতে খুব অসুবিধা হয়। সাবধানে থাকিস বাবা, একটু বুঝে চলিস।
মার কথাগুলো বুঝেছিল নিউটন। সেই থেকে ও চেষ্টা করে বৃষ্টিতে না ভিজতে। তবে বৃষ্টি দেখলেই ওর মন নেচে ওঠে। আজও নেচে উঠল। তবে এখন আর বৃষ্টি নেই। ও মৌটুসিকে বলল,
: গাছের পাতাগুলো কি সুন্দর দেখ!
: খুব সুন্দর। আচ্ছা এখন কোথায় যাওয়া যায় বলত? একটু ভেবে বলে, চলো দীঘায় যাই।
: দীঘা সেটা আবার কোথায়? এখন আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
: চলো দীঘাটা তো দেখি। তারপর কোথাও যেতে ইচ্ছে না হলে যাবে না। চলো।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে গড়ের মাঠে এসে দাঁড়ায়। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ডানা বের করে মৌটুসি। মেলে ধরে,
: চটপট আমার ডানায় বসো। মানুষ দেখলে রক্ষা নেই। অনেক ওপর দিয়ে মানে মেঘের ওপর দিয়ে উড়ব।
: কেন শুনি ওখানে কি বাস ট্রেনে যাওয়া যায় না? আর জায়গাটা কোথায়? ওখানে দেখারই বা কি আছে?
: আরে আছে আছে, দেখার অনেক কিছু আছে। না থাকলে কি যেতাম বল। দীঘা হচ্ছে কলকাতার সাগর পারের রিসোর্ট সিটি। কলকাতা থেকে রেল সড়ক দুই পথেই যাওয়া যায়। ভাল ভলভো বাস আছে। কলকাতা থেকে মাত্র ১৮৭ কিলোমিটার দূরে। গেলেই বুঝবে জায়গাটা কত সুন্দর। তুমি হয়ত ভাবছ এত অল্প পথ আমি কেন তোমাকে ডানায় করে নিয়ে যাচ্ছি। নিয়ে যাচ্ছি কারণ ওপর থেকে তুমি সমুদ্র দেখতে পারবে। ট্রেনে বা বাসে গেলে সেটা পারবে না।
উড়তে লাগল মৌটুসি। আগে ভয়ে মেঘ ধরত না নিউটন। এখন বেশ কয়েকবার উড়ে ওর সাহস বেড়ে গেছে। ও হাত দিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। কী কান্ড মুঠো খুলে দেখে কিছু নেই। অথচ ওরা ঠিকই ভাসছে। কেমন ম্যাজিকের মত মনে হয় নিউটনের। মৌটুসি যেতে যেতে বলে,
: তোমাদের দেশে কক্সবাজার নামে একটা জায়গা আছে জানো? নিশ্চয়ই জানো না। তুমি তো আবার কিছুই জানো না।
‘জানি জানি’ বলে চেঁচিয়ে উঠল নিউটন। আর সেই আবেগের আতিশয্যে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। জোরে আঁকড়ে ধরল মৌটুসিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল,
: উহ আল্লাহ, পড়ে গেলাম
: তোমাকে আগেও বলেছি অত উত্তেজনা ভালো না, আবেগও ভালো না। জানো ভাল কথা। ওটা তোমার দেশ, তুমি জানবে সেটাই স্বাভাবিক।
: তাহলে তুমি যে বললে, আমি কিছু জানি না। কক্সবাজারে সমুদ্র আছে।
: সমুদ্র আছে ওটুকু জানো। ওর বেশি কিছু জানো না। আমিও যে খুব জানি তা না। তবু যেটুকু জানি তোমায় বলছি। কক্সবাজার জায়গাটা বিচের জন্য বিখ্যাত। বিচ বোঝ তো? ওটা হচ্ছে সমুদ্রের পাড়। যাকে ভালো বাংলায় বলে সৈকত। জায়গাটা চিটাগাং শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওটা বিশ্বের বৃহত্তম সিবিচ। বিষবাকলি নদী আর বঙ্গোপসাগরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। বিচের মোট আয়তন ১২৫ কিলোমিটার। ভাবতে পারছ কত দীর্ঘ ওটা। ওই বিচ বালুময় আর সামান্য ঢালু আকৃতির। দেখতে যে কী মনোরম! ছুটি কাটাতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা ওখানে যায়। ওহ তুমি তো আবার পর্যটক বোঝ না। কি করে যে বোঝাই। আচ্ছা ধরে নাও বেড়াতে আসে, ওটাই পর্যটন। ও বিচ শার্কমুক্ত। আর পানি গোসল করার উপযোগী।
: কিন্তু আমি শুনেছি সমুদ্রের পানি লোনা। ওই পানি শুকিয়ে নাকি লবণ বানায়।
: লোনা তো অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ গোসল করে না। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ আসে সূর্য¯œান করার জন্য। সূর্য¯œান বোঝতো ? অবশ্য ওটা তোমার বোঝার কথা না। ওটা হচ্ছে সূর্যের আলোয় গোসল। বিদেশিরা বিচে শুয়ে শুয়ে সূর্যের আলোয় চামড়া পোড়ায়। ওতেই ওদের আনন্দ। এই ব্যাপার অবশ্য আমি থাইল্যান্ডের পাতাইয়াতেও দেখেছি। অসংখ্য মানুষ তোয়ালে পরে বালির ওপর শুয়ে আছে। সেখানে অবশ্য ব্যবস্থা অনেক উন্নত। গোসলের পর নোনাপানি ধুয়ে ফেলার জন্য মিঠে পানির অনেক বাথরুম আছে। কক্সবাজার সমুদ্রে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আর একেবারে মুক্ত হাওয়া। বড় বড় ঢেউ এসে বিচে আছড়ে পড়ে। জোয়ারের সময় পানি বাঁধের ওপর পর্যন্ত উঠে যায়। আবার ভাটায় সে পানি নেমে যায়। কী যে সুন্দর না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ঢাকা আর চিটাগাং থেকে বাস ট্রেন লঞ্চ বিমান সবকিছুতেই যাওয়া যায়।
মৌটুসি থামে। নিউটন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। এত সুন্দর জায়গা আছে তার দেশে আর সে কিছুই দেখল না। মৌটুসি থামতেই ও বলে,
: থামলে কেন বল। আমার শুনতে খুব ভাল লাগছে।
: এই প্রথম কোন জায়গা সম্পর্কে তোমার এতটা উৎসাহ দেখছি। শোন কক্সবাজারের নাম হয়েছে রে, কক্সের নামানুসারে। ১৭ সেঞ্চুরিতে আরাকানরা বার্মা দখল করার পর যিনি বহু বার্মিজ মানুষকে এখানে পুনর্বাসিত করেন। কক্সবাজারের সব জায়গা সুন্দর হলেও বিশেষ আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে হিমছড়ি, সোনাদিয়া দ্বীপ ও রামু। হিমছড়ি সাউথ বিচ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। এখানে আছে ব্রকেন হিল ও ঝরনা। আর আছে ক্রিস্টমাস ট্রি। রামু কক্সবাজার চট্টগ্রাম মেইন রোডে, কক্সবাজার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। ওটা বৌদ্ধদের গ্রাম। অনেক বৌদ্ধ মন্দির আছে ওখানে। আর আছে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি যা সোনা ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য মূল্যবান পাথরে নির্মিত। বাকলি নদীর পাশে টাইগার ক্যানেল। কক্সবাজারের ৮০ কিলোমিটার সাউথে টেকনাফ অবস্থিত। সে আর এক দর্শনীয় স্থান। নাফ নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গার বড় আকর্ষণ সাম্পানে ভ্রমণ করা। আর সেন্ট মার্টিনস হচ্ছে দেশের একমাত্র কোরালদ্বীপ। যার নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ গভর্নর সেন্ট মার্টিনের নামে। স্থানীয় লোকের ভাষায় এ জায়গার নাম ‘নারকেল জিঞ্জিরা।’ এ দ্বীপের আয়তন ৫ স্কয়ার কিলোমিটার। এখানে প্রচুর নারকেল গাছ রয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির সেল ও মাদার অব পার্ল কোনস সেল এখানে পাওয়া যায়। আর ছেঁড়া দ্বীপে মসৃণ পানির ২০ ফিট নিচে জীবন্ত কোরাল পাওয়া যায়।
: বলছ কি তুমি! আবারও চিৎকার করে ওঠে নিউটন,
: ঠিকই বলছি। যাক আর কথা বলার সময় নেই। আমরা দীঘায় এসে গেছি। এবার নামব। সাবধান। গাছপালার ডাল টাল দেখলে আমাকে বলবে আর নিজের মাথা বাঁচাবে।
ওরা একটা বাঁধানো জায়গা দেখে নিচে নেমে আসে। মৌটুসি দ্রুত তার ডানা লুকিয়ে ফেলে। তারপর নিউটনের হাত ধরে এগোতে থাকে। বিচে প্রচুর মানুষ। কেউ ঘুরছে, কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ ডলফিনের খেলা দেখছে। ওরা টিকেট কেটে ডলফিনের খেলা দেখতে ঢোকে। নিউটন অবাক হয়ে দেখে মাছের মত এক ধরনের জিনিস পানি থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে উঠছে, নাচছে, বল খেলছে। একসাথে নিয়ম করে চারটা একসাথে উঠছে। এক অ™ু¢ত ব্যাপার। ও দেখে, ওর চোখের পলক পড়েনা। মৌটুসি সেদিকে তাকিয়ে হাসে। বলে,
: খুব অবাক হচ্ছ তাই না? অবাক হবার কিছু নেই। যে কোন প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিলে সে সব কিছু শিখে নিতে পারে। দেখ না কুকুর কেমন বাড়ি পাহারা দেয়, মোরগ কেমন লড়াই করে, বাদর কেমন খেলা দেখায়, পাখি কেমন কথা বলে। শুধু কি তাই, কুমির ভল্লুক হাতি বাঘ সাপ সবাই খেলা দেখাতে পারে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওই যে বললাম ট্রেনিং। অনেক সময় দেখা যায় যাদের হাত নেই তারা পা দিয়ে লেখে, সবজি কাটে। কিভাবে বলত? প্রশিক্ষণ। আর সাথে থাকতে হয় ধৈর্য, যে দেবে আর যে নেবে দুজনেরই। মনে রাখবে ধৈর্য আর পরিশ্রম সব উন্নতির চাবিকাঠি।
নিউটন হাসে। মৌটুসি এমন ভাবে কথা বলছে যেন ও ওর মাস্টার। অথচ বয়স ওর থেকে বড়জোর দু-এক বছর বেশি হবে।
: কী ভাবছ?
