কলিমদ্দির ছেলেরা সলিমদ্দিই হয়। ব্যতিক্রমও হয়, তবে রেয়ার। রেয়ার ঘটনাই ঘটেছে সাঁতারকুলে। কলিমদ্দির ছেলে সলিমদ্দি না হয়ে এখন মিস্টার সেলিম হয়েছে।
হ্যাবলা, কেবলা, পচা, গদা, মনা, রইস্যাদের সাথে ময়লা কাগজ কুড়াতে যায় না সে। তার বন্ধুত্ব জুয়েল ও রিপনের সাথে। খাবার তিন বেলার পরিবর্তে এক বেলা খেলেও দুঃখ নেই। তার চাহিদা টিপটপ জামাকাপড়। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া তেমন ব্যয়বহুল নয়। তবু পিতা চেয়েছিল ময়লা কাগজ, লাকড়ি ও ঘুটে কুড়িয়ে সংসার চালাতে সাহায্য করুক সলিমদ্দি। লেখাপড়া শিখে জজ ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখা তাদের জন্য বোকামি।
শহরের ফুটপাথে এক ক্যানভাসারের মুখে শোনা চটি কবিতার দুটি লাইন সব সময় স্মরণ করে কলিমদ্দি।
লেখে পড়ে ধনীর ছেলে গরিবেরা খেত নিড়ায়।
কোথায় পাইবা খাতা কলম, কোথায় পাইবা বই?
কিন্তু সলিমদ্দির মনে গেঁথে গিয়েছিল কবিতার পরবর্তী লাইন দুটি।
বই পুস্তকের দরকার নাইকো, হাত ঘুরাইবো তালপাতায়।
বড় হইলে বই কিনিব বাঁচাইলে আল্লায়।
তাই সে তার পিতাকে বলে,
– তোমাদের খুব বেশি অসুবিধা হলে রাত দশটা থেকে ২টা পর্যন্ত সংসারের কাজ করব কিন্তু আমার রুটিনের ব্যতিক্রম করা যাবে না।
তার দৈনন্দিন রুটিন কোনো সলিমদ্দির রুটিন নয়। ধনীর আদুরে দুলালরাই এমন রুটিন মেনে চলে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুল, দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত বিশ্রাম, বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলাধুলা, সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত লেখাপড়া। রাত দশটা থেকে সকাল পাঁচটা পর্যন্ত ঘুম।
ছেলের সুন্দর রুটিন মেনে নেয় বাবা-মা। নিতান্ত অপারগ না হলে ফুটফরমাশ দেয় না।
– কাইল ছুটির দিন তোমার একটা কাম করণ লাগবো বাজান। খেতের কিছু ডাঁটা শাক তুইলা বাজারে লইয়া যাইবা।
– না বাবা, অন্য কাজ থাকলে বল। হাটবাজারে বেচা-কেনার কাজ আমার দ্বারা হবে না।
– বাজান, শাক-সবজি, তয়তরকারির যা দাম। খেত ভইরা রইছে। কিছু তুইলা পাতলা কইরা দেওন লাগব।
এইগুলা কি গরুরে খাওয়ামু? বেচলে কিছু টাকা পামু।
– তবে এক কাজ কর। আজ রাতেই তুলে আঁটি বেঁধে রাখ। আমি খুব সকালে নিয়ে বের হয়ে যাব। অন্য বাজারে নিয়ে বেচবো।
এভাবেই সলিমদ্দি সাহায্য করে সাংসারিক কাজে। একদিন এক মোরগ বিক্রি করতে যেয়ে পড়ে মহা ফ্যাসাদে। ঈদের বাজারে বিক্রির জন্য যতেœর সাথে পুষেছিল মোরগটি তার মা। রুবেল ও মামুনের দৃষ্টি ফাঁকি দেয়ার জন্য অনেক দূরের এক বাজারে নিয়ে গিয়েছিল মোরগটি। কিন্তু কে জানত, অঙ্ক স্যারের বাসা সেখানে? আর ঠিক ঐ সময়ই তিনি বাজার করতে আসবেন? বাজার করবেন ভালো কথা, তাই বলে সলিমদ্দির মোরগ কিনার সখ জাগবে কেন? স্যারকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই ঠ্যাং বাঁধা মোরগটা মাটিতে রেখে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায় সে। স্যার এসেই ঠ্যাং ধরে ওজন ও আঙুলে সিনা টিপে গোশতের মান পরীক্ষা করতে থাকেন। মোরগটিও তারস্বরে কক কক করে ডাকতে থাকে।
শুধু মোরগ ডাকলে ক্ষতি ছিল না। স্যারও ডাকতে থাকেন:
– এই মোরগ, এই মোরগ।
পাশের লাউ বিক্রেতাও সাথে সাথে ডাক শুরু করে:
– এই মোরগওয়ালা, গেলি কই? কাস্টমার চিল্লাইতাছে?
