শহীদ আফ্রিদির ৩৭ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ডটি টিকে ছিলো ১৭ বছর। ১৯৯৬ সালে গড়া ওয়ানডে ম্যাচে সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরির সেই রেকর্ড ২০১৪ সালের প্রথম দিন ভাঙেন নিউজিল্যান্ডের কোরি অ্যান্ডারসন (৩৬ বলে)। তবে দুর্ভাগ্য অ্যান্ডারসনের, রেকর্ডটি তার দখলে ছিলো মাত্র এক বছর ১৭ দিন। তার চেয়ে ৫ বল কম খেলে সেঞ্চুরি স্পর্শ করেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। শুধু তাই নয়, ১৮ বছর আগে আফ্রিদি যেটি পারেননি সেটিও করে দেখিয়েছেন ভিলিয়ার্স। সবচেয়ে কম বলে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিলো সনৎ জয়সুরিয়ার (১৭) বলে। রেকর্ড গড়ার দিন প্রথম পঞ্চাশ রান পূর্ণ করতে আফ্রিদির লেগেছিলো ১৮ বল। তবে ভিলিয়ার্স যেন পণ করেই নেমেছিলেন একদিনেই সব কিছু করার। ১৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও নিজের করে নেন। আর সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৩১ বলে। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে সেদিন গোলাপি রঙের জার্সি পরে নেমেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা দল। তবে গোলাপি নয়, রীতিমতো চোখে সর্ষে ফুলের হলুদ দেখেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা। উদ্বোধনী জুটিতে হাশিম আমলা আর রাইলি রুশোর ২৪৭ রানই মূলত ভিলিয়ার্সকে তরবারি চালানোর লাইসেন্স দিয়েছিলো। ৩৯তম ওভারে প্রথম উইকেট পতনের পর মাঠে নেমে তাই সেটাই করলেন। ইনিংসের শেষ ওভারে যখন আউট হয়েছেন ততক্ষণে নামের পাশে ৪৪ বলে ১৪৯ রান। টর্নেডো, তান্ডব কিংবা কোন বিশেষণেই স্পষ্ট করে বোঝানো যায় না সেদিনের ভিলিয়ার্সের ব্যাটিংকে। ১৬টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন, সেখানে চার মেরেছেন মাত্র ৯টি। সব মিলে সেই ম্যাচে ৫০ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ৪৩৯ রান করেছিলো স্বাগতিকরা। এক ইনিংসে ১৬ ছক্কার রেকর্ডে তিনি অংশীদার ক্রিস গেইল ও রোহিত শর্মার সাথে।
এবি ডি ভিলিয়ার্সের ব্যাটে এমন তান্ডব অনেকবারই দেখেছে বিশ্ববাসী। ঠিক পরের মাসেই সিডনিতে ২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচে আবারো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সামনে পেয়ে জ্বলে ওঠেন ভিলিয়ার্স। সেটিও এমনভাবে যাতে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। মাত্র ৬৬ বলে খেলেন অপরাজিত ১৬২ রানের ইনিংস। ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত ক্যারিবীয় বোলারদের নাকের পানি চোখের পানি এক করে ছেড়েছেন। এমন সব বলে চার-ছক্কা মেরেছেন যা কেউ কোনদিন কল্পনাও করেনি। সেই ম্যাচের পরই ভিলিয়ার্সের নাম হয়ে যায় মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি। যে কোন অবস্থায় যে কোন দিকে ঘুরে বল সীমানার বাইরে পাঠাতে পারেন বলেই এমন নাম দিয়েছেন ভক্তরা। অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বল, ব্ল্যাক হোলের বল কিংবা মাথার কয়েক ফুট ওপর দিয়ে যাওয়া বাউন্সারও লাফ দিয়ে বাউন্ডারি মারেন এবি। বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে করেছিলেন ৪৮২ রান।
তবে এত কিছুর পরও, ক্রিকেট পন্ডিতদের কাছে এবি ডি ভিলিয়ার্সের সেরা ইনিংসগুলোর একটি হলো ২০১২ সালে অ্যাডিলেড টেস্টের ৩৩ রানের ইনিংসটি। অবাক হলে নিশ্চয়! এত বড় বড় ইনিংস যিনি খেলেছেন তার ৩৩ রানের ইনিংস কেন সেরা হবে, তাও আবার টেস্টে? টেস্টে তো ভুরিভুরি সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি হয়। এবিরও আছে দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি আর ২১টি টেস্ট ও ২৫টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি। তাহলে শোন সেই গল্প।