: ভাবছি তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি আমার মাস্টার। আমার থেকে কত্ত বড়।
: দেখ বড় ছোট বলে কথা না। কথা হচ্ছে ভাল কথা বলছি কিনা। এই ধর তোমার কাছ থেকেও তো আমি কত কিছু শিখলাম। এই যে একটু আগে তোমাকে আমি টাকা দিতে চাইলাম। তুমি নিতে অস্বীকার করলে। বললে, অন্যের জিনিস নিতে নেই। নিজে পরিশ্রম না করে যা পাওয়া যায় সেটা রোজগার নয়। এটাও তো একটা বড় শেখার বিষয়। আমি তোমার কাছ থেকে শিখলাম। জানো এই কয়দিনে আমি তোমার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু শিখেছি।
ততক্ষণে ডলফিনের খেলা শেষ হয়েছে। ওরা বিচটা ঘুরে ঘুরে দেখে। প্রচুর বিদেশি বিচে ঘুরছে। কী চমৎকার তাদের পোশাক! ওদের কাছে নিজের পোশাকটা মলিন মনে হয় নিউটনের। ভাবামাত্র ওর পোশাক বদলে যায়। কী করে যে মৌটুসি এভাবে মনের কথা বোঝে! ও কিছু বলতে যায়। মৌটুসি বলে,
: কিছু বলো না। এ পোশাক তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে না। তোমার চারপাশে যারা আছে তারা এই পোশাকটা দেখছে। কিন্তু পোশাকটা আসলে তোমার শরীরে নেই। তোমার শরীরে সেই আগের পোশাকই আছে।
: কিন্তু।
: কোন কিন্তু নেই। দেখে যাও। যতটুকু দেখবে ততটুকুই লাভ। দেখায় কোন ফাঁকি দিতে নেই। কথাটা মনে রাখবে। ফাঁকি দিলে পরে আফসোস করে বলবে, কেন ভাল করে দেখলাম না। তখন কিন্তু হাজার খুঁজেও এ জায়গাটা পাবে না।
ওরা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মৌটুসি বলে,
: চটপটি খাবে, নাকি আইসক্রিম নাকি দুটোই?
: কোনটাই খাব না।
: কেন পয়সার জন্য? অত ভেবে না তো। একসময় রোজগার করে ডবল খাইয়ে দিও। এই নাও।
ওরা আইসক্রিম খায়। তারপর চটপটি। নিউটনের হাতের খাবার শেষ হবার আগেই মৌটুসি বলে,
: শোন আইসক্রিমের ক্যান, চটপটির ঠোঙা বিচে ফেলনা যেন। ওই যে দেখ একটু পর পর বিন আছে, ওখানে ফেল। তোমাদের অতবড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার কেন অতটা জনপ্রিয় নয় বলত? কারণ তোমরা বিচটা পরিষ্কার রাখতে পারোনি। তোমাদের জনগণ সচেতন না। তারা কলা খাচ্ছে, খোসা ছুড়ে ফেলছে, বাদাম খাচ্ছে কাগজ ছুড়ে ফেলছে, পানি খাচ্ছে বোতল ছুড়ে ফেলছে। ময়লায় ময়লায় বিচ সয়লাব। শুধু কি তাই, যা পাচ্ছে তাই পানিতে ছুড়ছে। আর তোমাদের সরকারেরও বিচ বা পানি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই। তাই তো অত বড় সমুদ্র সৈকত নিয়েও তোমরা কিছুই করতে পারছ না। কিন্তু যাও থাইল্যান্ডে। ওই অতটুকু একটা কৃত্রিম সৈকত কত ঝকঝকে রেখেছে তারা। যাও ভিয়েতনামের হে লং বেতে। একই অবস্থা। শুধু পারলে না তোমরা। না কক্সবাজার না কুয়াকাটা না বান্দরবান না রাঙ্গামাটি।
: কেন এ রকম হয় বলত?
: বুঝলে না, মানুষ তো প্রথম শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। পরিবারই শেখায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবে না। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলবে। ময়লা ছড়িয়ে ফেলবে না। কোন ঠোঙা বা পলিথিনে ভরে মুখ বেঁধে ফেলবে। তারপর ধরো ফুল পাতা ছিঁড়বে না। সকাল বিকেলে নিয়ম করে দাঁত মাজবে, নখ কাটবে, সর্দি ফেলবে না যেখানে সেখানে। কিন্তু তোমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারে এসব শেখানো হয় না। অনেক বড়লোকের পরিবারেও হয় না। আমি দেখেছি।
: কিন্তু আমরা গরিব হলেও আমার মা আব্বা এসব আমাকে শিখিয়েছেন। আরও অনেক কিছু তারা শিখিয়েছেন। যেমন গুরুজনদের সম্মান করবে, ছোটদের ¯েœহ করবে, অসুস্থকে সেবা করবে, দুস্থের পাশে দাঁড়াবে, মিথ্যা কথা বলবে না, সকালে ঘুম থেকে উঠবে। আরও কত কি!
: এ জন্যই তো তোমাকে আমার এত ভাল লাগে। শুনে শুনে তোমার আব্বা-মাকেও আমি ভালবেসে ফেলেছি। যাব একদিন তাদের দেখতে।
: কিন্তু কিভাবে যাবে? আমার আব্বা মা বলেন জিন পরী দৈত্য দানো কিছুই নেই। দেখ এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত। আমি জানি, আমার আব্বা-মা যা বলেন সবই সত্যি। কিন্তু তুমি আছ আমি দেখছি।
: আরে না, তোমার আব্বা মায়ের এই কথাটাও সত্যি। আমি আছি, আবার আমি নেই। ধরে নাও না যা সব ভাল, সুন্দর তাই পরী আর যা মন্দ খারাপ তাই দৈত্যদানো। যাক চলো, আমার মনে হয় এখানে আর দেখার কিছু নেই। এবার আমরা যেতে পারি।
: হ্যাঁ শোন একটা কথা। আমি আর কোথাও যেতে চাই না। আব্বা মার জন্য আমার ভীষণ মন কেমন করছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরতে চাই। তোমার দেশে না গেলে হয় না?
: আরে আমার দেশে যেতে সময় লাগবে না। এক লহমায় চলে যাব। কিন্তু তুমি কি শান্তিনিকেতন দেখতে চাও না, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে চাও না?
: না অন্য সময়। তুমিতো বলেছ আমি নাকি আমার আব্বা মাকে নিয়ে আসব এদেশে। তখন অনেক সময় ধরে সবকিছু দেখব। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন কি অত অল্প সময়ে দেখা যায়!
: তা তুমি ঠিকই বলেছ। অবশ্য তোমাদের দেশেও কবিগুরুর অনেক কিছু আছে। জীবনের অনেকটা সময় তো তিনি শিলাইদহে ছিলেন। পদ্মায় বোটে বোটে ঘুরেছেন। তোমাদের শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে কবিগুরুর কুঠিবাড়ি রয়েছে। রয়েছে তাঁর অনেক স্মৃতি। সেই উপেনের তিনবিঘা জমিও আছে শিলাইদহে।
: উপেন কে?
: ওহ তাইতো, তুমিতো আবার তিনবিঘা জমি কবিতা পড়োনি। ওটা রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত কবিতা। পড়ে নিও পারলে। তাহলে বুঝবে উপেন কে। আর কবিতায় যে আমগাছের কথা আছে সেটা ওখানে আছে।
: কী কা- পরীরা কবিতাও পড়ে নাকি!
: কেন পড়বে না কেন। পরীদের কি পড়তে নিষেধ আছে? আমিতো হিমু সমগ্রও পড়েছি। জানো আমার খুব ইচ্ছে করে হিমুর মত হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু আমিতো মেয়ে।
: কিন্তু তুমিতো ইচ্ছে করলেই ছেলে হতে পার।
: তা পারি, কিন্তু ইচ্ছে করে না। যাকগে তাহলে চল আমরা রওনা দিই। নাও ডানায় ওঠ। এবার অনেকটা দূর যেতে হবে।
মৌটুসি ডানা মেলে উড়তে থাকে। ওড়ে আর কথা বলে, মনে রেখ আমরা এখন ইন্ডিয়া ছাড়ছি। এদেশের প্রেসিডেন্টের নাম প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে এদেশ স্বাধীন হয়। এদের মুদ্রার নাম রুপি। এই দেশের সাউথে ভারত মহাসাগর, সাউথ ওয়েস্ট আর সাউথ ইস্টে বঙ্গোপসাগর। পাকিস্তান আর চীনের সাথে এদের বর্ডার আছে। থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ার সাথেও বর্ডার আছে। প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর মালদ্বীপ। এদেশের রাজধানী নয়াদিল্লি। সবচেয়ে বড় শহর মুম্বাই। অফিসিয়াল ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি। আর আঞ্চলিক ভাষা অসমিয়া, বাংলা, মারাঠি, মনিপুরি, তেলেগু, তামিল থেকে উর্দু পর্যন্ত। যাক আমরা এবার উত্তর প্রদেশ হয়ে বামে ঘুরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে তুরস্ক ইতালি হয়ে আমেরিকা পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে আমার দেশ খুব দূরে না। সেখানে গেলেই আমাদের যাত্রা শেষ।
: শেষ মানে কি বলছ তুমি, আমি ফিরব না? আমি কিন্তু এখনই লাফ দেব।
: আরে পাগল ফিরব তো অবশ্যই। ওই পর্যন্ত যাব সেটাই বললাম। ভয় পেও না, আমি তোমাকে ঠিকঠাক ফিরিয়ে আনব।

সাত.
মৌটুসি উড়ছে আর অনর্গল কথা বলে চলেছে। এ পরীটার সব ভাল শুধু বেশি কথা বলা ছাড়া। এত কথা মানুষ বলতে পারে! এ তো আবার মানুষ নয়, পরী। আব্বা একদিন মাকে বলেছিলেন, ওনার সাথে একজন কাজ করে তিনি বেশি বকেন বলে সবাই তাকে বকাউল্লাহ বলে। মৌটুসি আর এক বকাউল্লাহ। নিউটন ভাবতে থাকে, উল্লাহ সাধারণত ছেলেদের নামের সাথে থাকে। মেয়েদের কি কখনও উল্লাহ বলা যায়? তাহলে কি বলা যায়? বকা বেগম, বকা খাতুন, বকা খানম নাকি বকা আখতার? না একটাও মানাচ্ছে না। বরং ওকে ‘বকা পরী’ বললেই বেশি মানাবে। বলবে নাকি ওকে কথাটা। না থাক ও যদি রেগে যায়।
মৌটুসি কথা বলছে আর নিউটন ঢুলছে। ওর কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ঘুমালে যদি পড়ে যায় এই ভয়ে ঘুমাতেও পারছে না।
মৌটুসি বলে চলে,
: বুঝলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল নেপালটা তোমাকে দেখাব। নেপাল খুব সুন্দর দেশ, পাহাড়ি জায়গা। হিমালয় আছে। অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। সেদিনের ভূমিকম্পে ‘ভক্তপুর’ নামের ঐতিহাসিক জায়গাটা মাটির সাথে মিশে গেছে। খুব খারাপ লাগে ভাবলে জানো। গৌতম বুদ্ধের নাম জানোতো? বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। উনি নেপালের গ্রাম কপিলাবস্তুতে জন্মেছিলেন। নেপাল স্বাধীন দেশ। নাম ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল। জনসংখ্যা ২৭ মিলিয়ন। এটা আয়তনের দিকে থেকে বিশে^ ৯৩তম বড় আর ৪১তম জনবহুল দেশ। হিমালয়ের একটা শাখা কিন্তু পাকিস্তানেও আছে। ওটার নাম কারাকোরাম। এই দেখ বলতে বলতে আমরা পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছি। এই যে নিচে তাকিয়ে দেখ এটা ইসলামাবাদ, পাকিস্তানের রাজধানী। বামে তাকাও। প্রচুর ফুল দেখতে পাচ্ছ তো? ওটা শালিমার গার্ডেন। তুমি কি নিচে নেমে ঘুরে দেখতে চাও?