লাউওয়ালা কি আর জানে, কাস্টমার সলিমদ্দির অঙ্ক স্যার? আর সম্ভব হয় না স্যারের দৃষ্টি ফাঁকি দেয়া। লজ্জায় লাল হয়ে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কাছে এসে দাঁড়ায় সে। স্যারও তার লজ্জা টের পেয়ে আপাতত মোরগ কেনার খায়েশ ত্যাগ করে অন্য পথ ধরেন।
পাশের লাউওয়ালা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে:
– এই বোধাই, স্যারেরে মুরগিডা দিলি না ক্যান? বেয়াদব কোন ডাইকার?
– সলিমদ্দি কোন জবাব না দিয়ে অন্য কাস্টমারের অপেক্ষায় থাকে।
সলিমদ্দির আরো একটি ভাই ও একটি বোন আছে। তারা অন্যান্য দিন মজুরের সন্তানের মতোই টোকাইমার্কা জীবন যাপন করে। সলিমদ্দিন তাদেরকে বলে দিয়েছে:
– বাড়িতে এলে যত পারিস কোলে চড়িস। রাস্তাঘাটে কখনো ভাইয়া বলে ডাকবি না। সামনে পড়লে কেটে পড়বি।
পিতাকে ও বলে দিয়েছে, যতই দরকার পড়–ক পথে ঘাটে যেন নাম ধরে না ডাকে। খোঁজ নেয়ার জন্য যেন কখনো স্কুলে না যায়। তাই বলে, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভাই বোনদের প্রতি স্নেহ মমতার কোনো অভাব নেই তার। সতর্কতার সাথে অনেক কাজ করে দেয় সংসারের।
একদিন মা বলেন:
হুনছি নয়া ধান মলন দিছে তোর নানা। এক বস্তা ধান লইয়া আয়। তোর বাবার আত একদম খালি। কিছু পিডা-লাডা বানায়া খিচুড়ি রাইন্দা ঈদের দিনডা চালায়া দেওন যাইব।
– ঠিক আছে মা, তয় রাত এগারোটার পর। নইলে ধানের বস্তা মাথায় নিয়া মাসুদ আর জাকিরের সামনে পড়লে প্রেস্টিজ পাঙচার।
পিতা-মাতা, ভাই-বোন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চলে। বন্ধুবান্ধবের সামনে তাকে লজ্জায় ফেলতে চায় না। নিজেকেও অনেক সতর্কতার সাথে চলতে হয়।
একদিন এক বন্ধুর সাথে বৈকালিক ভ্রমণে হাঁটতে হাঁটতে পাশের গ্রামে গিয়েছিল। ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছিল দুই বন্ধু। মানুষ কেন সিগারেট খায়, কি মজা পায় তাতে, একটু টেস্ট করার জন্য সখ করে সিগারেট টানছিল আর গল্প করছিল দু’জন।
– এই সেলিম ঐ কামলাটাকে চিনিস?
আকস্মিক প্রশ্নে সে চমকে ওঠে। তারপর সামলে নিয়ে বলে:
– হ্যাঁ চিনিতো। তুইও চিনিস নাকি?
– আমি চিনি না। তবে লোকটা আমাকে চিনে। একদিন তোর সম্পর্কে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। তোদের কোনো আত্মীয়-টাত্মীয় নাকি?
– হতে পারে। আমি আবার আত্মীয়স্বজনের খবর একটু কম রাখি।
– তুই খুব ভাগ্যবান।
– কেন? ঐ গরিব লোকটার আত্মীয় বলে?
