জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে ইচ্ছুক আগামীর জীববিজ্ঞানী বন্ধুরা, দেখতে দেখতেই দেখ আবার কুয়াশার শাড়ি পরে, কানে শিশির দুল পরে এবং হাতে শীতল জাদুর কাঠি দিয়ে প্রকৃতির দুয়ারে কড়া নাড়লো শীতের পরী। শীতের পরীর শীতল জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় প্রকৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে সিক্ততা, ঝড়, বৃষ্টি, কাদামাটি, গরমের দাপট, শরতের কাশফুল, হেমন্তের সোনালি রূপ ও শেষ দিকের ধূসর প্রান্তর। হাজির হয়েছে নানা বর্ণের ফুল ও ফল, টাটকা রঙিন শাক-সবজি, নকশা ভরা রকমারি পিঠা, বরফ শীতল খেজুর রস গুড় পায়েস, বর্ণিল নানা প্রজাতির অতিথি পাখি, সবুজের উঁকি দেয়া, কম পানিতে মাছের ঝাঁক, হাড় কাঁপানো শীত, শুষ্কতা ও শীতের ফসল।

তোমাদের অনেকেরই মনে পড়বে শীতের ফসল গম ক্ষেতে ভোর না হতেই গরম কাপড় পরে উপস্থিত হয়ে শালিক তাড়ানোর কথা। মনে পড়বে শেষ বিকেলে ক্ষেত থেকে মশুর কালাই বা ছোলার গাছ তুলে খড়কুটো দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ছাইয়ে ফুঁ দিয়ে মশুর কালাই বা ছোলা কুড়িয়ে খাবার কথা। ময়লা মুখে বাড়ি ফেরার কথা। ভোরবেলা মিষ্টি রোদ পোহাতে পোহাতে পাটালি বা নরম গুড় দিয়ে মুড়ি খাওয়ার কথা। শরষে ফুল তুলে নিয়ে এসে মরিচ দিয়ে ডলে সেটা দিয়ে এবং ইছামাছের গুঁড়া দিয়ে বাসি বা কড়কড়া ভাত খাওয়ার কথা। খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ভোরবেলা বা সন্ধ্যাবেলা শীত নিবারণের কথা। ঠা-া খেজুর রস খেয়ে মাড়ি কাঁপানোর কথা। এগুলো শুধু তোমাদের মনেই পড়বে না, শীতের সময় এলে এখনো তোমাদের কেউ না কেউ এগুলো করোও। তবে আমরা যারা বড় হয়েছি তাঁদের কাছে এ বিষয় আশয়গুলো স্মৃতিই বলতে হবে।
যা হোক বন্ধুরা এই শীতের পরী শুধু শীতের রঙ রূপই হাজির করে না বরং হাজির করে নিদ্রা দানবকে। যে নিদ্রা দানবের মাধ্যমে প্রাণিজগতের অনেক প্রাণীকে সারা শীতকাল জুড়েই ঘুম পাড়িয়ে দেয় তথা নিষ্ক্রিয় করে দেয়। শীত পরীর প্রভাবে প্রাণীদের শীতকালে এই নিদ্রা যাওয়াকে বা নিষ্ক্রিয়তাকে শীত নিদ্রা বা হাইবারনেশন (Hibernation) বলে। আবার গ্রীষ্মকালেও অনেক প্রাণী গ্রীষ্মকালের কিছু সময় বা সারাটা গ্রীষ্মকালই ঘুম পেড়ে বা নিষ্ক্রিয় জীবন যাপন করে থাকে। একে গ্রীষ্মনিদ্রা বা অ্যাসটিভেশন(Aestivation) বলে। কিছু কিছু প্রাণীর এই গ্রীষ্মনিদ্রা যাওয়ার শুরুটাও হয় শীতের শেষ দিকে বা শীতকালে।
ছোট বন্ধুরা! সাধারণত শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীরা শীতকালে ঘুম ঠিক নয় অনেকটা নিষ্ক্রিয়ভাবে জীবন যাপন করে থাকে। প্রাণীদের শীতকালে এই নিষ্ক্রিয়ভাবে জীবন যাপন করাকেই শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন বলে। আবার একইভাবে প্রাণীদের গ্রীষ্মকালে নিষ্ক্রিয়ভাবে জীবন যাপন করাকে গ্রীষ্মনিদ্রা বা অ্যাসটিভেশন বলে।
তোমরা জান কিনা জানি না শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে অর্থাৎ ওঠানামা করে। এসব কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে সেই শীতল অঞ্চল থেকে তারা চলে গিয়ে তুলনামূলক গরম স্থানে নিষ্ক্রিয়ভাবে থাকে। একইভাবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি বৃদ্ধি পেলে ও প্রতিকূল পরিবেশ এলে এসব প্রাণী তুলনামূলক কম গরম স্থানে চলে যায় এবং সেখানে নিষ্ক্রিয়ভাবে জীবন যাপন করে। তবে এসব প্রাণীর নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যাবার পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ দু’টি হলো- প্রতিকূল পরিবেশ ও তীব্র খাদ্য সঙ্কট।
নিষ্ক্রিয়ভাবে থাকার সময় এরা বাইরে থেকে কোনো রকম খাদ্য গ্রহণ করে না। দেহের ভেতর জমাকৃত স্নেহপদার্থ থেকে যে শক্তি আসে তাই দিয়ে তারা বাঁচে। এ সময় এরা হৃদস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস এবং বিপাকীয় কার্যাবলি যারপরনাই কমিয়ে দেয়। নড়ন চড়ন তো দূরের কথা একেবারে নিথর অনড় হয়ে পড়ে। মনে হবে এরা মৃত। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ফিরে এলে এরা ঠিকই আবার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে আসে। শীতের সময় যারা এই শীতনিদ্রা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটির নাম বলছি- এই যেমন ধর- কুনোব্যাঙ, সাপ, কচ্ছপ, পর্বত মূষিক, বাদুর, গাটার সাপ, সজারু, ভল্লুক, কাঠ ব্যাঙ, কিছু হাঙ্গর, আটলান্টিক কড মাছ, অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে রানী মৌমাছি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আবার গ্রীষ্মনিদ্রা যারা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো- উভচর শামুক, স্থলজ শামুক, বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ, কিছু কাঁকড়া, বায়ুতে শ্বাস নেয়া শিং, মাগুর, বাইম মাছ, কুচিয়া, সরীসৃপদের মধ্যে কিছু কুমির, স্তন্যপায়ীদের মধ্যে লেমুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তথ্যের বাক্স আমার প্রিয় বন্ধুরা তোমাদের একটি তথ্য দেই- আর তা হলো এই বিশাল প্রাণী জগতের মধ্যে আমরা মাত্র ০.০১ শতাংশ প্রাণী আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি বাকি ৯৯.৯৯ শতাংশ প্রাণী প্রজাতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। এর অর্থ দাঁড়ায় আমরা মানুষেরা এই বিশাল প্রাণিজগৎ সম্পর্কে বলতে গেলে এখনো কিছুই জানি না। তাহলে আরো কত রকম প্রাণী শীতনিদ্রা বা গ্রীষ্মনিদ্রা যায় তার কোন সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে উপরে যে সমস্ত প্রাণীর নাম উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে শীতনিদ্রা যায় এমন একটি প্রাণী যেমন কুনোব্যাঙ এবং গ্রীষ্মনিদ্রা যায় এমন একটি প্রাণী যেমন আপেল শামুক সম্পর্কে নিচে কিছু কথা বলেই আজকের লেখাটি শেষ করবো।
কুনোব্যাঙ
তোমরা অনেকেই পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী এই মেরুদ-ী কুনোব্যাঙকে চেনো। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Bufo melanostictus. সম্প্রতি এই নাম পরিবর্তন হয়ে Duttaphrynus melanostictus এই নামে সারা বিশ্বের মানুষ কুনোব্যাঙকে চেনে। তবে এর ইংরেজি নাম হলো Asian Common Toad. এই ব্যাঙটি সারা শীতকাল জুড়েই শীতনিদ্রায় থাকে বা নিষ্ক্রিয় থাকে। এরা অনেকটা নিশাচর স্বভাবের। অর্থাৎ দিনের বেলা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ফাঁক-ফোকরে লুকিয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে খাবারের সন্ধানে বের হয়।