: না না কিছুতেই না।
: অত উত্তেজিত হলে কেন ? কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
: না আমার মন খারাপ।
নিউটন ফুঁপিয়ে কাঁদে।
: আরে পাগল কেঁদো না, কেঁদো না বলছি। তোমার কান্না দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। শোন আমি সবই জানি। থাক তোমাকে নামতে হবে না। তবে জানতে তো কোন দোষ নেই। কোন দেশকে পছন্দ না করলেও সে দেশ সম্পর্কে জানা ভাল তাই না? শোন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি। ভাষা ইংরেজি ও উর্দু। আঞ্চলিক ভাষা পাঞ্জাবি পশতু সিন্ধিসহ অনেকগুলো। জনসংখ্যা ১৮০ মিলিয়ন। এটা পৃথিবীর ষষ্ঠ জনবহুল দেশ। আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ৩৬তম বড় দেশ। এ দেশে আরব সাগর আর গালফ অব ওমান নামে দুটো সাগর আছে। কাছাকাছি দেশ ইন্ডিয়া আফগানিস্তান ইরান ও চায়না। অফিসিয়াল নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।
: থাক থাক মৌটুসি পরী ওদের কথা আর শুনতে চাই না। তুমি উড়ে চল তাড়াতাড়ি।
: হ্যাঁ তাই করছি। খুব দ্রুত উড়ছি আমি। চিন্তা করো না, দু এক মিনিটের মধ্যেই আমরা আফগানিস্তানের সীমানার মধ্যে এসে যাবো। এই দেখ বলতে বলতে এসে পড়েছি। তাকিয়ে দেখ নিচে আফগানিস্তান। এ দেশ সাউথ আর সেন্ট্রাল এশিয়ায় অবস্থিত। জনসংখ্যা ৩২ মিলিয়ন। বিশে^র ৪২তম জনবহুল দেশ। এই দেশের চারদিকে আছে পাকিস্তান, ইরান, তুর্কেমিনিস্তান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও চীন। অফিসিয়াল ভাষা পাসতো ও দারি। এরিয়া ৬৫২ কিলোমিটার। এদেশে পানি নেই বললেই চলে। আফগানিস্তান নামটা পার্সিয়ান। এখানে প্রাচীন ইরানিয়ানসহ বিভিন্ন সিভিলাইজেশনের লোক বাস করেছে। বাস করেছে খিলজি কাবুলশাহী। মোগল ডায়নেস্টিও এখানে রাজত্ব করেছে। সবশেষে ছিল হোতাক ও দুররানী ডায়নেস্টি। রাজধানী কাবুল। মুদ্রা আফগানি। আর শোন আফগানিস্তানেও কিন্তু হিমালয়ের একটা অংশ আছে তার নাম হিন্দুকুশ।
: এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
: ইরান। ইরানের পর তুরস্ক। তারপর ওই যে বললাম ইতালি আমেরিকা হয়ে আমার দেশে। ফেরার সময় সেই একই পথ। অবশ্য তুমি যদি চাও পথ বদলাতে পারি।
: সে পরে দেখা যাবে। আগে চলত।
: হ্যাঁ এইত আবার উড়তে শুরু করলাম। এক্ষুনি ঢুকে যাব ইরানে। তুমি জানত মুহূর্তের মাঝেই আমি চলে যেতে পারি হাজার মাইল। ও একটা কথা তোমায় বলি, তুমি যে আমার ডানায় চড়ে ঘুরছ কেমন লাগছে তোমার বললে নাতো?
: খুব ভালো লাগছে জানো, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কত কিছু দেখছি আমি, কত কিছু জানছি। এত কিছু কোনদিন দেখতে পাবো ভাবিনি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি খুব ভাগ্যবান তাইতো দীঘিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলরাক্ষসের খপ্পরে পড়লাম আর তুমি আমাকে রক্ষা করলে। যেসব জায়গা তুমি দেখাচ্ছ, যেসব দেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছ এসব দেশের নামই শুনিনি কখনও। যদি লেখাপড়া জানতাম তাহলে হয়ত কিছু কিছু জানতে পারতাম। কিন্তু আমিতো কখনই স্কুলে যাইনি আর যাওয়া হবেও না। আমরা বড্ড গরিব।
: ওভাবে বোলো না। মনের দিক দিয়ে যে গরিব সেই প্রকৃত গরিব। তুমি বড় মনের ছেলে আমি বুঝতে পারছি। আর শোন তোমায় একটা কথা বলি। আগেও বলেছি বোধহয়। স্কুল কলেজে গিয়েই যে সব কিছু জানতে হবে, বা জানা যায় তা কিন্তু না। তুমি কি আরজ আলি মাতব্বরের নাম শুনেছ ?
: না, উনি কে ? মাতব্বররা তো সাধারণত গ্রামে থাকে। গ্রামের নেতা গোছের লোক হয়। সবাই তাকে মান্য করে আবার ভয়ও পায়। ভয়ে মান্য করে আর কি।
: তুমি বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। তবে এই মাতব্বর সে মাতব্বর না। উনি একজন লেখক। উনি নিভৃত পল্লীতে বসে যা লিখে গেছেন তা অন্য কেউ লিখতে পারেনি। উনি স্কুল কলেজে যাননি। তোমাদের কবি নজরুলও তো তাই। তাই না? উনি তোমাদের রণসঙ্গীত লিখেছেন, ‘চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’। আহ কি গান। শুনলেই যেন রক্ত গরম হয়ে যায়। এই দেখ কথা বলতে বলতে ইরানে ঢুকে পড়েছি। আমরা এখন ইরানের উপর দিয়ে যাচ্ছি। মন দিয়ে শোন, তোমাকে ইরান সম্পর্কে কিছু কথা বলি। একটা দেশে আসবে আর সে দেশ সম্পর্কে জানবে না সেটা ঠিক না। ইরান শব্দটা পার্সিয়ান। ইরানকে পার্সিয়াও বলা হয়। অফিসিয়াল নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’। দেশটা পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত। আশপাশের দেশ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তাজাকিস্তান, রাশিয়া, তুর্কেমেনিস্তান। পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। পশ্চিমে তুরস্ক। ইরানের রাজধানী তেহরান। ভাষা পার্সিয়ান। এ ছাড়া আজারবাইজানি আর আরবি ভাষাও প্রচলিত। ধর্ম শিয়া ইসলাম। এ দেশের সুপ্রিম লিডার আলী খোমেনি, প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি। জনসংখ্যা ৭৮ মিলিয়ন। মুদ্রা রিয়াল।
: আচ্ছা মৌটুসি এসব জেনে আমি কি করব? কি লাভ আমার? আর কতক্ষণই বা মনে থাকবে?
: সব কিছু কি লাভের জন্য মানুষ জানে? কিছু কথা তোমাকে আমি বলছি আজ। আমি তোমাকে যা যা বলছি কোন দিনই তুমি তা ভুলবে না কেমন। শোন আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি। ইরান হল কবি-সাহিত্যিকের দেশ। পৃথিবীর বিখ্যাত কবিরা এখানে জন্মেছিলেন। তাঁরা সব অমর হয়ে আছেন। যেমন ধরো ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, রুমি, সাদি। এরা যে কে কার থেকে বড় বলা কঠিন। কবি ফেরদৌসির কথা শোন। উনি ১১ শতাব্দীর কবি। তুমি ‘শাহনামার’ নাম শুনেছ? শোননি তো? না শোনারই কথা। যারা অনেক অনেক ডিগ্রি নিয়েছে তারা অনেকেই ফেরদৌসির নাম জানে না। শাহনামাকে বলা হয় পার্সিয়ান বুক অব কিংস। এটা একটা কবিতা। আর এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম কবিতা। ফেরদৌসি ইরানের খোরাশান প্রদেশের তুস নগরীতে এক ল্যান্ড ওনারের পরিবারে জন্মগ্র্রহণ করেন। তিনি তুস নগরীতে তার নিজের বাগানে সমাধিস্থ আছেন।
ততক্ষণে নিউটন একটু নড়ে চড়ে বসেছে। কবি-সাহিত্যিক আর বড় মানুষের গল্প শুনতে তার খুব ভাল লাগে। তারা কি করে অত বড় হল তার জানতে ইচ্ছে করে। তারা কি করে মানুষের মনের কথা জেনে যায় নিউটন বুঝতে পারেনা। ওই যে নজরুল লিখেছে, আমি হব সকাল বেলার পাখি। তার ওতো প্রতিদিন সকালবেলার পাখি হতে ইচ্ছে করে। এ কথা নজরুল বুঝলেন কি করে?
: কি হল শুনছ তো?
: শুনছি। তুমি বল।
আর এক বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম। ফেরদৌসির সময়কার। তিনি শুধু কবি নন, গাণিতিক জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, ভূগোলবিদ, শিক্ষক। কি নন তিনি? কিন্তু তাঁর কবি খ্যাতি যতটা হয়েছে অন্যগুলো তা হয়নি। এটা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক। তিনি কিন্তু সব কিছুতেই সেরা ছিলেন। তিনি প্রচুর গানও লিখেছেন। জন্ম ইরানের নিশিপুরে। সমরকন্দে লেখাপড়া করেন। এরপর বুখারা চলে যান। সেখানে এলজাবরার উপর একটা বিখ্যাত বই লেখেন। নিশাপুরে খাইয়াম গার্ডেনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এই সমাধি ইরানিয়ান আর্কিটেকচারের ক্ষেত্রে এক মাস্টারপিস। এই সমাধি দেখতে প্রতি বছর বহু লোক আসে। তার ‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’ বিখ্যাত ইংরেজ কবিরা অনুবাদ করেছেন। ফলে সারা পৃথিবীব্যাপী তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
: তুমি কি ওর কবিতা জানো?
: কেন শুনতে ইচ্ছে করছে? বাহ! দুই এক লাইন বোধ হয় বলতে পারব। মনে আছে,
এইখানে এই তরুতলে
তোমার আমার কৌতূহলে
এখানে যে ক’টি দিন কাটিয়ে দিয়ে যাব
সঙ্গে থাকবে মধুর পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আর একখানি ছন্দমধুর কাব্য হতে নিয়ে।
ভাল লাগল তোমার?