– আরে না। লোকটা কথায় কথায় তোর জন্য দোয়া করছিল। হুজুরের কাছে শোনেছি, গরিব লোকের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
– শুধু গরিবের দোয়ার কথা শোনেছিস? আর কিছু শোনছ নাই?
– হ্যাঁ, শুনেছি। মা-বাবার দোয়াও কবুল হয়।
– তাহলে আমি ডাবল ভাগ্যবান।
– তার মানে?
– আমার মা-বাবাও আমার জন্য দোয়া করে। আবার ঐ গরিব লোকটাও করে। সুতরাং আমি ডাবল দোয়া পাচ্ছি।
– এই সেলিম, দেখ, লোকটা বিড়ি টানছে। এসব বিড়ি খুব বাজে জিনিস। একটা সিগারেট দিয়ে আয়।
– তোর যখন খুব দরদ লাগতেছে, তুইই দিয়ে আয়। না, থাক। প্যাকেটটা দে। আমিই দিয়ে আসি। তুই আবার কোনো ফ্যাসাদে ফেলিস।
– কিসের ফ্যাসাদ?
– তুই বুঝবি না, প্যাকেটটা দে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি যাব আর আসব।
তার বাবা কলিমদ্দি আরও কয়জন কামলার সাথে খেতে ধানের রোপা বুনছে। সে পাশে যেয়ে বলে:
– বাবা বিড়ি ফালাও। এই সিগারেট খাও। আমি চললাম। পেছন থেকে আবার ডাকাডাকি করো না। ফিরে আসার পর বন্ধু বলে:
– কিরে, আস্ত প্যাকেটটাই দিয়ে দিলি?
– দান যখন করবি, ভালো করেই কর। সেতো আমাদের কাছে ভিক্ষা চায়নি।
— সিগারেট দান করলে কি কোন সওয়াব হয়?
– অত ফতুয়ার কিতাব এখনো পড়ি নাই। এটুকু জানি, কারো ব্যবহারে কেউ খুশি হলেই সওয়াব হয়। মানুষকে খুশি করলে আল্লাহও খুশি হন।
কলিমদ্দি কাঁঠালদিয়ায় একখ- ধানের জমি বর্গা চাষ করছিল। খুব ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু ধান পাকার সময় হঠাৎ জোয়ারের পানি এসে খেত তলিয়ে ফেলে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ধান কেটে আঁটি বেঁধে পানির ওপর ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু বাড়ি নিতে পারে না। বিকেলের দিকে শরীরে প্রচ- জ্বর দেখা দেয়। সারা রাত বিছানায় ছটফট করে আর ভাবে, জ্বর না সারলে ধানগুলোর কী উপায় হবে? সকালবেলা কোমরে গামছা বেঁধে অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বের হয় কলিমদ্দি। স্ত্রী সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।
– এই জ্বর লইয়া পানিত নামবা? মরবার চাও নাকি?
– কী করমু? শেষমেশ পাকা ধানগুলা খোয়ামু?
– সলিমদ্দিরে একটু ডাহি?
– দরকার নাই। আমগো কই মাছের প্রাণ। সহজে বাইর অইব না। জ্বর না হয় একটু বাড়বো। আগে ধান ঘরে তুলি।
পরে সপ্তাহ খানেক হুইয়া থাকলেও ক্ষতি নাই।
ঘর থেকে বের হয়ে একটু পরেই ফিরে আসে কলিমদ্দি। স্ত্রী জিজ্ঞেস করে:
– ফিরা আইলা যে? শরীর খুব বেশি খারাপ লাগতাছে?
– বাড়িতে জিন-ভূতের আছর লাগছে।
– কী সব আবোল তাবোল কথা কইতাছ ?
– আমগাছের তলে ধানের আডির স্তূপ। দেইহা মনে অইতাছে আমার খেতের ধান। এইগুলো এহানে আইল কেমনে?
স্বামী স্ত্রী দু’জন এক সাথে দৌড় দেয় আমগাছ তলার দিকে। ঘটনা খুবই ভৌতিক মনে হয় তাদের কাছে। জিন ভূতের অনেক গল্প কাহিনী শুনে থাকলেও বাস্তবে কিছু দেখেনি কখনো।
মা ছুটে যায় তার শিক্ষিত ছেলে সলিমদ্দির ঘরে।
– এই ছইল্যা। উড, দেখ কিসব জিন ভূতের কা-। খেতের ধান ভূতে বাড়িতে দিয়া গেছে।
– আহ্ মা, এখন বিরক্ত কর না ভূতেরা ধানের আঁটি টেনে টায়ার্ড হয়ে এখন ঘুমাইতেছে।
– পাগলের মত কী কইতাছস?