চিত্র: কুনোব্যাঙ চিত্র : হাতের আঙুলের ওপর কুনোব্যাঙ

এরা জীবন্ত ক্ষতিকর বা অপকারী কীটপতঙ্গসহ ছোট ছোট শামুক খায়। এদের গায়ে আঁচিলের মতো ছোট ছোট অনেক দাগ থাকে। এরা শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী হওয়ায় পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে দেহের তাপমাত্রা ওঠানামা করে। তাই শীতকালে এদের বাইরে দেখা যায় না। এরা মাটির গর্তে, গাছের কোটরসহ নানা ফাঁক-ফোকরে শীতনিদ্রা বা নিষ্ক্রিয় জীবন যাপন করে। এ সময় এরা কোন রকম খাদ্য গ্রহণ করে না। তাই বাইরে আসার প্রয়োজন হয় না। দেহের সঞ্চিত স্নেহপদার্থ থেকে এরা শক্তি পায়। শীতনিদ্রার সময় এই ব্যাঙটির অল্প পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়। সেটা তার দেহের সঞ্চিত স্নেহপদার্থই পূরণ করে থাকে। যখন শীতনিদ্রার সময় আসবে তার আগে থেকেই কুনোব্যাঙ প্রস্তুতি নিতে থাকে। অর্থাৎ তার আগে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। যার জন্য দেহে অনেক স্নেহপদার্থ জমা হয়। যা শীতনিদ্রার সময় কাজে লাগায়। এ সময় এদের বিপাকক্রিয়া, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নড়াচড়া একেবারেই কমিয়ে দিয়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকে। যখন আবার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তখন কুনোব্যাঙ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। অর্থাৎ নিদ্রা বা ঘুম ভেঙে যায়। খাওয়া দাওয়া ও নড়াচড়া শুরু করে আগের মত। বিপাকীয় ক্রিয়া, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়।

আপেল শামুক
দেখতে বড় আপেলের মত মনে হয় বলে এই শামুকটিকে আপেল শামুক বলে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির তথা বিভিন্ন ধরনের শামুক থাকলেও শামুক বলতে বেশি শিক্ষিত মানুষ ছাড়া এই আপেল শামুককেই বুঝে থাকি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pila globosa সারা বিশ্বর মানুষ একে এই নামে চেনে। এর ইংরেজি নাম Apple Snail.