: খুব ভাল। দেখ উনিও কিন্তু লেখাপড়া করার কথা বলেছেন। কাব্য মানে বই তো? আর তুমি বললে পড়ালেখার দরকার নেই। উনি খাবার চেয়েছেন অল্প, কিন্তু বই চেয়েছেন।
: তুমি কিন্তু আবারও আমাকে ভুল বুঝলে। আমি কখন বললাম বই পড়ার দরকার নেই? আমি বলেছি স্কুল কলেজে না পড়লেও জ্ঞানী হওয়া যায়, শিক্ষিত হওয়া যায়। যাকগে এবার বলব শেখ সাদির কথা। শোন শেখ সাদি আর একজন বিখ্যাত কবি। ইরানের সিরাজ নগরীতে তাঁর জন্ম। শিশুকালে তাঁর বাবা মারা যান। কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি বড় হন।
: হ্যাঁ তাইতো। বাবা না থাকলে দেখবে কে। আমি তো আব্বা মা না থাকার কথা ভাবতেও পারি না।
: তাহলেই বোঝ। এই দুনিয়ায় অসংখ্য শিশু আছে যাদের জন্ম দিতে গিয়ে তাদের মা মারা যায়। অসংখ্য শিশু আছে যারা শৈশবেই বাবা মা হারায়। তারা কত কষ্টে বড় হয় ভাব। হয়ত আর্থিক অনটন কারো থাকে, কারো থাকে না। কিন্তু বাবা-মায়ের ¯েœহ মমতা ভালবাসা আদর তারা পায় না। তাদের সবার প্রতিই আমাদের ভালবাসা থাকা উচিত, দরদ থাকা উচিত কি বল ?
: অবশ্যই ওদের সবার প্রতিই আমার ভালোবাসা আছে, দরদ আছে।
: এই জন্যইতো তুমি আমার বন্ধু। কত ভাল ছেলে তুমি। আর একটা কথাও মনে রাখবে, শুধু মাতৃ-পিতৃহারা শিশুই নয়, প্রতিবন্ধী আর অসুস্থ শিশুদেরও আমাদের ভালবাসা উচিত। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। ঠিক না?
: ঠিকই বলেছ। তাছাড়া পশু-পাখিদের প্রতিও আমাদের দরদি আর সহানুভূতিশীল হতে হবে। পশু-পাখি দেখলেই খাঁচায় বন্দি করলাম বা মেরে দিলাম এটা কিন্তু ঠিক না।
: ঠিক বলেছ। আমি না একদিন এক বাসায় একটা শালিখকে ঘরবন্দি করে মেরে ফেলতে দেখেছিলাম। ওরা নাকি ওটা ভেজে খাবে। আমার খুব দুঃখ হয়েছিল।
: কেউ যদি খেতে চায় খাবে, কিন্তু খাওয়ার আগে এভাবে ঘর বন্ধ করে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা অন্যায় না তুমি বল? মৌটুসির গলা ধরে আসে।
: খুব অন্যায়। যাক ওসব ভেবে আর মন খারাপ করো না। জানো মৌটুসি আমি ভেবে অবাক হচ্ছি তুমি কেমন বড়দের মত কথা বলছ। এতসব তুমি জানো কি করে এটাও আমি বুঝি না।
মৌটুসি হাসে। বলে,
: থাক অত বোঝার দরকার নেই। শেখ সাদির কথা বলছিলাম, সেটাই শোন। উনি ১৩ শতকের কবি। জ্ঞানান্বেষণে এক সময় তিনি নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর এক সময় তিনি সুফিদের দলে নাম লেখান। সুফিরা তখন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ছিল। এক সময় ক্রুসেডাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আর সেখানে দাস হিসেবে তাকে ৭ বছর কাটাতে হয়। তার কবিতার কথা খুব গভীর আর কবিতায় তিনি অনেক সামাজিক আর নৈতিক বিষয় যোগ করেছেন। তার কবিতার বই পশ্চিমা দুনিয়ায় খুবই জনপ্রিয়। তার দুটি বিখ্যাত বই হচ্ছে গুলিস্তান ও বুস্তান (গুলিস্তা ও বুস্তা)। গুলিস্তার একটা অংশের নাম ‘বনিআাদম’, যা খুবই জনপ্রিয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের জনগণের সম্মানে দেয়া রিসেপশনের ভাষণে সাদির কবিতার দু’ লাইন আবৃত্তি করেন,
: মার্কিন কি। আর বারাক ওবামা কে?
: সেটাও তো কথা। তোমার তো বারাক ওবামার নাম জানার কথা না। উনি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট, উনি ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। উনি হাওয়াইয়ের হনলুলুতে জন্মগ্রহণ করেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হারভার্ড ল স্কুলের গ্র্যাজুয়েট উনি। হারভার্ড ল রিভিউএর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিনেট মেম্বারও ছিলেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন রিপাবলিকান পার্টির মেককেইনকে পরাজিত করে। ওই বছরই উনি নোবেল প্রাইজ পান। ২০১২ সালে পুনঃ নির্বাচিত হন রিপাবলিকান পার্টির মিট রমনিকে পরাজিত করে। দেখ তুমি আবার জিজ্ঞাসা করো না রিপাবরিকান পার্টি কি? ওসবে তোমার দরকার নেই।
নিউটন হাসে। বলে,
: কিন্তু ওনার বাবা মা?
: ওনার মা স্টানলি হ্যান ডুনহাম আর বাবা বারাক ওবামা স্যার, স্ত্রী মিশেল ওবামা আর দুই মেয়ে সাসা ও মালিয়া ওবামা। উনি একটা ইন্টারভিউতে কি বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন ওনার পরিবার হচ্ছে ‘মিনি ইউনাইটেড ন্যাশন’। বোঝ তাহলে পরিবারকে উনি কত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন! ইউনাউটেড ন্যাশন হচ্ছে জাতিসংঘ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
: তাতো ঠিকই, পরিবারের মত গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু আছে নাকি। পরিবার মানে আব্বা-মা ভাইবোন তাইতো। আমার অবশ্য ভাই বোন কিছুই নেই। একটা ভাই বোন থাকলে কি যে ভাল হতো! মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে আমার। কিন্তু শোন আমার আব্বা মা সবার উপরে আমার কাছে।
: ঠিকই বলেছ, ওই যে তোমরা কি যেন বল, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। ওটা একদম সত্যি।
: বেহেশত টেহেশত আমি জানি না। আমি জানি আমার আব্বা মা-ই আমার কাছে সব। তুমি জানো আমার মা না খেয়ে আমার জন্য খাবার রাখে। আমি ঠিকই বুঝতে পারি। অসুখ হলে রাত জেগে আমার সেবা করে। আর আমার আব্বা আমার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রোজগার করে।
: তুমি ভাল ছেলে তাই ওদের ভালবাসা, ওদের কষ্ট বোঝ। যাক অন্যান্য ইরানি কবিদের কথা শুনবে না?
: শুনব। তুমি বলো।
: আচ্ছা এবার বলব কবি রুমির কথা। ওনার পুরো নাম জালাল উদ্দিন রুমি। উনি ১৩ শতকের কবি। সুফিবাদ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সমস্ত এশিয়ার মানুষ তার লেখা দ্বারা প্রভাবিত। আমেরিকান মুসলমানদের কাছে তার বই খুবই জনপ্রিয়। তাকে ‘বেস্ট পপুলার আর বেস্ট সেলিং’ পোয়েট বলা হয়। অর্থাৎ উনি যেমন জনপ্রিয় তেমনই ওনার বই বিক্রি হয়। ওনার বেশির ভাগ কবিতা ফারসি ভাষায় লেখা। তবে উনি টার্কিস আরবি ও গ্রিক ভাষাতেও কিছু কিছু লিখেছেন। ওনার কবিতার অনুবাদ ফারসি ভাষাভাষী, তুরস্ক, আজারবাইজান ইউএই ও সাউথ এশিয়ার জনগণ সাগ্রহে পড়ে। তাঁর সাহিত্য শুধু ফারসি নয়, টার্কিস, পাঞ্জাবি, হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘মসনবি।’ এ বইতে ২৭০০০ লাইন পার্সিয়ান কবিতা আছে। তার আর একটা বিখ্যাত বই ‘শামস ই তাবরেজি।’ এ বই তাঁর শিক্ষক শামসের নামানুসারে।
: ওনার বাবা-মা সম্পর্কে বল?
ইরানের খোরাশানের বালখ শহরে ওনার জন্ম গ্রামীণ বাবা মায়ের ঘরে। ওই জায়গাটা এখন আফগানিস্তানে। তবে এটা নিয়ে মতভেদ আছে। দেশ ভেঙে ভেঙে এখন এত ছোট হয়ে যাচ্ছে যে কোনটা আগে কোথায় ছিল বোঝা মুশকিল। কেউ কেউ বলেন সেই জায়গাটা বর্তমান তাজাকিস্তানে।
: কবিদের অনেক কষ্ট হয় তাই না?
: তা লিখতে গেলে কষ্ট তো করতে হয়ই। ভাবতে হয়, মানুষ দেখতে হয়, ঘুরতে হয়, মানুষের মন বুঝতে হয়। এবার তোমাকে বলব কবি হাফিজের কথা। উনি ১৪ শতকের করি। ফারসি ভাষায় লিখতেন। ইরানের প্রতি ঘরে ঘরে তার বই দেখা যায়। ইরানিরা কথায় কথায় প্রবাদ হিসেবে তার কবিতার লাইন আওড়ায়। তার গজল খুবই জনপ্রিয়। ইরানের সঙ্গীত বিশেষ করে লোকগীতি, গান আর আর্টেও হাফিজের কবিতা আর গজলের প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে। তোমাদের বাংলা ভাষাতেও আছে। ওমর খৈয়ামের অনুবাদও আছে। ইরানের সিরাজ নগরে হাফিজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত একটা মার্বেলের তৈরি সমাধি আছে। যা দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য লোক সেখানে যায়।
: শেখ সাদিরও তো সিরাজ নগরীতে জন্ম? ফেরদৌসি আর রুমির খোরাশানে জন্ম তাই না?
: ঠিক তাই। তুমি তো দেখছি দারুণ মেধাবী। লেখাপড়া শিখলে তুমি সেরা হবে। আমার ভীষণ ভাল লাগছে। এবার গিয়েই তুমি স্কুলে ভর্তি হবে।
: কি যে তুমি বলছ পাগলের মত।
: আমি পাগল না, ঠিকই বলছি। তুমি দেখে নিও। আমি বললাম।
: তুমি জ্যোতিষ নাকি।
: আমি শুধু জ্যোতিষ না, অনেক কিছু। আমি ভাল মানুষকে সাহায্য করি, তোমাকেও করব।
: আমি তোমার সাহায্য নেব না।
: তাও করব দেখে নিও। তুমি স্কুলে পড়বে, কলেজে পড়বে, অনেক বড় হবে, মানুষের কাজে লাগবে। যাক আমরা এবার তুরস্কে ঢুকছি।
: তুমি কি এবার তুরস্ক সম্পর্কে বলতে শুরু করবে নাকি? আমার কিন্তু ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
: না না ঘুমানো চলবে না। এই তো আর সামান্য পথ। হ্যাঁ শোন তুরস্ক শব্দটা টার্কিস। এ দেশের অফিসিয়াল নাম রিপাবলিক অব টার্কি। এটা পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত। তবে এ দেশের একটা অংশ ইউরোপের মধ্যে রয়েছে। ৮টা দেশের সাথে এদেশের বর্ডার রয়েছে। বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, ইরান, আজারবাইজান ও সিরিয়া। রাজধানী ইস্তাম্বুল। অফিসিয়াল ভাষা তুর্কিস। প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েব এরদোগান। জনসংখ্যা ৭৭ মিলিয়ন। মুদ্রা টার্কিস লিরা। আর এদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট কে জানো?
: কে?
: মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক। আতাতুর্ক শব্দের অর্থ টার্কিসদের জনক। এদেশের জনগণ তাকে এই নাম দিয়েছে। আর সংসদে পাস করে নিয়েছে যে এ নাম আর কেউ গ্রহণ করতে পারবে না। উনি কিন্তু কামাল পাশা নামেও পরিচিত। কবি নজরুল ইসলাম ওনাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সে কবিতার নাম কামাল পাশা। তাঁর জন্ম ১৮৮১ সালে আর মারা যান ১৯৩৮ সালে ৫৭ বছর বয়সে। তিনি অটোমান রাজত্বকালে সারোনিকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রথম জীবনে কাঠ ব্যবসায়ী পরবর্তীতে একজন মাইনর অফিসার ছিলেন। তিনি ১৯১৯ সালে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি মিলিটারি স্কুলে যান, সেখান থেকে মিলিটারি একাডেমিতে।
এরপর তিনি সামরিক অফিসার হন। ১৯২১ সালে তিনি প্রভিশনাল সরকার গঠন করেন। ১৯২৩ সালে অটোম্যানরা বিদায় হলে তিনি তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। এরপর তিনি তুরস্কের পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। তাঁর উদ্যোগে অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক আর বাধ্যতামূলক করা হয়। নারীদের সামাজিক রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়। জনগণের উপর থেকে করের বোঝা কমানো হয়। তখন শধু তার নেতৃত্বে তুরস্কে একটাই দল ছিল। তারাই জনগণের জন্য কাজ করেছে। তুরস্কের আঙ্কারা শহরের কেন্দ্রস্থলে মার্বেলের তৈরি তার একটা সমাধি আছে। ওই সমাধিতে যদি ঢুকতে হয় তাহলে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য হ্যাট বা টুপি খুলে ঢুকতে হয়।
: ঠিকই আছে, যে বড় তাকে তো সম্মান দিতেই হবে। আমার আব্বা এ কথাই বলেন।
: সত্যি তোমার আব্বা তোমাকে অনেক ভাল ভাল কথা শিখিয়েছেন। তিনি একজন মহৎ মানুষ। আমরা এবার ইতালিতে ঢুকব।
: তুমি ইতালিতে ঢোক আর যাই করো আমি কিন্তু চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আমি ঘুমাবো। তুমি তোমার দেশে গিয়ে আমাকে জাগাবে।
: আর একটু, আর একটু গল্প করি। হ্যাঁ তখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার ডানায় বসে উড়তে তোমার কেমন লাগছে। তুমি কিছু একটা বলতে শুরু করেছিলে কিন্তু শেষ করোনি। বলত কেমন লাগছে তোমার?
: এখন অবশ্য খুব ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যদি এখান থেকে পড়ে মরে যাই আমার আব্বা-মা জানতেও পারবে না। ওরা শোকে পাগল হয়ে যাবে। আমি ওদের একমাত্র ছেলে।
নিউটন প্রায় কেঁদে ফেলে।
: আরে পড়বে কেন। আমি আছি না। ঠিক আছে তোমার যখন অত ঘুম পাচ্ছে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। এই নাও এই বেল্টটা দিয়ে আমার সাথে নিজেকে বেঁধে নাও। তাহলে আর কোনো ভয় থাকবে না।
নিউটন বেল্টটা ভাল করে বেঁধে নেয়। তারপর মৌটুসিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। উহ শব্দ করে ওঠে মৌটুসি।
: এই তোমার আঙুলে বড় বড় নখ। নখ কাটো না? আমার দেশে গিয়েই নখ কাটবে। ওই যে তোমরা কি যেন বল, হ্যাঁ ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ’। শোন নিয়মিত নখ আর শরীর পরিষ্কার করবে। খাবার আগে হাত ধোবে, বাথরুম সেরে সাবান দিয়ে হাত ধোবে। মনে থাকবে তো?
ততক্ষণে নিউটন ঘুমিয়ে পড়েছে। ও শুনেছে কিনা কে জানে। মৌটুসি হাসে। কথাগুলো ওকে আবার বলতে হবে।

আট.
মৌটুসি কতক্ষণ উড়েছে জানে না নিউটন। ও তখন গভীর ঘুমে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ও। স্বপ্ন দেখছে ওর মা একটা চমৎকার লাল ডুরে শাড়ি পরেছে আর তার মাথার লম্বা চুলগুলো বেণীতে বাঁধা। বেণীর দু’গোড়ায় টকটকে দুটো জবা ফুল। মা একবাটি বোঝাই রসগোল্লা এনে ওর সামনে ধরে বলছে,
: নে বাবা খা। আজ একটা শুভ দিন, তুই স্কুলে যাবি। তাই মোড়ের দোকান থেকে কিনলাম। বলতে বলতে নিউটনের খাওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেই ওর মুখে রসগোল্লা তুলে দিলেন মা। আহ কি মিষ্টি সে রসগোল্লা। ‘মা আর একটা দাও’ বলার আগেই ঘুম টুটে গেল নিউটনের। আর ঘুম ভাঙার সাথে সাথে চমৎকার একটা সুগন্ধ এসে ঝাপটা দিল ওর নাকে। সবচেয়ে দামি সুগন্ধিও বোধ হয় এত ভাল গন্ধ দেয় না। এ কোন জায়গা ভাবতে ভাবতে ওর মনে পড়ল পরীর ডানায় বসে উড়ে চলছিল ও। এখন মৌটুসি পরী আস্তে আস্তে নামছে। ওর মনে পড়ল জোড়াদীঘিতে জলরাক্ষস ওকে আক্রমণ করেছিল আর ওকে উদ্ধার করে মৌটুসি তার ডানায় তুলে নিয়ে উড়ছিল নিজের দেশের পথে। ওর একটু ভয় ভয় লাগল। আস্তে ডাকল,
: মৌটুসি পরী।
: এতক্ষণে ঘুম ভাঙল তাহলে। আমরা পরীরাজ্যে পৌঁছে গেছি। নামো এবার।
নিউটন নামল আর চারদিকে জ্বলে উঠল হাজার হাজার বাতি। লাল নীল হলুদ সবুজ। আর কী চমৎকার একটা বাজনা বাজতে লাগল। মৌটুসি ওর হাত ধরে এগোল।
: চলো সামনেই আমাদের প্রাসাদ। ওখানে আছেন আমার মা বোন।
ওরা হাঁটছে। গাছের ডাল থেকে পাখিরা কলস্বরে বলছে,
: স্বাগতম পরী রাজকন্যা, স্বাগতম নতুন অতিথি। পরীরাজ্যে তোমার আগমন শুভ হোক।
গাছের ফুলের কুঁড়িগুলো ওদের দেখে ফুটতে থাকে। গাছে গাছে নতুন নতুন পাতা গজাতে থাকে। সবাই একযোগে বলে,
: স্বাগতম নতুন অতিথি, স্বাগতম পরী রাজকন্যা।
বাতাস দোল খেতে থাকে। নিউটনের চোখ মুখে পরশ বুলাতে বুলাতে ওরা বলে,
: স্বাগতম নতুন অতিথি, স্বাগতম আমাদের রাজ্যে। কী নামে ডাকব তোমায়?
ও জবাব দেবার আগেই মৌটুসি বলে, ওর নাম নিউটন। ও আমাদের রাজ অতিথি। সবাই ওকে সম্মান করবে।
মৌটুসির কথা শেষ হবার সাথে সাথে পাখিরা মাথা নোয়ায়, ফুল আর পাতারা মাথা নোয়ায়। নিউটন অবাক হয়ে যায়। সে এক সাধারণ গরিবের ছেলে। তাকে ওরা এত সম্মান করছে!
ওর ভাবনা শেষ হবার আগেই মৌটুসি বলে,
: আবার তুমি নিজেকে সাধারণ ভাবছ, গরিব ভাবছ? তুমি মোটেও গরিব নও, সাধারণ নও। তুমি অসাধারণ।
মৌটুসি সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে। ওর দেখাদেখি নিউটনও ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়ে। চারদিক মৌ মৌ করা গন্ধের মধ্য দিয়ে ওরা হাঁটে। মৌটুসি বলে,
: আমাদের এই রাজ্যে কোন অভাব নেই বুঝেছ। যা চাইবে পাবে, যে যা নিতে চাইবে চোখের নিমেষে পেয়ে যাবে। ওই যে দেখ গাছে গাছে ফল পেকে আছে, ওই দেখ মাঠে ধান, গম, সরিষা। ওই যে পুকুরে মাছ। ওই দেখ কত গরু ছাগল। প্রচুর দুধ হয় এ রাজ্যে। ফল মিষ্টি কিছুরই অভাব নেই। কত খাবে তুমি, যত পারো খাও। অত খাওয়ার মানুষ মানে পরী নেই এখানে। আর এখানে সবকিছুই বারো মাস ফলে। কাজেই শীতের জিনিসের জন্য শীত পর্যন্ত বা গরমের জিনিসের জন্য গরম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এখানকার পানি খুবই মিষ্টি। আর ওই যে দেখ একটু পর পর ঝরনা আছে। ওই দেখ তোমাকে দেখে ঝরনা গান গাইছে। শুনতে পাচ্ছ ? ঝরনা তখন গাইছে,
এসো নতুন অতিথি এসো
আমার পাশে বোসো
একটুখানি হাসো
একটু ভালবাসো ..
: হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। দারুণ তো! আচ্ছা এখানে কি কারো অসুখ বিসুখ হয়?
এবার মৌটুসি একটু চুপ করে যায়। তারপরে বলে,
: মানুষ যেমন সব পারে কিন্তু জীবন দিতে পারে না, ওটা দেন সৃষ্টিকর্তা। এখানেও তাই। পরীদের অসুখ বিসুখ আছে, মৃত্যুও আছে।
: তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই আছে?
: আমাদের রাজ কবিরাজ আছে, তিনি চিকিৎসা করেন।
: দূর এই আধুনিক যুগে কবিরাজি চিকিৎসা! এটা একটা কথা হল। ডাক্তার নেই এখানে, পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই?
: আছে। একজন ভাল ডাক্তারও আছে। পরীক্ষার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সেখানে কেউ যেতে চায় না। পরীরা ইঞ্জেকশনকে খুব ভয় পায়।
হো হো করে হেসে ওঠে নিউটন। পরীরাও তাহলে কিছু জিনিস ভয় পায়।
: হাসছ কেন ?
: এমনি। আচ্ছা আর কত দূর যেতে হবে ?