– টিভিতে দেখো নাই, কৃষিবিদ ও টিভি উপস্থাপক শাইখ সিরাজ ঢাকা শহর থেকে কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের গ্রামে নিয়ে খেত খামারের ধান চাষ করায়। আমিও আমার ক্লাসের ছাত্রদের বললাম, চল, আজ একজন অসুস্থ গরিব কৃষকের খেতের ধানগুলা বাড়িতে দিয়া আসি। বন্ধুরা রাজি হয়ে গেল। দুঃখ হলো, এই খবর টিভিতে দেখাবে না।
সলিমদ্দির কৃষি কার্যক্রম টিভিতে না দেখালেও মি. সেলিমের খবর প্রচারিত হয় প্রায়ই।
মিস্টার সেলিম এখনও ছাত্র, কিন্তু এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। ছাত্র অবস্থায়ই তার উপার্জন হাজার হাজার টাকা। টিভির পর্দায় তাকে দেখে করতালি দেয় হাজার হাজার দর্শক। সেলিম নিজেও ভাবেনি, সে এমন ভাগ্যবান ও সুনামের অধিকারী হতে পারবে।
ঠিকমত চাঁদা দিতে পারত না বলে বন্ধুরা তাকে খেলায় নিত না। অনেক অনুনয় বিনয় করে খেলার সুযোগ পেলেও এমন জায়গায় তাকে খেলতে দিত, যেখানে অন্য কেউ খেলতে চায় না। অর্থাৎ সে হতো গোলকিপার।
ছোটকালে বল খেলায় জয়ের চেয়ে লাথি মারার আনন্দই ছিল বেশি। যে যত লাথি মারতে পারবে, সে তত ভাগ্যবান খেলোয়াড়। ফুটবল মানে পায়ের বল। হাত দিয়ে ধরা গুনায়ে কবিরা। হাত লাগলেই ‘হ্যান্ড বল’ শাস্তি। সেই বলই হাত দিয়ে ধরার দায়িত্ব পায় সলিমদ্দি।
স্কুল মাঠের সেই খুদে গোলকিপার এখন জাতীয় দলের গোলকিপার মি. সেলিম। প্রতিটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তার আমন্ত্রণ। প্রতিপক্ষের পেলান্টি মোকাবেলা করে সে পেয়েছে একাধিক পুরস্কার। এখন সেলিমের বাড়ি হয়েছে। মায়ের পরনে শাড়ি গয়না। ভাই বোনেরা টোকাই থেকে আধুনিক স্মার্ট হয়েছে। কিন্তু বাবা কলিমদ্দি সেই কলিমদ্দিই রয়ে গেছে।
ছেলের দেয়া প্যান্ট শার্ট সে পরে না। গামছা লুঙ্গি পাঞ্জাবিই তার ভালো লাগে। দুধের গাভীটার দেখাশোনার জন্য যে চাকর রেখেছিল, কলিমদ্দি তাকে বিদায় করে দিয়েছে এবং বলেছে:
– এরকম দশটা গরু পোষার ক্ষমতা এখনো আমার আছে।
এখনো সে ধানের বস্তা মাথায় নিয়ে রাইছ মিলে যায়। কোমরে গামছা বেঁধে গরুর গোবর সাফ করে। সেলিম বিরক্ত হয়ে বলে:
– বাবা, তোমার একটু বুঝা উচিত, তুমি একজন ভদ্রলোকের বাবা।
কলিমদ্দি জবাব দেয়:
– খুব ভদ্দর লোক অইছস? তোরও বুঝা উচিত, তুই একটা চাষার পোলা।
– ঠিক বলেছ বাবা। তবে এই চাষার নেক দোয়ার বরকতেই আমি আজ ভদ্রলোক।
– শুধু দোয়ায় বরকত অয় নাই। তোর হরকতও কমনা। হরকতের জোরেই তুই চাষার পোলা খাসা ভদ্দরলোক।

Share.

মন্তব্য করুন