চিত্র: আপেল শামুক চিত্র: বস্তার ভেতর আপেল শামুক

আপেল শামুক হলো প্রায় গোলাকার সাড়ে ছয়টি প্যাঁচ বিশিষ্ট খোলক, মুখে অপারকুলাম বা ঢাকনা ও মাংসল পা যুক্ত অবিভক্ত উভচর অমেরুদন্ডী প্রাণী যারা পানিতে বসবাসের সময় ফুলকার সাহায্যে এবং ডাঙায় বসবাসের সময় ফুসফুসীয় থলির সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়।
একটি পূর্ণ বয়স্ক আপেল শামুক ২২-৭৪ মিলিমিটার লম্বা এবং প্রস্থে ২৫-৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। আপেল শামুক মিঠাপানি বা স্বাদুপানির শামুক। এরা পুকুর, ডোবা, হাওর-বাঁওড়, বিল, ঝিল, নদী-নালা, ধানক্ষেত ইত্যাদি স্থানে বসবাস করে। এরা সাধারণত পানিতে থাকে। তবে পানিতে পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকলে এবং ডিম পাড়ার জন্য সবুজ ঘাসের ওপর উঠে আসে। এ জন্য এদের উভচর শামুক বলে। এরা সবুজ ঘাসের ভেতর মুক্তার দানার মতো ধবধবে সাদা থোকা থোকা ডিম পাড়ে।
এই শামুকটি গ্রীষ্মনিদ্রা যায় অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে ঘুমায়। কিন্তু তাদের এই ঘুমও শুরু হয় শীতের শেষ ভাগে। এ সময় যখন পানি কমে যেতে থাকে এবং যখন শুকিয়ে যায় ও তাপমাত্রাও ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন এরা গ্রীষ্মনিদ্রার জন্য ১-২ ফুট সর্বোচ্চ ৪ ফুট মাটির নিচে চলে যায়। প্রতিকূল এই পরিবেশে গ্রীষ্মকালটা এরা মাটির নিচেই ঘুম পেড়ে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় থেকে কাটিয়ে দেয়। এদের গ্রীষ্মনিদ্রার সময়কাল ৪-৫ মাস। সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসের দিকে বৃষ্টিপাত শুরু হলে এবং তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হলে এদের ঘুম ভেঙে যায়। অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়তা ছেড়ে মাটির ওপরে উঠে আসে এবং স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে থাকে। গ্রীষ্মনিদ্রার সময় এরা কুনোব্যাঙের মতো কোন খাবার গ্রহণ করে না, চলাফেরা করে না। হৃদস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাস থাকে না বললেই চলে। একবারে নিথর নীরব। মনে হবে এরা মৃত। এটিই আপেল শামুকের গ্রীষ্মনিদ্রা।
ছোট বন্ধুরা! আমি যখন ছোট ছিলাম তখন শামুকের গ্রীষ্মনিদ্রার সময় লোহার সরু দ- মাটির ভেতর ঢুকিয়ে দিতাম। খ্যাচ করে শব্দ হলেই মাটি খুঁড়ে এই শামুকগুলো সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসতাম। মা দেখে যারপরনাই খুশি হতেন। কারণ মা এগুলোকে ভেঙে বাড়ির হাঁস-মুরগিকে খেতে দিতেন। এটি হাঁস-মুরগির জন্য খুবই পুষ্টিকর খাবার।
বন্ধুরা জানা হলো প্রাণিজগতের দুটি প্রাণীর নিষ্ক্রিয় অবস্থা সম্পর্কে, যা শীত এবং শীতের শেষে শুরু হয়ে থাকে। মনে হয় শীতের পরী তার শীতল কাঠি দিয়ে ঠোকা দিয়ে এদের ঘুম পাড়িয়ে দেয় বা নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
আসলে সোনামণিরা প্রকৃতির কোন প্রাণী কিভাবে বাঁচবে, বেঁচে থাকবে সেই জ্ঞান সেই প্রাণীর মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। যাতে করে তাদের বেঁচে থাকাটা হয় সহজ ও সুন্দর। তাই মহান আল্লাহকে ভালোভাবে জানতে গেলে বা বুঝতে গেলে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বুঝতে হবে বা জানতে হবে তার তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টিকে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে এসব প্রাণীকে জানতে গেলে তোমাদের হয়ে উঠতে হবে বিজ্ঞানী। তোমরা তাই হও এবং হবে ইনশাআল্লাহ।

Share.

মন্তব্য করুন