: ওই তো প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে। চলো যাই।
ওরা ভেতরে ঢুকতেই নহবত বেজে ওঠে। ওদের মাথার উপর ফুল বৃষ্টি হতে থাকে। কে যেন ওদের কপালে ফোটা জাতীয় কিছু দেয়। একজন বয়স্ক পরী মৌটুসিকে জড়িয়ে ধরে। মৌটুসি বলে,
: মা ও আমার বন্ধু নিউটন। মানুষের রাজত্ব থেকে এসেছে। খুব ভাল ছেলে। কোন ভেজাল নেই। আমাদের দেশ দেখাতে নিয়ে এসেছি। এই আমার মা আর এই আমার বোন মৌমিতা।
: খুব ভালো করেছিস। এ রাজ্যে অনেকদিন নতুন অতিথি আসেনি। রাজবাবুর্চিকে বলেছি তার স্পেশাল রান্নাগুলো করতে। নিউটন, এখানে আরাম করে বসো। কইরে ওকে শরবত দে। তুমি বসো বাবা। আমার শরীরটা একটু খারাপ। আমি একটু বিশ্রাম নেব।
: মা তোমার কি হয়েছে ? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মৌটুসি বলে,
: তেমন কিছু না। সেই আগের দুর্বলতাটা। ও ঠিক হয়ে যাবে। তুই ভাবিস না। ওর যতœ নে।
মুহূর্তের মধ্যে শরবত এসে যায়, সাথে ফল আর প্রচুর মিষ্টি। নিউটন এমন শরবত খাওয়া তো দূরের কথা, এমন শরবত যে হয় তাই জানত না। শরবতে চমৎকার এক সুগন্ধি দেয়া। হিম পানিতে বানানো সাথে প্রচুর পেস্তা কিশমিশ আরো যেন কিসব। নিউটনের খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। ও ছোঁ মেরে শরবতের গ্লাস হাতে নেয় সাথে খাবার দাবার। গোগ্রাসে খেতে থাকে ও। কিন্তু একটু খেয়েই লজ্জিতভাবে মৌটুসিকে বলে,
: দেখ ক্ষুধায় আমার কিছুই খেয়াল ছিল না। আমার মা বলেন, সামনে খাবার দিলে আগে অন্যকে খেতে বলতে হয় তারপর নিজে খেতে হয়। আর সবসময় ছোট জিনিসটা, কম জিনিসটা নিজে নিতে হয়। দেখ আমরা গরিব ঠিকই কিন্তু আমার মা অনেক কিছুই জানেন। আজ ক্ষুধায় মায়ের অবাধ্যতা করলাম। চরম অবাধ্যতা। তুমি খাও। আমার খুব লজ্জা করছে।
নিউটন হাত গুটিয়ে নেয়।
: আরে না না, আমি এখন খাবো না। আমার মোটেও ক্ষুধা পায়নি। আমি পরে খাব। তবে হ্যাঁ বলতেই হবে তোমার আব্বা মা তোমাকে খুব ভাল শিক্ষা দিয়েছেন। তুমি ধীরে সুস্থে আরাম করে খাও। আমি তোমার খাওয়ার পর বিশ্রামের জায়গাটা দেখিয়ে দেব।
নিউটন খায় কিন্তু যতটা খাবে ভেবেছিল তা পারে না। তবে খাবারগুলো ছিল দারুণ সুস্বাদু।
: আরে তুমি যে কিছুই খেলে না। এই যে বললে খুব ক্ষুধা পেয়েছে। এক কাজ করো। আইসক্রিম খাও। আমি জানি সব শিশুই আইসক্রিম ভালবাসে।
: আমি শিশু না, কিশোর।
: আচ্ছা আচ্ছা তাই হলো, তুমি কিশোর।
ততক্ষণে প্রচুর আইসক্রিম এসে গেছে। নিউটন খুব একটা আইসক্রিম খায়নি। কিন্তু অনেক আইসক্রিম সে দেখেছে দোকানের শোকেসে। তাছাড়া অনেক রকম আইসক্রিমের ছবিও সে দেখেছে। কিন্তু এখানে যেসব আইসক্রিম দেয়া হয়েছে তা সে কোনদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। কী চমৎকার চমৎকার রং সেসব আইসক্রিমের আর কী তার সুগন্ধ! আর দেখতে কত ভাল!
: একটা চমৎকার চৌকোনা পাত্রে আইসক্রিম তুলে দেয় মৌটুসি। ও পাত্রের নাম কী? বাটি না প্লেট? কিসের তৈরি জিনিসটা? এত চকচকে মসৃণ আর নকশাটা কী সুন্দর! মৌটুসি ওর দিকে পাত্রটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাও।
এবার আর নিউটন ভুল করে না। পাত্র হাতে নেয়। তবে বলে,
: তুমি আগে নাও।
মৌটুসি হাসে। পাত্রে আইসক্রিম নিতে নিতে বলে,
: হ্যাঁ আমি একটু নেব। এই যে এই আইসক্রিমটা, এটার নাম ‘কইকম্বুর।’ পরীদের স্পেশাল আইসক্রিম। আমার খুব পছন্দের। খুব তেষ্টা পেয়েছে তাই খাব।
ওরা আইসক্রিম খায়। একটা শেষ হবার পর মৌটুসি নিউটনের পাত্রে আর একটা তুলে দেয়। খাওয়ার পর ওকে একটা ঘরে নিয়ে যায় মৌটুসি। এমন ঘর নিউটন কখনও স্বপ্নেও দেখেনি। মৃদু আলো জ্বলছে ঘরে। সে আলোর রংটা ও ঠিক বোঝে না, না নীল না সবুজ না হলুদ। অদ্ভুত ¯িœগ্ধ একটা রঙ! চমৎকার ফিনফিনে পর্দা সে ঘরে টানানো। কে জানে ওগুলো কি কাপড়। দেখলে মনে হয় খুবই পাতলা অথচ বাইরের কিছুই দেখা যায় না। নিচু একটা কারুকার্য করা খাটে চমৎকার বিছানা। ঘরের মাঝে পুরু কার্পেট পাতা। পা দেয়ামাত্র সে কার্পেট ডুবে যেতে থাকে। ভয়ে উহ করে ওঠে নিউটন। মৌটুসি হাসে। বলে,
: ভয় পেও না, কার্পেটটা খুব নরম। তাই মনে হয় দেবে যাচ্ছে, আসলে দাববে না। একটু হাঁটাচলা করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
পর্দা কার্পেট বিছানা বালিশ সবই সাদা রংএর। মৌটুসি ওকে সব ঘুরে ঘুরে দেখায়।
: এখানে তুমি বসবে, এখানে শোবে। এটা তোমার বাথরুম। তুমি বোধ হয় এ ধরনের বাথরুম কখনও ব্যবহার করোনি। আসো কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তোমাকে শিখিয়ে দি। আর এই যে টেবিলের উপর তোমার জন্য পানি, কোল্ড ড্রিংকস, শরবত, ফলের রস রাখা আছে। যেটা ইচ্ছে হবে খাবে। আর এই যে দেখ, এটা একটা অ্যালার্ম ঘড়ি। ঠিক দু’ঘন্টা পর এটা রিনি রিনি করে বাজবে। তোমার ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভাঙলে ফ্রেশ হয়ে এই আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে পরবে।
মৌটুসি ওকে হাত ধরে আলমারির কাছে নিয়ে যায়। নিউটন দেখে সেখানে থরে থরে কাপড় জামা সাজানো। কী মূল্যবান সেসব কাপড় আর কী তার রং! এমন কাপড় সিনেমায় রাজপুত্রদের পরনেও সে কখনও দেখেনি। এসব তার জন্য!
মৌটুসি বলে,
কিছু দরকার হলে এখানে চাপ দেবে। এটা কলিংবেল। সাথে সাথে লোক এসে যাবে। তাছাড়া তোমার দরজার বাইরে সর্বক্ষণ একজন লোক থাকবে। অ্যালার্ম বাজলে তুমি কাপড় পরে রেডি থেকো।
: অত কিছুর দরকার নেই আমার।
: তোমার দরকার নেই, আমাদের আছে। তুমি আমাদের অতিথি, এখানে নতুন। তোমার কি লাগবে না লাগবে আমাদের দেখতে হবে না? এখন তুমি খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। আমি দু’ঘন্টা পর এসে তোমাকে আমাদের রাজ্য ঘুরাতে নিয়ে যাব। ঠিক আছে, আসি তাহলে।
মৌটুসি দরজা টেনে দিয়ে চলে যায়। নিউটন বিছানায় বসে। বসামাত্র অনেকটা দেবে যায় বিছানা। এত নরম বিছানা হয় নাকি ! এটা কি বিছানা নাকি তুলোর বস্তা! ও এবার সাবধানে বসে। তারপর আস্তে আস্তে শোয়। সন্তর্পণে বালিশে মাথা রাখে। বিছানা আর বালিশ থেকে চমৎকার একটা সুগন্ধ ভেসে আসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায় ও।
অ্যালার্মের রিনি রিনি শব্দে ঘুম ভাঙে নিউটনের। কী যে চমৎকার সে বাজনা! ও ধীরে ধীরে চোখ মেলে। আর চোখে মেলেই ঘাবড়ে যায়। এ কোথায় সে! পরক্ষণে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে। ও ওঠে, বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধোয় তারপর আলমারি খোলে। আলমারি খুলে হকচকিয়ে যায়। এত সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় ! এত জামার মধ্যে কোনটা সে পরবে। মাথা ঠা-া রাখতে চেষ্টা করে নিউটন। তার পর বেছে বেছে চমৎকার একটা জামা পরে। মা একবার ঈদে ওর জন্য নীল রংএর একটা শার্ট কিনে এনেছিল। সে শার্ট পরলে বস্তির সবাইকে ডেকে এনে দেখিয়ে বলেছিল,
: দেখ দেখ নীল রংএর জামায় নিউটনকে কেমন রাজপুত্রের মত লাগছে। ও নীল রঙএর একটা পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মার জন্য কান্না পায় ওর। ও ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদে। ও খাটের উপর ঝিম মেরে বসে থাকে। আর তখনই মৌটুসি আসে,
: কি মন খারাপ মায়ের জন্য? অত মন খারাপের কিছু নেই। আর তো মাত্র কিছুক্ষণ। এরপরই চলে যাবে মায়ের কাছে। তখন আমার জন্য মন খারাপ লাগবে দেখো।
ওর কথায় প্রচ- অভিমান হয় নিউটনের। এই কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ ও আর কত দিন করবে। সেকি আর কখনও মায়ের কাছে ফিরতে পারবে!
মৌটুসি হাসে। বলে,
: মনে অবিশ্বাস এনোনা। অকারণে অবিশ্বাস করা ঠিক না। যখন দেখবে তোমার ধারণা ভুল তখন কিন্তু নিজেই কষ্ট পাবে। এসো দেখি তোমাকে রেডি করে দিই।
মৌটুসি নিজ হাতে ওর চুল আঁচড়ায়, ¯েœা পাউডার মাখায়। গলায় পরায় মূল্যবান জুয়েলারি। পায়ে পরায় চমৎকার নরম স্যান্ডেল। তারপর ওর হাত ধরে বের হয়।
পুরো শহর লাল কার্পেটে মোড়া। ওরা বের হতেই নিউটন দেখে পাখিরা গাইছে, ফুলেরা হাসছে আর বাতাস গানের মত করে বইছে। রাস্তায় যার সাথেই দেখা হচ্ছে সেই হাসিমুখে কথা বলছে। আর পরীগুলো যে কী সুন্দর! কী সুন্দর তাদের গায়ের চামড়া, কী তাদের রং চেহারা আর চুল। আর না বেশি লম্বা না বেঁটে। সবারই পরনে চমৎকার পোশাক। ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মৌটুসি বলে,
: এটা আমাদের পাহাড়। এটার নাম পরীহিল।
নিউটন তাকিয়ে তাকিয়ে পাহাড়টা দেখে। পুরো পাহাড়ের গা জুড়ে ফুল আর ফুল। নিচের দিকে কিছু সবজিও আছে। পাকা তরমুজ, আনারস। আর একেবারে নিচে কাঁদি কাঁদি কলা, আপেল, পেয়ারা, লেবু। সব পেকে লাল হয়ে আছে। আর পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে একটা ঝরনা। অবিরাম সে ঝরনার জল ঝরে পড়ছে। আর তার নিচে অনেক রংএর অনেক মাছ। মৌটুসি বলে,
: মাছগুলো দেখ। খুব সুন্দর না? আমি তো মাঝে মাঝে এই মাছ দেখার জন্যই এখানে আসি। অবশ্য তোমাদের বাবুপুরা নীলক্ষেতে অনেক সুন্দর সুন্দর মাছ পাওয়া যায়। অনেকে সেগুলো কিনে নিয়ে অ্যাকোরিয়ামে রাখে। পাখিও পাওয়া যায়, সুন্দর সুন্দর পাখি। তবে এখানে অনেক মাছ আছে যা তোমাদের ওখানে কেন, পৃথিবীর কোথাও নেই।
: এখানে মাছ থাকবে কি করে। পানি তো বয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝগুলো পানির সাথে ভেসে যাচ্ছে। এভাবে মাছ হয় নাকি?