অ্যাডিলেডে মাইকেল ক্লার্কের স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ৪৩০ রানের টার্গেট দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে এত বড় টার্গেট তাড়া করে জেতা সম্ভব নয়, কেউ পারেওনি কোনদিন। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে সুযোগ ছিলো বাকি ১৫০ ওভার ব্যাট করে ম্যাচ ড্র করার; কিন্তু ২১ ওভারে ৪৫ রান তুলতেই তারা হারিয়ে ফেলে ৪ উইকেট। নিশ্চিত পরাজয় যখন চোখ রাঙাচ্ছে তখন ক্রিজে এলেন এবি। ম্যাচ বাঁচাতে হলে খেলতে হবে আরো ১২৫ ওভার, হাতে আছে ৬ উইকেট। পণ করেছিলেন যে করেই হোক ম্যাচ ড্র করবেন। মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন ক্রিজে। ৩৩ রান করেছেন ২২০টি বল খেলে। বলের চেয়ে যিনি রান বেশি করেন সেই ভিলিয়ার্সের নামের পাশে এমন ইনিংস দেখলে আশ্চর্য লাগাটাই স্বাভাবিক। দলের প্রয়োজনেই নিজের খেলার ধরন ভুলে গিয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাট করেছেন। যার কারণে ম্যাচটা ড্র করতে পেরেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। আর পার্থে পরের টেস্টেই ১৬৯ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছেন ম্যাচ ও সিরিজ।
ভিলিয়ার্স এমনই। যার কাছে দলের প্রয়োজনটাই সবচেয়ে বড় কথা। ২০১০ সালে আবুধাবি টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৭৮ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় ইনিংস ঘোষণা করেছেন। ইচ্ছে করলেই দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করার জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন; কিন্তু তার কাছে দলের প্রয়োজনটাই বড় মনে হয়েছে।
২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষ টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ভিলিয়ার্সের। সেঞ্চুরিয়ানে সিরিজের শেষ টেস্টের দুই ইনিংসে ৯২ ও ১০৯ রান করে নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ দেন। পারফরম্যান্সের জোরেই ১১ বছরে টানা ৯৮টি টেস্ট খেলে গড়েন নতুন এক বিশ্বরেকর্ড। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ওয়ানডে সিরিজ খেলেই সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য ছুটে যান দেশে। নইলে অভিষেকের পর টানা একশো টেস্ট খেলার রেকর্ডটাও হতো তার।
টেস্টের ৭৯তম ইনিংসে প্রথম শূন্য রানে আউট হন এবি। তিনি এমন একজন ব্যাটসম্যান যার কোন দুর্বল দিক নেই। তার অভিধানে নাই অফ ফর্ম নামক কোন শব্দ। যখনই মাঠে নামেন দলের জন্য অবদান রাখেন। উইকেট কিপিং করেছেন দীর্ঘদিন। দলের প্রয়োজনে টুকটাক বোলিংও করেছেন। আবার ফিল্ডার হিসেবেও দক্ষিণ আফ্রিকা দলে জন্টি রোডসের যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। মোটকথা, নিজের সবটুকু দিয়ে দলের জন্য লড়াই করার একটি বিরল প্রতিভা এবি ডি ভিলিয়ার্স। ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
টি-টোয়েন্টিতেও এবি ডি ভিলিয়ার্সের তান্ডব দেখেছে বিশ্ববাসী। আইপিএলে অনেক বছর ধরেই খেলছেন। সিপিএল, বিগব্যাশেও নিয়মিত দেখা যায় তাকে। যে কোন বোলারের কাছে সেখানেও তিনি সাক্ষাৎ আতঙ্ক। আইপিএলে তিনটি সেঞ্চুরি আছে। ২০১৬ আসরে অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে দলকে জেতানোর পর রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর অধিনায়ক বিরাট কোহলি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানকে এই তর্কের অবসান আজকেই হলো। পুরো বিশ্ব দেখেছে এবিই সেরা। এ ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না।’
তবে ২০১৫ সালের পর থেকে ইনজুরির কারণে সময়টা ভালো যাচ্ছে না এই তারকা ক্রিকেটারের। দুই বছর পর টেস্ট খেলেছেন গত ডিসেম্বরে। ওয়ানডেতেও নিয়মিত হতে পারেননি। ইনজুরির কারণে ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছেন অধিনায়কত্ব। এই সময়টাতে অন্য সেরা ব্যাটসম্যানদের তুলনায় কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। এ বছর জানুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের সবগুলো ম্যাচ খেললেও শেষ টেস্টে চোট পেয়ে আবার ছিটকে গেছেন ওয়ানডে সিরিজ থেকে। ইনজুরি অনেক সময় কেড়ে না নিলে অনায়াসেই বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানের তকমাটা জুটে যেত তার নামের সাথে।
১৯৮৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় জন্ম নেয়া এই ক্রিকেটার ব্যক্তিগত জীবনে এক পুত্রসন্তানের জনক। ভিলিয়ার্সের বাবা ছিলেন পেশাদার রাগবি খেলোয়াড়। নিজেও ছোটবেলায় রাগবি, টেনিস, সাঁতারসহ অনেক খেলাধুলায় দক্ষ ছিলেন। ভালো গান গাইতে পারেন, বাজারে অডিও অ্যালবামও আছে তার। সব শেষে একটি মজার তথ্য দিই। ভিলিয়ার্সের জন্ম তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি, প্রথম শ্রেণি ম্যাচে অভিষেক ১৭ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ১৭ ডিসেম্বর। যে কারণেই হয়তো নিজের জার্সি নম্বর বেছে নিয়েছেন ১৭ সংখ্যাটিকে।

Share.

মন্তব্য করুন