পূর্ব দিগন্তে ফুটন্ত সূর্যমুখী আলোক বিচ্ছুরণ ঘটাতে শুরু করেছে। আঁধারিয়া চাদর জড়ান শায়িত প্রকৃতি বিছানা ছাড়ছে যেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাজে নিমগ্ন হওয়ার উপযুক্ত সময়। রাখাল গরুর পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। দিনমজুর ধনীর গৃহপানে ছোটে কাজের সন্ধানে। সাদিক গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে আনমনে হাঁটছে। কাঁধে তার বইয়ের ব্যাগ। দুই কিলো পথ পাড়ি দিয়ে বাস ধরতে হবে। আতিক আর নয়ন পথেই তার সঙ্গী হয়। সহপাঠী ওরা। দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে প্রতিদিনের মত আজো তারা স্কুলে যাচ্ছে। এ জন্য কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়। সাদিক সদা প্রাণবন্ত এক কিশোর। কোন কষ্টই কষ্ট মনে হয় না তার। প্রায়শ পান্তা-মরিচ খেয়ে স্কুলের পথ ধরে। দুপুরের টিফিন কেবল এক গ্লাস পানি। এজন্য দুঃখবোধের পরিবর্তে বুকের জমিনে আছে মায়ের বপনকৃত একগুচ্ছ রঙিন স্বপ্ন। তার মায়ের স্বপ্ন হলো, মানুষের মত মানুষ হতে হবে। বড় হতে হবে মহত্ত্বের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে। যে আলোয় আলোকিত হবে চতুর্দিক। যথেষ্ট মনের মিল আতিক ও সাদিকের। রয়েছে কর্মেরও মিল। ওদের থেকে নয়ন ব্যতিক্রমী। রোজ রোজ কষ্ট করে স্কুলে যেতে তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে গ্রামের মাঠেঘাটে ঘোরাঘুরি করতে। কার বাগানে ফল পেকেছে, কোন গাছে পাখির ছানা ফুটল; এসব দেখতে তার চিত্ত সর্বদা তাড়িত হয়।
: “আর কত পরে গাড়ি আসবে?” নয়নের কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ে। তিন বন্ধু গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
: “কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই অধৈর্য হয়ে গেছ। গাড়িতে সিট না পেলে কী যে অবস্থা হবে তোমার!” বাঁকাস্বরে জবাব দেয় আতিক। নয়নের মুখটা কালো হয়ে যায়। সে বলে,
: “এই কষ্ট আর ভালো লাগে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। ঠিকমত খেলার সময়ও পাই না। গ্রামের স্কুলে পড়লেই তো হয়। কেন যে আব্বু দূরের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন!” আতিক কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাদিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
: “নয়ন, আমার আম্মুর থেকে একটি কথা শিখেছি। কিছু অর্জনের জন্য কিছু বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে অর্জনের মাত্রা। প্রকৃতিগত নিয়ম এটি। তুমিই বেছে নাও জীবনে কী হতে চাও। আর তেমনি প্রচেষ্টা চালাও।” নয়ন জবাবে কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারে না বাস এসে যাওয়ায়। পড়িমরি উঠতে হয় তাদের।
লোকভর্তি বাসে তিনজনের গেটের পাশে কোন রকমে ঠাঁই মেলে। পরবর্তী স্টপে এসে কয়েকজন নেমে যাওয়ায় কয়েকটা সিট খালি হয়ে যায়। ঝটপট বসে পড়ে তিন বন্ধু। বসতে না বসতে সাদিকের নজর পড়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধের প্রতি। বুকের কোথাও খোঁচা দিয়ে ওঠে। তার পক্ষে বসে থাকা সম্ভবপর হয় না। বৃদ্ধের হাত ধরে এনে বসিয়ে দেয় নিজের সিটে। এ সময় গাড়ির সুপারভাইজার সকলের থেকে ভাড়া উঠাচ্ছিল। বিষয়টি নজরে পড়লে তিনি মনে মনে বলে ওঠেন, ‘আরে, এইত সেই ছেলে, যাকে আমি খুঁজছি।’ সুপারভাইজারকে আসতে দেখে সাদিক পকেট থেকে টাকা বের করে। ভাড়া দিতে উদ্যত হয়। সাদিকের মেলানো হাত তার দিকেই ফিরিয়ে দিয়ে মৃদুহাস্যে তিনি বলেন,
: “রেখে দাও বাবা। তোমার ভাড়া পেয়ে গেছি।”
: “ভাড়া পেয়ে গেছেন? কে দিলো?” একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে হতে।
: “কেন, তুমিইতো গত পরশু দিন দিলে!” সাদিক একটু ভেবে নিয়ে বলে,
: “কই, নাতো! সেদিন নামার সময় সেদিনের ভাড়াটাই কেবল দিয়েছিলাম।”
: “তুমি ঠিকি বলেছ; ওই দিনের ভাড়াটাই দিয়েছিলে। আর আমি তোমার থেকে প্রতিদিনের ভাড়া নিয়েছিলাম। এখন থেকে এই গাড়িতে সেদিনের ভাড়াতেই যাতায়াত করবে।”
: “জগতের বিস্ময় ঠিকরে পড়ে সাদিকের চোখে মুখে। আতিক, নয়নসহ আশপাশের যাত্রীরাও অবাক হয়। একজন যাত্রী বলে ওঠেন,
: “কী এমন হলো যে আজীবনের টিকিট ধরিয়ে দিলেন, সুপারভাইজার?”
: “কত লোক আছে ভিড়ের মধ্যে ভাড়া না দিয়েই নেমে পড়ে। কিন্তু ওইদিন আমি যথাসময়ে ভাড়া নিতে না পারলেও ওই ছেলে নামার সময় নিজের থেকে ভাড়া দিয়ে গিয়েছিল। আবার আজ নিজের সিট ছেড়ে একজনকে বসতে দিয়েছে। এমন ছেলে খুব কম আছে। তাই ওর সামান্য পুরস্কার দিলাম।” তিনি জবাব দেন।
: “চাচু, গাড়ির মালিক আপনি নন। ইচ্ছে করলেই আপনি এমন করতে পারেন না। গাড়ির মালিকেরই পাওনা এই নির্ধারিত ভাড়া। এমনটি করতে যেয়ে আপনি নিজেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।” সাদিক বলে ওঠে।
: “আশ্চর্য ছেলে দেখছি! এমন ভাবনা তোমাকে কে শেখাল? এই যুগে এমন ভাবনার মানুষ কোথায়।”
: “কেন ভাববো না? আপনার মত মানুষ যেখানে আছে সেখানে এমন ভাবনার মানুষ না থাকাটাই অস্বাভাবিক।” সাদিক উত্তর দেয়। সুপারভাইজার লোকটি আরো একবার বিস্মিত হন। এইটুকু পিচ্চি ছেলে বলে কী! চৌদ্দ-পনেরো বয়স হবে হয়ত। তিনি বললেন,
: “এ নিয়ে তুমি চিন্তিত হয়ো না। গাড়ি আমার কন্টাকে নেয়া। ট্রিপপ্রতি নির্দিষ্ট টাকা মালিককে দিয়ে দিলেই হয়ে যায়। লস-লাভ সব আমার।” কী করবে ভেবে পায় না সাদিক। ইতোমধ্যে হেলপার হাঁক ছাড়ে,
: “কদমতলা! কদমতলা! নামার আছেন কেউ?” কদমতলা তাদের গন্তব্য স্থান। নেমে যায় তারা।
Share.