: খেয়াল করে দেখ মাছগুলো ভেসে যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকার ক্ষমতা ওদের আছে। এ জন্যই তো ওরা পরীরাজ্যের মাছ। তবে এ মাছগুলো দেখার, খাওয়ার না। খাওয়ার মাছ পাওয়া যায় নদীতে। কেমন দেখলে আমাদের পাহাড়টা? তোমাদের খাগড়াছড়ি বান্দরবান রাঙ্গামাটিতেও পাহাড় আছে। ওখানে আমি গেছি। ওখানে এক ধরনের চাষ হয় তাকে বলে জুম। জুমচাষ সারা বছর করা যায়না। আর জুমে কিন্তু সব গাছ লাগানো যায়না। কিছু কিছু গাছ লাগানো যায়। আমাদের এখানে এমন কোন গাছ নেই যা লাগানো যায় না। সব গাছ লাগানো যায় আর মাটি খুবই উর্বর। লাগানোর সাথে সাথেই গাছ হয়ে যায়। সারা বছর এই দেশে ফুল ফোটে, ফল ধরে।
: কিন্তু তোমরা তো ফল খাও না। পেকে পেকে পড়ে আছে। নষ্ট হচ্ছে।
: খাই। যার যতটা লাগে নিয়ে নি। বাকিগুলো পশু পাখি খায়। ওদের তো আমাদের খাবারে অধিকার আছে কি বল? হ্যাঁ তোমাদের মত যত পারি তত নি, না লাগলেও নি, জোর করে নি এমন না। চলো এবার নদীর দিকে যাই।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর পাড়ে আসে। এদেশের আবহাওয়া এতই সুন্দর যে মানুষ ঘামে না। বরং শরীর যেন জুড়িয়ে যায়। রাস্তার চারপাশে গাছ। গাছগুলো মাঝারি আকৃতির। আর সে সব গাছ বোঝাই ফুল আর ফুল। এ যেন পরীরাজ্য নয়, ফুল রাজ্য। ওর মনের কথা বুঝে নিল মৌটুসি বরাবরের মত। বলল,
: তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে বড় বড় গাছগুলো আছে আর তার যে ফুল সেও কিন্তু চমৎকার। বিশেষ করে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। আর তোমাদের সেনানিবাস এলাকায় আছে অজ¯্র গুলমোহর। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা কি দেখতে। শোন ফুলের কোন বিকল্প নেই। একজন কবি লিখেছেন,
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা / খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে / অর্ধেক ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।
সত্যি চমৎকার। ফুল দেখলে যে কি আনন্দ হয়! আর গাছ দেয় অক্সিজেন। সে অক্সিজেন নিয়ে মানুষ বাঁচে। গাছের সবুজ চোখ আর মন ভাল রাখে। আর সবুজ তোমাদের জাতীয় পতাকার রং। জানত তুমি এসব?
: এসব জানব না কেন। আমাদের জাতীয় পতাকা হচ্ছে সবুজের মধ্যে লাল সূর্য। আর শোন আমি ফুল খুবই ভালবাসি। আমার মাও। মার জন্য ফুল তুলতে গিয়েই তো জলরাক্ষস ধরল আর তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। ভুলে গেলে সে কথা? আর শোন আমাদের নিজের কোন জায়গা নেই তারপরও আমার মা বস্তির কমন উঠোনে ফুলের গাছ লাগায়। আমাদের সরকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে লিখে দিয়েছে,
সবুজে থাকো, সবুজে বাঁচো
সবুজে বেড়ে ওঠো
: বাহ তুমি ভারি ভাল ছেলে। অনেক কিছু জানো। চলো নদীর ধারে এসে গেছি।
ওরা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। এ নদীর পানিও সেই ঘরের আলোর মত। না নীল না সবুজ না হলুদ। আর পানির নিচের পুরোটা দেখা যায়। সেখানে খলবলিয়ে ভাসছে কত রকমের মাছ। সেসব মাছের কোনটাই ওর চেনা না। পানিতে এক বিন্দু ময়লা নেই। নিচের বালির কণাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রং বেরংএর পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। মাঝিরা কি এক অদ্ভুত ভাষায় গান করছে। নিউটন বলে,
: এই নৌকাগুলো কোথায় যাচ্ছে?
: কেন অন্য শহর, বন্দরে। তোমাদের যেমন ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় আর জেলা শহর আছে, গ্রামগঞ্জ আছে আমাদেরও আছে। সেখানে যাচ্ছ্।ে এটা তো আমাদের রাজধানী পরীস্থান।
: নৌকায় কি যাচ্ছে?
: পরীরা যাচ্ছে, মালামাল যাচ্ছে। আবার অনেক সময় বিয়ের নতুন বর কনে রাজকীয় নৌকায় যায়।
: কিন্তু তোমাদের তো ওড়ার জন্য ডানা আছে। তাহলে নৌকা কেন?
: নৌকা শুধু নয়, লঞ্চ, জাহাজও আছে। আর শোন ডানা থাকলেই কি ওড়া যায় নাকি সব সময়? এই ধর ছোট শিশু বৃদ্ধ তারা কি উড়তে পারে? তাছাড়া আমরা দূরের পথ উড়ি খুব কাছের পথ হাঁটি আর অল্প দূর হলে নৌকা বাস এসবে যাই।
: কই তোমাদের শহরে তো কোন বাস রিক্সা দেখলাম না?
: আছে, আছে, সবই আছে অন্যপাশে। আমাদের দেশে যে রাস্তা দিয়ে পরীরা হাঁটে সেখানে যানবাহন চালানো নিষেধ। ওতে অনেক এক্সিডেন্ট হয়।
নিউটন মনে মনে বলে, এটা খুব ভাল। তাদের ঢাকায় তো গায়ের উপর রিক্সা বাস তুলে দেয়। একই রাস্তায় বাস ট্রাক কার ঠেলা রিক্সা সবই চলে। মাঝে মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়। কত রোগী যে এভাবে মারা যায় প্রতিদিন, কত একসিডেন্ট হচ্ছে আর কত মানুষ মারা যাচ্ছে তার হিসেব নেই।
: মনে রাখবে জীব হত্যা মহা পাপ। সে হত্যা যদি নিজের হাতে না হয়, নিজের বোকামি বা অসচেতনতার জন্য হয় সেটার দায়ও কিন্তু যে দায়ী তার উপর এসে পড়ে।
: ঠিক বলেছ, খুব ঠিক কথা। আচ্ছা মাঝিরা কি গান গাইছে।
: ওরা পরীদের ভাষায় গাইছে।
: কিন্তু তুমি তো আমার সাথে বাংলায় বলছ। আমি ভেবেছি এটাই তোমাদের ভাষা,
: আরে না, পরীদের ভাষার নাম পরী ভাষা। আমরা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারি। তুমি আমাদের ভাষা বুঝবে না তাই বাংলাতেই বলি তোমার সাথে। ওরা কি গাইছে খেয়াল করে শোন ওরা গাইছে,
রিনি রিনি রিনি
কিনি কিনি কিনি
জিনি জিনি জিনি
রিনি রিনি রিনি
এর মানে হচ্ছে, বন্ধুরা দূর দেশে যাচ্ছি আমি। দোয়া করো যেন সুস্থ দেহে সুস্থ মনে ফিরতে পারি। যাত্রা যেন শুভ হয়। তোমরা ভাল থেক।
: তোমরাও সুস্থ থাকার চিন্তা করো ?
: কেন করব না। শুনলে না আমার মা খুব অসুস্থ। আমরাও তো অসুস্থ হই। আমাদেরও তো রোগ শোক হয়। যাক মাছগুলো দেখ, দারুণ না? শোন পরীরাজ্যের একটা স্পেশাল মাছ আছে। ওটার নাম পরীমাছ। রাতে তোমার জন্য ওই মাছের স্পেশাল ডিস হবে।
ওর কথা শেষ হবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে একজন পরী আসে।
: রাজকন্যা রাজকন্যা, পরীরাণী অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
: বলছ কি তুমি। মার কি হয়েছে? বলতে বলতে ডানা মেলে দেয় মৌটুসি। ‘ওঠ বন্ধু আমার ডানায়, ওঠো তাড়াতাড়ি।’
ওরা পরী রাজবাড়িতে এসে দেখে হুলু¯ূ’’ল কা-। বাড়ির সবার মুখ থমথমে, সবার চোখে পানি। মৌটুসিকে দেখামাত্র ছোটবোন মৌমিতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরীরানী অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। রাজকবিরাজ তার নাড়ি ধরে রেখেছেন। তার মুখ গম্ভীর।
: কেমন দেখছেন কবিরাজ মশাই। মা হঠাৎ অজ্ঞান হলেন কেন?
: অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। কেন অজ্ঞান হলেন সেটাই তো বুঝছি না। নাড়ির গতি খুবই দুর্বল।
: কিছু একটা করুন। আপনি রাজ কবিরাজ, আপনাকেই তো করতে হবে।
নিউটন রানীমার নাড়ি টিপে পালস দেখে। ওর মুখ আরও গম্ভীর হয়। বলে,
: এসব করিবাজিতে চলবে না। আমি একবার এক কম্পাউন্ডারের কাছে পালস দেখতে শিখেছিলাম। মনে হচ্ছে পালস রেট খুবই কম। এটা ভয়ের ব্যাপার। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকুন।
: কিন্তু ডাক্তার তো ইঞ্জেকশন দেয়।
: এখন ইঞ্জেকশনই দিতে হবে। এ ছাড়া কোন উপায় নেই। না হলে দেরি হয়ে যাবে।
দু’বোন পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর ডাক্তারকে ডাকে। ডাক্তার এসে পালস দেখে, প্রেসার দেখে, তারপর গম্ভীর মুখে একটা ইঞ্জেকশন দেয়। অজ্ঞান অবস্থাতেই রানীমার চোখ কুঁচকে যায়। আর অন্যরা এমন ভাব করে যেন রানীমার হাতের মধ্যে একটা শাবল ঢুকেছে। নিউটনের ভীষণ হাসি পায়। ওরা এত উপর দিয়ে উড়তে পারে আর ইঞ্জেকশনে ওদের এত ভয়। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। আব্বা অনেকবার বলেছেন, বিপদ দেখলেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেবে। কি করে করবে সেটা ভাববে না। ভাবলে দেরি হয়ে যাবে। নিউটন বলে,
: কেমন দেখলেন ডাক্তার সাহেব?
: ভাল না। পালস রেট খুবই কম, প্রেসারও ওঠা নামা করছে। ভীষণ দুর্বল। আমি এখনই রক্ত পরীক্ষা করতে দিচ্ছি। রক্ত পরীক্ষা না করে কিছু বলা যাবে না।
ডাক্তার রক্ত নিয়ে চলে যায়। দশ মিনিট পরে এসে বলে,
: ইমিডিয়েট রক্ত দিতে হবে। একদম রক্তশূন্য হয়ে গেছেন। সে জন্যই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। এখানে কার গ্রুপ এ পজেটিভ?
ওরা কেউ তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না। সুচ ফোটানোর ভয়ে এতদিন ওরা রক্তের গ্রুপ চেক করেনি। কিন্তু পরীরানীর অসুখ বলে কথা! ওরা একে একে রক্তের গ্রুপ চেক করে। এ পজেটিভ গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায় না। এরপর রাজ্যে ঢেঁড়া পেটানো হয়। দলে দলে লোক আসতে থাকে। হঠাৎ নিউটন বলে,
: আমার প্রুপটা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন? অবশ্য আমি মানুষ আর আপনারা পরী। আমি জানি না গ্রুপ মিললেও আমার রক্তে কাজ হবে কিনা।
: খুব হবে। আরে সেই একই ধমনী শিরাতো আমাদের শরীরেও বইছে। আগে রক্তটা পরীক্ষা করি।
রক্ত পরীক্ষা করে চেঁচিয়ে ওঠে ডাক্তার।
: হুররে মিলে গেছে, আর কোন ভয় নেই। এখনই তোমার রক্ত নিয়ে রানীমার শরীরে দিয়ে দিচ্ছি। এবার রানীমা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
পাশাপাশি দুটো বেড। নিউটনের শরীরের রক্ত নল দিয়ে ঢুকছে রানীমার শরীরে। আস্তে আস্তে রানীমার শরীরের সাদাভাব দূর হয়ে রক্তাভা ফুটে উঠছে। কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে প্রাসাদের পরীরা আর মৌটুসি তাকিয়ে আছে কান্নাভরা চোখ নিয়ে। ও এক হাতে ধরে আছে নিউটনের হাত আর একহাতে রানীমার।

নয়.
বাড়ি ফিরছে নিউটন। রানী মা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে বিদায় দিয়েছেন। বলেছেন,
: ভাল থেকো বাবা। তোমার জন্য আমি এ যাত্রা বেঁচে গেলাম
: না রানীমা আমার জন্য না। মহান আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবেন। তিনি পরম করুণাময়।
সারা রাজ্যের লোক চোখে কান্না নিয়ে হাত নেড়ে নিউটনকে বিদায় জানিয়েছে,
: বিদায় রাজ অতিথি, ভাল থেকো। খুব ভাল থেকো।
পরীরানী ওকে নানান উপহার দিতে চেয়েছিলেন। জামা জুতো সোনা হীরে। ও কিছুই নেয়নি। এসব নিলে মাকে সে কি জবাব দেবে। তবে একটা জিনিস সে পরীরানীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
: আপনাদের বাগানের কিছু ভাল ভাল ফুল আর কিছু চারা আমাকে দেবেন। আমার মা ভীষণ ফুল ভালবাসে।
: ওসব আমরা রেডি করেই রেখেছি। মৌটুসি আগেই আমাকে বলেছে আমাদের বাগানের সেরা ফুল আর চারা তোমাকে দিতে।
এবার কৃতজ্ঞ চোখে মৌটুসির দিকে তাকায় নিউটন। এত কিছু মনে রেখেছে মৌটুসি!
এখন মৌটুসির ডানায় নিউটন। ও ফিরছে নিজের বাড়িতে। যেতে যেতে মৌটুসি বলে,
: শোন নিউটন তুমি দু’ চারদিনের মধ্যেই স্কুলে ভর্তি হবে। অনেক বড় হবে তুমি। তোমার বিশ্বজোড়া নাম হবে। তখন কিন্তু তোমার এই বন্ধুর কথা ভুলো না। আর যা করবে মানুষের মঙ্গলের জন্য করবে। আমি শুনেছিলাম মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আজ সেটা তুমি প্রমাণ করে গেলে। তুমি আমার মাকে রক্ত দিয়ে গেলে। যতদিন আমার মা বেঁচে থাকবে, আমি বেঁচে থাকব, এই পরীরাজ্য থাকবে তোমাকে কেউ ভুলবে না। আর যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় আমাকে মনে মনে ডেকো। আমি হাজির হয়ে যাবো। এই যে পরীরাজ্যের ফুল, ফুলের চারা আর দিঘীর সেই শাপলা। ধরো, তোমার মাকে দিও। ভাল থেকো বন্ধু। বিদায়।
নিউটন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই বড় একটা ঝাঁকিুনি খায় সে। মা তাকে ঝাঁকাচ্ছে।
: কিরে এখানে বসে বসে ঘুমাচ্ছিস কেন? আমি তোর আব্বা আর চাচি গল্প করছিলাম। খেয়াল করিনি তুই এখানে বসে ঘুমাচ্ছিস। ওঠ, বিছানায় গিয়ে শো।
নিউটন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। তার ঘোর কাটে না। কোথায় ছিল আর কোথায় এল সে। এতো তার সেই চির চেনা বস্তির ঘর। তাহলে কোথায় সেই পরীস্থান আর কোথায় মৌটুসি! তাহলে ওগুলো কি স্বপ্ন ছিল! তখনই চোখ যায় হাতের দিকে। হাতে সেই টকটকে লাল শাপলা। তেমনই সতেজ। তাহলে কিছুই স্বপ্ন নয়, সবই সত্যি, সবই বাস্তব। ও মার দিকে ফুল বাড়িয়ে দেয়।
: মা ফুলগুলো নাও।
: কী কা-, এই এত রাতে তুই এমন তাজা শাপলা পেলি কোথায়? গেলিই বা কখন, আনলিই বা কখন?
: গেছিলাম মা, মা আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ফুলগুলো নাও।
মা শাপলাগুলো নিয়ে বেণীর গোড়ায় গুঁজে ফেলে। নিউটন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, হাসে। ওর শাপলা আনা সার্থক হয়েছে।
পরদিন সকাল। অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে নিউটনের। ঘুম ভেঙে দেখে মা বাড়িতে। অবাক হয়ে বলে,
: মা কাজে যাওনি?
: শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। ভাবছি আজ কাজে যাব না
: সেতো ভাল কথা, কিন্তু ওরা রাগ করবে না?
: তা করবে। আচ্ছা তুই গিয়ে একটু বলে আসতে পারবি না, আমার মায়ের শরীর খারাপ। আজ কাজে আসতে পারবে না?
: তা পারব। তাহলে ওখানে বলে আমি রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে যাব। আজ থেকে তো আমার রিক্সা চালানোর কথা। মহাজনকে বলে এসেছি।
: না আজ তুই কাজে যাস না। আমি আজ বাড়িতে আছি। তুই বাড়িতে আমার কাছে থাক। এবার তুই পান্তা খেয়ে বেরিয়ে যা। আসার সময় একটা পত্রিকা কিনে আনিস। এই নে টাকা। আজ লটারির রেজাল্ট বেরুবে।
পান্তা খেয়ে বের হয় নিউটন। মার কাজের দুটো বাড়িতে বলে, মহাজনকে বলে একটা পত্রিকা কিনে বাড়িতে ফেরে। যেতে যেতে পত্রিকার হেডলাইনগুলো পড়ে। ছেলে বেলায় পাশের ঘরের রকিবের কাছে সামান্য কিছু পড়তে শিখেছিল ও। গুনতে পারে, দু একলাইন পড়তেও পারে। ও বাসায় ফিরলে মা ওকে দিয়ে টিকেট মেলাবে। ঘরে ফিরে মার হাতে পত্রিকাটা দেয় নিউটন। অসুস্থ মা সাথে সাথে উঠে বসে। নিউটন বলে,
: মা তোমার শরীর খারাপ। একটু শুয়ে থাকো, পরে টিকিটি মিলাও।
: আরে না, তুই আয়।
মা টিকেটগুলো বের করে নিয়ে নিউটনের হাতে দেয়। নিউটন একটা একটা করে মেলায়। ও নিশ্চিত জানে এবারও টিকেট মিলবে না। কেন যে মা খালি খালি টিকেট কেনে আর না মিললে মনমরা হয়ে যায়। দুটো টিকেট মেলানোর পর তৃতীয়টা হাতে নিয়ে মেলাতে বসে নিউটন। প্রথম পুরস্কারে চোখ আটকে যায় ওর। বার বার মেলায়। ততক্ষণে ওর দমবন্ধ হবার অবস্থা। ও চেঁচিয়ে ওঠে,
: মিলেছে মা মিলেছে। ফার্স্ট প্রাইজ বিশ লাখ টাকা।
: বলছিস কি বাপ, বলছিস কি। এইত মাত্র কদিন আগে টিকেটটা কিনলাম। বছরের পর বছর টিকেট কিনি, মেলে না আর চারদিন আগে কেনা টিকেট মিলে গেল আশ্চর্য! নিউটনরে আমাদের ভাগ্য খুলে গেল। এবার আমি তোকে ভাল স্কুলে ভর্তি করব। তুই বড় হবি, অনেক বড়।
নিউটন বিড় বিড় করে বলে,
‘আমি জানি মৌটুসি এটা তোমার কাজ, তোমার।’ ওর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে।
বিশ বছর পর। নিউটন এখন নামকরা বৈজ্ঞানিক। সারা পৃথিবীজোড়া ওর খ্যাতি। ও ঘুরে বেড়ায় বিশ্বব্যাপী এ সেমিনার সে সেমিনার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে। মাঝে মাঝে আব্বা মাকেও সাথে নিয়ে যায়। ওদের ঘুরিয়ে এনেছে নভোথিয়েটার, সায়েন্স সিটি আরও কত কত জায়গা। যেখানেই যায় সব জায়গা নিউটনের চেনা মনে হয়। এসব জায়গা ওকে মৌটুসি চিনিয়ে দিয়ে গেছে। তার ডানায় বসে এসব দেশ ও দেখে গেছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পরীস্থানে যাবার পথ আবিষ্কার করতে পারেনি নিউটন। ভূগোলের কোথাও ওটা নেই।
নিউটন এখন ব্যস্ত এক নতুন আবিষ্কারে। যে আবিষ্কারে উপকৃত হবে পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষ। যে আবিষ্কার আরো সামনে এগিয়ে দেবে সভ্যতার চাকা, ঠিক যেমনটি চেয়েছিল মৌটুসি। নিউটন কাজ করে, কাজ করে যায় কিন্তু কখনই ভোলে না মৌটুসিকে। যখনই ওর কথা মনে পড়ে আপনা আপনি চলে যায় পরীরাজ্যে। মৌটুসি ওর হাত ধরে বলে, স্বাগতম বন্ধু।

Share.

মন্তব্য করুন